শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১২

সব্যসাচী সাযযাদ কাদির

মাহমুদ কামাল
ইদানীং বেশ কয়েকজন লেখকের নামের আগে ‘সব্যসাচী’ শব্দটি বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মহাভারতের অর্জুন দু’হাতে বাণ নিক্ষেপ করতে পারতেন বলে বিশেষায়িত সব্যসাচী নামটি যেমন পুরাণে প্রতিষ্ঠিত সেই অর্থের আদলেই যাঁরা সাহিত্যের সকল শাখাতেই সফলভাবে কলম চালাতে পারেন তাঁদের নামের আগে এই বিশেষণটি ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। সেই অর্থেই কবি সৈয়দ শামসুল হক সব্যসাচী লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ষাটের অকাল প্রয়াত কবি আবু কায়সার (১৯৪৫-২০০৫)-এর মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে একটি স্মারকগ্রন্থ আমরা (কবি মোহাম্মদ আবদুল মাননানের সঙ্গে যৌথ) বের করেছিলাম ‘সব্যসাচী আবু কায়সার’ শিরোনামে। কবি আবু কায়সার দু’হাতে নানা বিষয়ে লিখতে পারতেন বলেই স্মারক গ্রন্থের ওই শিরোনামটি আমরা দিয়েছিলাম। ষাটের বিশিষ্ট কবি সাযযাদ কাদির কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ-গবেষণা, নিবন্ধ-ফিচার, শিশুতোষ লেখা অর্থাৎ সৃষ্টিশীল ও মননশীল সব ধরনের লেখায় সমান পারদর্শী। ‘ভাষাতত্ত্ব পরিচয়’ নামে তাঁর একটি ছোট গ্রন্থ রয়েছে যেটি শিক্ষার্থীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য। ‘সব্যসাচী সাযযাদ কাদির’ এই শিরোনামটি তাঁর বেলায় স্বয়ংক্রিয় ভাবেই প্রযোজ্য একথা আমি দ্বিধাহীনভাবেই জ্ঞান করি। তাঁর সাহিত্যকীর্তি সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করার আগে ব্যক্তিগত কিছু বিষয় এখানে উল্লেখ করছি। সাহিত্য সৃষ্টিতে যেমন তিনি সব্যসাচী, পেশাগত জীবনেও তিনি বদল করেছেন নানাবিধ চাকরি। অধ্যাপনা, নানা পত্রিকায় সাংবাদিকতা, সরকারি-বেসরকারি সংস্থায় প্রশাসনিক কর্মকর্তা প্রভৃতি কাজ তিনি করেছেন, কিন্তু কোথাও মাথা বিক্রি কিংবা আপস করেন নি। আজীবন প্রতিষ্ঠাবিরোধী তিনি দলবাজি করেন নি বলেই দলীয় বিবেচনায় যাঁরা রাষ্ট্রীয় পুরস্কার-টুরস্কার পাচ্ছেন দীর্ঘদিন থেকে তাঁদের বাইরেই রয়েছেন। তাঁর অধ্যাপনা জীবনে প্রায় দু’বছর আমি উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে সরাসরি ছাত্র ছিলাম। শিক্ষক হিসেবে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন পাঠদান পদ্ধতির কারণে। আমরা কখনও তাঁর ক্লাশ ফাঁকি দিতাম না। সা’দত কলেজ থেকে তিনি যোগ দেন সাপ্তাহিক বিচিত্রায়, ১৯৭৬ সালে। এরপর তাঁর পেশার নানা পরিবর্তন ঘটে যেতে দেখি।
তাঁর বেশ কিছু গুণের মধ্যে একটি হলো প্রখর স্মৃতিশক্তি। শক্তিটি এমন, তাঁর মাথায় একটি তথ্যব্যাংক রয়েছে যেখান থেকে অনেকেই উপকৃত হয়েছেন। শব্দের বানান অথবা অর্থ কিংবা যে  কোনও লেখক বা গ্রন্থের নাম প্রভৃতি তিনি অবলীলাক্রমে বলে দিতে পারেন। আরেকটি গুণ ক্ষমতানুযায়ী মানুষকে সহযোগিতা করা। ভালমন্দ মিলিয়েই মানুষ। যেহেতু আমি তাঁর ছাত্র ছিলাম এ জন্য মন্দ বিষয়গুলো না বলাই উচিত। শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের ছাত্রটিও এখন শিক্ষক। তাঁর ছাত্রও শিক্ষকতা করে। এই সাহসে আমার শিক্ষকের একটি নেতিবাচক দিক এখানে উল্লেখ করি। তিনি খুব সহজেই ভুল বোঝেন; সাহিত্য সম্পর্কে নয়, ব্যক্তি মানুষ সম্পর্কে। যতটুকু জানি ভুল বোঝার কারণে তাঁর বন্ধুর সংখ্যা কম। একজন শক্তিমান লেখকের জন্য এ বিষয়টি অদরকারি। আশা করি আমার এই আকাট মন্তব্যে তিনি ভুল বুঝবেন না।
সাযযাদ কাদির সব্যসাচী লেখক হলেও কবি পরিচয়ে তিনি শ্লাঘা বোধ করেন। এই  বিবেচনায় এখন থেকে তাঁর নামের আগে কবি শব্দটি ব্যবহৃত হবে।
কবি সাযযাদ কাদির দশক বিচারে গত শতকের ষাটের কবি হিসেবে পরিচিত। যেহেতু তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একজন ছাত্র এবং পরে শিক্ষক ছিলেন ? এ কারণে তাঁর কবিতা যেমন প্রথানুগ আবার প্রথাবিরোধীও। সাহিত্যের রীতি-নীতি অক্ষুণ্ন রেখে তিনি কবিতা রচনা করার কারণে তাঁর কবিতা প্রথাগত কিন্তু কবিতার বক্তব্য প্রকাশে প্রথাবিরোধী। আবার কখনও-কখনও রচনা পদ্ধতি প্রথাবিরোধী কিন্তু কবিতার বিষয় প্রথার বাইরে নয়। অর্থাৎ তিনি কোনও সীমানার মধ্যে নিজেকে আটকে রাখেন না। তিনি জীবনকে দেখেছেন তাঁর মতো করে। কথাসাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি উক্তি এরকম, ‘সৃষ্টিকর্তার কোনও ডুপ্লিকেট নেই। পাওয়ার অভ অ্যাটর্নিও নেই।’ একারণে কবির সৃষ্টি একান্তই কবির। সেই সৃষ্টিশীলতায় যদি নিজস্বতা থাকে এবং তা যদি সামগ্রিকতা পূর্ণ হয় তাহলে তিনি আলাদা হবেন না কেন।
সাযযাদ কাদিরের কবিতা যেমন ছন্দোবদ্ধ তেমনি ছন্দহীন, কিন্তু উভয়ই সৃষ্টিশীল। কবিতাকল্পনালতা এবং প্রচলিত বাস্তবতার মিশেলে তার কবিতা কখনও হয়ে ওঠে পরাবাস্তবতার ডানা। ‘খাদ্যতালিকা’ কবিতাটি নজর করে এই মন্তব্যের সত্যাসত্য খোঁজ করা যেতে পারে। দীর্ঘ কবিতাটির কয়েকটি পঙ্‌ক্তি উদ্ধৃত করি:
“আমার একটি হাত  সহসা দীর্ঘ হতে-হতে
জ্যোৎস্নাকে অতিক্রম করে যায়;
যেন হাত নয়, যেন হাতিয়ার,
যেন ত্বকের  গভীর থেকে বেরিয়ে আসা
এক স্বয়ংক্রিয় হোস্‌পাইপ।
...

নিরাঙ্গুরীয় পাঁচটি আঙুলের নিম্নবিত্ত যে হাত
কোনও দিন সিনেমার টিকিট
    বা প্রিয়জনের জন্য উপহার
           কোনও কিছুই কেনে নি,
চিরায়ত সাহিত্য
     বা দৈনিক পত্রিকা
     কোনওটিরই পৃষ্ঠা ওলটায় নি,
প্রাচীন বা আধুনিক
     কোনও ধর্মগ্রন্থই ছুঁয়ে দেখে নি,
চিরস্মরণীয়া বা ক্ষণিকা
        কাকেও তেমন স্পর্শ করেনি;
...

সেই বিপন্নতায় আমার কি কোনও দিন যাওয়া হবে?
কোনও স্বেচ্ছাচার আমাকে কি কোনও দিন সঙ্গী করে নেবে?
তবু সে আমার হাত,
তবু সে আমার হাত নয়, যেন হাতিয়ার,
যেন ত্বকের গভীর থেকে বেরিয়ে আসা
নিশ্চিত হরিণীর প্রতি স্পষ্ট জ্যোৎস্নায়
        ধাবমান এক চিতা...”

তাঁর কবিতা উপচে-পড়া আবেগতাড়িত নয়। জীবনকে ছুঁয়ে-ছেনে বাক্যের কাঠামোবিন্যাস করেছেন নিপুণ শক্তিতে। ‘সমস্ত মুখের রেখায় স্থির হয়ে থাকে অন্ধকার’ ? তিনি এই অন্ধকারকে সরিয়ে দিয়ে গর্বিত স্বাধীনতা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করেন। এরকম শ্রেয়োচেতনা লক্ষ্য করা যায় তাঁর বিভিন্ন কবিতায়।
তাঁর কবিতার বিশেষ গুণ সহজবোধ্যতা। শব্দের মারপ্যাঁচ নেই, বাক্যের চাতুরি নেই, কিন্তু অপূর্ব চিত্রকল্পের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় তাঁর বিভিন্ন কবিতায়। এরকমই একটি কবিতা ‘দরজা খুললেই’। তাঁর অনুরাগী পাঠক হিসেবে এটি আমার প্রিয় কবিতা। এই কবিতার পুরোটা উদ্ধৃত করে কবি এবং কবির সাহিত্যকর্মকে আমি শ্রদ্ধা জানাতে চাই।
“দরজা খুললেই চিকিৎসক
পথে নামলেই অ্যামবুলেন্স
যে কোনও বাড়িই হাসপাতাল
- আমার খুব অসুখ হলো কি
অঘ্রাণের চাঁদে সাঁতার দেয়ার পর?

আসলে এক ছায়া,
ছায়া বলি কেন নিঃসন্দেহে ভূত,
তার শরীর ও শরীরের হাওয়া এবং শোকগীতি
সহজ অনুগমন শিখেছে, ?
যেখানে-সেখানে করতালি বাজিয়ে
খুলে দিচ্ছে দরজা, রাজপথ আর রমণীর অন্তঃপুর
? এ-সবের শুশ্রূষা করবেন কোন মহাশয়?

আমি বলি,
চাঁদ ও চাঁদের ছায়ায় কিছু ভুল-বোঝাবুঝি ঘটেছে,
মূলত ওই চুলের অন্ধকারেই
চন্দ্রায়িত রমণীর আঙুলে
প্রেম বা প্রতিহিংসা বুনেছিল,
আমি কিছু ভালবাসার অসুখে
শরীর গরম করি নি,
অথচ দরজা খুললেই ...”

বৃহস্পতিবার, ২৯ মার্চ, ২০১২

সাযযাদ কাদির

আসল নাম: শাহ নূর মোহাম্মদ। ডাক-নাম: বাবর। পিতা: এস এম আবদুস সালাম (মরহুম)। মা: মাহমুদা বেগম। স্ত্রী: আফরুনা বাবলি। পিত্রালয়: দেলদুয়ার, টাঙ্গাইল। মাতুলালয়: মিরের বেতকা, টাঙ্গাইল। শ্বশুরালয়: দেবত্র, মঠবাড়িয়া, পিরোজপুর। স্থায়ী ঠিকানা: আকুরটাকুর, টাঙ্গাইল। বর্তমান ঠিকানা: ২এ, আরবান পয়েন্ট; ১৪২এ, বীর উত্তম কে এম সফিউল্লাহ সড়ক (গ্রিন রোড), ঢাকা-১২১৫। ফোন: ৮১২০১৭২। সেল: ০১৭১৫-৪৪৫০৪৪; ০১৬৭৫-৩৮৩৪৪৬; ০১৯১৪-০৮৮০৯০; ০১৬৮২ ৪০৮৭৫২। ই-মেইল:

# ম্যাট্রিকুলেশন, বিন্দুবাসিনী হাই স্কুল, টাঙ্গাইল, ১৯৬২; এইচ এস সি (বিজ্ঞান > মানবিক): সা’দত কলেজ, করটিয়া > এম এম আলী কলেজ, কাগমারী, ১৯৬৬; বি এ সম্মান (১৯৬৯), এম এ (১৯৭০), বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
# কবিতা: যথেচ্ছ ধ্রুপদ; রৌদ্রে প্রতিধ্বনি; দূরতমার কাছে; দরজার কাছে নদী; আমার প্রিয়; এই যে আমি; কবিতাসমগ্র; জানে না কেউ; বিশ্ববিহীন বিজনে; বৃষ্টিবিলীন। গল্প: চন্দনে মৃগপদচিহ্ন; রসরগড়। গবেষণা: ভাষাতত্ত্ব পরিচয়; হারেমের কাহিনী: জীবন ও যৌনতা; রবীন্দ্রনাথ : মানুষটি; রবীন্দ্রনাথ : শান্তিনিকেতন। সঙ্কলন: রাজরূপসী; প্রেমপাঁচালি; পৃথিবীর প্রিয়প্রণয়ী; নারীঘটিত। শিশুতোষ: তেপান্তর; মনপবন; রঙবাহার; বীরবল নামা; এফফেনতি; উপকথন; উপকথন আরও; উপকথন আবারও; উপকথন ফের; ইউএফও: গ্রহান্তরের আগন্তুক; জমজমাট; জানা আছে জানা নেই; সাগরপার। অনুবাদ: লাভ স্টোরি; রসচৈনিক। স্মৃতিকথা: নানা রঙের দিন। সম্পাদনা: প্রবন্ধ সংগ্রহ: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; প্রবন্ধ সংগ্রহ: বেগম রোকেয়া; বাংলার লোককথা। উপন্যাস: অপর বেলায়; অন্তর্জাল; খেই।
# সহকারী সম্পাদক: মাসিক কণ্ঠস্বর (১৯৬৬-৬৮); সহকারী সম্পাদক: মাসিক বিচিত্রা (১৯৬৮-৬৯); নিয়মিত প্রদায়ক: রহস্য পত্রিকা (১৯৬৮-); ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সাপ্তাহিক রণাঙ্গন (১৯৭১-৭২); সম্পাদক: সাপ্তাহিক সংকেত (১৯৭২); সহকারী সম্পাদক: সাপ্তাহিক বিচিত্রা (১৯৭৬-৮২); সহকারী সম্পাদক: দৈনিক সংবাদ (১৯৮২-৮৫); সম্পাদক: সাপ্তাহিক আগামী, পাক্ষিক তারকালোক, কিশোর তারকালোক (১৯৮৫-৯২); বার্তা সম্পাদক / ফিচার সম্পাদক: দৈনিক দিনকাল (১৯৯২-৯৫); পরিচালক / সহযোগী সম্পাদক: বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (১৯৯৫-২০০৪); যুগ্ম সম্পাদক: দৈনিক মানবজমিন (২০০৪-)। উপদেষ্টা সম্পাদক: সময়ের বিবর্তন; জলকণা। কলামনিস্ট: দৈনিক ইত্তেফাক; দৈনিক আমার দেশ, পাক্ষিক বৈচিত্র। প্রদায়ক: মাসিক সরগম।
# অধ্যাপক: বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ (১৯৭২-৭৬); কোর্স টিচার: স্টামফোর্ড ইউনিভারসিটি, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অভ কমিউনিকেশন অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্‌স্‌, ফিল্ম ইনস্টিটিউট অভ বাংলাদেশ।
# ১৯৬৬ সাল থেকে রেডিও-টিভির বহু অনুষ্ঠান রচনা, পরিচালনা, উপস্থাপনা সহ অংশগ্রহণ। বিটিভিতে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘তাৎক্ষণিক’ (১৯৮২), ‘প্রত্যয়’ (১৯৮৭), ‘শাণিত সংকল্প’ (১৯৯২-৯৫), ঈদের আনন্দমেলা ও বিশেষ নাটক রচনা ও পরিচালনা। গণচীনের রেডিও পেইচিং-এ ভাষা-বিশেষজ্ঞ (১৯৭৮-৮০)। বাংলা ডেস্কটপ পাবলিকেশনের অন্যতম পথিকৃৎ।
# প্রতিষ্ঠাতা সদস্য: লেখক সংগ্রাম শিবির (মার্চ, ১৯৭১)। জীবন সদস্য: বাংলা একাডেমী (৯৭৫)। সদস্য: বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড (১৯৯২-৯৫)। সাবেক সদস্য ও সভাপতি: বহুবচন, চম্পক (নাট্যগোষ্ঠী)। প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক / প্রেসিডিয়াম সদস্য: জাতীয় কবিতা পরিষদ, সামপ্রতিক সাহিত্যচিন্তা, আয়োজক, বুধসন্ধ্যা। কোষাধ্যক্ষ: বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (১৯৮৬-৯২)। দপ্তর সম্পাদক: বাংলাদেশ লেখক ইউনিয়ন। আজীবন সদস্য: বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি। সদস্য: জাতীয় প্রেস ক্লাব। সমন্বয়কারী: সমালোচক সংঘ, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। বাংলাদেশ ফিল্ম ক্লাব প্রবর্তিত “বার্ষিক চলচ্চিত্র পুরস্কার-২০০৬”-এর জুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান। প্রতিষ্ঠাতা: বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র। আজীবন সদস্য: সাধারণ গ্রন্থাগার, টাঙ্গাইল। উপদেষ্টা: বেড়াইদ গণপাঠাগার। আজীবন সদস্য: বানিয়াজুরী গণকেন্দ্র পাঠাগার। আজীবন রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৩৮৭৭)। উপদেষ্টা: লেখক ফাউন্ডেশন।
# সেরা পরিচালক: টাঙ্গাইল জেলা নাট্য-উৎসব (১৯৭৬)। একুশে স্মৃতি স্বর্ণপদক (১৯৯৪)। শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়া স্বর্ণপদক (১৯৯৫)। কবি জসীম উদ্‌দীন পুরস্কার (১৯৯৭); নন্দিনী পুরস্কার (২০০১)। কবি সুকান্ত সাহিত্য পুরস্কার (২০০২)। সৈয়দ আবদুল মতিন স্বর্ণপদক (২০০২)। বাচসাস পুরস্কার ? আজিজ মিসির ক্রিটিক অ্যাওয়ার্ড (২০০২)। ট্রাব অ্যাওয়ার্ড ?  লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট (ক্রিটিক) অ্যাওয়ার্ড (২০০৩)। এম নুরুল কাদের পুরস্কার (২০০৪)। কবিতা পরিষদ পুরস্কার, সাতক্ষীরা (২০০৪)। সাহিত্যে ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব পদক (২০০৬)। শেকড় নাট্যগোষ্ঠী পুরস্কার (২০০৭)। কপোতাক্ষ সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (২০০৮)। টাঙ্গাইল সাহিত্য সংসদ পুরস্কার ? ভাষাসৈনিক শামসুল হক পদক (২০০৮)। বিজয় সাহিত্য পুরস্কার (২০০৮)। কবি বিষ্ণু দে পুরস্কার, সাংস্কৃতিক খবর (২২তম বাংলা কবিতা উৎসব), কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত (২০১০)।
সংবর্ধনা: বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, থানা কমান্ড, দেলদুয়ার (১৯৯৭)। সংবর্ধনা: ভোরের কাগজ পাঠক ফোরাম, টাঙ্গাইল জেলা পরিবার (২০০১)। সংবর্ধনা: জাতীয় প্রেস ক্লাব (২০০৩)। সংবর্ধনা ও সম্মাননা: সাতক্ষীরা সাহিত্য একাডেমী (২০০৪)। সংবর্ধনা: অধ্যাপক সৈয়দ নূরুল হাসান ডিগ্রি কলেজ, ফারাক্কা, মুরশিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত (২০০৫)। গুণী সম্মাননা, বিন্দুবাসিনী স্কুল, টাঙ্গাইল (২০০৫)। শহিদ বুদ্ধিজীবী সম্মাননা (২০০৫)। সংবর্ধনা: ছন্দক, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত (২০০৭)।
গণচীনের রাজধানী পেইচিং-এ প্রথম বাংলা নাটক (মুনীর চৌধুরী’র “কবর”) পরিচালনা (২১.০২.১৯৮০)। রাষ্ট্রীয় সাংবাদিক প্রতিনিধি হিসেবে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস সফর (নভেম্বর, ১৯৮৪)। রাষ্ট্রীয় কবি-প্রতিনিধি হিসেবে ফার্স্ট সাউথ এশিয়ান ফেসটিভ্যাল অব সার্ক কানট্রিস্‌-এ অংশগ্রহণ, ভারত (অকটোবর, ১৯৯২)। রাষ্ট্রীয় সাহিত্যিক-সাংবাদিক প্রতিনিধি হিসেবে কলকাতা বইমেলায় ‘বাংলাদেশ দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে অংশগ্রহণ, ভারত (০৭.০২.২০০৯)। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ আয়োজিত আন্তর্জাতিক আলোচনাচক্রে সভাপতিত্ব ও প্রবন্ধ উপস্থাপন (বারাসত, ১২-১৩.০৩.২০০৯)।
# ১৯৬২: টাঙ্গাইলে শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম নেতৃস্থানীয় সংগঠক। ১৯৬৯: ঢাকায় গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম রূপকার ও সংগঠক। ১৯৭১: টাঙ্গাইলে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক সংগঠক, হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার, মৃত্যুশিবিরে নৃশংসভাবে নির্যাতিত। ১৯৯০: স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম রূপকার।

‘যেটুকু যা পারি তা-ই নিয়ে আছি’

অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় কবি সাযযাদ কাদির
ষাটের দশকের শীর্ষস্থানীয় কবি, কথাসাহিত্যিক, কলামনিস্ট, সাংবাদিক সাযযাদ কাদির এ দেশে বিরল গোত্রের একজন বহুমাত্রিক লেখক। বিচিত্র বিষয়ের প্রাঞ্জল উপস্থাপনা তাঁর রচনার প্রধান আকর্ষণ। প্রচলিত প্রচারমুখী মানসিকতার বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়েও শিল্প-সাহিত্যের জগতে তিনি অর্জন করেছেন এক মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান। তাঁর মেধাবী মননশীল লিখন-চর্চার জনগ্রাহ্যতা যেমন, তেমনই রয়েছে জনপ্রিয়তাও।
সাযযাদ কাদির লিখে চলেছেন অবিরাম। তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা প্রায় ষাট ছাড়িয়েছে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, অনুবাদ, শিশুতোষ সহ নানা বিষয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ তিনি লিখেছেন অত্যন্ত সুচিন্তিত ও সাবলীলভাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স সহ মাস্টার্স এই চিরনবীন মানুষটি শিক্ষকতা করেছেন, সম্পাদনা করেছেন দেশের জননন্দিত সাপ্তাহিক ও দৈনিক। বর্তমানে তিনি দৈনিক মানবজমিনের যুগ্মসম্পাদক। আগামী ১লা বৈশাখ (১৪ই এপ্রিল) কবির ৬৫তম জন্মদিন। সমপ্রতি লেখালেখি ও কর্ম-বর্ণাঢ্য জীবনের নানান দিক নিয়ে কথা হয়েছে তাঁর সঙ্গে। সেই আলাপচারিতার কিছু অংশ পাঠকদের জন্য তুলে এনেছেন কবি-সাংবাদিক সাবিত সারওয়ার।

