শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১১

সংবাদপত্র: আড়ম্বরের আসর

সাধারণত অল্প-শিক্ষিত, অর্দ্ধ-শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত ব্যক্তির হৃদয় ও মন নিয়ে সংবাদপত্র গঠিত।
    আজ থেকে ১০০ বছর আগে এ মন-ব্য করেছিলেন সেকালের সাহিত্যিক-গবেষক হারানচন্দ্র রক্ষিত (১৮৬৪-১৯২৬)। তিনি লিখেছিলেন, অনেকটা আড়ম্বর ও দোকানদারি করতে হয় সংবাদপত্রে। না করলে আসর জমে না। খদ্দের জমে না।
সংবাদপত্রের সঙ্গে হারানচন্দ্র রক্ষিত অবশ্য যুক্ত করেছিলেন থিয়েটার-কে। ১৩১৮ বঙ্গাব্দের আশ্বিনে প্রকাশিত “ভিক্টোরিয়া-যুগে বাঙ্গালা সাহিত্য” নামের গবেষণা-প্রবন্ধগ্রনে'র “সংবাদপত্র ও থিয়েটার” শীর্ষক প্রবন্ধে ওই মন-ব্য করেছিলেন তিনি। বিস্ময় ও বেদনার সঙ্গে বলতে হয়, এখনও এ ধরনের মন-ব্য কেউ এভাবে না লিখলেও বা প্রকাশ্যে না বললেও প্রকারান-রে প্রকাশ করেন নানাভাবে। আর তাঁদের সংখ্যা একেবারে কম নয়।
হারানচন্দ্র রক্ষিতের মন-ব্য অবশ্য পূর্বাপর সম্পূর্ণ উল্লেখের দাবি রাখে। নাহলে অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে বিষয়টি। তবে তিনি যেহেতু একালে প্রায় বিস্মৃত এক নাম তাই আগে তাঁর পরিচয় দেয়া আবশ্যক।
হারানচন্দ্র রক্ষিতের জন্ম ১৮৬৪ সালে, কলকাতার দক্ষিণে জয়নগরের মজিলপুর গ্রামে। কলেজের শিক্ষা পান নি তিনি, তবে তাঁর সাহিত্যস্পৃহা ছিল অদম্য, চর্চা ছিল অক্লান-। মাত্র ২৩ বছর বয়সে সাহিত্য ও সমালোচনামূলক পত্রিকা মাসিক কর্ণধার-এর প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক হিসেবে সাহিত্যজগতে প্রবেশ করেন তিনি। সচিত্র মাসিক পত্রিকা জন্মভূমি কেন্দ্রিক লেখকগোষ্ঠীর একজন হিসেবেই অবশ্য তাঁর পরিচিতি বেশি। বঙ্গবাসী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা যোগেন্দ্রচন্দ্র বসু (১৮৫৪-১৯০৫)-র অনুরোধ ও উপদেশে মেরি ল্যাম্ব (১৭৬৪-১৮৪৭) ও চার্লস ল্যাম্ব (১৭৭৫-১৮৩৪)-এর টেলস অভ শেক্সপিয়ার (১৮০৭) অবলম্বনে শেক্সপিয়ারের নাটকের কাহিনী গল্প-আকারে রচনা করেন হারানচন্দ্র রক্ষিত। এ রচনার কৃতিত্বে বিপুল খ্যাতি পান তিনি, সরকারও ‘রায়সাহেব’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন তাঁকে। এখানে তাঁর প্রকাশিত বইগুলোর একটি তালিকা দিচ্ছি, এতে একালের পাঠক-পাঠিকারা কিছুটা ধারণা নিতে পারবেন হারানচন্দ্র রক্ষিতের বহুমাত্রিক প্রতিভা সম্পর্কে -
প্রবন্ধ-গবেষণা: সাহিত্য সাধনা; বঙ্গসাহিত্যে বঙ্কিম; ভিক্টোরিয়া-যুগে বাঙ্গালা সাহিত্য; ফুলের বাগান; সংসার আশ্রম; রামকৃষ্ণ শানি- শতক।
 উপন্যাস: মোহিনী প্রতিমা (১৮৮৭); নিরাশ প্রণয় (১৮৮৮); প্রতিভা সুন্দরী (১৮৯৩); পদ্মিনী (১৮৯৪)। 
নাটক: বঙ্গের শেষ বীর; কামিনী ও কাঞ্চন; দুলালী (১৮৯২); পারিজাত মালা (১৮৯৭); মন্ত্রের সাধন বা রাণা প্রতাপ (১৮৯৯); চিত্রা ও গৌরী (১৯০০); জ্যোতির্ম্ময়ী বা নুরজাহান (১৯০০); রানী ভবানী (১৯০০); প্রতিভাময়ী (১৯০৪); ভক্তের ভগবান (১৯১৫)।  
অনুবাদ: কামিনী কাহওন; সেকসপীয়র (১-৪); হেমহার (১৮৯৫)।
“সংবাদপত্র ও থিয়েটার” প্রবন্ধটি লেখার একটি বিশেষ কারণ বইটিতে সঙ্কলিত আগের প্রবন্ধ “রবীন্দ্রনাথ”-এর শেষ দু’টি বাক্যে উল্ল্লেখ করেছেন হারানচন্দ্র রক্ষিত। লিখেছেন “থিয়েটার ও সংবাদপত্রের অবনতির সহিত দেশের কি অনিষ্ট হইতেছে,... সেই অপ্রিয় প্রসঙ্গের আলোচনায় বাধ্য হইলাম।”
এবার তাঁর উল্ল্লিখিত মন-ব্য দু’টির পূর্বাপর:
“বিলাতী সভ্যতার আলোকে যেমন আমরা অসংখ্য বস' লাভ করিয়াছি, তেমনই সংবাদপত্র ও থিয়েটার জিনিস দু’টিও পাইয়াছি। সাধারণ লোকশিক্ষার হিসাবে, এই দুইটি জিনিস অমোঘ বলশালী। যাহার প্রভাবে, এক দিনেই সমগ্র দেশ মাতিয়া উঠিতে পারে, তাহার শক্তি ও প্রভাব, বোধ হয় কেহ অস্বীকার করিবেন না। সাধারণতঃ, অল্প-শিক্ষিত, অর্দ্ধ-শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত ব্যক্তির হৃদয় ও মন লইয়া জিনিস দুইটি গঠিত।”
তবে তিনি মনে করেন, “অশিক্ষিতের উপভোগ্য বলিয়া যে সেই জিনিস সুশিক্ষিতেরও আদরণীয় হইবে না, এমন কোন অর্থ নাই। এই দেশে এবং প্রায় সকল দেশে এমন অনেক জিনিস আছে, যাহা পণ্ডিত ও মূর্খে সমান আগ্রহে উপভোগ করিতে পারে। এই সংবাদপত্র ও থিয়েটার হইতেও তাহা পারে।”
এরপর আসল কথাটা পাড়েন হারানচন্দ্র রক্ষিত, “তবে আসল কথাটা হইতেছে এই যে, সংবাদপত্র ও থিয়েটার জিনিসটা প্রধানতঃ সধংং বা ‘দল’ লইয়া পরিচালিত। দলের রুচি অনুযায়ী সাময়িক আন্দোলন, হুজুগ, সংস্কার ও নূতন প্রবর্ত্তন, - প্রধানতঃ এই লইয়াই ঐ দুইটি জিনিস চলিয়া থাকে। সুতরাং অনেকটা আড়ম্বর ও দোকানদারী ঐ জিনিস দুটায় করিতে হয়। না করিলে আসর জমে না, খরিদদার জুটে না।”
এবার তিনি ব্যক্ত করেন তাঁর অনুযোগের কারণ, “এ দেশের কথা দূরে যাউক, এই শিক্ষা-সভ্যতার পূর্ণ-আধিপত্যকালে, খাস ইংলণ্ড এবং আমেরিকায়ও ঐ অবস'া। তবে, সেখানে ঐ ব্যবসাদারীর সঙ্গে সঙ্গে, লোকহিতের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি থাকে, এখানে অনেক স'লেই তাহা নাই।... দুঃখের বিষয় এই যে, সাধারণের প্রতিনিধি স্বরূপ হইয়া আমাদের দেশের অধিকাংশ সংবাদপত্র ও থিয়েটার ক্রমেই বড় অবনতির দিকে যাইতেছে। কথাটা উল্টাইয়া বলিলে ইহাই বলা হয় যে, সাধারণ লোকের মতি-গতি ক্রমশই বড় নিম্নগামী হইতেছে। সংবাদপত্র ও থিয়েটার সমাজের দর্পণ-স্বরূপ; সাধারণের প্রতিবিম্ব অনেক সময় সেই দর্পণে প্রতিবিম্বিত হইয়া থাকে। একজন বিদেশী পর্য্যটক কোন দেশে উপনীত হইয়া যদি সর্ব্বাগ্রে সেই দেশের সংবাদপত্র পাঠ করেন এবং থিয়েটার দেখেন, তবে তিনি স্বল্পায়াসে সেই দেশের রীতি-নীতি, আচার-পদ্ধতি, শিক্ষা ও মনের গতি হৃদয়ঙ্গম করিতে পারেন। সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন-স-ম্ভ দেখিয়া যেমন সেই দেশের অভাব অনুযোগ উপলব্ধি হয়, সম্পাদকীয় মন-ব্য পাঠ করিয়াও তেমনি সে দেশের শিক্ষা-দীক্ষা, রুচি-প্রবৃত্তি এবং মানসিক গঠনও জানা গিয়া থাকে। পক্ষান-রে, থিয়েটার দেখিতে গিয়াও দেশের অবস'া কিছুটা বুঝা যায়। সাধারণ লোক কি চায়, কি ভালবাসে, কোন্‌ রসের বেশী ভক্ত, তাহা সেই দর্শক ও শ্রোতৃবৃন্দের মুখের তৎকালীন ভাব দেখিয়া জানা যায়।”
সংবাদপত্রের মতো থিয়েটারেরও যে লোকহিতের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি নেই তা লক্ষ্য করেছেন হারানচন্দ্র রক্ষিত। লিখেছেন, “... শ্রোতা ও দর্শকের মনের ভাব বুঝিয়া অধিকাংশ অভিনেতা ও অভিনেত্রী অভিনয় করিয়া থাকে। সাধারণতঃ ‘বাহবা’ই তাহাদের সম্বল; সমবেত দর্শক ও শ্রোতার তুষ্টি-সাধনই তাহাদের লক্ষ্য; আর রঙ্গমঞ্চের অধিকারী বা অধ্যক্ষের ইঙ্গিত-উপদেশ পালন করাই তাহাদের কার্য্য। তাহার বেশী তাহারা বড় একটা যায় না, - যাইতে পারে না।”
থিয়েটারের পাশাপাশি সংবাদপত্রের অবস'ার দিকে তাকিয়ে ১০০ বছর আগে অন্ধকার দেখেছিলেন হারানচন্দ্র রক্ষিত। বলেছিলেন, “বাঙ্গালী-জীবনে ধিক্কার জন্মে!”
এবার দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিতে হচ্ছে:
“যে সংবাদপত্র বিলাতে প্রবল রাজশক্তির পশ্চাদ্ধাবিত হয়; যে শক্তি সভ্যদেশের ‘চতুর্থ শক্তি’র  মধ্যে গণ্য; যে দেশের সংবাদপত্র-সম্পাদক সাধারণের প্রতিনিধি বলিয়া রাজার ন্যায় সম্মান পান, - তুলনা করাও দূরে থাক্‌, - সে দেশের ও সে জাতির ‘আদর্শে’র ধারণাও যেন আমাদের স্বপ্ন বলিয়া মনে হয়।... মুখসর্ব্বস্ব বাঙ্গালীর যা ধর্ম্ম , বাঙ্গালীর সংবাদপত্রেও ত তার ছায়া পড়িবে। স্বার্থত্যাগী ও সত্যসন্ধ হইতে না পারিলে সম্পাদকের আসন লওয়া বিড়ম্বনা মাত্র।... এখন ব্যক্তিগত কুৎসা ও গালাগালি, বৈরিতা ও দলাদলি, - কোন কোন কাগজের একমাত্র অঙ্গ। সাধারণ শিক্ষা ও লোকহিত কিরূপে হইবে; সমাজ ও দেশ কিরূপে উন্নত হইবে; দেশের অভাব ও অভিযোগ কোন্‌ উপায়ে প্রশমিত হইবে; প্রজার প্রতি রাজার সহানুভূতি কিসে বর্দ্ধিত হইবে, - সে দিকে কাহারও লক্ষ্য নাই। লক্ষ্যের মধ্যে আছে, কিসে পাঠকের মনোরঞ্জন হইবে, - কিসে নিজের দুই পয়সা লাভ হইবে, - আর কিসে গ্রাহক জুটিবে। অথচ ইঁহারাই এখন লোক-শিক্ষকের পদে অভিষিক্ত, - ইঁহারাই এখন “বড়লোক”। ... এখন বিজ্ঞাপনের যুগ!... যার যত বিজ্ঞাপন, তার তত জয়জয়কার! ধর্ম্ম মানিবে না, মনুষ্যত্ব দেখিবে না, সমাজের পানে চাহিবে না, - যেন তেন প্রকারেণ টাকা আসিলেই হইল! সর্ব্বত্রই কেবল “টাকা, টাকা, টাকা” - রব।...”
উপসংহারে হারানচন্দ্র রক্ষিত যা লিখেছেন তা এই ১০০ বছর পর পাঠ করতে হয় অতীব বিস্ময়ের সঙ্গে। তিনি যে “থিয়েটার”-এর কথা লিখেছেন তার স'ান এখন দখল করে নিয়েছে অন্য একটি মাধ্যম। সে মাধ্যমের নাম যে “টিভি চ্যানেল” তা উল্লেখ না করলেও পাঠক বুঝে নিতেন সহজেই।
শেষ কথা হিসেবে তিনি যা লিখেছেন তা এই:
“সংবাদপত্র ও থিয়েটার, - এই দুই প্রবল শক্তি ক্রমেই সাধারণের মন হইতে শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস হারাইতেছে। সংবাদপত্রের সকল কথা এখন আর লোকে সহজে বিশ্বাস করে না। কাহারও সম্বন্ধে প্রশংসা বা নিন্দা প্রকাশ হইলে, পাঠক স্পষ্টই বলিয়া থাকেন, - ঐ লোকটার সঙ্গে এই কাগজওয়ালার কোনরূপ স্বার্থের সম্বন্ধ বা মনোবিবাদ আছে। এইরূপ বিশ্বাস হারাইতে হারাইতে সংবাদপত্রের অসি-ত্ব, - শেষে বিজ্ঞাপনেই পর্যবসিত হইবে। দু’একখানার ঠিক তাহাই হইয়াছে।”
এ অবস'ায় করণীয় কি?
১৯১১ সালে একজন বিক্ষুব্ধ হারানচন্দ্র রক্ষিত লিখেছিলেন, “... সংবাদপত্র ও থিয়েটার সমাজের দর্পণস্বরূপ। যে দর্পণে বাঙ্গালী-জীবনের এমন কুৎসিত প্রতিবিম্ব উঠে, সে দর্পণ ভাঙ্গিয়া ফেলাই ভাল। সে দর্পণকে নির্ম্মল ও উজ্জ্বল করিতে না পারিলে, তাহার অসি-ত্ব লোপ করিয়া, অন্ধকারে চক্ষু মুদিয়া থাকাই বিধেয়।”
২০১১ সালে এমন কিছু আমরা দেখি না, শুনি না, বলি না।

রবিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১১

বিপদ বানানো বানান

বানান নিয়ে আমি বিপদে পড়ি প্রায় সব সময়েই। লেখালেখিতে যেমন, পথেঘাটেও তেমন। আর তা ঘটতে পারে যে কোনও বিষয় নিয়ে আলোচনায়। রাজনীতি হোক, আর খুনোখুনি হোক।
অস্ত্র সহ  ধরা পড়েছে পাঁচ দুর্বৃত্ত। পুলিশ উদ্ধার করেছে গুলি, পিস্তল, ম্যাগাজিন...। যেই ‘ম্যাগাজিন’ বলেছি  অমনি তড়বড় করে ওঠে একজন, উঁহুঁ... ম্যাগজিন। যত বলি ‘ম্যাগাজিন’ তত বলে ‘ম্যাগজিন’। বলে, সাময়িকী পত্রিকা ‘ম্যাগাজিন’... রাইফেল বা বন্দুকে কারতুজ রাখার কুঠুরি ‘ম্যাগজিন’। জেদাজেদির পর্যায়ে চলে যায় ব্যাপারটা। ডিকশনারি, এনসাইক্লোপিডিয়া, ওয়ার্ড ওয়েব... সব ঘেঁটে ঘাট মেরে যায় সবাই। শেষে যুক্তি দেখায়, ডিকশনারিতে যা-ই থাকুক... পুলিশেরা ম্যাগজিন বলে। ওটাই বোঝে সবাই। ওটাই চালু। এই সূত্রে জানা যায়, পুলিশের জনসংযোগ বিভাগ থেকে যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আসে তাতে প্রায়ই ‘ম্যাগজিন’ উল্লেখ থাকে... সেটাই হয়েছে কোনও-কোনও পত্রিকায় বছরের পর বছর ধরে ওই  ভুল বানান লেখার কারণ। যাঁরা ওই বিজ্ঞপ্তি কখনও দেখেছেন তাঁরা জানেন কেমন তার ভাষা আর বানান!
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন পরিচালকের কথা। লেখালেখিতে বেশ উৎসাহ ছিল তাঁর। প্রায়ই লিখতেন ‘বিচিত্রা’য়, দৈনিক বাংলা’র ‘ছায়ামঞ্চ’ বিভাগে। বিদেশী চলচ্চিত্র ও পরিচালকদের কথা বলতেন সব সময়। সে সব কথায় চলচ্চিত্রিক পরিভাষা ব্যবহার করতেন খুব বেশি। লিখতেনও ও রকম ভাষায়। তাঁর প্রিয় পরিচালক ছিলেন ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো (১৯৩২-৮৪) আর প্রিয় ছবি ছিল “দ্য ৪০০ ব্ল্লোস”, “জুলে অ্যান্ড জিম”, “ফারেনহাইট ৪৫১”, “ডে ফর নাইট”, “দ্য স্টোরি অভ আদেল এইচ”, “দ্য ম্যান হু লাভড্‌ উইমেন”, “দ্য উওম্যান নেক্সট ডোর”...। তবে তিনি ‘ত্রুফো’ (ঞৎঁভভধঁঃ)-কে লিখতেন ‘ক্রুফো’। আমি সংশোধন করে ছেপে দিতাম লেখা, যেমন করে থাকি অন্য অনেকের লেখার বেলায়। কিছু দিন পরে তিনি একদিন অফিসে এসে চেপে ধরেন আমাকে। বলেন, আপনি এত বড় একটা ভুল করেন?
জানতে চাই, কি সেই ভুল। তিনি উত্তেজিত হয়ে যান, আপনি ক্রুফো-কে ত্রুফো করে দিচ্ছেন সব সময়? এজন্য লজ্জা পেতে হচ্ছে আমাকে!
আমি বলি, ত্রুফো না লিখলে তো সম্পাদক কবি শামসুর রাহমান আমাকে কারণ দর্শাও নোটিস দেবেন!
কেন? কেন?
কারণ যাঁকে আপনি ক্রুফো লেখেন... তিনি আসলে ত্রুফো।
কিন' আমি তো ক্রুফো-ই লিখি!
কেন লেখেন?
কলকাতার পত্রিকায় এ রকম লেখে।
কিছু দিন পর কলকাতার এক লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে আসেন তিনি। বলেন, দেখুন বানানটা আসলে ক্রুফো!
এর পর ছাপার ভুল ব্যাপারটা তাঁকে বোঝাতে প্রায় এক ঘণ্টা লেগে যায় আমার।
সেই থেকে আমি ধন্দে আছি কতিপয় ইতিহাসবিদ সম্পর্কে। তাঁরা দু’ হাতে প্রচুর লেখেন বাংলাদেশের ইতিহাস, ঢাকার ইতিহাস সম্পর্কে। এত লিখতে যত গবেষণা প্রয়োজন, অনুসন্ধান প্রয়োজন... তত গবেষণা বা অনুসন্ধানের সময় তাঁরা পান কখন এবং কিভাবে? এত লিখতেও তো অনেক সময় লাগে! তাছাড়া এ দেশের ইতিহাস লিখতে গেলে সংস্কৃত, আরবি, ফারসি ও ইংরেজি জানতে হবে ভালভাবে। কারণ ইতিহাসের উপাদান হিসেবে যত লেখ, লিপি, বৃত্তান্ত, বিবরণী, দলিল প্রভৃতি আছে সেগুলো সব ওই সব ভাষার কোনও না কোনওটিতে লেখা। তাহলে যাঁরা ওই চারটি ভাষার প্রথম তিনটি জানেন না এবং চতুর্থটিতে দুর্বল ... তাঁরা কিভাবে ইতিহাসবিদ হয়ে যাচ্ছেন? নিশ্চয়ই নির্ভর করছেন ইংরেজি বা বাংলা অনুবাদের ওপর। যদি ওই অনুবাদে ভুল থাকে, ছাপার ভুল থাকে? তখন তো ওই ‘ক্রুফো’!
পথেঘাটের কথা বলছিলাম। সেদিন একজন জিজ্ঞেস করেন,  গ্রিনিচ মান সময়ের সঙ্গে আমাদের ব্যবধান কত?
আমি বাধা দিলাম, গ্রিনিচ মান নয় গ্রিনিচ মিন...
তিনি জানান, ইংরেজিতে গ্রিনিচ মিন... কিন' বাংলায় গ্রিনিচ মান।
এখানে মিন মানে মধ্যবর্তী বা মধ্য। মধ্যবর্তী সৌর সময়... মিন সোলার টাইম।
কিন' বিভিন্ন পত্রিকার দোহাই দিয়ে তিনি জানান, ওঁরা মান-ই লিখছেন।
পরে তাঁকে অভিধান দেখাই। তিনি বলেন, অভিধান দেখাবেন না। অভিধানে অনেক ভুল। তাছাড়া অভিধান আপনারা নিজেরাই যখন মানেন না, তখন আমাদের কেন মানতে বলেন?
আমরা মানি না?
না। এই দেখুন... অভিধানে কোথাও নেই ‘ওঠ’। আছে ‘উঠ’। কিন' আপনারা “সূর্য উঠে” না লিখে লিখছেন “সূর্য ওঠে”।
অভিধানে তে অনেক কিছু নেই। কিন' আমাদের লিখতে হয়। ‘ওপর’ নেই। কিন' লিখতে হয় ‘মুখের ওপর কথা’!
এই যে ‘ম্যাগজিন’, ‘ক্রুফো’ বা ‘গ্রিনিচ মান’ - এঁদের জন্য এখনও ইংরেজি ড়ভ  বাংলায় ‘অফ’ বা ‘অব’ হয়ে আছে, শুদ্ধ উচ্চারণের ‘অভ’ হতে পারে নি। একই ভাবে ইংরেজি ধহফ বাংলায় ‘এণ্ড’ বা ‘এন্ড’ হয়ে আছে, ‘অ্যান্ড’ হতে পারে নি। ‘আশিস্‌’ না লিখে ‘আশীষ’ লেখেন, ‘দিলীপ’ না লিখে ‘দীলিপ’ লেখেন, জেনেশুনে ‘পৃথ্বীশ’ না লিখে ‘পৃথ্বিশ’ লেখেন - এমন লোকের সংখ্যা এখন অনেক। জিজ্ঞেস করলে তাঁরা বলেন, আমি তো এ রকমই লিখি।
অনেকে আছেন যাঁরা ভুল বানান লেখার পক্ষে যুক্তিও দেখান। বলেন, কম্যুনিকেট করাটাই আসল। আমি যদি পাঠককে বোঝাতে পারি তাহলে অসুবিধা কোথায়?
এই ভদ্রলোকের এক লেখার প্রথম পাঁচ বাক্যে ছিল ১১টি ভুল। তাঁকে বলেছিলাম বানানের ব্যাপারে সচেতন হতে, কনফিউশন হলে ডিকশনারি দেখতে। তিনি অম্লান বদনে উত্তর দিয়েছিলেন, আমার কোনও কনফিউশন হয় না।
রবিবারকে অনেকে রোববার লেখেন। কিন' ‘রোব ও সোমবার’ লেখেন না। ‘আজও, আরও, আবারও, এখনও, কখনও, কোনও’ না লিখে অনেকে লেখেন ‘আজো আরো আবারো এখনো কখনো কোনো’। এঁরা অনেকেই ‘আজো গিয়েছি কালও যাবো’ লেখেন, কিন' ‘আজো গিয়েছি কালো যাবো’ লেখেন না। ‘জানালা’কে ‘জানলা’ এবং ‘দরজা’কে ‘দরোজা’ লেখার উদাহরণ মেলে অজস্র। এগুলো চালু হয়ে গেছে ব্যাপকভাবে। এর কোনটা ভুল তা নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ছে ক্রমশ। ‘হোতা’ শব্দটির মূল অর্থ গুণবাচক হলেও এখন এর প্রয়োগ চলছে হীন অর্থে। নায়ক শব্দটিও গুণবাচক। তবুও ‘চার খুনের নায়ক’ লেখেন অনেকে, ‘চার খুনের হোতা’ও লেখেন কেউ-কেউ। ইদানীংকার নানা রকম দখল অভিযানের কারণে ‘দখল’ কথাটি ব্যবহৃত হচ্ছে ‘অবৈধ অধিকার’ অর্থে। আর ‘বেদখল’-এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে ‘অবৈধ অধিকারমুক্ত’। ‘ইত্যাদি’ ও ‘প্রভৃতি’তে কোনও অর্থগত পার্থক্য না থাকলেও লোকের মুখে-মুখে ‘ইত্যাদি’র সঙ্গে মিশে গেছে কিছু তুচ্ছতা। তাই লেখা হয় ‘মল মূত্র কফ কাশি ইত্যাদি’, কিন' ‘দুধ ঘি ছানা মাখন প্রভৃতি’। মানুষের বেলায় ‘প্রভৃতি’ লেখেন অনেকে, কিন' ‘প্রমুখ’ই তো লেখার কথা। যেমন, ‘বাবর, হুমায়ুন, আকবর প্রমুখ’। কিন' কারও যদি কোনও রকম কনফিউশন না হয় তখন তো আর কিছু থাকে না বলার।
    বিপদের কথা বলছিলাম, আমার বিপদের কারণ অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী... কথায়-কথায় ডিকশনারি! কিন' হাতে পাঁজি মঙ্গলবার তো চলে না! এই দোটানায় স্কুল-জীবনে আমাদের সম্বল ছিল এক ও অদ্বিতীয় এ টি দেবের ডিকশনারি। তবে কিভাবে-কিভাবে আমি পেয়ে যাই রাজশেখর বসু’র “চলন্তিকা”। আর জানতে পারি “অধীনস' আয়ত্তাধীন আয়ত্ত্ব আশীষ উচিৎ উৎকর্ষতা একত্রিত ঐক্যতান কেবলমাত্র চলমান পৈত্রিক ফেণ ভদ্রস'তা ভাণ মৌনতা মৌন সৌজন্যতা অনুবাদিত অর্ধাঙ্গিনী আবশ্যকীয় আহরিত ইতিপূর্বে ইতিমধ্যে উপরোক্ত সকাতরে সক্ষম সচল চলৎশক্তি চাকচিক্য নিন্দুক নির্বিরোধী বিতরিত মহারথী মহিমাময় মুহ্যমান শরৎচন্দ্র সম্ভব সৃজন সততা সাবধানী” ইত্যাদি অশুদ্ধ শব্দ। এগুলো ব্যাকরণদুষ্ট, বানানে বা শব্দের গঠনে ভুল। এ সব অশুদ্ধ শব্দের স'লে শুদ্ধ শব্দ হিসেবে আমাদের লেখা উচিত “অধীন আয়ত্ত আয়ত্তি আশিস্‌ উচিত উৎকর্ষ একত্র ঐকতান কেবল চলন্ত পৈতৃক ফেন ভদ্রতা ভান মৌন মৌনী সৌজন্য অনূদিত অর্ধাঙ্গী আবশ্যক আহৃত ইতঃপূর্বে ইতিমধ্যে উপর্যুক্ত কাতরভাবে ক্ষম চল চাকচক্য নিন্দক নির্বিরোধ বিতারিত মহারথ মহিমময় মোহ্যমান শরচ্চন্দ্র সম্ভবপর সর্জন, সৃষ্টি সাধুতা সাবধান” ইত্যাদি। এই একই সূত্রে জানা গেল “আভ্যন্তরীণ ঐক্যমত কৃচ্ছ্রতা  প্রয়োজনীয়তা রহস্যময়তা সপক্ষে সার্বজনীন সুষ্ঠ”র বদলে লেখা উচিত “অভ্যন্তরীণ ঐকমত্য কৃচ্ছ্র, কৃচ্ছ্রসাধন প্রয়োজন রহস্য পক্ষে সর্বজনীন সুষ্ঠু”।
এখান থেকেই বিপদের শুরু আমার। সহপাঠীদের সঙ্গে, তারপর সহকর্মীদের সঙ্গে, তারপর লেখক সাংবাদিক সম্পাদক প্রকাশকদের সঙ্গে প্রথমে তর্ক-বিতর্ক, তারপর বাদবিসংবাদ, ঝগড়াঝাটি, মন কষাকষি, তারপর... বুঝতেই পারছেন!
বিপদের শুরুর সময়টা মনে রাখা দরকার। তখন “সূর্য্য পূর্ব্ব দিকে উদিত হয়... সকলে ধর্ম্ম-কর্ম্ম সাঙ্গ করিয়া কেহ কৃষিকার্য্যে মাঠে যায়... কেহ রেলষ্টেশনে বা ষ্টীমারঘাটে যায়... খ্রীষ্টাব্দ অনুযায়ী তখন ১৯৫৯ বৎসর...”। সেই সময়ে কেন, এখনও অমন শুদ্ধাশুদ্ধি বিচারে তেড়ে আসেন অনেকে। এর কারণও আছে অনেক। ‘শরচ্চন্দ্র’ বানানের সর্বনাশ করে গেছেন শরৎচন্দ্র স্বয়ং। ‘আশিস্‌’কে প্রায় ‘আশীষ’ করে ফেলেছেন আশীষকুমার লোহ, শুভাশীষ, দেবাশীষ অনেকে। [একই ভাবে ‘দিলীপ’কে ‘দীলিপ’ করে ফেলেছেন পরিচালক-প্রযোজক দীলিপ বিশ্বাস; ‘উজ্জ্বল’কে ‘উজ্জল’ করে ফেলেছেন নায়ক-প্রযোজক উজ্জল; ‘আকাঙ্ক্ষা’কে ‘আকাংখা’ বা ‘আকাঙ্খা’ করে ফেলেছেন কবি ফজল শাহাবুদ্দিন, পরিচালক-অভিনেতা সুভাষ দত্ত, লেখক হুমায়ুন আহমেদ।] আর ‘একত্রিত কেবলমাত্র (শুধুমাত্র-ও) চলমান অর্ধাঙ্গিনী আবশ্যকীয় আহরিত সকাতরে সক্ষম সচল চলৎশক্তি (চলচ্ছক্তি-ও) চাকচিক্য নিন্দুক নির্বিরোধী বিতরিত মহারথী মুহ্যমান সৃজন সততা সাবধানী প্রয়োজনীয়তা সপক্ষে” এমন ভাবে প্রতিষ্ঠিত এখন যে এগুলোর শুদ্ধ রূপটাকেই অশুদ্ধ মনে করবেন পাঠকরা। ‘চলমান’ না থাকলে ‘চলমান আন্দোলনের ফসল’ পাবো কোথ্‌ থেকে? (ছোটবেলায় ‘অর্ধাঙ্গিনী’ (১৯৫৫) নামে একটি হিট ছবি দেখেছিলাম মনে পড়ে।)
এছাড়া -িকার ও ঈ-কার,  ু-কার বনাম  ূ-কার, ও বনাম াে-কার,  ৃ-ফলা বনাম + ি্র-ফলার নানা জটঝঞ্ঝাট তো আছেই!
দৃষ্টি আকর্ষণের পরও ‘প্রয়োজনীয়তা’র অর্থ যে আসলে ‘প্রয়োজন’ তা বুঝতেই চান নি এক প্রবীণ সাংবাদিক। তিনি একটি অনুষ্ঠানে রীতিমতো বক্তৃতাই করেছিলেন এ নিয়ে। ‘সৃজন’ কথাটি ভুল জেনেও কি সংগঠনের নাম বদলে দেবেন সৃজনশীল প্রকাশকেরা? ‘সপক্ষে’র ব্যবহার কি ছাড়তে পারবেন মুক্তিযুদ্ধের বা স্বাধীনতার ‘সপক্ষের’ শক্তিরা? (এখানে বলে রাখি, ‘স্বপক্ষের’ বানানও দেখা যায়।) ‘মোহ্যমান’ লিখে ভেংচি খেয়েছি অনেক। যিনি ভেংচি দিয়েছিলেন তিনি ভাষাসৈনিক দাবি করেন নিজেকে। তাঁকে এবং আরও একজনকে দেখে আমার একবার মনে হয়েছিল, ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যাঁরা ঢাকা’র কোনও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ছিলেন তাঁরা সবাই বোধহয় নিজেদের ভাষাসৈনিক দাবি করেন এভাবে। প্রশ্ন জাগে, বায়ান্ন’র সৈনিকরা  কেন পরে ফেব্রুয়ারি মাসে সংবর্ধনা নেয়া ছাড়া বাংলা ভাষার জন্য কিচ্ছু না করে নিজেকে ভাষাসৈনিক দাবি করেন? বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতির জন্য কোনও রচনা নেই, গবেষণা নেই, চর্চা নেই, উদ্‌যোগ-আয়োজন নেই, ভূমিকা নেই, অবদান নেই, সাহায্য সহযোগিতা সহায়তা পৃষ্ঠপোষকতা নেই - কেবলই রাশি-রাশি ভারা-ভারা সম্মান-সংবর্ধনা?
আমার সমস্যা হলো, বহুপ্রচলিত ভুলের কাছে অসহায় হয়ে থাকলেও নিজের লেখায় আমি শুদ্ধতা বজায় রাখারই চেষ্টা করি। তাই কখনও ‘মুহ্যমান সপক্ষে সৃজনশীল’ ইত্যাদি লিখি না, ‘মোহ্যমান পক্ষে সৃষ্টিশীল’ ইত্যাদিই লিখি। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ‘অশ্রুজল’ লিখলেও লিখি না। পারতপক্ষে এড়িয়ে চলি আরও অনেক ভাষাদুষ্টি। এটা বাড়াবাড়ি মনে করেন অনেকে, কিন' আমি মনে করি সকলেরই এমন একটি অধিকার থাকা উচিত। আমি ক্ষুদ্র, সামান্য হলেও স্পর্ধা দেখাই ওই অধিকার সংরক্ষণের। কিন' বিপদ ঘনিয়ে আসে যখন “আগস্ট রিখটার টেরেস্টেরিয়াল” ইত্যাদি না লিখে “অগস্ট রিকটার টিরেসট্রিয়াল” লিখি কিংবা স্বরবর্ণের আগে ‘দি’ এবং ব্যঞ্জনবর্ণের আগে ‘দ্য’ লিখি, তখন ডিকশনারির দোহাইও খাটে না, হুঙ্কার আসে - “এই কচুর ডিকশনারিতে এত ভুল?”

শনিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১১

হারানো দিনের ছবি

ইংরেজিতে বায়োস্কোপ, টকি, সিনেমা, ফিল্ম, মুভি - আর বাংলায় নির্বাক চিত্র, সবাক চিত্র, চলচ্চিত্র, ছায়াছবি, ছবি। তবে আমাদের টাঙ্গাইলে ‘বই’। আর ঢাকায় ‘পিকচার’। টাঙ্গাইলে ‘কি বই চলতাছে’ ঢাকায় হয়ে যায় ‘কি পিকচার খেলতাছে’!
‘বই’ কেন বলা হয় তা অনুমান করা যায় কিছুটা। সেকালে বেশির ভাগ বাংলা ছবিই হতো গল্প-উপন্যাস থেকে অর্থাৎ ছবি হতো বই থেকে, তার মানে ছবির পরিচয়টা ছিল বইয়ের সূত্রে। এ জন্য আমাদের মফস্বল শহরের কালী সিনেমায় নতুন কোনও ছবি এলে প্রশ্ন করা হতো, কি বই? উত্তরে মিলতো, শরৎচন্দ্রের বই বা তারাশঙ্করের বই। পরে তারকা-যুগে উত্তরটি বদলে হয়ে যায় সূচিত্রা-উত্তমের বই।
ছবি দেখার নেশা সেই ছোটবেলায় আমার হয়েছিল অপরিসীম কৌতূহলের কারণে। ছবি নড়ে, কথা বলে, গান গায়, নাচে, মারপিট করে, - আর বইয়ে যা পড়ি - জলে স্থলে আকাশে যুদ্ধ, লন্ডন টোকিও নিউ ইয়র্ক, প্যারিস, দৈত্যদানব, বাঘ-সিংহ - সব দেখা যায় ছবিতে - এমন বিচিত্র বিস্ময়কে না দেখে  কি থাকা যায়!
আসলেই বিচিত্র বিস্ময় এই ছবি। এখানে-ওখানে খণ্ড-খণ্ড দৃশ্য ধারণ করে, তারপর সেগুলোকে জোড়া দিয়ে-দিয়ে গোটা একটা কাহিনী দাঁড় করানো সোজা কম্ম নয়। আর কাহিনী একটা দাঁড় করালেই কি হলো? তাকে এমনভাবে তুলে ধরতে হবে যাতে দর্শকের আবেগ-অনুভূতিতে সাড়া জাগে নানারকম। এ জন্য ক্যামেরায় ছবি তোলার নানা কায়দা আছে, শিল্পীদের অভিনয়ে আছে নানা কৌশল, সংলাপে সংগীতে ধ্বনি-সংযোজনায় সম্পাদনায় আছে কত রকম কত রীতি! এ যদি বিস্ময় না হয় তাহলে বিস্ময় কি!
দর্শকদেরও নানা ব্যাপার-স্যাপার আছে উপভোগের ক্ষেত্রে। ছবি দেখার পর তাঁদের প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যায় সেসব। আকিরা কুরোসাওয়া’র এক ছবি দেখেছিলাম চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের পাশে বসে। সারাক্ষণ চুপচাপ ছিলেন তিনি। ছবি শেষ হলে বাইরে বেরিয়ে এসে বলেছিলেন, লাইটিং-এ সমস্যা আছে বেশ। ‘ডোন্ট লুক নাউ’ (১৯৭৩) দেখার পর চলচ্চিত্রপ্রেমী শাহাদত চৌধুরী বলেছিলেন, কি কাণ্ড! জুলি ক্রিসটি’র মতো নায়িকারও খোলামেলা হয়ে এসব করতে হয়! ‘আখরি চাট্টান’ (১৯৭০) ছবিটি ১০-১১ বার দেখেছিলেন সাহিত্যিক-সাংবাদিক শেখ আবদুর রহমান ও আখতার-উন-নবী নৃত্যপটয়সী নায়িকা রানী ও তারানা’র জন্য। কবি রফিক আজাদ অনেক ছবি দেখেছেন স্রেফ ‘ডাকু কি লাড়কি’ (১৯৬০) খ্যাত মুসাররাত নাজির ও ‘বানজারান’ (১৯৬২) খ্যাত নীলো’র কারণে।
ছবি দেখতে গিয়ে আমার হয় নানারকম দশা-ছবি দেখার সঙ্গে সঙ্গে আমি দেখতে থাকি এর নির্মিতির নানা দিক। অর্থাৎ প্রতিটি দৃশ্যের চিত্রায়ন হয়েছে কিভাবে - কোথায় ক্যামেরা ছিল, লাইটিংয়ের ব্যবস্থা ছিল কি রকম, কলাকুশলীরা কে কোথায় ছিলেন, রিহার্সাল হয়েছে কতক্ষণ, টেক হয়েছে ক’বার ইত্যাদি ছাড়াও সাউন্ড এফেক্ট, স্পেশ্যাল এফেক্ট-এর নানা কিছু তখন ঘুরপাক খায় মাথায়। এতে অবশ্য উপভোগে কিছু ঘাটতি হয় নি কখনও আমার। বরং উপভোগের মাত্রা যেন বাড়ে আরও। বৈচিত্র্যও যেন আসে বেশি! এখনও নিয়মিত ছবি দেখি, উপভোগও করি বেশ। এই লেখাটি শুরু করার আগে দেখেছি ‘দ্য বাটারফ্লাই এফেক্ট’ (২০০৪) নামের এক ড্রামা/থ্রিলার/সাই-ফি ছবি। কোনও প্রজাপতির একটি পাখার কাঁপন থেকেও ঝড় উঠতে পারে আধা পৃথিবী জুড়ে - এমন একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু হয়েছে ছবিটি। এ ছবির নায়ক ইভান ট্রেবর্ন। তার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে অনেক। কোনও-কোনও ঘটনা ডেকে এনেছে চরম ক্ষতি। সেই ঘটনাগুলো সে মনে রাখতে চায় নি, প্রাণপণে চেষ্টা করেছে ভুলে থাকতে। বড় হয়ে সেসব ঘটনা সে স্মৃতি থেকে উদ্ধারের এক উপায় খুঁজে পায়। এক অলৌকিক উপায়ে তখনকার ভুলগুলো সংশোধনের মাধ্যমে জীবনকে বদলে-বদলে দেখতে থাকে ইভান। এরপর ঘটতে থাকে নাটকীয় সব ঘটনা। শেষ পর্যন্ত নিজের জন্মটাকেই ভুল মনে করে সে উদযোগী হয় সংশোধনের।
প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রুদ্ধশ্বাসে দেখার মতো এ ছবি, প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ্য এ ছবির। হলিউডের এ ছবিটিতে আছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে একটি সংলাপ। ইভান-এর মুখে ওই সংলাপটি এ রকম: “আমার এখন যে অবস্থা তাতে আজ ঘুমিয়ে পড়লে কাল হয়তো জেগে উঠবো বাংলাদেশের কোনও ক্ষেতখামারে!”
ছবি দেখে মজা পেতে শুরু করেছি কবে থেকে তা জানতে চেয়েছি অনেকবার মাথা খুঁড়ে! প্রথম ছবিটি দেখি কবে - কি ছিল সেই ছবি - এ নিয়ে খোঁজাখুঁজি করেছি অনেক। শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেতে যা মনে করতে পেরেছি তাতে নিশ্চিত হয়েছি এ নেশার শুরু আমার সেই ১৯৫৫ সালে, তখন ক্লাশ ফোর-এ পড়ি। প্রথম দেখা ছবিটির নাম ‘সতীর দেহত্যাগ’ (১৯৫৪)। মানু সেন পরিচালিত ও ছবিতে অভিনয় করেছেন দীপ্তি রায়, কমল মিত্র, রাজা মুখার্জি, অঞ্জলি রায় প্রমুখ। এরপর দেখি ডাবল প্রোগ্রাম - এক টিকিটে দুই ছবি - ‘রাশিয়ান সারকাস’ আর ‘ব্যাটল অব স্ট্যালিনগ্রাড’। তবে বিপত্তি দেখা দেয় ছোট বোন বকুল-কে নিয়ে। সে ‘রাশিয়ান সারকাস’-এর সিংহ-ভালুক দেখে ভয় পেয়ে এমন চিৎকার জুড়ে দেয় যে মাথায় উঠে যায় গোটা কালী সিনেমা। আমার মনে হয় না ‘কালী সিনেমা’ আর কখনও অমন বিপদে পড়েছে! সে রাতে আর ছবি দেখা হয় নি আমাদের। দর্শকরা চেচাঁমেচি করে আমাদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বাড়িতে। তবে দু’টি ছবিই আমি দেখেছিলাম পরে। ওই ১৯৫৫-৫৬ সালে দেখা দু’টি বাংলা ছবির কথা মনে আছে এখনও - ‘বাবলা’ (১৯৫১) ও ‘মহাপ্রস্থানের পথে’(১৯৫২)। অগ্রদূত পরিচালিত ‘বাবলা’ ছবির নামভূমিকায় মর্মস্পশী (অভিনয় করেছিল শিশুশিল্পী মা. বীরেন (নীরেন?) ভট্টাচার্য। অন্যান্য ভূমিকায় ছিলেন শোভা সেন, জহর গাঙ্গুলী, পরেশ ব্যানার্জী, পাহাড়ী সান্যাল, ধীরাজ দাস, প্রভা দেবী প্রমুখ। শোভা সেনকে পরে দেখেছি ‘মরণের পরে’, ‘সবার উপরে’, ‘শিল্পী’, ‘পথে হলো দেরী’, ‘কিছুক্ষণ,’ ‘আম্রপালী’, ‘হেডমাস্টার’ প্রভৃতি ছবিতে। তিনি উৎপল দত্তের স্ত্রী। ‘বাবলা’ চিত্রায়িত হয়েছিল সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় (১৮৮৪-১৯৬৬)-এর উপন্যাস থেকে। চিত্রায়িত হওয়ার পর উপন্যাসটির একটি কিশোর সংস্করণও প্রকাশিত হয়েছিল। সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সুচিত্রা মিত্রের পিতা। কার্ত্তিক চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ও চিত্রায়িত হয়েছিল উপন্যাস থেকে। তবে সেটি ভ্রমণ-উপন্যাস। লেখক প্রবোধ কুমার সান্যাল (১৯০৫-৮৩)। তাঁকে দেখেছিলাম ১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলনে, তাঁর অটোগ্রাফও নিয়েছিলাম একটা ছোট্ট খাতায়। ‘মহাপ্রস্থানের পথে’র নায়ক-নায়িকা ছিলেন দুই নবাগত শিল্পী - বসন্ত চৌধুরী ও অরুন্ধতী দেবী। এছাড়া ছিলেন মায়া  মুখার্জি,  তুলসী চক্রবর্তী, কমল মিত্র প্রমুখ। ছবিটির হিন্দি ভার্সানের নাম ছিল ‘যাত্রিক’। ‘বাবলা’ ও ‘মহাপ্রস্থানের পথে’র ছবি দু’টি দেখতে-দেখতে কি কারণে যেন খুব হাপুস কান্না পেয়েছিল আমার, তখন বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন আশপাশের দর্শকরা। এরপর থেকে দুঃখভরা ছবি আর দেখতে চাইতাম না আমি, সুযোগ পেলে দেখতাম ‘নাচ-গান-ফাইটিংয়ে ভরপুর’ ছবি।
১৯৫৫-৫৬ সালে দেখা কয়েকটি হিন্দি ছবির কথা বলি এখানে। পরে আর দেখার সুযোগ পাই নি বলে এ ছবিগুলো আবছা হয়ে আছে স্মৃতিতে। প্রথমে বলি ‘জীবনতারা’ (১৯৫১) ছবিটির কথা। হিন্দিতে ডাব করা দক্ষিণ ভারতীয় ছবি। জোসেফ তেলিয়াত প্রযোজিত-পরিচালিত এ ছবির নামভূমিকায় শিল্পী ছিলেন টি. আর. মহালিঙ্গম  ও টি. আর. রাজকুমারী। বসন্ত দেশাই সুরারোপিত এ ছবির গান অনেকে গুনগুন করতেন সেকালে। টি. আর. রাজকুমারী-কে পরে দেখেছি ‘চন্দ্রলেখা’ (১৯৪৮) ছবির নামভূমিকায়। ‘জীবনতারা’র পর দেখি ‘মুকাদ্দর’ (১৯৫০)। এতে অভিনয় করেছেন কিশোর কুমার, নলিনী জয়ন্ত, কৃষ্ণকান্ত, সজ্জন, ইফতেখার, সোফিয়া, নীলম, স্যামসন প্রমুখ। অরবিন্দ সেন পরিচালিত ও ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন দু’জন - খেমচাঁদ ও শ্রেষ্ঠ। এই ‘মুকাদ্দর’-এর মাধ্যমে প্রথম চিনতে পারি গায়ক-নায়ক কিশোর কুমারকে; আর প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে প্রথম জানতে পারি আশা ভোসলেকে - তিনি লতা মঙ্গেশকরের বোন।
আমার দেখা তৃতীয় হিন্দি ছবির নাম ‘সরকার’(১৯৫১)। ছবিটি কয়েক বার কয়েক সপ্তাহ ধরে চলেছে টাঙ্গাইলে। সম্ভবত গানের জন্য। কে. অমরনাথ পরিচালিত এ ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন গোবিন্দরাম। ছবিটিতে অভিনয় করেছেন অজিত, বীণা, শশিকলা, হীরালাল, উল্লাস, ঊষা কিরণ, কাক্কু, মুরাদ, এস. নাজির, মধুবালা প্রমুখ।
গানের কথা বলছিলাম, গানের জন্য আরেকটি ছবি  কয়েক সপ্তাহ চলেছে আমাদের কালী সিনেমায়। ডাবল প্রোগ্রাম, ট্রিপল প্রোগ্রামেও প্রধান আকর্ষণ ছিল ওই ছবি। ‘খুবসুরত’ (১৯৫২) নামের ওই ছবির শিল্পী ছিলেন সুরাইয়া, নাসির খান, ইয়াকুব, জানকী দাস প্রমুখ। নাসির খান পরিচিত ছিলেন দিলীপ কুমারের ভাই হিসেবে। তিনি একালের ভিলেন আইয়ুব খানের পিতা। এস এফ হাসনাইন পরিচালিত ‘খুবসুরত’ ছবিতে মদন মোহন-এর সুরে সুরাইয়া গেয়েছিলেন কয়েকটি অসাধারণ গান। দু’টি গানের প্রথম পঙ্‌ক্তি মনে আছে এখনও - ‘ইয়ে চাঁদ সিতারে কেয়া জানে’ ও ‘চাঁদনি রাতোঁ যিস দম ইয়াদ আ যাতে হো তুম’।
আরেকটি ছবির কথা বলি। এটি হিন্দিতে ডাব করা দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত জেমিনি পিকচার্স-এর ছবি ‘সংসার’ (১৯৫১)। এস এস ভাসান পরিচালিত এ ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন পার্থসারথি ও শঙ্কর। তাঁদের সুরারোপিত ‘আম্মা রোটি দে, আব্বা রোটি দে’ গানটি এখনও মনে থাকার কথা অনেকের। এ ছবির শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন পুষ্পাবলী, এম. কে. রাধা, আগা, বনজা, ডেভিড, মোহনা প্রমুখ। এঁদের মধ্যে পুষ্পাবলী বলিউড-তারকা রেখা’র মা, এস কে রাধা ‘চন্দ্রলেখা’ ছবির নায়ক বীরসিং, আর আগা বলিউড-চরিত্রাভিনেত্রী ফরিদা জালালের পিতা।
ছবি দেখতে দেখতে ঝোঁক সৃষ্টি হয় ছবি সংক্রান্ত পত্রপত্রিকা পড়ার দিকে। ঢাকা-কলকাতা’র এই সব পত্রপত্রিকার যথেষ্ট আদর ছিল তখন। বাবা  মাঝেমধ্যে কিনতেন, বন্ধু ফারুক কোরেশী’র কাছেও মিলতো অনেক। সে অভ্যাস আছে এখনও। ওই পত্রপত্রিকা নাকেমুখে গেলার কারণে জানি জেমিনি’র ‘ইনসানিয়াত’ (১৯৫৫) ছবির অনেক তারকার পরিচয়। ওই ছবির ভিলেন জয়ন্ত অভিনয় করেছেন দস্যু সরদার জাঙ্গুরা চরিত্রে। তিনি ‘শোলে’ খ্যাত ভিলেন আমজাদ খানের পিতা। ওই ছবিতে তাঁর সংলাপ ‘জাঙ্গুরা খুশ হুয়া’কেই শেখর কাপুর প্রায় একইভাবে ব্যবহার করেছেন ‘মি. ইনডিয়া’ (১৯৮৭) ছবিতে অমরীশ পুরী’র মুখে ‘মোগামবো খুশ হুয়া’। জয়ন্তকে ভিলেন-প্রায় ভিলেন এ ধরনের চরিত্রে আরও দেখেছি ‘দুলারী’ (১৯৪৯), ‘অমর’ (১৯৫৪) প্রভৃতি ছবিতে। এ দু’টি ছবিরই নায়িকা মধুবালা। ‘ইনসানিয়াত’ ছবির দুই নায়ক দিলীপ কুমার ও সদ্যপ্রয়াত দেব আনন্দ পরে আর কখনও অভিনয় করেন নি একই ছবিতে। এর কারণ - দেব আনন্দ পরে জানতে পেরেছিলেন, ছবিতে তাঁর নাকের নিচে বেঢপ গোঁফ লাগানোর আর হাতে এক লম্বা বেখাপ্পা তলোয়ার ধরিয়ে দেয়ার বুদ্ধি পরিচালককে দিয়েছিলেন দিলীপ কুমার। ‘ইনসানিয়াত’-এ শোভনা সমর্থ মা চরিত্র রূপায়িত করেছেন দিলীপ কুমারের। তিনি সেকালের দুই নায়িকা নূতন ও তনুজা’র মা এবং একালের নায়িকা কাজল-এর নানী। ওই ছবিতে পাতি ভিলেন ছিলেন জয়রাজ। তিনি ছিলেন সেকালে বলিউডের জবরদস্ত  নায়ক। ঐতিহাসিক, পৌরাণিক, মারদাঙ্গা ছবিতে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল তাঁর। সুরাইয়া’র বিপরীতে ‘রাজপুত’ ছবিতে দেখেছি তাঁকে, দেখেছি আরও কয়েকটি ছবিতে । মারা গেলেন ক’বছর আগে। বয়স হয়েছিল নব্বইয়ের কমবেশি। বার্ধক্য ও অসুস্থতায় জয়রাজ শয্যাশায়ী ছিলেন দীর্ঘকাল। শোনা যায়, বোঝা টানতে-টানতে নাকি বিরক্ত হয়ে পড়েছিল তাঁর ছেলেরা। তাঁকে সেবাযত্ন করা দূরে থাক, ঠিকমতো খেতেও নাকি দিতো না। ওষুধ খাইয়ে তাকে তারা ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে মাসের পর মাস। পরে ওই অবস্থাতেই মৃত্যু ঘটে জয়রাজের। পত্রপত্রিকায় এসব অভিযোগের খবর প্রকাশিত হলে হৈচৈ পড়ে যায় চারদিকে। পড়ারই কথা। বলিউডের রুপালি পর্দার কোনও মহিমান্বিত নায়কের এমন শোচনীয় জীবনাবসান কি ভাবতে পারেন কেউ?
ষাটের দশকে ঢাকার বেশির ভাগ ছবি দেখেছি টাঙ্গাইলের রওশন টকিজ ও রূপবাণী প্রেক্ষাগৃহে। নতুন মালিকানায় কালী সিনেমা হয়েছিল রওশন টকিজ, আর রূপবাণী’র প্রথম নাম ছিল ‘লিলাক’। ঢাকার প্রথম ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’ (১৯৫৬) তখন দেখা হয় নি অল্পের জন্য। কোনও আগাম ঘোষণা ছাড়া ছবিটি হুট করে মুক্তি পেয়েছিল শুক্রবারে, তেমনি হুট করেই বিদায় নেয় তিন দিনের মাথায়। এমন ঘটনা ঘটে না সাধারণত। সব ছবিই কমপক্ষে চলে সাত রজনী। আমরা সাধারণত দল বেঁধে দেখতে যাই মঙ্গল-বুধবার। তখন ভিড় কমে আসে কিছু। এছাড়া আমরা অপেক্ষা করি ডাবল-ট্রিপল প্রোগ্রামের আশায়। সেখানে এমন একটি ঘটনা! কানাঘুষায় শোনা গেল, ছবির প্রিন্ট নাকি পুড়ে গেছে - তাই ‘মুখ ও মুখোশ’ আর দেখা যাবে না।
সেই সময়ে দেখা আমার ভাল লাগা ঢাকার ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে - আসিয়া (১৯৬০), কখনো আসেনি (১৯৬১), সূর্যস্নান, নতুন সুর (১৯৬২), সংগম, সুতরাং, অনেক দিনের চেনা, শীতবিকেল (১৯৬৪), কার বউ, রাজা সন্ন্যাসী, কাগজের নৌকা (১৯৬৬), আয়না ও অবশিষ্ট, নয়নতারা (১৯৬৭), পিয়াসা (১৯৬৯), জীবন থেকে নেয়া, ছদ্মবেশী (১৯৭০) প্রভৃতি।
‘আসিয়া’ ভাল লেগেছিল এর সংগীতাংশের জন্য। আবহসংগীতেও অসাধারণ সৃষ্টিশীলতার প্রমাণ রেখেছেন আব্বাস উদ্দিন আহমদ। চরম নাট্যমুহূর্ত সৃষ্টিতে তিনি যে ভাবে ঢোলকে ব্যবহার করেছেন তা এখনও শুনতে পাই কানে। ‘কখনো আসেনি’ ভাল লেগেছিল নিরীক্ষাধর্মী আধুনিক মনমানসিকতার ছবি হিসেবে। ‘সূর্যস্নান’-এ নাসিমা খানকে কাজী খালেকের ধর্ষণদৃশ্যের শিল্পিত চিত্রায়ন মনে আছে এখনও। ছবিটি দেখতে মেয়ে কাজী সুরাইয়াকে মানা করেছিলেন কাজী খালেক। ‘নতুন সুর’-এর রোমান্টিকতা মুগ্ধ করেছিল আমাকে। তখন আমি ১৫ বছরের কিশোর। ‘সংগম’-এ দেখেছি অভিযাত্রী যৌবনের প্রাণোচ্ছল, আবার বেদনা-সুন্দর রূপায়ন। ‘সুতরাং’ অবাক করেছিল নায়ক হিসেবে সুভাষ দত্তের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করে। ছবিটির স্বপ্নদৃশ্যের পরিকল্পনা ও চিত্রায়নে ছিল মোহনীয় কবিত্ব। ‘অনেক দিনের চেনা’, ‘কাগজের নৌকা’, ‘ছদ্মবেশী’র রোমান্টিকতা মন ছুঁয়েছিল আমার। তিনটি ছবিকেই তখন মনে হয়েছে বেশ আধুনিক, স্মার্ট। ‘শীতবিকেল’-এ তুলে ধরা সমাজবাস্তবতা নানা বিষয়ে চোখ খুলে দিয়েছিল আমার। ‘কার বউ’ দেখে খুব হেসেছিলাম, মনে আছে। ‘রাজা সন্ন্যাসী’র নাটকীয়তা, ‘নয়নতারা’র অলৌকিকতা, ‘আয়না ও অবশিষ্ট’র বৈচিত্র্য উপভোগ করেছি। নীরব গভীর প্রেমের এক মর্মান্তিক পরিণতির ছবি ‘পিয়াসা’। রহমান ও সুচন্দা উভয়ই সম্ভবত জীবনের সেরা অভিনয় করেছেন এ ছবিতে। ‘জীবন থেকে নেয়া’ প্রেরণা দিয়েছে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে, আমাদের আত্মোৎসর্গকে।
ওই সময়ে আমার না দেখা বেশ কিছু ছবি সম্প্রতি দেখার সুযোগ পেয়েছি ডিভিডি হিসেবে বাজারে আসায়। আমার না দেখা আরও কিছু ছবি এখন পাওয়া যাচ্ছে অনলাইনে। যেমন - আখরি স্টেশন (১৯৬৫), চকোরি, ছোটে সাহাব (১৯৬৭), কুলি, চাঁদ আউর চাঁদনী, তুম মেরে হো (১৯৬৮), আনাড়ি (১৯৬৯), জ্বলতে সুরজ কে নিচে (১৯৭১) প্রভৃতি। ইচ্ছা আছে ডাউনলোড করবো ছবিগুলো।

