সোমবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১২

সংবাদশিল্পের সন্ধানে

সংবাদ আমাদের সবসময়ের সঙ্গী। আমরা নিঃশ্বাস নেই সংবাদে, আমরা বাঁচিও সংবাদে। আমাদের জীবন-সংসার চলন বলন ভাবনা সবই সংবাদময়। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত অসংখ্য সংবাদে ডুবে থাকি আমরা সবাই। আমাদের আবেগ আগ্রহ আকাঙক্ষা সবই সংবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমাদের সকলের দেখা শোনা চেনা জানা, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে যা কিছু সবই সংবাদবিজড়িত। যখন কথা বলি বা শুনি - সামনাসামনি বা সেলফোন-টেলিফোনে তখনও আদানপ্রদান করি সংবাদের। তারপর আছে কত শত সংবাদমাধ্যম। রেডিও, টেলিভিশন, ইনটারনেট, সেলফোন, সংবাদপত্র। বাংলাদেশী শ্রোতাদের জন্য সংবাদবিশ্ব উন্মুক্ত হয়ে গেছে তথ্যপ্রযুক্তি প্রসারের সঙ্গে-সঙ্গে। রেডিওতে, এফএম ব্যান্ডে সারা দিনই খবর দেশী-বিদেশী নানা চ্যানেল থেকে। টেলিভিশনেও দেশী-বিদেশী অসংখ্য চ্যানেলে ঘণ্টায়-ঘণ্টায় পরিবেশিত হয় সংবাদ। আর আছে আমাদের দুই শতাব্দী প্রাচীন বিশ্বস্ত সঙ্গী সংবাদপত্র। অডিও-ভিসুয়াল মাধ্যমগুলোর বৈপ্লবিক উৎকর্ষে অনেকেই আশঙ্কা করেছেন, এর আকর্ষণ বুঝি যায়-যায়। কিন্তু সে সব আশঙ্কা অমূলকই প্রমাণিত হয়েছে। সংবাদপত্র স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে আছে এখনও। তাই আমরা সংবাদপত্রের চোখ দিয়ে দেখি, তার কান দিয়ে শুনি, তার বিবরণ থেকে বুঝি, এমনকি কথা বলি ও লিখি তার ভাষায়ই। সংবাদপত্রের আকর্ষণ কতখানি তা একটু মজা করেই লিখেছেন প্রখ্যাত মারকিন সাংবাদিক-সাহিত্যিক হেলেন রাওল্যান্ড (১৮৭৫-১৯৫০) -“Before marriage, a man declares that he would lay down his life to serve you; after marriage, he won’t even lay down his newspaper to talk to you.”
এমন তীব্র আকর্ষণের কারণ সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, ভাস্কর্য প্রভৃতির মতো সংবাদও এক শিল্প। সাহিত্যে যেমন ভাব ভাষা নির্মাণ, সংবাদেও তেমন তথ্য ভাষা উপস্থাপন। এ তিনটি ক্ষেত্রে যিনি যত শিল্পিত তিনি তত কৃতী সাহিত্যিক বা সাংবাদিক। সমস্যা একটিই। সেটা বলেছেন বৃটিশ কবি-সমালোচক ম্যাথু আরনল্ড (১৮২২-১৮৮৮) -“Journalism is literature in a hurry.” এই চটজলদি কাজের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সংবাদশিল্প নির্মাণ সহজ নয় কোনও সাংবাদিকেরই পক্ষে। তবে ওই মোকাবেলাটাও এক শিল্প। সে পথে দুই শতকে অনেকখানি পথ হেঁটে এসেছে সংবাদপত্র। তবে আরও পথ হাঁটতে হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। এখন সে হাঁটা-চলা কেমন তা একটু সন্ধান করা যেতে পারে।
গত ২১শে এপ্রিল একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দিলে চালক পুড়ে মারা যান - এ খবরটি পরদিনের এক পত্রিকায় ছাপা হয়েছে এভাবে:
“আট বাসে আগুন / চালক জীবন্ত দগ্ধ... বিএনপির সকাল-সন্ধ্যা হরতালের আগের দিন দুর্বৃত্তরা  রাজধানীর খিলগাঁও, গুলিস্তান, আবদুল্লাহপুর, আজিমপুর, ভিক্টোরিয়া পার্ক, মিরপুর ও ফার্মগেট এলাকায় ৮টি বাস আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। এ ঘটনাগুলোর মধ্যে খিলগাঁও খিদমাহ হাসপাতালের সামনে বদর আলী বেগ (৪০) নামের এক চালক অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। নিহত বদর আলী ঈগল পরিবহনের একটি বাসের চালক ছিলেন। এছাড়া এসব ঘটনায় ৪জন আহত হয়েছেন। তবে বাসগুলোতে কারা কীভাবে আগুন দিয়েছে তাৎক্ষণিকভাবে তা জানাতে পারে নি পুলিশ বা ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। বাস ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের চেষ্টা চালানোর অভিযোগে ৮জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এছাড়া হরতালের সমর্থনে গতকাল বিকালে রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকায় মিছিল বের করেছে বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। এদিকে বিভিন্নস্থানে বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক প্রায় যানবাহনশূন্য হয়ে পড়ে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন বাড়ি ফেরা সাধারণ মানুষ। উল্লেখ্য, সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীকে ‘গুম’ করেছে - এমন অভিযোগে বিএনপি রবিবার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে।...”
    অন্য এক পত্রিকায় উপস্থাপনা এ রকম:
    “রাজধানীতে ৬ যানবাহনে আগুন / ১ জন নিহত... গতকাল শনিবার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত রাজধানীর ছয়টি স্থানে ছয়টি বাস-মাইক্রোবাসে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়ার ঘটনায় একজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত ব্যক্তির নাম বদর আলী (৪০)। তিনি বাসচালক। গতকাল দুপুর ২টার দিকে খিলগাঁও, আজিমপুর, গুলিস্তান ও উত্তরার আবদুল্লাহপুরে চারটি বাসে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ফকিরাপুলে আগুন দেয়া হয় সরকারি জনপ্রশাসনের এক মাইক্রোবাসে। এর আগে দুপুরে খিলগাঁওয়ে ঈগল পরিবহণের বাসে দেয়া আগুনে বাসটির চালক বদর আলী জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা যান এবং হেলপার মোতালেব আহত হন। ঈগলের বাসটি (যশোর-ব-১১-০০১৯) ঢাকা-খুলনা রুটের। খিদমা হাসপাতালের সামনে ওই বাসটিকে আগুন ধরিয়ে দেয় কয়েকজন যুবক। এ গাড়ির ভেতর থেকেই উদ্ধার করা হয় গাড়িচালক বদরের মৃতদেহ।...”
    অন্য আরেক পত্রিকায় খবরটি এসেছে এভাবে:
    “বাসে আগুন, দগ্ধ হয়ে চালক নিহত... রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় গতকাল দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত আটটি যাত্রীবাহী বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। অগ্নিদগ্ধ হয়ে একটি বাসের চালক নিহত হয়েছেন। দুপুর থেকে একের পর এক বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর রাজধানীতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তাঘাট ফাঁকা হতে শুরু করে। বিশেষ করে রাস্তায় দুপুরের পর থেকে যাত্রীবাহী বাসের সংখ্যা কমে যায়। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় অফিস ফেরত নগরবাসীকে। গতকাল দুপুরের পর থেকে রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়িও কম দেখা গেছে। দুপুরে ।াধ ঘণ্টার ব্যবধানে চারটি বাসে দুর্বৃত্তরা অগ্নিসংযোগ করে। এর মধ্যে খিলগাঁও গভর্নমেন্ট কলোনির সামনে পার্কিং করা বাসে আগুন লাগিয়ে দেয়ায় চালক বদর উদ্দিন (৪০) অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন ওই বাসের চালকের সহকারী আবদুল মোতালেব। কে বা কারা কি কারণে বাসে অগ্নিসংযোগ করেছে, তা নিশ্চিত জানা যায় নি। তবে পুলিশ দাবি করছে, বিএনপি’র ডাকা হরতালকে কেন্দ্র করেই বাসে আগুন লাগিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে।...”
    ইংরেজি একটি পত্রিকায় খবরটি এ রকম:
   Bus was parked, driver asleep... A driver was burned to death and his assistant suffered injuries as their bus was set alight at the capital’s Khilgaon yesterday on the eve of the opposition-called hartal. Nine more buses, including three with passengers, were torched at Mirpur-1 and 10, Baridhara, Azimpur, Abdullahpur Beribadh, Gulistan, Darus Salam, Farmgate and near Bahadur Shah Park, fire brigade officials said. The latest was around 8:15pm. Police identified the ill-fated bus driver as Badar Ali Beg, 48. They took the injured, Abdul Motaleb, 26, to Khilgaon Police Station for interrogation. Motaleb, who suffered burns on his neck and back of his head, told The Daily Star that the two were sleeping on the isle in the afternoon; Motaleb was closer to the doors. Excessive heat woke him up, and seeing fire and smoke, he jumped out of a window. All the doors were locked. For the moment, he had forgotten that Badar was inside, he said. None in the area could say how and by whom the bus was set on fire....”
    কোনও রকম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ছাড়াই আমরা বুঝতে পারি তথ্য, ভাষা ও উপস্থাপনের দিক থেকে প্রকাশিত খবর চারটির শুরু চার রকম। আহরিত ও পরিবেশিত তথ্য প্রায় একই রকম। গাড়িচালকের নাম ও বয়স দু’টি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে ভিন্ন। একটি পত্রিকায় আহত আবদুল মোতালেব অনুল্লিখিত। একটি পত্রিকায় স্থানটি সুনির্দিষ্ট করা হয় নি, অন্যান্য পত্রিকায় সুনির্দিষ্ট করা হলেও ভিন্নতা রয়েছে। একটি খবরে প্রাক-হরতাল বিষয়টির উল্লেখ নেই। অগ্নিসংযোগকারীরা দু’টি পত্রিকায় ‘দুর্বৃত্ত’ হিসেবে উল্লিখিত হলেও একটি পত্রিকায় তাদের উল্লেখ করা হয়েছে স্রেফ ‘যুবক’ হিসেবে। উপস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি পত্রিকায় বাসচালকের জীবন্ত দগ্ধ হওয়ার বিষয়টিই গুরুত্ব পেয়েছে অন্যান্য পত্রিকায় গুরুত্ব পেয়েছে রাজধানীর পরিস্থিতি ও হরতাল প্রসঙ্গ। কোনও উপস্থাপনায়ই মর্মান্তিক ঘটনাটির প্রকৃত বেদনা প্রকাশ পায় নি। ভাষায় ক্রিয়াপদের শুধু কথ্য রূপ দেখা যায়, কিন্তু শব্দচয়নে সাধু ভাষার মিশ্রণই বেশি। বাক্যগঠনেও প্রভাব বেশি সাধুরীতির। সংবাদশিল্পের জন্য আমাদের চাই - অল্প কথায় অধিক বলার দক্ষতা। চাই ছোট-ছোট শব্দে ছোট-ছোট বাক্য।
sazzadqadir@rediffmail.com

বৃহস্পতিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১২

বলের বল বাহুবল

হরতাল আমি অপছন্দ করি। আরও অপছন্দ করি জ্বালাও পোড়াও ভাঙচুর। দেশের সম্পদ বিনষ্ট করা, জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি করা সমর্থন করি না মোটেও। যারা অতিউৎসাহে এসব কর্মকা-ে মাতে বা তৎপরতায় লিপ্ত হয় তাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলায় কোনও দোষ দেখি না আমি। পরাধীন দেশের সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আর স্বাধীন দেশের সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন একই রকম হতে পারে না বলে বিশ্বাস করি। কিন্তু তাহলে সরকারের অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে কিভাবে প্রতিবাদ-আন্দোলন গড়ে তুলবে বিরোধী দল, কিভাবে লড়বে সরকারি দমন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে। ছোটবেলায়, সেই পঞ্চাশ-ষাট দশকে, দেখেছি - দেশে নিত্যপণ্য আক্রা হলে, খাদ্যাভাব দেখা দিলে ভুখ মিছিল বের করতো বিরোধী দল। এতে লজ্জা পেয়ে সরকার তাড়াতাড়ি খুলতো লঙ্গরখানা। না খুললে সরকারকে আরও লজ্জা দিতে বিরোধী দলের পক্ষ থেকেই খোলা হতো লঙ্গরখানা। এখন তো লজ্জা-শরমের বালাই নেই কারও। ভুখ মিছিল তো দূরে থাক ভুখ হরতাল করলেও টনক নড়ে না সরকারের। সেকালে মাইকিং, লিফলেট, হ্যান্ডবিল, ব্যানার, পোসটার, ফেসটুন, দেয়াল লিখন, চিকা দেখলেই অস্থির হয়ে পড়তো প্রশাসন। এগুলো বন্ধ করতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে শুরু করে দিতো ধরপাকড়। তারপর পত্রিকায় বিবৃতি, বিজ্ঞপ্তি দেখলে তো পত্রিকা ভরে যেতো প্রেসনোটে। সভা, সমাবেশ বন্ধ করতে ১৪৪ ধারা দিলেই চলতো তখন। এই আশির দশকেও এরশাদ লাগাতার কারফিউ দিয়ে রাখতেন। আর মিছিল? ভুখ মিছিলের কথা তো বলেছি, এছাড়া মশাল মিছিল ছিল তখন বিরোধী দলের বিশেষ প্রিয় কর্মসূচি। এখন তো লাঠি মিছিল, কাফনের কাপড় পরে মিছিল চলছে হরহামেশা। এ সবে ভ্রুক্ষেপ করে না সরকার। হরতাল, ধর্মঘট তো ধার হারিয়েছে কবে! অনশন ধর্মঘট ভারতে কাজে লাগলেও আমাদের এখানে অচল। শহিদ মিনারে শিক্ষকদের বা প্রেস ক্লাবের সামনে আয়াদের লাগাতার অনশন ধর্মঘট কোনও কাজ দিয়েছে বলে মনে হয় না। অবস্থান ধর্মঘট মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফরিকা, লাতিন আমেরিকায় ক্ষমতায় পালাবদল আনলেও এখানে সুযোগ পর্যন্ত মেলে না অবস্থানের। আর এখন যে ইউরোপ-আমেরিকায় দখল আন্দোলন (অকুপাই মুভমেন্ট) চলছে তা এখানে চালু করা অসম্ভব বললেই হয়। অথচ ষাটের দশকে ঘেরাও ছিল এক কার্যকর কর্মসূচি। মানববন্ধন, পদযাত্রা, সড়কযাত্রা, ট্রেনযাত্রা, শোভাযাত্রা, শোডাউন - এগুলো নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করলেও কোনও পাত্তা দেয় না সরকার। তাহলে কি করবে বিরোধী দল? সরকারি দলের লোকজন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে মহড়া দিলেও সে সব দেখার কেউ নেই। তারা হামলা হানাহানি করলে বরং বাহবা মেলে সরকারি মহলের। এমন পরিস্থিতিতে বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি কোনও বোধোদয় ঘটায় না সরকারের, বরং তামাশার ব্যাপার বলেই ঠেকে সকলের কাছে। সেই কবে ‘পথের দাবী’ (১৯২৬) উপন্যাসে শরৎচন্দ্র লিখেছেন, “ধর্মঘট বলে একটা বস্তু আছে, কিন্তু নিরুপদ্রব ধর্মঘট বলে কোথাও কিছু নেই। সংসারে কোনও ধর্মঘটই কখনও সফল হয় না, যতক্ষণ না পিছনে তার বাহুবল থাকে। শেষ পরীক্ষা তাকেই দিতে হয়।” যে দেশে সদ্যবিদায়ী সরকারি দলকে আচ্ছামতো ছ্যাচা না দিলে নির্বাচনে জয় নিশ্চিত করা যায় না সেখানে বলের বল বাহুবলই তো হয়ে থাকবে!
sazzadqadir@yahoo.com

রবিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১২

সাযযাদ কাদির: ৬৫তম জন্মদিনে বিশেষ সাক্ষাৎকার

কবি সাযযাদ কাদির বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এক বহুদর্শী ব্যক্তিত্ব। সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় তাঁর সৃষ্টিশীল বিচরণ বিস্ময় জাগায় পাঠকদের। শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা, সম্পাদনার কারণেও খ্যাতিমান তিনি।  সম্পাদনা প্রতিভা তাঁর অনন্য, রয়েছে সাংগঠনিক দক্ষতা। নিশ্ছিদ্র গভীর জ্ঞানের অনুসন্ধানে তিনি ব্রতী ও মনস্ক। ১৪ই এপ্রিল ১৯৪৭ সালে তাঁর জন্ম মাতুলালয় টাঙ্গাইল জেলা-শহরের উপকণ্ঠ-গ্রাম মিরের বেতকায়। পিত্রালয় একই জেলার দেলদুয়ার উপজেলা-সদরে। ১৯৬৯ ও ১৯৭০ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স ও এম এ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যথেচ্ছ ধ্রুপদ’ প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে, গল্পগ্রন্থ ‘চন্দনে মৃগপদচিহ্ন’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালে। কবিতা ও গল্প ছাড়াও উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ-গবেষণা, শিশুতোষ, সম্পাদনা, সঙ্কলন, অনুবাদ সহ বিভিন্ন বিষয়ে ৬০টির বেশি গ্রন্থের প্রণেতা সাযযাদ কাদিরের একাদশ কবিতাগ্রন্থ “বৃষ্টিবিলীন” প্রকাশিত হয়েছে গত অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। সাহিত্য সংস্কৃতি, সমকালীন প্রসঙ্গ সহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন ‘আমার দেশ’ সাহিত্য সাময়িকীর প্রতিনিধি কবি হাসান হাফিজ। কবি সাযযাদ কাদিরের ৬৫তম জন্মদিন উপলক্ষে সে আলোচনার উল্লেখযোগ্য অংশ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো এখানে:

লেখালেখিতে কেমন করে এলেন?
ছোটবেলায় পড়তে শেখার পর শিখেছি লিখতে। পড়তে-পড়তে হয়েছিল পড়ার নেশা। আর লিখতে-লিখতে হয়েছে লেখালেখির নেশা। এ নেশা ফোর-ফাইভে পড়ার সময় থেকে। তখনই উৎসাহ-অনুপ্রেরণা পেয়েছি অনেকের কাছ থেকে। তাতে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে ক্রমে। একটু বড় হয়ে, মানে ক্লাশ এইটে পড়ার সময় থেকে, ঢাকার পত্রপত্রিকার শিশুকিশোর বিভাগে লেখা পাঠাতে থাকি। পদ্য, ছড়া, গল্প - এসব। পাঠিয়েছি, কিন্তু ভাবি নি তখনকার টাঙ্গাইলের মতো এক ঘোরতর মফস্বুলে গ্রাম-শহর থেকে পাঠানো এক বালকের লেখা ছাপার অক্ষরে প্রকাশ পাবে কোনও দিন। কিন্তু আমাকে ও আমার চেনাজানা সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে সব লেখা ছাপা হয়েছে ঠিকই। তবে শিশুতোষ লেখা লিখি নি বেশি দিন। ১৯৬২ সালে কলেজে ভর্তি হই অর্থাৎ সাবালক হয়ে উঠি। তখন ‘সাবালক’ কবিতা ও গল্প পাঠাতে থাকি পত্রপত্রিকায়। সেগুলো ছাপাও হতে থাকে। ফলে ওই সময় থেকেই আমি পরিচিত হয়ে উঠি লেখালেখির জগতে। তারপর এই ৫০ বছর ধরে আছি লেখার নেশাতেই। সেই সঙ্গে সেই পড়ার নেশা তো আছেই। আরও আছে দু’টি ঘোর নেশা - গান শোনা আর ছবি দেখা।
কবিতা ও গদ্য - কোন ধরনের রচনায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন? কেন?
লেখালেখির শুরু থেকেই চর্চা করে আসছি দু’টোরই। দীর্ঘ দিনের চর্চায় তো এক ধরনের অভ্যস্ততা, স্বাচ্ছন্দ্য তৈরি হয়ে যায়ই। সে স্বাচ্ছন্দ্য আছে আমার। তাছাড়া সব লেখাই আমি লিখি আগাগোড়া ভেবেচিন্তে। কোনও লেখার ভাবনা মাথায় এলে তা কোত্থেকে শুরু করে, কি-কি লিখে, কোথায় শেষ করবো - তা মনে-মনে ছকে নিই আগে। তারপর লিখতে বসি।
বলা হয়, বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ রাজধানী হবে ঢাকা। অনেকের মতে, এই লক্ষণ ক্রমেই পরিস্ফুট হয়ে উঠছে। আপনার কি অভিমত?
এ রকম কথা বলা হচ্ছে সেই পঞ্চাশ-ষাট দশক থেকে। বায়ান্ন’র লড়াইয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে আমরা সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছি চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে। সে লড়াইয়ের রক্তঝরা পথ বেয়েই ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ - আমাদের স্বাধীনতা। আমরা ভেবেছি, এই অর্জন আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে সর্বক্ষেত্রে। কিন্তু তা হয় নি। রাজনীতি দুর্নীতিগ্রস্ত, অর্থনীতি ভঙ্গুর, সমাজ কলুষিত। চল্লিশ বছর পরও অবক্ষয় সর্বত্র। সমাজপ্রগতি স্তব্ধ। এ অবস্থায় বিচ্ছিন্ন ভাবে কোনও মাধ্যম কি শীর্ষ সাফল্য পেতে পারে? চলচ্চিত্র, নাটক, টেলিভিশন, বেতার, সংগীত, চিত্রকলা, ক্রীড়া - কি অবস্থায় আছে? আমরা নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টি করতে চাই কিন্তু চারপাশে অনেক বাধা। ওদিকে কলকাতা চাইছে তাদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে। ষাটের দশকে আমরা যেভাবে উরদুত্বকে মোকাবিলা করে বাংলাকে উঁচুতে রাখার সংগ্রাম করেছি, ওঁরা সেভাবেই হিন্দিত্বকে মোকাবিলা করে চলেছে, আর চ্যালেঞ্জ হিসেবে নতুন-নতুন ধারায় সৃষ্টিশীলতাকে অব্যাহত রাখছে। ওঁরা সমর্থন ও সাহস পাচ্ছে ওঁদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিবেশ থেকে, কিন্তু এমন সমর্থন ও স্বাধীনতা এখানে কোথায়? এখানে বিভাজন, পরমতঅসহিষ্ণুতা, চরিত্রহনন ব্যাপক। দলীয়করণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে মেধা, শ্রম, সততা আর যোগ্যতা বলে বিবেচিত হয় না; তাই সর্বোচ্চ শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানে চাকরি হয়ে যায় গাড়লদের, এবং তারা দিব্যি ছড়ি ঘুরিয়ে বেড়ায়। যেখানে কবিরা রাজকবি হয়ে ওঠে বা রাজকবি হতে চায় ্ল- সেখানে সাহিত্যের ভবিষ্যৎ কি? কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা যখন ভিন্নমত পোষণের ও সমালোচনা করার অধিকার বিসর্জন দেয়, তখন দেশ জাতি জনগণের জন্য আর কিছু থাকে না তাদের। দেশ, রাজধানী - এ সব তো মানুষের। সেই মানুষের পক্ষে না থেকে যারা প্রতিষ্ঠার পোঁ ধরে তারা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে কোন গতিধারা আনবে? তবুও অবিশ্বাসী নই আমি। হতাশ নই। এই বৈরী সময়কে, অবক্ষয়কে চ্যালেঞ্জ করে সৃষ্টিশক্তির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটবেই এখানে। বিশাল বাংলা আজ কাঁটাতারের বেড়ায় ছিন্নভিন্ন, কিন্তু আমাদের মানসবাংলা অভিন্ন আকাশের নিচে হাজার বছরের এক পবিত্র ঐতিহ্যভূমি। এর ইতিহাস, ভূগোল, সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্যকে কখনওই বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন করতে পারবে না কোনও রাষ্ট্রনীতি, কোনও কূটকচাল। তাই ঢাকা শুধু সাহিত্যের নয়, প্রতিটি বাঙালির মনে চিরজাগরূক সে বিশাল মানসবাংলা, তার রাজধানী হবে একদিন।
তারুণ্যের স্পর্ধিত বিকাশে লিটল ম্যাগাজিনগুলো আজকাল ঈপ্সিত ভূমিকা পালন করতে পারছে না বলে কারও-কারও ধারণা। এ ব্যাপারে আপনার পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে বলুন।
ষাটের দশকের লিটল ম্যাগাজিন চর্চায় আমি যুক্ত ছিলাম। আমার ভূমিকাও ছিল উল্লেখ করার মতো। ‘স্বাক্ষর’, ‘কণ্ঠস্বর’, ‘ছোটগল্প’ ও আরও অনেক ম্যাগাজিনে লিখেছি, কাজ করেছি। নিজে সম্পাদনা, প্রকাশনা করেছি। এগুলো ‘লিটল’ কেন তা বুঝি না। চালু হওয়া নাম ছাড়া আর কি? এগুলো সবই সাহিত্য পত্রিকা। সাহিত্যপত্র, কবিতাপত্র বা এ রকম কিছু। চালু বহু কিছু ঝেড়ে ফেললেও এই ‘চালু’ কথাটা যে কেন ঝাড়া গেল না এত দিনে তা বুঝি না। লিটল ম্যাগাজিনে লিখে আমি স্বস্তি পাই। তখনও পেয়েছি, এখনও পাই। আমি খুঁজে-খুঁজে সবচেয়ে বেশি কিনি ও পড়ি লিটল ম্যাগাজিন। আমার দরকারি বহু সম্পদ-সামগ্রী পাই এখানে। হারিয়ে যাওয়া, ভুলে যাওয়া কত কি পেয়ে যাই! তাছাড়া নতুন রকম লেখা, নতুন ভাবে দেখা থাকে লিটল ম্যাগাজিনে। যখন দেখি চালুর ব্যাপারে দ্রোহ, আক্রমণ তখন বেশি ভাল লাগে। তবে সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও মিডিয়ার যে ধান্দাবাজি চলছে তা আরও খুলে দেখাতে পারতো তারা। প্রতিষ্ঠার প্রতিভূদের নানা মতলববাজি, অলেখকদের দৌরাত্ম্য, ভুয়াদের গ্রুপিং - এগুলো ন্যাংটো করে দেয়া দরকার। এ সব করতে গেলে অবশ্য নিজের ক্ষতি স্বীকারে প্রস্তুত থাকার সাহস থাকতে হবে।
সাহিত্যে গোষ্ঠীবদ্ধতা কতটা প্রয়োজন? সেটা কি ক্ষতিকর, না উপকারী? আপনার কি মনে হয়?
সাহিত্য আর যা-ই হোক দল বেঁধে, গোষ্ঠী গড়ে করা যায় না। কিন্তু প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠায় গোষ্ঠীবদ্ধতা ভূমিকা রাখে। এখন তো গোষ্ঠী-গ্রুপিং ছাড়া লেখা প্রকাশ করাই মুশকিল। মুখে গণতন্ত্রের পক্ষে, দলীয়করণের বিপক্ষে কথা বললেও বহু প্রকাশ-প্রচার মাধ্যমে কড়া দলবাজি চলছে। রীতিমতো কালো তালিকা তৈরি করে এক ধরনের ফাসিস্ত ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর। মুখ চিনে লেখা বা বই ছাপা হয়, অনুষ্ঠানে ডাকা হয়। এই গোষ্ঠী-গ্রুপিং অসুস্থ, অস্বাস্থ্যকর। এর মধ্যে সৃষ্টির চেয়ে বেশি আছে হননেচ্ছা। আমার নিজের অভিজ্ঞতা আছে এ ব্যাপারে। এক সাহিত্য সাময়িকীতে আমার লেখা ছাপা হয় না - আমি গাঞ্জুটি বা হেরোইনচি নই বলে। ওই সাময়িকী যিনি প্রযোজনা করেন তিনি নিজে একজন গাঞ্জুটি, তাই একই রকম পালকের পাখিদের সমাদর সেখানে।
কেমন বাংলাদেশ আপনি দেখতে চান?
আমি চেয়েছিলাম বাংলাদেশ হবে সমাজকল্যাণ রাষ্ট্র। সমাজে জীবনে থাকবে উদার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। এই কল্যাণরাষ্ট্র হবে “a concept of government in which the state plays a key role in the protection and promotion of the economic and social well-being of its citizens. It is based on the principles of equality of opportunity, equitable distribution of wealth, and public responsibility for those unable to avail themselves of the minimal provisions for a good life. The general term may cover a variety of forms of economic and social organization.”  মডেল হবে নোরডিক - সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক ও ফিনল্যান্ডের মতো। কিন্তু কি পেয়েছি? সকালে বা বিকালে শাহবাগে যাওয়ার পথে পরীবাগে দেখি ফুটপাতে অসহায় নরনারীশিশুর জীবন। কাওরানবাজারে আমার অফিস। রাতে বাসায় ফেরার পথে ভিআইপি রোডের ফুটপাতেও দেখি সেই দুঃস্থ নরনারীশিশুদের। দেখি প্রখর উজ্জ্বল আলোর নিচে কত নিকষ কালো অন্ধকার। গ্রীন রোডে থাকি। এ রোডেরও এখানে-ওখানে ফুটপাতে দেখি ওই নিঃসহায়দের। এই ভুখানাঙ্গা ছিন্নমূল মানুষকে দেখবো চারপাশে আর শুনবো ক্ষমতার রাজনীতির গলাফাটা চেঁচামেচি? না, এমন দেশ আমি চাই নি।

জলা-নালা জয়ের জন্য

দু’ দশকেরও বেশি হলো আমাদের দেশে দু’টি বড় রাজনৈতিক দল ক্ষমতা ভোগ করছে পালাক্রমে। পর-পর দু’বার ক্ষমতা ভোগের জন্য যৎপরোনাস্তি চেষ্টা চালালেও এখনও সফল হন নি তাঁরা। সম্ভবত যত বড় ভাবা হয় অত বড় দল নয় বলেই এমনটি ঘটে।  অত বড় নয় বলছি, কারণ ছোট-ছোট দলের সঙ্গে জোট গড়তে হয় তাঁদের। এছাড়া ছোটদের জোটে রাখাও জরুরি। নাহলে ছোটরা সব মিলেঝুলে বড় জোট গড়ে একদিন তারাও বড় দল হয়ে উঠতে পারে। সেটা ভাল হবে না দুই বড়’র জন্য। কিন্তু রাজনীতির নামে এই দুই বড় পরস্পরের প্রতি যে রকম মারমুখো তাতে পরিস্থিতি সেদিকেই যাবে শিগগিরই - এমন মনে করার কারণ আছে যথেষ্ট। তাদের বেপরোয়া বিরোধিতা সব ক্ষেত্রে ছড়িয়ে দিয়েছে নেতিবাচক মনোভাব, সন্দেহ, অবিশ্বাস, অসষ্ণিুতা, আক্রোশ, ঘৃণা। আর এসব সূত্রে দেখা দিচ্ছে সহিংসতা। জ্বালাও পোড়াও ভাঙচুর হানাহানি সংঘাত সংঘর্ষ হামলা মামলা হরতাল ধর্মঘট। গরিব দেশের জন্য এ সব চরম বিলাসিতা। দু’দলের নেতাকর্মীদের অহমিকা অনাচার দুরাচার প্রতিশোধ প্রতিহিংসার জন্য দেশের সম্পদ বিনষ্ট হবে, প্রশাসন ব্যতিব্যস্ত থাকবে, ব্যবসা বাণিজ্য শিক্ষা সহ সকল আর্থসামাজিক কার্যক্রম হুমকির মুখে পড়বে - আর কত দিন দেশ জাতি জনগণের এই বিপুল ক্ষয়ক্ষতি নিত্য সইবে মানুষ? ভারতচন্দ্রের ভাষায় বলি, “নিত্য তুমি খেলো যাহা। নিত্য ভাল নহে তাহা ॥”
    দু’ দলের সর্বশেষ খেলা এখন চলছে সাগরের জয়-পরাজয় নিয়ে। সরকার বলছে, মিয়ানমারের সঙ্গে সাগরসীমা সংক্রান্ত বিরোধে আন্তর্জাতিক আদালত যে রায় দিয়েছে তা বাংলাদেশের পক্ষে এসেছে। এ জয় বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় উদযাপন করছে সরকারি দল। অভিনন্দন, সংবর্ধনা, অভ্যর্থনা চলছে। অভিনন্দন প্রথমে বিরোধী দলও জানিয়েছিল, পরে প্রত্যাহার করে নিয়ে বলেছে, এটা বিজয় নয়... শুভঙ্করের ফাঁকি। বিজয় হলে মিয়ানমার-ও কেন উৎসব করছে? পত্রপত্রিকায় নানা তথ্য-উপাত্ত আসছে এ সব নিয়ে। সরকারের প্রতি আমার অভিনন্দন প্রত্যাহার করি নি আমি, কিন্তু বুঝতে পারছি না ঘটনা কি। দু’দল এভাবেই আমাকে, আমার মতো অনেককে, দেশবাসীকে বিমূঢ় বিভ্রান্ত করে রাখে প্রায় সব বিষয়েই। তাঁরা পরস্পর সম্পর্কে যে সব কথা বলেন সে সব বিশ্বাস করলে বলতে হয় - আমরা এক ভয়ঙ্কর সময়ে বাস করছি ভয়ঙ্কর লোকজনের সঙ্গে।
    যাহোক, সাগরে আমাদের জয়-পরাজয় নিয়ে খোঁজাখুঁজি করি সংবাদমাধ্যমে। নানা প্রতিবেদন, মন্তব্য, মতামত পড়ি। মিয়ানমারের অনলাইন সংবাদপত্র দি ইরাবতী’র গত ১৫ই মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত জোসেফ আলচিন-এর প্রতিবেদন “বাংলাদেশ ক্লেইমস্‌ ভিক্টরি ইন বে অভ বেঙ্গল ডিসপিউট”  (www2.irrawaddy.org.article.php)-এর নিচে মতামত অংশে জনৈক Andy’র একটি মন্তব্য পাই এরকম:“ Bengali claimed purportedly victory because of their own political reason at home. They are just being jactitation. Actually they didn't even win what they had asked for. ITOLS awarded 171,832 square kilometres to Myanmar whereas it allocated approximately 111,631 square kilometres of the relevant area to Bangladesh. Bangla may have won their disputed deep sea block 11 but Myanmar will still retain Bangla's drawn up gas-field blocks 18, 22, 23, 27 and 28.” কৌতূহলী পাঠক-পাঠিকাদের জন্য এ সংক্রান্ত দু’টি লিঙ্ক দিচ্ছি এখানে। আপনারা নিজেরাও দেখে নিতে পারেন - http://horizonspeaks.wordpress.com/2011/09/11/bangladesh-vs-myanmar-the-maritime-arbitration/; http://internationallawobserver.eu/2012/03/15/judgment-in-bangladesh-myanmar-maritime-boundary-dispute/.
    এ থেকে জানতে পারছি - বঙ্গোপসাগরের বিরোধপূর্ণ এলাকার ১১১,৬৩১ বর্গকিলোমিটার অংশ বণ্টন করা হয়েছে বাংলাদেশকে, আর ১৭১,৮৩২ কিলোমিটার অংশের মালিকানা মিয়ানমারের বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। গভীর সাগরের ব্লক ১১ নিয়ে বিরোধে বাংলাদেশ জয়ী হয়েছে, কিন্তু দাবিকৃত ১৮, ২২, ২৩, ২৭ ও ২৮ ব্লক পায় নি। ওগুলোর মালিকানা রয়ে গেছে মিয়ানমারেরই। আমার এবং আমার মতো বহুজনের প্রশ্ন, আসল ঘটনা কি এটাই? বিষয়টি পরিস্কার করতে পারেন শুধু বিশেষজ্ঞ ও বিশারদগণ। তাঁরা নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবেন তাঁদের দায়িত্ব পালনে।
    তবে সাগর জয়ের খবর পেয়ে প্রথমে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, এ জয়ের ফল ভোগ করবে কে? বিদেশী তেল-গ্যাস কোমপানি, দেশী ধনিক ব্যবসায়ী ও আমলাচক্রের বেষ্টনী চুঁইয়ে কি কিছু আসতে পারবে জনমানুষের কাছে? সাগর দূরে থাক, আমাদের নিজেদের নদীনালা খালবিল-ই তো জয় করতে পারছি না আমরা। বাঁধ ও বণ্টনের মধ্যে আমরা হারিয়েছি গঙ্গা নদীকে। তাই পদ্মা আজ পরাজিত। এক শ’ বছর আগে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২) তাঁর ‘কুহু ও কেকা’ (১৯১১) কাব্যে ‘পদ্মার প্রতি’ নামে যে কবিতাটি লিখেছিলেন তা আজ অবিশ্বাস্য, হয়তো হাস্যকরও, মনে হবে এ প্রজন্মের অনেকের কাছে। তিনি লিখেছিলেন -
    “হে পদ্মা! প্রলয়ঙ্করী! হে ভীষণা! ভৈরবী সুন্দরী!
    হে প্রগল্‌ভা! হে প্রবলা! সমুদ্রের যোগ্য সহচরী
    তুমি শুধু; নিবিড় আগ্রহ তার পার গো সহিতে
    একা তুমি; সাগরের প্রিয়তমা অয়ি দুর্বিনীতে!
    দিগন্ত-বিস্তৃত তব হাস্যের কল্লোল তারি মত
    চলিয়াছে তরঙ্গিয়া, - চিরদৃপ্ত, চির-অব্যাহত।
    দুর্দমিত, অসংযত, গূঢ়চারী, গহন-গম্ভীর,
    সীমাহীন অবজ্ঞায় ভাঙিয়া চলেছ উভতীর!...”
    তিস্তা ও ফেনী নদী নিয়ে চলেছে এক অনিশ্চিত প্রক্রিয়া। ওদিকে টিপাইমুখে বাঁধ হুমকি হয়ে উঠেছে সুরমা ও কুশিয়ারা’র জন্য। বাঁধ নির্মিত হতে যাচ্ছে মেঘালয়ে। সবার উপরে ৩৮টি নদ-নদীর মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে এবং ছোট-বড় ৩৪টি বাঁধ ও ৭৮টি বড় জলাধার নির্মাণের মাধ্যমে প্রতিবেশী ভারত যে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প হাতে নিয়েছে তাতে কোন সর্বনাশ নেমে আসবে আমাদের ওপর তা কি জানি এখনও? অভিজ্ঞ মহল বলছেন, এতে এ দেশের নদী-ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটবে, মরুকরণ শুরু হবে ব্যাপক মাত্রায়, সুন্দরবন ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে, প্রতিবেশগত ভারসাম্যহীনতা দেখা দেবে চরম আকারে।
    এ তো প্রতিবেশীদের ব্যাপারস্যাপার। দেশের ভেতরকার নদ-নদীর অবস্থা কি? রাজধানীর ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর অবস্থা কি? ঢাকার ভেতরকার খাল-নালাগুলো এখন কোথায়? আশপাশের জলাভূমিগুলো কোথায়? দু’ বছরেরও আগে, ২০০৯ সালের ৮ই এপ্রিল, পরিবেশন দূষণ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে যা উল্লেখ করা হয়েছিল এখনও তা সত্য হয়ে আছে হুবহু। এই দু’ বছরে সরকার অনেক কিছু করেছে, আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে ভূমিকাও রেখেছে ? কিন্তু উন্নতি হয়েছে কতখানি কি? প্রতিবেদনটি এ রকম:“The government over the years has allowed industrialists to pollute the rivers, canals and wetlands in and around the city  to such an extent that surface water turned pitch black in several spots. Pollution has set in on the Buriganga, Shitalakhya and Balu rivers and made it almost impossible to treat the water. The water and Sewerage Authority  (wasa), is supplying stinky water by purifying it with cholorine ammonia sulfate. But most of the industrialists have defeid the directive and the government also did not take action against any of the violators. Even the Department of Environment (DoE) does not know much about it. Besides industry generated liquid and solid waste, most of the human excreta directly goes down the rivers through underground pipelines as nearly 70 percent houses are not connected to the excrete treatment plant. Waste from these industries is connected with the sewerage system that directly goes into tha rivers around the city. In fact, the rivers have become a dumping ground of all kinds of solid, liquid, and chemical waste of bank side population.”
    আমরা সাগর জয় করেছি, কিন্তু এই সব ছোট-ছোট জলা-নালার কাছে হেরে বসে আছি কেন? যখন একের পর এক নদী মরছে, খাল-বিল ভরাট হয়ে যাচ্ছে, আর আমরা কিচ্ছু করতে না পেরে কেবল তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখছি, তখন উৎসাহ পাই না কোনও সাগরজয়ের উৎসবে। কেউ কি পান?