: দেখতে-দেখতে  পেরিয়ে এলেন এতটা বছর। কেমন লাগছে আপনার?
? তা ৬৫ বছর কাটলো! মাঝেমধ্যে বিস্ময় লাগে বড়। আমার তো বাঁচার কথা ছিল না! বারবার আক্রান্ত হয়েছি রোগে ও ঘাতকের হামলায়, শিকার হয়েছি দুর্ঘটনার। মরতে-মরতে বেঁচে এসেছি কতবার! ভাবি, কি করে যে বেঁচে আছি! কত বার যে মৃত্যুর কথা প্রচার হয়েছে আমার! আরও এক বিস্ময় আছে আমার। সেই ১৯৫৮ সালে, তখন আমি সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র, মনে-মনে নিজের জন্য চেয়েছিলাম মাত্র তিনটি সুযোগ ? সারা জীবন যেন অব্যাহতভাবে বই পড়তে, গান শুনতে ও ছবি দেখতে পারি। জীবনে আর কোনও ইচ্ছা পূরণ না হলেও এ ইচ্ছা তিনটি ভালভাবেই পূরণ হয়েছে আমার। দেশ-বিদেশ থেকে মনের মতো বই যোগাড় করে পড়ছি সবসময়েই, টিভি ইনটারনেট সিডি ডিভিডি’র কল্যাণে বহু দুর্লভ গান শুনছি, ছবি দেখছি। ১৯৬৫’র পর আমার পড়া, শোনা ও দেখার জগতে যে বিচ্ছেদ ঘটেছিল তার পুনরুদ্ধার হয়েছে পুরো মাত্রায়। সেই ভাল লাগাটা আছে আমার মধ্যে। 

: আপনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক আবার একজন সাংবাদিকও। লেখালেখির কোন শাখাতে আপনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন? কেন?
? লিখতে কোনও অস্বাচ্ছন্দ্য নেই আমার, তা যা-ই লিখি। সব লেখাই লিখি অনেক ভেবেচিন্তে, সময় নিয়ে। ভাবনাটা যেমন মনে আসে, তেমন মনে-মনে তা রচনাও হয়ে যায়। তারপর লিখে ফেলি ধীরেসুস্থে, তাড়াহুড়া করি না। কিছু দিন পর ওই লেখা সম্পাদনা ও পরিমার্জনা করি। সাংবাদিক হিসেবে উপস্থিত প্রয়োজনের লেখা লিখতে আমি অভ্যস্ত, সেখানেও অস্বাচ্ছন্দ্যের কিছু ঘটে নি কখনও। আসলে আমার মনের কথাটি আমি সবসময়ই চাই মুখের ভাষায় লিখতে। বানিয়ে-বানিয়ে কিছু লিখি না, লিখতে গিয়ে অশালীন-অমার্জিতও হই না। এ কারণে স্বচ্ছন্দ থাকি সব ধরনের লেখাতেই। কিছু দিন আগে চাপের মধ্যেও লিখেছি, এখন আর চাপ নিচ্ছি না কোনও। এখানে বলি, মনে যত ভাবনা আসে? মনে-মনে যত রচনা হয় ? তার বেশির ভাগই শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখে না। আর কখনও-কখনও, পত্রিকার ডেডলাইন মানতে হয় বলে, কোনও-কোনও লেখা দ্রুত শেষ করেই পাঠিয়ে দিতে হয়।

: সমপ্রতি পাক্ষিক বৈচিত্রে আপনার নিয়মিত একটি কলাম ছাপা হচ্ছে ‘প্রিয়রা পরস্পরে’।  লেখাটি বাংলাসাহিত্যের শেকড়ের কথা বলে। তথ্যভিত্তিক এই লেখাটির পাঠকও দিনে-দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেন এবং কিভাবে ব্যতিক্রমী এই বিষয়টি আপনার চৈতন্যে ধরা দেয়?
? রবীন্দ্রনাথ আমার প্রিয় গীতিকবি, সুরকার, কথাশিল্পী, চিন্তাবিদ, কর্মনায়ক, মানুষ এবং বিষয়। সেই ছোটবেলা থেকে পড়ছি, জানছি তাঁকে। স্কুল কলেজ ’ভারসিটিতে পড়েছি, পড়িয়েছি, আলোচনা করেছি, বলেছি, তবে তিনটির বেশি প্রবন্ধ লিখি নি। এর মধ্যে আমার শ্রদ্ধেয় প্রিয়জন কবি মনজুরে মওলা বললেন রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর শান্তিনিকেতন সম্পর্কে আস্ত একটা বই লিখতে। লিখতে গিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করি অনেক। নতুন করে চিনতে পারি রবীন্দ্রনাথকে। ‘রবীন্দ্রনাথ : শান্তিনিকেতন’-এর পর লিখে ফেলি আরও একটি বই ‘রবীন্দ্রনাথ : মানুষটি’। এতে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক সংগ্রহ আমার জমে যায় অনেক। এ সব নিয়ে আরও কয়েকটি আকর্ষণীয় বই লিখতে পারি সহজেই। ভাবি, লিখবো। ঠিক করি কোন-কোন বিষয়ে লিখবো। তারপর বেছে নিই এই ‘প্রিয়রা পরস্পরে’।

: আপনার সমকালে কিংবা জানা মতে যাঁরা লেখালেখির শুধুমাত্র ঝুল ধরে ঝুলে আছেন তাঁদের অনেকে নামী প্রতিষ্ঠানের দামি পুরস্কার পেয়েছেন। আপনার ভাগ্যবিড়ম্বনার উৎস কি? একটু যদি বলতেন?
? লেখালেখির সঙ্গে পুরস্কারের তেমন সম্পর্ক আছে বলে মনে করি না। লেখার সময় পুরস্কারের কথা কেউ ভাবেন বলে জানি না, আমিও ভাবি না। লেখার সময় আমার সামনে, চারপাশে লেখার বিষয়ই থাকে। তাই পুরস্কার না পাওয়াটাকে আমি ‘ভাগ্যবিড়ম্বনা’ মানতে পারছি না। এ ছাড়া আমি বরাবরই প্রতিষ্ঠাবিরোধী, তাই কোনও নামী প্রতিষ্ঠানের তকমা আমার জন্য নয়। তবে পুরস্কার সম্পর্কে শুনেছি, ওগুলো নাকি দেয়া হয় না, নেয়া হয়। তাহলে বলতেই হয়, নেয়ার ক্ষেত্রে কোনও যোগ্যতাই নেই আমার।

: আমরা জানি ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে বিশেষ সাংগঠনিক ভূমিকা ছিল আপনার। ’৭১-এ ছিলেন টাঙ্গাইলে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। হানাদার বাহিনী কর্তৃক আটক হয়ে বন্দিশিবিরে নৃশংস নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আবার ’৯০-এ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। অথচ বর্তমানে বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে আপনাকে নিষ্ক্রিয়ই মনে হয়। বিষয়টি কেন যেন রহস্যের মনে হয়। ভুল বলেছি নাকি?
? আমি রাজনীতিমনস্ক, রাজনীতিসচেতন মানুষ। তবে কোনও রাজনৈতিক সংগঠনে জড়িত নই। ছাত্রজীবনে অল্প কিছু দিন ছাত্রসংগঠনে যুক্ত ছিলাম, পরে যুক্ত হয়েছি বিভিন্ন সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনে। কিছু আনুষ্ঠানিক কাজ করতে হয় এজন্য। ’৬৯, ’৭১ ও ’৯০ রাজনৈতিক ছিল না, ছিল দেশ ও জাতির মুক্তির সংগ্রাম। এ সংগ্রাম ছিল সর্বজনীন। ওই সময়ে আমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ পেয়েছি আমার বিশেষ অবস্থানগত কারণে। ’৬৯-’৭১এ আমি ছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ছাত্র, ’৯০এ ছিলাম সাংবাদিক সমাজের শীর্ষস্থানীয় নেতা। আর একাত্তরে ওটা ‘বন্দিশিবির’ ছিল না, ছিল মৃত্যুশিবির ? ডেথক্যাম্প। হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে যেতো নির্যাতন চালিয়ে হত্যার জন্য। ওখান থেকে প্রাণ নিয়ে ফেরা অলৌকিক উপায় ছাড়া সম্ভব ছিল না। আমার বেলায়ও হয়েছিল তা-ই। ঘটেছিল অলৌকিক কিছু। আমার বর্তমান ভূমিকা সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, আমি লেখক ? রাজনীতিক নই। লেখক হিসেবে লেখালেখিতে আমি যথেষ্ট সক্রিয়। আমার লেখায় প্রাসঙ্গিক রাজনৈতিক ইস্যু অবশ্যই উপস্থিত থাকে। প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে সমালোচনা থাকে, আক্রমণ থাকে। তবে আমার ভাষা উগ্র নয়, যুক্তি-প্রমাণসিদ্ধ, গণতান্ত্রিক।  এতে কোনও দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থাকে না। কারণ আমি লিখি জনগণের পক্ষে এবং জনগণের জন্য। আর আমি কোনও শক্তির কাছে নতজানু নই। বরাবরই আমি সংরক্ষণ করি আমার ভিন্নমত পোষণের ও সমালোচনা করার অধিকার। আমার ভূমিকা স্পষ্ট, এতে রহস্যের কিছু নেই।

: লেখালেখি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি। সম্বোধনের অনেক শব্দ থেকে কোনটিতে আপনি বেশি খুশি হন? কেন?
? যখন শরীরে সামর্থ্য ছিল, তখন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সংক্রান্ত জানাশোনায় ঘাটতি ছিল কম, জ্ঞান ছিল অপরিপক্ব। এখন এই এতদিনে একটু পেকেছি মনে হয়, কিন্তু খুইয়েছি শক্তিসামর্থ্য। ফলে যত কিছু ? যা কিছু লিখতে পারতাম তা আর পারছি না। অল্প নিয়ে আছি। যেটুকু যা পারি তা-ই শুধু করি। এটাই আমার ভবিষ্যৎ। সম্বোধনের ব্যাপারে বলতে হয় ? আমাকে ‘স্যর’ সম্বোধনটাই এখন প্রতিষ্ঠিত। দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করেছি, দেশে-বিদেশে, এখনও করছি। এ সূত্রেই আমার ছাত্র-ছাত্রীদের এ সম্বোধনটি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আর বহু জনসংযোগপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন পদে দায়িত্ব পালন করেছি, সে হিসেবেও ছড়িয়েছে ‘স্যর’ সম্বোধনটি। এছাড়া টাঙ্গাইলের মুক্তিযোদ্ধারা ‘স্যর’ সম্বোধন করে আমাকে। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের বাল্যবন্ধু হিসেবে এ সম্মান জানায় তারা।

হাত ধরে নিয়ে চলো সখা

ড. অমিতাভ চক্রবর্তী

আগামী ১লা বৈশাখ কবি সাযযাদ কাদিরের ৬৫তম জন্মদিন উপলক্ষে বিশেষ রচনা

মানুষের চলার পথে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা শেষ দিন পর্যন্ত মনকে আন্দোলিত করে। বর্ণময় করে রাখে হৃদয়। বছর দশেক আগে সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জে এক কবিতা-উৎসবে যোগ দিতে গিয়ে শীতের কুয়াশা জড়ানো সকালে ওই উজ্জ্বল প্রতিভাধর মানুষটিকে প্রথম দেখি। পঞ্চান্ন বছর বয়সেও সে যেন পঁচিশের যুবক। প্রায় সমবয়সী আমার। সাধারণ চেহারা অথচ উজ্জ্বল চোখ-মুখ। পরে পরিচয় প্রণয়ে পরিণত হয়। অসাধারণ প্রতিভা তার। সাহিত্য বিজ্ঞান দর্শন থেকে শুরু করে সমাজবিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় সহজ স্বচ্ছন্দ বিচরণ। এক জীবন্ত অভিধান। যত তাকে কাছ থেকে, দূর থেকে দেখি বিস্ময়ে বাক্যহীন হয়ে উঠি। এত পড়াশুনো কখন ও করে? কখন এত লেখে? ফিচার থেকে উপন্যাস, অনুবাদ থেকে শুরু করে প্রবন্ধ, কবিতা থেকে শুরু করে সম্পাদনা ? নিভৃতে নীরবে একটানা পঞ্চাশ বছর ধরে করে চলেছে দুই বাংলার জনপ্রিয় এই ব্যক্তিত্ব ? যার পরিচয় সাযযাদ কাদির নামে। সুফি সাধকের মতন নির্লোভ জীবন যাপন। সংসারের মায়াজালের মধ্যে থেকেও জ্ঞান আহরণের কঠিন ব্রত প্রত্যহ পালন করে চলেছে আমার প্রাণের প্রিয় বন্ধুটি ? যাকে মজা করে বলি ‘সাযপা৮৫’। হ্যাঁ, চর্যাপদের ৮৪ সাধক-কবির উত্তরসূরি সে, বাংলা ভাষা-সাহিত্যের অন্যতম সুসন্তান। ঘটনাক্রমে ও আমার মায়ের দেশ অর্থাৎ মাতুলদের জেলা টাঙ্গাইলের সুসন্তান। অসামপ্রদায়িক উদার মনোভাব। আরও জানার আগ্রহ, সহজ সরল জীবন যাপন আমার মতন সুরাসক্ত মানুষকে মুগ্ধ করে। লুব্ধ করে রাখে সারাক্ষণ।
    দেশ-বিদেশে বহু দিন থাকার অভিজ্ঞতা সাযযাদের বহু লেখায় বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। ওর কলম কখনও সমালোচনার সুরে হয়ে ওঠে ঝলসানো তরবারি। ভারতীয় উপমহাদেশে ও মহাচীনে যাতায়াত ও বসবাসের কারণে কবি সাযযাদ হয়ে ওঠেছে ঢাকা, কলকাতা ও পেইচিং-এর আপনজন। একজন বিশ্ব-নাগরিক। ঢাকার গ্রিন রোডে ওর সাজানো ফ্ল্যাটে দু’ একবার প্রবেশ করেছি। অসংখ্য পত্রপত্রিকা এবং হাজার-হাজার দুর্লভ গ্রন্থের ভাণ্ডার ?  দুষ্প্রাপ্য সামগ্রীর সে এক অমূল্য সংগ্রহশালা। পাগলের মতো হাজার-হাজার টাকা খরচ করে বই কেনে। সেই সঙ্গে আজন্ম রোমান্টিক মানুষটির সংগ্রহে আছে হারিয়ে যাওয়া সোনালি দিনের গান ও ছবির কয়েক হাজার সিডি ও ডিভিডি। মনে-মনে ভাবি, ওর স্ত্রী কি করে কবির এই পাগলামি সহ্য করে? বাইরে থেকে দেখে মনেই হয না চিন্তা-ভাবনায় ওর এত গভীরতা। দু’ দিনের জীবনকে, একটা জন্মকে কিভাবে পরিপূর্ণ ভাবে জ্ঞান আহরণে ও নতুন সমাজগঠনে ব্যয় করা যায়, তার জ্বলন্ত উদাহরণ আমার প্রিয় সখা সাযযাদ। বানান ও ভাষা এবং বাক্যবিন্যাসে ওর দখল বাংলা সাহিত্যের বহু অধ্যাপকের কাছেও ঈর্ষার বিষয়। অসুস্থ শরীর নিয়েও ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা কাজের অভিজ্ঞতা ওর আছে।
    বন্ধু আমার চিরসবুজ। যৌবনের প্রতীক বসন্তের অগ্রদূত। মাঝে-মাঝে ফোনে সুখ-দুঃখের কথা হয়। খুব অভিমানী বালকের মতন ওর ব্যবহার। রাগ-অনুরাগ এবং জোয়ার-ভাটার সন্ধিক্ষণে কবি সাযযাদের অবাধ বিচরণ। মাঝে-মাঝে বলে উঠি, ‘আমি যে পথ চিনি নে, হাত ধরে নিয়ে চলো সখা!’
    সাযযাদ প্রগতিশীল গণআন্দোলনের অন্যতম সৈনিক। সূর্যকে ঘিরে মহাকাশে যেমন এক ঝাঁক গ্রহ-উপগ্রহ আবর্তিত হয়, ঠিক সেই রকম সাযযাদের প্রতিষ্ঠিত বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রকে ঘিরে তৈরি হয়েছে এক ঝাঁক কবি-গল্পকার-নাট্যকার। সাহিত্য-আন্দোলনের যোগ্য সেনাপতি। ওর মনের ঔদার্য এবং সৌন্দর্য শত্রুকেও মিত্রে পরিণত করে। ওর মুখে কোনও দিন পরনিন্দা-পরচর্চা শুনি নি। বন্ধুবৎসল অজাতশত্রু এই মহান কবি।
    সাযযাদের বহু কবিতায় তাঁর নিজস্ব জীবন-দর্শন খুঁজে পাওয়া যায়। ‘পুরনো বাসা’ কবিতাটি যেমন ? এক মধ্যবিত্ত পরিবার যখন ভাড়া বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র ভাড়া যায়, তখন ফেলে আসা পোষা মেনি বেড়ালটার জন্য কবির সন্তান হারাবার মতন অসহায় কান্না-যন্ত্রণা আমাকেও এই বয়সে চোখে জল এনে দেয়। কি অসাধারণ কবির অন্তর্দৃষ্টি এবং বহিঃদৃষ্টি। ওর মণিমালা কবিতামালা বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য সম্পদ।
রাজনৈতিক কারণে কবিকে বহুবার হেনস্তা হতে হয়েছে , কিন্তু সাযযাদ কখনও হাল ছাড়ে নি। জীবনের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে নি। এপার-ওপার বাংলার বহু ধান্দাবাজ স্বার্থপর মানুষ সাযযাদের কাছ থেকে অসংখ্যরকম সাহায্য নিয়েছে, কিন্তু সেই বেইমান বিশ্বাসঘাতকদের কবি ‘ক্ষমাই সুন্দর’ মনে করে ক্ষমা করে দিয়েছে। এই ঔদার্য এবং মহানুভবতা একালের মানুষের মধ্যে দেখাই যায় না।
মহাজগতের অজানা রহস্য কবিকে আকৃষ্ট করে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ওকে বিমুগ্ধ করে রাখে। শিশুদের মন জয়ের জন্য নানান দেশের অসংখ্য লোকরচনা ভাষান্তর করেছে। দুই বাংলার হারিয়ে যাওয়া লেখকদের ওপর আমাকে অসংখ্য গ্রন্থ প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে পাঠায়। বিনিময়ে ওর করুণ প্রার্থনা । বন্ধুর কাছে আবদার ‘বই পাঠাও’। ‘আরও বই’। ‘বাংলা বই’।
সাযযাদ একজন উঁচু মাপের সাংবাদিক। একদা জনপ্রিয় অধ্যাপক এবং এখন দুই বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। ওর সঙ্গে আমার পরিচয় আমাকে গর্বিত করে। আমি অহঙ্কারী হয়ে উঠি যখন ভাবি ওই বিদগ্ধ পণ্ডিত মানুষটি আমার বন্ধু । আমাকে ভালবাসায় জড়িয়ে রেখেছে।
আন্তর্জাতিকতাবাদী-মানবতাবাদী হয়েও কবির কলমে বিদ্রূপ পরিহাস বহু লেখায় স্পষ্ট। মানুষের স্বভাব যে কাকের চেয়েও অধম, সেই বিষয়ে সাযযাদের লেখা সামান্য ‘কাক’ বিষয়ক কবিতা অসামান্য হয়ে উঠেছে। বহু বছর আগে পড়েছিলাম ওর কবিতা পড়েছিলাম চট্টগ্রাম থেকে ’৭২ সালে প্রকাশিত ‘রৌদ্র-দিন’ পত্রিকায়। তখন ওর সঙ্গে পরিচয় ছিল না। কবি মেসবাহ খানের সৌজন্যে আমিও ওই পত্রিকায় লিখি। তারপর বহু বছর বাদে ওকে আলিঙ্গন করার সৌভাগ্য হয়। আড্ডাবাজ কবির বাড়িতে স্নেহময়ী ভাবীর হাতের চা-পান, সাহিত্য-আলোচনা সবই এ জন্মের পরম প্রাপ্তি। প্রিয় কবি-বন্ধুর দীর্ঘ সাহিত্যজীবন ও সুস্বাস্থ্য প্রার্থনা করি।

ঙ ড. অমিতাভ চক্রবর্তী: কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক; রিডার, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, দমদম মতিঝিল কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

চুপ! গণতন্ত্র চলছে!!

