বৃহস্পতিবার, ৩১ মে, ২০১২

সাংবাদিক তো হইছে কি?

তখন তদারক সরকারের আমল। রাস্তার এখানে-ওখানে চেকপোস্ট। আমাদের গলায় চেইন, তাতে ‘সাংবাদিক’ বা ইংরেজিতে ‘প্রেস’ লেখা কার্ড আটকানো। সে কার্ড ঢুকিয়ে রাখি বুক পকেটে। জায়গামতো আবার  ঝুলিয়েও রাখি ওই পকেট থেকে বের করে।
    কি কাজে গিয়েছিলাম উত্তরায়। ফিরছি সিএনজি চালিত বেবি ট্যাকসিতে। ফার্মগেটের ওখানে পুলিশের এক জিপ পেছন থেকে দু’-একবার টুক-টুক গুঁতো দেয়ার পর জোরেই দেয় ধাক্কা। আমি ছিটকে উঠি, আমার চশমা পড়ে যায় কোথায়, কানের কাছে মাথায় লাগে বেশ চোট। বেবি ট্যাঙি চালক জোরে ব্রেক কষেন, আবারও উঠি ছিটকে। এবার বেরিয়ে পড়ি বাইরে, চালকও আসেন বাইরে। জিপের চালকের অবশ্য ভ্রূক্ষেপ নেই কোনও, জোরে-জোরে কড়া হর্ন দিয়ে ব্যতিব্যস্ত করে রাখেন জটাক্রান্ত গাড়িগুলিকে। চালকের পাশে বসে থাকা পুলিশ আমাদের দেখে এগিয়ে আসেন, আমাকে ‘আঙ্কেল’ বলে দুঃখ প্রকাশ করেন, প্রকৃত দুঃখিত ও স্বরে আরও দু’চারটে কথা বলেন, তাঁর ব্যবহারে আমি পানি হয়ে যাই একেবারে। এই সময়ে আমার পকেট থেকে বেরিয়ে পড়া লাল ইংরেজি অক্ষরে ‘প্রেস’ লেখা কার্ডটি দেখে ফেলেন চালক, দেখেই চেঁচিয়ে ওঠেন, “এমুন কইরা ধাক্কা দিলেন? উনি একটা সাংবাদিক, কিছু একটা হইতো যদি?” আর যায় কোথা! সঙ্গে-সঙ্গে মুখ চোখ চেহারা কণ্ঠ ভঙ্গি বদলে যায় পুলিশের। রেগে ক্ষেপে চিৎকার করে ওঠেন, “সাংবাদিক! আমার গাড়িতেও ম্যাজিস্ট্রেট আছে! সাংবাদিক তো হইছে কি!” তাকিয়ে দেখি ম্যাজিস্ট্রেট গোছেরই এক চেহারা, আমার অর্ধেক বয়সী হবে, বসে আছেন নির্বিকার।
    পুলিশের আকস্মিক ভাবান্তরে কিছুটা হতভম্বই হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। হওয়া অবশ্য উচিত হয় নি। নানা কাজে ও ঘটনায় পুলিশের কাছে যেতে হয়েছে, তাদের সঙ্গে কাজও করতে হয়েছে, কিছু ব্যতিক্রম বাদে তাদের কাছ থেকে যথেষ্ট আদর-সমাদরই পেয়েছি। একাত্তরে হানাদার বাহিনীর ডেথ ক্যাম্পে শহিদ নামের যে রাজাকার কমান্ডার আমার ওপর নৃশংস নির্যাতন চালিয়েছিল, আশির দশকের গোড়ার দিকে  পুলিশ কর্মকর্তা নবাব আলী (শওকত মাহমুদের ভগ্নিপতি)-ই খুঁজে পেয়েছিলেন তাকে। তারপর আমার কথা মনে করিয়ে দিয়ে, হাতেনাতে তাকে উপযুক্ত যত্ন করতে তিনি ভোলেন নি একটুও। বর্তমান আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার যখন টাঙ্গাইলের এসপি ছিলেন তখন এক ঈদ দিনের আপ্যায়নে তাঁর সমাদরের কথা ভুলি নি এখনও। সে আপ্যায়নে আমার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন ঢাকা থেকে বেড়াতে যাওয়া আরও একজন পুলিশ কর্মকর্তা নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা ও চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেল।