আমার মামা

হাসান হাফিজুর রহমান নামটি আমাদের কাছে ছিল এক দ্রোহের প্রতীক। রক্তরাঙা একুশের লড়াই থেকে  স্বায়ত্তশাসনের দাবি তখন রূপ নিয়েছে স্বাধিকারের আন্দোলনে। শুরু হতে যাচ্ছে স্বাধীনতার সংগ্রাম। প্রজ্জ্বলিত পঞ্চাশ তখন সংগ্রাম-সচকিত ষাটে। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ (১৯৫৩) সঙ্কলনটি নিষিদ্ধ, কিন' গোপনে ছাপা হয়ে বাঁশ-কাগজের মলাটের আড়ালে আমাদের হাতে-হাতে। আর মুখে-মুখে তাঁর কবিতা ‘অমর একুশে’ -
    “... আবুল বরকত নেই: সেই অস্বাভাবিক বেড়ে ওঠা
    বিশাল শরীর বালক, মধুর স্টলের ছাদ ছুঁয়ে হাঁটতো যে
    তাঁকে ডেকো না;
    আর একবারও ডাকলে ঘৃণায় তুমি কুঁচকে উঠবে -
    সালাম, রফিকউদ্দিন, জব্বার - কি বিষণ্ন থোকা-থোকা নাম;
    এই এক সারি নাম বর্শার তীক্ষ্ণ ফলার মতো এখন হৃদয়কে হানে...”
    বলিষ্ঠ প্রকাশভঙ্গি আর সমকালীন বাস-বতা - তখনকার পাঠকদের প্রিয় এই দু’টি বৈশিষ্ট্য সবার থেকে আলাদা করেছিল হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতাকে। তবে ‘অমর একুশে’ কবিতাটির আবেদন ছিল তাঁর অন্য সকল রচনাকে ছাড়িয়ে। এ কবিতার শেষ দু’টি পঙ্‌ক্তির ইঙ্গিত বুঝে নিতে একটু বিলম্বও হয় নি কারও -
    “আজ তো জানতে একটুকু বাকি নেই মাগো,
    তুমি কি চাও, তুমি কি চাও, তুমি কি চাও।”
    এ আকুতি যে এক মুক্ত স্বাধীন স্বদেশের জন্য সে কথাও তখন বলাবলি হতো আমাদের মধ্যে। মা যে মাতৃভূমি আর তাঁর চাওয়া যে পূর্ণ স্বাধীনতা - এতে কোনও অস্পষ্টতা নেই কবি হাসান হাফিজুর রহমানের উচ্চারণে। এখানে ‘মা’ সম্বোধন থাকলেও কবিতার শুরুতে সম্বোধন ‘আম্মা’ -
    “আম্মা তাঁর নামটি ধরে একবারও ডাকবে না তবে আর?”
    এ নিয়ে নানা রকম বিতর্ক হয়েছে এ কবিতা প্রকাশের পর-পরই। অনেকে সামপ্রদায়িকতার গন্ধও পেয়েছে এতে। ভুল রাজনীতির কথাও বলেছে অনেকে। কিছু ব্যঙ্গ-বিদ্রূপও শুনেছি কথিত প্রগতিশীলদের কাছে থেকে। তারা বলেছে, ‘ওইটুকু পিয়াজের গন্ধ না থাকাই ছিল ভাল।’ কিন'  দেশকাল-জাতীয় বাস-বতা যে ‘মা’ সম্বোধনের চেয়ে ‘আম্মা’ সম্বোধনেই প্রকাশ পেয়েছে বেশি তা পরে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন সকলেই। বস'ত হাসান হাফিজুর রহমানের চেয়ে প্রগতিপনি' কবি ওই সময়ে কি ছিলেন কেউ - এ প্রশ্ন জাগেই। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে।
    হাসান হাফিজুর রহমানকে প্রথম দেখি ১৯৬৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে। নতুন সংখ্যা ‘কণ্ঠস্বর’ নিয়ে, সম্পাদক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গী হয়ে, গিয়েছিলাম ১ ডিআইটি এভিন্যু’র দৈনিক পাকিস-ান কার্যালয়ে। দোতলার কোণের রুমে তখন বসেন দুই সহকারী সম্পাদক কবি শামসুর রাহমান ও কবি হাসান হাফিজুর রহমান। সেদিন শামসুর রাহমানকেও দেখি প্রথম। দেখা হলেও খুব বেশি কথা হয় নি শামসুর রাহমানের সঙ্গে, তিনি ব্যস- ছিলেন সম্পাদকীয় লেখায়। আমাদের সময় দিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। চা খাওয়ালেন। চায়ের সঙ্গে ছিল সেকালের জনপ্রিয় ‘পারটেক্স’ বিসকুট। সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ নিয়ে কথা বলেন হাসান হাফিজুর রহমান ও সায়ীদ ভাই। আমার সঙ্গেও বলেন দু’ চার কথা। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। থাকি নাখালপাড়ায়। সায়ীদ ভাই কিছু দায়িত্ব দিয়েছেন ‘কণ্ঠস্বর’ প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট কাজে। পত্রিকায় নাম ছাপা হয় ‘সহকারী সম্পাদক’ হিসেবে। মাসে ৬০ টাকা বেতনও পাই।
    এর কিছু দিন আগে দৈনিক পাকিস-ানের সাহিত্য বিভাগে কবি আহসান হাবীব ছেপেছিলেন আমার দু’টি কবিতা একসঙ্গে - ‘শত্রু শত্রু’ ও ‘তিন নম্বর বাস’। সে কথা বলতেই খুব খুশি হয়ে গেলেন হাসান হাফিজুর রহমান। বললেন, এত দিন হাবীব ভাইয়ের কাছে তরুণ কবি ছিলেন ফজল শাহাবুদ্দীন। এখন হলে তুমি।
    সে সময় সপ্তাহে একদিন, বিশেষ করে মঙ্গলবার, অবশ্যই যেতাম হাবীব ভাইয়ের কাছে। কখনও কোনও লেখা নিয়ে, কখনও লেখা ছাড়াই - স্রেফ দেখা করা বা গল্প করার জন্য। তখন অফিসে থাকলে অবশ্যই দেখা করতাম হাসান হাফিজুর রহমানের সঙ্গে। খুব পান খেতেন তিনি, চা-ও খেতেন খুব। আপ্যায়নেও ছিলেন উদার।
    আহসান হাবীবের আদর-স্নেহ পাওয়ার পর আমার বন্ধুদেরও নিয়ে গিয়েছিলাম তাঁর সান্নিধ্যে। আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ, সেলিম আল-দীন সহ অনেককে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম তাঁর সঙ্গে। ওই সূত্রেই ওদের লেখা ছাপা হতে শুরু করে দৈনিক পাকিস-ানে। পরে হাসান হাফিজুর রহমানের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দেই ওদের। ফলে সপ্তাহে এক-দু’দিন দল বেঁধে আমরা যেতামই তাঁর কাছে। তখন দেখতে আমি ছিলাম সবার মধ্যে ছোটখাটো হালকা পাতলা। আমার মুখে ‘হাসান ভাই’ সম্বোধন যেন ঠিক মানায় না। একদিন সে কথাই বললেন হাসান হাফিজুর রহমান, ওরা বলে বলুক। তুমি বলো না।
    তাহলে কি বলবো আমি?
    হাসতে-হাসতে বললেন, তুমি বলবে মামা।
    সেই থেকে প্রকৃত অর্থেই আমার মামা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। আমার যাবতীয় ‘মামার বাড়ির আবদার’ চলতো তাঁর কাছে, তাঁর নামে ‘মামার জোর’ও খাটতো অনেকের কাছে। তাঁর ছোট ভাই খালেদ খালেদুর রহমান ও আমি ওই সুবাদেই ‘মামা’ সম্বোধন করতাম পরস্পরকে।
মামার দু’টি বই পাওয়া যেতো তখন - কবিতার বই ‘বিমুখ প্রান-র’ (১৯৬৩) ও প্রবন্ধ-সঙ্কলন ‘আধুনিক কবি ও কবিতা’ (১৯৬৫)। তবে পত্রপত্রিকায় তাঁর কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ ছাপা হতো নিয়মিত। ওই সময়কার লেখাগুলো পরে সঙ্কলিত হয়েছে তাঁর ‘আর্ত শব্দাবলী’ (কবিতা, ১৯৬৮), ‘আরো দুটি মৃত্যু’ (ছোটগল্প, ১৯৭০) ও ‘মূল্যবোধের জন্যে’ (প্রবন্ধ, ১৯৭০) বই তিনটিতে। তাঁর একটি কবিতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের মুখে-মুখে ফিরতো তখন। ‘পরমাদ’ নামের সে কবিতাটির কথা মনে করতে পারেন অনেকে -

মেয়েরা সব ধারালো-নখ উটকো পাখি
যতই চাই নির্বিবাদে বক্ষে রাখি
চালাক চোখে হঠাৎ আঁকে উড়াল ফাঁকি

হয়তো ওরা এ কদাকার হাওয়ার তোড়ে
মোটেই সুখ  পায় না খুঁজে বাহুর ডোরে
আঁতকে ওঠে কুরূপ-ঘোর মুখের ঘোরে

হয়তো হবেই তাতেই-বা কী! দুচোখ মেলে
দেহের ঘন ক্ষুধার রূঢ় অগ্নি জ্বেলে
আমি তো পুড়ি! কণ্ঠপোড়া গরল ঢেলে

পেতেছি রেখে ভীষণ গূঢ় জিঘাংসার ফাঁদ
প্রেম না পাই প্রতিহিংসা ঘটাবে পরমাদ ॥

মামার ‘আধুনিক কবি ও কবিতা’ বইটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের পাঠ্যসূচিতে অন-র্ভুক্ত ছিল রেফারেন্স বই হিসেবে। কবি-মহলেও বেশ আলোচিত ছিল এ বই তখন। সে আলোচনায় প্রশংসাই ছিল বেশি, আর সমালোচনার মধ্যে একটি ছিল বিদেশী নামের বাংলা উচ্চারণ নিয়ে। অভিযোগ ছিল, ওই উচ্চারণগুলো যথাযথ হয় নি। যেমন, ফার্লিংহেটি-কে তিনি লিখেছেন ফার্লিংঘেট্টি। একবার সাহস করে মামাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, লরেন্স ফার্লিংহেটিকে ফার্লিংঘেট্টি লিখেছেন কেন?
এক মারকিন বন্ধুর কথা বলেছিলেন তখন, অমন উচ্চারণই তাঁর মুখে শুনেছিলেন তিনি। কিছু দিন পর দ্বিতীয় সংস্করণ হয় বইটির। তাতে ‘ফার্লিংঘেট্টি’ অপরিবর্তিতই ছিল।
১৯৬৮ সালের দিকে দৈনিক পাকিস-ান উদ্যোগ নেয় রম্য মাসিক ‘বিচিত্রা’ প্রকাশের। সম্পাদক ‘ছায়াছন্দ’ বিভাগের সম্পাদক কবি ফজল শাহাবুদ্দীন। এক দিন ডেকে তিনি দু’টি ইংরেজি ফিচার দেন আমাকে। বলেন, তিন দিনের মধ্যে অনুবাদ করে দাও আমাকে।
ফিচার দু’টি ছিল এএফপি’র - এডওয়ার্ড অ্যালবি’র নাটকের চিত্ররূপ, মাইক নিকোলস্‌ পরিচালিত, লিজ টেলর ও রিচার্ড বার্টন অভিনীত হু’জ অ্যাফ্রেড অভ ভারজিনিয়া উলফ (১৯৬৬) এবং তখন নির্মীয়মান শেক্সপিয়ারের নাটকের চিত্ররূপ, ফ্রাঙ্কো জেফিরেলি পরিচালিত, লেওনার্ড হোয়াইটিং ও অলিভিয়া হাসি অভিনীত রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট (১৯৬৮) সম্পর্কে।
অনুবাদ পড়ে ফজল ভাই জিজ্ঞেস করেন, চাকরি করবে ‘বিচিত্রা’য়? মাসে ২০০ টাকা পাবে।
এরপর তিনি আমার চাকরির জন্য সুপারিশ করেন কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন' কে বা কারা আপত্তি করে বসেন আমার বিরুদ্ধে। অভিযোগ, আমি রাগি ছোকরা... স্বাক্ষর-কণ্ঠস্বর গোষ্ঠীর বেয়াদবদের একজন... ইত্যাদি, ইত্যাদি।
কিন- ধোপে টেকে না সে সব আপত্তি। কারণ জানতে পেরে মামা গর্জে ওঠেন, রীতিমতো গাল-মন্দ করেন তাদের নাম ধরে। ফলে পিছু হটে বিরোধীরা। আর চাকরি হয়ে যায় আমার। সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করতে থাকি মন-প্রাণ ঢেলে।
 ১৯৬৯’র গণঅভ্যুত্থানকালে দৈনিক পাকিস-ান-মরনিং নিউজ ভবনে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। এতে ক্ষতিগ্রস- হয় মুদ্রণ ও অন্যান্য বিভাগ। এ অবস'ায় বন্ধ হয়ে যায় ‘বিচিত্রা’। মামা তখন আমাকে বলেন পাকিস-ান লেখক সংঘের পত্রিকা ‘পরিক্রম’-এ যোগ দিতে। একই বেতন, একই পদ। ‘পরিক্রম’-এর সম্পাদক তখন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। এরপর অন্য ঘটনা, অন্য অভিজ্ঞতা।
মামা’র কথা এক বারে বলে ফুরাতে পারবো না, বলতে হবে আরও অনেক বার। মাঝে-মাঝে নানা লেখায় চলে আসে তাঁর প্রসঙ্গ। গভীর কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করি আমার জীবনে তাঁর যত অবদানকে। তিনি ছিলেন মহান মানুষ, মহৎ সাহিত্যিক। এমন মহামানবিক ব্যক্তিত্ব অল্প ক’জনই দেখেছি এ জীবনে। তবে তাঁর মূল্যায়ন হয় নি সে ভাবে। কেন হয় নি তা নিজেই তিনি বলে গেছেন:

যখন একদিন শোকসভায় উঠবো আমি,
করতালিতে নয়, অবিরাম দীর্ঘশ্বাসে
মুহূর্তেই জান-ব হয়ে যাবো ফের।
তোমরা বলবে বড্ড প্রয়োজনীয় ছিল লোকটা।
এখন দরকারের ফর্দে আছি উদ্বাহু, ফিরেও তাকাও না।
তোমরা বলবে, অপূরণীয় ক্ষতি হলো
লোকটার তিরোধানে।
এখন সকল ক্ষতি পুরিয়ে দিতে আছি এক পায়ে দাঁড়িয়ে
ফিরেও তাকাও না।
মড়া ছাড়া তোমাদের কিছুই রোচে না।
তোমাদের হিসেবি খাতায়
বীর নেই, শহীদ রয়েছে শুধু। (‘বীর নেই আছে শহীদ’, “আমার ভেতরের বাঘ”)