 এটা করবো? না। ওটা করবো? না। তাহলে কেমন করবো? কেমনও করবে না। কি করবো তবে? চুপ করবে। দেশে এখন গণতন্ত্র চলছে। এ গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে সমাবেশ, মিছিল, মানববন্ধন, প্রচার, অনুষ্ঠান ঠেকাতে হবে। স্মৃতিসৌধে যেতে পদে-পদে বাধা দিতে হবে, বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান বাতিল করতে হবে, খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে যাওয়া চলবে না। ইতিহাসবিদরা ইতিহাসচর্চা করতে পারবেন না, রাজনীতিকরা করবেন। সাংবাদিকরা সংবাদ লিখতে পারবেন না, প্রশাসন দেখবে। এমন অনেক কলকাঠি নাড়ার কল আছে সরকারের। সেগুলো ক্রমে-ক্রমে বেশি করে নাড়ার আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠছে দিনে-দিনে। গণতন্ত্রের নামে ? আসলে যে কোনও কিছুর দোহাই দিয়ে, ছুতোনাতা করে বা অজুহাত দেখিয়ে অপছন্দের লোকজনকে কলে ফেলার মতো সহজ কাজ আর কিছু নেই সরকারের। কিন্তু আমি বলি এসব কল তাদের কব্জায় রাখাই ভাল। আমার প্রিয় বিজ্ঞানচেতনাবাদী সাহিত্যিক-চিন্তাবিদ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪) সেই কবে ‘কমলাকান্তের দপ্তরে’ (১৮৭৫)-র ‘আমার মন’ নিবন্ধে লিখেছেন, “তোমরা এত কল করিতেছ, মনুষ্যে মনুষ্যে প্রণয় বৃদ্ধির জন্য কি একটা কিছু কল হয় না? একটা বুদ্ধি খাটাইয়া দেখ, নহিলে সকল বেকল হইয়া যাইবে।”
    বঙ্কিমচন্দ্র যখন ওই নিবন্ধ লেখেন তখন ‘মনুষ্যে মনুষ্যে প্রণয় বৃদ্ধি’র আয়োজন চলছিল ইউরোপে ? বিশেষ করে ফ্রান্সে। Denis Saurat: লিখেছেন ? “১৮৭০-এর বিপর্যয়কালে ফ্রান্সে প্রতিষ্ঠিত হয় তৃতীয় প্রজাতন্ত্র... এ প্রজাতন্ত্র স্থান করে নেয় জনমানুষের হৃদয়ে; আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারমূলক কাজ হয়ে ওঠে জনগণের শিক্ষা। ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো ফ্রান্সের প্রতিটি গ্রামে স্থাপিত হয় একটি করে স্কুল; প্রাথমিক হলেও কার্যকর শিক্ষা পায় সাধারণ মানুষ, শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে রাষ্ট্র স্কুল প্রতিষ্ঠা করে সর্বত্র, নিখরচায় লেখাপড়ার সুযোগ দেয় সবাইকে।... বিনামূল্যে শিক্ষা পাওয়ার অধিকারী হয় সবাই; ধর্মের কোনও স্থান থাকে না স্কুলে; সকল নারী ও পুরুষের দায়িত্ব হয়ে পড়ে নিজেদের শিক্ষিত করা। গণতন্ত্রের আবশ্যিক শর্ত শিক্ষা।” (Modern French Literature, 1870-1940 )
    আমরা যে গণতন্ত্র-গণতন্ত্র করে মরছি সে গণতন্ত্রের জন্য কি করেছি বা করছি আমরা? প্রতিবেশী ভারতের অভিজ্ঞতা এখানে উল্লেখ করা যায় উদাহরণ হিসেবে, প্রখ্যাত গবেষক-চিন্তাবিদ সুভদ্রকুমার সেন লিখেছেন, “ভারতীয় সাধারণ প্রজাতন্ত্রের সংবিধান (২৬শে জানুয়ারি, ১৯৫০) একটি সমস্যা-কণ্টকিত অনুন্নত দেশের সকল প্রাপ্তবয়স্ক মানসিকভাবে প্রস্তুত ও অপ্রস্তুত নরনারীকে ভোট দেয়ার অধিকারী করে।... গণতন্ত্র বিকাশের পক্ষে, নিরপেক্ষ বিচারে, এর ফল শুভ হয় নি। গণতন্ত্রের সাফল্যের আবশ্যিক শর্ত প্রকৃত শিক্ষা। (কিন্তু ভারতে) অদ্যাপি ধর্ম সমাজজীবন থেকে বিযুক্ত হয়ে বিশুদ্ধভাবে ব্যক্তির একক জীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠে নি। ধর্মীয় উৎসবে বা মিছিলের কারণে রাস্তায় যান চলাচল ব্যাহত হয়। প্রাথমিক অথচ কার্যকরী শিক্ষা সকলের কাছে দূরে থাক অধিকাংশের কাছেই পৌঁছানো যায় নি।... গণতন্ত্রের ভিত্তি শিক্ষা।” (‘কালের যাত্রার ধ্বনি’)
    ভারতের এই আয়নায় বাংলাদেশের মুখটিও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে আশা করি। আমরা ভোট দেয়ার অধিকার যাঁদের দিয়েছি তাঁদের বেশির ভাগকে আর কি দিয়েছি? বলছি গণতন্ত্র, কিন্তু গণতন্ত্রের ভিত গড়েছি কি? তাহলে এই গণতন্ত্র, এই গণতন্ত্রের মঙ্গল কাদের জন্য? আবার যাই বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে, “দেশের মঙ্গল? দশের মঙ্গল? কাহার মঙ্গল? তোমার আমার মঙ্গল দেখিতেছি, কিন্তু তুমি আমি কি দেশ? তুমি আমি দেশের কয়জন? আর এই কৃষিজীবী কয়জন? তাহাদের ত্যাগ করিলে দেশে কয়জন থাকে? হিসাব করিলে তাহারাই দেশ ? দেশের অধিকাংশ লোকই কৃষিজীবী।... যেখানে তাহাদের মঙ্গল নাই, সেখানে দেশের মঙ্গল নাই।” (‘বঙ্গদেশের কৃষক’, “বিবিধ প্রবন্ধ ? দ্বিতীয় ভাগ”, ১৮৯২)
    বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন উনিশ শতকের শেষ দিকে, আমরা এখন একুশ শতকের প্রথম দিকে। কথাগুলো কিছুটা হালনাগাদ করার প্রয়োজন আছে কি? না। গণতন্ত্র চলছে। চুপ!


বৃহস্পতিবার, ২২ মার্চ, ২০১২

একজন কবি

অমিতাভ চক্রবর্তী

আগামী ১৪ই এপ্রিল কবি সাযযাদ কাদিরের ৬৫তম জন্মদিবস উপলক্ষে

অনেক শব্দ, অনেক বাক্য সাজাবার খেলায়,
রঙ-তুলি-চোখ-মন-মুখ মেঘের মেলায়
ভেসে-ভেসে অনেকগুলি নির্মম বছর
কাটালেন কবি, সম্মুখে তীব্র পশ্চিমি ঝড়।

অচঞ্চল হৃদয়মাঝে স্বপ্নের বকুল-ঝরা পথ,
মানুষের সংগ্রামে অশ্রু-ঘাম-রক্তের শপথ;
জিজ্ঞাসাভার মুক্ত হবে কবে বন্দি কবুতর?
পৃথিবীর মাটি থেকে মুছে যাবে লক্ষ বর্বর।

কিভাবে পৌঁছে যায় মানুষ মানুষের দরজায় ?
কিভাবে জীবন দৃপ্ত যৌবনকে আলিঙ্গন জানায়,
অভিমানী কবি জানে প্রতিটি রাত্রির কত দাম?
দুঃসাহসী নাবিক জানে চাঁদের কপালে কত ঘাম!

আকাশ বাতাস ফুল পাখি আর প্রিয় মানুষ,
দু’ হাতে ওড়ায় ঘুড়ি, পাহাড়ে আগুনে ফানুস,
কবিকণ্ঠে শুনি আজ নবপ্রজন্মের গণসংগীত
পদানত হয় না কখনও সীমান্তসৈনিক, জানে না হারজিত।

এমন একজন কবি আছেন আজ আমাদের মাঝে,
নববর্ষের নিমন্ত্রণ যার জানালায় সকাল ও সাঁঝে।

চুপ-চুপ! থাপ্পড় মারবো!

বাঙালি সবচেয়ে বেশি উপভোগ করে বিয়েবাড়ির ধুমধাম। তাই বাঙালির পরিবার, সমাজ ও সংস্কৃতি-জীবনে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। বিয়েবাড়ির আনন্দ শুধু বর্ণাঢ্য আয়োজন-অনুষ্ঠান, আলোকসজ্জা, বাহারি সাজপোশাক, সুস্বাদু চর্ব্য চোষ্য লেহ্য পেয়’র ভূরিভোজ, সুগন্ধিতে মউ-মউ সুরভিত পরিবেশ, নম্র শান্ত ললিতলবঙ্গলতা লজ্জাবতী ললনাদের রসরগড়ে রঙিলা রূপ নয় ? বর ও কনে দুই পক্ষের পরস্পরকে জব্দ ও হেনস্তা করে, ভাঙানি দিয়ে হেয় বানিয়ে গুষ্ঠি উদ্ধারের বেপরোয়া পালটাপালটি। এই প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা বকাঝকা, গালাগালি, হাতাহাতি পর্যন্ত গড়ায় কখনও-সখনও। গেট আটকানো, ধাঁধা ধরা, বুদ্ধি পরীক্ষা থেকে পানের মধ্যে মরিচের গুঁড়া, শরবতে চিনির বদলে লবণ ? এগুলো মামুলি রসিকতা। তবে বহু রসিকতা মধুরতা হারিয়ে দুঃসহও হয়ে ওঠে কখনও। একবার কাইলান (কালিয়ান?) গ্রামে বরযাত্রী হয়ে গিয়ে পরনের জামা-কাপড় হারিয়ে খালি গায়ে পায়জামা-প্যান্ট পরে টাঙ্গাইল ফিরতে হয়েছিল আমাদের। রাতে ঘুমাবার সময় পাহারা থাকা সত্বেও কোন ফাঁকে পোশাক-আশাক লোপাট করেছিল বরপক্ষের লোকজন। সেকালে তো লেঠেল নিয়ে বিয়েবাড়ি যেতে হতো বরপক্ষকে। কনেপক্ষের লেঠেলদের নানা কসরতের খেলায় হারিয়ে তবেই ঢুকতে হতো বিয়ের আসরে। শুধু তাই নয় যেতে-আসতে কোনও-কোনও গ্রামের লেঠেলদের চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হতো তাদের। এ পাল্লাপাল্লি ছিল ঐতিহ্যিক। গত শতকের চল্লিশ দশকের শেষের দিকে আমার মা-বাবার বিয়েতেও ঘটেছিল এমন। মিরের বেতকা থেকে কনে নিয়ে দেলদুয়ার যেতে পথে সাত গ্রাম পাড়ি দিতে গিয়ে অন্তত তিন গ্রামের লেঠেলদের আচ্ছামতো শিক্ষা দিতে হয়েছিল বরপক্ষের লেঠেলদের। একালে বীর্যবত্তার অমন প্রকাশ্য গৌরব প্রদর্শনের সুযোগ নেই, তবে বিয়ের আসরে কথা চালাচালি, নানা হিসাবের ঠেলাঠেলি নিয়ে রাত কাবারের উত্তেজনা আছে অনেক। আর রস-রসিকতা শ্লীলতার সীমা ছাড়িয়ে কখনও ইতরতায় পৌঁছে যায় বর-কনের বাসরঘরে। সেই ১৮৮৩ (?) সালে প্রকাশিত ‘কামিনীমালা’ সঙ্কলনে ‘বাসর রহস্য’ শীর্ষক নিবন্ধে শ্রীমতী বসন্তকুমারী লিখেছেন, “... হে বঙ্গভগ্নীগণ! চিরদিন পিঞ্জরাবদ্ধ সাধের পাখির ন্যায় সংসারে বাস করিয়া স্বাধীনতার নামে অগ্নিবৎ হইয়া উঠ, অথচ সমাজকে শাসন করিতেও কোমর বাঁধিয়া লাগ, তবে কেন তোমরা একজন অপরিচিত যুবার সম্মুখে নানা প্রকার অশ্লীল ব্যবহার করিয়া থাক।... যে লক্ষ্মীরা সম্পূর্ণ অপরিচিত পুরুষের সম্মুখে প্রথম দর্শনেই এত বাচালতা এবং বেহায়ার পরিচয় দেখাইতে পারেন, তাঁহারা স্বাধীনতা পেলে না জানি কি করেন? সত্য বটে বাঁধা গরু একবার দড়া ছিঁড়িলে খুব ছুটিতে আরম্ভ করিয়া থাকে। চিরআবদ্ধেরা যে খানিক স্বাধীনতায় একেবারে উন্মত্ত হইবেন এ আর বিচিত্র নহে।... বাসরে কোনও প্রকার ভদ্রতা কি সভ্যতা, কি লজ্জাশীলতার পরিচয় রক্ষা হয় না। আমার বিবেচনায় সমাজ হইতে এই প্রথাটি শীঘ্র উঠিয়া যাওয়াই মঙ্গল।...”
    ছোটবেলায় ধুমধামে বেশি মাতলেও বিয়েবাড়িতে দুই পক্ষের কষাকষি উপভোগ করেছি কমবেশি। এ সংস্কৃতির প্রতিফলন দেখেছি প্রায় সকল ক্ষেত্রে। স্কুলে কোনও আয়োজন-অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে যেতো অংশগ্রহণের সুযোগ পাওয়া এবং না পাওয়াদের দুই পক্ষ। অনুষ্ঠান পণ্ড করতে এবং তা ঠেকাতে কত কটুকাটব্য, দুয়ো-দুয়ো, পচা ডিম, ছেঁড়া জুতা, দেয়াল লিখন! খেলার মাঠেও একই দৃশ্য। দুই দলের গোলবার ঘিরে ভিড় করতো দুই পক্ষ ? নানা কথা বলে গোলকিপারকে ভড়কে দিতো তারা। মাঝমাঠের দু’ পাশ থেকে উঠতো নানারকম বিচ্ছিরি আওয়াজ। মাঝেমধ্যে ক্ষেপে গিয়ে খেলোয়াড়রা চড়াও হতেন দর্শকদের ওপর। মঞ্চ-অনুষ্ঠানেও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার বহু আয়োজন দেখেছি। পচা ডিম, দুয়ো-দুয়ো ছাড়াও বেদম চুলকানি সৃষ্টিকারী বিলাইশুঙশুঙি বা চৈতরা পাতার গুঁড়ো ছড়িয়ে দেয়া হতো শিল্পীদের লক্ষ্য করে। এরপর ভেস্তে যেতো অনুষ্ঠান। ১৯৭৬ সালে চম্পক নাট্যগোষ্ঠী গঠন করে ‘স্পার্টাকাস বিষয়ক জটিলতা’ মঞ্চস্থ করতে গিয়ে পড়েছিলাম সব ধরনের জটিলতায়। প্রস্তুতিপর্বে একের পর এক অভিনেতা ভাগিয়ে নেয়ার পর একেবারে পরদা ওঠার আগ মুহূর্তে নায়িকাকে ভাগিয়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র ঠেকাতে হয়েছিল তখন। তারপরও কিভাবে যেন টাঙ্গাইল নাট্যোৎসবে শ্রেষ্ঠ পরিচালকের সম্মাননা জুটেছিল আমার!
    এভাবে বিয়েবাড়ির সংস্কৃতি এখন বাঙালি জীবনের সকল ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছে একমাত্র আদর্শ। ব্যবসা, চাকরি, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, মেলা, উৎসব, সম্মেলন, নির্বাচন, রাজনীতি ? সবখানে দেখি পক্ষে-পক্ষে ঠেলাঠেলি, কাদা ছোড়াছুড়ি। এ ঐতিহ্য আমাদের সনাতন। এ আমাদের জাতীয় গর্ব, গৌরব।
    এর বেশি বলবো না আর। কে আবার তেড়েমেরে আসে, “চুপ-চুপ! থাপ্পড় মারবো!” কিছু তো বলা যাবে না তাকে। ঐতিহ্য বলে কথা!
sazzadqadir@gmail.com; sazzadqadir@rediffmail.com; sazzadqadir@yahoo.com; facebook.com/sazpa85

একজন জাহিরুল হাসান

কবি জসীম উদ্‌দীন সম্পর্কে লিখতে গিয়ে, ক’ দিন আগে, উসখুস করেছি খুব। হাতের কাছে ভাল একটা জীবনী ছিল না তাঁর। ২০১১ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি জাতীয় কবিতা উৎসবের এক সেমিনারে আমি ছিলাম সভাপতি, আলোচক ছিলেন শ্রদ্ধেয় পবিত্র সরকার। অনুষ্ঠানের ফাঁকে-ফাঁকে নানা বিষয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তখন কি এক প্রসঙ্গে কথায়-কথায় বলেছিলেন, ‘জসীম উদ্‌দীনের সেরা জীবনীটি লিখেছেন জাহিরুল হাসান। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি ছেপেছে।’ খোঁজখবর নিতে বলেছিলেন, ‘বইটি ছাপা নেই এখন।’ লেখার সময় সে কথাটা মনে পড়েছে বারবার। উসখুস করেছি সেজন্যই। মজার ব্যাপার ? লেখা শেষ, ছাপা শেষ ? তারপর সে বই এসে যায় হাতে।  হঠাৎ আজিজ সুপারমারকেটে গিয়ে সেটা পেয়ে যাই এক দোকানে। বাসায় ফিরে আগাপাশতলা উলটেপালটে নেড়েচেড়ে পড়ে ফেলি সে বই। আমি অবশ্য সেই ছোটবেলা থেকেই মনের মতো বই পেলে এভাবেই আস্ত বই হাপিস করি।
    পবিত্র সরকার হয়তো খবর পান নি জাহিরুল হাসানের ‘জসীম উদ্‌দীন’-এর দ্বিতীয় সংস্করণ বাজারে এসেছে আগের মাসে। এর প্রথম সংস্করণও বেরিয়েছিল জানুয়ারিতে, ২০০৬ সালে। বইটি সম্পর্কে সমালোচকেরা তখন মন্তব্য করেছেন ? ‘অসাধারণ’, ‘অত্যন্ত মনোজ্ঞ জীবনী’, ‘নানা অজানা তথ্য পেশ করার ধরনটি সুন্দর’, ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রকাশিত জীবনীগ্রন্থমালার অন্যতম উল্লেখযোগ্য জীবনী’, ‘ছোট অথচ চমৎকার জীবনী’। প্রতিটি মন্তব্যই যথার্থ। অক্লান্ত পরিশ্রমে সংগৃহীত সকল তথ্যপ্রমাণ ঘেঁটে জসীম উদ্‌দীনের জীবনের খুঁটিনাটি নানা দিক, বলতে গেলে প্রায় সব দিকই তুলে ধরেছেন জাহিরুল হাসান। এই তুলে ধরায় দেখতে পাই তাঁর গভীর মনোনিবেশ, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণশক্তি, নৈর্ব্যক্তিকতা, নিরাসক্ত গবেষকের মূল্যায়ন-বিশ্লেষণ। এ বই পড়েই জানতে পারলাম বাংলা একাডেমী’র ‘চরিতাভিধান’-এ কত কি ভুল আছে জসীম উদ্‌দীন সম্পর্কে। যেমন, তাঁর জন্ম ও মৃত্যু তারিখ।  অর্থাৎ জসীম উদ্‌দীনের জন্মতারিখ ১৯০৩ সালের ১লা জানুয়ারি না-ও হতে পারে, আর মৃত্যুতারিখ ১৯৭৬ সালের ১৩ই মার্চ নয়, ১৪ই মার্চ। এছাড়া জসীম উদ্‌দীন যে ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমীর সাহিত্য পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সে তথ্যটিও পেলাম এ বইয়ে। তবে কিছু-কিছু বিষয় ছুঁয়েই চলে গেছেন তিনি। বিশেষ করে ব্যক্তি জসীম উদ্‌দীনের নানা দিক। যেমন লিখেছেন, “তাঁর মোট ছ’টি সন্তান, চার ছেলে ও দুই মেয়ে।” কিন্তু তাঁদের নাম-ধাম পরিচয় তুলে ধরেন নি কিছু। কেবল বলেছেন ? ছোট মেয়ে ছাড়া সবাই উচ্চ শিক্ষা পেয়ে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত আর “বড় জামাতা মওদুদ আহমদ ব্যারিস্টার এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী।” আর ‘মেয়ে হাসনা’র উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছেন রসগোল্লা ফুটিয়ে খাওয়ার ঘটনা। কিন্তু তিনি কোন মেয়ে  ? বড় না ছোট ? বলেন নি এটুকুও। “ফরিদপুরের তরুণ তমিজউদ্দিন ওকালতি ছেড়ে কলকাতায় জাতীয় বিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দিয়েছিলেন” ? এটুকু মাত্র তথ্য দিলেন, পুরো নামও বললেন না যাঁর ? তিনি অন্য কেউ নন প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ তমিজউদ্দীন খান (১৮৮৯-১৯৬৩)। ১৯২৬ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে তিনিই পরাজিত করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলামকে। জাহিরুল হাসান ওই নির্বাচন নিয়ে লিখলেন, নজরুলকে পির বাদশা মিয়ার সমর্থন দেয়ার খবরও দিলেন, কিন্তু নির্বাচনে নজরুলের যিনি প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তাঁর নামটি পর্যন্ত উচ্চারণ করলেন না।
এ ধরনের ‘ছুঁয়ে যাওয়া’র উদাহরণ খুব বেশি নেই বইয়ে। কিন্তু যেখানে বিস্তর বিশদ তথ্যের আয়োজন, অগণ্য অ-গণ্যজনের উল্লেখ-উদ্ধৃতি, সেখানে এ অভাবগুলি চোখে পড়বেই। তবে জাহিরুল হাসান সাহিত্য-অঙ্গনে বিশেষ পরিচিতি পেয়েছেন ‘সাহিত্যের ইয়ারবুক’ সঙ্কলন-সম্পাদনার জন্য। সাহিত্যমনস্ক নকল শিক্ষক শিক্ষার্থী লেখক গবেষক সাংবাদিক প্রচারক প্রকাশকের জন্য জরুরি এই ‘বাংলা সাহিত্যের তথ্যভাণ্ডার’। ১৯০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১০ বার প্রকাশিত এ ইয়ারবুকের একাধিক সংস্করণও হয়। এতে বোঝা যায় এর পাঠকপ্রিয়তার পরিমাণ। ২০১০ ও ২০১১ সালের ইয়ারবুক পেয়েছি আমি। একটিই অভাব বোধ করেছি ? সাহিত্যিকদের জন্মস্থান ও জন্মতারিখ স্থান পায় নি এতে। আর জাহিরুল হাসানের উদারতার কথা তো আগেই বলেছি। তার সুযোগ ভালভাবেই পায় অ-গণ্যরা।
কবি-লেখক ও শিল্পীদের সুলুকসন্ধান দিলেও নিজেকে প্রচ্ছন্ন রেখেছেন জাহিরুল হাসান। সহজে জানার উপায় নেই তাঁর পরিচয়-বৃত্তান্ত। জেনেছি সরকারি আয়কর-কর্মকর্তা ছিলেন তিনি, অবসরে আছেন এখন। জন্ম ১৯৪৬ সালে। থাকেন কলকাতার কবিতীর্থ সরণিতে। ‘জসীম উদ্‌দীন’-এর মতো সুখ্যাত তাঁর আরও দু’টি জীবনীগ্রন্থ ? ‘কাজী আবদুল ওদুদ’ ও ‘রেজাউল করীম’। এছাড়া তাঁর পাঠকপ্রিয় বইয়ের তালিকায় রয়েছে ? ‘বিশ শতকের বাঙালি প্রতিভা’, ‘সাহিত্যসঙ্গী’, ‘কলমের জাদু’, ‘উর্দু ভাষা ও সাহিত্য’। তবে তাঁর কীর্তিগ্রন্থ ‘বাংলায় মুসলমানের আটশো বছর’। গত বছর কলকাতা থেকে প্রকাশিত এ বইটি এ বছর প্রকাশিত হয়েছে ঢাকা থেকে।
১২০৪ সালে বাংলায় তুর্কি মুসলমানরা আসে ? সে হিসাবে এই আট শ’ বছর। ‘প্রস্তাবনা’য় লেখক এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “... এখন এদেশের অধিকাংশ বাঙালিই মনে করেন যে, ইংরেজ না এলে বাঙালি ভারতের সবচেয়ে অগ্রগণ্য জাতিতে পরিণত হতে পারত না। কিন্তু ১২০৪ সালে বখতিয়ার (ইখতিয়ার) খলজির নদিয়া বিজয় সম্পর্কে কোনও আবেগ তাঁদের মনে নেই। না থাকলেও ছশো বছরের সুলতানি ও মোগল শাসন বাঙালির স্বরূপকে যে সম্পূর্ণ পালটে দিয়েছে এবং সেই পরিবর্তনেরও যে ইংরেজ শাসনের মতোই বেশ কিছু ইতিবাচক দিক আছে ? এ কথা একটু ভেবে দেখলে বোধহয় তাঁরাও স্বীকার করবেন। এই পরিবর্তনের একটি অনিবার্য ফলশ্রুতি (ফল) হল বাঙালি সমাজের ভিন্নতর ধর্মীয় বিন্যাস, হিন্দু ও মুসলমান দুই বৃহৎ সমপ্রদায়ে বাঙালির বিভাজন।... তুর্কিরা আসার আটশো বছর পূর্ণ হল মাত্র কয়েক বছর আগে। এই পূর্তি ঐতিহাসিকদের নজর এড়িয়ে গেছে। একে উপলক্ষ করে কোথাও কোনও সেমিনার বা কোনও বিশেষ প্রকাশনারও আয়োজন হয় নি। একটু দেরি হয়ে গেছে, তবু মনে হয় এই আটশো বছরের ইতিহাসের একটা পর্যালোচনা জরুরি।... সে উদ্দেশ্যেই এই বইটি লেখা।...”
জাহিরুল হাসান লিখেছেন, বইটি ‘ঠিক ধারাবাহিক ইতিহাস নয়, খণ্ড-খণ্ড প্রবন্ধের সঙ্কলন, সাজানো হয়েছে সময়ের ধারাবাহিকতা মেনেই। এ ইতিহাস শুধু মুসলমানের ইতিহাস নয়, গোটা বাঙালি জাতিরই ইতিহাস।...”
তাঁর এই দাবিতে অতিশয়োক্তি নেই এতটুকু। বইয়ের সূচি দেখলেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ? বাংলায় ইসলামের উৎস ও বিস্তার, সুকুমার সেনের ‘ইসলামি বাংলা সাহিত্য’ বইটির আলোচনা, মুসলিম মননে বঙ্কিমচন্দ্র ও ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস, মীর মশারফ হোসেনের নারীচরিত্র এবং মুসলিম নারী প্রগতি, জসীম উদ্‌দীনের স্মৃতিকথায় বাংলা ও বাঙালি, বঙ্গভঙ্গের মুসলমান দিক, কাজী আবদুল ওদুদের চিন্তাধারা, ছেচল্লিশের দাঙ্গা, দেশভাগের আবর্তে মুসলিম সমাজ, প্রবন্ধসাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাজগৎ, ছোটগল্পে মুসলিম সমাজ, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের জটিলতা। পড়তে-পড়তে আলোকিত হই নানা বিষয়ে। হঠাৎ জেনে যাই ‘বাংলাপিডিয়া’য় বাংলা সাহিত্যের আলোচনায় ‘মুসলিম বাংলা লিটারেচার’ শীর্ষক আলাদা উল্লেখ আছে। নতুন করে আলোক পাই আমাদের মানসগঠনের নিকট-ইতিহাস সম্পর্কে:
“১৯১১ সালে ভাষাতাত্ত্বিক মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র জন্ম, ওই বছরই বেগম রোকেয়া কর্তৃক কলকাতায় মুসলিম মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা, ১৯১৮ সালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের সম্পাদনায় ‘সওগাত’ পত্রিকার প্রকাশ, ১৯২০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনা, ১৯২২ সালে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখে কাজী নজরুল ইসলামের খ্যাতি অর্জন, ১৯২৫ সালে মূলত কুতুবুদ্দীন আহমদ-শামসুদ্দীন হুসায়ন-আবদুল হালীম-মুজফ্‌ফর আহমদ-কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ মুসলিম তরুণদের উদ্যোগে কমিউনিস্ট পার্টির পূর্বসূরি হিসেবে ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজ্যান্টস পার্টি নির্মাণ, পরের বছরে কাজী আবদুল ওদুদ ও আবুল হুসেন-এর নেতৃত্বে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের সূচনা, ১৯৩৫ সালে জসীম উদ্‌দীনের হিন্দু-মুসলিম সমপ্রীতি-সূচক কাব্য ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ লিখে ‘বেদ-ভাগবতের চেয়েও বেশি পবিত্র’ বলে দীনেশচন্দ্র সেনের কাছ থেকে অভিনন্দন লাভ, ১৯৩৭ সালে কৃষক প্রজা পার্টির অসামপ্রদায়িক নেতা ও বাঙালি জাতীয়তার প্রবক্তা ফজলুল হকের নেতৃত্বে মন্ত্রীসভা গঠন, ১৯৪৪-এ রেজাউল করীমের ‘বঙ্কিমচন্দ্র ও মুসলমান সমাজ’ লিখে মুসলিম মৌলবাদীদের মোকাবিলা, এ সবই ছিল সেই ঘটনা-শৃঙ্খলা যা পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে এক প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ ভাষা-জাতীয়তায় উদ্বুদ্ধ শ্রেণীর বিকাশ ঘটিয়েছে।... একে আমরা পুনর্জাগরণ বলে চিনতে পারি না কারণ এর যে ফলদায়ী প্রান্ত তা দেশভাগের দরুন আমাদের চোখের আড়ালেই থেকে গেছে।...”
এ বইয়ের পৃষ্ঠায়-পৃষ্ঠায় এমন অনেক পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন। পড়তে-পড়তে বুঝতে পারি, জাহিরুল হাসান কেবল একজন কৌতূহলী তথ্যান্বেষী বা অনুসন্ধিৎসু গবেষক নন, তিনি একজন গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মননশীল চিন্তাবিদ। তাঁর গবেষণা ও চিন্তাধারা আমাদের ক্রমাগত ঋদ্ধ করে চলুক ? এই কামনা করি।
sazzadqadir@gmail.com; sazzadqadir@rediffmail.com; sazzadqadir@yahoo.com; facebook.com/sazpa85