sazzadqadir@gmail.com; sazzadqadir@rediffmail.com; sazzadqadir@yahoo.com; facebook.com/sazpa85

সংবাদশিল্পের সন্ধানে

সংবাদ আমাদের সবসময়ের সঙ্গী। আমরা নিঃশ্বাস নেই সংবাদে, আমরা বাঁচিও সংবাদে। আমাদের জীবন-সংসার চলন বলন ভাবনা সবই সংবাদময়। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত অসংখ্য সংবাদে ডুবে থাকি আমরা সবাই। আমাদের আবেগ আগ্রহ আকাঙক্ষা সবই সংবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমাদের সকলের দেখা শোনা চেনা জানা, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে যা কিছু সবই সংবাদবিজড়িত। যখন কথা বলি বা শুনি - সামনাসামনি বা সেলফোন-টেলিফোনে তখনও আদানপ্রদান করি সংবাদের। তারপর আছে কত শত সংবাদমাধ্যম। রেডিও, টেলিভিশন, ইনটারনেট, সেলফোন, সংবাদপত্র। বাংলাদেশী শ্রোতাদের জন্য সংবাদবিশ্ব উন্মুক্ত হয়ে গেছে তথ্যপ্রযুক্তি প্রসারের সঙ্গে-সঙ্গে। রেডিওতে, এফএম ব্যান্ডে সারা দিনই খবর দেশী-বিদেশী নানা চ্যানেল থেকে। টেলিভিশনেও দেশী-বিদেশী অসংখ্য চ্যানেলে ঘণ্টায়-ঘণ্টায় পরিবেশিত হয় সংবাদ। আর আছে আমাদের দুই শতাব্দী প্রাচীন বিশ্বস্ত সঙ্গী সংবাদপত্র। অডিও-ভিসুয়াল মাধ্যমগুলোর বৈপ্লবিক উৎকর্ষে অনেকেই আশঙ্কা করেছেন, এর আকর্ষণ বুঝি যায়-যায়। কিন্তু সে সব আশঙ্কা অমূলকই প্রমাণিত হয়েছে। সংবাদপত্র স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে আছে এখনও। তাই আমরা সংবাদপত্রের চোখ দিয়ে দেখি, তার কান দিয়ে শুনি, তার বিবরণ থেকে বুঝি, এমনকি কথা বলি ও লিখি তার ভাষায়ই। সংবাদপত্রের আকর্ষণ কতখানি তা একটু মজা করেই লিখেছেন প্রখ্যাত মারকিন সাংবাদিক-সাহিত্যিক হেলেন রাওল্যান্ড (১৮৭৫-১৯৫০) -“Before marriage, a man declares that he would lay down his life to serve you; after marriage, he won't even lay down his newspaper to talk to you.”
    এমন তীব্র আকর্ষণের কারণ সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, ভাস্কর্য প্রভৃতির মতো সংবাদও এক শিল্প। সাহিত্যে যেমন ভাব ভাষা নির্মাণ, সংবাদেও তেমন তথ্য ভাষা উপস্থাপন। এ তিনটি ক্ষেত্রে যিনি যত শিল্পিত তিনি তত কৃতী সাহিত্যিক বা সাংবাদিক। সমস্যা একটিই। সেটা বলেছেন বৃটিশ কবি-সমালোচক ম্যাথু আরনল্ড (১৮২২-১৮৮৮) - "Journalism is literature in a hurry." এই চটজলদি কাজের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সংবাদশিল্প নির্মাণ সহজ নয় কোনও সাংবাদিকেরই পক্ষে। তবে ওই মোকাবেলাটাও এক শিল্প। সে পথে দুই শতকে অনেকখানি পথ হেঁটে এসেছে সংবাদপত্র। তবে আরও পথ হাঁটতে হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। এখন সে হাঁটা-চলা কেমন তা একটু সন্ধান করা যেতে পারে।
    গত ২১শে এপ্রিল একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দিলে চালক পুড়ে মারা যান - এ খবরটি পরদিনের এক পত্রিকায় ছাপা হয়েছে এভাবে:
    “আট বাসে আগুন / চালক জীবন্ত দগ্ধ... বিএনপির সকাল-সন্ধ্যা হরতালের আগের দিন দুর্বৃত্তরা রাজধানীর খিলগাঁও, গুলিস্তান, আবদুল্লাহপুর, আজিমপুর, ভিক্টোরিয়া পার্ক, মিরপুর ও ফার্মগেট এলাকায় ৮টি বাস আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। এ ঘটনাগুলোর মধ্যে খিলগাঁও খিদমাহ হাসপাতালের সামনে বদর আলী বেগ (৪০) নামের এক চালক অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। নিহত বদর আলী ঈগল পরিবহনের একটি বাসের চালক ছিলেন। এছাড়া এসব ঘটনায় ৪জন আহত হয়েছেন। তবে বাসগুলোতে কারা কীভাবে আগুন দিয়েছে তাৎক্ষণিকভাবে তা জানাতে পারে নি পুলিশ বা ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। বাস ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের চেষ্টা চালানোর অভিযোগে ৮জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এছাড়া হরতালের সমর্থনে গতকাল বিকালে রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকায় মিছিল বের করেছে বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। এদিকে বিভিন্নস্থানে বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক প্রায় যানবাহনশূন্য হয়ে পড়ে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন বাড়ি ফেরা সাধারণ মানুষ। উল্লেখ্য, সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীকে ‘গুম’ করেছে - এমন অভিযোগে বিএনপি রবিবার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে।...”
    অন্য এক পত্রিকায় উপস্থাপনা এ রকম:
    “রাজধানীতে ৬ যানবাহনে আগুন / ১ জন নিহত... গতকাল শনিবার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত রাজধানীর ছয়টি স্থানে ছয়টি বাস-মাইক্রোবাসে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়ার ঘটনায় একজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত ব্যক্তির নাম বদর আলী (৪০)। তিনি বাসচালক। গতকাল দুপুর ২টার দিকে খিলগাঁও, আজিমপুর, গুলিস্তান ও উত্তরার আবদুল্লাহপুরে চারটি বাসে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ফকিরাপুলে আগুন দেয়া হয় সরকারি জনপ্রশাসনের এক মাইক্রোবাসে। এর আগে দুপুরে খিলগাঁওয়ে ঈগল পরিবহণের বাসে দেয়া আগুনে বাসটির চালক বদর আলী জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা যান এবং হেলপার মোতালেব আহত হন। ঈগলের বাসটি (যশোর-ব-১১-০০১৯) ঢাকা-খুলনা রুটের। খিদমা হাসপাতালের সামনে ওই বাসটিকে আগুন ধরিয়ে দেয় কয়েকজন যুবক। এ গাড়ির ভেতর থেকেই উদ্ধার করা হয় গাড়িচালক বদরের মৃতদেহ।...”
    অন্য আরেক পত্রিকায় খবরটি এসেছে এভাবে:
    “বাসে আগুন, দগ্ধ হয়ে চালক নিহত... রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় গতকাল দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত আটটি যাত্রীবাহী বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। অগ্নিদগ্ধ হয়ে একটি বাসের চালক নিহত হয়েছেন। দুপুর থেকে একের পর এক বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর রাজধানীতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তাঘাট ফাঁকা হতে শুরু করে। বিশেষ করে রাস্তায় দুপুরের পর থেকে যাত্রীবাহী বাসের সংখ্যা কমে যায়। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় অফিস ফেরত নগরবাসীকে। গতকাল দুপুরের পর থেকে রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়িও কম দেখা গেছে। দুপুরে ।াধ ঘণ্টার ব্যবধানে চারটি বাসে দুর্বৃত্তরা অগ্নিসংযোগ করে। এর মধ্যে খিলগাঁও গভর্নমেন্ট কলোনির সামনে পার্কিং করা বাসে আগুন লাগিয়ে দেয়ায় চালক বদর উদ্দিন (৪০) অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন ওই বাসের চালকের সহকারী আবদুল মোতালেব। কে বা কারা কি কারণে বাসে অগ্নিসংযোগ করেছে, তা নিশ্চিত জানা যায় নি। তবে পুলিশ দাবি করছে, বিএনপি’র ডাকা হরতালকে কেন্দ্র করেই বাসে আগুন লাগিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে।...”
    ইংরেজি একটি পত্রিকায় খবরটি এ রকম:
   “Bus was parked, driver asleep... A driver was burned to death and his assistant suffered injuries as their bus was set alight at the capital's Khilgaon yesterday on the eve of the opposition-called hartal. Nine more buses, including three with passengers, were torched at Mirpur-1 and 10, Baridhara, Azimpur, Abdullahpur Beribadh, Gulistan, Darus Salam, Farmgate and near Bahadur Shah Park, fire brigade officials said. The latest was around 8:15pm. Police identified the ill-fated bus driver as Badar Ali Beg, 48. They took the injured, Abdul Motaleb, 26, to Khilgaon Police Station for interrogation. Motaleb, who suffered burns on his neck and back of his head, told The Daily Star that the two were sleeping on the isle in the afternoon; Motaleb was closer to the doors. Excessive heat woke him up, and seeing fire and smoke, he jumped out of a window. All the doors were locked. For the moment, he had forgotten that Badar was inside, he said. None in the area could say how and by whom the bus was set on fire....”
    কোনও রকম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ছাড়াই আমরা বুঝতে পারি তথ্য, ভাষা ও উপস্থাপনের দিক থেকে প্রকাশিত খবর চারটির শুরু চার রকম। আহরিত ও পরিবেশিত তথ্য প্রায় একই রকম। গাড়িচালকের নাম ও বয়স দু’টি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে ভিন্ন। একটি পত্রিকায় আহত আবদুল মোতালেব অনুল্লিখিত। একটি পত্রিকায় স্থানটি সুনির্দিষ্ট করা হয় নি, অন্যান্য পত্রিকায় সুনির্দিষ্ট করা হলেও ভিন্নতা রয়েছে। একটি খবরে প্রাক-হরতাল বিষয়টির উল্লেখ নেই। অগ্নিসংযোগকারীরা দু’টি পত্রিকায় ‘দুর্বৃত্ত’ হিসেবে উল্লিখিত হলেও একটি পত্রিকায় তাদের উল্লেখ করা হয়েছে স্রেফ ‘যুবক’ হিসেবে। উপস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি পত্রিকায় বাসচালকের জীবন্ত দগ্ধ হওয়ার বিষয়টিই গুরুত্ব পেয়েছে অন্যান্য পত্রিকায় গুরুত্ব পেয়েছে রাজধানীর পরিস্থিতি ও হরতাল প্রসঙ্গ। কোনও উপস্থাপনায়ই মর্মান্তিক ঘটনাটির প্রকৃত বেদনা প্রকাশ পায় নি। ভাষায় ক্রিয়াপদের শুধু কথ্য রূপ দেখা যায়, কিন্তু শব্দচয়নে সাধু ভাষার মিশ্রণই বেশি। বাক্যগঠনেও প্রভাব বেশি সাধুরীতির। সংবাদশিল্পের জন্য আমাদের চাই - অল্প কথায় অধিক বলার দক্ষতা। চাই ছোট-ছোট শব্দে ছোট-ছোট বাক্য।
sazzadqadir@rediffmail.com

বৃহস্পতিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১২

পা পিছলে আলুর দম

‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে / তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে’ - রবীন্দ্রনাথের ‘নৈবেদ্য’ (১৯০১) কাব্যগ্রন্থের ৭০ সংখ্যক কবিতার এই দু’টি পঙ্‌ক্তি সম্ভবত সর্বাধিক উল্লিখিত বাংলা কবিতাংশগুলোর একটি। এ কথারই প্রতিধ্বনি মেলে আরেকটি উদ্ধৃতিতে - ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ন্যায়সংগত’। গত শতকের ষাটের দশকে একটি রাজনৈতিক সংগঠনের স্লোগান ছিল এ উদ্ধৃতিটি। তখন পোসটারে, ব্যানারে, দেয়াল লিখনে দেখা যেতো এ বিদ্রোহের আহবান। শুনেছিলাম উদ্ধৃতিটি চীনের কমিউনিস্ট নেতা মাও চ্যতোং (১৮৯৩-১৯৭৬)-এর। আরেকটি বিখ্যাত উদ্ধৃতি মারকিন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন (১৭৪৩-১৮২৬)-এর - “If a law is unjust, a man is not only right to disobey it, he is obligated to do so.”
গত ৯ই এপ্রিল রাতে পিলখানায় ৭০ লাখ টাকা নিয়ে যে ঘনঘোর নাটকের অবতারণা হয় তাতে এ সব উদ্ধৃতি মনে পড়ছিল বারবার। উদ্ভূত নাটকীয় ঘটনাই প্রমাণ করে ওই টাকার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক অন্যায়। সে প্রমাণ পেয়েই অনুসন্ধানে নামে মিডিয়া। আর খুব দ্রুত বেরিয়ে পড়ে থলের কালো বিড়াল। দেখা যায়  ‘রেলগাড়ি ঝমাঝম... পা পিছলে আলুর দম’ গোছের এক কাহিনী। রেলের ট্রেড অ্যাপ্রেনটিস পদে ১৬ কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্যের এক অংশ ওই ৭০ লাখ টাকা। সে অন্যায়ে বহু পক্ষ জড়িত। নিয়োগদাতা, নিয়োগপ্রার্থী, তদবিরকারী, নিয়োগপ্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও আছেন তাঁরা - যাঁদের না দিয়েথুয়ে বড় দাঁও মেরে  ভূরিভোজ করা যায় না।
     রেল নতুন মন্ত্রণালয়। তাই বলে দুর্নীতির ব্যাপারস্যাপার নতুন নয় এখানে। এ মন্ত্রণালয় আগে ছিল যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অংশ। তখন দুর্নীতি সংক্রান্ত ঘাপলা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পর্যন্ত জানাজানি হওয়ায় পদ্মা সেতুর নির্মাণ হয়ে যায় অনিশ্চিত। এর আগে সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপার নিয়ে ঘটে নানা তুলকালাম। এক দুর্ঘটনায় দু’জন খ্যাতিমান ব্যক্তির প্রাণহানির সূত্রে মিডিয়ায় আসে তাদের সে সব কর্মকা-ের ফিরিস্তি। তবে এসব কি কেবল রেলে বা যোগাযোগে চলছে? অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে এদিক-সেদিক কিছু নেই?
    উপন্যাসের পাঠকরা বা টিভি-নাটকের দর্শকরা জানেন, এখন সবচেয়ে ভাল ফরমুলা হচ্ছে - অস্বাভাবিক লোকজনদের নিয়ে উপন্যাস-নাটক লেখা। নায়ক-নায়িকা, মা-বাবা থেকে কাজের লোক বা বুয়া সবাই কথাবার্তা বলবে অদ্ভুত-অদ্ভুত, কাজকর্ম করবে আরও অদ্ভুত-অদ্ভুত অর্থাৎ উপন্যাস বা নাটকের সকল চরিত্রকে চলনে বলনে হতে হবে পাগলা বা পাগলাটে। তাহলেই উপন্যাস হট কেক, টিভি নাটক সুপার হিট। এ রকম হট বা হিট করার ফরমুলা আগেও ছিল। শরৎচন্দ্রের উপন্যাস যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন - ‘পল্লীসমাজ’-এ সবাই খারাপ, কেবল ‘রমা’ ও ‘রমেশ’ ভাল। কথাটির অর্থ, উপন্যাসে শরৎচন্দ্র  সমাজের শতেক দোষ-ত্রুটি দেখালেও নায়ক ও নায়িকাকে রাখতেন প্রায় দেবোপম নিষ্কলঙ্ক। বাস্তবে এমন তো হতে পারে না। কোনও সমাজে মাত্র দু’জন ভাল লোক থাকতে পারে না, যদি ৯৮ জন মানুষ খারাপ হয়। সে রকম কেবল রেল-যোগাযোগ খারাপ আর বাকি সকল মন্ত্রণালয় ভাল - এমন হতে পারে কি? কিন্তু সবার উপরে রাজনীতি। তাই বলছি, সকল শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে ৭০ লাখ হতে পারে সাদা বিড়াল। সে ম্যাঁও শোনা গেছে এরই মধ্যে। আমার প্রিয় কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই কবে লিখেছেন - “রূপসী তুই রাজনীতি, দিস্‌ ছেলে-ছোকরাদের মাথা ঘুরিয়ে; কিন্তু বুড়ো শয়তানদের সঙ্গে থাকিস্‌ রাত্রে শুয়ে।” তাহলে এই নোংরা রাজনীতি ঠেকাবার উপায় কি? একটাই উপায়। বাঁচার রাজনীতি।
sazzadqadir@yahoo.com

বৃহস্পতিবার, ১২ এপ্রিল, ২০১২

কোটি-কোটি কাঠখরচ

ম্যাটরিকুলেশন, সংক্ষেপে ‘ম্যাটরিক’, পরীক্ষা চালু করেছিল ব্রিটিশ রাজ, এর সমাপ্তি ঘটে ১৯৬২ সালে। আমার মনে আছে, কারণ এ পরীক্ষা আমি দিয়েছিলাম ওই বছর। এর পর, ১৯৬৩ সাল থেকে, চালু হয় সেকেন্ডারি স্কুল সারটিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষা। কেটে গেছে প্রায় ৫০ বছর, কিন্তু এখনও সবার মুখে-মুখে চালু আছে ম্যাটরিক পরীক্ষা, এসএসসি কথাটা আর মুখে আসে না কারও। এ রকম অনেক কিছুই বদলে গেছে, কিন্তু আগেরটাই আঁকড়ে ধরে আছি আমরা। নতুনের প্রতি নেতি আর পুরনোর প্রতি প্রীতি কি আমাদের জাতীয় রক্ষণশীলতারই এক বৈশিষ্ট্য? মারকিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩২তম প্রেসিডেন্ট (১৯৩৩-১৯৪৫) ফ্রাঙ্কলিন ডিলানো রুজভেল্ট (১৮৮২-১৯৪৫) বলেছেন, রক্ষণশীলদের পা দু’টো থাকে চমৎকার ? তবে তারা সামনের দিকে চলা শেখে না কখনও। সম্ভবত এ জন্যই ভাষা-ভাষা বলে প্রাণ দিলেও বানান শিখি না, শেখার চেষ্টাও করি না। প্রমিত বানান তো নয়ই। ও সব জানতেও চাই না। ‘ঘুষ’ বানানটি যে ‘ঘুস’ হওয়া উচিত তা বলা হয়েছে অনেক আগে। হিন্দি ‘ঘুস’ থেকে আসা এ অ-তৎসম বিদেশী শব্দের বানান বাংলায় ‘ঘুস’ হওয়ারই কথা। বাংলা একাডেমীর ‘বাংলা বানান-অভিধান’ (পুনর্মুদ্রণ, ১৯৯৫) এ বানানটিই নির্দেশ করেছে, কোনও বিকল্প দেয় নি। তবে ঘুষের সঙ্গে ঘুষাঘুষির একটা ব্যাপার আছে বলেই হয়তো হিন্দি ‘ঘুস’ বাংলায় হয়ে গেছে ‘ঘুষ’। তবে ওই অভিধানে ‘ঘুষি’ ও ‘ঘুষাঘুষি’ও  বিকল্পহীন ‘ঘুসি’ ও ‘ঘুসাঘুসি’। তবে বানান যা-ই হোক ঘুষের অনেক কদর সমাজে। ভাষাতেও। তাই কত নামে ঘুষকে ডাকি আমরা ? উৎকোচ, উপরি, বখশিশ, সেলামি, টু-পাইস, হাতটান, লেনদেন, বাঁ হাতের কামাই, খুশি করা, প্রণোদনা, নজরানা, রিসওয়াত, গোপন পারিতোষিক, গেটিস...! ইংরেজদের কাছেও এর কদর অনেক। ওদের ভাষাতেও অনেক নাম ? " tip, gift, sop, perk, skim, favor, discount, waived fee/ticket, free food, free ad, free trip, free tickets, sweetheart deal, kickback/payback, funding, inflated sale of an object or property, lucrative contract, donation, campaign contribution, fundraiser, sponsorship/backing, higher paying job, stock options, secret commission, or promotion (rise of position/rank)...! "আরও অনেক রকম ঘুষ আছে। মারকিন নাট্যকার থর্নটন ওয়াইল্ডার (১৮৯৭-১৯৭৫) বলেছেন, বিয়েটাও ঘুষ। এ ঘুষ পেলে বাঁদী নিজেকে বেগম ভাবে।
    তবে ঘুষ নিয়ে সামপ্রতিক এক ঘুষাঘুষি জাতীয় ঘটনার খবর জেনেই এত সব কথা বললাম। রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুক তালুকদারের গাড়ি থেকে ৭০ লাখ টাকা উদ্ধার হয়েছে গাড়িচালক আলী আজমের আকস্মিক তৎপরতায়। গাড়িতে আরও ছিলেন পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা ও রেলওয়ে পুলিশের কমান্ডেন্ট এনামুল হক। ১৬ কোটি টাকার ঘুষ-বাণিজ্যের একটা ভাগ ওই টাকা। ধরা পড়ার পর ঘুষের টাকা ভাগ-বাটোয়ারার নানা কাহিনী ফাঁস হয়ে পড়ছে মিডিয়ায়।  এ দেশে এ সব ওপেন সিকরেট। তারপরও এমন ঘটনা যে কেন ঘটে! আসলে ঘুষ জিনিসটা দিয়ে-থুয়ে খাওয়াই ভাল। তা করলে গাড়িচালক আজমকে হজম করা কঠিন হতো না কিছু। রাজনীতি অত্যন্ত ব্যয়বহুল এখন। নেতা হতে, মন্ত্রী-এমপি হতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় মানে কাঠখরচ করতে হয়। দলের সদস্য হওয়া, তারপর পদ পাওয়া, নির্বাচনে মনোনয়ন জোটানো, জিতে এমপি হওয়া, মন্ত্রীত্ব বাগানো ? এগুলো সহজ কম্ম নয়। কোটি-কোটি-কোটি কাঠখরচ। সেগুলো আসে কোত্থেকে? আসবে কোত্থেকে? রাজনীতিতে টাকা তো এভাবেই আসে। আর কোনও ভাবে আসে নাকি?