সেই সাপ্তাহিক বিচিত্রা, দৈনিক সংবাদ থেকে এই দৈনিক মানবজমিন-এ কত সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় লিখেছি পুলিশকে নিয়ে। দু’একজনের কুকর্মের জন্য গোটা পুলিশ সমাজকে দায়ী করতে যাই নি কখনও। যে পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় পুলিশি জুলুমের খবর ছাপা হয়, দেখা যাবে তার ভেতরের পৃষ্ঠায় ‘চিঠিপত্র’ বিভাগে ছাপা হয়েছে ‘পুলিশ ফাঁড়ি চাই’ শিরোনামের আবেদন। পুলিশের নানা বাড়াবাড়িতে কঠোর সমালোচনা করেও রাতে যে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যাই তার কারণ তো তোলপাড় ঝড় জল বৃষ্টি বা কনকনে শীত বা গনগনে গরমে ওঁরা বাইরে  জেগে থাকেন, পাহারা দেন রাস্তায়-রাস্তায় - পাড়ায়-পাড়ায়। কবি অজিত দত্ত (১৯০৭-১৯৭৯) লিখেছেন, “নিশীথ রাত্রে নিদ্রিত ধরার প্রতিনিধি পুলিশ একাকী জাগে রোজ।” ভ্রমণোপন্যাসিক অবধূত (১৯১০-১৯৭৮)  লিখেছেন, “... যাদের হুকুমে পুলিশ লাঠি চালায় - তারা দায়ী নয়, দায়ী হতে গেল কুড়ি টাকা মাইনের চাকরগুলো!” কথাসাহিত্যিক আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩) লিখেছেন, “দারোগা বলে যত ঠাট্টাই করুক, ঠেকায় সকলকেই দারোগার দ্বারস্থ হতে হয়।” সতীনাথ ভাদুড়ী (১৯০৬-১৯৬৫)-ও লিখেছেন, “পুলিশ নিমকহারাম নয়; - যার নুন খায় তার গুণ গায়।” তবে সবাই সমর্থন করতে পারেন নি অত। কথাসাহিত্যিক সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় (১৮৮৪-১৯৬৬) লিখেছেন, আইন তো পুলিশের হাতের খেলনা মাত্র! কথাশিল্পী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১) লিখেছেন, পুলিশ সাপ হয়ে দংশায়, রোজা হয়ে ঝাড়ে। সমরেশ বসু (১৯২৪-১৯৮৮) প্রশ্ন করেছেন, পুলিশ কি পাপ অন্যায়ের ধার ধারে? সাহিত্যিক-চলচ্চিত্রকার প্রেমাঙ্কুর আতর্থী (১৮৯০-১৯৬৪)-র লেখায় বিস্ময়-প্রশ্ন, “পুলিশে চাকরি করো বলে কি মানুষের চামড়া তোমার গায়ে নেই!” সবচেয়ে কড়া কথাটি রবীন্দ্রনাথই লিখেছেন, “পুলিশ একবার যে চারায় অল্পমাত্রও দাঁত বসাইয়াছে সে চারায় কোনও কালে ফুলও ফোটে না, ফলও ধরে না। উহার লালায় বিষ আছে।” (‘ছোটো ও বড়ো’)
১৯৮৩ সালে এক পুলিশ কর্মকর্তা আমার সাংবাদিক পরিচয় জেনে ‘খালাতো ভাই’ বলেছিলেন আমাকে। জিজ্ঞাসা করায় বলেছিলেন, “আর ক’ মাস পর অবসরে যাবো। পুলিশের চাকরি করে সবই দেখলাম। আমাদের ওপর দায়িত্ব - আদালতে যাতে সুবিচার হয় তার যোগাড়যন্ত্র সব ঠিকঠাক করা। আমরা তা করি না। আপনাদের ওপর দায়িত্ব সত্য কথা লেখার। আপনারা তা লেখেন না। জনগণ আমাদের উভয়কেই ঘৃণা করে!”