বৃহস্পতিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১১

জাতির অভ্যুদয় ইতিহাসে

“আমরা বিস্ময়-বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছি যে আমাদের পশ্চিম বাংলায় প্রতিদিনের জীবনে দেবমন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি ও শিশুকণ্ঠের কলহাস্যের ওপারে জীবন যখন সন্ত্রাসে ও গুপ্তহত্যায় মলিন ও বিড়ম্বিত হয়ে উঠেছে তখন ইতিহাসের কোন্‌ আশ্চর্য নির্দেশে আমাদের পূর্ব সীমান্তের ওপারে আমাদেরই ভাষা ও সংস্কৃতির আর এক অংশে দেশের সামগ্রিক জীবন এক আশ্চর্য ও অনির্বচনীয় মহিমায় ভাস্বর ও প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সে প্রায় আশ্চর্য ও দিব্য স্বপ্নের মতো, অথচ আজ তা দিবালোকের মতো প্রত্যক্ষ। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি - জীবলোকে যে প্রাণ জীবের শ্রেষ্ঠতম, প্রিয়তম সম্পদ, যে প্রাণকে শত বিরুদ্ধতা ও প্রতিকূলতার মধ্যে বাঁচিয়ে রাখা অমোঘ জীবধর্ম, সেই প্রাণের সম্মান রক্ষার অনিবার্য প্রয়োজনে একটি সমগ্র জাতি, সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যা সমন্বিত একটি জাতি, একান- অবহেলায়, অকাতরে, হাসিমুখে সামগ্রিক ভাবে নিজেদের প্রাণ নিঃশেষে দান করবার জন্য উদ্যত। সংখ্যা গণনার প্রায় অতীত সংখ্যায় প্রাণ ইতিমধ্যে নিবেদিত হয়েছে, বাকি প্রাণ নিবেদনের জন্য প্রস্তুত উন্মুখ। একেই বলে অভ্যুদয়। মানুষ জাতি উদিত হয় ইতিহাসের ক্ষেত্রে।”
    স্বাধীনতা ও মুক্তির রক্তাক্ত সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া বাংলাদেশের উদার অভ্যুদয়কে এভাবেই দেখেছিলেন মহান কথাশিল্পী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। উল্লিখিত অনুচ্ছেদটি তাঁর “বাংলা দেশের নূতন প্রকাশ মুহূর্তে” শীর্ষক ভাষণের প্রারম্ভিক অংশ। এ ভাষণ তিনি দিয়েছিলেন আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে, ১৯৭১ সালের এপ্রিলের এক রাত (বাংলাদেশ সময়) ০৮-৩০ মিনিটের বিশেষ অনুষ্ঠানে। ওই অনুষ্ঠানটি ছিল ধারাবাহিক। এতে ভাষণ দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষস্থানীয় কবি-সাহিত্যিক প্রায় সকলেই।
তখন আমরা শহর ছেড়ে গ্রামাঞ্চলে। ব্যর্থ হয়েছে আমাদের প্রতিরোধ। টাঙ্গাইলে ঢুকে পড়েছে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে মুসলিম লীগ, জামায়াত ইসলামী ও অন্যান্য স্বাধীনতাবিরোধী দল। জেলাশহরে ঘাঁটি গেড়ে তারা গড়ে তুলছে দোসর বাহিনী। চলছে অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ। তরুণ-যুবক ও হিন্দুদের প্রতিই তাদের যত রোষ। তবে রেহাই পাচ্ছে না অন্যরাও। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে সে সব বীভৎস পৈশাচিকতার বিবরণ। পথে-ঘাটে পরিচয়পত্র ছাড়া চলা যায় না। তারপরও কলেমা বলতে হয়, শিশ্ন দেখাতে হয়। বাড়ি-বাড়ি ওড়াতে হয় পাকিস্তানি পতাকা।
পাকুল্লা-নাটিয়াপাড়ার প্রতিরোধ যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিল হানাদার পাকিদের অনেকে। ওই যুদ্ধ সংগঠনে কিছু দায়িত্ব এসে পড়েছিল আমার ওপর। চেনাজানা সাবেক আনসার, পুলিশ, ইপিআর, সেনা বাহিনীর সদস্যদের একত্রিত করেছিলাম আমি। তাঁদের মধ্যে আমাদের আকুরটাকুর পাড়ার মোকাদ্দেস ভাই, ফজলু ‘মামা’ ও আরও কয়েকজন যোগ দিয়েছিলেন যুদ্ধে। আমার বাল্যবন্ধু বজ্র (কাদের সিদ্দিকী) নিয়েছিল সক্রিয় ভূমিকা। সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক ছিলেন আরজু ভাই (আবদুল লতিফ সিদ্দিকী), সভাপতি ছিলেন বদিউজ্জামান খান।
হানাদার পাকিদের ঠেকাতে যাঁরা অস্ত্র ধরেছিলেন, যাঁরা সংগঠিত হয়েছিলেন ও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের প্রতি তীব্র আক্রোশ ছিল দখলদার বাহিনীর। তাঁদের খোঁজ জানতে তৎপর ছিল তারা। এজন্য তাঁদের পরিবার-পরিজন আত্মীয়-স্বজনের ওপর চলতো অকথ্য নির্যাতন, বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দিয়ে লুটপাট করা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রাথমিক শক্তি সঞ্চয়ের পর গ্রামাঞ্চলের থানাগুলোকে ভিত্তি করে চারপাশে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতো পাকি ও তাদের দোসররা। কোথাও বাধা পেলে প্রবল শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তো সেখানে - চালাতো বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ, নৃশংস নির্যাতন। এক বামপনি' নেতাকে ধরতে পাছ চারান গ্রামে চলেছিল এমন এক বীভৎসতা। সেখানে ধর্ষণের শিকার হন জামায়াত-নেতা শহীদুল্লাহ’র এক বোন। তবে এর কোনও প্রতিবাদ করেন নি ওই নেতা। তিনি নাকি দোষ দিয়েছিলেন বোনকেই। বলেছিলেন, ও নিশ্চয়ই কোনও পাপ করেছিল... সেই পাপের খেসারত দিয়েছে!
প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রথম ধাক্কা সামলে ওঠার সময় তখন। প্রত্যন- অঞ্চলগুলোতে সংগঠিত হচ্ছে যোদ্ধারা। তাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে তরুণ-যুবকেরা। রাজনৈতিক সংগঠন ও অস্ত্রের প্রশিক্ষণ হয়ে উঠেছে অত্যন- জরুরি। আমি চলছিলাম দেলদুয়ার, বাসাইল, কালিহাতি থানার গ্রামাঞ্চল দিয়ে। পাহাড়ে সংগঠিত হয়ে উঠছে বজ্র - এ খবর চারদিকে। আমি যাবো ভাবছি... এর মধ্যে পৌঁছলাম ছোট বোন বকুলের শ্বশুরবাড়ি বাসাইলের ঢংপাড়ায়। সেখানেই এপ্রিলের ওই রাতে শুনি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণটি। কেবল তাঁর ভাষা নয়, তাঁর কণ্ঠ ও বলার ভঙ্গি গভীরভাবে আপ্লুত করে আমাদের। ওই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী সকল কবি-সাহিত্যিকের ভাষণই আবেগান্বিত করেছে আমাদের, কিন' কি যেন ছিল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে, উচ্চারণে। সেই অনিশ্চিত, পলায়নপর, উদ্যত সঙ্গীনের নিচে আতঙ্ক-বিহ্বল জীবনে - আমাদের বুক ঠেলে উথলে উঠে আসে কান্না - পরম এক আপনজনের স্নেহ ও মমতায়। বুঝি রবীন্দ্রনাথ কেন লিখেছেন, “ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি...!” এখনও শুনতে পাই সেই বেতার-ভাষণের হৃদয়স্পর্শী কণ্ঠ, এখনও সামলাই উদগত অশ্রু:
“এই বীর্যবত্তার ও অভ্যুত্থানের বোধ হয় কোনও তুলনা সমসাময়িক ইতিহাসে নেই। আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য, স্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য, আত্মরক্ষার জন্য সংগ্রাম বুঝি। সেখানে অস্ত্র দিয়ে অস্ত্রের মোকাবিলা হয়, অস্ত্রের বলে বলীয়ান শত্রুর সঙ্গে বীর অস্ত্র নিয়ে লড়াই করে। কিন্তু আজ আমাদের সীমান্তের ওপারে আমাদের ভাষাভাষী ভ্রাতা-ভগ্নীরা যে সংগ্রামে লিপ্ত সে সংগ্রাম একান-ভাবে অসম। এক পক্ষ, যারা বিদেশী, যারা শাসকরূপী শোষক তারা আধুনিকতম মারণাস্ত্রের ঐশ্বর্যে ও সজ্জায় পূর্ণ সজ্জিত; আর অপর পক্ষ, যাঁরা নদীমাতৃক ‘বাংলা দেশে’র মৃত্তিকার সন্তান, যাঁদের প্রাত্যহিক জীবনে লাঙল, পাঁচনলাঠি, কোদাল আর কাসে- ছাড়া অন্য যন্ত্র ও অস্ত্রের সংবাদ রাখতেন না, তাঁরা। তাঁরা আজ হাতের কাছে যে যা অস্ত্র পেয়েছেন তাই সম্বল করেই বুকে সাহস, মুখে হাসি নিয়ে এগিয়ে এসেছেন লড়াই দিতে। এই অসম সংগ্রামে কি ফল হতে পারে তা সম্পূর্ণ জেনে বুঝেই তাঁরা অগ্রসর হয়ে এসেছেন। এই আশ্চর্য বীর্যবত্তা, সাহস ও আত্মসম্মানবোধের পদপ্রানে- একজন বাঙালি লেখক হিসেবে নিঃশেষে প্রণাম নিবেদন করছি।”
এর কিছু দিন পর অল ইন্ডিয়া রেডিও দিল্লি কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়েছিল বাংলাদেশে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন জানাতে বিশ্ববাসীর প্রতি আবেদন। ইংরেজিতে লেখা সে আবেদনও ছিল এমন আবেগ-উদ্দীপ্ত। লিখেছিলেন ও পাঠ করেছিলেন কবি সৈয়দ আলী আহসান। তাঁর ভাষায়, শব্দচয়নে, কণ্ঠে, উচ্চারণে কি মহিমা যে ছিল... সেদিনও হৃদয়মথিত কান্নায় আপ্লুত হয়েছিলাম আমরা। মনে আছে রাত তখন ১২-০০টা। সখিপুর এলাকায় পাহাড়ের কাছে এক গ্রামের চকমিলানো আঙিনায় বসেছিলাম আমরা। মাথার ওপর ছিল বিশাল সুগোল চাঁদ। তবুও আক্রান- রক্তাক্ত মাতৃভূমির বেদনায় পুরো প্রকৃতি ছিল বিষাদ-স্তব্ধ। তার মাঝে ছড়িয়ে পড়া সেই ধীর গভীর উদাত্ত ভাষণের স্বরধ্বনি কোনও দিন ভুলে যাওয়ার নয়।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেছিলাম কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলনে। ১৯৫৭ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছিল সে সম্মেলন। তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। বয়স মোটে ১০। টাঙ্গাইল শহর থেকে অল্প দূরে কাগমারী। আমরা সকাল-বিকাল হেঁটেই চলে যেতাম সম্মেলনের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে। ওখানেই প্রথম দেখেছিলাম “পথের পাঁচালী” - ভারতীয় দূতাবাসের সৌজন্যে।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ওই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন ভারতীয় শিক্ষা প্রতিনিধি দলের অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে। এ দলের নেতা ছিলেন হুমায়ুন কবির। অন্যান্য প্রতিনিধি ছিলেন প্রবোধকুমার সান্যাল, নরেন্দ্র দেব, রাধারানী দেবী প্রমুখ। আমি চেষ্টা করেছিলাম তাঁদের অটোগ্রাফ নিতে।
ওই সময়ই পাড়া-স্কুল ছাড়িয়ে পুরো শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল আমাদের ক’জনের ‘বইপোকা’ নাম। পরিবারে অবশ্য কড়া শাসন ছিল ‘আউট বই’ পড়ার ব্যাপারে। তারপরও আমাদের হাতে-হাতে ছিল কলকাতার দেব সাহিত্য কুটীরের যাবতীয় শিশুতোষ বই, সঙ্কলন, বার্ষিকী। ওই সব প্রকাশনায় ওঁরা সবাই ছিলেন আমাদের প্রিয় লেখক-লেখিকা। এছাড়া চলচ্চিত্রের কারণেও নাম জানতাম তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রবোধকুমার সান্যালের। আমাদের শহরের সবেধন ‘কালী সিনেমা’য় সগৌরবে চলেছে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত “সন্দীপন পাঠশালা” (১৯৫০), “চাঁপাডাঙ্গার বউ” (১৯৫৪), “রাইকমল” (১৯৫৫) আর প্রবোধকুমার সান্যালের “মহাপ্রস্থানের পথে” (১৯৫২)। ওই পুঁচকে বয়সেই কয়েকবার করে দেখা হয়ে গিয়েছিল সেগুলো। তাই ভারতীয় শিক্ষা প্রতিনিধি দলের সবাই ছিলেন বইপত্র ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আমাদের অত্যন- প্রিয় ও পরিচিত।
তবে তাঁর এত ভালবাসার বাংলাদেশের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেন নি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই ভাষণের কয়েক মাস পর, ১৪ই সেপ্টেম্বর, মৃত্যুবরণ করেন তিনি। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র  যখন খবরটি প্রচার করে তখন বারবার মনে পড়ছিল তাঁর ওই বেতার-ভাষণের কথা। এখনও কোনও কথায় তাঁর প্রসঙ্গ উঠলে মনে পড়ে সে রাতের স্মৃতি, শুনতে পাই সেই কণ্ঠ:
“... এই যে একটি নিরস্ত্র, অস্ত্রসম্বলহীন জাতির নিজের ভূমিতে বিদেশী, সমরাস্ত্রসজ্জিত সামরিক শাসকরা, শাসিতের সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত দাবি ও সমস্ত অধিকার অস্বীকার করে, নির্বিচারে হত্যা, নির্যাতন ও অত্যাচারের বর্বরোচিত ও হীনতম অভিযান চালিয়েছে যার মধ্যে বাংলাদেশের নারীধর্ম ও নারীজীবনের ওপর পৈশাচিক অত্যাচারের কথা আছে যা সারা বিশ্বে প্রচারিত হয়েছে যার নিন্দা শুধু পশ্চিমবঙ্গেই ওঠে নি, সমগ্র ভারতবর্ষেই ধ্বনিত হয়েছে এবং হয়ে চলেছে তার সম্পর্কে সমগ্র বিশ্বের বিবেক, যা প্রতিটি জাতির কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়, সেই বিশ্ববিবেক নীরব কেন? সে ধিক্কারে সোচ্চার হোক!... এই মূঢ় ও বর্বর অভিযান রোধ করবার জন্য বিশ্বের যে হস্ত ন্যায়কে ধারণ করে থাকে, প্রলয়কালে পুরাণপুরুষের বেদধৃত হস্তের মতো, সেই হস্ত প্রসারিত হোক, সেই বিবেক তার রুষ্ট দৃষ্টি ক্ষেপণ করুক। অন্য দিকে ন্যায় যার পক্ষে, তাকে অভয় দেবার জন্য, রক্ষা করবার জন্য সেই বাণী সোচ্চার হোক, সেই বরাভয়ধৃত হস্ত উত্তোলিত হোক - তাদের মস্তককে স্পর্শ করুক।”
এ ভাষণের আট মাস পর বাংলাদেশের উদার অভ্যুদয়ের মাধ্যমে সার্থক হয়ে ওঠে এই অবিস্মরণীয় আবেদন, পূরণ হয় তাঁর স্বপ্ন-সাধ।

সোমবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১১

অপারেশন খুকরি

একাত্তরে সিলেট রণাঙ্গনে আহত হয়েছিলেন মেজর জেনারেল আয়ান কারদোজো (অব.)। ল্যান্ডমাইনের বিস্ফোরণে উড়ে গিয়েছিল তাঁর একটি পা। সেই বিপর্যয় জয় করেছিলেন তিনি। ভারতীয় সেনাবহিনীর প্রথম বিকলাঙ্গ কর্মকর্তা হিসেবে অধিনায়কত্ব করেছেন প্রথমে এক ইনফ্যানট্রি ব্যাটালিয়নের, পরে এক ব্রিগেডের।
    বীরত্বের জন্য সেনা পদকে ভূষিত জেনারেল কারদোজো এখন ‘রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল অভ ইনডিয়া’র চেয়ারম্যান। যুদ্ধদিনের স্মৃতি ও ইতিহাস নিয়ে তিনি লিখেছেন দু’টি মূল্যবান দলিলগ্রন্থ - “দ্য সিনকিং অভ আইএনএস খুকরি - সারভাইভরস্ স্টোরিজ ” এবং “পরম বীর - আওয়ার হিরোস্ ইন ব্যাটল”।
    সম্প্রতি বিশিষ্ট সাংবাদিক ক্লদ আরপি’র সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জেনারেল কারদোজো স্মৃতিচারণ করেছেন সিলেট রণাঙ্গনের সেই সব রুদ্ধশ্বাস দিন-রাতের। সেখানে অসম সাহসে লড়েছিল ফিফথ গোর্খা রাইফেলস্। সে যুদ্ধে তরুণ মেজর কারদোজো আর তাঁর সঙ্গীরা পালন করেছিলেন এক নির্ধারক ভূমিকা।
    সিলেট রণাঙ্গনে তাঁর নেতৃত্বাধীন ব্যাটেলিয়ন ‘ফিফথ গোর্খা রাইফেলস্’-এর অভিযান সম্পর্কে ক্লদ আরপি জানতে চাইলে তিনি বলেন:
“তখন আমি ছিলাম স্টাফ কলেজে, কোর্স করছিলাম একটা। আমার ব্যাটেলিয়ন আগেই চলে গিয়েছিল ফ্রন্টে। সেখানে এর মধ্যেই নিহত হয়েছেন সেকেন্ড ইন কমান্ড। এ অবস্থায় আর্মি ভাবছে, তাঁর জায়গায় পাঠানো যায় কাকে। চারদিকে খোঁজাখুঁজি করে তারা শেষে স্টাফ কলেজে খুঁজে পায় এই আমাকে। পদায়ন বাতিল করে আমাকে তখন পাঠানো হয় ফ্রন্টে।
স্ত্রী ও তিন পুত্র নিয়ে আমার পরিবার। তাদের বাড়িতে রেখে আসার অনুমতি দেয়া হয় আমাকে। তা-ই করি। ওদের বাড়িতে রেখে ট্রেনে দিল্লি ফিরে আসি ৩রা ডিসেম্বর।
যুদ্ধ তখন শুরু হয়ে গেছে, কিন্তু আমরা জানতাম না কিছু। যদিও মাথার উপরে দেখতাম জঙ্গি বিমানের ঘন-ঘন চক্কর, শুনতাম কান-ফাটানো গর্জন। দিল্লি তখন নিষ্প্রদীপ। পরদিন সকালে যাই পালাম বিমানবন্দরে, আসামে যাওয়ার প্লেন ধরতে। গিয়ে দেখি সহজ লক্ষ্যবস্তু হওয়ার আশঙ্কায় বাতিল করা হয়েছে সে ফ্লাইট।
তাড়াতাড়ি উঠে বসি ট্যাক্সিতে, ছুটি রেলস্টেশনে। ট্রেন তখন যাচ্ছে প্লাটফর্ম ছেড়ে, কোনও রকমে টানি চেন, তারপর উঠি গাড়িতে। পরদিন রাতে পৌঁছাই ধর্মনগর নামের এক জায়গায়।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর ঠিকাদারদের এক অদ্ভুত ব্যবস্থা আছে - যা পৃথিবীর অন্য কোনও দেশে নেই। যেমন, এক-একটি ঠিকাদার পরিবার আর্মির এক-একটা ইউনিটকে সেবা দিয়ে আসছে ১৫০ বছরেরও আগে থেকে। ধর্মনগরে অমন এক পরিবারের সদস্য অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। সে বলে, সাহেব, হসপিটাল ট্রেন আসছে। আমাদের ইউনিটের আহত অফিসাররা আছে ওই ট্রেনে। তাঁদের সঙ্গে আপনার দেখা করা উচিত।
ট্রেনে উঠে চারজন গুরুতর আহত তরুণ অফিসারকে দেখি আমি। এরপর উঠি এক জিপে। সারা রাত, তারপর সারা দিন সে জিপ চালিয়ে পৌঁছি আমার ব্যাটেলিয়নে।
সময়মতো আমার পৌঁছানো ছিল খুব জরুরি। কারণ ফিফথ গোর্খা রাইফেলস্ ছিল হেলিবোর্ন অপারেশনের অংশ, আর কমান্ডিং অফিসার (সিও, একজন কর্নেল) অপেক্ষা করছিলেন আমার জন্য। আমাদের যেতে হবে বাংলাদেশের ভেতরে।
নির্ধারিত স্থানে আমি পৌঁছাই রাত তিনটায়। চারটি হেলিকপটার তখন ওড়ার জন্য প্রস্তুত সেখানে। আরও চারটি বাংলাদেশের ভেতরে দায়িত্ব শেষ করে ফিরে আসার পথে। তিন জনকে দেখলাম দাঁড়িয়ে থাকতে। কাছে যেতেই একজন জিজ্ঞেস করেন, কে ওখানে? কে তুমি?
উত্তর দেই, আমি মেজর কারদোজো, স্যর।
তিনি বলেন, আমি জেনারেল রাও। (পরে চিফ অভ দ্য আর্মি স্টাফ কৃষ্ণ রাও)
সেখানে অন্য একজন ছিলেন আমার ব্রিগেড কমান্ডার, আরেকজন ছিলেন ইঞ্জিনিয়ারস্ কোরের একজন কর্মকর্তা। তাঁরা বলেন, সাবাশ! ঠিক সময়ে এসেছো।
হেলিকপটারে তখন ফিরিয়ে আনা হচ্ছিল আহতদের। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইতিহাসে সেই প্রথম আমরা যাচ্ছিলাম এক হেলিবোর্ন অপারেশনে।
স্টাফ কলেজে সেনা ও বিমান বাহিনীর অফিসারদের বসে এ ধরনের একটি অপারেশনের পরিকল্পনা করতে কেটে যায় দু’-তিন দিন। তাঁরা বিশদ ভাবে আলোচনা করেন রুট, অস্ত্র ও গোলাবারুদের যোগান ইত্যাদি সব কিছু নিয়ে। সেদিন সকাল ন’টায় মাত্র ব্যাটেলিয়নকে বলা হয়েছে, তোমাদের রওনা হতে হবে বিকাল আড়াইটায়। কিভাবে কি করবে সে পরিকল্পনা করে নাও এর মধ্যে। সকাল ১০টায় রেকি (রিকনিসনস্: তথ্যানুসন্ধান অভিযান) হবে একটা।
মনে পড়ছে, আটগ্রামে এক ব্যাটেলিয়ন পাকড়াও করতে অভিযান চালিয়েছিলাম আমরা। সাধারণত একটি ব্রিগেড (প্রায় ৩০০০ সৈন্য) পাকড়াও করে একটি ব্যাটেলিয়ন (প্রায় ৭৫০ সৈন্য)। আর সেদিন এক ব্যাটেলিয়নকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল এক ব্যাটেলিয়নকে পাকড়াও করতে, তা-ও আবার গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তা ছাড়া। অথচ অবিরাম গোলাবর্ষণের মুখেই শত্রুপক্ষ বাধ্য হয় মাথা নোয়াতে, তারপর শুরু করা যায় আক্রমণ।
আমার সিও প্রশ্ন করেছিলেন, কামানের সমর্থন ছাড়া কিভাবে আমার ব্যাটেলিয়নকে দিয়ে পাকড়াও করবো এক ব্যাটেলিয়ন? উত্তর এসেছিল, তোমার সামনে কোনও বিকল্প নেই। করতে হবে, এটাই কথা। আমেরিকান ও চীন ঢুকে পড়ার তালে আছে, সব অপারেশন জলদি শেষ করতে হবে আমাদের।
সিও অনুরোধ করেন, আমি দু’টি রাত চাই রেকি করতে।
প্রথম রাতে আমরা যোগাযোগ করি মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে। ওদের সঙ্গে মিশে স্লোগান দিতে থাকি, ‘জয় বাংলা! জয় বাংলা!’ পাকিস্তানি বাহিনী গুলিবর্ষণ শুরু করে সঙ্গে-সঙ্গে। ফলে ওদের এলএমজি (লাইট মেশিন গান) কোথায় তা বুঝতে পারি, ওদের মর্টারগুলিও দেখে ফেলি গোলাগুলির ঝলকে। একই কৌশল অনুসরণ করি পরের রাতেও। শত্রুপক্ষ এবার কম সতর্ক, গুলিবর্ষণও কম।
সিদ্ধান্ত হয় পরের রাতে আক্রমণ চালানোর। সিও নির্দেশ দেন, এ অভিযানে আমাদের অস্ত্র খুকরি (নেপালি বাঁকা ছোরা, ভোজালি, কুকরি)। আমরা ব্যবহার করবো শুধু খুকরি আর গ্রেনেড। ক্ষেতের ভিতর দিয়ে যাবে বাঙ্কারে, ভেতরে গ্রেনেড ছুড়বে, তারপর চালাবে খুকরি।
দুই তরুণ অফিসারের জোশ ছিল বেশি। সিও’র কথা শোনে নি তারা। সোজা গিয়ে হামলে পড়ে বাঙ্কারে। প্রাণ হারায় দু’জনেই - একজন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ও একজন ক্যাপটেন। তবে ৩২ শত্রুর ধড়-মুণ্ডু আলাদা হয়েছিল সেদিন।
সিও এসে দেখেন চারপাশে অনেক লাশ। তবে তিনি বুঝতে পারেন নি পাকিস্তানি সিনিয়র কোম্পানি কমান্ডার ভান করে আছে মরার। কাছে যেতেই তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় সে। সিও ঝাঁপিয়ে পড়েন তার ওপর। একজন আরেকজনকে চেপে ধরে গলা টিপে মারার চেষ্টা করে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে-খেতে। প্রথমে কিছুক্ষণের জন্য হকচকিয়ে যায় গোর্খারা, পরে তারা খতম করে পাকিস্তানি অফিসারকে।
ওই আটগ্রামের যুদ্ধে আমরা হারাই দু’জন অফিসার, তিনজন জেসিও (জুনিয়র কমিশনড্ অফিসার) ও তিনজন ওআর (আদার র‌্যাঙ্কস্)। গোলন্দাজ বাহিনীর সমর্থন ছাড়া এ ধরনের এক অভিযানে প্রাণহানি ঘটতে পারতো এর চেয়ে অনেক বেশি।
এরপর আমাদের সবচেয়ে উদ্যমী কমান্ডারদের একজন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল সগৎ সিং (কমান্ডিং ৪ কোর), নির্দেশ দেন, ফিফথ গোর্খাদের পাঠাও গাজিপুরে।
কেন? প্রথমে দিকে এক ব্যাটেলিয়ন পাঠানো হয়েছিল সেখানে। কাজ হয় নি। পরে পাঠানো হয়েছিল আরেক ব্যাটেলিয়ন। ব্যর্থ হয়েছে তারাও।
সগৎ সিং বলেন, এ কাজ পারবে ফিফথ গোর্খা।
আমাদের ব্যাটেলিয়নে প্রাণহানি ঘটেছে অনেক। নিহত হয়েছেন সেকেন্ড ইন কমান্ড। প্রাণ দিয়েছেন অনেক জওয়ান। সিও অনুরোধ করেন, আমাদের এখন বিরতি দেয়া উচিত।
সগৎ সিং বলেন, না।
ভারতীয় সেনাবাহিনী ঢাকা দখলের কথা ভাবে নি প্রথমে। কিন্তু অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে দ্রুত পরিবর্তন ঘটছিল পরিস্থিতির। শত্রুপক্ষের জোরদার অবস্থানকে পাশ কাটিয়ে দুর্বল অবস্থান ধরে এগিয়ে যাওয়ার কৌশলে কাজ দিচ্ছিল খুব। ফলে ঢাকা দখলের সম্ভাবনা হয়ে উঠেছিল সুস্পষ্ট।
সগৎ সিং বলেন, সবার আগে আমি পৌঁছতে চাই ঢাকায়।
কিন্তু তার আগে তো দখল করতে হবে সিলেট।
কিভাবে যাবো সেখানে?
উত্তর আসে, হেলিকপটারে।
কারা যাবে?
৪/৫ গোর্খা ব্যাটেলিয়ন।
সিও বলেন, আমি অনেক অফিসার হারিয়েছি হতাহত হওয়ার কারণে।
সগৎ সিং বলেন, তোমাকে যেতেই হবে। ওখানে পাকিস্তানি ২০২ ব্রিগেড ছিল, এখন নেই - চলে গেছে ঢাকায়। মাত্র ২০০-৩০০ রাজাকার আছে। কি সমস্যা তোমার?
তখন আমাদের ব্যাটেলিয়নে সৈন্য ছিল মাত্র ৪৮০ জন।
৭ই ডিসেম্বর হেলিকপটারে রেকি করতে যান ব্রিগেড কমান্ডার সহ ক’জন। ফিরে এসে তাঁরা বলেন, শত্রুদের কোনও তৎপরতা নেই, কোনও গোলাগুলি নেই। সবাই মনে করে কোর কমান্ডারের কথাই ঠিক, শত্রুদের কেউ নেই ওদিকে।
অফিসারদের বলা হয়, জলদি তৈরি হয়ে নাও। আমাদের হাতে তখন না ছিল সময় পরিকল্পনা আঁটবার, না ছিল সময় কৌশল বাতলাবার। হুকুম ছিল সোজাসাপটা - “দখল করো এলাকা, তারপর এগিয়ে যাও, ছড়িয়ে পড়ো ক্রমে!”
সিলেটে প্রথম অভিযানে গিয়ে তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ি আমরা। তখন জানতাম না, ২০২ ব্রিগেড ঢাকা না গিয়ে ওখানেই ছিল। ওদিক থেকে কামান-মর্টারের গোলা আসছিল প্রচুর, কিন্তু ভেবেছি একটি ব্যাটেলিয়নই হবে। বুঝতে পারি নি ওটা ছিল একটি ব্রিগেড।
শেষ অভিযানে যাই আমি। আমার কোমপানির ‘জনি’ (জওয়ান)-রা আমার নাম ‘কারদোজো’ উচ্চারণ করতে পারতো না ঠিকমতো। ওরা বলতো ‘কারতুস সাহিব’।
হেলিকপটারগুলো নামার পর প্রতিটি হেলিকপটার খুঁজে ওরা বের করে আমাকে, তারপর উল্লাস করতে থাকে শূন্যে গুলি ছুড়ে। শত্রুপক্ষের গোলাগুলি আসছে, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ ছিল না ওদের। আমাকে কাঁধে তুলে নিয়ে ওরা চেঁচামেচি করতে থাকে, কারতুস সাহিব এসে গেছেন... সঙ্গে আছেন... চলো এখন সামনে যাই!
সিও’র সঙ্গে দেখা করতে যাই সেখান থেকে, আমাকে দেখে তিনিও খুশি হন খুব।
শুরু হয় লড়াই। কিছুক্ষণের মধ্যে ১০০০ বাই ১৫০০ মিটার জায়গা আসে আমাদের অধিকারে। সিও বলেছিলেন, শক্তি বাড়াতে আমাদের সঙ্গে সংযুক্তি (লিঙ্ক-আপ) ঘটবে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে। প্যারা-কমান্ডোদের জন্য অবশ্যই সংযুক্তি ঘটাতে হবে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে, নাহলে খতম হয়ে যাবে তারা।
কোনও খাবার ছিল না আমাদের সঙ্গে। ছিল শুধু অস্ত্রশস্ত্র, কিছু গ্রেনেড, এক মুঠো শাকরপরা (মিষ্টি গোল্লা), একটি ব্যান্ডেজ, এক বোতল পানি, আর মাটিতে পেতে ঘুমাবার জন্য একটা বরসাত্তি। কম্বল নেই, কাপড় নেই, জুতা নেই, আর কিচ্ছু নেই।
সে সময় যুদ্ধের খবর প্রচার করতো বিবিসি, আকাশবাণী (অল ইনডিয়া রেডিও) ও রেডিও পাকিস্তান। কেউ বিশ্বাস করতো না রেডিও পাকিস্তানের খবর। অল ইনডিয়া রেডিও খবর দিতো সব সময় দু’ দিন পর, কারণ সেনা সদর দপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া যুদ্ধের কোনও খবর প্রচার করতে পারতেন না তাঁরা। কিন্তু বিবিসি খবর দিতো ঘটনাস্থল থেকে। তাঁদের রণাঙ্গন সংবাদদাতারা ছিল অত্যন্ত নিবেদিত, আর বিভিন্ন অভিযানের খবর সংগ্রহের ব্যাপারে বিশেষ অনুমতি দেয়া হয়েছিল তাঁদের।
আমরা সবাই শুনতাম বিবিসি। সেদিন আমরা শুনলাম, ‘এক ব্রিগেড গোর্খা সৈন্য সিলেটে নেমেছে।’
সিও-কে বললাম, স্যর, পাকিস্তানিরা বিবিসি শোনে, আমরাও বিবিসি শুনি। ওরা ওখানে আছে এক ব্যাটেলিয়নের বেশি, কাজেই আমরা যেন একটি ব্রিগেড সে রকমই ভান করি। ব্রিগেডের মতো করেই ছড়িয়ে পড়ি ব্যূহ থেকে।
এতে ঝুঁকি ছিল একটি। আলাদা-আলাদা ভাবে টার্গেট নিয়ে আমাদের খতম করতে পারে ওরা। তাহলেও ঝুঁকিটা নিয়ে ফেলি আমরা।  কোম্পানিগুলোর ফাঁক ভরাতে এলএমজি বসাই এমন ভাবে যেন শত্রুরা ধরতে না পারে চালাকিটা।
একদিন এক পাকিস্তানি সামরিক যান আসছিল আমাদের দিকে। সেটাকে আক্রমণ চালিয়ে টেনে বের করি অফিসারদের, তারপর চালিয়ে দেই খুকরি। এর পর আরও চাপ বাড়ে আমাদের ওপর। মনে হয়, আমাদের খতম করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ওরা। এ অবস্থায় পরের ক’দিন ধরে অব্যাহতভাবে চলতে থাকে অপারেশন।
দিনের বেলায় বিমান বাহিনীর সমর্থন পেতাম আমরা। হানটার ও মিগগুলো তছনছ করে দিতো শত্রুদের আক্রমণ। রাতে আমাদের মতো করেই চালাতে হতো আমাদের যুদ্ধ।
একদিন এক পাকিস্তানি সন্ধানী দল ঢুকে পড়ে আমাদের কোম্পানিগুলোর মধ্যে। আমরা বুঝতে পারি, ওরা টের পেয়েছে আমরা এক ব্রিগেড নই। তখন আমাদের গুলি-গ্রেনেড প্রায় শেষ। সিদ্ধান্ত নেই, ব্যাটেলিয়ন হিসেবে আবার একত্র হয়ে লড়ে যাবো মরণপণ করে।
সন্ধ্যার দিকে প্রত্যাহার করা হয় কোম্পানিগুলোকে, যাতে আমাদের নড়াচড়া দেখতে না পায় শত্রুরা।
এক কোম্পানি চলে আসে ঠিকঠাক, কিন্তু আরেক কোম্পানি আগেভাগে চলে আসায় নজরে পড়ে যায় শত্রুপক্ষের। সিও ও আমি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখছিলাম সন্ধ্যার অন্ধকারে ওদের ফিরে আসা। হঠাৎ শুনি, আল্লাহু আকবর, চার্জ!
সঙ্গে-সঙ্গে খুকরি উঁচিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় গুর্খারা, গর্জন করে ওঠে, আইও গুর্খালি!
কি লড়াটাই না লড়লো তারা! একসময় চিৎকার, যুদ্ধের হুঙ্কার থামে, নেমে আসে নিস্তব্ধতা। কোম্পানি চলে আসে আমাদের কাছে। পাঁচ-ছ’জনের খোঁজ মেলে না, দূর থেকে ভেসে আসে আহতদের গোঙানি।
আমাদের সঙ্গে পাকিস্তানিদের একটা অঘোষিত চুক্তি ছিল - আমাদের লোক নিয়ে আসতাম আমরা, একই কাজ ওরা করতো ওদের ছোকরাদের দিয়ে।
যুদ্ধ চলে পরদিনও। কিন্তু জেনারেল (পরে ফিল্ড মার্শাল) স্যাম মানেকশ’ চরমপত্র দিয়েছিলেন পাকিস্তানকে, আত্মসমর্পণ করো নাহলো সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করবো তোমাদের।
১৫ই ডিসেম্বর সকালে সাদা পতাকা হাতে ওদের ১৫০০ জন (আমরা ছিলাম ৪৮০ জন) বেরিয়ে আসে। কোম্পানি কমান্ডাররা জিজ্ঞেস করে সিও-কে, ওরা তো সংখ্যায় অনেক বেশি, এখন কি করবো আমরা?
সিও বলেন, ওদের প্রতিনিধি ক’জনকে আসতে দাও। তবে ওরা যদি জানতে পারে আমরা মোটে ৪৮০ জন, তাহলে অন্য মূর্তি ধরতে পারে।
প্রতিনিধিরা এলে সিও বলেন, তোমাদের আত্মসমর্পণ গ্রহণের আদেশ এখনও পাই নি আমরা। বরং আগামীকাল আসো তোমরা।
তারা বলে, আমরা এখনই আত্মসমর্পণ করতে চাই।
সিও বলেন, না। আগামীকাল আসো।
আমরা ব্রিগেড কমান্ডারকে রেডিও মারফত বলি (তামিল ভাষায়), ভগবানের দিব্যি, এখানে এসে আত্মসমর্পণ গ্রহণ করুন।
পরদিন সকালে পাকিস্তানিরা আসে আবার। এর মধ্যে হেলিকপটারে এসেছেন ব্রিগেড কমান্ডার। পাকিস্তানিরা জিজ্ঞেস করে তাঁকে, আপনি এলেন কোথা থেকে?
তিনি বলেন, অমুক আর অমুক জায়গা থেকে।
পাকিস্তানিরা জানতে চায়, এখানে কি এটা, ব্রিগেড?
তিনি বলেন, একটা ব্যাটেলিয়ন মাত্র।
মাত্র একটা ব্যাটেলিয়ন? বিশ্বাস করতে পারে না ওরা। আমরা যে একটা ব্রিগেড নই তা ওরা বুঝতে পারে নি কখনও। তাদের জন্য এটা ছিল এক বিরাট বিস্ময়।
বিস্ময় ছিল আমাদের জন্যও। আমরা ভেবেছিলাম ওরা একটি ব্রিগেড, তখন দেখি দু’টি ব্রিগেড (২০২ ও ৩১৩ ইনফ্যানট্রি ব্রিগেড)! ফলে আমরা আত্মসমর্পণ গ্রহণ করি তিনজন ব্রিগেডিয়ার, একজন পূর্ণ কর্নেল, ১০৭ জন অফিসার, ২১৯ জন জেসিও আর ৭০০০ সৈন্যের।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল  এ এ কে নিয়াজি (কমান্ডিং দ্য পাকিস্তান আর্মি ইন ঈস্ট পাকিস্তান) আদেশ দিয়েছিলেন, ঢাকা প্রতিরক্ষার জন্য সিলেটকে মজুত থাকতে হবে। যেদিন আমরা যাই সেদিনই পাকিস্তানি দ্বিতীয় ব্রিগেডটি নেমেছিল সিলেট রণাঙ্গনে। আমরা আসলে একসঙ্গে লড়েছি দু’টি ব্রিগেডের সঙ্গে।
যাহোক, আমরা তখন কাহিল ছিলাম ঠাণ্ডায়। তাই এক পাকিস্তানি জেসিও-কে জিজ্ঞেস করি, সাব, আপ কে পাস কম্বল হ্যায় স্টোর মেঁ?
হাঁ সাহিব।
আমি বলি, ম্যয় আপ কো রিসিপ্ট দে দুঙ্গা। আমার লোকদের জন্য কম্বল দিতে পারেন?
কম্বল নাহিঁ লায়ে,  সাব?
হাম শোনে কি লিয়ে নাহিঁ আয়ে, আপ কো বরবাদ করনে কে লিয়ে আয়ে।
আমার খোঁচাটা হজম করে সে। পরে আমি বলি, আগার কুছ কম্বল রহে যাতে হ্যায়, হামারে অফসার সাহিবা কো দে সাকতে হ্যায়?
কেয়া বাত করতে হ্যায় সাব, আফসার সাহিবা ভি কম্বল নাহিঁ লায়ে?
তখন আমি বলি, সাব, আগার জওয়ানো কে পাস কম্বল নাহি হ্যায়, তো অফসার সাহিবা কে লিয়ে কম্বল কেয়সে হো সকতা হ্যায়?
সে অ্যাটেনশন হয়ে স্যালুট করে আমাকে, বলে, জনাব, আগার হামারি ফৌজ মেঁ ভারত যেয়সা অফসার হোতে, ইয়ে দিন হামনে দেখনা থা!”

রবিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১১

টাইমস্ অব ইন্ডিয়া’র রিপোর্ট: বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক কে?