sazzadqadir@rediffmail.com

বুধবার, ১১ এপ্রিল, ২০১২

সাযযাদ কাদিরের কবিতায় দেশবোধ

সালমান ফরিদ
কালের সীমানা ছাড়িয়ে কবিতা হয় না। কবিতার জন্য প্রয়োজন সময়, মাটি, মানুষ ও প্রকৃতি। এগুলোর ভেতরেই তামাম কবিতার উপকরণ। বিশ্বসভার কবিদের কাব্যে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোড়িত তা হলো ? সময় ও মানুষ। আর এগুলোর সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবেই এসেছে অন্যান্য উপকরণ। এসেছে মাটির কথা। এসেছে প্রকৃতির কথা। অতিপ্রাকৃতিক বিষয়ও ঢুকেছে এখানে। তখন কারও-কারও কবিতায় দেখা গেছে ঐশ্বরিক প্রবণতা। এটা বিশেষ যত্ন পেয়েছে নানা কারণে। যত্ন পেয়েছে দেশবোধও। অবশ্য দেশমাতৃকাকে নিয়ে সব দেশে সমান ভাবে কবিতাচর্চা হয়নি। এটি নিদের্শিত হয়েছে প্রকৃতি ও পরিবেশগত কারণে। বাংলা কবিতায় যেভাবে দেশ ও প্রকৃতির কথা এসেছে সেভাবে ইংরেজি, আরবি, গ্রিক কিংবা অন্য অনেক ভাষার কবিতায় দেখা যায় নি। কারণ চার ঋতু, মরুর প্রকৃতি আর এখানকার পরিবেশ আলাদা করে দিয়েছে ভাবনা ও উপকরণকে। এই আঙ্গিকটা নির্ণীত হয়েছে মূলত আবহাওয়া ও পরিবেশের কারণে। যে জন্য আমাদের বাংলা কবিতায় যতটা আছে মাটি, গাছপালা, লতাপাতা, পানি, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, বর্ষা, শীত প্রভৃতি, আরবি বা অন্যান্য কবিতায় ততটাই আছে অদৃশ্য সত্তার উপকরণ। আছে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার প্রবণতা সেই সত্তায়। আছে দেব-দেবী। তথা নিয়তিবাদ। সাহিত্যের সব শাখায়ই এর ছাপ বিদ্যমান। কেবল ব্যতিক্রম বাংলা কবিতা। এখানে মিশ্রণ হয়েছে সবগুলো দৃশ্যপটের। এটি অবশ্য প্রাচীন যুগ কিংবা মধ্য যুগ থেকে পুরোপুরি ভাবে নয়। মধ্যযুগে কিঞ্চিৎ দেখা গেলেও প্রয়োগ হয়েছে বেশি আধুনিক ও উত্তর-আধুনিক যুগে এসে। বাংলা কবিতাকে বেশি আলোড়িত করার কারণ দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে লেগে থাকা নানাবিধ আন্দোলন। বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, নব্বই’র স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন কবিতাকে করেছে মানুষ, মাটি ও সময়ের সঙ্গে আরও একীভূত। এর আগে দীর্ঘ দু’ শ’ বছর ইংরেজ শাসনে ক্রমে-ক্রমে কবিতা ও সাহিত্যের অন্যান্য সৌন্দর্যে গভীর ভাবে আকৃষ্ট হয়েছে দেশবোধ। এগুলো বাংলা কবিতাকে করেছে স্বতন্ত্র এবং আলাদা ভাবে মর্যাদাবান। এই স্বতন্ত্রেরই একটি ব্যক্তিমানস সাযযাদ কাদির। বাংলা কবিতাকে তিনি আলোকিত করছেন মেধা ও শব্দশিল্পের জোরে। তাঁর কবিতায় প্রজ্ঞার ছাপ স্পষ্ট। সহজ কথায় তিনি বলেন। সরল ভাবে দেখান পথ। ফলে তার বর্ণনা রসবোধে আপ্লুত হয়ে ওঠে। শব্দে-শব্দে হৃদয়নিংড়ানো ভালবাসা। আছে স্বপ্ন ও বাস্তবতা। কখনও অর্জন করেন। কখনও করেন না। যখন করেন তখন টিকিয়ে রাখার মন্ত্র খোঁজেন। আর বঞ্চিত হন যখন, তখন না পাওয়ার যন্ত্রণায় ব্যথিত হন। তার কবিতায় দেশ ও মানবতাবোধ প্রবল। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ আর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন তাঁকে প্রভাবিত করেছে ভীষণ ভাবে। তাই তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে নিজেই একটি আন্দোলন। কবিতায় আয়োজন করেছেন মিছিল-সমাবেশের। জাগিয়ে দিয়েছেন আরেকটি স্বপ্নে ?  করেছেন প্রতিবাদমুখর নীরব এ কাশবনকে।
তখন দেখবে রাজপথে-রাজপথে মিছিল
শুনবে মিছিলে-মিছিলে আকাশ কাঁপানো স্লোগান।
দেখবে সভায়-সভায় শপথ, পথে-পথে মোকাবেলা
তারপর তুমি আর কখনও আপস শিখবে না, ভাঙবে না
(‘উত্তরাধিকার’)
এসবই হয়েছে তাঁর উত্তরাধিকার তত্ত্বে। ইতিহাসকে আশ্রয় করে তিনি বলেছেন। ভাষার ভেতর নিয়ে এসেছেন বাংলাদেশ। প্রেরণা হয়ে উঠেছে বিদ্রোহ আর বিপ্লবের। যে বিপ্লবের কথা শোনা হয়েছে জাতীয় কবির মুখ থেকে। রুখে দাঁড়ানোর অঙ্গীকারে কবি একেবারেই নির্ভেজাল।
অবশ্য এই প্রতিবাদী হয়ে ওঠার পেছনে যথেষ্ট কারণও আছে। ক্ষোভ আছে ভেতরে। যা তাঁকে তাড়িয়েছে সত্য ও সুন্দরের জন্য। ভালভাবে বেঁচে থাকার জন্য। কতিপয়দের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ তাঁর এ ক্ষোভ বাড়িয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা কঠিন কিংবা তার স্বাদ না পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাঁকে আরেকবার প্রশ্ন করতে উদ্বুদ্ধ করেছে-
তারপর ওই হাতে কি তুমি পরাজয় লিখবে?
(‘উত্তরাধিকার’)
কবির এই সন্দেহটাই যেন বাস্তবতায় শুদ্ধ। সাযযাদ কাদির কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন সাম্প্রতিক ইতিহাসকে। ঐতিহ্যের আশ্রয়ে তিনি পিপাসা মিটিয়েছেন। আবার ইতিহাস বিকৃতির অলীক সত্যকেও জানিয়েছেন বাস্তবিক ব্যাকরণে। উচ্চারণ করেছেন, রাজনীতিকের হাতে ইতিহাসের ‘ইচ্ছা পূরণের শৌখিন বিলাসিতায় পরিণত হওয়াকে’। ইতিহাস নিয়ে তাদের মর্জিটাও বিস্তর প্রাধান্য পেয়েছে। আর সত্যিকার অর্থে এটাই দেখছে এ প্রজন্মের নাগরিকেরা।
তিনি কবিতায় শব্দ ও ভাষার প্রয়োগে বরাবরই নিজস্ব। অত্যন্ত সহজ সরল ভাবে কথামালাকে কবিতা বানিয়ে পাঠকের মুখে-মুখে পৌঁছে দেয়ায় পরীক্ষিত সফলতা পেয়েছেন। আর যে ভাষায় তিনি এভাবে পাঠকের কাছে স্বতন্ত্র কবিসত্তায় পরিণত হয়েছেন সেই ভাষাকে বিলিয়ে দিয়েছেন সর্বত্র। আটকে রাখেন নি পাঠশালার বইয়ে অথবা বায়ান্ন’র ঐতিহাসিক কোঠায়। ছড়িয়েছেন এখানে-ওখানে ?
তুমি আমার শহিদ মিনার,
আমার বাংলা বিভাগ, আমার দৈনিক বাংলা,
আমার মুনীর অপটিমা, আমার বিজয়লিপি
আমার বইমেলা, আমার বৈশাখি মেলা
তুমি আমার বাংলা,
তোমাকে আমি ভালবাসি।
(‘বাংলাভাষা, তুমি’)
একই ভাবে বইয়ের পুঁথিগত অধ্যায়েও সীমাবদ্ধ রাখেন নি। ‘যারা কম্পিউটার, ইন্টারনেট ইত্যাদির পরিভাষা খুঁজে হদ্দ হয়’ তাদের কাছেও বাংলা ভাষাকে তুলে দিয়েছেন। এদের কাছে ছড়িয়ে দিয়ে হতাশও হয়েছেন এক অর্থে। ভাষায় সঠিক প্রয়োগের অভাবে চারদিকে ভাষা নিয়ে অবক্ষয় চলছে। বানান নিয়ে চলছে আরেক তুলকালাম কাণ্ড।  ভুল বানান লিখেও নিজের দোষ আড়াল করেন কেউ-কেউ। এ নিয়ে রসিকতা করেছেন বিস্তর। তিনি তাদের জবাবটা দিয়েছেন তাদের মুখেই ? ‘আমি ওই রকমই লিখি’ বলে।
দেশকে তিনি কবিতার সৌন্দর্যের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বাংলাদেশের প্রকৃতি ও পরিবেশ কবিতায় যেভাবে ফুটে উঠেছে তাতে তার বৈশিষ্ট নির্ণীত হয়েছে পরিবেশের আবর্তে। যা বলেছি শুরুতেই। সাযযাদ কাদির তাঁর কবিতায় সেই কথাটিই প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাংলার রূপ উঠে এসেছে কবিতার ভাঁজে-ভাঁজে। সৌন্দর্য আরও সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়েছে কবিতার কল্যাণে। লাবণ্য পেয়েছে ভাষার মাধুর্যে। কিন্তু কিভাবে এটা সম্ভব হলো? তাঁর উপকরণ একেবারে তিলোত্তমা অপরূপা বাংলার কোনও না কোনও প্রান্তে থাকা প্রজ্ঞাবান সত্তার মস্তিষ্কজাত! ফলে সৌন্দর্যের মাঝে কবিতা আর বাংলাদেশ একাকার হয়ে গেছে। বাংলার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে বাংলা কবিতা। কবি সে কথাটাই বলেছেন এভাবে ?
বাংলা কবিতা এই বাংলার মতোই
(‘বাংলা কবিতা’)
তাঁর কবিতায় অপরূপ রমণী থেকে শুরু করে রাখাল বালকের কথা মেলে। মেলে কৃষক-শ্রমিকের কথা। আছে সুন্দরীর খোঁপায় ফুলের মালা গুঁজে দেয়ার দৃশ্যও। আকুল-ব্যাকুল হওয়া বাঁশির শব্দ বেজে ওঠে বারবার। আছে সন্তানহারা মায়ের আর্তনাদ। বাবার কথা। বলেছেন একাত্তরে সন্তান হারিয়ে কিভাবে বুক চাপড়ে মা মর্সিয়া করেছে। সেই মা, সেই বাবা, সেই বোন, সেই ভাই ? তাদের কান্নার সঙ্গে কেঁদেছে এই বাংলার নদী। সে-ও মূর্ছা গেছে পরিজনের মতো করে। সংজ্ঞাহীন হয়েছে বাংলার প্রতিটি গ্রাম-প্রান্তর। এই বাণী পৌঁছে দিয়েছেন নতুন প্রজন্মের কাছে।
তাঁর কবিতার শব্দগুচ্ছে আছে বিদ্রোহ। যে বিদ্রোহ বাংলা কবিতাকে করেছে মহিমান্বিত। এখন যে প্রতিবাদ করে কিছু হয় না তা বলেছেন। কি করতে হবে তাহলে? সঙ্গে-সঙ্গে দিয়েছেন সেই সমাধানও। বলেছেন, করতে হবে আঘাত। কাপুরুষের মতো বসে না থেকে অল্প শক্তি দিয়ে আঘাত করার মাঝে তিনি বীরত্বের সন্ধান দিয়েছেন। এক্ষেত্রে উদাহরণ হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার ইরাক, আফগানিস্তান আক্রমণের বিষয়টি। সেখানে অল্পশক্তির প্রতিরোধ তাকে শক্তি যুগিয়েছে। ‘আমি প্রতিবাদ করি না/আঘাত করি।’ তার এই ‘আমি’ হলো তামাম পৃথিবীর নির্যাতিত মানুষ। যারা এখন প্রতিবাদ করা ভুলে রুখে দাঁড়াচ্ছে। মৃত্যুর সারি বাড়িয়ে তারা আঘাত করছে বিশ্ববিবেক ও সভ্যতায়। ইতিহাসের বুকে আঘাত করে প্রতীকী ‘আমি’ হয়েছেন কবি। এর মাধ্যমে মাথা নত না করার অঙ্গীকার জানিয়েছেন। আর বাংলাদেশের জন্য তিনি প্রতিবাদের ভাষা হিসাবে বেছে নিয়েছেন কবিতাকে ?
বিদেশী ঠাকুর মানে না, ভিখারি রাঘবে ডরায় না।
যারা নিভিয়ে দেয় আলো, বিষিয়ে দেয় বায়ু
তাদের ক্ষমা করে না বাংলা কবিতা
(‘বাংলা কবিতা’)
কবি মুক্তিযুদ্ধ থেকে উপকরণ নিয়েছেন তাঁর কবিতার। শব্দের শিল্প মার্জিত করেছেন মাটির ভালবাসা ছুঁইয়ে। সর্বত্রই মাটি ও মানুষের ছায়া। বাংলাদেশ নামের এক খণ্ড ভূমির মালিকানা পেতে একাত্তরের জন্ম। আর সেই একাত্তর এখন মিশে আছে এই মাটির গন্ধে। পরতে-পরতে লেগে আছে তার ছোঁয়া। সেটিই প্রকাশ করেন কবিতায় ?
যেখানে পাতবে কান
শুনবে সেখানে
অবিনাশী তানে
একাত্তরের গান।
(‘একাত্তরের গান’)
স্বকীয় কবি সত্তায় সাযযাদ কাদিরকে আবিষ্কার করেন বিদগ্ধজনেরা। লিখেন তিনি সম্পূর্ণ আলাদা মেজাজ ও ভঙ্গিতে। নতুন রীতি মনে না হলেও অনেকটা নতুন করেই বলা হয়। পাঠকরা তাই সহজে তার কবিতা আলাদা করতে পারেন এই স্বকীয়তার গুণে। দেশাত্মবোধক কবিতার ক্ষেত্রেও এটির যথাযথ প্রতিফলন দেখিয়েছেন। আবার সমকালীন কবিতাকে যে একেবারে এড়িয়ে গেছেন, তা-ও কিন্তু নয়। বাংলা ভাষার আকার ও সৌবর্ণ খুঁজতে গিয়ে শামসুর রাহমানের ঐতিহ্য মেনেছেন। তাঁর মতো করে একেবারে সহজ ভাবে বাংলা ভাষার ব্যাখ্যা দিয়েছেন ?
বাংলা ভাষা
তুমি হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতা
তুমি আলতাফ মাহমুদের গান
তুমি জহির রায়হানের কথাছবি
(‘বাংলাভাষা, তুমি’)
এই মুহূর্তে বাংলা সাহিত্যে শীর্ষ কবিদের একজন সাযযাদ কাদির। পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠা এই কবির গুণই হচ্ছে প্রাণবন্ত করে বলার দক্ষতা ও ক্ষমতা। আর শব্দের সহজ সরলতা। প্রেম-রোমান্স, মানবিক সৌন্দর্য আর জীবনঘনিষ্ঠতা সব দিকই সমান ভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। জীবনানন্দ দাশ যেখানে বনলতা সেনের চুল আর শ্রাবস্তীর কারুকাজে কিংবা বিদর্ভ নগরীতে খুঁজেছেন তাঁর সুখ ? সাযযাদ কাদির এখানে হয়েছেন একেবারেই আলাদা। চণ্ডীদাস থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, উইলিয়াম কেরি থেকে হ্যারি কে টমাস, লি ইউয়ানশানের কাছে ভবিষ্যতের জন্য ভালবাসা খুঁজেছেন। এ ভালবাসা দেশমাতৃকার জন্য। প্রেম-ভালবাসা সিক্ত হয়েছে এই সব কবিতার একেকটি লাইনে। মানব মনের অব্যক্ত কথা প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রেমের কবিতায়। আর দেশাত্মবোধক কবিতায় মুগ্ধ হয়েছেন নিখুঁত দেশপ্রেমে।

সালমান ফরিদ: কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক

সোমবার, ৯ এপ্রিল, ২০১২

বৈশাখে ওই শাখে...