sazzadqadir@rediffmail.com

মঙ্গলবার, ২৯ মে, ২০১২

ঊর্মিমালা ও জগন্নাথ

পশ্চিমবঙ্গের নন্দিত বন্দিত বাচিক শিল্পী ঊর্মিমালা বসু-কে ধন্যবাদ জানাবো না, তবে সারা জীবন মনে রাখবো তাঁকে। আমার এই জীবন দুঃখ-দারিদ্র্যে লাঞ্ছিত বঞ্চিত বিড়ম্বিত হলেও অনেক অভাবনীয় অকল্পনীয় শুভাশিসে ধন্য হয়েছে বহুবার। সে সব আশিস্‌ যেভাবে গ্রহণ করেছি মনপ্রাণ ভরে, স্মরণে বরণীয় করে রেখেছি অসীম কৃতজ্ঞতায় - ঠিক তেমন করেই ঊর্মিমালা’র দান থাকবে আমার পরম পাওয়ার সঞ্চয়ে। তিনি কি করে আমাকে চিনলেন, আমার কবিতাকে ভালবাসলেন - সে এক বিস্ময়! তারপর সারদা-তারা মিউজিক-এর ‘আজ সকালের আমন্ত্রণে’ অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করলেন আমার ‘এখন’ কবিতাটি - সে আরও এক বিস্ময়। অনুষ্ঠানটির বেশির ভাগ অংশ দেখার সুযোগ হলেও ওই আবৃত্তির অংশটুকু দেখতে পারি নি - ঠিক তখনই ঝুপ করে লোডশেডিং নেমে আসায়। এ কারণে লোডশেডিং এবং এর সংশ্লিষ্ট সব কিছুকে শক্ত অভিশাপ দিয়েছি চীনা ভাষায় - বাংলা ভাষায় মনের মতো যুতসই কথা খুঁজে না পাওয়ায়।
    ঊর্মিমালা ও তাঁর স্বামী জগন্নাথ বসু - দুই কীর্তিধন্য বাচিক শিল্পী বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতে অত্যন্ত সুপরিচিত দুই ব্যক্তিত্ব। ‘সোনায় সোহাগা’, ‘মানিকজোড়’, ‘রাজযোটক’ প্রভৃতি শব্দবন্ধে এই যুগলের বর্ণনা সঠিক হবে না বলে এখানেই থামছি, আশা করছি তাঁদের জন্য নতুন কোনও রূপশব্দ খুঁজে পাবো - নয় নিজেই কোনও দিন পারবো তৈরি করে নিতে। আচ্ছা, ‘জগমালা বসু’ বললে কেমন হয়?