বৃহস্পতিবার, ১৫ মার্চ, ২০১২

একটি গায়েবি রিপোর্ট এবং...

কথা বলতে না দিতে চেয়ে, সারা দেশে পথ চলতে বাধা দিয়ে, সরকার সৃষ্টি করেছে এক নজিরবিহীন ইতিহাস। বাস, ট্রাক, ট্রেন, লঞ্চ, ট্যাক্সি, টেম্পো, বেবিট্যাক্সি, ভ্যান, রিকশা- সব যানবাহনের গতিরোধ করে দেখিয়েছে ক্ষমতার যথেচ্ছ প্রয়োগ। ১২ই মার্চ বিরোধী দলের মহাসমাবেশকে নস্যাৎ করতে হোটেল, রেস্তরাঁ, বেকারি বন্ধ করে অন্ন ও বাসস্থানের মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে নির্দ্বিধায়। পোস্টার, ব্যানার, মাইকিং- বেতারে-টিভিতে সমপ্রচার- সব কিছুকে বন্ধ, নিষিদ্ধ করে বাক্‌স্বাধীনতাকে রুদ্ধ, গণতন্ত্রের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেশকে এক অঘোষিত জরুরি অবস্থার পরিস্থিতিতে নিয়ে গেছে। গায়েবি রিপোর্ট নাকি ছিল ২০ লাখ লোক ঢাকায় জমায়েত হবে। তিন দিন তারা থাকবে খালেদার নির্দেশে। এতে সরকারের পতন হয়তো হবে না। কিন্তু তিন দিন যদি ঢাকায় ২০ লাখ লোক থাকে তখন কি হবে? দুনিয়ায় বর্তমান সরকার সম্পর্কে কি বার্তা যাবে? এ কারণে নাকি নীতিনির্ধারকরা স্থির করেন লোক সমাগম যে করেই হোক বন্ধ করতে হবে। এই ‘কর্তব্য’ পালন করতে গিয়ে দেশব্যাপী এমন ব্যাপক দলন দমন স্মরণ করিয়ে দিয়েছে ঘোরতর কোন যুদ্ধাবস্থাকে। তবুও মহাসমাবেশে যোগ দিয়েছে মানুষ। লাখ-লাখ মানুষ। পথে-পথে হামলা হেনস্তার শিকার হয়ে, জখম রক্তাক্ত হয়ে, ক্লান্ত শ্রান্ত অবসন্ন ক্ষুধার্ত অবস্থায় তারা এসেছে রাজধানীতে। পুলিশ ও যুবলীগ-ছাত্রলীগের মারমুখো তাড়না, অত্যাচার, নির্যাতন, লাঞ্ছনা ঠেকিয়ে রাখতে পারে নি তাদের। যানবাহন থেকে পিটিয়ে নামিয়ে দেয়া হয়েছে, তারা রওনা হয়েছে পায়ে হেঁটে। হাঁটা পথেও ছাত্রলীগ-যুবলীগ রড-লাঠি-স্টিক হাতে হামলে পড়েছে তাদের ওপর, পুলিশ বন্ধ করে দিয়েছে পথ। লঞ্চ বন্ধ, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা এসেছে নৌকায়। বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে এসেছে উপকূলীয় এলাকার মানুষ। ঢাকার অদূরে নেমে অলিগলি পথ ধরে তারা এসেছে মহাসমাবেশে। যা খুশি অজুহাত দেখিয়ে গ্রেপ্তার-আটক করা হয়েছে বহু মানুষকে, চিড়া-মুড়ি কেনার দায়েও জেলে যেতে হয়েছে অনেককে। সরকার সবই করেছে নিরাপত্তার নামে সতর্কতার কথা বলে, রাজনীতির নামে প্রতিপক্ষকে মোকাবেলার যুক্তি দেখিয়ে- কিন্তু কারও কারও ইচ্ছা-খুশি কি ছাপিয়ে ওঠেনি সব কিছুকে? ‘খবর’ দেখাতে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের কত অর্থ এ নিয়ে ব্যয় হলো সে হিসাব কে দেবে?

অবরুদ্ধ নগরীতে আমরা যেমন আছি-

কেমন আছি ১২ই মার্চকে ঘিরে হঠাৎ অবরুদ্ধ নগরীতে পরিণত রাজধানী ঢাকায়? অঘোষিতভাবে কিছু বলা নিষেধ, কোথাও চলা নিষেধ। সরকারের স্বউদ্যোগে অবরুদ্ধ এ নগরীতে অচল হয়ে পড়েছে জীবন। বাস, ট্রাক, টেম্পো, ট্যাক্সি, বেবিট্যাক্সি, ভ্যান চলছে হঠাৎ দু’একটি। বাইরে থেকে আসছে না, যাচ্ছেও না। লঞ্চ বন্ধ, ট্রেন না চলার মতো। পথে পথে যাত্রী দুর্ভোগ চরমে। অফিসে বা স্কুল-কলেজে যাওয়া-আসা প্রায় বন্ধ। অঘোষিত ছুটি চলছে নানা ব্যস্ত কার্যালয়ে। চাকাও ঘুরছে না অনেক কারখানা-ফ্যাক্টরিতে। মুমূর্ষু বা গুরুতর অসুস্থ রোগীকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন আত্মীয়-স্বজনরা। কোথায় হাসপাতাল, ডাক্তার বা চিকিৎসা? মানুষ বড় বিপন্ন এখন রাজধানীতে। চারদিকে গুজব গুঞ্জন। তা নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা, নানা আশঙ্কা। বাজারে সরবরাহ নেই। হু-হু করে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। থলে হাতে শুকনো মুখে ঘুরছে খাদ্যসন্ধানী নর-নারী। ঘরে-ঘরে লোডশেডিং, আর বাইরে পুলিশ-র‌্যাব। ধরপাকড়, হেনস্তা, হয়রানি, চড়া হারে গ্রেপ্তার বাণিজ্য। সবার উপরে প্রশ্ন, কি হবে আজ? ঘটনাস্রোত গড়াবে কোন দিকে? কখন কিভাবে অবসান ঘটবে এই অবরুদ্ধতার? কোন বিক্ষোভ বিস্ফোরণে?

একটি আদর্শ মহাসমাবেশ

রাজনীতিকরা নানা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। রাজনীতির ভাষণ থেকে তা বোঝা যায় সহজেই। যে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়নি তার আয়োজন করেই তারা আগে থেকে প্রচার করতে থাকেন ‘বিশাল জনসভা’ বা ‘ঐতিহাসিক জনসভা’। সেই ছোটবেলা থেকে এখনও আমি অবাক হয়ে ভাবি, কি করে এমন আগাম ঘোষণা দিতে পারেন তারা! কি করে সব কিছু জানতে পারেন আগেভাগে! একই ভাবে ‘সমাবেশ’ যে ‘মহাসমাবেশ’ হবে তা-ও অগোচরে থাকে না তাদের। এ নিয়ে জোরেশোরে প্রচার-প্রচারনা চলে আয়োজনের পরিকল্পনার সময় থেকেই। মুশকিল হলো আর কোন ব্যাপারেই তাদের আগাম ঘোষণা বাস্তবায়ন হয় না কখনও। তখন ‘পরিকল্পনা’র ‘পরি’ উড়ে যায়, কেবল ‘কল্পনা’টুকু থাকে। যাহোক, সামপ্রতিক দু’টি মহাসমাবেশ সূত্রেই এত সব ভনিতা। দু’টি জোট, একটি মহাজোট, আয়োজন করেছিল এই মহাসমাবেশ দু’টির। আমার ভাল লেগেছে দ্বিতীয়টি। এর আয়োজন-অনুষ্ঠান হয়েছে আমার মনমতো। দু’টি মহাসমাবেশের গালাগালি, রাগারাগি, হুমকি-ধমকিও উপভোগ করেছি বেশ। বুঝেছি তাদের আর অন্য কিছু বলার নেই। বলা শেষ, মানে কম্মও শেষ। দেশবাসীর জন্য এরচেয়ে বাঁচোয়া আর কি আছে!
তবে দ্বিতীয় মহাসমাবেশটি কেন এত ভাল হয়েছে তা বলি এখন। এর অনুষ্ঠান-আয়োজনে কোন সমস্যা হয়নি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। সমাবেশে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি মিলেছে কোন টালবাহানা ছাড়াই। এ জন্য ধরাধরি দৌড়ঝাঁপ করতে হয়নি। তাছাড়া এ মহাসমাবেশ নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, রিপোর্ট লেখা, তৎপরতা? এসব কিছুই ছিল না। সপ্তাহ খানেক আগে থেকে দেশব্যাপী ধরপাকড় চালাতে হয়নি। আরও অনেক শান্তিতে ছিলেন তারা। পুলিশ, গোয়েন্দা, আনসার, ভিডিপি, র‌্যাব, বিজিবি- কারও পথে পথে টহল দিতে হয়নি, চেকপোস্ট বসাতে হয়নি। রাজধানীর ভবনগুলোর ছাদের উপরে উপরে, মহাসড়কের পয়েন্টে পয়েন্টে, নৌপথের ঘাটে ঘাটে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়নি। মহাসমাবেশের যাত্রীদের ঠেকাতে হয়নি, গ্রেপ্তার বা আটক করতে হয়নি। বড় কথা তাদের কোন গ্রেপ্তার বাণিজ্য করে দুর্নাম কিনতে হয়নি। ফলে বাস, ট্রাক, ট্রেন, টেম্পো, ভ্যান, ক্যাব, বেবিট্যাঙি, মাইক্রোবাস, রিকশা চলেছে রাস্তায়। লঞ্চ-ট্রলারও ভিড়তে পেরেছে ঘাটে ঘাটে। তাই গাড়ি-বাড়ি তল্লাশি করে নিরীহ লোকজনকে হেনস্তা হয়রানি নিগ্রহ করার ঝামেলায় পড়তে হয়নি আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে। চিড়া-মুড়ি কেনার জন্য কাউকে জেলে ঢোকাতে হয়নি। হোটেল, রেস্তরাঁ, বেকারি বন্ধ করে মানুষের থাকা-খাওয়ার মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের দায় নিতে হয়নি ঘাড়ে। বলা যাবে না, চলা যাবে না, খাওয়া যাবে না, থাকা যাবে না? এমন একটি নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হয়নি। নাশকতার আশঙ্কার নামে দেশকে অধিকৃত দেশের মতো করে তুলতে হয়নি। এই তো গেল নিরাপত্তার দিকটি। রাজনৈতিক দিক থেকেও আমার মনমতো হয়েছে দ্বিতীয় মহাসমাবেশটি। এ কাজে দলের ছাত্র-যুব-শ্রমিক-স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মী-ক্যাডারদের চাঁদাবাজি ছাড়া আর তেমন কোন কাজে নামতে হয়নি। রড-লাঠি-স্টিক হাতে রাস্তার মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিয়ে মহাসমাবেশের নিরস্ত্র যাত্রীদের দেখামাত্র হামলে পড়তে হয়নি। ঘাটে কোন লঞ্চ ভিড়া মাত্র লাঠি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়নি। আনসার-পুলিশদেরও গ্রেপ্তার বা আটকের ঝামেলা করতে হয়নি। তবে সবচেয়ে ভাল লেগেছে মহাসমাবেশের যাত্রীদের। তারা দলে দলে মিছিল নিয়ে যোগ দিয়েছেন মহাসমাবেশে। হাতে লগি-বৈঠা, লাঠি-ডান্ডা থাকলেও তাদের আটক বা গ্রেপ্তার হতে হয়নি। পথে পথে পিটুনি খেয়ে রক্তাক্ত জখম হতে হয়নি, প্রাণ বাঁচাতে ছুটে মরতে হয়নি পথে-ঘাটে অলিতে গলিতে।
সত্যিই সর্বাঙ্গসুন্দর হয়েছে দ্বিতীয় মহাসমাবেশ। দেশের প্রতিটি জনসভা-সমাবেশ যেন এমনই হয়?এ কামনাই করি। এমন একটি আদর্শ মহাসমাবেশের জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ জানাই। আপনাদের জয় হোক। গণতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক।