বৈশাখ এলে মনে পড়ে আমার সাত-আট বছর বয়সের জীবনটাকে। ওই জীবনে আমাদের বাড়ির, গাঁয়ের বাড়ির আর মামার বাড়ির সবাই ছিলেন আমার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের আদেশ-উপদেশ মেনে চলার পাশাপাশি তাঁদের নজর এড়িয়েও চলেছি অনেক। সেই এড়িয়ে চলার জীবনটাতেই ছিল যত মজা। কিন্তু কেমন ছিল সেই গ্রীষ্মতপ্ত বৈশাখের দিনগুলি? সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২)-এর কবিতা থেকে উদ্ধৃত করে দিই এর জবাব:
    “বৈশাখে খরতাপে মূর্চ্ছাগত গ্রাম,
    ফিরিছে মন্থর বায়ু পাতায় পাতায়;
    মেতেছে আমের মাছি, পেকে ওঠে আম,
    মেতেছে ছেলের দল পাড়ায় পাড়ায়।
    সশব্দে বাঁশের নামে শির, ?
    শব্দ করি’ ওঠে পুনরায়;
    শিশুদল আতঙ্কে অস্থির,
    পথ ছাড়ি’ ছুটিয়া পালায়।
    স্তব্ধ হয়ে সারা গ্রাম রহে ক্ষণকাল,
    রৌদ্রের বিষম ঝাঁজে শুষ্ক ডোবা ফাটে;
    বাগানে পশিছে গাভী, ঘুমায় রাখাল,
    বটের শীতল ছায়ে বেলা তার কাটে।
    পাতা উড়ে ঠেকে গিয়ে আলে,
    কাক বসে দড়িতে কুয়ার;
    তন্দ্রা ফেরে মহালে মহালে,
    ঘরে ঘরে ভেজানো দুয়ার।” (‘গ্রীষ্ম-চিত্র’)
আমাদের বাড়ি টাঙ্গাইল শহরে, গাঁয়ের বাড়ি দেলদুয়ারে, মামার বাড়ি মিরের বেতকায়। শহর থেকে দক্ষিণ-পুবে দেলদুয়ার ১২ কিলোমিটার দূরে। মিরের বেতকা-ও দক্ষিণ-পুবে। তবে শহরের উপকণ্ঠে, দূরত্ব মাত্র তিন কিলোমিটার। তখনও যমুনা নদীকে শাসাতে বন্যারক্ষা বাঁধ হয় নি, আমরা ছ’ মাস শুকনায় আর ছ’ মাস ডুবে থাকতাম। দেলদুয়ার-মিরের বেতকা শুকনা কালে যেতাম টমটমে, আর বর্ষা কালে যেতাম নৌকায়। আমাদের ঘুম-ঘুম শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যেতো লৌহজঙ্গ নদী। বর্ষায় ফুলেফেঁপে উঠলেও বৈশাখে সত্যিই হাঁটুজল নিয়ে হয়ে পড়তো আঁকেবাঁকে বয়ে চলা ছোট নদী।
    সেই সময়ে আমার জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ ছিল আমাদের বিন্দুবাসিনী স্কুল, আর আমাদের আকুরটাকুর পাড়া। বৈশাখ এলে আমরা স্কুলে পেতাম সামার ভ্যাকেশন অর্থাৎ গ্রীষ্মের ছুটি, আর পাড়ায় পেতাম একে-একে কয়েকটি মেলা। পাড়ার সবচেয়ে বড় মেলা ছিল, এখনও আছে, মদনার মায়ের মেলা বা মদনার মেলা। সেই মদনা বা মদনার মা কে ছিলেন তা জানতে পারি নি অনেককে জিজ্ঞেস করেও, তবে ছোট কালীবাড়ি নামে পরিচিত পূজাবাড়িকে ঘিরে ছিল যাবতীয় আয়োজন। পাড়ায় আমাদের বাড়ির লাগোয়া কোকিলার বাড়িকে ঘিরে ছিল বুড়ির মেলা। সে মেলা নেই এখন। কোকিলারাও নেই। পাশের পাড়া সাবালিয়ায় হরি পাগলার মেলা হয় এখনও। এই তিন মেলাকে নিয়ে ছিল আমাদের সারা বছরের নানা আগ্রহ-উদ্দীপনা। মদনার মায়ের মেলা হয় বৈশাখের প্রথম রবিবারে, হরি পাগলার মেলা পরের রবিবারে। বুড়ির মেলা হতো আরও পরে। তবে আমার মেলা উদযাপন শুরু হতো বৈশাখের আগেই, চৈত্রের শেষে। মামাবাড়ি মিরের বেতকার দক্ষিণে নদীপাড়ের গাঁ গাড়াইলে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা দিয়ে উদ্বোধন হতো আমার এবং আমাদের গোটা এলাকার গ্রীষ্ম-উৎসবের।
    মেলায় কি-কি কিনতে হবে আর কি-কি খেতে হবে তার একটি ফর্দ ছিল আমার। ওই ফর্দের প্রথমেই ছিল ছুরি। কামারের কাছ থেকে কিনতাম ওই ছোট্ট ছুরি কাঁচা আম কেটে খাওয়ার জন্য। নুন-মরিচ মাখিয়ে সে কাঁচা আম খাওয়ার স্বাদই ছিল অন্য রকম।
    আহা, পাড়ায় কত আম গাছ তখন! ঝড়ের সময় কুড়াতাম সে সব গাছের আম। অনেক গাছে ঢিল ছুড়তাম, অনেক গাছে চড়ে বসতাম ভর দুপুরবেলা - বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে থাকতো তখন। কিচ্ছুটি টের পেতো না কেউ। যারা টের পেতো তাদের কেউ-কেউ ঝগড়ার মতো ভাব দেখিয়ে প্রশ্রয়ই দিতো! সেই চিনু, কণা, রেখা, সারা, চায়না, জাপু, দীপু... ওরা এখন কে যে কোথায়! সেই আমগাছগুলির দু’টি-একটি দাঁড়িয়ে আছে এখনও। তবে আমি মনে রেখেছি সব ক’টি গাছকেই। মনে রেখেছি সে সব গাছের আমের রঙ, স্বাদ, ঘ্রাণকেও।
    ফর্দের দ্বিতীয় স্থানে পতং। মানে ঘুড়ি। ঠিকমতো ওড়াতে পারতাম না, কিন্তু আমার বেশ মাতামাতি ছিল ঘুড়ি নিয়ে। সুতায় মাঞ্জা দিয়ে কাট্টি-ও খেলেছি অনেক। তখন পাড়ায় খোলামেলা জায়গা ছিল কত! বিকালে ঘুড়ি বা চঙ ওড়াতে-ওড়াতে যেতাম খেলার মাঠে। সেখানে ঘুড়িকে তার মতো উড়তে দিয়ে আমার মেতে উঠতাম গোল্লাছুট, লবণদাঁড়ি, হাডুডু, জামবুরা বল খেলায়...!
    এরপর ফর্দে নাম মারবেলের। তখন কি নেশাই যে ছিল এ খেলার! তাই কত রকমের রঙিন কাচের কত মারবেল যে কিনতাম! সানি মারবেলও কিনতাম বেশি দাম দিয়ে। খেলতে-খেলতে ক্ষত-বিক্ষত হতো অনেক মারবেল। সেগুলোকে ব্যবহার করতাম বাঁটুল বা গুলতির গুলি হিসেবে। ভাবতাম, বড় হয়ে যখন চাকরি করবো বাবার মতো, আয়-উপার্জন করবো, তখন কিনবো সব রকমের মারবেল।
    বন্ধুদের নিয়ে মেলায় নানা রকম মিষ্টি খাওয়া ছিল আরেক মজার ব্যাপার। দু’ রকমের মিষ্টি তখনও ছিল। গুড়ের মিষ্টি আর চিনির মিষ্টি। কোন-কোন মিষ্টি গুড়ের হলে বেশি মজা হয়, কোনগুলো আবার চিনি ছাড়া ভাবা যায় না - তা নিয়ে জব্বর তর্ক বাঁধতো আমাদের মধ্যে। তাহলেও মেলায় গিয়ে দু’ রকমেরই জিলিপি, কদমা, বাতাসা খেতাম আমরা। হাওয়াই মিঠাই-ও ছিল আরেক আকর্ষণ। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখতাম হাওয়াই মিঠাই বানানো। তারপর এক আনায় তিনটি মিঠাই খাওয়ার মজা... সে কি ভোলা যায়! এছাড়া বোঁদে, শনপাপড়ি, নৈ টানা, বাদাম টানা, ঝাল চানাচুর... এসব খাওয়ারও ছিল ধুম।
    মেলা শেষ হয়ে যেতো সন্ধ্যার পর-পরই। তারপর বন্ধুরা সবাই মিলে সুযোগ খুঁজতাম ছবি দেখার। শহরে তখন একটাই প্রেক্ষাগৃহ - কালী সিনেমা। আসলে টিনের গুদামঘর একটা। ছবি চলে ভটভট ডায়নামো’য়। রিল ঘোরাতে হয় হাতে। ফ্যান নেই। গরমে পুরো ঘর পরিণত হয় এক চুল্লিতে। ছবি দেখার কোনও মজাই থাকে না তখন। থাকতে পারেই না। তারপরও সে মজা পেতে যারা ওই চুল্ল্লিতে সেদ্ধ হন তারাই হন আসল মজার ব্যাপার। গরমে ভাজা-ভাজা, ঘামে জবজবা, প্রায় উদোম ওই দর্শকদের পাগলা-পাগলা চেহারা এখনও ভাসে চোখে।
    চৈত-বৈশাখে তাই দর্শক জুটতো না কালী সিনেমার। তাঁরা কনসেশন রেটে ছবি দেখাতেন তখন। এক টিকেটে দুই ছবি... তিন ছবি... চার ছবিও দেখাতেন। সন্ধ্যার পর মেলার শেষে আমরা সব জুটতাম তাই কম পয়সায় বেশি ছবি দেখার আশায়... গরমে পুড়ে আর ঘামে ভিজে সেদ্ধ হতে-হতে প্রায় দিগম্বর হওয়ার উল্ল্লাসে মেতে উঠতে। কিন্তু ছবি কি সহজে শুরু হয়? দর্শক জোটাবার আশায় ন’টা-সাড়ে ন’টা পর্যন্ত মাইকে ফিট করা গানের কলে বাজতেই থাকে হেমন্ত, তালাত, শ্যামল, সতীনাথ, ধনঞ্জয়, মান্না, দ্বিজেন, তরুণ, সুবীর, লতা, সন্ধ্যা, গীতা, আশা প্রমুখের পাশাপাশি অধুনা প্রায় বিস্মৃত অখিলবন্ধু ঘোষ, শৈলেন মুখোপাধ্যায়, মৃণাল চক্রবর্তী, সনৎ সিংহ, দীপক মৈত্র, অপরেশ লাহিড়ী, গায়ত্রী বসু, উৎপলা সেন, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, বাণী ঘোষাল, ইলা বসু, মাধুরী চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের গান। ‘নেভার অন সানডে’ গানের সুরে অপরেশ লাহিড়ীর গাওয়া “বৈশাখে ওই শাখে ওই ডাকে কোন পাখি হায়... যৌবন মৌবনে মৌমাছি ডাক দিয়ে যায়...” গানটি খুব জনপ্রিয় ছিল তখন। (স্মৃতি থেকে উদ্ধৃত করলাম, একটু ভুল থেকে গেল হয়তো।) লাগাতার শেষ হয়ে ছবি শুরু হওয়ার পর গায়ক-গায়িকাদের পর কত অপরূপ হয়ে ওঠেন নায়ক-নায়িকারা। অসিতবরণ, বিকাশ, উত্তম, বসন্ত, সন্ধ্যারানী, সুচিত্রা, সাবিত্রী, সুপ্রিয়া প্রমুখের পাশাপাশি অধুনা বিস্মৃত নায়ক-নায়িকা রবীন মজুমদার (‘অরক্ষণীয়া, ১৯৪৮), রাধামোহন ভট্টাচার্য (‘ভুলি নাই’, ১৯৪৮), জহর গাঙ্গুলি (‘সঙ্কল্প’, ১৯৪৯), মলয়া সরকার (‘কঙ্কাল’, ১৯৫০), মঞ্জু দে (‘জিঘাংসা’, ১৯৫১), স্মৃতিরেখা বিশ্বাস (‘আবু হোসেন’, ১৯৫২),  প্রণতি ঘোষ (‘পাত্রী চাই’, ১৯৫২), দেবযানী (‘সীতার পাতাল প্রবেশ’, ১৯৫৩), ধীরাজ ভট্টাচার্য (‘মরণের পরে’), নীতিশ মুখোপাধ্যায় (‘রাইকমল’, ১৯৫৫)...
    এখন অত মধুর গান শুনি না, অত মুগ্ধকর অভিনয় দেখি না! তবে সেই খরতর বৈশাখ এখনও আছে ? যেমন ছিল কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮২১-১৮৫৯)-এর কালে ?
    “..প্রভাকর ভয়ঙ্কর খরতর তাপ্‌।
    ছাতি ফাটে প্রাণ যায় বাপ্‌রে বাপ্‌ ॥...
    পৃথিবীর কোন সুখ মনে নাহি ধরে।
    নিষ্ঠুর নিদাঘে প্রাণ ছটফট করে ॥
    অচল সবল যত বল বুদ্ধি হরে।
    নিদ্রা নাহি করে বাস নয়নের ঘরে ॥
    কেবল বাতাস খাই হাতে লয়ে পাখা।
    পাখার বাতাসে প্রাণ নাহি যায় রাখা ॥
    আপনি না থাকি আর আপনার বশে।
    পৃথিবী ভিজিয়া যায় শরীরের রসে ॥
    সংসার সংহার করে গুমটের দাপ্‌।
    ছাতি ফাটে প্রাণ যায় বাপ্‌রে বাপ্‌ ॥... (‘গ্রীষ্মের অত্যাচার’)

মুখোমুখি

‘কবিতায় থাকে এক গোপন জাদু’
১লা বৈশাখ ৬৫তম জন্মদিন উপলক্ষে বিশেষ সাক্ষাৎকার

কবি সাযযাদ কাদির বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এক বহুদর্শী ব্যক্তিত্ব। সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় তাঁর সৃষ্টিশীল বিচরণ বিস্ময় জাগায় পাঠকদের। শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা, সম্পাদনার কারণেও খ্যাতিমান তিনি।  ১৪ই এপ্রিল ১৯৪৭ সালে তাঁর জন্ম মাতুলালয় টাঙ্গাইল জেলা-শহরের উপকণ্ঠ-গ্রাম মিরের বেতকায়। পিত্রালয় একই জেলার দেলদুয়ার উপজেলার সদরে। ১৯৬৯ ও ১৯৭০ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স ও এম এ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিভিন্ন বিষয়ে ৬০টির বেশি গ্রন্থের প্রণেতা সাযযাদ কাদিরের একাদশ কবিতাগ্রন্থ “বৃষ্টিবিলীন” প্রকাশিত হয়েছে গত অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। সাহিত্য সংস্কৃতি, সমকালীন প্রসঙ্গ সহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন সুবর্ণ আহসান। তাঁর ৬৫তম জন্মদিন উপলক্ষে সে আলোচনার উল্লেখযোগ্য অংশ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো এখানে:

সুবর্ণ আহসান: ১৯৪৭ থেকে আজ পর্যন্ত জীবনের যে পরিক্রমা, তা কিভাবে উপভোগ করছেন?
সাযযাদ কাদির: কোন অর্থে বলছো, এই যে বেঁচে থাকা? মানে বেঁচে আছি কিভাবে?
: আপনি যে কাজ করছেন, আপনার কর্মক্ষেত্রটাকে কিভাবে উপভোগ করছেন?
? আমি তো এখন সাংবাদিকতা-সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত। দৈনিক মানবজমিন-এর যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। এখানে কাজ নিয়ে আমার কোনও অভিযোগ-অনুযোগ নেই।
: এই দীর্ঘ সময়ে তো আপনি অধ্যাপনা থেকে শুরু করে নানান পেশায় কাজ করেছেন?
?  শিক্ষকতা করেছি, সাংবাদিকতা করেছি। আর তো অন্য কোনও পেশায় ছিলাম না। এ দু’টোই করেছি।
: আর যদি বলি যে, পাশাপাশি যে লেখক সত্তা সেই সম্পর্কে কি কিছু বলবেন?
?  ওটা তো আর পেশা হিসেবে নিতে পারি নি। ওটা তো মনের আনন্দে করি। ওটা এক সৃষ্টিশীল প্রবণতা। আমার ভেতর যে সৃষ্টিশীল একটা মন তা সকল মানুষের মধ্যেই আছে। সৃষ্টিশীল মানুষ কিছু প্রকাশ করতে চায়, লেখালেখি সে প্রকাশের চেষ্টা।
: বাংলাদেশে কি পেশাগত ভাবে লেখক হওয়ার সুযোগ আছে?
? আছে হয়তো। আমি কিছু আয় করতে পারি নি লিখে।
: একটা কবিতায় বলেছেন, কবিতা জীবন না শিল্প। এ দু’টোর কোনটাকে আপনি মনে করেন কবিতা ? জীবন না শিল্প? নাকি অন্য কোনও সংজ্ঞায় কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করবেন?
?  কবিতা জীবন থেকেই আসে। রচনাটা শিল্প, বিষয়টা জীবন। নির্মাণ ব্যাপারটা তো শিল্প। তারপরও কবিতাকে ঠিক ব্যাখ্যা করা যায় না। কেন ভাল লাগলো, কেন লাগলো না, কেন একটা কথা কবিতা হয়ে ওঠে ? এটা তো ব্যাখ্যা করা যায় না। এ অনুভূতির ব্যাখ্যা করা যায় না। এজন্য বলেছি কোনও এক গোপন জাদু আছে এতে।
: বিভিন্ন জন  বিভিন্ন ভাবে কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। কেউ কথাকে বলেছেন কবিতা।
?  সব কবি’র কাছে, সব সমালোচকের কাছে কবিতার সংজ্ঞা আছে, ব্যাখ্যা আছে। তবে কবিতার সংজ্ঞা কবিতার ব্যাখ্যা দিয়ে তো আর কবিতার স্বাদ পাওয়া যায় না। আলোচনা থাকবেই। কবিতার আলোচনা তো কবিতা না। একটা হলো লজিক, আরেকটা হলো ম্যাজিক। কবিতা যদি ম্যাজিক হয়, কবিতার আলোচনা লজিক।
: “সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি” কথাটা কি সমর্থন করেন?
?    জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন। আমি এটা বিশ্বাস করি না। আমি মনে করি ?  সকলেই কবি, কেউ কেউ কবি নন।
: সকলেই কবি, বিষয়টি কি একটু ব্যাখ্যা করবেন?
?    কবিমন কার নেই? জীবন-যাপন, কষ্ট, দুঃখ, প্রকৃতি সব নিয়ে এই যে আমরা  ?  আমাদের সবার মধ্যেই আছে কবিমন। একেক জনের প্রকাশ একেক রকম। তবে কিছু আছে যারা কবি নয়। দুর্বৃত্ত, ধান্দাবাজ তারা। এই আর কি!
: কবি ও অকবি ?  এই দু’য়ের মধ্যে পার্থক্য কোথায় করবেন?
? সাহিত্য জগতে শিক্ষিত... সুশিক্ষিত... স্বশিক্ষিত মানুষ আছেন। অল্পশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত আবার অশিক্ষিতও আছে। কিন্তু কুশিক্ষিত যারা আমার মতে তারাই অকবি।
: আপনি গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ সহ বিভিন্ন শাখায় লিখেছেন। কোন শাখায় লিখতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন?
? স্বচ্ছন্দ বোধ না করলে তো লেখাই যায় না। তাই না? আমি যদি স্বচ্ছন্দ বোধ না করি তাহলে লিখতেই পারবো না। প্রবন্ধ নিবন্ধ গল্প কবিতা যা-ই লিখি না কেন সেটা মনে আসে প্রথম। তারপর সেটা মনে মনে লেখা হতে থাকে। লেখা হয়েও যায়। এর পরের কাজ হলো সেটাকে প্রকাশ করা।
: কেউ কেউ বলেন যে, লিখতে গেলে মনে হয় কেউ কাজটা তাকে করিয়ে নিচ্ছে। এ রকম কোন অনুভুতি কি কখনও হয়?
? মনে একটা ভাবনা আসে। থাকে। চলতে ফিরতে সবসময় যে থাকে তা নয়। ভাবনা আসার পর মনে-মনে তা নিয়ে ভাবতে থাকি, মনে-মনে রচনা করতে থাকি, কিভাবে কি লিখতে পারি। এ কাজটা চলতে থাকে ভেতরে-ভেতরে। তারপর একটা পর্যায়ে গিয়ে দেখা গেল যে আমি লিখছি। এটা লিখছি সম্পূর্ণ নিজের জন্য। আমিই স্রষ্টা, আমিই কর্তা। আমাকে কেউ গাইড করার নেই। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন কে যেন তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে। এ রকম কিছুতে আমার বিশ্বাস নেই। আমি নিজেই তো লিখছি সব। অলৌকিক অপ্রাকৃত কোনও কিছুতে বিশ্বাস করি না।
    : আপনার বাল্যবন্ধু বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম লিখেছেন, আপনি ছেলেবেলায় বেশ দুরন্ত ছিলেন। সেই ছেলেবেলার কথা মনে করে কি নসটালজিয়ায় ভোগেন?
? নসটালজিয়া কিছু না। ছেলেবেলার কথা ভেবে সবাই আনন্দ পায়। আমিও পাই। তখনকার কথা মনে করি। স্মৃতি তো সুখের। স্মৃতি সবসময়ই সুখের। তখন দুঃখেরও অনেক কিছু ছিল। কিন্তু আমরা দুঃখের কথা ভুলে যাই। বজ্র মানে কাদের সিদ্দিকীর লেখার কারণ আমরা খেলার সাথি ছিলাম। একসাথে খেলাধুলা করেছি। সেইসব খেলায় আমার কিছু সাফল্য ছিল। ভাল ফুটবলার ছিলাম। গোল দিতে পারতাম। এজন্য আমার সুনাম ছিল। ফুটবল, ক্রিকেট ও অন্যান্য খেলাধুলার পাশাপাশি পাড়ায় নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেছি। সেসবে আমার কিছু না কিছু ভূমিকা ছিল। এছাড়া ক্লাসে  ফার্স্ট বয় ছিলাম। লেখাপড়ায় ভাল ছিলাম। তবে বজ্র আমার চেয়ে বেশি অ্যাকটিভ ছিল। আর সমবয়সী হলেও ও তো গায়েগতরে আমাদের ছাড়িয়ে। আমি একটা গোল দিলে খুশিতে সে আমাকে কাঁধে নিয়ে লাফাতো। ওই বয়সের বন্ধুত্বের কোনও তুলনা হয় না।
: লেখালেখির শুরুর দিকটার কথা  জানতে চাই, কারও অনুপ্রেরণা ছিল এর পেছনে?
? বিশেষ কারও নেই। অনুপ্রেরণা দেয়ার মতো অমন কেউ আমাদের পরিবারে ছিল না, চারপাশেও নেই, আমি আসলে খুব বিচ্ছিন্ন পরিবেশে বড় হয়েছি। লেখালেখির কোন ব্যাপারই ছিল না সেখানে। আমার অনুপ্রেরণা এসেছে পাঠ্যবই থেকে। পাঠ্যবইগুলোর মধ্যে বিশেষ করে ইংরেজি ও বাংলা গদ্য-পদ্য আর র‌্যাপিড রিডার ও দ্রুতপঠনের বই। ফোর-ফাইভে যখন পড়ি তখন থেকেই মুখে-মুখে ছড়া কাটা আর পদ্য মিলানোর অভ্যাস ছিল।
:লেখক হয়ে উঠতে কি-কি গুণ থাকা দরকার?
? অধ্যয়ন ও অনুশীলনে নিবেদিত থাকতে হবে, অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। দেশ, জাতি, সমাজের প্রতি অঙ্গীকার থাকতে হবে।
: এক কথায় যদি বাংলাদেশ সম্পর্কে বলতে বলি তা হলে কি বলবেন?
? আমাদের প্রচুর সম্ভাবনা আছে, কিন্তু প্রকৃত উদ্যোগ নেই। দুর্নীতি কুরে-কুরে খাচ্ছে সব কিছু।
: আপনার কাজের সফলতা কতটুকু বলে মনে করেন?
? সফলতা নেই। জীবনে কাজে সফলতা বলতে কিছু নেই। আছে একটা সম্ভাবনা। তারপরও এটুকু বলতে পারি ? লেখার ভাব, ভাষা ও নির্মাণ ? এই তিনটা ক্ষেত্রেই নতুনত্ব আমার আছে। আমি তো অন্য কারও মত না। আমার আগের বা আমার সমসাময়িক কারও মতো নই। আমার লেখা এখন না হলেও এক সময় ঠিকই সমাদর পাবে। এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। মিডিয়ার জেল্লায় আমি ভুলি না। জানি, স্রোতে মরা মাছই ভাসে।
: পাঠকের কাছে আপনার চাওয়া কি?
? আমার চাওয়া তাঁরা ভাল লেখা পড়ুক, ভাল লেখার পৃষ্ঠপোষকতা করুক।