    ঊর্মিমালা তুলনামূলক সাহিত্যে এম এ করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পেশাদার শ্রুতি নাটকের জগতে তারকা হয়ে ওঠার অনেক আগে, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. রমা চৌধুরী (১৯১১-১৯৯১)-র তত্ত্বাবধানে সংস্কৃত নাটকে তিনি অভিনয় করতেন বেতারে ও মঞ্চে। ওই সময়টায় বিয়ে হয়, ১৯৭১ সালের ১০ই অগস্টে। নিউ আলিপুরের বিদ্যাভারতী স্কুলে শিক্ষকতা করছিলেন, তখন ঊর্মিমালার বিশেষ ঝোঁক পড়ে শ্রুতিনাটকের দিকে। ১৯৭২ সাল থেকে শুরু করেন অল ইনডিয়া রেডিও’র ‘বিবিধ ভারতী’ সার্ভিসের নাটকে অভিনয়। পরে কলকাতা কেন্দ্রে নাটকে অডিশন দিয়ে উত্তীর্ণ হন। নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি দীর্ঘকাল উপস্থাপক ছিলেন আকাশবাণী কেন্দ্রের ‘এফএম, কলকাতা’র। ১৯৮৩ সালে, স্বামীর সঙ্গে মিলে ঊর্মিমালা গড়ে তুলেছেন উন্মেষ বাচনিক শিক্ষা কেন্দ্র। এর মাধ্যমেই তাঁরা প্রথম আয়োজন করেন সাড়াজাগানো ‘শ্রুতিনাট্যোৎসব’ (১৯৮৪)। ২০০৭ সাল থেকে উন্মেষ-এর শাখা ‘কথানদী’র একক চালিকা ঊর্মিমালা।
মঞ্চে তাঁর প্রথম অভিনয় করেন ১৯৭৬ সালে, স্বামী পরিচালিত ‘আত্মজা’ নাটকে। সেই থেকে জড়িয়ে আছেন মঞ্চাভিনয়েও। সুন্দরম্‌ প্রযোজিত ‘অলকানন্দার পুত্রকন্যা’য় তিনি ছিলেন নামভূমিকায়। এ নাটকের প্রদর্শনী হয়েছে দু’ শ’রও বেশি। ১৯৯০ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নাট্য একাডেমি এ নাটককে দিয়েছে ‘শ্রেষ্ঠ প্রযোজনা’র পুরস্কার, মুখ্য চরিত্রের অভিনেত্রীকে দিয়েছে ‘শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী’র সম্মাননা। ওই বছর ভারতের সেরা সাংস্কৃতিক সাফল্য হিসেবে এশিয়া পেইন্টস লি.-এর ‘শিরোমণি পুরস্কার’ও পেয়েছে নাটকটি। উল্লেখ্য, সুন্দরম্‌ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৭ সালে, প্রখ্যাত নাট্যজন মনোজ মিত্র, পার্থপ্রতিম চৌধুরী প্রমুখের উদ্যোগে। এ গোষ্ঠীর ‘মুন্নি ও সাত চৌকিদার’ নাটকেও অভিনয় করেছেন ঊর্মিমালা। খ্যাতিমান নাট্যজন রমাপ্রসাদ বণিক (১৯৫৪-২০১০)-এর ‘থিয়েটার প্যাশন’-এর প্রযোজনায় অভিনয় করেছেন ‘ত্রাতা’ নাটকে। এছাড়া অভিনয় করেছেন অসিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘আকরিক’ (‘চুপকথা’ প্রযোজিত), অলোক দেব পরিচালিত ‘কেনারাম বেচারাম’ (‘প্রতিকৃতি’ প্রযোজিত), দেবেশ চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘চলমান অশরীরী’ (‘কল্পায়ু’ প্রযোজিত) প্রভৃতি নাটকে। টেলিফিল্ম, মেগা সিরিয়াল প্রভৃতিতে পরিচিত মুখ ঊর্মিমালা। ‘তৃষ্ণা’, ‘সোনার হরিণ’ প্রভৃতি মেগাসিরিয়ালে তাঁর অভিনয় নিশ্চয়ই মনে আছে অনেকের। বড় পরদাতেও ঊর্মিমালা’র উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। শতরূপা সান্যাল পরিচালিত ‘অনু’, অঞ্জন দাস পরিচালিত ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’ (২০০৭) প্রভৃতি তাঁর অভিনীত ছবি। কিছু দিন আগে অভিনয় করেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষের হিন্দি ছবি ‘সানগ্লাস’-এ। ছবিটি এখন মুক্তিপ্রতীক্ষায়।
    পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বসু-দম্পতি ঢাকা এসেছিলেন গত ১৩ই এপরিল (৩০শে চৈত্র), ২০১২। এর আগে জানুয়ারিতে এসেছিলেন রণেশ দাশগুপ্তের স্মৃতি-অনুষ্ঠানে, তখন আমি ছিলাম হাসপাতালে। এবার আসার পর যোগাযোগ হতেই জানা গেল ওঁরা আছেন আমার বাসার কাছেই এক হোটেলে। সেখানে দেখা ও কথা হয় কয়েক মিনিট। অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত হয়ে রুমে বসেছিলেন ওঁরা, গাড়ি নিয়ে গাইডের আসার অপেক্ষায়। ঊর্মিমালাকে দেখে বিশ্বাস হতে চায় নি প্রথমে, ছবিতে যেমন দেখা যায় তার চেয়ে অনেক স্মিতমধুর তিনি, ছোটবেলায় দেখা পাড়ার ভট্টাচার্য-বাড়ির প্রতিমার মতো। দু’ চোখের বিবাদ ঘোচাতে তাই ছুঁয়ে দেখতে চাই হাত বাড়িয়ে। হেসে হাত এগিয়ে দেন ঊর্মিমালা। এরপর পরিচিত হই জগন্নাথ বসু’র সঙ্গে। আলোচনা শুরু হয় কলকাতায় আমাদের অভিন্ন পরিচিতদের নিয়ে। প্রথমে কবি প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়ের কথা। তাঁর কবিতাও ঊর্মিমালা আবৃত্তি করেছিলেন সেদিন ‘আজ সকালের আমন্ত্রণে’ অনুষ্ঠানে। এক সময় প্রতিবেশী ছিলেন ওঁরা। আর কাকতালীয় ভাবে, কবি তারাপদ রায়ের প্রয়াণের পর যে উদার স্নেহাশিস্‌ থেকে আমি বঞ্চিত হয়ে আছি, তা এখন কানায়-কানায় পূর্ণ করে দিয়েছেন কবি প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথা নিয়েই তারাপদ রায়ের কথা ও কাহিনী একে-একে স্মৃতি থেকে উদ্ধার করি তিনজনে। এর মধ্যে ঊর্মিমালা ব্যাগ খুলে বের করেন কলকাতা থেকে আমার জন্য নিয়ে আসা উপহার - রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প অবলম্বনে দু’টি শ্রুতিনাটক ‘রবিবার’ ও ‘ভুল স্বর্গ’; হিমানীশ গোস্বামী, বিমল কর, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, বনানী মুখোপাধ্যায়, বিধায়ক ভট্টাচার্য্য, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ও মনোজ মিত্রের রচনা অবলম্বনে ১০টি ‘সরস শ্রুতিনাটক’ এবং জগন্নাথ বসু’র স্মৃতিকথা ‘বেতারের কথকতা এবং’ (আনন্দ, ২০১০)। অসামান্য সব উপহার, কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা ভুলে যাই। বলি, আপনারা বাচিক শিল্পী... কিন্তু আমি তো অর্বাচিক।
    জগন্নাথ বসু বলেন, তারাপদ রায়ের সঙ্গে যে আপনার কতখানি কি মেলামেশা ছিল তা বুঝলাম। উনি এমন করেই কথা বলতেন।
    অনুষ্ঠানের গাইড, গাড়ি ও তাড়া এসে যায় এর মধ্যে। হোটেলের আট তলা থেকে নিচে নামতেই কবি হাসান হাফিজ যোগ দেন আমাদের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত এক কর্মসূচি ছিল আমার। পরিচয় করিয়ে দিতেই জগন্নাথ বসু বলেন, আপনার নাম জানি। চিনি আপনাকে।