sazzadqadir@gmail.com

বুধবার, ১৪ মার্চ, ২০১২

বসন্ত: ফুলের পেয়ালা হাতে সাকি

শীতের রিক্ত রুক্ষ বিবর্ণতার পর আসে বসন্ত। আলোময় হয়ে ওঠে আকাশ, চারপাশে পুলক বয়ে আনে স্নিগ্ধ শীতল মৃদুমন্দ বাতাস। ফুলে-ফুলে পত্রপল্লবে বর্ণে-গন্ধে নতুন রূপে শোভিত প্রকৃতির বুকে জাগে রঙিন উচ্ছ্বাস, সেই সঙ্গে জীবনও মাতোয়ারা হয় প্রাণময় উৎসবে। বসন্ত তাই নতুনের প্রতীক, সে নতুন করে তোলে সব কিছু। যে দিকে চোখ যায় সে দিকেই নতুন জন্ম, নতুন নির্মাণ, নতুন বিকাশ। প্রকৃতি যেন সব দিকে জ্বালিয়ে দেয় সবুজ আলো, তাই সব দিকে খুলে যায় দিগন্তে উধাও পথ, আর শুরু হয় জীবনের হাসি-খুশি ছুটে চলা। ভাবি, কি শক্তি এই প্রকৃতির! আমাদের নিত্য দিনের একঘেয়ে বৈচিত্র্যহীন জীবনে ? বিপর্যস্ত, জঞ্জালপূর্ণ, কটুগন্ধী পরিবেশে কি রূপান্তরই না ঘটিয়ে দেয়! উষ্ণ রোদ কিন্তু শীতল বাতাস ? এ এক ভারি আশ্চর্য জাদু। ইংরেজ কথাশিল্পী চার্লস ডিকেন্স (১৮১২-১৮৭০) লিখেছেন, বসন্ত দুই ঋতু মিলিয়ে এক ঋতু ? এর আলোর উজ্জ্বলতা গ্রীষ্মের, এর স্নিগ্ধ ছায়া শীতের। এমন যুগল মাধুরীর কারণেই এ ঋতু এত মনোরম, এত উপভোগ্য। জারমান কবি রাইনের মারিয়া রিলকে (১৮৭৫-১৯২৬) লিখেছেন, বসন্ত এলে পৃথিবী আমোদিত আহলাদিত হয়ে ওঠে কবিতা জানা শিশুদের মতোই। আসলেই বসন্ত কবিতার ঋতু, কবিদের মুগ্ধ আতিশয্যের কাল। উত্তর ভারতের কবি কালিদাস (চতুর্থ শতক) বসন্তকে বলেছেন ‘সর্বাঙ্গসুন্দর’। এ ঋতুকে তিনি বর্ণনা করেছেন প্রেম কাম মিলন বিরহের নানা আবেগ ও অভিব্যক্তিতে। তাঁর ‘পুষ্পবাণবিলাস’ কাব্যে নায়কের আসন্ন বিচ্ছেদে, বিরহব্যথার আশঙ্কায় কাতর, এক নায়িকা বলেছে, ‘হে হৃদয়েশ্বর! বসন্ত দুয়ারে, আর তুমি ছেড়ে যাচ্ছো আমাকে?’ আরেক নায়িকা বসন্তকে বলেছে নির্দয়। কারণ তার আগমনে সে জর্জরিত হয়েছে বিরহজ্বালায়। ‘কোকিলের কুহু রব শুনে, পূর্ণচন্দ্রের কিরণচ্ছটা দেখে আর দখিনা বাতাসের নিষ্ঠুর আচরণে’ সে হয়ে পড়েছে মৃতপ্রায়। ‘ঋতুসংহার’ কাব্যেও কালিদাস বসন্ত অধীর ও উন্মনা করে দেয় প্রণয়ীদের। সে রূপের ডালি নিয়ে হাজির হয় প্রেমজ্বালায় তাদের পুড়িয়ে মারতে। গাছে-গাছে আম্রমুকুল, ভ্রমরদল, রক্তবর্ণ অশোক পুষ্পরাশি, কোকিলের কুহু তাদের করে রাখে উৎসুক ও উৎকণ্ঠিত, মিলনেও ফুরায় না সে আকুল অধীরতা। কিন্তু ভিন্ন রূপও আছে বসন্তের। সে রূপ এঁকেছেন বাংলার কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী (আ. ১৫৪৭-?)। তাঁর ‘চণ্ডীমঙ্গল’ (১৫৯৪-১৬০৬) কাব্যের দুঃখী নায়িকা ফুল্লরা বিলাপ করেছে, বসন্তে মদনজ্বালার চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে দারিদ্র্য ও ক্ষুধার জ্বালা। সে জ্বালায় রাতে পাশে শোয়া প্রিয় পতিকে মনে হয় ক্রোশ খানেক দূরে। বাংলা ও বাঙালির জীবনে উভয়ই বাস্তব, তবুও বাংলার কবিরা জীবনের সকল দুঃখ ব্যথা পরাভবকে জয় করে গেয়েছেন ফুল্ল বসন্তের গান, বন্দনা করেছেন প্রেম প্রীতি ভালবাসার। প্রকৃতির বিকাশে তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন জীবনের ঐশ্বর্যকে।
    মিথিলা’র কবি বিদ্যাপতি (আ. ১৩৮০-১৪৬০) বসন্তকে বলেছেন ‘ঋতুরাজ’। তাঁর কাব্যে পাই নায়িকার বসন্তযাপনের আবেগঘন বিবরণ:
    ... সেই কোকিল অব লাখ ডাকউ
    লাখ উদয় করু চন্দা।
    পাঁচ বাণ অব লাখ বাণ হোউ
    মলয় পবন বহু মন্দা ॥...
    বসন্তে এমন প্রেমানুভূতির প্রকাশ দেখি সমসাময়িক কবি শাহ মুহম্মদ সগীর (আ. ১৪-১৫ শতক)-এর ‘ইউসুফ জোলেখা’ কাব্যেও:
    মাঘ হৈল পরকাশ কানন কুসুম হাস
    শুভ ছিরি পঞ্চমী প্রকাশ।
    মউলিত পুষ্পবন মদন মোহন ঘন
    তা দেখিআ মোর মনোদাস ॥
    বিকশিত আম জাম ভ্রমর ভ্রমএ কাম
    সৌরভ ধারন্তি চতুর্দিশ।
    মলয়া সমীর ধীর হৃদয় অন্তরে পীড়
    বিরহিনীজন অহর্নিশ ॥
    ফাগুনে চৌগুণ রীত নানা পুষ্প বিকশিত
    যুবজন ফাগু বিভূষিত।
    নবীন পরব বেশ সুরঙ্গ দুর্লভ দেশ
    তরুলতা নবরঙ্গ হাস।
    জুবক জুবতীগণ নানা বস্ত্র বিভূষণ
    আভরণ বিচিত্র বিলাস ॥
    চৈত্র হৈল সুললিত নানা পুষ্প বিকশিত
    চম্পক চামেলী যূথী জাতী।
    নাগেশ্বর শতবর্গ লবঙ্গ গুলাল স্বর্গ
    আমোদিত প্রতি পাতি পাতি ॥...
    মধ্যযুগের কবিদের ঋতু-বর্ণনা আমাদের মুগ্ধ করে এখনও। বুঝতে পারি কেবল কাব্যের শর্ত মেনে গৎবাঁধা বর্ণনা করেন নি তাঁরা, প্রতিটি ঋতুকে তুলে ধরেছেন ভিন্ন-ভিন্ন জীবন-প্রতীকে। সে অনুযায়ী বেশির ভাগ কবি বর্ষাকে বলেছেন ছয় ঋতুর রানী আর বসন্তকে বলেছেন রাজা। বর্ষা বিরহের প্রতীক, আর বসন্ত প্রেম-আনন্দের। চট্টগ্রামের কবি দৌলত উজির বাহরাম খান (১৬ শতক)-এর ‘লায়লী মজনু’ (১৫৪৩-১৫৫৩) কাব্যে সে রূপেই দেখি বসন্তকে:
    ... অলিকুল গুঞ্জে নওবত বাজে
    কেহ নাদএ নাকাড়া ॥
    কানন কুসুমিত নলিনী আমোদিত
    চৌদিশ মন্দির স্থল।
    বালেমু সুবদনী দোহঁ মিলি নিরজনি
    খেলত রঙ্গে ধামাল ॥
    এই দূতী মণ্ডল কো নাহি জানল
    বিষম কাম হলাহল।
    গোধর হরিহর অন্তর জরজর
    কো নহি তিতল জ্বাল ॥
    নাগর অতি নব তুরিতে মিলাওব
    কেলি করাওব তছু সঙ্গে।
    কি করব মারুত চঞ্চল পরভৃত
    কি করব কঞ্চক অনঙ্গে ॥...
    সতের শতকের মহাকবি আলাওল (১৬০৭-১৬৮০) ‘পদ্মাবতী’ কাব্যে দীর্ঘ বর্ণনায় তুলে ধরেছেন তাঁর নায়ক-নায়িকার অধীর বসন্তযাপনের নানা ছবি। সেখান থেকে উদ্ধৃত করি কয়েক পঙ্‌ক্তি:
    ... মলয়া সমীর হৈলা কামের পদাতি।
    মুকুলিত কৈল তবে বৃক্ষ বনস্পতি ॥
    কুসুমিত কিংশুক সঘন বন লাল।
    পুষ্পিত সুরঙ্গ মল্লি লবঙ্গ গুলাল ॥
    ভ্রমরের ঝঙ্কার কোকিল কলরব।
    শুনিতে যুবক মনে জাগে মনোভব ॥...
    আদি ও মধ্যযুগের ঋতুকাব্যের উত্তরাধিকার সগৌরবে বহন করেছেন যুগসন্ধির কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮৫২-১৮৫৯)। বসন্তে প্রকৃতির ফুলে-ফুলে সেজে ওঠা, সেই সঙ্গে জীবনে পরিবর্তনের নানা ছবি এঁকেছেন তিনি। কিন্তু প্রেম মিলন অভিসার বিরহ ছাড়া কি এ ঋতুর সার্থকতা আছে কোনও? রঙ্গ-ব্যঙ্গে সিদ্ধহস্ত গুপ্ত-কবি বসন্তে সমব্যথী হয়েছেন বিরহিণী নারীর:
    যদবধি প্রাণনাথ প্রবাসেতে রয়।
    বসন্ত পীযূষ সম, বিষোপম হয় ॥
    কোকিলের কুহুরবে কুহক লাগায়।
    আমার হৃদয়ে আসি’ বিঁধে শেল প্রায় ॥
    বকুল মধুর গন্ধে প্রমোদিত বন।
    আকুল করিল তায় অভাগীর মন ॥
    পলাশে বিলাস করে মালতীর লতা।
    প্রবল করয়ে তার মনোমলিনতা ॥
    নাগেশ্বর কেশর বেশর সম শোভা।
    প্রজাপতি বসে ধরি’ মনোহারী প্রভা ॥
    যেন কোন চতুর লম্পট জন শেষ।
    ভুলায় ললনা-মন ধরি’ নানা বেশ ॥
    পরে মধু ফুরাইলে, অমনি প্রস্থান।
    যে দিকে সৌরভ ছোটে সে দিকে পলান ॥
    সেই মত আমারে ভুলালে অরসিক।
    আশাপথ চেয়ে আঁখি হোলো অনিমিখ ॥
    একালে কবিতা ও গানে যুগ-যুগ ধরে কীর্তিত বসন্তের মহিমাকে আরও ঐশ্বর্যময় করেছেন রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, নজরুল সহ অনেক কবি। প্রকৃতির বুকে বসন্তকে নবজীবনের, উজ্জীবনের এবং পুনরুজ্জীবনের প্রতীক হিসেবে দেখেছেন তাঁরা। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “... বসন্তে... প্রাণের অজস্রতা, বিকাশের উৎসব। তখন আত্মদানের উচ্ছ্বাসে তরুলতা পাগল হইয়া উঠে; তখন আমাদের হিসাবের বোধমাত্র থাকে না; যেখানে দু’টো ফল ধরিবে সেখানে পঁচিশটা মুকুল ধরাইয়া বসে। মানুষই কি কেবল... আপনাকে ফুটাইবে না, ফলাইবে না, দান করিতে চাহিবে না; কেবলই কি ঘর নিকাইবে, বাসন মাজিবে; যাহাদের সে বালাই নাই, তাহারা বেলা চারটে পর্যন্ত পশমের গলাবন্ধ বুনিবে। আমরা কি এতই একান্ত মানুষ? আমরা কি বসন্তের নিগূঢ় রসসঞ্চার বিকশিত তরুলতাপুষ্পপল্লবের কেহই নই?...” দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানেও বসন্তে বিকাশের অজস্রতায় একাত্ম হওয়ার আহবান:
    আয় রে বসন্ত তোর ও কিরণ পাখা তুলে।
    নিয়ে আয় তোর কোকিল পাখির গানের পাতা গানের ফুলে।...
    নিয়ে আয় তোর কুসুমরাশি,
    তারার কিরণ চাঁদের হাসি,
    মলয়ের ঢেউ নিয়ে আয় উড়িয়ে দে মোর এলোচুলে।...
তবে নগরজীবনের কৃত্রিমতায় ? যান্ত্রিকতায় বসন্ত যে তার প্রাচীন জৌলুস অনেকখানি হারিয়েছে তা-ও দুঃখ করে বলেছেন তাঁদের অনেকে। ভোগবাদী সমাজে বসন্ত-ও যে পণ্য হয়ে উঠেছে, একে ঘিরে যে ব্যবসা জমে উঠেছে ? সে দুঃখও করেছেন অনেকে। তাই শুনি কবির ব্যঙ্গোক্তি ? ‘বসন্ত কি আর্য আহা ? এসপ্ল্যানেডে আশ্চর্য জনতা!’ কারও রসিকতা আরও রঙ্গমধুর। তারাপদ রায় দেখেন ন্যাকা গাছে দখিনা ছোকরার সুড়সুড়ি, শিমুল শিরীষ ঢালে বিষ মনে মনে, কবিরা জড়িয়ে যায় লিরিকের লতায়। আসলে কবিতা কি? কিঞ্চিৎ রৌদ্রের সঙ্গে কতিপয় ফড়িংয়ের বাহার! তারপরও তো মানুষ ও প্রকৃতি এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা, তাই বসন্ত আসে, হৃদয়ের দু’কূল ছাপিয়ে ভালবাসার বন্যাও আসে কোন অলক্ষ্য প্রাণ-উৎস থেকে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘হৃদয়ের জগতেও একটা বসন্তের হাওয়া আছে ? সে কোন স্বর্গ থেকে আসে, গলির মোড় থেকে আসে না।’ আরও লিখেছেন, ‘বসন্ত ঋতুরই ধাতটা বায়ুপ্রধান ? সেই বায়ুর প্রকোপেই বিরহমিলনের প্রলাপটা প্রবল হয়ে ওঠে।’ এর রূপচ্ছবি তিনি দিয়েছেন কবিতায়:
... ফাগুন মাসে দখিন হতে হাওয়া
বকুল বনে মাতাল হয়ে এল।
বোল ধরেছে আমের বনে বনে,
ভ্রমরগুলো কে কার কথা শোনে,
গুনগুনিয়ে আপন মনে মনে
ঘুরে ঘুরে বেড়ায় এলোমেলো।... (‘হোরিখেলা’)
এ প্রাণমত্ততা বসন্তের ফাগুনবেলায় কি চৈত্রদিনেই শুধু সম্ভব। সে চৈত্রমাস কারও চোখে সর্বনাশ দেখার মাস। বুঝি তাই ছান্দসিক কবি আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪)-ও লেখেন:
    ফাল্গুনে দেখিয়াছিনু স্বপ্নশীলা সখিরে আমার ?
    তনুলতা লীলায়িয়া চলিয়াছে মন্দার-চয়নে,
    শুভ্র বুকে পদ্মকলি শিহরায় সুগন্ধি-শয়নে,
    অপাঙ্গে ভ্রূভঙ্গে খেলে অনঙ্গের বাঁকা তরবার, ?
    স্তনতটে লোটে মালা, শ্রোণীমূলে মেখলা-ঝঙ্কার,
    ওষ্ঠাধরে স্ফূর্তহাসি, রূপ-নেশা ঘূর্ণিত নয়নে,
    স্নায়ুতে শিরায় নৃত্য, রক্তরেণু পুষ্প-প্রসাধনে,
    চরণে অলক্ত-রেখা ? লেখা দূর দীর্ঘ অভিসার।...
    ঐতিহ্যের কবি ফররুখ আহমদ (১৯৭৮-১৯৭৪) জীবনে তারুণ্যের উদ্ভাসন দেখেছেন বসন্তে, অনুভব করেছেন হৃদয়ের অনুরাগ-দীপ্ত জাগরণ:
    ‘বনানী সেজেছে সাকি ফুলের পেয়ালা নিয়ে হাতে’,
    তুহিন শীতের শেষে দেখি আজ মুক্ত রূপ তার,
    গাছে গাছে, ডালে ডালে তারুণ্যের জেগেছে জোয়ার;
    জেগেছে ফুলের কুঁড়ি অরণ্যের মদিরা বিলাতে।
    ...
    এখন তরুণী সেই প্রশাখার মত বাহু মেলে
    একান্তে প্রতীক্ষমানা দয়িতের সাথে চায় মিল,
    অরণ্যের শামাদানে প্রতীক্ষার মণিদীপ জ্বেলে
    দেখে সে বিস্ময়ে চেয়ে সাজানো বনের মহফিল!
    হৃদয়ের সব সুর, অনুরাগ কণ্ঠে তার ঢেলে
    এ নির্জন বনছায় গেয়ে যায় প্রচ্ছন্ন কোকিল ॥ (‘ফাল্গুনে’)
    বসন্ত সত্যিই বুঝি ফুলের পেয়ালা হাতে সাকী! কিন্তু কবিদের বসন্ত কি শুধুই প্রেম-কাম লীলা-বিলাস মগ্নতার কাল? জীবনের আর কোনও পরিসরে কি স্থান নেই তার? শিশুদের জীবনেও যে অনাবিল আনন্দের উৎস হয়ে আসে সে তা লিখেছেন কবি শেখ ফজলল করিম:
    ... এসো এসো ঋতুর রাজা
    ধর মোদের স্নেহ তাজা রে
    বল কোথায় বছর ভরে
    ফুল ফোটালে কেমন করে হে
    বাংলা মায়ের কানন ছেড়ে
    সুখ পাও কি দুনিয়া ফিরে হে!
    আমাদের বাগান কর আলা
    কাল সকালে গাঁথব মালা যে।
    ভোরেই এসো বনের রাজা
    ফুল দিও ভাই তাজা তাজা যে।   
sazzadqadir@gmail.com; sazzadqadir@rediffmail.com; sazzadqadir@yahoo.com; facebook.com/sazpa85

বৃহস্পতিবার, ৮ মার্চ, ২০১২

সত্য শুধু নিজেরটুকু

মাগুরা’য় বাউলদের অনুষ্ঠানে হামলা হয়েছে কিছু দিন আগে। মাদরাসা-মক্তবের ছাত্র-শিক্ষকেরা মিলে পণ্ড করে দিয়েছে তাদের আসর, মারপিটও করেছে। এর আগে বাউলদের ওপর চড়াও হওয়ার ঘটনা ঘটে রাজবাড়িতে। সেখানে তাদের হেনস্তা করা হয় রীতিমতো মাথা মুড়িয়ে। ক’ দিন আগে হিন্দুদের মন্দির-অনুষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর হয় চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে। দাড়ি, টুপি ও বোরকা’র কারণেও লাঞ্ছনা-গঞ্জনার ঘটনা ঘটছে এখানে ওখানে। বলবো, এ সবই সমাজে হিংসা ছড়িয়ে পড়ার ফল। তাই অসহিষ্ণুতা আর উত্তেজনা সবখানে। এ অসহিষ্ণুতার কারণ যে মত, পথ, চিন্তাধারা নিয়ে বিরোধিতা বা দল, গোষ্ঠী, সমপ্রদায়গত ভিন্নতা ? তা নয়। কোনও আর্থ-সামাজিক স্বার্থও ইন্ধন যোগায় এ সবের পিছনে। জায়গা-জমি দখল, আর্থিক লেনদেন ইত্যাদি নিয়েই উত্তেজনা সৃষ্টি হয় বেশি, তবে যথাবিহিত আমন্ত্রণ বা আসন না পাওয়ার কারণেও হুড়হাঙ্গামা ঘটে অনেক। হানাহানির খবর তাই সবখানে সবদিন। এ এক নিত্য সামাজিক উচ্ছৃঙ্খলতা। আজ ৮ই মার্চের পত্রপত্রিকায় পড়ছি এমনই কয়েকটি খবর। রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার মোফাজ্জল হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে অস্ত্র দেখিয়ে অপহরণ করেছিল ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠন যুবলীগের তিন কর্মী। তারা লাঞ্ছিতও করছে তাঁকে। বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে তাদের মনোনীত প্রার্থীকে সমর্থন দিতে প্রধান শিক্ষককে বাধ্য করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। কাপাসিয়ায় ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মীদের হামলায় আহত বিরোধী দলের অঙ্গ সংগঠন যুবদলের কর্মীর মৃত্যু ঘটেছে। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় জমিজমা নিয়ে বিরোধের জের ধরে এক গৃহবধূকে পিটিয়ে হত্যা করেছে প্রতিবেশী পক্ষ। মাগুরা’র শ্রীপুরে দুই দল গ্রামবাসীর সংঘর্ষে ভাঙচুর ও লুট হয়েছে ৫০-৬০টি ঘরবাড়ি। এর নেপথ্যে রয়েছে এক চেয়ারম্যান ও এক মেম্বারের নির্বাচনী বিরোধ। জেলায়-জেলায় এমন দলে-দলে চড়াও হওয়ার খবর আছে আরও। প্রশ্ন করি, কেন এত হামলা হাঙ্গামা অস্থির করে তুলছে সমাজজীবনকে? উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই চোখে পড়ে আমাদের আক্রমণাত্মক রাজনীতির চেহারাটা। এ রাজনীতির ভাষায় হিংসার উত্তাপ, বিদ্বেষের বিষ আর শক্তির আস্ফালনই শুধু শুনি। কারণ অন্য কিছু নয় ? ক্ষমতাহীনের ঈর্ষা আর ক্ষমতাসীনের ভয়। এই কাড়াকাড়ি কামড়াকামড়ি কোনও শুভতার লক্ষণ নয়, তবে অত্যন্ত সংক্রামক। তাই ক্ষমতাকেন্দ্রের পথ ও প্রাসাদ থেকে তা ছড়িয়ে পড়ে সমাজের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে। ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে একটি প্রশ্ন তুলেছেন শরৎচন্দ্র ? ‘মাত্র নিজের প্রয়োজনটুকুই কি একমাত্র সত্য?’ আমাদের রাজনীতিতে এ প্রশ্নের উত্তর, হ্যাঁ। এখানে নিজেরটুকু ছাড়া অন্যের কোনও কিছুর কোনও মূল্য নেই, সেগুলোর মূলোৎপাটনই একমাত্র লক্ষ্য। রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে এখানে সমাপ্তি টানি আমার বক্তব্যে। তিনি লিখেছেন, “কোনও দেশের অধিপতি যদি এ কথা অত্যন্ত করে জানেন যে সেই দেশ থেকে তাঁদের নানাপ্রকার সুবিধা ঘটছে, তবে সেই দেশকে তাঁরা সুবিধার কঠিন জড় আবরণে বেষ্টিত করে দেখেন ? প্রয়োজন সম্বন্ধের অতীত যে চিত্ত তাকে তাঁরা দেখতে পারেন না।” (‘বিশ্বব্যাপী’, “শান্তিনিকেতন”)

বুধবার, ৭ মার্চ, ২০১২

যেভাবে অক্ষরবন্দি হলো...

আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘রৌদ্রে প্রতিধ্বনি’ (১৯৭৬) প্রকাশের পর ‘মুক্তধারা’র প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহা একদিন কথায়-কথায় বলেন, এখন থেকে বড়দের বই আর বের করবো না ভাবছি। জিজ্ঞেস করি, কারণটা কি? এত আয়োজন, উৎসাহ কি সব বৃথা যাবে? তিনি বলেন, প্রায় বৃথাই গেছে। লোকে আর বই কেনে না। বই পড়ার সেই অভ্যাসই আর নেই। বলি, তাহলে সে ধরনের বই-ই প্রকাশ করুন যা পাঠক সৃষ্টি করবে, পাঠাভ্যাস গড়ে তুলবে। চিত্তরঞ্জন সাহা বলেন, সে কাজই করছি। করছি একেবারে গোড়া থেকে। বড়দের বই ছেড়ে বের করছি ছোটদের বই। পড়ার অভ্যাস, নেশা গড়তে চাইছি ছোটদের। কেন চাইছি? যদি ওদের মধ্যে পাঠাভ্যাসটা গড়তে পারি তাহলে বড় হয়েও ওরা বই খুঁজবে, পড়বে। তাহলেই বুঝতে পারছেন?  আমরা পাবো ক্রেতা। আর সৃজনশীল সাহিত্য, সৎসাহিত্য পাবে পাঠক। তারপর বলেন, সবাইকে বলেছি ? আপনাকেও বলছি। আপনার পরের যে বইটা আমরা ছাপতে চাইছি সেটা ছোটদের বই। আমাদের একটা পাণ্ডুলিপি দিন।
    তাঁর চিন্তা সুদূরপ্রসারী, বক্তব্য যৌক্তিক, কিন্তু আমার জন্য হতাশাজনক। আমি কি আর ছোটদের জন্য লিখি? আমি বরং আমার বন্ধু মলয়কুমার ভৌমিক, হাফিজউদ্দিন আহমেদ ও আরও কেউ-কেউ যারা ‘কচিকাঁচার আসর’, ‘মুকুলের মহফিল’ বা ‘খেলাঘর’-এ লেখে তাদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করি। ছোটবেলা থেকেই তো আমি ডেঁপো। বড়দের বই পড়ে-পড়ে পেকে গেছি একেবারে। সেই ১২-১৩ বছর বয়সেই সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় (১৮৮৪-১৯৬৬), ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় (১৯০৪-১৯৭৫), প্রভাবতী দেবী সরস্বতী (১৯০৫-১৯৭২) প্রমুখের গল্প-উপন্যাসের ধাঁচে আমিও রোমান্টিক ও ডিটেকটিভ গল্প-উপন্যাস লিখে ছোট-বড় খাতা ভরে ফেলেছি কত!
    তাহলে কি মুক্তধারা থেকে আর কোনও বই বেরোবে না আমার? হঠাৎ মনে পড়ে যায় স্কুল-জীবনে লেখা ও পত্রপত্রিকায় ছাপা হওয়া কিছু গল্পের কথা।
১৯৫৯ সালে, তখন আমি অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি, পুজোর ছুটিতে কলকাতা থেকে টাঙ্গাইলে বাড়িতে মা-বাবা-ভাইয়ের কাছে বেড়াতে আসা খোকন দা (কবি তারাপদ রায়, ১৯৩৬-২০০৭)-র সঙ্গে পরিচয়। আমার পড়া ও লেখার নেশা দেখে একদিন তিনি বলেন, ইংরেজিটা ভাল করে শেখো। এ ভাষাটা না জানলে বিশ্ব-পৃথিবীর অনেক কিছুর খবর পাবে না ঠিকমতো। উন্নত সাহিত্য ও সাংবাদিকতার স্বাদ পাবে না, নতুন-নতুন চিন্তাধারা ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির খোঁজ জানবে না।
এরপর থেকে শুরু হয় আমার ইংরেজি বই পড়ার চেষ্টা। সে বড় কঠিন ও দুঃসাধ্য কাজ। বন্দে আলী মিয়া (১৯০৬-১৯৭৯)-র উপন্যাস ‘তাসের ঘর’ পড়ে ফেলি এক বেলায়, কিন্তু আরস্কিন কল্ডওয়েল (১৯০৩-১৯৮৭)-এর ‘টোবাকো রোড’-এর পাঁচ পৃষ্ঠাও ওলটাতে পারি না সারা দিনে। খোকন দা বললেন, ডিটেকটিভ বই পড়ো। তাড়িয়ে-তাড়িয়ে পড়তে পারবে। তারপর অভ্যাস হয়ে যাবে ইংরেজি পড়াটা।
এই বলে পড়তে দেন আগাথা ক্রিসটি (১৮৯০-১৯৭৬)-র চারটি গোয়েন্দাগ্রন্থ। নিজেও যোগাড় করি আরলি স্ট্যানলি গার্ডনার (১৮৮৯-১৯৭০)-এর এক গাদা বই। এতে কাজ হয় অনেকটা, তবে সবটা নয়। শেষে ওই পড়তে-পড়তেই মাথায় বুদ্ধি আসে ? অনুবাদ করলে কেমন হয়! ইংরেজি শেখার চর্চাটাও হবে, সেই সঙ্গে আবার লেখালেখিও চলবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। শুরু করি সহজ ভাষায় লেখা শিশুতোষ গল্প অনুবাদ। হাতের কাছে পেয়ে যাই ন্যাথানিয়েল হথর্ন (১৮০৪-১৮৬৪)-এর ‘এ ওয়ান্ডার-বুক ফর গার্লস অ্যান্ড বয়স্‌’ । এ বইটি থেকেই প্রথম অনুবাদ করি হারকিউলিস-এর একটি গল্প। প্রথমে গলদঘর্ম অবস্থা, পরে সয়ে আসে আস্তে-আস্তে। তারপর বিভিন্ন রূপকথা-উপকথার সঙ্কলন থেকে এক-এক করে আরও অনেক গল্প ? তা ২০-২১টি হবে ? অনুবাদ করে ফেলি এক-দু’ বছরেই। সাহস করে কয়েকটি গল্প পাঠাই ঢাকার পত্রপত্রিকায়। সেগুলো ছাপা হয় সাপ্তাহিক জনতা, পাকিস্তানী খবর, পাক জমহুরিয়াত, দৈনিক আজাদের মুকুলের মহফিলে। ১৯৬২ সালে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর সওগাত, মোহাম্মদী, চিত্রালী ও অন্যান্য জাতীয় পত্রপত্রিকায় মৌলিক কবিতা-গল্প ছাপা হতে থাকায় আর উৎসাহ পাই নি অনুবাদে। তবে পুরনো খাতা থেকে ঘষে-মেজে কয়েকটি গল্প পাঠিয়েছিলাম বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। সেগুলোর একটি ছাপা হয়েছিল স্থানীয় পাক্ষিক হিতকরীতে। প্রথম অনুবাদ করা গল্পটি অবশ্য বহু বছর পর, ১৯৭৭-৭৮ সালে, ছাপা হয়েছিল ‘কিশোর বাংলা’য়।
ইংরেজি শিখতে চেয়ে অনুবাদ করা সেই সব গল্পের বেশির ভাগই হারিয়ে গেছে। সবগুলোর জন্য না হলেও বিশেষ করে একটি হারানো গল্পের জন্য দুঃখ করি এখনও। ‘তিন জন বামন বুড়ি’ নামের ওই গল্পটা ছাপা হয়েছিল ১৯৬৪-৬৫ সালের ঈদ সংখ্যা ‘মুকুলের মহফিল’-এ।
শেষ পর্যন্ত টাঙ্গাইলের বাড়িতে পুরনো বাঙপেটরা ঘেঁটে পেয়ে যাই গল্পগুলো। আশ্চর্যের ব্যাপার খুব বেশি মাজা-ঘষা না করেই সেগুলো সঙ্কলিত করি ‘তেপান্তর’ নামে। পৌঁছে দেই চিত্তরঞ্জন সাহা’র হাতে। তিনি পর-পর দু’টি সংস্করণের জন্য চুক্তি করেন সঙ্গে-সঙ্গে। ‘মুক্তধারা’র অন্যতম উপদেষ্টা তখন শিল্পী হাশেম খান। ভেবেছিলাম তিনিই হয়তো প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ করবেন বইটির, যেমন করেছিলেন আগের বই ‘রৌদ্রে প্রতিধ্বনি’র। ‘তেপান্তর’ ছাপা হয় ১৯৭৯ সালে। তখন আমি চীনের রাজধানী পেইচিং-এ, রেডিও পেইচিং-এর বাংলা বিভাগে ভাষা-বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত। সেখানেই ২৫ কপি বই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। দেখি, এর প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ করেছেন আইনুল হক মুন্না।
সেই থেকে শুরু আমার শিশুতোষ বই লেখা। ‘তেপান্তর’-এর পর এ পর্যন্ত ছোটদের জন্য লেখা ১৭টি বই বেরিয়েছে আমার।

sazzadqadir@gmail.com; sazzadqadir@rediffmail.com; sazzadqadir@yahoo.com; facebook.com/sazpa85



প্রাণ-বাংলার কবি

করটিয়া’র সা’দত কলেজ (প্রতিষ্ঠা: জুলাই, ১৯২৬)-এ অধ্যয়ন (১৯৬২-৬৪) ও অধ্যাপনা (১৯৭২-৭৬)-র আগে, একদিন গিয়েছিলাম ১৯৫৭ সালে। তখন আমি বিন্দুবাসিনী হাই স্কুল (প্রতিষ্ঠা: ৩রা এপ্রিল, ১৮৮০)-এ ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। বয়স মোটে ১০ বছর। টাঙ্গাইল থেকে সাত সাত চোদ্দ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে রোদে পুড়ে করটিয়া গিয়ে আসার সে মহাউদ্যমে ক’জন মুরুব্বির সঙ্গী হয়েছিলাম কবি জসীম উদ্‌দীন ও শিল্পী জয়নুল আবেদিনকে দেখার উৎসাহে। কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন তখন লোকশিল্প-অনুরাগী তোফায়েল আহমেদ। তাঁর উদ্যোগে আয়োজন করা হয়েছিল লোকসংস্কৃতি উৎসবের। সেই উৎসবে যোগ দিতেই এসেছিলেন ওই দুই দেশবরেণ্য ব্যক্তিত্ব ? আমাদের স্বপ্নের মানুষ। এখানে উল্লেখ করা দরকার, তোফায়েল আহমেদের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আমাদের প্রাচীন শিল্প’ প্রকাশিত হয় নি তখনও। এর কিছু-কিছু লেখা অবশ্য ছাপা হয়েছিল ঢাকার পত্রপত্রিকায়, কলেজের বার্ষিকীতে। বইটি বেরিয়েছিল ১৯৬০ সালে।
    উৎসবে ছিল গ্রামীণ পণ্য আর খেলাধুলার আয়োজন। কবি ও শিল্পী দু’জনেই লাঠিখেলা দেখে ও লাঠিয়ালদের সঙ্গে কথা বলে সময় কাটিয়েছেন অনেকক্ষণ। তাঁদের আগমন উপলক্ষে কলেজ মাঠের পশ্চিম পাশে, অধ্যক্ষের বাসভবনে ঢোকার মুখে,  বাঁশ বেত ছন দিনে কুঁড়েঘরের আকৃতিতে গড়া হয় এক মঞ্চ। এর উপরে বাঁশ-বেত দিয়ে লেখা ‘আমার বাড়ি আইস বন্ধু...’। ওই মঞ্চ ও লেখা এখনও আছে সম্ভবত। ১৯৮১ সালে একবার গিয়েছিলাম কলেজে বেড়াতে, তখন ওই শিল্পকীর্তিকে দেখেছিলাম অমনই।
    জসীম উদ্‌দীনকে কতখানিই বা চিনি তখন? মুরুব্বিদের মুখে ‘পল্লীকবি-পল্লীকবি’ নামডাক আর রেকর্ডে বা অনুষ্ঠানে তাঁর লেখা বা সংগৃহীত গান শুনি, পাঠ্য বাংলা বইয়ের পদ্যাংশে পড়ি ক’টি কবিতা ? এই তো আমার চেনাজানার চৌহদ্দি ওই বয়সে ও সময়ে। ‘রাখাল ছেলে’, ‘কবর’, ‘জননী’ ছাড়াও একটি কবিতা প্রিয় ছিল বিশেষভাবে। ‘নতুন কবিতা’ নামের সে কবিতার প্রথমাংশ এ রকম ?
    “রামধনুরে ধরতে পারি রঙের মায়ায়,
        ধরব না তা;
    বিজলী এনে ভরতে পারি রঙের খাঁচায়
        আনব না তা।
    আঁকশি দিয়ে পাড়তে পারি চাঁদের চুমো,
    ছড়ার নূপুর বাজিয়ে তোমায় করতে পারি ঘুমোঘুমো;
    পাতালপুরীর রাজকন্যে সাত মানিকের প্রদীপ জ্বালি’
    ঘুম ঘুমিয়ে ঘুমের দেশে ঘুমলী স্বপন হাসছে খালি,
    এসব কথা ছড়ায় গেঁথে বলতে পারি,
        বলব না তা,
    পাখির পাখায় লিখন তারে লিখতে পারি,
        লিখব না তা;
    লিখব আজি তাদের কথা, কথা যারা বলতে নারে,
    এক শ’ হাতে মারছে যাদের সমাজ-নীতি হাজার মারে।...”
    যারা কথা বলতে পারে না , তাদের কথা লিখতে হবে ? এ চিন্তা মাথায় ঢুকেছিল সেই তখনই। তারপর থেকে প্রতিষ্ঠাবিরোধীই থেকে গেছি, আর বদলে নিতে পারি নি নিজেকে। হাত কচলে, ঘাড় চুলকে, হালুয়া-রুটি খাওয়ার আসরে পারি নি যোগ দিতে।
    জসীম উদ্‌দীনের সবচেয়ে বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘নঙী-কাঁথার মাঠ’ (১৯২৯) ও ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ (১৯৩৪)-এর সঙ্গেও আমার পরিচয় পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে। কোনও শ্রেণীর এক বাংলা দ্রুতপঠন ছিল বিখ্যাত কাব্য, গীতিকা, উপন্যাস, নাটকের কাহিনীসংক্ষেপের সঙ্কলন। ‘আনোয়ারা’, ‘আবদুল্লাহ’, ‘বীরাঙ্গনা সখিনা’ প্রভৃতির পাশাপাশি ওই দু’টি কাব্যগ্রন্থের কাহিনীও স্থান পেয়েছিল তাতে। কাহিনীর সঙ্গে ছিল বিভিন্ন কাব্যাংশের উদ্ধৃতি। ফলে মূলের স্বাদও মিলতো কিছুটা। ওই বয়সে আমাকে মুগ্ধ করার জন্য ওইটুকুই ছিল যথেষ্ট। অষ্টম শ্রেণীতে আমাদের বাংলা দ্রুতপঠন ছিল জসীম উদ্‌দীনের ‘চলে মুসাফির’ (১৯৫২)। এ বইয়ের অসাধারণ গদ্য কি রকম মুগ্ধ মোহিত করেছিল আমাকে তা মনে পড়ে খুব। তাঁর শিশুতোষ গ্রন্থ ‘হাসু’ (১৯৩৮), ‘এক পয়সার বাঁশী’ (১৯৪৯) ও ‘ডালিমকুমার’ (১৯৫১) প্রথম পড়ার শিহরণ যেন অনুভব করি এখনও। রেডিওতে বহুবার শুনেছি ‘বেদের মেয়ে’ ও ‘মধুমালা’ (১৯৫১)-র নাট্যাভিনয়। সুযোগ পেলে আবারও শুনবো। ‘চিত্রালী’তে ধারাবাহিক ভাবে পড়েছি স্মৃতিকথা ‘ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়’। আর দুই খণ্ড ‘বাঙ্গালীর হাসির গল্প’ (১৯৬০, ১৯৬৪) তো প্রকাশের পর থেকেই রয়েছে আমার প্রিয় সংগ্রহের সামগ্রী। যত বার হারাই তত বার খুঁজে-খুঁজে কিনি।
    তিরিশের কবিদের দ্বারা আদ্যন্ত প্রভাবিত ষাটের বেশির ভাগ কবি-বন্ধুর কাছে জসীম উদ্‌দীন ও তাঁর কবিতা ছিল হাসি-তামাশার বিষয়। তাঁর ব্যক্তিজীবনের নানা কিছু নিয়ে রঙ্গব্যঙ্গ করতেন তাঁরা, আর এমন ভাবে তাঁর নামের আগে ‘পল্লীকবি’ বলতেন যেন তিনি বুঝি কোনও গ্রাম্য কবি। কিন্তু তা তো তিনি ছিলেন না। বাংলা একাডেমীর ‘চরিতাভিধান’-এ বলা হয়েছে, “গ্রামীণ জীবনের নিখুঁত চিত্র তাঁর কবিতায় কুশলতার সাথে অঙ্কিত। এ অঙ্কন রীতিতে আধুনিক শিল্প-চেতনার ছাপ সুস্পষ্ট।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কবিতা সংগ্রহ’-এ বলা হয়েছে, “রবীন্দ্র কাব্যধারার পাশে গ্রাম-বাংলার সহজ সরল প্রাকৃত জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নাকে তিনি নতুন মহিমায় কাব্যমূল্য দান করেছেন। পল্লীজীবনের সহজ সতেজ শব্দ, উপমা এবং চিত্র সর্বদা তাঁর কাব্যের রূপকল্প নির্মাণ করেছে।...” জসীম উদ্‌দীনের কবিতার ছন্দও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে পেয়েছে ভিন্ন এক নাম ? ‘সহজ সমিল পল্লী পয়ার ছন্দ’। কিন্তু এ ছন্দে তাঁর কবি-উত্তরসূরি মেলে নি আজও। কয়েকজন ছড়াকার-কবির উল্লেখযোগ্য প্রয়াস থাকলেও এ ছন্দ অত কিছু সহজ নয়। এ ছন্দ এত আন্তরিকতায় স্পন্দিত যে কবি, কবিতা ও পাঠককে তা করে তোলে এক মন-প্রাণ। এই একত্ব সৃষ্টি মহৎ শিল্পী ছাড়া সম্ভব নয়।
    জসীম উদদীনকে সব সময়েই আমার মনে হয়েছে বাংলা ও বাঙালির নিজস্ব কবি। কথাটা অনেক আগেই বলেছেন কবিশেখর কালিদাস রায় (১৮৮৯-১৯৭৫), যিনি বিশেষ খ্যাত সমালোচক হিসেবেও, তবে সমপ্রতি পড়ার সুযোগ পেয়েছি আমি। কৌতূহলী পাঠকদের জন্য তাঁর সেই মূল্যায়নটি উদ্ধৃত করি এখানে:
“বাংলাদেশের এক-একজন কথাসাহিত্যিকের লেখনীতে এক-এক অংশের নরনারীর জীবন ও প্রাকৃতিক আবেষ্টনী ফুটেছে। হুগলী, হাওড়া জেলার অন্তরটা ফুটেছে শরৎচন্দ্রের রচনায় ? কোনও কবি এ অঞ্চলের অন্তরকে বাণীরূপ দেন নি। দেয়ার কথা ছিল কবিবর মোহিতলালের ? আরম্ভও করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এড়িয়ে গেলেন। নদীয়া, মুরশিদাবাদের কিয়দংশ, যশোহর, খুলনা, ২৪ পরগনার (আগেকার প্রেসিডেন্সি বিভাগ) অন্তরটা ফুটেছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও মনোজ বসুর রচনায়। এ অঞ্চলের কবি যতীন্দ্রমোহন। ভাগীরথীতীরের বর্ণহিন্দু সমাজের বাণীরূপ লাভ করেছে বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের রচনায়। এই অঞ্চলের কবি কিরণধন চট্টোপাধ্যায়। আর রাঢ়দেশের অন্তরের অন্তস্তল পর্যন্ত নিঃশেষভাবে রূপ গ্রহণ করেছে তারাশঙ্করের রচনায় এবং কতকটা সরোজকুমারের রচনায়। এ অঞ্চলের কবি কুমুদরঞ্জন। এ হিসাবে পূর্ববঙ্গের কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, আর ও অঞ্চলের কবি জসীমউদ্‌দীন।”
এ ভাবে জসীম উদ্‌দীনকে আমরা দেখতে পারি নি আজও। বস্তুত তাঁর কাব্যমহিমার মূল্যায়ন- বিশ্লেষণ হয় নি প্রাণ-বাংলার কবি হিসেবে। এমনিতে নানা দায়ে ও স্বার্থে নামডাক করলেও প্রকৃত সমাদরও করা হয় নি তাঁকে। বাংলা একাডেমীর সাহিত্য পুরস্কার পান নি তিনি। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। বাংলা একাডেমী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও নজরুলকেও সম্মান জানায় নি। এ ঐতিহ্য সে পালন করে আসছে বরাবরই। কিন্তু তাতে কি আসে যায় শিল্পী-সাহিত্যিকদের? পুরস্কারের গৌরব নয়, সৃষ্টির সৌরভই তাঁদের জীবনকে করে রাখে কীর্তিধন্য।
সবশেষে ‘নঙী-কাঁথার মাঠ’ থেকে উদ্ধার করি আমার প্রিয় কয়েক পঙ্‌ক্তি:
    “... কেউ বা বলে আদ্যিকালের এই গাঁ’র এক চাষী,
    ওই গাঁ’র এক মেয়ের প্রেমে গলায় পরে ফাঁসি;
    এ পথ দিয়ে একলা মনে চলছিল ওই গাঁয়ে,
    ও গাঁ’র মেয়ে আসছিল সে নূপুর-পরা পায়ে!
    এইখানেতে এসে তারা পথ হারায়ে হায়,
    জলীর বিলে ঘুমিয়ে আছে জল-কুমুদীর গায়।
    কেই বা জানে হয়তো তাদের মালা হতেই খসি’
    শাপলা-লতা মেলছে পরাগ জলের উপর বসি’।
    মাঠের মাঝে জলীর বিলের জোলো রঙের টিপ,
    জ্বলছে যেন এ গাঁ’র ও গাঁ’র বিরহেরই দীপ।
    বুকে তাহার এ গাঁ’র ও গাঁ’র হরেক রঙের পাখি,
    মিলায় সেথা নতুন জগৎ নানান সুরে ডাকি’।
    সন্ধ্যা হলে এ গাঁ’র পাখি এ গাঁও পানে ধায়,
    ও গাঁ’র পাখি ও গাঁও চলে বনের কাজল-ছায়।...”
sazzadqadir@gmail.com; sazzadqadir@rediffmail.com; sazzadqadir@yahoo.com; facebook.com/sazpa85