সাক্ষাৎকার গ্রহণ: ২৮শে মার্চ, ২০১২

বৃহস্পতিবার, ৫ এপ্রিল, ২০১২

আমরা সবাই রাজা

কোন জরিপ নেয়া হয়নি কখনও, তবে নিলে দেখা যেতো - আমরা দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি কথা বলি রাজনীতি, সরকার ও গণতন্ত্র নিয়ে। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে রাতে শুয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত আমাদের প্রধান বিষয় এ সবই। আসলে আমরা সবাই রাজা, তাই রাজ্যের খবর না নিয়ে চলতে ফিরতে পারি না মোটে। ঘর-সংসারে, কার্যালয়-কর্মস্থলে, পথে-মাঠে - যখন যেখানে যাই আমরা শুনতে ও বলতে আগ্রহী ও অভ্যস্ত ওই একটাই ব্যাপার - কোথায় কি হচ্ছে তা নিয়ে সত্য-মিথ্যা নানা কথা, গুঞ্জন ও জল্পনা।
এ বলাবলির একটা হদিস নেয়া যাক। কে কি বলেন বা বলেছেন রাজনীতি, সরকার ও গণতন্ত্র নিয়ে - আগে শুনি সে সব।
এক সন্ত-দার্শনিক বলেছেন, নির্যাতক সরকার বাঘের চেয়েও হিংস্র। তিনি আরও বলেছেন - সুশাসিত দেশে দারিদ্র্যই সবচেয়ে বেশি লজ্জাজনক, আর কুশাসিত দেশে সবচেয়ে বেশি লজ্জাজনক বিলাসব্যসন ধনসম্পদ। রঙ্গ-ব্যঙ্গের জন্য খ্যাতিমান এক নাট্যকার বলেছেন, জনপ্রিয় রাজনীতিকের প্রধান বৈশিষ্ট্য তিনটি - বিটকেল গলার আওয়াজ, বিদঘুটে পরিবেশে জন্ম ও বেড়ে ওঠা আর বিচ্ছিরি চলন বলন। এক শিক্ষক দার্শনিক তাঁর শিষ্যদের উদ্দেশে বলেছেন, যদি আমি রাজনীতি করতাম তাহলে বহু আগেই ধ্বংস হয়ে যেতাম। আমি রাজনীতিক হলে না তোমাদের না আমার নিজের কোন উপকার করতে পারতাম। তাঁর শিষ্য এক তাত্ত্বিক দার্শনিক বলেছেন, গণতন্ত্র এক চমৎকার পদ্ধতির সরকার। যেমন এর বৈচিত্র্য, তেমনই এর বিশৃঙ্খলা। এই সরকার যারা চালায় তাদের আছে দেশে-বিদেশে মিথ্যা বলার সুবিধা। তবে কোনও বিশেষ শ্রেণীর সুখ-সুবিধার জন্য দেশ নয়। এই দার্শনিকের শিষ্য তিনিও একজন খ্যাতনামা দার্শনিক। তিনি বলেছেন, গণতন্ত্র পদ্ধতির সরকার চালায় অনভিজাত, সম্পত্তিহীন ও রুচিবিগর্হিত বৃত্তিধারীরা। অর্থাৎ এদের মধ্যে খাই-খাই বেশি, লাজ-শরম কম। তারা লাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়। এই দার্শনিকই আবার বলেছেন, প্রতিটি মানুষই স্বভাবত রাজনৈতিক প্রাণী। এক ধর্মতত্ত্ববিদ বলেছেন, আমরা ধর্মকর্ম করি - রাজনীতির মতো উদ্ভট আর দুর্বোধ্য আর কিছু নেই আমাদের কাছে।
প্রিয় পাঠক, ক’জন প্রখ্যাত দাশনিক, তাত্ত্বিক, নাট্যকারের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছি এখানে - তাঁরা কেউই সমকালীন নন, সবাই দু’-আড়াই হাজার বছর আগের মানুষ। সন্ত চীনের দার্শনিক খুংফুচ্য (৫৫১-৪৭৯ পূর্বাব্দ)। তিনি কনফুসিয়াস নামে অধিক পরিচিত। নাট্যকার গ্রিসের আরিসতোফানেস (আ. ৪৪৮-আ. ৩৮৮ পূর্বাব্দ)। শিক্ষক গ্রিসের দার্শনিক সোকরাভেস (আ. ৪৬৯-৩৯৯ পূর্বাব্দ), যিনি সক্রেটিস নাম বহুপরিচিত। তাত্ত্বিক গ্রিসের দার্শনিক প্লাতো (আ. ৪২৮-৩৪৮ পূর্বাব্দ)। তাঁর শিষ্য গ্রিসের দার্শনিক আরিসতোতল (৩৮৪-৩২২ পূর্বাব্দ), যাঁকে এরিস্টটল-ও বলা হয়। তত্ত্ববিদ রোমান খ্রিষ্টিয় ধর্মতাত্ত্বিক তেরতুলিয়ান (আ. ১৬০-আ. ২৩০ অব্দ)।
এই মনীষীদের নাম আগে উল্লেখ না করায় কোনও পাঠক যদি বিভ্রান্ত হয়ে থাকেন তবে আমি দুঃখিত, ক্ষমাপ্রার্থী।
facebook.com/sazpa85


পত্রপত্রিকায় প্রথম পর্বে

পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর পাঁচ দশক কাটলো আমার। এ প্রকাশ ঘটেছে সাহিত্যচর্চা ও সাংবাদিকতার সূত্রে। মাঝেমধ্যে পিছন ফিরে দেখি জীবনের হারানো সময়। অনেক ঘটনা এখনও স্পষ্ট হয়ে ভাসে চোখের সামনে। সে সব কেবল ব্যক্তিগতভাবে আমার নয়, অনেক ঘটনা আজ দেশ ও জাতির ইতিহাসের অংশ। ভাবি, এর কিছু লিখে রেখে যাওয়া উচিত। কিন্তু সারা জীবন বহুজনের কথা লিখলেও নিজের কথা লেখার বিষয়টি মাথায়ই আসে নি কখনও। তাই লিখি নি তেমন কিছু। এখন এই এতগুলো বছর পাড়ি দিয়ে আসার পর (এই সামনেই ১লা বৈশাখে পা রাখবো ৬৫ বছরে) মনে হচ্ছে, এ তো আমার কথা নয় শুধু, আরও অনেকের কথা, বিভিন্ন সময়ের কথা। তাই কিছু-কিছু লিখছি, তবে অভ্যাসবশত লিখছি নিজেকে যথাসম্ভব প্রচ্ছন্ন রেখে। সে সব লেখার একটি অংশ, পত্রপত্রিকায় আমার সংশ্লিষ্টতার প্রথম পর্বের, বিশেষ করে টাঙ্গাইল পর্বের কিছুটা বিবরণ তুলে ধরলাম এখানে।
টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত যে পত্রিকায় আমার প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে তার নাম “বাতায়ন”। ঘটনাটি ১৯৫৮ সালের। আমি তখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। কবি আল মুজাহিদী সম্পাদিত “বাতায়ন” ছিল হাতে লেখা দেয়াল পত্রিকা। আমাদের বিন্দুবাসিনী স্কুলের নোটিশ বোর্ডে ছিল তার স্থান। মাঝেমধ্যে টাঙ্গাইলের অন্যান্য স্কুলে, বিবেকানন্দ ও শিবনাথ-এ, আবার করটিয়ার সা’দত কলেজেও যেতো।
সেবার কৃষি, শিল্প, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রদর্শনী উপলক্ষে শহরে ছিল খুব তোড়জোড়। করোনেশন পার্কে প্রতি বছর আয়োজিত ওই প্রদর্শনী ছিল সেকালে শহরবাসীর কাছে বছরের সেরা আকর্ষণ। আমাদের স্কুলের স্টলে সেবার স্থান পেয়েছিল আমার আঁকা দু’টি ছবি। এর একটি পুরস্কারও পেয়েছিল। তবে সবচেয়ে বড় পুরস্কার দিয়েছিল প্রদর্শনী উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যা “বাতায়ন” ? ১১ বছরের এক বালকের ‘আধুনিক গদ্য কবিতা’কে তার বুকে স্থান দিয়ে।
 সা’দত কলেজের দেয়াল পত্রিকার নামও ছিল “বাতায়ন”। নামটি রেখেছিলেন  প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ (১৮৯৪-১৯৭৮)। তখন ওই নামে তিনি ধারাবাহিক স্মৃতিকথা ‘মাসিক মোহাম্মদী’তে। ১৯৬২ সালে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর কিছু দিন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি পত্রিকাটির। এ সুযোগ আমাকে দিয়েছিলেন অধ্যক্ষ তোফায়েল আহমেদ ? কলেজ বার্ষিকী “মালঞ্চ”তে আমার একটি লেখা পড়ে। লেখাটি ছিল এডগার এলান পো’র কবিতার শিল্পবৈশিষ্ট্য সম্পর্কে।
ওই সময়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত হয় পাক্ষিক হিতকরী। এর সম্পাদক ছিলেন টাঙ্গাইলের ‘থার্ড অফিসার’ মির্জা আ মু আবদুল হাই (১৯৭৬ সালে আমার পীড়াপীড়িতে ‘মিরজা আবদুল হাই’), কার্যকরী সম্পাদক ছিলেন কাগমারী মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক খন্দকার আবদুর রহিম। দু’জনেই ছিলেন খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক। টাঙ্গাইল থাকতে মিরজা আ মু আবদুল হাই-এর কয়েকটি গল্প প্রকাশিত হয় ঢাকার নামী পত্রিকায়। সেগুলোর মধ্যে মাহে নও-এ প্রকাশিত “কিসের বাদ্য বাজে” এবং  পূবালী-তে প্রকাশিত “রাজদর্শন”-এর কথা মনে আছে এখনও। আর মাসিক মোহাম্মদী-তে ওই সময় প্রকাশিত হচ্ছিল খন্দকার আবদুর রহিমের ধারাবাহিক উপন্যাস “যমুনাচরের বাসিন্দা”।
হিতকরী-তে কবিতা ও গল্প লিখেছি। ছোটদের বিভাগেও লিখেছি। আমার কবিতা “তারা নেই আকাশে” প্রথমে অমনোনীত করেছিলেন খন্দকার আবদুর রহিম। বলেছিলেন, বালক বয়সে এত নৈরাশ্য ভাল নয়। হতাশা-নিরাশাকে আমরা নীতিগত ভাবে উৎসাহিত করতে পারি না।
পরে কবিতাটি পড়ে মিরজা আ মু আবদুল হাই প্রশংসাই করেন। খন্দকার আবদুর রহিমকে ছাপতে অনুরোধ করে বলেন, ১৪-১৫ বছরের একটি ছেলে নিখুঁত ভাষা ও ছন্দে একটি কবিতা লিখেছে ? এই বিষয়টিকে আমাদের উৎসাহিত করা উচিত।
১৯৬৩ সালে আমার লেখা গল্প “বৃষ্টি এলো” প্রকাশিত হয় হিতকরী-তে। সুবোধ ঘোষের রচনারীতির দ্বারা বেশ প্রভাবিত ছিলাম তখন। লেখায় সেই প্রভাবের ছাপ ছিল যথেষ্ট। ২০০৮ সালে প্রকাশিত “দুই প্রজন্মের গল্প” (সম্পাদক: পপি চৌধুরী; প্রিতম প্রকাশ, ঢাকা) নামের একটি সঙ্কলনে পুনর্মুদ্রিত হয় গল্পটি। তবে কেউই বলতে পারেন নি গল্পটি ৪৫ বছর আগে লেখা।
একই বছর হিতকরী-র ছোটদের বিভাগ “কিশোর প্রাঙ্গণ”-এ ছাপা হয় আমার লেখা “টিয়া কেন এত বাঁচে”। লেখাটি এক বিদেশী লোকরচনার ভাবানুবাদ। ১৬ বছর পর প্রকাশিত আমার শিশুতোষ রচনার সঙ্কলন “তেপান্তর”-এ স্থান পেয়েছে ওই মজাদার গল্পটি।
বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনে যথেষ্ট সক্রিয় ছিলাম আমি। ওই সময়ে টাঙ্গাইলের মিছিল-সভা-সমাবেশে ব্যবহৃত বেশির ভাগ পোসটার-ফেসটুনে ছিল আমার হাতে লেখা স্লোগান। অনেক স্লোগানের ভাষাও রচনা করেছি আমি। দেয়াল লিখন-ও যে লিখেছি কত! এসব কাজে ফজলুর রহমান ফারুক (বর্তমানে টাঙ্গাইল জেলা পরিষদের প্রশাসক) ছিলেন আমার মূল উৎসাহদাতা। ছাত্রলীগের একুশে সঙ্কলন “ওরা আর ফিরে আসবে না” এবং  পরে ছাত্র ইউনিয়নের একুশে সঙ্কলন “ডাক দিয়ে যাই” ? উভয়েরই সম্পাদক ছিলাম আমি। পাড়ায় গড়ে তুলেছিলাম ‘সমন্বয়’ নামে এক সাহিত্য সংঘ। এর সাধারণ সম্পাদক ছিলাম আমি। সংঘের মুখপত্র “সমন্বয়”-এরও সম্পাদক ছিলাম আমি। এতে জড়িত ছিলেন সিরাজুল ইসলাম শাহজাহান (আমার পীড়াপীড়িতে নাম পরিবর্তন করে শাজাহান সিরাজ, সাবেক মন্ত্রী), আবদুল লতিফ সিদ্দিকী (বর্তমানে পাট মন্ত্রী), আনোয়ার-উল-আলম শহীদ (আমার পীড়াপীড়িতে হয়েছিলেন ‘শহীদ আনোয়ার’, সাবেক রাষ্ট্রদূত), আমীরুল ইসলাম (বর্তমানে বাংলাদেশ ডেন্টাল কলেজের অধ্যক্ষ, নূরুন্নবী সাঈদ, আসাদ তালুকদার (সাবেক চেয়ারম্যান, বিসিক), রফিকুল ইসলাম মন্টু, বদরুল আমীন, রুহুল আমিন ও আরও অনেকে। এছাড়া কবিতাপত্র “শব্দরূপ”-এরও সম্পাদক ছিলাম আমি। দু’টি সংখ্যা বেরিয়েছিল এ সঙ্কলনটির।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর-পরই “পূর্বদেশ” পত্রিকা উদযোগ নেয় টাঙ্গাইলের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলীর ওপর বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশের। পত্রিকার পক্ষ থেকে মাহফুজ সিদ্দিকী (তোতা ভাই) দায়িত্ব নিয়ে আসেন টাঙ্গাইলে, যোগাযোগ করেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের সঙ্গে। তিনি সম্মতি দেয়ার পর তাঁর নির্দেশ ও পরিকল্পনা অনুযায়ীই প্রকাশিত হয় ক্রোড়পত্রটি। ওই সময় মাহফুজ সিদ্দিকী সমন্বয় করেন প্রকাশনার গোটা কাজ। সঙ্কলন, সম্পাদনা, এমন কি রিটাচিং-এর কাজও করি আমি। টাঙ্গাইলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় এখনও অনেকের মূল অবলম্বন ওই ক্রোড়পত্র।
এর পর এসে পড়ে সাপ্তাহিক রণাঙ্গন সম্পাদনার কাজ। মুক্তিযুদ্ধ কালে সাইক্লোস্টাইলের মাধ্যমে কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল, এবার উদযোগ নেয়া হয় মুদ্রিত আকারে প্রকাশের। এই উদযোগের নেপথ্যে ছিল হিলালী। পুরো নাম খন্দকার ইমামুল হক হিলালী। কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে এ ব্যাপার আলাপ-আলোচনা করেছিল সে, পরে যাবতীয় যোগাযোগও রক্ষা করেছে। ‘রণাঙ্গন’ সম্পাদনায় হিলালী-ই ছিল আমার প্রধান সহযোগী। ছিল আরও কয়েকজন প্রতিভাদীপ্ত তরুণ ? আনোয়ার ইকবাল, রেজাউল হাসান, আলমগীর মনজুর, আকবর কবীর। রণাঙ্গন-এ আমার নাম ছাপা হয়েছে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে।
১৯৭৩ সালে টাঙ্গাইলের বরেণ্য রাজনীতিবিদ শামসুর রহমান খান শাহজাহানের উদযোগে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক সংকেত। সম্পাদনার দায়িত্ব তিনি অর্পণ করেন আমার ওপর। পত্রিকার প্রকাশ উপলক্ষে শুভেচ্ছাবাণী পাঠিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আবদুল মান্নান।
সাপ্তাহিক সংকেত ছাপা হতো কল্লোল মুদ্রায়ন-এ। ওই প্রেসে তখন মওলানা ভাসানী প্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিক হক-কথা-ও ছাপা হতো। রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিষয়টি ছিল এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তখন “হক-কথা”য় আমি ‘আওরঙ্গজেব চৌধুরী’ নামে লিখতাম আন্তর্জাতিক বিষয়াদি নিয়ে। মনে পড়ে বায়াফ্রা’য় দুর্ভিক্ষ ও ভারত মহাসাগরে পরাশক্তির রণসজ্জা সম্পর্কে দু’টি লেখার কথা।
টাঙ্গাইলের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ইতিহাসে এ দু’টি সাপ্তাহিকেরই রয়েছে গৌরবজনক ভূমিকা। এজন্য হক-কথা-র পাশাপাশি সংকেত-এর নামও সমমর্যাদায় উচ্চারণ করা উচিত বলে আমি মনে করি। সেই সঙ্গে বিশেষ সম্মান সহকারে তুলে ধরা উচিত শামসুর রহমান খান শাহজাহানের অবদানের ইতিহাসটি। সেদিন সংকেত-এ শিক্ষানবিশি করে অনেকেই পরে কেরিয়ার গড়ে তুলতে পেরেছেন জাতীয় পত্রপত্রিকায়। দু’-একজন তা স্বীকার না করলেও প্রকৃত সত্য আড়াল হবে না কোনও দিন।
স্বাধীনতার পর টাঙ্গাইলে সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল “ধানসিঁড়ি”। এ সংগঠনের নেতৃত্বে ছিল আনোয়ার ইকবাল, রেজাউল হাসান, আলমগীর মনজুর, রহিমা সিদ্দিকী প্রমুখ। ওদের সঙ্গে আমিও যুক্ত ছিলাম ওতপ্রোতভাবে। আরও একজন তখন বিশেষ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ধানসিঁড়ি-র। তিনি টাঙ্গাইলের তৎকালীন জেলার ও খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন (১৯১৭-১৯৮১)। তাঁর লেখা উপন্যাস “অবাঞ্ছিত” (১৯৫০), “কি পাইনি” (১৯৫২), “মোহমুক্তি” (১৯৫৩) এক সময় ছিল পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষে। টাঙ্গাইল থাকতে তিনি লিখছিলেন “নতুন পৃথিবী” নামের একটি উপন্যাস। পরে, ১৯৭৪ সালে, প্রকাশিত হয়েছিল এটি।
১৯৭৬ সালে টাঙ্গাইল জেলা পরিষদের মাধ্যমে উদযোগ নেয়া হয় “টাঙ্গাইল সমাচার” নামে এক পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশের। উদযোক্তা ছিলেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক শেখ হাবিবুল্লাহ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আবদুল আউয়াল ও জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী (পরে মহকুমা প্রশাসক) অরবিন্দ কর (সাবেক বিদ্যুৎ সচিব)। আমার ওপর এসে পড়ে সম্পাদনার দায়িত্ব। তখন কবি ও সাংবাদিক আবু কায়সার বেকার অবস্থায় দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছিলেন টাঙ্গাইলে। আমি সম্পাদনার দায়িত্ব তাঁকেই দিতে অনুরোধ করি। আমার এ অনুরোধ রক্ষা করে প্রশাসন। এরপর উপদেষ্টা হিসেবে আমি দায়িত্ব পালন করি “টাঙ্গাইল সমাচার”-এর।
sazzadqadir@gmail.com; sazzadqadir@rediffmail.com; sazzadqadir@yahoo.com; facebook.com/sazpa85