অনুরাধা শর্মা: বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছে ৪০ বছর আগে। কিন্তু এখনও একটি বিতর্ক চলে আসছে যার সন্তোষজনক উত্তর নেই। দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন কে? শেখ মুজিবুর রহমান না জিয়াউর রহমান? এ প্রশ্নের উত্তর বাংলাদেশীদের কাছে দু’রকম, বিশেষ করে রাজনৈতিক মতাদর্শ অনুযায়ী। আওয়ামী লীগ, তথা সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী - ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ গ্রেপ্তার হওয়ার আগে মুজিবুরই প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এ দিনটি পালিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে। বিরোধী দল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), দাবি করে সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা করেন ২৭শে মার্চ। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকায় আক্রমণ চালায়, শেষ রাতের দিকে তারা গ্রেপ্তার করে মুজিবুরকে। এর আগেই, ২৬শে মার্চ, তিনি ‘আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ স্বাক্ষর করেন বলে উল্লেখ করা হয়। ২৭শে ও ২৮শে মার্চ রেডিওতে জিয়াউরের কণ্ঠ শুনতে পায় দেশবাসী। তিনি ঘোষণা করেন:
"This is Swadhin Bangla Betar Kendro. I, Major Ziaur Rahman, at the direction of Bangobondhu Sheikh Mujibur Rahman, hereby declare that the independent People's Republic of Bangladesh has been established. At his direction, I have taken command as the temporary head of the republic. In the name of Sheikh Mujibur Rahman, I call upon all Bengalis to rise against the attack by the West Pakistani army. We shall fight to the last to free Our motherland."
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও ভাইস প্রেসিডেন্ট বিএনপি নেতা মওদুদ আহমেদ বলেন, আমি ছিলাম সিলেটের এক চা বাগানে। তখন শুনি মেজর জিয়ার ঘোষণা। তার ঘোষণাই সবাই শুনেছে। শেখ মুজিবের ঘোষণা কেউ শোনে নি।
প্রত্যুত্তরে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মতিন খসরু বলেন: এ বিতর্ক তাদের (বিএনপির) সৃষ্টি। এর নিষ্পত্তি এর মধ্যে হয়ে গেছে সুপ্রিম কোর্টে। শেখ মুজিব ছিলেন অবিসংবাদিত জাতীয় নেতা, তিনি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছিলেন ২৬শে মার্চ। জিয়াউর ছিলেন সেনাবাহিনী একজন মেজর মাত্র, কোন নেতা ছিলেন না। অমন একটি ঘোষণা দেয়ার মতো অবস্থান তার ছিল না। তিনি অমন দাবিও করেননি। ১৯৮১ সালে তার মৃত্যুর পর বিএনপি এই বিতর্ক শুরু করে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি মুজিব-কন্যা, আর বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া, যিনি জিয়াউর রহমানের বিধবা পত্নী, এ বিতর্ককে জাগিয়ে রেখেছেন।
তবে যে বিষয়টি অনস্বীকার্য,  আকস্মিক হামলায় হতভম্ব জাতিকে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ওই বেতার ঘোষণাটিই ছিল তূর্যধ্বনি, সেদিনের সেই রুখে দাঁড়ানো থেকেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর।

সোমবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১১

হিটলার

হিটলার। এ নাম কেবল নাম নয়, নামের অধিক কিছু। এ নাম কেবল জার্মান নাৎসি নেতা আডলফ হিটলার-এর নাম নয়, পৃথিবীর প্রায় সকল ভাষায় বিশেষ অর্থে স্থান করে নেয়া এক ভয়-দেখানো  দুঃস্বপ্নের নাম। হিটলার অর্থ ডিক্টেটর, একনায়ক। হিটলার-এর সমার্থক স্বৈরশাসক, বলদর্পী। বিশ্ব-ইতিহাসে এ নাম প্রতীক হয়ে আছে ক্ষমতার দম্ভ, ক্রূরতা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, নিধনযজ্ঞ সহ সকল অপ ও অশুভর।
    গত শতকের তিরিশ দশকে ক্ষমতার শীর্ষে হিটলারের যাত্রা শুরু নির্বাচনী ষড়যন্ত্র-কারচুপির মাধ্যমে, তারপর চূড়ান্তসীমায় পৌঁছে দেখা দেন এক ক্ষ্যাপা নাৎসি ফুয়েরার (নেতা) হিসেবে। ১৯৩৩ সালের জানুয়ারিতে চ্যান্সেলর (সরকার-প্রধান, প্রধানমন্ত্রী) হওয়ার পর নিজের গণতান্ত্রিক অবস্থানকে ক্রমে পরিণত করেন একনায়কীয় শক্তিতে। সাধারণ নির্বাচন আহ্বান করেন, তারপর রাইকস্টাগ (পার্লামেন্ট)-এ অগ্নিকাণ্ডের সুযোগ নিয়ে রাইকস্টাগকে দিয়ে পাস করান এনাব্লিং অ্যাক্ট (জনসাধারণ ও রাইক-এর সঙ্কট মোচন আইন)। এই ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করে নিজের ইচ্ছামতো আইন প্রণয়ন করতে থাকেন হিটলার, গঠন করেন গেসটাপো (গোপন রাষ্ট্রীয় পুলিস) বাহিনী, ট্রেড ইউনিয়ন ও সকল বিরোধী দল নিষিদ্ধ করেন, শেষে নাইট অভ দ্য লং নাইভস (অপারেশন হামিংবার্ড)-এর মাধ্যমে নিজের নাৎসি পার্টির ভিন্নমতাবলম্বীদেরও খতম করেন নিষ্ঠুরতার সঙ্গে। প্রেসিডেন্ট পল ফন হিনডেনবুর্গ মারা গেলে নিজেকে ফুয়েরার ঘোষণা করেন হিটলার। তাঁর চরম একনায়ক হওয়ার পথে ছিল আটটি পদক্ষেপ। সেই ‘নষ্ট অষ্ট’ হচ্ছে -
রাইকস্টাগে অগ্নিকাণ্ড, ২৭শে ফেব্রুয়ারি ১৯৩৩: রাইকস্টাগ ভস্মীভূত হয়। দেশলাই ও আগুন ধরানোর সরঞ্জাম সহ হাতেনাতে ধরা পড়ে ভান ডের লুবে নামের এক ডাচ কম্যুনিস্ট। এ ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে বহু কম্যুনিস্ট প্রতিপক্ষকে গ্রেপ্তার করেন হিটলার, পরের মাসে সাধারণ নির্বাচনে ঘটনাটিকে তিনি করে তোলেন অন্যতম প্রধান ইস্যু। অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপারে তখন অনেকে বলেছেন, এ কাজ নাৎসিরা করে দোষ চাপিয়েছে কম্যুনিস্টদের ঘাড়ে। একালের ঐতিহাসিকরা অবশ্য মনে করেন, ভান ডের লুবে-ই ধরিয়েছিল আগুন, হিটলার এ থেকে ফায়দা লুটেছে মাত্র।
    সাধারণ নির্বাচন, ৫ই মার্চ ১৯৩৩: সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করে হিটলার জার্মান জাতির কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন, ‘আমাকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিন।’ কিন্তু নাৎসি পার্টি ভোট পায় মাত্র ৪৪%, ফলে রাইকস্টাগে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ব্যর্থ হন হিটলার। তখন ৮১জন কম্যুনিস্ট ডেপুটিকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে ঢোকান তিনি। আর এভাবে অর্জন করেন সংখ্যাগরিষ্ঠতা। রাইকস্টাগ-এর স্পিকার হন হেরমান ভিলহেলম গোয়েরিং।
    এনাব্লিং অ্যাক্ট, ২৩শে মার্চ ১৯৩৩: রাইকস্টাগ নিজস্ব আইন প্রণয়নের ক্ষমতা তুলে দেয় হিটলারের হাতে। বিরোধী ডেপুটিদের ভেতরে যেতে বাধা দেয় নাৎসি ঝটিকা বাহিনী। যাঁরা বিরুদ্ধে বলার সাহস করেন তাঁদের রীতিমতো মারধর করে তারা। এনাব্লিং অ্যাক্ট আইনসম্মত ভাবেই জার্মানির ডিক্টেটর করে তোলে হিটলারকে।
    স্থানীয় সরকার, ২৬শে এপ্রিল ১৯৩৩: স্থানীয় সরকার ও পুলিসের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে নাৎসিরা। এর পর শুরু করে বিরোধী মতাবলম্বী শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের অপসারণ। গেসটাপো বাহিনী গঠন করে হিটলার নানা ভাবে উৎসাহ দিতে থাকেন জার্মানদের - যাতে বিরোধী ও অসন্তুষ্টদের চিনিয়ে দেন তাঁরা। লাখ-লাখ ইহুদি, কম্যুনিস্ট, প্রোটেস্টান্ট, যিহোভা’স উইটনেস, জিপসি, সমকামী, মদ্যপ ও যৌনকর্মীদের গ্রেপ্তার করে পাঠানো হয় নির্যাতন শিবিরে। নাৎসি-বিরোধী দেয়াল লিখন, নিষিদ্ধ বই ঘরে রাখা, এমনকি ‘ব্যবসা ভাল চলছে না’ বলাটাও ছিল গুরুতর অপরাধ। এ সব কারণেও আটক করে নির্যাতন শিবিরে পাঠানো হতো নির্বিশেষে।
    ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধ, ২রা মে ১৯৩৩: ট্রেড ইউনিয়নগুলোর সব অফিস বন্ধ ও তহবিল বাজেয়াপ্ত করে নেতাদের ঢোকানো হয় জেলে। জার্মান লেবার ফ্রন্ট-কে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেন হিটলার। শ্রমিকদের মজুরি হ্রাস ও ধর্মঘটের অধিকার হরণ করে তারা।
    রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ, ১৪ই জুলাই ১৯৩৩: রাজনৈতিক দল গঠন বিরোধী আইন ঘোষণা করে - নাৎসি পার্টি-ই জার্মানির একমাত্র রাজনৈতিক দল। অন্য সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ওই সব দলের নেতাদের ঢোকানো হয় জেলে।
    নাইট অব দ্য লং নাইভস্, ৩০শে জুন ১৯৩৪: স্টারমাবটেইলিং (সংক্ষেপে এসএ) বা ঝটিকা বাহিনী ছিল গুন্ডাপান্ডাদের দল। তাদের ব্যবহার করে ক্ষমতায় ওঠেন হিটলার। তারা হামলা চালাতো বিরোধীদের ওপর, আর হামলা ঠেকাতো হিটলারের সভায়। ১৯৩৪ সালে নাগাদ তাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১০ লাখেরও বেশি।
    হিটলার কেন চড়াও হয়েছিলেনএসএ-র ওপর তা এখনও এক বিস্ময় হয়ে আছে ইতিহাসবিদদের কাছে। তবে ১৯৩৪ সালে তিনি যখন ক্ষমতায় তখন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ নেই, বিরোধীরাও সমূলে নির্মূল। এসএ-র কোনও উপযোগিতা নেই তখন, বরং নানা রকম বিরক্তি-বিড়ম্বনার কারণ। এছাড়া তাদের নেতা আর্নস্ট রোম চাইছিলেন সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব নিয়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটাতে। ১৯৩৪ সালের ৩০শে জুন রাতে এসএ-র চার শতাধিক নেতা-কর্মীকে হত্যার নির্দেশ দেন হিটলার। তাঁর ওই নির্দেশ পালন করে স্কুৎসস্তাফেল (সংক্ষেপে এসএস) বা প্রতিরক্ষা বাহিনী। এ হত্যা-অভিযানের সাঙ্কেতিক নাম ছিল ‘হামিংবার্ড’।
    ফুয়েরার, ১৯শে আগস্ট ১৯৩৪: প্রেসিডেন্ট পল ফন হিনডেনবুর্গ মারা গেলে হিটলার গ্রহণ করেন প্রেসিডেন্ট ও সৈন্যবাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব। হিটলারের জন্য প্রয়োজনে মৃত্যু বরণের শপথ নিতে হতো সৈন্যদের। এরপর হিটলার নিজেকে ঘোষণা করেন ‘ফুয়েরার’ (মহান নেতা)।
    হিটলার বুঝেছিলেন, সরকারের বাইরে থেকে বিপ্লব ঘটিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে - যেতে হবে বৈধ পথেই, আইনসম্মতভাবে, গণতান্ত্রিক বিধিবিধান যেটুকু যা আছে সেগুলোকেই কাজে লাগিয়ে। তবে ওই উচ্চাভিলাষ পূরণ করে চূড়ান্ত একনায়ক হওয়া তাঁর পক্ষে যে সম্ভব হয়েছিল শেষ পর্যন্ত সেজন্য বেশি দায়ী জার্মানির নাৎসিবাদ-বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ হতে না পারা। তাদের অনৈক্যই শক্তি যুগিয়ে হিটলারকে করেছে ডিক্টেটর।

শনিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১১

সামনের চল্লিশ বছর

বিজয়ের পর চল্লিশ বছর কেটেছে, কিভাবে কেটেছে সবাই জানেন, তাই পিছন ফিরে আর তাকিয়ে দেখছি না, পিছনকে নিয়ে ভাবছি না। রাজনীতিকরা, বুদ্ধিজীবীরা অনেক কথা বলেন, কিন্তু আমরা নিজেরাই তো সব কিছু জানি। আমরা সবাই তো প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী। কে কি করেছেন, কিভাবে কি হয়েছে - তার অনেক কিছুই তো অজানা ছিল না, আর  সে সব কিছু ভুলেও যাই নি এখনও। সত্তর দশকে কেমন ছিল আওয়ামী লীগ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর সম্পর্ক? আওয়ামী লীগ সরকারের রক্ষীবাহিনী আর জাসদ-এর গণবাহিনী মেতেছিল খুনোখুনির খেলায়। এখন দুই দলের নেতাকর্মীরা ঐক্যসূত্রে গ্রথিত, মহাজোটবদ্ধ। কিন্তু সহিংস রাজনীতির বলি সেই শ’-শ’ তরুণের রক্তদান, আত্মদান তো ভুলি নি আজও। ১৯৭২-৭৬ সালে ছিলাম টাঙ্গাইলের করটিয়ার সা’দত কলেজের অধ্যাপক। ওই তরুণদের অনেকেই তখন ছিল আমার ছাত্র। তাদের অনেকের মুখ এখনও ভাসে চোখের সামনে। বৃথা গেছে কি ওদের জীবনোৎসর্গ? আশির দশকেও দেখেছি নূর হোসেন, জেহাদ, ডা. মিলন ও আরও অনেকের প্রাণদান। তখন ছিলাম অবিভক্ত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)-এর কোষাধ্যক্ষ।  সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের সংগ্রামে ছিলাম সামনের সারিতে। ভূমিকা ছিল আরও। কবি-সহজনদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলাম জাতীয় কবিতা পরিষদ। গণতন্ত্রকে মুক্ত করার সেই লড়াইয়ে শামিল ছিলাম আগাগোড়া। কাছে থেকে দেখেছি দমন-নির্যাতন, যুক্ত থেকেছি প্রতিরোধ-সংগ্রামে। কিন্তু কি হয়েছে সেই দশকব্যাপী কষ্টযন্ত্রণার? সেই মায়ের অশ্রুধারার, সন্তানের রক্তস্রোতের?  তখনকার সেই স্বৈরাচার ও স্বৈরাচার-বিরোধীরাও এখন একপ্রাণ, এক মহাজোটবদ্ধ। তাহলে কি বৃথা গেছে সেই সব আত্মোৎসর্গ? নব্বই দশক থেকে আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) যে ভাবে তিক্ত তিক্ততর করে চলেছে সম্পর্ক তাতে, কে জানে, সামনেই হয়তো একদিন ঐক্যবদ্ধ জোটবদ্ধ হবেন তাঁরাও। সত্তর দশকের ঘোরতর শত্রু জাসদ, আশির দশকের প্রবল প্রতিপক্ষ জাতীয় পার্টির সঙ্গে যদি শূন্য দশকে জোট গড়তে পারে আওয়ামী লীগ, তাহলে জানি দুশমন বিএনপি’র সঙ্গেও এক ঘাটে পানি খেতে পারে এই দশ অথবা পরের বিশ দশকে। রাজনীতির শেষ কথা হলো, রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই। কালকের জানি দুশমন আজ জানের জান হতে পারে। দলীয় রাজনীতিতে বিচিত্র শয্যাসঙ্গীর অভাব থাকে না কোনও। তাই হতেই পারে - আজ গোলাগুলি, কাল কোলাকুলি।
    তাহলে ফেলে আসা চল্লিশ বছর নয়, সামনের চল্লিশ বছর নিয়ে কথা বলি আজ। কি আমাদের স্বপ্ন, প্রত্যাশা আর কি প্রাপ্তিই বা সম্ভব! কিন্তু এ চিন্তায় প্রথমেই ছেদ পড়তে চায় যখন ভাবি আমাদের বিভাজিত অবস্থার কথা। পুরো দেশ-জাতি যেন ভাগ হয়ে গেছে দু’দিকে। চিন্তায়, আদর্শে, লক্ষ্যে এ ভাগ তীব্র তীব্রতর হয়ে উঠছে ক্রমে। কথা বলাবলি, মুখ দেখাদেখি প্রায় বন্ধ। সমাজ ভিন্ন হওয়ার পথে, কারণ সামাজিক সম্পর্ক ছিন্ন অনেকখানি। বিভাজন যত বাড়ছে, বিরোধও তত বাড়ছে। রাজনীতি জাতীয় বৈশিষ্ট্য হারিয়ে দলীয় রূপ ধারণ করে পালটাপালটি আর অন্তর্কোন্দলের হানাহানিতে লিপ্ত। দলের ভেতরে গণতন্ত্র নেই, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা তাহলে কিভাবে সম্ভব দলের দ্বারা? ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’ - এটাই এখন দলের কাজ ও প্রধান নীতি। সুযোগ পেলেই এক দল চড়াও হয় আরেক দলের ওপর। কারণ একটাই - ক্ষমতাহীনরা ঈর্ষা করে ক্ষমতাসীনদের, ক্ষমতাসীনরা ভয় পায় ক্ষমতাহীনদের। স্বার্থের দ্বন্দ্ব, পারস্পরিক সন্দেহ আর অবিশ্বাস, দুর্নীতি, তারপর সন্ত্রাস হয়ে ওঠে রাজনীতির নিয়ামক। আমরা এমনই এক পরিস্থিতির মুখে এসে দাঁড়িয়েছি যেন। বিশিষ্ট গবেষক সুনন্দ সান্যালের এক লেখায় ঠিক যেন ফুটে উঠেছে এ পরিস্থিতির ছবিটি:
    “... ‘মারের বদলে মার’ দিয়ে ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করলে সন্ত্রাস হবেই। আর ক্ষমতাসীন দল বিরোধীদের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতায় আসার চেষ্টা যদি মার দিয়ে বন্ধ করতে চায় তাহলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস অনিবার্য হবেই। অথচ মারামারি করে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা বন্ধ করতেই গণতন্ত্র। গণতন্ত্র ও সন্ত্রাস পরস্পরবিরোধী। সহজবোধ্য কারণে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসই সবচেয়ে বিপজ্জনক। কেননা, রাষ্ট্রের চেয়ে বড় সংগঠিত শক্তি আর নেই, তার হাতে পুলিসবাহিনী, সংবিধানসম্মত শক্তি প্রয়োগের অধিকার তার এবং তদুপরি একদিকে আইন ও শৃঙ্খলা আর একদিকে সাধারণ নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার প্রধান দায়িত্বও তারই। তাই রাষ্ট্র নিজেই অগণতান্ত্রিক হয়ে বেপরোয়া শক্তি প্রয়োগ করতে থাকলে সাধারণ জনজীবন দিশাহারা হয়ে পড়ে। তখন সাধারণ নাগরিকের একাংশ... সাতে, পাঁচে নেই... ভদ্রলোক হয়ে প্রাণ বাঁচাতে চেষ্টা করে, কিন্তু তার অপেক্ষাকৃত ছোট একটা অংশ মারের বদলে মার দেয়ার জন্য সংগঠিত হতে থাকে।” (‘বর্তমান’, কলকাতা, ০২.০৮.২০০২)
    কেন যেন আশঙ্কা জাগে এমন একটা দিশাহারা অবস্থাতেই ক্রমশ ঠেলে দেয়া হচ্ছে জনজীবনকে। প্রকাশের ও প্রচারের পথ নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ছে ক্রমে, পরিবর্তনের উপায় দেয়া হচ্ছে বন্ধ করে। অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে মানুষ। সামনে নির্বাচন। বলা হচ্ছে, সে নির্বাচনে বিরোধীদের অবস্থা হবে হাত-পা বেঁধে সাঁতার দেয়ার মতো। তখন ক্ষমতায় থাকবে দলীয় সরকার। নতুন নির্বাচন কমিশন হবে তাদের দ্বারা গঠিত। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)-এ কারচুপির সুযোগ রয়েছে বলে অভিযোগ এর মধ্যেই ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ জয়লাভের যোগাড়যন্ত্র পাকা। অন্তত বিরোধীরা মনে করছেন তাই। এ অবস্থায় নির্বাচন যে তাঁরা বর্জন করবেন তা সুনিশ্চিত। কিন্তু অবরুদ্ধ অবস্থা বড় ভয়ঙ্কর। ঘরের দরজা-জানালা সব বন্ধ করে বিড়ালকে লাঠিপেটা করতে গেলে কি হয়? মরণপণ ফোঁস করে ওঠে বিড়াল। এখানেও সে রকম এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ ফোঁস করে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ। তা কি জনবিস্ফোরণ না গণঅভ্যুত্থান?
    এ বিপদ বুঝেছেন আরও অনেকে। সমাজের বিভিন্ন অংশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আসন্ন বিপদের আশঙ্কা নিশ্চেষ্ট বসে নেই একেবারে। দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশে বড় দুই দল ও জোটের ব্যর্থতার পর এক অভিন্ন অবস্থানে আসতে চাইছেন তাঁরা। তৃতীয় শক্তি বা তৃতীয় পক্ষ - এ সব কথা শোনা যায়, বাস্তবে তেমন কিছু সম্ভব নয় আপাতত। তবে চাপ বা প্রভাব সৃষ্টি করার মতো কোনও বলয় গড়ে উঠতে পারে অদূরভবিষ্যতে। তা অবশ্য তরুণ প্রজন্মের ভূমিকার ওপর নির্ভরশীল। রাজনীতির অচলায়তন ভেঙে বেরিয়ে পড়ার উদ্যম তাঁদের মধ্যে জাগতে পারে - এমন আশা অমূলক হয়তো নয় একেবারে।
    কাজেই সামনের চল্লিশ বছর নিয়ে ভাবনার প্রথমেই বাধা হয়ে দাঁড়ায় আসন্ন পরিস্থিতি। এই আশঙ্কাপূর্ণ পরিস্থিতি ভেদ করে দৃষ্টি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সহজ নয়। অথচ অনেক চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে। সমাজে জীবনে অনেক অনিয়ম অব্যবস্থা গেড়ে বসেছে জগদ্দলের মতো। গত চল্লিশ বছরে এমন অনেক জগদ্দল অপসারণ করতে পারি নি আমরা, বরং নতুন-নতুন বোঝা চেপে উন্নয়নের বদলে বৃদ্ধি করেছে অনুন্নয়নকে। বাজারে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেট - এমনি এক জগদ্দল। একে ভাঙার শক্তিসামর্থ্য আমরা কি পাবো? প্রশাসনের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে দুর্নীতি। এ প্রশাসন কি কখনও আসবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির আওতায়? শিক্ষাঙ্গন কি মুক্তি পাবে সন্ত্রাস থেকে? সমাজের অন্যান্য অঙ্গনকেও কুরে-কুরে খাচ্ছে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি। বিশেষ করে নির্মাণকাজ মুখ থুবড়ে চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজির দৌরাত্ম্যে। শিল্প-কারখানা ব্যবসা-বাণিজ্যে অস্থিরতা নিয়েছে স্থায়ী রূপ। অপরাধ-মাদক ধ্বংস করে চলেছে কিশোর-তরুণদের। পরিবেশ-প্রকৃতি বিপন্ন। বনাঞ্চল উজাড়, নদীনালা মৃত, পাহাড় কেটে সাফ। এ অবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তন জনিত বিপদ আসছে ধেয়ে। তাহলে সামনের চল্লিশ বছরে দেশের ভূপ্রকৃতি দাঁড়াবে কেমন? সাগরগর্ভে তলিয়ে যাবে কতখানি ভূভাগ? সমাজপ্রগতি, দারিদ্র্যবিমোচন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ - সবই হয়তো থেকে যাবে মুখের কথা। পথে-পথে হেঁটে যেতে-যেতে ফুটপাথে দেখি ভুখা-নাঙ্গা মানুষ। বৃষ্টি বাদল কুয়াশায়, শীতে গ্রীষ্মে ওরা কুণ্ডলি পাকিয়ে থাকে টুকরিতে, খুপরিতে। বাতাসে ভাসে নির্যাতিত নারীর চিৎকার, ক্ষুধাতুর শিশুর কান্না। ৯৯ ভাগ মানুষের জীবনে ‘আসিতেছে শুভ দিন’ কেবলই একটি কবিতা! কারণ আমাদের রাজনীতির কেবল অতীত আছে, ভবিষ্যৎ নেই।