রবিবার, ৪ মার্চ, ২০১২

আতঙ্কের সঙ্গে বসবাস

রাজধানী ঢাকায় বিরাজমান আতঙ্কের তালিকায় এখন অনেক নাম। অপরাধমূলক তৎপরতা, রাজনৈতিক সহিংসতা, যানজট, লোডশেডিং, গ্যাস-পানির সঙ্কট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ছাড়াও গত মে-জুন মাসে নতুন দু’টি নাম যুক্ত হয়েছে ওই তালিকায় - বেগুনবাড়ি ও নিমতলি। রাজধানীর তেজগাঁও ও লালবাগ এলাকার দু’টি অবহেলিত এলাকা। তেজগাঁও এলাকার বেগুনবাড়িতে এক ছ’ তলা ভবন ধসে পড়ায় প্রাণহানি ঘটে ২৫ জন মানুষের। এর পর-পর আরেক ছ’ তলা ভবন হেলে পড়ে মিরপুরের মাজার রোডে। আতঙ্ক ব্যাপক হয়ে ওঠে যখন এরই মধ্যে আরেক বহুতল ভবন হেলে পড়ে তেজগাঁওয়ের হাতিঝিল এলাকায়। সঙ্গে-সঙ্গে খোঁজ-খোঁজ শুরু করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। শনাক্ত করা হয় অনুমোদন ছাড়া অপরিকল্পিত ভাবে নির্মিত ৭২টি বিপজ্জনক ভবন। বলা হয়, সেগুলো ভেঙে ফেলা হবে শিগগিরই। এরই মধ্যে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে লালবাগের নিমতলিতে। সেখানে প্রাণ হারান ১২১ জনের বেশি মানুষ। আতঙ্ক এবার ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। নির্মাণ ও তদারকে সমন্বয়হীন এক উন্নয়নের চেহারা নগ্ন হয়ে পড়ে সবার সামনে। এরপর থেকে ঢাকার বেশির ভাগ মানুষ বসবাস করে আসছে মৃত্যুহিম আতঙ্কে সঙ্গে - কখন কোথায় ধসে পড়ে কোন ভবন, কোথায় কখন আগুন লাগে হঠাৎ!
    বেগুনবাড়ি ও নিমতলি ট্র্যাজেডির পর কর্তৃপক্ষের যেন ঘুম ভাঙে অবশেষে। আপাতত মনে হয় সে রকমই। দু’টি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠন করা হয় প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে। বিপজ্জনক ভবন ও অননুমোদিত কাঠামো শনাক্ত করার কাজে সহায়তা করবেন তাঁরা - যাতে ওই সব অবৈধ নির্মাণের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যায় দ্রুত। টাস্কফোর্স দু’টিকে আরও দেয়া হয় আবাসিক এলাকায় অবৈধ কারখানা ও রাসায়নিকের দোকান খুঁজে বের করার দায়িত্ব। সেগুলো উচ্ছেদ করার সুপারিশও করবেন তাঁরা।
    বেগুনবাড়ির ভবনধস ও নিমতলির অগ্নিগ্রাস - এই যুগল ট্র্যাজেডি এখন দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে ফিরছে নগরবাসীকে। সবাই বুঝতে পারছেন কত বিপন্নতার মধ্যে তাদের বসবাস করতে হচ্ছে এই নগরে। সেই সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এক বিস্ময়কর, এক বেদনাবহ সত্য - বছরের পর বছর ধরে কত অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে আমাদের গর্বের রাজধানী ঢাকা। কত অনিয়ম, অব্যবস্থা, দুর্নীতি জড়িত হয়ে পড়েছে এর রন্ধ্রে-রন্ধ্রে!
    বস্তুত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ তদারকের অভাবে আর অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে যেখানে সেখানে ব্যাঙের ছাতার মতো নির্মিত হয়েছে এবং হচ্ছে অসংখ্য অননুমোদিত ভবন ও কাঠামো। ফলে তছনছ হয়ে গেছে রাজধানীর মূল স্থাপত্যিক পরিকল্পনা। নগরবাসীর জীবনও পড়েছে ঝুঁকির মধ্যে। কিন্তু রাজউক-এরই বা কতখানি কি করার আছে! নীতিমালা মেনে, উন্নত সামগ্রী ব্যবহার করে, প্রকৌশলিক ত্রুটি ছাড়া কোনও ভবন নির্মিত হচ্ছে কিনা তা দেখার মতো প্রয়োজনীয় জনবল বা ব্যবস্থা নেই তাদের। সীমিত তদারক-ক্ষমতা নিয়ে এত ব্যাপক একটা পরিস্থিতি সামাল দেয়া সত্যিই এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। ফলে যা নয় তা-ই হচ্ছে। ক’ দিন আগে জানা গেল রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র পরিবাগের এক বহুতল ভবন সম্পর্কে। এর আদ্যন্ত কিছুই নাকি জানা নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। অথচ সকলের চোখের ওপর নির্মিত হয়েছে একটির পর একটি করে মোট বারোটি তলা!
    রাজউক কেবল খোঁজখবর নেয় তাদের অনুমোদিত নকশা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্মীয়মান ভবনগুলো সম্পর্কে। তবে ওই সব ভবনে ব্যবহৃত নির্মাণসামগ্রী দুর্বল কিনা বা কোথাও কোনও প্রকৌশলিক ত্রুটি আছে কিনা - সেসবের খোঁজ নেয় না তারা। একের পর এক সরকার ও প্রভাবশালী মহল নিজেদের স্বার্থে, অনেক ক্ষেত্রেই, প্রায় অকার্যকর করে রেখেছে রাজউককে। অপরিকল্পিত নগরায়নের যে বিপদ তার সূচনা এখান থেকেই। রাজউক এ পর্যন্ত পাঁচ হাজারের বেশি ভবন শনাক্ত করেছে যেগুলো নির্মিত হয়েছে নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত নকশা ও পরিকল্পনায় ব্যত্যয় ঘটিয়ে। আর ১৫ হাজারেরও বেশি ভবন শনাক্ত করা হয়েছে যেগুলো নির্মাণে কোনও অনুমোদনই নেয়া হয় নি রাজউক থেকে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাজধানীর ১০ ভাগের বেশি ভবন নির্মিত হয়েছে নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে।
    ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি)-এর হিসাব অনুযায়ী রাজধানীতে ভবনের সংখ্যা ০.২৩ মিলিয়ন। তবে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের কমপ্রিহেনসিভ ডিজাসটার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম (সিডিএমপি)-এর এক সমীক্ষা প্রতিবদনে বলা হয়েছে, এ সংখ্যা ০.৩২ মিলিয়নের বেশি।
    নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নকশা ও পরিকল্পনায় ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মিত পাঁচ হাজার ভবন শনাক্ত করতে পারলেও সেগুলোর নির্মাতা-মালিকদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিতে পারে নি রাজউক। এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তাঁরা বলেন প্রয়োজনীয় জনবল ও সামগ্রী-সরঞ্জামের অভাবের কথা। তাঁদের এখতিয়ার এলাকা ৫৯০ বর্গ কিলোমিটার। এই বিস্তীর্ণ এলাকায় নির্মীয়মান শ’-শ’ ভবন ও কাঠামোর কাজকর্ম তদারক করা তাঁদের মাত্র ১০০০ কর্মী দ্বারা সম্ভব নয়। রাজউক-এর কর্মকর্তা পত্রিকান্তরে জানিয়েছেন, অবৈধ ভবন নির্মাণের ব্যাপারে খবর ও ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রয়োজন কমপক্ষে আট জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ১৬ জন কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। সমপ্রতি ওই আট ম্যাজিস্ট্রেট ও ১৬ কর্মকর্তা সহ ২০০০ কর্মী বিশিষ্ট এক প্রতিষ্ঠান-ছক (অরগানোগ্রাম)-এর প্রস্তাব তাঁরা জমা দিয়েছেন মন্ত্রণালয়ে।
    এদিকে স্থানীয় ভূতত্ত্বীয় বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন আরও এক বিপদের কথা। রাজধানীর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে দ্রুত। এ অবস্থায় একদা জলাভূমির ওপর গড়ে ওঠা এ নগরে বহুতল ভবনের ধসে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে সবসময়েই। কোনও ভূমিকম্প ছাড়াই দুমড়ে মুচড়ে পড়তে অনেক বহুতল ভবন। দীর্ঘ খরার পর এক-দু’দিনের তুমুল বর্ষণেই ঘটতে পারে তেমন বিপদ। বেগুনবাড়ির ভবনধস ও অন্য ক’টি ভবনের হেলে পড়ার কারণ মওসুমি বৃষ্টিপাত। ক্রমশ নিচে নেমে যাওয়া ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে হঠাৎ ‘ঊর্ধ্বমুখী পানির চাপ’ সৃষ্টি হওয়ায় এ ঘটনা ঘটেছে। পানির স্তর নেমে গেলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয় তার সঙ্গে ভবনের নিচের মাটি একভাবে বিন্যস্ত হয়ে যায়। কিন্তু দীর্ঘ দিন শুষ্কতার পর ভারি বর্ষণ হলে ভূগর্ভস্থ পানি ঠেলে উঠিয়ে দেয় ওই বৃষ্টির পানি। এতে কিছু আন্দোলন দেখা দেয় ভূমিতে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, কয়েক দিন ধরে তুমুল বৃষ্টিপাত হলে - জলাভূমি ভরাট করা স্থানে দুর্বল ভিত্তির ওপর স্থাপিত বহুতল ভবনগুলো ধসে পড়তেই পারে।
    মাঝারি মাত্রার একটা ভূমিকম্প হলে কি অবস্থা হবে ঢাকার? একটি সরকারি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ৬-মাত্রার একটি ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র (এপিসেনটার) যদি ঢাকার মধ্যে হয় তাহলে প্রায় ৭৮,৩২৩টি ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস হবে। যদি মধুপুর ফল্ট থেকে ৭.৫-মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি হয় তাহলে রাজধানীর ৭২,৩১৬টি ভবন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হবে, ৫৩,১৬৬টি ভবন হবে আংশিক বিধ্বস্ত। যদি ফল্ট ২-এর প্লেট বাউন্ডারি থেকে ৮.৫-মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে এই অঞ্চলে তাহলে দেশের প্রায় ২৩৮,১৬৪টি ভবন বিধ্বস্ত হবে পুরোপুরি। মারকিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে,  বিশ্বের যে সব নগরী রয়েছে প্রবল ভূমিকম্প-ঝুঁকির মধ্যে তার একটি ঢাকা। এর কারণ অপরিকল্পিত নগরায়ন।
    এ অবস্থায় আমাদের ভবিষ্যৎ কি?
    বাংলার প্রাচীন রাজধানীগুলোর বেশির ভাগই এখন বিলুপ্ত, কয়েকটি ধ্বংসপ্রাপ্ত। ঢাকার পরিণামও কি তাই? তবে কি আমাদের ভাবতে হবে পরিকল্পিত নতুন রাজধানীর কথা? মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফরিকা, নেদারল্যান্ড প্রভৃতি দেশের দৃষ্টান্ত কি অনুসরণ করতে হবে আমাদের? মুহম্মদ বিন তুগলক (শাসনকাল ১৩২৫-৫১)-এর দিল্লি থেকে দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর চিন্তা যে দূরদর্শী ছিল তা এখন স্বীকার করেন অনেকেই, আমাদেরও হয়তো মেনে নিতে হবে সে ‘তুগলকি’ চিন্তা। নাহলে কি জীবন কাটাতে হবে আতঙ্কের সঙ্গে বসবাস করে?

করাল গ্রাসের কবলে

কত পুরনো আমাদের এই ঢাকা নামের জনপদটি? গবেষকরা বলেন, দুই সহস্রক ছুঁয়েছে এর বয়স। সাত শতকে যে বসতি ছিল এখানে সে প্রমাণ মিলেছে অনেক আগেই। সামপ্রতিক তথ্যানুসন্ধানে, উয়ারি বটেশ্বরের খননে ও অন্যান্য নিদর্শন থেকে আমরা পেয়েছি এ অঞ্চলের দীর্ঘ জন-ইতিহাস। সেই শতকে কামরূপের বৌদ্ধ রাজাদের অধীনে ছিল ঢাকা, তারপর ছিল পাল রাজাদের অধীনে। পাল রাজারাও ছিলেন বৌদ্ধ। নয় শতকে পালাবদল ঘটে ক্ষমতার। ফলে ঢাকা আসে হিন্দু সেন রাজাদের অধীনে। এই বংশের রাজা বল্লাল সেন (?-১১৭৯) এখানে নির্মাণ করেন ঢাকেশ্বরী মন্দির। ঢাকা নামের উৎপত্তি সম্ভবত ওই মন্দিরের নাম থেকেই। ঢাকেশ্বরী মন্দির ঘিরেই ক্রমশ গড়ে ওঠে ঢাকা শহর। শহর বলতে অবশ্য কয়েকটি বাজার তখন ? কুমারটুলি, গোয়াল নগর, তাঁতিবাজার, পটুয়াটুলি, বেনিয়া নগর, লক্ষ্মীবাজার, শাঁখারীবাজার প্রভৃতি।  ঢাকা ও এর আশপাশের অঞ্চলের ‘বাঙ্গালা’ নামে পরিচিতিও সেই তখন থেকেই শুরু বলে ধারণা করা হয়।
    সেন রাজাদের পর ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় সুলতানদের শাসন। ওই সুলতানদের অনেকে ছিলেন স্বাধীন, অনেকে ছিলেন দিল্লি থেকে পাঠানো প্রশাসক। তাঁদের সময়ও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে ঢাকা। ১৪৫৭ সালে নির্মিত মসজিদ এখনও আছে এ শহরে। ১৬০৮ সালে মুগলদের অধিকারে আসে ঢাকা। রাজমহল থেকে রাজধানী সরিয়ে এনে ঢাকাকে তাঁরা গড়ে তোলেন দুর্গ-শহর হিসেবে। এর প্রথম প্রশাসক ছিলেন সুবাদার ইসলাম খাঁ। মুগল সম্রাট জাহাঙ্গিরের নাম অনুসারে তিনি ঢাকার নাম রাখেন জাহাঙ্গিরনগর। তবে জাহাঙ্গিরের মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গে বাতিল হয় এ নাম। ১৬০৮ সালেই আবার বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে স্থানান্তরিত হয় রাজমহলে, কিন্তু ১৬৬০ সালে ফিরে আসে আবার। ১৭১৭ সালে নবাবি আমলে ঢাকা থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত হয় মুরশিদাবাদে।
    ঢাকার সত্যিকারের সমৃদ্ধি আসে মুগল সেনাপতি শায়েস্তা খাঁ’র আমলে। তখন শহরের আয়তন দাঁড়ায় ১৯ঢ১৩ কিলোমিটার, আর জনসংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় এক লাখ। বৃটিশ ইস্ট ইনডিয়া কোমপানি এ অঞ্চলের দিওয়ানি (রাজস্ব আদায়ের অধিকার) পায় ১৭৬৫ সালে, পরে শাসনের অধিকার পায় ১৭৯৩ সালে। ওই বছর বাংলা, বিহার ও ওড়িশা’র কর্তৃত্ব ত্যাগে বাধ্য করা হয় বাংলার নবাবদের। কোমপানি শাসনে কলকাতা’র প্রাধান্য থাকায় ঢাকা’র জনসংখ্যা হ্রাস পায় অনেক। কিছু কাল পরে অবশ্য নানারকম উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে ঢাকায়। মুগল সেনাপতিদের অনুসরণে বৃটিশ ও বাঙালি সৈন্যদের জন্য গড়ে ওঠে ছাউনি-নিবাস। পিলখানা, তোপখানা প্রভৃতি নামে রয়ে গেছে সে ইতিহাস। ঢাকা মিউনিসিপাল শহর হয় ১৮৬৪ সালে। বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা চালু হয় ১৮৭৮ সালে। এর চার বছর আগে, ১৮৭৪ সালে, চালু হয়  আধুনিক পৌর পানি সরবরাহ ব্যবস্থা। তারপর এই ১৩৭ বছর পর কি অবস্থা সেই পানি ব্যবস্থার?
    ঢাকাকে দুর্গ-শহর হিসেবে মুগলদের বেছে নেয়ার বিশেষ কারণ ছিল বুড়িগঙ্গা নদীর বিচিত্র জোয়ার-ভাটা। কারণ তাঁরা চাইছিলেন এমন এক নৌশক্তি গড়ে তুলতে যা দক্ষিণাঞ্চলের মগ, পরতুগিজ ও অন্যান্য জলদস্যুদের দমনে নিতে পারে কার্যকর ব্যবস্থা। ঢাকার চারপাশের নৌপথ সেদিক দিয়ে ছিল সর্বতোভাবে উপযোগী। ওই সব নৌপথের সঙ্গে ঢাকার ভেতরকার বিল-ঝিলও ছিল যুক্ত। তারপরও ব্যাপকভাবে চলাচলের সুবিধা যাতে হয় সেজন্য বেশ কিছু খাল খনন করে পুরো ঢাকার পানি-ব্যবস্থাকে পরস্পর-যুক্ত করেছিলেন মুগল প্রশাসকেরা। এসব ছিল ঢাকার প্রাণপ্রবাহ। এজন্য বর্ষাকালের মতো শুষ্ক মওসুমেও নৌপথে চলাচল ছিল স্বাভাবিক। সেসব খাল-বিল ভরাট করে রুদ্ধ করা হয়েছে প্রবাহ, এখন নদীগুলো বিপন্ন, ধ্বংসের মুখে।
    অথচ রাজধানী ঢাকার অস্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে চারপাশে চারটি নদী ? উত্তরে টঙ্গি খাল, পুবে বালু, দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা ও পশ্চিমে তুরাগ। আমাদের খাবার পানি, নানা ধরনের মাছ, নৌ চলাচল, পয়ঃপ্রণালী প্রভৃতির সঙ্গে গভীর ভাবে সম্পর্কিত এই নদীগুলি। কিন্তু গত শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে প্রায় অপরিকল্পিত ভাবে গড়ে ওঠায় এ শহর পরিবেশগত ভারসাম্য শুধু বিনষ্ট করে নি, রীতিমতো বিপর্যয়ই ঘটিয়ে ফেলেছে এখন। এ বিপর্যয়ের প্রধান শিকার হয়েছে নদী, বিল-ঝিল, খাল, জলাভূমি। জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি, শিল্প-কারখানার বর্জ্য, যন্ত্রপাতি-বাহনের জঞ্জাল, পৌর আবর্জনা ইত্যাদি এর জন্য বিশেষভাবে দায়ী। এই ব্যাপক নদীদূষণ গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করে চলেছে আমাদের প্রাণব্যবস্থার ওপর। এ সব নদীর পানি আর ব্যবহার-উপযোগী নয়। সেই টলটলে স্বচ্ছ পানি আর নেই। মুখে দিলে সঙ্গে-সঙ্গে ওয়াক করতে হয় ?? এমনই বিস্বাদ। এর রঙ মিশমিশে আলকাতরার মতো। আর এমন দুর্গন্ধ যে নাকে রুমাল না দিয়ে থাকার উপায় নেই। শ্যাওলা জমে বদ্ধ এ পানিতে কোনও জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয় না। এর ওপর সবসময় তেলতেলে পদার্থ দেখা যায় ভেসে থাকতে।
    গত এক দশকে ব্যাপক শিল্পায়ন ঘটেছে আমাদের রাজধানীর কয়েকটি এলাকায়। এই সময়ের মধ্যে হাজারিবাগ, তেজগাঁও ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা বাঁধ এলাকায় নতুন কারখানা স্থাপিত হয়েছে সাত হাজারেরও বেশি। এগুলোর মধ্যে রঙ ও চামড়ার কারখানার বর্জ্য মারাত্মক দূষণের জন্য বেশি দায়ী। দূষণের পাশাপাশি রয়েছে নদীগ্রাস। খাল বিল ঝিল জলাভূমি যেভাবে করাল গ্রাসের কবলে পড়েছে, নদীও পড়েছে সেভাবেই। এই দূষণ ও গ্রাস ঠেকাতে সেই উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে কত আইন-কানুন বিধিবিধান আদেশ-নির্দেশই না জারি করা হয়েছে ?? কিন্তু কে শোনে কার কথা! আর শুনবেই বা কেন? এসব দেখার ? দেখভাল করার কেউ আছে কি?
    বছর তিনেক আগে, ২০০৯ সালের ৮ই এপ্রিল, পরিবেশন দূষণ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে যা উল্লেখ করা হয়েছিল এখনও তা সত্য হয়ে আছে হুবহু। এই দু’ বছরে সরকার অনেক কিছু করেছে, আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে ভূমিকাও রেখেছে ? কিন্তু উন্নতি হয়েছে কতখানি কি?
    প্রতিবেদনটি এ রকম:
   “The government over the years has allowed industrialists to pollute the rivers, canals and wetlands in and around the city  to such an extent that surface water turned pitch black in several spots. Pollution has set in on the Buriganga, Shitalakhya and Balu rivers and made it almost impossible to treat the water. The water and Sewerage Authority  (wasa), is supplying stinky water by purifying it with cholorine ammonia sulfate. But most of the industrialists have defeid the directive and the government also did not take action against any of the violators. Even the department of environment (DoE) does not know much about it. Besides industry generated liquid and solid waste, most of the human excreta directly goes down the rivers through underground pipelines as nearly 70 percent houses are not connected to the excrete treatment plant. Waste from these industries is connected with the sewerage system that directly goes into tha rivers around the city. In fact, the rivers have become a dumping ground of all kinds of solid, liquid, and chemical waste of bank side population.”
    এরপর আর কোনও মন্তব্য করার প্রয়োজন দেখছি না। ঢাকার নদী নয়, খোদ ঢাকাই তো পড়েছে করাল গ্রাসের কবলে!

রিস্টার্ট ঢাকা

ঢাকার কি হবে? জীবন যাপনের সমস্যা, নাগরিক সুবিধার অভাব তীব্র হয়ে উঠছে দিনের পর দিন ? এ অবস্থায় কি ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে আমাদের এই রাজধানী শহরের জন্য?  বাংলার বিলুপ্ত / পরিত্যক্ত রাজধানী কর্ণসুবর্ণ, চন্দ্রকেতুগড়, পুণ্ড্রবর্দ্ধন, নালন্দা, বিক্রমশীল, সোমপুর, সাগরদিঘি, নবদ্বীপ, বিক্রমপুর, গৌড়, পাণ্ডুয়া, সোনারগাঁও, মুঙ্গের, মুরশিদাবাদ, রাজমহল প্রভৃতির তালিকায় একদিন স্থান হবে ঢাকার? পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থার ক্ষমতা প্রায় নিঃশেষিত। যাতায়াত-যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি জট-জটিল,। পণ্যমূল্য, দারিদ্র্য, দুর্নীতি, অপরাধ ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে। পরিবেশ-প্রকৃতি অবাধ তৎপরতায় লুণ্ঠিত ও বিধ্বস্ত। যে দেশের রাজনীতি সংঘাতপূর্ণ, অর্থনীতি বিপন্ন, উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত ? সে দেশের রাজধানী আর বাঁচে কি করে? কমপিউটার যেমন হ্যাং হয়ে যায়... তার সিসটেম থেমে যায়, ? কিবোর্ড, মাউজ সহ কোনও ইনপুট ডিভাইস আর কাজ করে না... তেমন একটা অবস্থায় যেন পড়ে গেছি আমরা। তাহলে কি দিতে হবে রিস্টার্ট? স্থানান্তর করতে হবে রাজধানী, একেবারে গোড়া থেকে গড়তে হবে নতুন করে?
    তুগলকি চিন্তা?
    তা বলতে পারেন অনেকে। কিন্তু একালের ঐতিহাসিক-গবেষকরা একমত হয়েছেন ? দিল্লি’র তুরকি বংশীয় সুলতান মুহাম্মদ বিন তুগলক (রাজত্বকাল ১৩২৫-১৩৫১) মোটেই ক্ষ্যাপাটে ছিলেন না, তাঁর রাজধানী স্থানান্তর সহ সকল উন্নয়ন ও সংস্কার কার্যক্রম ছিল অত্যন্ত দূরদর্শী ও বিচক্ষণ সিদ্ধান্তপ্রসূত উদ্যোগ। সে সবের বাস্তবায়ন যথাযথভাবে হতে পারে নি তাঁর অপদার্থ আমলা ও অজ্ঞ প্রজাদের অসহযোগিতায়। আসলে তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে।
    রাজধানী স্থানান্তর করেছেন আরও অনেকেই। সম্রাট হর্ষবর্দ্ধন (রাজত্বকাল ৬০৬-৬৪৬) থানেশ্বর থেকে রাজধানী সরিয়ে নেন কনৌজ-এ। সুলতান ইলতুতমিশ (রাজত্বকাল ১২১১-১২৩৬) লাহোর থেকে দিল্লিতে নিয়ে যান রাজধানী। আলাউদ্দিন খিলজি (রাজত্বকাল ১২৯৬-১৩১৬) কিছু দিনের জন্য রাজধানী করেছিলেন সিরি। সিকানদার লোদি (রাজত্বকাল ১৪৮৯-১৫১৭) দিল্লি থেকে রাজধানী নিয়ে গিয়েছিলেন আগরা। আকবর (রাজত্বকাল ১৫৫৬-১৬০৫) রাজধানী সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন আগরা থেকে লাহোর, পরে ফতেপুর সিকরি-তে। শাহজাহান (রাজত্বকাল ১৬২৭-১৬৫৮) রাজধানী স্থানান্তর করেছিলেন শাহজাহানাবাদ, পরে আগরা-য়। আওরঙ্গজেব (রাজত্বকাল ১৬৫৮-১৭০৭) দিল্লি থেকে আগরা, পরে আওরঙ্গাবাদ-এ স্থানান্তর করেছিলেন রাজধানী। বাংলার নবাবেরা তাঁদের রাজধানী পাটনা, মুঙ্গের, রাজমহল, ঢাকা, মুরশিদাবাদ-এ স্থানান্তর করেছেন বিভিন্ন সময়। বৃটিশরাও তাদের রাজধানী স্থানান্তর করেছে কলকাতায়।
    কাজেই রাজধানী স্থানান্তরের কথা বলে মুহাম্মদ বিন তুগলককে ‘ক্ষ্যাপাটে’ বলা নিরর্থক। একালেও এ ধরনের স্থানান্তর চলছে পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে। এজন্যই ভারত গণরাজ্যকে দিললি ছাড়িয়ে নয়া দিললি বানিয়ে নিতে হয়েছে ১৯৩১ সাল থেকে। মালয়েশিয়া’র নতুন প্রশাসনিক রাজধানী এখন পুত্রজয়া। আমাদের প্রতিবেশী মিয়ানমার ইউনিয়ন ঐতিহ্যবাহী ইয়াঙ্গন ছেড়ে এখন উঠেছেন নতুন রাজধানী নেপিড’-তে। দক্ষিণ আফরিকা প্রজাতন্ত্রের রাজধানী তিনটি ? কেপ টাউন (আইনসভা), প্রিটোরিয়া (প্রশাসন), ব্লুমফনটেন (বিচার বিভাগ)। কিংডম অভ নেদারল্যান্ডস্‌-এর রাজধানী আসলে দু’টি ? আমস্টারডাম (দাপ্তরিক) ও দ্য হেগ (প্রশাসনিক)। তবে দ্য হেগ-এর নাম রাজধানী হিসেবে উল্লেখ করা হয় না সংবিধানগত কারণে। অথচ সেখানেই থাকেন রানী বিয়াট্রিঙ, সেখানেই বসে তাঁর দরবার। এছাড়া সংসদ, সরকার, সুপ্রিম কোর্ট, স্টেট কাউন্সিল, বিদেশী দূতাবাস, মন্ত্রণালয় প্রভৃতি সেখানেই অবস্থিত।
    প্রয়োজনের দাবি মানতে হবে আমাদেরও। ভাবতে হবে রাজধানী স্থানান্তর অথবা একাধিক রাজধানী স্থাপনের কথা। দীর্ঘ দিন ধরে জল্পনা চলছে রাজধানীর ভেতর থেকে বিজিবি সদর দপ্তর, কেন্দ্রীয় কারাগার, সচিবালয়, মন্ত্রীপাড়া, ঢাকা বিশ্বদ্যিালয় (প্রশাসন ও পরীক্ষা ব্যতিরেকে) প্রভৃতি স্থানান্তরের। এখন সময় এসেছে সে সব জল্পনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার এবং বাস্তবোচিত পদক্ষেপ নেয়ার। ঢাকার জন্য রিস্টার্ট আসলেই জরুরি।