বুধবার, ৪ এপ্রিল, ২০১২

বৈশাখে বইমেলা

প্রতি বছর বৈশাখে আসে বইমেলা, এর একটু আগে আসে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’, সেই সঙ্গে নানা সেমিনার-সিমপোজিয়াম আসে গ্রন্থের প্রসার নিয়ে ভাবনা করতে। উদ্যোগ নেই কোনও, কিন্তু ভাবনা কেন?
    আঠারো শতকে প্রতাপ ও প্রতিষ্ঠা ছিল পুঁথির। ধর্মকর্ম, রাজকার্য, শিক্ষা ও সাহিত্য - সব কিছুর এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে পুঁথির প্রসার ছিল পরাক্রমশালীর প্রাসাদ থেকে আলোকপ্রাপ্ত দরিদ্রের পর্ণকুটির পর্যন্ত। তারপর উনিশ শতকে গ্রন্থের প্রতিষ্ঠা ঘটে অন্য সব মাধ্যমকে ছাড়িয়ে। উন্নত কাগজ, পরিপাটি মুদ্রণ, মজবুত বাঁধাই, বিষয়বৈচিত্র্যে অনন্য রচনা, মেধাবী পাঠক - গুণে মানে গ্রন্থের মহিমা তখন সর্বশীর্ষে। কিন্তু বিশ শতকে প্রবল প্রতাপ অডিও-ভিসুয়াল মাধ্যমের। একে-একে সংবাদপত্র, চলচ্চিত্র, গ্রামোফোন, বেতার ও মঞ্চনাটক অনেকখানি দখল করে নেয় গ্রন্থজগতের জায়গাজমি, লেখক-পাঠকদের সময়। এক কাজী নজরুল ইসলামের উদাহরণ দিয়েই বলতে পারি - তাঁর মতো একজন যুগন্ধর কবি কিভাবে জড়িত ছিলেন ওই সব মাধ্যমের প্রতিটির সঙ্গে। তারপর এসেছে টেলিভিশন, ক্যাসেট, সিডি, ভিসিডি, ডিভিডি, কমপিউটার, সেলফোন। আরও আসছে কত। বিশ শতক যদি হয় টেলিভিশনের শতক, তাহলে এই একুশ শতক অবশ্যই কমপিউটারের।
এ অবস্থায় গ্রন্থের প্রসারের প্রশ্নটি আসতেই পারে। গত শতকে কোণঠাসা হওয়ার পর এ শতকে চ্যালেঞ্জেই পড়েছে সে। বিল গেটস তো বলেছেনই - কাগজের ব্যবহার থাকবে না এক সময়। এখনই অনলাইন প্রকাশনা এগিয়ে গেছে অনেকখানি। এ অবস্থায় সংবাদপত্র জগতে বিপর্যয় শুরু হয়েছে, আর গ্রন্থ জগৎ অপেক্ষা করছে আসন্ন পরিস্থিতির। কারণ “গুটেনবার্গ দানো”র মহিমা ছাড়াও অল্প আয়াস নির্ভর পাঠ্যপুস্তকের জগৎ এখনও অনেকখানি ভরসা হয়ে আছে তার।
তাহলে কি ভূমিকা রাখতে পারেন লেখক? গ্রন্থজগতে বিরাজমান প্রতিকূলতা কাটিয়ে প্রসারতা ঘটাতে কি করতে হবে লেখককে? যাঁরা পাঠ্য বই লেখেন তাঁদের পরিচিতিই বড় ভূমিকা রাখে ওই বইয়ের প্রচার ও প্রসারে। কারণ পরিচিতির সূত্রে নানারকম যোগাযোগ থাকে, আর ওই যোগাযোগটাকে অর্থপূর্ণ করা গেলে কাজটা সহজ হয় বেশ। কিন্তু “অপাঠ্য” বইয়ের লেখক - তাঁদের ভূমিকা কেমন?
সব লেখকের কাছেই প্রিয় তাঁর নিজের লেখা। এই প্রিয়তা নিয়ে তিনি যে ভূমিকা পালন করেন তা অনেকটা কন্যার পিতার মতো। কন্যাকে কেবল জন্ম দিলেই চলে না, তাকে সৎপাত্রস্থও করতে হয়। লেখকও সে রকম এক দায়িত্ব ও কর্তব্য বোধ নিয়ে নিজের লেখাটি ভালভাবে প্রকাশ করতে চান, উদ্দিষ্ট পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে চান।
তবে কোনও-কোনও লেখককে প্রকাশকরাও খোঁজেন, কিন্তু অনেক লেখকই ভাল একজন প্রকাশক খোঁজেন। এই অনেক লেখকদের অনেকে নানাভাবে সহায়তাও করেন প্রকাশকদের। তাঁরা অঙ্কনশিল্পীদের ধরে প্রচ্ছদ করিয়ে নেন, পত্রপত্রিকায় ঘুরে-ঘুরে খবর ছাপান, বিজ্ঞাপন ছাপান, মোড়ক উন্মোচন বা প্রকাশনা উৎসব করেন, রাস্তার মোড়ে-মোড়ে ব্যানার ঝোলান, বইমেলায় বিক্রেতা সাজেন।
কোনও-কোনও লেখক করেন আরও বেশি। তাঁরা টিভি-অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন, বিশাল-বিশাল হোরডিং লাগান রাজপথের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে, পুরস্কার আদায় বা যোগাড় করেন।
তবে “অপাঠ্য” বইয়ের বেশির ভাগ লেখককেই নিজের বই ছাপতে হয় নিজেকে। প্রচার, বিক্রয়ও করতে হয় নিজের উদ্যোগে। এতে অবশ্য লজ্জা বা সঙ্কোচের কিছু নেই। প্রথম দিকে দু’একটি ব্যতিক্রম বাদে রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন নিজের বই নিজেই ছেপেছেন, নজরুলও ছিলেন নিজের অনেক বইয়ের প্রকাশক।
আরও অনেক লেখক আছেন যাঁদের বই ছাপা হয় না কখনও। প্রকাশকরা ছাপেন না তাঁদের বই, নিজেদেরও সংগতি নেই ছেপে বের করার। হঠাৎ কখনও কোনও মতে তাঁদের দু’একজনের দু’একটি বই বের হলেও তা হয়তো থেকে যায় পাঠকদের অজানাই।
আসলে শিক্ষা ও বিনোদন - এ দু’টি চাহিদার একচেটিয়া যোগান গত এক শতক ধরে আর গ্রন্থে নেই। ভোক্তারা এখন তা পাচ্ছেন অন্যান্য অনেক মাধ্যমেই। বই পড়ার সময়গুলোও দখল হয়ে গেছে নানাভাবে। তারপরও পাঠক-ক্রেতারা আসছেন বইমেলায়, খুঁজছেন তাঁদের মনের মতো বই। কোনও বইয়ের প্রয়োজন জীবন-জীবিকার কাজে, কোনও বইয়ের চাহিদা মনের খোরাক মেটাতে। এ সব প্রযোজন ও চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে লেখক ও প্রকাশকরা ব্যস্ত রেখেছেন নিজেদের।
উনিশ শতকের শেষ পাদে সেরাকাটতি মানে বেস্টসেলার লেখক ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪)। কিন্তু তাঁকে বেস্টসেলার লেখক বানিয়েছিলেন কারা? কারা ছিলেন সেই পাঠক-ক্রেতা? সুকুমার সেন (১৯০১-৯২)  তাঁর বিখ্যাত “বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস”-এর তৃতীয় খণ্ডে (কলকাতা, ১৯৪৩) উল্লেখ করেছেন, “যে সকল পাঠক সংস্কৃত সাহিত্যের অথবা সংস্কৃতানুসারী বাঙ্গালা সাহিত্যের ধার বিশেষ ধারিতেন না অথচ ইংরেজী সাহিত্যে তেমন দখল না থাকায় যাঁহারা বাঙ্গালা বই পড়া অবজ্ঞেয় কাজ মনে করিতেন না তাঁহারাই বঙ্কিমের প্রধান সমঝদার ছিলেন, এবং স্বভাবতই ইঁহাদের মধ্যে দলে ভারী ছিলেন নারী ও তরুণেরা।”
আমার ধারণা গত প্রায় দেড় শ’ বছর ধরে পাঠক-ক্রেতা সমাজে দলে ভারি হয়ে আছেন এই কলেজপড়ুয়ারা, এই গৃহিণীরা। তাঁরা সমকালীন বুদ্ধিজীবীদের ঠাট্টা-মশকরা উপেক্ষা করে সেই তখন থেকে পড়ে আসছেন বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, বিভূতি-তারাশঙ্কর, সুবোধ ঘোষ-বিমল মিত্র, শংকর-সুনীল। পাশাপাশি পড়েছেন পাঁচকড়ি দে, দীনেন্দ্রকুমার রায়, শশধর দত্ত, স্বপনকুমার। প্রভাবতী দেবী, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, অবধূত, জরাসন্ধ, নিমাই ভট্টাচার্য-ও পড়েছেন। সে পড়াও হয়তো বৃথা যাবে না তাঁদের। একদিন পুনর্মূল্যায়ন, পুনঃপ্রতিষ্ঠা হতে পারে এই উপেক্ষিত লেখকদেরও।
গ্রন্থের প্রসারে প্রচারমাধ্যমের ভূমিকা আগের চেয়ে অনেক জোরালো এখন। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক উভয় মাধ্যম কারিগরি উৎকর্ষের কারণে জোরদার হয়ে উঠছে প্রতিদিন। বড়-বড় হাউস প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, নতুন-নতুন ভেন্যু খুলে যাচ্ছে - আর এ সবের সবখানে যথামহিমা ও যথামর্যাদায় পাতা আছে গ্রন্থজগতের আসনটি। সরাসরি সমপ্রচার হচ্ছে বইমেলা, টক শো হচ্ছে নিয়মিত, আলোচনা-পরিচিতির আয়োজন আছে, স্বল্পমূল্যে বিজ্ঞাপনেরও ব্যবস্থা আছে।
এ পর্যন্ত সব খবরই ভাল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সব খবরই ভাল নয়। সব কিছুও ভাল নয়।
প্রথমত, যত ভাল বই পড়বো বলে আশা করি অত ভাল বই প্রকাশ হয় না।  মেধাবী ও শ্রমনিষ্ঠ লেখকের সংখ্যা কম। যাঁরা আছেন তাঁরা শৌখিন লেখক ও ধান্দাবাজদের উৎপাতে প্রায় কোণঠাসা। এই ধান্দাবাজরা নানা দল ও গোষ্ঠীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকে তালে থাকেন নগদ ফায়দা লোটার। তাঁরা দলাদলি করে একে ওঠান, ওকে নামান - একে হটান, ওকে কাটেন! মারকা মেরে, লেবেল এঁটে বেড়ান তাঁরা, অপপ্রচার চালিয়ে খুনও করেন।
দ্বিতীয়ত, লেখালেখি ক্রমশ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে চর্চাকারীদের মধ্যে। যাঁরা লেখেন কেবল তাঁরাই পড়েন। তাঁদেরও পড়ার অভ্যাস সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে ক্রমে। কেউ-কেউ নিজের লেখাই শুধু পড়েন। প্রয়োজন বা ঠেকায় না পড়লে অন্যের লেখা ছুঁয়েও দেখেন না।
তৃতীয়ত, প্রচারমাধ্যমে চেনামুখেরই ছড়াছড়ি বেশি। সেখানে গোষ্ঠীপ্রীতি ছাড়াও আছে অঘোষিত কালো তালিকা।
অথচ লেখকদের ব্যাপারে আমাদের আশা অনেক। বিশ্বাস করি, তাঁরা বিশেষ কোনও দলের নন, দেশ জাতি জনগণের, গোটা বিশ্বসমাজের। দুঃখজনক হলেও সত্য - এ দেশের অনেক লেখক চলেন বলেন দলীয় মুখপত্র বা মুখপাত্রের মতো, অনেকের আচরণ দলের উপজেলা পর্যায়ের অঙ্গসংগঠনের কর্মীদের চেয়েও খারাপ। এ অবস্থায় লেখালেখির চেয়ে কোন্দলের কোলাহলই সৃষ্টি হয় বেশি, আর এর আছর পড়ে বইয়ের প্রকাশ, প্রচার, প্রসারের ওপর।
অনেকে বলবেন, প্রকৃত লেখকের প্রাপ্য তো বৈরিতা ও তিরস্কার - সমর্থন বা পুরস্কার নয়। কারণ সুন্দরী মহিলাদের বান্ধবী থাকে না, প্রতিভাবান পুরুষদের বন্ধু থাকে না - এটা বাস্তবতা। প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে বলেই এমনটা ঘটে। সাহিত্যসম্রাট হিসেবে নন্দিত বন্দিত যে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁকেও একদিন গভীর দুঃখে বলতে হয়েছে, “নিরপেক্ষ সমালোচনায় একটা দেশ আমার শত্রু হইয়া উঠিতেছিল। শুনিয়াছি, কোনও কোনও গ্রন্থকার আমাকে মারিতে পর্যন্ত সংকল্প করিয়াছিল। গালাগালির ত কথাই নাই। সার্‌ জর্জ কেম্বেলের পর বোধ হয়, আমি এ বাঙ্গালার গালাগালির প্রধান পাত্র - ও ধস ঃযব ড়িৎংঃ ধনঁংবফ সধহ রহ ইবহমধষ হবীঃ ড়হষু ঃড় ঝরৎ এবড়ৎমব ঈধসঢ়নবষষ.চ
প্রচারমাধ্যম আরও প্রচারনিরপেক্ষ হবে - এটুকু আমরা আশা করতে পারি। এতে গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে তাদের। এছাড়া অতিপ্রচার যে এক ধরনের অপপ্রচার তা অতীতে যেমন বারবার প্রমাণিত হয়েছে, ভবিষ্যতেও তেমন প্রমাণিত হবে বারবার। এ সত্যটি জানা থাকলে চেনামুখের দৌরাত্ম্য ও কালো তালিকার দাপট বন্ধ হবে এমনিতেই।
সবশেষে বলি, গ্রন্থের প্রসারে অতীতে অনেক উদযোগ নেয়া হয়েছে, এখনও কিছু-কিছু উদযোগ চালু আছে। এসব উদযোগের অপব্যবহার সম্পর্কে অনেক অভিযোগ আমরা শুনেছি, পড়েছি এবং জেনেছি। সরকারি উদযোগে বই কেনার নিয়ম কিভাবে পালিত হচ্ছে তা খোঁজ না নিয়েও জানা যায় এমনিতে। এ নিয়ম তৈরি করেছে ঢের-ঢের অ-প্রকাশক আর অ-লেখক। আর যে সব প্রতিষ্ঠান কিছু-কিছু বই কেনে সেখানেও চলছে ইচ্ছামতো বাছবিচার। দলাদলি। রাজনৈতিক খেয়োখেয়ি। ফলে আবর্জনায় ভরে উঠছে সারা দেশের বহু আলমারি। সে আবর্জনার অবশ্য সতূপে যেতেও দেরি হয় না বেশি।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও চলছে একই অবস্থা। স্কুলের শিশুদের জন্য উন্নত মানের শিক্ষামূলক জ্ঞানচর্চার বই রেখে কেনা হচ্ছে নিম্নমানের অর্থহীন বিনোদনমূলক রঙচঙা বই। বানান ভুল, ভাষা ভুল ? এ সব বই এক শিক্ষিকাকে কিনতে দেখে বলেছিলাম, এর থেকে তো বিষ কিনে দেয়াই ভাল! তিনি বলেন, ওরা এগুলোই চায়।
শিশুদের রুচিনির্মাণের দায়িত্ব যাঁদের ওপর তাঁরা যদি শিশুরুচির কাছেই আত্মসমর্পণ করেন তাহলে পাঠকরুচি গড়বেন কারা? এ রুচি ছাড়া কি প্রসার হওয়া সম্ভব সৃষ্টিশীল সাহিত্যের? বৈশাখে তাই বইমেলা হোক বিশেষভাবে রুচিশীল বইয়ের।
sazzadqadir@gmail.com; sazzadqadir@rediffmail.com; sazzadqadir@yahoo.com; facebook.com/sazpa85