বৃহস্পতিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১১

রশীদ করিম: সাহিত্যচিন্তা

গত শতকের ষাট দশকের শুরুর তিন-চার বছরের মধ্যে ক’জন স্কুল বালকের সঙ্গে পরিচয় হয় আমার। তখন আমিও স্কুল বালক, কিছু দিন পর অবশ্য কলেজ কিশোর। ওই বালকেরাও অমনি। বালক কিশোর তরুণ। তবে ওরা বয়সে আমার চেয়ে কিছুটা বড়। তাতে অবশ্য সমস্যা হয় নি তেমন। বয়সের তুলনায় পাকা ছিলাম বলে একাত্ম হতে পেরেছিলাম ওদের ভাব, অনুভূতি সব কিছুর সঙ্গেই। ওই তিন জনের নাম শাকের, কনখল ও অমল। শাকেরের ঠাঁইঠিকানা রশীদ করিম (১৯২৫-২০১১)-এর ‘উত্তম পুরুষ’ (১৯৬১), কনখলের ঘরবাড়ি মণীশ ঘটক (১৯০২-১৯৭৯)-এর ‘কনখল’ (১৯৬৩), অমলের বাসভূমি বিমল কর (১৯২১-২০০৩)-এর ‘খড়কুটো’ (১৯৬৩)। গ্রন্থভুক্ত হওয়ার আগে শাকের ছিল ‘সমকাল’-এ, আর কনখল ছিল ‘চতুরঙ্গ’-এ। অমল-ও অমন কোনও পত্রিকায় ধারাবাহিক ছিল বলে কেন যেন ভাবছি বারবার। ‘সমকাল’-এ বেশি দিন থাকা হয় নি শাকেরের। সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফর ‘কমুনাল’ অভিযোগ করে প্রকাশ বন্ধ করে দেন ‘উত্তম পুরুষ’-এর। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়ে অবশ্য বিপুল ভাবে সংবর্ধিত হয় উপন্যাসটি। পত্রপত্রিকায় প্রশংসিত হয় উচ্ছ্বসিত ভাষায়, সে আমলের সবচেয়ে নামী আদমজী পুরস্কার পায়, সংস্করণও হয়ে যায় একাধিক।
    সেই কবে, ৫০-৫১ বছর আগে, ‘সমকাল’-এ ‘উত্তম পুরুষ’ পড়েছি মুগ্ধ মোহিত হয়ে! আজ অবাক হয়ে ভাবি, সেই মুগ্ধতার অবশেষ এখনও কিভাবে রয়ে গেছে অনেকখানি। গত ২৬শে নভেম্বর রশীদ করিম চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে। এ খবর পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে প্রথমেই মনে পড়ে যায় শাকের, সেলিনা, অনিমা, মুশতাক, নিহার ভাবী ও আরও অনেকের কথা। চোখের সামনে ভেসে ওঠে কলকাতার মুসলমান পাড়াগুলো  পার্ক সারকাস, মারকুইস স্ট্রিট, সদর স্ট্রিট, রাজাবাজার, খিদিরপুর, ইকবালপুর, আলীপুর, চিৎপুর, চাঁদনী চক...
অনিমার জন্মদিন,  উপহার কিনতে বেরিয়েছে শাকের  “এসপ্লানেডের ট্রামে উঠলাম। তখনও আমীর আলী এভিনিউ, গড়িয়াহাট রোডে ট্রাম লাইন বসে নি। তাই পার্ক সার্কাস থেকে এসপ্লানেড ঘুরে বালীগঞ্জে যেতে হতো। অবশ্য দশ নম্বর বাস ধরতে পারতাম; কিন্তু বাসে এত ভিড় যে সে প্রস্তাব মনেও আসে না। এসপ্লানেডে পৌঁছলে মুশতাক বললো: আগে একবার নিউ মার্কেট যেতে হবে।... আমি ফুলের একটা তোড়া কিনলাম। মুশতাক কিনলো ভ্যানিটি ব্যাগ। তারপর দু’জনেই গিয়ে উঠলাম বালীগঞ্জের ট্রামে।...”
তবে সকলের অত ভাল লাগে নি ‘উত্তম পুরুষ’। সমালোচক-গবেষক মনসুর মুসা লিখেছেন  ‘কোনও সুসংবদ্ধ কাহিনী নেই’ এ উপন্যাসে। খণ্ডিত কাহিনী আছে, তবে সেগুলোর ‘কোনও নিজস্ব গুরুত্ব নেই’। তিনি আরও লিখেছেন, উপন্যাসে বিভিন্ন চরিত্র এসেছে ‘অনাবশ্যক কথা বিস্তারের ধারায়’। তাঁর মতে, উত্তম পুরুষ-এর চেয়ে তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস প্রসন্ন পাষাণ ‘অধিক সুলিখিত উপন্যাস  এতে সন্দেহ নেই।’ (‘পূর্ব বাঙলার উপন্যাস’, অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ২০০৮)
আমি অবশ্য প্রসন্ন পাষাণ পড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি কয়েকবার। শুরু করে কিছু পৃষ্ঠা পার হয়েছি, তারপর এগোতে পারি নি আর। এরপর তিনি উপন্যাস লিখেছেন দশটি। এর মাত্র একটি, প্রেম একটি লাল গোলাপ, আমি পড়েছি দু’বার। এর বিশেষ কারণও ছিল। উপন্যাসটি ছেপেছিলাম ঈদ সংখ্যা ‘বিচিত্রা’য় ১৯৭৭ সালে। প্রেসে পাঠাবার আগে একবার পড়েছিলাম তখন, আর সেলোফেন করার আগে চূড়ান্ত প্র“ফ পড়েছিলাম একবার। কিন্তু উত্তম পুরুষ-এর সেই রশীদ করিমকে খুঁজে পাই নি আর। তিনি লিখেছেন, “আমার শ্রেষ্ঠ বই কোনটি তার বিচারক পাঠক সমাজ, আমি নই।” আরও লিখেছেন, “আমার উপন্যাসে আমি যা লিখেছি শুধু তাই বলার অধিকার আছে আমার। তার বাইরে কোনও অতিরিক্ত ঘটনা আমার বলার অধিকার নেই। যদি বলি তবে সেটা হবে উপন্যাসের বহির্ভূত একটি অংশ। আমার একাধিক উপন্যাসই কোনও না কোনও বাস্তব চরিত্র বা ঘটনাকে অবলম্বন করে লেখা। অনেকে প্রশ্ন করেন, আমি তো কাজকর্ম করি, লিখবার সময় পাই কোথায়? লেখকের সংসারের কাজ, দায়িত্ব, অফিসের কাজ ও দায়িত্ব সব কিছুকে অতিক্রম করে সাহিত্যচিন্তা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। লেখক যখন সংসারের দায়িত্ব, অফিসের দায়িত্ব প্রভৃতি পালন করেন তখনও ফল্গুধারার মতো সাহিত্যচিন্তা সর্বক্ষণ তাঁর মনের মধ্যে থাকে। এমনকি যখন তিনি বিশ্রাম করতে রাত্রে শয়ন করেন তখনও সাহিত্যচিন্তা তাঁর মধ্যে আনাগোনা করে।”
কি ছিল তাঁর নিজের সাহিত্যচিন্তা? ১২টি উপন্যাস ছাড়াও রশীদ করিম লিখেছেন অন্তত ৮৩টি প্রবন্ধ-নিবন্ধ। এগুলো স্থান পেয়েছে তাঁর প্রবন্ধ-গ্রন্থ “আর এক দৃষ্টিকোণ” (১৯৮৯), “অতীত হয় নূতন পুনরায়” (১৯৯২), “মনের গহনে তোমার মুরতিখানি” (১৯৯৭) ও “প্রবন্ধ সমগ্র” (২০০৩)-এ। এ সব প্রবন্ধে-নিবন্ধে তাঁর সাহিত্যচিন্তা প্রকাশ পেয়েছে নানা ভাবে। উপন্যাস, কবিতা, চলচ্চিত্র প্রভৃতি সম্পর্কে আলোচনায়, লেখকদের সম্পর্কে নানা মত-মন্তব্যে রয়েছে সেই চিন্তার প্রতিফলন।
ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার নেশা ছিল রশীদ করিম। পড়তে-পড়তেই ঝুঁকে পড়েছিলেন লেখালেখির দিকে। তারপর সারা জীবন পড়েছেন ও লিখেছেন প্রায় সমান তালে। এ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, “একজন লেখক হচ্ছেন একজন বড় পাঠক, আমি তাই মনে করি। নানা রকমের বই পড়ে একজন লেখকের বহু নতুন কথা শেখার আছে। তার অর্থ এই নয় যে লেখক অনুকরণ করছেন। আমার লেখালেখিতে প্রত্যক্ষ প্রেরণা হিসেবে কোনও একজন কাজ করেন নি। তবে শরৎচন্দ্রের লেখা ছেলেবেলায় খুব পড়তাম। সাহিত্যের একটা পরিবেশ ছিল আমাদের পরিবারে। সেটাও আমার লেখালেখিতে উৎসাহ যুগিয়েছে।” (‘সাহিত্যের বর্তমান মান’, “প্রবন্ধ-সমগ্র”)
রশীদ করিমের লেখায় অনেকের মধ্যে এক বিশেষ প্রেরণা ছিলেন শরৎচন্দ্র। ছোটবেলা থেকে সারা জীবনই তাঁর বিষম ভক্ত ছিলেন তিনি। ভাল লাগা বই / উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে শরৎচন্দ্রের নামই তিনি উল্লেখ করতেন বারবার। যেমন বলেছেন তাঁর বিবেচনায় সে রকম বই একাধিক আছে যার গুরুত্ব শেষ হবে না কখনও। এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন চারটি বইয়ের নাম  এর মধ্যে শরৎচন্দ্রের দু’টি  ‘গৃহদাহ’ ও ‘শ্রীকান্ত’। অন্য দু’টি বই রবীন্দ্রনাথের  ‘গীতাঞ্জলি’ ও ‘সঞ্চয়িতা’। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ পাঁচটি বইয়ের নাম বলতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেছিলেন চারটি বইয়ের নাম। এর একটি শরৎচন্দ্রের ‘গৃহদাহ’। অন্য তিনটি  বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ’, রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’। ‘গোরা’ উপন্যাসটির কথা তিনি নানা আলোচনায় উল্লেখ করেছেন বারবার। বলেছেন ‘গোরা’ তাঁর ‘খুব প্রিয় বই’। শরৎচন্দ্রের বইগুলোর মতো এ বইটিও তিনি পড়েছেন একাধিক বার। লিখেছেন, “আজকাল তো বহু উপন্যাস লেখা হচ্ছে। সেগুলোতে বহু নতুন নায়িকা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আমার মনে আজও ‘গোরা’র ললিতা দাগ কেটে আছে।”
রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের উপন্যাস সম্পর্কে এক পর্যায়ে রশীদ করিম স্পষ্ট করেই বলেছেন, “... সব মিলিয়ে আমার মনে হয় ঔপন্যাসিক হিসেবে শরৎচন্দ্র ছিলেন রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ভাল।” এত ভক্তি সত্ত্বেও শরৎচন্দ্র যে ঘোরতর সাম্প্রদায়িক ও মুসলিম বিদ্বেষী ছিলেন তা-ও উত্তম পুরুষ উপন্যাসে তিনি প্রকাশ করেছেন নায়ক শাকেরের সংলাপে  “... মনে আছে, এই শরৎচন্দ্রই বলেছিলেন, ‘বস্তুত মুসলমান যদিও কখনও বলে  হিন্দুর সহিত মিলন করিতে চাই, সে যে ছলনা ছাড়া আর কি হইতে পারে, ভাবিয়া পাওয়া কঠিন। একদিন মুসলমান লুণ্ঠনের জন্যই ভারতে প্রবেশ করিয়াছিল, রাজ্য-প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য আসে নাই। সেদিন কেবল লুঠ করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, মন্দির ধ্বংস করিয়াছে, প্রতিমা চূর্ণ করিয়াছে, নারীর সতীত্ব হানি করিয়াছে, বস্তুত অপরের ধর্ম ও মনুষ্যত্বের ওপরে যতখানি আঘাত করা যায়, কোথাও কোনও সঙ্কোচ মানে নাই।... হিন্দু নারী হরণ ব্যাপারে সংবাদপত্রওয়ালারা প্রায়ই দেখি প্রশ্ন করেন, মুসলমান নেতারা নীরব কেন? তাঁদের সম্প্রদায়ের লোকেরা যে পুনঃপুনঃ এত বড় অপরাধ করিতেছে, তথাপি প্রতিবাদ করিতেছেন না কিসের জন্য? মুখ বুজিয়া নিঃশব্দে থাকিবার অর্থ কি? কিন্তু আমার তো মনে হয় অর্থ অতিশয় প্রাঞ্জল। তাঁরা শুধু অতি বিনয়বশতই মুখ ফুটিয়া বলিতে পারেন না, বাপু, আপত্তি করবো কি, সময় ও সুযোগ পেলে ও কাজে আমরাও লেগে যেতে পারি।’...”
রবীন্দ্রনাথকেও ছেড়ে কথা বলে নি শাকের  “রবীন্দ্রনাথের কাব্য-প্রতিভাকে আমি শ্রদ্ধা করি, ... কিন্তু সে কেবল তিনি অতুল কাব্য-প্রতিভার অধিকারী বলে। মুসলমানকে তিনি কোনও দিন আপন মনে করেন নি। তিনি মুসলমানকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছেন।”
এ তো গেল রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র, অন্য ঔপন্যাসিকদের সম্পর্কে কি মূল্যায়ন ছিল রশীদ করিমের? “সাহিত্যের বর্তমান মান” নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, “তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমার খুব ভাল লাগে নি তাঁর ভাষার কারণে, তবে তাঁর কবি বইটির কথা মনে পড়ে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা ও পদ্মানদীর মাঝি যে রকম উচ্চপ্রশংসিত সে রকম মনে হয় না। বিশেষ করে এই দু’টি উপন্যাসের নায়িকাকে আমার একই রকম মনে হয়। অনেকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র লাল সালু উপন্যাসের খুব উচ্চ প্রশংসা করেন। কিন্তু এই বইয়ের প্রথম ২৫ পৃষ্ঠা সম্পূর্ণ অনাবশ্যক। তাছাড়া এই উপন্যাসের পরিধি খুবই সঙ্কীর্ণ।”
এ প্রসঙ্গে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে রশীদ করিমের মূল্যায়নের কিছু অংশ উদ্ধার করা যেতে পারে 
“লাল সালু উৎকৃষ্ট উপন্যাস। খুবই উৎকৃষ্ট, নিঃসন্দেহে। কিন্তু এ উপন্যাসের ব্যাপ্তি তো তত বড় নয়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এ উপন্যাসে মুক্ত বিচরণের জায়গা খুব একটা দেন নি। তাঁর চৌহদ্দি খুবই সঙ্কীর্ণ। এর কাহিনী বেদনাদায়কভাবে সীমাবদ্ধ।... তিনি কিছু ছোটগল্প এবং কিছু প্রহসন লিখেছেন। দু’টোই দ্বিতীয় শ্রেণীর। কতিপয় সমালোচক তাঁর প্রহসনগুলোকে নাটক বলে দাবি করে। করতে দিন। ওগুলো নাটক নয়। এসব প্রহসন কাঁচাভাবে লেখা। তার চেয়ে বড় কথা, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র মতো একজন পরিশীলিত লেখকের পরিপ্রেক্ষিতে এগুলো রীতিমতো অপকৃষ্ট রুচির। আমি জানি, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র সমস্ত লেখা যাঁরা বাইবেল পাঠের মতো ভক্তি ভরে পড়েন, তারা আমার এ কথায় ক্ষুব্ধ হবেন। আমি নিজেও ওয়ালীউল্লাহ’র দারুণ ভক্ত। কিন্তু মন্দ-সাহিত্যের বন্দনা গাইতে আমি রাজি নই। আশা করি, অন্যদের মতো আমারও নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি পোষণের অধিকার আছে।... আমি বলবো, তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাসটি শেষটির চেয়ে ভাল। আবার দ্বিতীয়টি প্রথমটির চেয়ে খারাপ।...” (‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সঙ্গে একটি দিন’, প্রাগুক্ত)
সাম্প্রতিক সাহিত্য নিয়ে হতাশা ছিল রশীদ করিমের। লিখেছেন, “বর্তমান সাহিত্যের মান পৃথিবীর সর্বত্র পড়ে গেছে। এখন যাঁরা নোবেল প্রাইজ পান তাঁদের লেখা পড়বার কোনও উৎসাহও পাই না...।”