নগরে বইয়ের হাট কোথাও

আমার যে স্বভাব তাতে মেলায় গিয়ে যুত হয় না বই কেনায়। নেড়েচেড়ে দেখবো, দোকানির সঙ্গে দু’ চার কথা বলবো, খোঁজখবর নেবো ? তারপরই না কিনবো পছন্দের বইগুলো। কিন্তু তেমনটি হওয়ার যো নেই মেলায়। সেখানে আছে ভিড়, ঘেষাঘেষি, ঠেলাঠেলি, ধুলো, আর দোকানির ফুরসত নেই কথা বলার। এজন্য মেলায় প্রথম দিকে কয়েক বার চক্কর দিয়ে মনে-মনে বেছে রাখি বই, তারপর শেষের দিকে দু’ দিনে দু’ চক্কর দিয়েই কিনে ফেলি সব বই। এ কায়দাটা নতুন বইয়ের বেলায় খাটলেও পুরনো বইয়ের বেলায় না-ও খাটতে পারে। এবার একটি বইয়ের শেষ কপি পাই একেবারে শেষ মুহূর্তে, আরেকটি বই নেড়েচেড়ে দেখে রেখে এসে পরে পাই নি আর।
    চক্কর দেয়া নিয়েও আছে সমস্যা। হেঁটে চলে ঘুরতে ফিরতে গায়ের ওপর এসে পড়ে লোকজন। ধাক্কাধাক্কি করে। প্রবীণ বা বর্ষীয়ান বলে রেহাই দেয় না ? আশপাশ থেকেই চেঁচিয়ে খিস্তিখেউড় করে, অশালীন অঙ্গভঙ্গি করে মাতে হি-হি হো-হোতে, মুখের ওপর ছুড়ে দেয় বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়া। চেনাজানা থাকলে যেটুকু সমীহ মেলে তা জোটে না আমার বেলায়। এর কারণ অন্য কিছু নয়, সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে জাতীয় পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করলেও ফাটাফাটি কিছু লিখে উঠতে না পারায় আমি তেমন পরিচিত নই লেখক-সাংবাদিক জগতে। কিছু পাঠক আমার লেখা বা নাম জানলেও তাঁদের অনেকেই কখনও দেখেন নি আমাকে। হৃদব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার কারণে ১৯৯৩ সাল থেকে আমার জীবন কাটে কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। বাইরে তেমন বেরোই না, আড্ডা-অনুষ্ঠানে যাই না। এজন্য অনেকেই চেহারায় চেনেন না আমাকে। এই অপরিচয়ের কারণে মেলায় স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াবার সুখ থাকলেও বিব্রত হওয়ার, অস্বস্তিতে ভোগার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় প্রায়ই। সেদিন এক চক্কর দিয়ে বসেছি ক্যানটিনের খোলা জায়গাটায়। সামনে টেবিলে কয়েকজন বয়স্ক মহিলা। ও পাশের টেবিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক’জন শিক্ষক। এর মধ্যে তিন যুবক এসে বসে পিছনের টেবিলে। বসেই কাঁচা খিস্তি, তারপর আমাদের চেনাজানা কবিদের নাম ধরে-ধরে সমস্বরে গুষ্ঠি উদ্ধার শুরু করে তারা। কথায় বোঝা যায় সামপ্রতিক কবিতার রাজ্যে তাদের দাপট আছে যথেষ্ট, পত্রপত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে নিয়মিত নানা চোটপাট চলে তাদের। কিন্তু ওই তিন তালেবর আগাগোড়া যে ভাষায় কথা বলে গেল তাতে কবি-লেখক কিছু ভাবতে পারি না তাদের, নিতান্তই ইতর মাসতান ভাবি। তাজ্জব ব্যাপার হলো, এত সব গলগলে খেউড় শুনেও কোনও প্রতিক্রিয়া নেই মহিলাদের, শিক্ষকদের। জিজ্ঞেস করে জানলাম, এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন তাঁরা। এখন আর অমার্জিত বোলচাল ও অঙ্গভঙ্গিতে কিছু মনে করেন না, গাসহা হয়ে গেছে সব। তবে আমার হয় নি, হবেও না।
    মেলায় বই কেনার সমস্যার কথা বলছিলাম। এ সমস্যা আছে আরও। বড় সমস্যা বইয়ের খোঁজ পাওয়ার। কোন লেখকের কোন বই কোন প্রকাশক ছেপেছেন ? এই মূল্যবান খোঁজটাই পাওয়া যায় না সহজে। মেলার সময়টায় দু’একটি পত্রিকায় কিছু বিজ্ঞাপন ছাপা হয় সেগুলোর ওপর নির্ভর করা যায় না। টিভি চ্যানেলগুলোর ক্যামেরাও ঘোরাঘুরি করে মেলায়, তাতেও ধরা পড়ে না তেমন কিছু। এর কারণও আছে। আত্মমর্যাদাবান লেখকেরা সাংবাদিক বা ক্যামেরার সামনে কখনও নিজে থেকে যাবেন না, আবার তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের সময় ও সুযোগ হয়ে ওঠে না সাংবাদিক-প্রযোজকদের। এ অবস্থায় তথ্যকেন্দ্র পরিবেশিত ভুলে ভরা নামের তালিকা আর চেনামুখদের নিয়ে দায়সারা কাজই দেখা যায় মেলার খবরাখবরে। নীতিনৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে কিছু মিত্রতোষণ ও স্বজনপ্রীতি যে থাকবেই তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে কোনও-কোনও পত্রিকা থেকে এমন নবিশদেরও পাঠানো হয় যাঁদের লেখক বা বই সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই। আমি এমন একজনকে এবার চিনেছি যিনি রশীদ করীমকে ‘রশিদুল করিম’ লেখেন, মোহন রায়হানের নাম শোনেন নি, জিজ্ঞেস করলে বলেন ‘মোহন খানের নাম জানি’। এই নবিশের অনেক কীর্তির একটি ? নজরুল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হুমায়ূন আজাদ স্মরণসভার খবরটি দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেন নি তিনি।
এ ছাড়া আছে আরও নানারকম ধান্দাবাজি। ধান্দা? শুনে চোখ কপালে তুলবেন অনেকে। বইমেলাতেও ধান্দাবাজি চলে? চলে। ক’ দিন না যেতেই স্বঘোষিত সম্পাদক সঙ্কলক অনুসন্ধানী জরিপকারী হাজির হয়ে যান মেলাতে। কিছু প্রকাশক-লেখককে ‘বাবা-সোনা’ বলে আর অন্যদের ঘাড় ভেঙে তাঁরা বের করেন মেলায় সেরা ২৫ বা ৫০ বা ১০০ বইয়ের বাহারি তালিকা। বিনা মূল্যে বিলিয়ে দেয়া ও সব তালিকায় নিজেদের এক বা একাধিক বইয়ের নামও ঢুকিয়ে দেন তাঁরা। কিছু পত্রিকাও করে এ কাজটি। প্রশ্ন হলো: এই কয়েক হাজার নতুন বই কারা কখন পড়ে কিভাবে কি বিচার করলেন? এটা যদি ধান্দা না হয় তাহলে ধান্দা কি? এ ধান্দার নাম প পি চু অর্থাৎ পরস্পর পিঠ চুলকানি। এ ধান্দাবাজদের সমিতিও আছে। তার নাম ? প পি চু স। পরস্পর পিঠ চুলকানি সমিতি। এ সমিতির কারণে দেশের অনেক লেখক ও তাঁদের অনেক বইয়ের খবর  পান না অনেক পাঠক। এ পরিস্থিতির শিকার হন বহু কৃতী লেখক, আর বঞ্চিত হন বহু পিপাসু পাঠক।
    সবার উপরে আছে মেলায় নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থা। শুরু থেকেই ছিল এ সব। এক পর্যায়ে রীতিমতো হয়ে পড়েছিল রীতিমতো ঘাপলা-গ্যানজাম। সাবেক মহাপরিচালক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন যথেষ্ট কঠোরতা অবলম্বন করে যে সৌষ্ঠব শৃঙ্খলা এনেছিলেন এবার ধস নেমেছে তাতে। তবে পত্রপত্রিকাও এবার প্রথমবারের মতো হাত খুলে লিখেছে মেলার যত ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে। অনেক প্রকাশকও মন খুলে বলেছেন নানা সমস্যার কথা। মেলা নিয়ে হীন রাজনীতি, নগ্ন দলীয়করণ সহ অনেক বিষয়ই উঠে এসেছে সে সব আলোচনা-সমালোচনায়। প্রকাশক নয় এমন অনেক প্রতিষ্ঠান সংগঠন সমিতি সংস্থাকে স্টল বরাদ্দ দেয়া নিয়েই কথা হয়েছে বেশি। সে সব সমালোচনা মেলাকে ছাড়িয়ে বাংলা একাডেমীর সামপ্রতিক রাজনৈতিক নিয়োগ পর্যন্ত গড়িয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
    এবারের মেলায় বিশেষ উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা-কীর্তি রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতজন্মবার্ষিকী উপলক্ষে মূর্ধন্য প্রকাশনী কর্তৃক ‘রবীন্দ্রস্মারক গ্রন্থমালা’র ১৫১টি বইয়ের প্রকাশ। এ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা প্রচার-প্রকাশমাধ্যমে যেমন যথোচিত গুরুত্ব পায় নি, অন্যদিকে বাংলা একাডেমী-ও এমন একটি প্রকাশনাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে একটি সিঙ্গল স্টল বরাদ্দ দিয়ে কর্তব্য পালন করেছে। তবে যাঁদের ডাবল-ট্রিপল স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তাঁদের বেশির ভাগেরই দু’-তিনটিও উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা পাওয়া যায় নি এ বছর।
    ঐতিহ্য নিয়ে আমরা গর্ব-গৌরব করি, তবে কখনও সে ঐতিহ্য বোঝা হয়েও দাঁড়ায়। অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র ঐতিহ্য বাংলা একাডেমীর জন্য তেমন বোঝা হয়ে উঠেছে কিনা তা ভেবে দেখার সময় এসেছে এখন। কারণ বাংলা একাডেমী তো আসলে একটি একাডেমী। এর কাজ তো আসলে একাডেমিক। এখানে তেমন মানুষ তেমন কাজ চাই। সে সব রেখে গ্রন্থ প্রকাশনা-ব্যবসায় জড়িয়ে একে আদর্শ ও লক্ষ্য থেকে চ্যুত করা ঠিক হবে কি? গ্রন্থমেলার কাজ তো আসলে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের। প্রতি বছর সুশৃঙ্খল ‘ঢাকা বইমেলা’র আয়োজন করে এ প্রতিষ্ঠানটি। এবার কেন করে নি তা বোঝা গেল না। মাহমুদুর রহমান (যিনি লেখক হিসেবে ‘আনু মাহমুদ’ নামে পরিচিত) যখন পরিচালক ছিলেন তখন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সুনাম সুযশ ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের বাইরেও। এখন পরিচালক আমাদের সকলের প্রিয় কবি রফিক আজাদ। তাঁর কাছেও আমাদের প্রত্যাশা বেশি। তিনি ‘ঢাকা বইমেলা’র গৌরব ফিরিয়ে আনবেন এমনটাই চাই আমরা।
    তবে সবচেয়ে ভাল হয় যদি এই নগরে আমরা পাই একটি বইয়ের হাট। শুক্র ও শনি দু’দিন সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সে হাট বসতে পারে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, পান্থকুঞ্জ, ধানমণ্ডি পার্ক বা অন্য কোথাও। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের নেতৃত্বে এ আয়োজনে উদ্যোগী হতে পারে বাংলা একাডেমী, শিশু একাডেমী, ইসলামী ফাউন্ডেশন, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর সহ সরকারি / স্বায়ত্তশাসিত সকল প্রতিষ্ঠান ? যারা প্রকাশনা কার্যক্রমে জড়িত। আমি তো মনে করি কেবল সরকারের মুখাপেক্ষী থাকাও ঠিক নয়। বেসরকারি উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসতে পারেন এ মহতী কাজে। বইয়ের হাটের একটি স্থায়ী রূপ দেয়াও হয়তো সম্ভব হবে একদিন।

sazzadqadir@gmail.com; sazzadqadir@rediffmail.com; sazzadqadir@yahoo.com; facebook.com/sazpa85

শনিবার, ৩ মার্চ, ২০১২

উপকথার তিন বানর

মানুষ আধা-সুখী আধা-দুঃখী প্রাণী। তাই কখনও কোনও কিছুতে পুরো খুশি হয় না সে। নানা অভিযোগ-অনুযোগ তার থাকেই। এ অসন্তোষ থাকে সকল কালেই। আগেও ছিল, এখনও আছে। সেই হাজার বছর আগে চর্যাপদের কবি ঢেণ্‌ঢণপা আক্ষেপ করেছেন ‘হাড়ীত ভাত নাহি’ (হাঁড়িতে ভাত নেই)। মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরাম করেছেন ব্যথিত উচ্চারণ ‘শিশু কাঁদে ওদনের (ভাতের) তরে’। আলাওল প্রকাশ করেছেন ক্ষোভ ‘না পাইয়া বিচার পড়িলুঁ কারাগারে’। একালে নজরুল-ও বলেছেন ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ চায় দু’টি ভাত একটু নুন’।
যুগে-যুগে অনেক শাসক এসেছেন, অনেক রকম শাসন-ব্যবস্থা চালু করেছেন, কিন্তু খুশি হয়েছে কি মানুষ? হয় নি। তাই শাসক থাকেন নি, শাসন ব্যবস্থাও থাকে নি। রাজতন্ত্র, পুরোহিততন্ত্র, খিলাফত, প্রজাতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, সংসদীয় গণতন্ত্র, প্রেসিডেন্সিয়াল গণতন্ত্র, বুনিয়াদি গণতন্ত্র, জনগণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, দলতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র - কত রকম তন্ত্র-মন্ত্র নিয়ে কত রকম যোগাড়যন্ত্র কত দেশে চলেছে এবং চলছে - কিন্তু সব মানুষ খুশি হতে পেরেছে কি? আমাদের দেশেও কি পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলো বা হচ্ছে কম? কিন্তু শান্তি-স্বস্তি কি এসেছে কিছু?
তাহলে সমাধান কি? সব মানুষকে খুশি করা যাবে না, কিন্তু বেশির ভাগ মানুষকে তো খুশি করা সম্ভব। সেটা কোন ব্যবস্থায় সম্ভব? সেই ষাটের দশকের শুরুতে, কলেজে পৌরনীতির পাঠ্যপুস্তকে, পড়েছিলাম সোস্যাল ওয়েলফেয়ার স্টেট অর্থাৎ কল্যাণরাষ্ট্রের কথা। তখন থেকেই ওই রাষ্ট্রচিন্তা গেঁথে আছে মাথায়। এখনও ভাবি অমন এক রাষ্ট্রের কথা। ১৯৮৪ সালে ‘সংবাদ’-এর সম্পাদকীয় বৈঠকে সে কথা বলেছিলাম একদিন। সে বৈঠকে ছিলেন সম্পাদক আহমদুল কবির, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বজলুর রহমান, সহকারী সম্পাদক তোয়াহা খান, সন্তোষ গুপ্ত ও আনিসুর রহমান। প্রথম চারজন আজ আর নেই, শেষে উল্লিখিত জন আছেন সুইডেন-এ। আমার ওই কথায় সেদিন আহমদুল কবির বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশের জন্য দরকার একজন বেনেভোলেন্ট ডিকটেটর (উদার একনায়ক)। তাছাড়া উন্নয়ন-কাজ গতি পাবে না।’ এ কথার পক্ষে উদাহরণ সহকারে বেশ কিছু যুক্তি দিয়েছিলেন তিনি, তবুও কেন জানি মেনে নিতে পারি নি একনায়কীয় শাসনের কোন চিন্তাকে। হয়তো তখন দেশে চলছিল একনায়কীয় শাসন - সেটাও হতে পারে এক বিশেষ কারণ। তবে এখনও ভাবি, এ দেশ একদিন হবে গণতান্ত্রিক অধিকার সংবলিত এক কল্যাণরাষ্ট্র। আমার অধিকার থাকবে ভিন্নমত পোষণের, সমালোচনা করার। এখন তো সে অধিকার আক্রান্ত পদে-পদে। ভিন্নমতাবলম্বী হওয়ার অর্থ আপনি হয় ‘রাজাকার’ নয় ‘বাকশাল’। আর সমালোচক হলে আপনি হয় ‘আল-আবদুল’ নয় ‘আল-বদরুদ্দিন’। অথচ লেখক ও সাংবাদিক হিসেবে যত কিছু দেখি শুনি জানি তার এক-শতাংশও তো লিখতে পারি না আমরা। এ এক অদভুত পীড়ন। দেখবো শুনবো জানবো কিন্তু বলতে পারবো না। লিখতে পারবো না। থাকবো উপকথার তিন বানরের মতো দু’হাতে চোখ কান মুখ চেপে রেখে।
সবাই বলেন - ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়। আসলে ঘটে উলটোটাই। তাই এত মহান নেতা দেশে-দেশে। কিন্তু আমাদের দেশের জনগণই সকল অর্থে মহান। আর যে দেশের জনগণ মহান সে দেশের কোনও মহান নেতার প্রয়োজন নেই।
sazzadqadir@rediffmail.com 

বৃহস্পতিবার, ১ মার্চ, ২০১২

ছাপাখানার ভূত

সেকালে ছাপাখানায় কাজ শেখা সহজ ছিল না মোটেও। নতুনরা কাজ করতে গিয়ে আনাড়িপনার জন্য ভূত হয়ে থাকতো তেল-কালি মেখে, তারপর কাজ শেষে নেয়েদেয়ে সাফ হতে আস্ত একটা সাবান লাগতো তাদের। ওই বেচারা নবিশদের নাম হয়ে গিয়েছিল তাই “ছাপাখানার ভূত”। তারপর ছাপায় কোনও ভুল থাকলে সব দোষ গিয়ে পড়তো ওই ‘ভূত’দের ওপর। বানান ভুল, এক শব্দে আরেক শব্দ ঢুকে পড়া, বাক্য / বাক্যাংশ এমন কি প্যারা শুদ্ধ গায়েব হয়ে যাওয়া - সব মুদ্রণপ্রমাদ তাই “অনিচ্ছাকৃত” অথবা “অনবধানবশত”, দায়ী “ছাপাখানার ভূত”! ইংরেজিতে একে বলে ‘টাইপোগ্রাফিকাল এরর’, সংক্ষেপে ‘টাইপো’।
তবে ‘ভূত’ পরিচয়ে লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই। জীবনের এক পর্যায়ে অ্যামব্রোজ বিয়ার্স, বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন, টমাস জেফারসন, ওয়াল্ট হুইটম্যান, মার্ক টোয়েন, লিনডন জনসন প্রমুখের মতো বিশ্ববরেণ্য মানুষও একদিন ছিলেন ছাপাখানার ভূত। আর একটা কথা, এ ভূত কিন্তু ছাড়ে না কাউকে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা বাংলা একাডেমী - সবখানে চোখে পড়ে ভূতের আছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কবিতা সংগ্রহ’-এ কবি ফররুখ আহমদের জন্মসন ১৯১৯, বাংলা একাডেমী চরিতাভিধানে তা ১৯১৮। একই ভাবে ওই ‘কবিতা সংগ্রহ’ অনুযায়ী সৈয়দ আলী আহসান-এর জন্মসন ১৯২০, হাবীবুর রহমানের ১৯২২, সানাউল হকের ১৯২৩, আশরাফ সিদ্দিকীর ১৯২৬, মযহারুল ইসলামের ১৯২৭, আবদুস সাত্তারের ১৯৩১, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ’র ১৯৩২, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের ১৯৩৯, শহীদ কাদরীর ১৯৪০। বাংলা একাডেমীর ‘চরিতাভিধান’, ‘লেখক অভিধান’ ও ‘লেখক পরিচিতি’ অনুযায়ী এ সনগুলি যথাক্রমে ১৯২২, ১৯২৬, ১৯২৪, ১৯২৭, ১৯২৮, ১৯২৭, ১৯৩৬, ১৯৪২। এছাড়া ‘কবিতা সংগ্রহ’ সৈয়দ আলী আহসান-এর নামের বানানে একটি অতিরিক্ত হস্‌-চিহ্ন বসিয়ে ‘আহ্‌সান’ লিখেছে। আর হাবীবুর রহমান-এর ‘হাবীবুর’কে করেছে ‘হাবিবুর’। ‘চরিতাভিধান’-এ এমন উদাহরণ মিলবে অনেক। একটিই দিচ্ছি। তাঁরা “শহীদুল্লা কায়সার”-এর “শহীদুল্লা”কে  করেছেন হ-যুক্ত - “শহীদুল্লাহ”। তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে বাংলা একাডেমীর সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৬৯ সালে। কিন্তু সেই বাংলা একাডেমীরই ‘চরিতাভিধান’ বলছে সনটি ১৯৬২!
আবু ইসহাকের উপন্যাসের নাম কি? “সূর্যদীঘল বাড়ী” না “সূর্য দীঘল বাড়ী”? “পূর্ব বাঙলার উপন্যাস” গ্রন্থে মনসুর মুসা লিখেছেন দু’ রকম বানানই। “কথাসাহিত্যের কথকতা” গ্রন্থে হাসান আজিজুল হক লিখেছেন “সূর্য দীঘল বাড়ি”। তিনি উপন্যাসের নায়িকা “জয়গুণ”কে লিখেছেন “জয়তুন”।
সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত মাসিক পূর্বাশা পত্রিকার নির্বাচিত রচনা সঙ্কলন “পূর্বাশা সংকলন ১” প্রকাশ করেছে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি। এর ‘মুখবন্ধ’ লিখেছেন সঙ্কলন-সম্পাদক নিত্যপ্রিয় ঘোষ। তাঁর ওই লেখাটিতে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের নাম প্রথম উল্লেখেই হয়েছে ‘সঞ্চয়’!