রবিবার, ১ এপ্রিল, ২০১২

স্বাগত চোদ্দ শ’ উনিশ

ঘটনাবহুল একটি বছর শেষে আসছে আরেকটি বছর। ক’দিন পরেই আমরা অভিনন্দন জানাবো নতুন বছরকে, উদযাপন করবো বছরের প্রথম দিন ? ১লা বৈশাখ ১৪১৯ বঙ্গাব্দ, ১৪ই এপ্রিল ২০১২ অব্দ (খ্রিষ্টাব্দ), ২১শে জুমাদা আল-আউয়াল ১৪৩৩  হিজরি সন ? বঙ্গাব্দ পালনকারী বাঙালির জন্য এ দিনটিতে শুরু হবে নতুন একটি বছর। কিন্তু খৃষ্টীয়, হিজরি বা অন্যান্য সন অনুসরণকারীদের জন্য নতুন বছরের প্রথম দিনটি নির্ধারিত হয়ে আছে ভিন্ন-ভিন্ন তারিখে। এর কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের বর্ষপঞ্জি।
সময়-গণনার এই বিশেষ পদ্ধতিটি সুপ্রাচীন, একই সঙ্গে সমস্যাসঙ্কুলও বটে। ওইসব সমস্যা এখনও আছে, পাশাপাশি আছে সমাধানেরও চিরন্তন প্রয়াস। বহমান সময়ের হিসাব সংরক্ষণের এই পদ্ধতির নাম “বর্ষপঞ্জি” (“পঞ্জিকা”) বা “ক্যালিনডার”। 
প্রাচীনকালে মানুষ যখন বুঝতে পারে প্রকৃতি মূলত নিয়ম-শাসিত, আর প্রকৃতির নিয়মে ঋতুর যে পরিবর্তন ঘটে তা-ই নিয়ন্ত্রণ করে তাদের জীবন, চাহিদা ও খোরাক ? তখন তাদের জন্য  দরকারি হয়ে ওঠে বর্ষপঞ্জি। কবে শীত নামবে, বর্ষা শুরু হবে ? তা জানতে হবে আগেভাগে, নইলে ওই বিপদকালের জন্য প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব কিভাবে! ঘড়ি আবিষ্কারের আগে মানুষ সময়ের হিসাব  রেখেছে সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজির মাধ্যমে। সূর্যের উদয় ও অস্তের মাধ্যমে সে পেয়েছে সবচেয়ে সহজ ও স্বাভাবিক এক একক ? সৌর দিন । ঋতুগুলোর মাধ্যমে মোটামুটিভাবে পাওয়া গেছে আরও একটি সহজ একক ? সৌর বর্ষ।
সেকালের মানুষ অবশ্য জানতো না ঋতু পরিবর্তনের কারণ। সূর্যকে ঘিরে পৃথিবী যে ঘোরে সে সত্য অজ্ঞাত ছিল তাদের কাছে। তবে চাঁদের আকার ও অবস্থানের পরিবর্তন তো চোখে পড়ে সহজেই। ফলে প্রাচীনতম বর্ষপঞ্জিতে এক পূর্ণিমা থেকে আরেক পূর্ণিমা পর্যন্ত সময়ের হিসাব থেকে চান্দ্র মাস নির্ণয়ের ব্যাপারটি ঘটে। সৌর দিনের সঙ্গে সৌর বর্ষের হিসাব মেলাতে যুক্ত হয় এই মাসের হিসাব।
চান্দ্র মাসের হিসাব আমাদের সকলেরই জানা ? গড়ে ২৯.৫৩০৫৮৯ দিনে হয় এক চান্দ্র মাস। এ রকম ১২টি মাস মিলে হয় প্রায় ৩৪৫ দিন। ফলে সৌর বর্ষ থেকে তা হয়ে পড়ে ১১ দিন কম। এক সৌরবর্ষ হতে সময় লাগে ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড। এই অসংগতি চলছে হাজার-হাজার বছর ধরে। চান্দ্র ও সৌর বর্ষপঞ্জিতে সাযুজ্য বিধান করা সম্ভব হয়নি এখনও।
প্রাচীনকালের বর্ষপঞ্জিতে চালু হয়েছিল সৌর ও চান্দ্র বর্ষে সমতা বজায় রাখার জন্য কোনও বছর ১২ মাসে, কোনও বছর ১৩ মাসে গণনা করার নিয়ম।  তাই গ্রিস ও ইউফ্রেতিস নদীর দক্ষিণ উপত্যকায় অবস্থিত বেবিলন-এর জ্যোতিষীরা যে বর্ষপঞ্জি ব্যবহার করতেন তাতে অনেক আদিম বৈশিষ্ট্য ছিল। অনিয়মিতভাবে কোনও-কোনও বছরের শেষে তাঁরা জুড়ে দিতেন একটি অতিরিক্ত মাস। রাজজ্যোতিষীরা যখন বুঝতেন বর্ষপঞ্জির হিসাব অনুযায়ী আর কাজ চলছে না তখন একমত হয়ে বিভিন্ন নির্দেশনা ঘোষণা করতেন তাঁরা।  এ রকম ঘোষণা তিনবারও করতে হতো তাঁদের। কিন্তু এতে হিসাবের ভুল ও অন্যান্য বিভ্রান্তি এড়ানো যেতো না কোনও ভাবে। সম্ভবত মিশর-এর  জ্যোতিষীরাই  প্রথম ব্যবহার করেন একটি পূর্ণাঙ্গ সৌর বর্ষপঞ্জি। তাঁরা খেয়াল করেছিলেন কয়েক মাস অদৃশ্য থাকার পর সূর্যোদয়ের ঠিক আগে আকাশে দেখা দেয় লুব্ধক নক্ষত্র । তারা আরও খেয়াল করেছিলেন, লুব্ধক-এর পুনরুদয়ের পর-পরই নীলনদে আসে বাৎসরিক বন্যা। এই ঘটনাকে নির্দেশিকা হিসেবে রেখে ৩৬৫ দিনের এক সৌর বর্ষ নির্ণয় করেন তাঁরা। ওই  বর্ষ হতো ১২ মাসে, আর প্রতিটি মাস হতো ৩০ দিনে। বছর শেষে যুক্ত হতো অতিরিক্ত পাঁচ দিন । দিনের অতিরিক্ত চতুর্থাংশ হিসাবে না রাখায় তাদের বর্ষপঞ্জিতে গরমিল ঘটতো নিয়মিত। মিশরের এই বর্ষপঞ্জি নিয়ে  গবেষণা হয়েছে অনেক। গবেষকরা ধারণা করেন, অন্তত ৪২৩৬ পূর্বাব্দে প্রচলিত ছিল মিশরীয় বর্ষপঞ্জিটি।
রোম-এর জ্যোতিষীরা বর্ষপঞ্জির ধারণা পেয়েছিলেন গ্রিক জ্যোতিষীদের গণনা থেকে। তাঁদের পঞ্জিতে ছিল ১০ মাস, আর ৩০৪ দিনে এক বছর। বাকি ৬০ দিন তাঁরা হিসাবে রাখতেন না, ওই দিনগুলো ছিল শীতকালের মধ্যভাগে। রোম নগরীর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে উপকথায় বর্ণিত রোমালাস (আ. ৭৭১-৭১৮ পূর্বাব্দ) ৭৩৮ পূর্বাব্দে ওই বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন করেন বলে কথিত আছে।
রোমালাস-এর উত্তরাধিকারী নুমা পমপিলিয়াস (৭১৫-৬৭৩ পূর্বাব্দ) ওই পঞ্জির শুরুতে একটি এবং শেষে আরও একটি মাস গণনার নির্দেশ দেন। এছাড়া সৌর বর্ষের সঙ্গে হিসাব মিলাতে তিনি ২২ ও ২৩ দিনের আরও একটি মাস নির্ধারণ করেন। ওই মাসটি এক বছর পর-পর যুক্ত হতো বছরের শেষ মাসটির ২২,২৩ তারিখের মধ্যে। ওই বর্ষপঞ্জির হিসাব বদলানো হয় ৪৫২ পূর্বাব্দে।
জুলিয়াস সিজার (১০০-৪৪ পূর্বাব্দ) রোম সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়ে লক্ষ্য করেন বিদ্যমান বর্ষপঞ্জির হিসাব তিন মাস আগে চলছে প্রত্যেক ঋতুর। তিনি তখন জ্যোতিষী সোসিনিজিনিস-কে নির্দেশ দেন পঞ্জিকা সংস্কারের। ওই সংস্কারের ফলে ৩১ ও ৩০ দিনের পর্যায়ক্রমিক ১২টি মাস নিয়ে গণনা করা হয় একটি বছর, তবে দ্বিতীয় মাসের জন্য নির্ধারিত হয় ২৯ দিন। চার বছর পর-পর ওই মাসটি গণনা করা হতো ৩০ দিন হিসাবে। একই সঙ্গে ৪৬ পূর্বাব্দে, অন্য এক নির্দেশে ৪৪৫ দিনে গণনার ঘোষণা দেয়া হয়। পরে সম্রাট অগসতাস (৬৩ পূর্বাব্দ - ১৪ অব্দ) দ্বিতীয় মাসের একটি দিন সরিয়ে নিয়ে যান অষ্টম মাসে ? যাতে সপ্তম মাসের সমান সংখ্যক দিন থাকে ওই মাসেও।
‘জুলিয়ান’ নামে খ্যাত এই বর্ষপঞ্জি ১৫০০’র বেশি বছর ধরে চালু ছিল। এই পঞ্জি অনুযায়ী প্রতিটি বছর ছিল ৩৬৫.২৫ দিন। অর্থাৎ প্রতিটি সৌরবর্ষ থেকে ১১ মিনিট ১৪ সেকেন্ড দীর্ঘ। ফলে ঋতুভিত্তিক তারিখে গরমিল দেখা দিতে থাকে। ১৫৮০ সালে মহাবিষুবের তারিখ দেখা দেয় ১১ই মার্চ হিসেবে অর্থাৎ ১০ দিন আগে চলে আসে তারিখটি (২০শে মার্চ)।
এর পর জুলিয়ান বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদযোগ নেন জ্যোতিষীরা। তাঁদের পরামর্শে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি (১৫০২-৮৫) ১০ দিন বাতিল করেন দশম মাস থেকে । ফলে ১৫৮২ সালের ৫ই অকটোবর পরিণত হয় ১৫ই অকটোবর। এছাড়া দ্বিতীয় মাসে একটি অতিরিক্ত দিন সংযোজনের নির্দেশ দেন ৪০০ দ্বারা বিভাজ্য শত বর্ষে। এ হিসেবে ১৬০০ সালে যুক্ত হয়েছে একটি অতিরিক্ত দিন, ২০০০ সালেও যুক্ত হয়েছে আরও একটি দিন।
এই বর্ষপঞ্জি ‘গ্রেগরিয়ান’ নামে খ্যাত। সৌরবর্ষের সঙ্গে এর ব্যবধান মাত্র ২৬ সেকেন্ড। প্রতি ১০০ বছরে এই ব্যবধান বাড়বে .৫৩ সেকেন্ড হারে। কারণ সৌরবর্ষ ছোট হয়ে আসছে ক্রমশ।
ইউরোপের বিভিন্ন রোমান ক্যাথলিক অধ্যুষিত দেশ ‘গ্রেগরিয়ান’ বর্ষপঞ্জি গ্রহণ করে সঙ্গে-সঙ্গে। জারমানি’র কয়েকটি রাজ্য ‘জুলিয়ান’ বর্ষপঞ্জি বহাল রাখে ১৭০০ সাল পর্যন্ত। গ্রেট ব্রিটেন ও আমেরিকান উপনিবেশগুলিতে ‘গ্রেগরিয়ান’ চালু হয় ১৭৫২ সালে। এই বর্ষপঞ্জি রাশিয়ায় ১৯১৮ সালে, গ্রিসে ১৯২৩ সালে ও তুরস্কে ১৯২৭ সালে গ্রহণ করা হয়। জাপান, কোরিয়া ও চীন গ্রহণ করে যথাক্রমে ১৮৭৩, ১৮৯৫ ও ১৯১২ সালে। চীনে অবশ্য সার্বিক ভাবে চালু হয় ১৯২৯ সাল থেকে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, অঞ্চলে বা প্রতিষ্ঠানে এখনও রয়েছে নানা ধরনের বর্ষপঞ্জি। ‘গ্রেগরিয়ান’ ছাড়াও আছে চার্চ, হিবরু, হিজরি, চীনা প্রভৃতি বর্ষপঞ্জি। উপমহাদেশে আছে শকাব্দ, বঙ্গাব্দ ও অন্যান্য আঞ্চলিক পঞ্জি। আমাদের বঙ্গাব্দের সঙ্গে সাদৃশ্য মেলে চাকমাদের ‘বিজু’, ত্রিপুরাদের ‘বৈসুক’, মারমাদের ‘সাংগ্রাই’, অসম-এর ‘বিহু’, পূর্ব পাঞ্জাব-এর শিখদের ‘বৈশাখী’ প্রভৃতি পর্ব-পার্বণের। উপমহাদেশের বাইরে শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, কমবোডিয়া প্রভৃতি দেশে রয়েছে প্রায় একই রকমের বর্ষপঞ্জি।
    বঙ্গাব্দ প্রবর্তনের নেপথ্যে রয়েছে বাংলায় ১৫৭৬ অব্দ থেকে মুগল শাসন। খাজনা আদায়ের সুবিধা হবে ? এই চিন্তা থেকে হিজরি সনের পরিবর্তে এ সন চালু করা হয় তখন ফসলের মওসুমের দিকে লক্ষ্য রেখে। সম্রাট আকবর (১৫৪২- ১৬০৫)-এর এ সংক্রান্ত নির্দেশ জারি করা হয়েছিল ১৫৮৫ অব্দের ১০ই মার্চ, তবে তা কার্যকর হয় সম্রাটের সিংহাসন আরোহনের স্মারক বর্ষ ১৫৫৬ অব্দ মোতবেক হিজরি ৯৬৩ চান্দ্র সনকে ৯৬৩ সৌর সনে রূপান্তরের মাধ্যমে। এ রূপান্তরে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন শাহি দরবারের জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতেহ সিরাজি। এজন্য বঙ্গাব্দ ‘মুগলি’ বা ‘ফসলি’ সন হিসেবেও পরিচিত।
    উপমহাদেশে পঞ্জিকা “পঞ্চাঙ্গ” নামেও পরিচিত। কারণ এতে থাকে পাঁচটি অঙ্গ ? বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ ও করণ। এই পঞ্জিকা গণনাপদ্ধতি রচিত হয়েছিল আনুমানিক ১৫০০ পূর্বাব্দে। তখন বছরকে ভাগ করা হয়েছিল ১২ মাসে। সেই মাসগুলোর নাম ছিল ? তপঃ, তপস্যা, মধু, মাধব, শুক্র, শুচি, নভস্‌, নভস্য, ইষ, উর্জ, সহস্‌, সহস্য। বর্তমান ১২ মাসের নাম রাখা হয়েছে ওই সময়ে উদিত নক্ষত্রগুলোর নাম অনুসারে। যেমন, বিশাখা ? বৈশাখ; জ্যেষ্ঠা ? জ্যৈষ্ঠ; আষাঢ়া ? আষাঢ়; শ্রবণা ? শ্রাবণ; ভাদ্রপদা ? ভাদ্র; অশ্বিনী ? আশ্বিন; কৃত্তিকা ? কার্ত্তিক; পুষ্যা ? পৌষ (পউষ); মঘা ? মাঘ; ফল্গুনী ? ফাল্গুন; চিত্রা ? চৈত্র।  অগ্রহায়ণ ছিল সেকালে পঞ্জির প্রথম মাস, এজন্য তার নামে রয়ে গেছে সেই পরিচয়।
    বঙ্গাব্দের সঙ্গে গ্রেগরিয়ান অব্দের সাযুজ্য আনার একটা চিন্তা ছিল সবসময়েই। কারণ ১লা বৈশাখ কখনও হয় ১৩ই, কখনও ১৪ই, আবার কখনও ১৫ই এপ্রিল তারিখে। ২৫শে বৈশাখ, ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ২২শে শ্রাবণ ও অন্যান্য স্মরণীয় তারিখের অব্দগত হেরফের দূর করতে ১৯৬৩ সালে বিশিষ্ট ভাষাবিদ পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র নেতৃত্বে বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি গঠন করে বাংলা একাডেমী। কমিটি অন্যান্য সুপারিশের পাশাপাশি ১৪ই এপ্রিলকে নির্ধারণ করে ১লা বৈশাখ। পরে ‘বাংলা বর্ষপঞ্জী সংস্কার কমিটি’ নামে আরেকটি কমিটির সুপারিশে ১২ই সেপটেম্বর, ১৯৯৪ অনুষ্ঠিত সভায় ১৪ই এপ্রিলকে ১লা বৈশাখ ধার্য করার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলা একাডেমী। এর পরের সভা হয় ১৯৯৫ সালের ১৩ই অগস্ট। ওই দুই সভার মাধ্যমে গঠিত টাস্কফোর্স এটি কার্যকরের সিদ্ধান্ত নেয় ১৯৯৫ সালের ১৪ই এপ্রিল থেকে। সেই থেকে ক্রমে-ক্রমে চালু হয়েছে বাংলা একাডেমী বর্ষপঞ্জি। তবে বাংলাদেশের বাইরে এ বর্ষপঞ্জি গ্রহণ করে নি কেউ। ফলে ১লা বৈশাখ, ২৫শে বৈশাখ, ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ২২শে শ্রাবণ ও অন্যান্য স্মরণীয় তারিখ পালিত হয় বাংলাদেশে এক দিন, বাংলাদেশের বাইরে অন্য দিন।
    ১লা বৈশাখ প্রথম ছুটি ঘোষণা করা হয় ১৯৫৪ সালে। এ ঘোষণা করেন যুক্তফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক। ১০ বছর পর, ১৯৬৪ সালে, এ ঘোষণা কার্যকরের সিদ্ধান্ত জানায় তৎকালীন প্রাদেশিক সরকার। ১৯৬৭ সাল থেকে রমনা বটমূলে শুরু হয় নববর্ষ উৎসব।
    বঙ্গাব্দের সঙ্গে কালক্রমে সম্পর্কিত হয়েছে আমাদের প্রতিবেশী কয়েকটি দেশ ও অঞ্চলের বর্ষপঞ্জি। ১লা বৈশাখে নববর্ষ উৎসব পালিত হবে ভারতের অসম, কেরল, ওড়িশা, তামিল নাড়ু, কর্ণাটক, রাজস্থান ও মিথিলা (প্রস্তাবিত) রাজ্যে এবং মিয়ানমার, কমবোডিয়া, লাওস, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডে। আমাদের পার্বত্য রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায় ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমা জাতি এ উৎসব পালন করে যথাক্রমে বৈসুক, সাংগ্রাই ও বিজু  ? একত্রে বৈসাবি নামে। দেশ-অঞ্চল ভেদে এমন ভিন্ন-ভিন্ন নাম রয়েছে এই বৈশাখি উৎসবের। যেমন ? রঙ্গলি বিহু (অসম), বিষু (কেরল ও কর্ণাটক), মহাবিষুব সংক্রান্তি (ওড়িশা), পূতাণ্ডু (তামিল নাড়ু ও শ্রীলঙ্কা), জুদে শীতল (মিথিলা), থিঙ্গিয়ান (মিয়ানমার), চোল চ্‌নাম থ্‌মেই (কমবোডিয়া), সোংকান / পি মাই লাও (লাওস), বিক্রম সামওয়াত / বৈশাক এক (নেপাল), অলুত অবুরুদু (শ্রীলঙ্কা)।
    যে নামই নিক নববর্ষ শুভ বার্তা নিয়ে আসুক ? এ কামনা সকলের। আমরাও স্বাগত জানাই ১৪১৯ বঙ্গাব্দকে। কিন্তু কেমন যাবে নতুন বছরটি?
    এ লেখা লিখছি লোডশেডিংয়ে জেরবার হতে-হতে। আশঙ্কা করি, এ থেকে রেহাই মিলবে না আসছে বছরেও। পণ্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ায় রাশ টেনে ধরার লক্ষণ দেখছি না, কাজেই এ ঘোড়া বছর ধরেই ছুটতে থাকবে। রাজনীতিকদের বকাঝকা ও চড়-থাপ্পড় আরও জমবে। নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে সমঝোতা হবে না। বিদেশী দাতা ও কূটনীতিকরা বুঝবেন, গতিক সুবিধার নয়। অনিয়ম ও অব্যবস্থার কারণে ধস নামবে বিভিন্ন খাতে। দুর্নীতি, সন্ত্রাস প্রকট হয়ে উঠবে আরও। ঢাকার চার নদী মুমূর্ষু হবে আরও। ভূমিকম্পে থরথর করবে মানুষে। প্রশাসনিক / সরকারি নানা বিধিনিষেধে রুদ্ধ সমাজ হয়ে উঠবে বিস্ফোরণোন্মুখ। তবে ঢাকা সিটি নির্বাচন হয়ে যাবে হুড়হাঙ্গামার মধ্যে। আর একটির পর একটি ভারতীয় ছবির শুভমুক্তি ঘটতে থাকবে সগৌরবে। আরও একটা কথা। বড় দল দু’টো অত বড় দল নয়। জোট না করে নির্বাচনে যেতে পারেন না তাঁরা। ছোট-ছোট দল তাঁদের লাগেই। আসছে বছর এই ছোটরাই খেতে থাকবে বড়দের। তারপরও... হে ১৪১৯, স্বাগত তোমাকে!

sazzadqadir@gmail.com; sazzadqadir@rediffmail.com; sazzadqadir@yahoo.com; facebook.com/sazpa85