    একটু অবাক হন হাসান হাফিজ। তারপর কথা এগিয়ে চলে ওঁদের।
    আসলে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতে হাসান হাফিজ শুধু সুপরিচিত নন, ‘দেশ’ পত্রিকার ঢাকা প্রতিনিধি হিসেবে - সেই তখন থেকে - গোটা বাংলাভাষী জগতে বিশেষ সুপ্রিয়ও তিনি। আমাদের দু’চার কথায় পরিচয় মেলে সেই প্রিয়তার।
    রাতে টেঙট মেসেজে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা, কুশল ও বিদায় ঊর্মিমালা’র সঙ্গে। এর পর সময় কাটে জগন্নাথ বসু’র অন্তরঙ্গ স্মৃতিকথায় ডুবে। প্রখ্যাত অভিনেতা প্রেমাংশু বসু’র ভাইপো তিনি, আকাশবাণী-দূরদর্শন কলকাতা কেন্দ্রের প্রযোজক ছিলেন, প্রশাসনিক কর্মকর্তাও ছিলেন। এখন অতিথি অধ্যাপক যাদবপুর ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের। তাঁর স্মৃতিকথা ষাট-সত্তর দশকের আকাশবাণীর বেতার-নাটক ও কলকাতার মঞ্চ-নাটকের নানা বৃত্তান্ত, নাট্যশিল্পীদের  অনেক কৌতূহলোদ্দীপক কথা ও কাহিনী, সেই সঙ্গে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার বর্ণনা এবং দুর্লভ কিছু আলোকচিত্রে সমৃদ্ধ। ওই সময় আকাশবাণী’র নাটকের মুগ্ধ শ্রোতা ছিলাম আমি। ‘বেতারের কথকতা এবং’ পড়তে-পড়তে তাই ফিরে যাই সেই সময়ে, জানতে পারি আমার ভাল লাগা অনেক নাটকের প্রযোজক ছিলেন তিনি।  আরও জানতে পারি সে সব নাটক প্রযোজনার নেপথ্য কাহিনীও কম নাটকীয় ছিল না মূল নাটকের চেয়ে। আমার ক’জন প্রিয় শিল্পীর কণ্ঠবৈশিষ্ট্যের প্রায় নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন জগন্নাথ বসু ু “রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের ভরাট কণ্ঠস্বরে রোম্যান্টিক অভিনয়, নির্মলকুমারের স্মার্ট উচ্চারণ, সুন্দর বাচনভঙ্গি, শেখর চট্টোপাধ্যায়ের জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বরে খলনায়কের পার্ট, নীলিমা দাস ও কণিকা মজুমদারের মানসিক টানাপড়েনের অনবদ্য চরিত্রায়ণগুলো আজও সজীব হয়ে আছে মনে।... নীলিমা দাসের গলায় ছিল বিষাদ, রোমান্টিকতা, আভিজাত্য, গভীরতা, অন্যদিকে লাস্যময়ী ঝুমুরওয়ালির ভাবসাবও।... গলা দিয়ে বিভিন্ন বয়স, মুড প্রকাশ করাটা শ্রীমতী দাসের কাছে সবসময়ই থ্রিলিং ব্যাপার।... মঞ্জু দে আর বিনতা রায়ের পরিশীলিত বাচনভঙ্গি, ব্যক্তিত্ব আর বুদ্ধিদীপ্ত ভাবটা ছিল বেশি। শ্রীমতি দে-র প্রতিটি সংলাপ উচ্চারণ স্বাভাবিক, অর্থবহ।... পরিশীলিত উচ্চারণ ও সুকণ্ঠের জন্য খ্যাতি ছিল অনুভা গুপ্ত-র।... বনানী চেীধুরী (র)... কণ্ঠেও ছিল আভিজাত্য। সবিতা বসু’র গলার আদুরে ভাব, বাসবী নন্দীর স্নিগ্ধতা, মীনাক্ষি গোস্বামির ব্যক্তিত্ব, শিপ্রা মিত্রের খসখসে অল্প ধরা ধরা ভাব,... শেফালি দে, মিতা চট্টোপাধ্যায়ের উচ্চারণে আঞ্চলিক ভাষা প্রাণবন্ত হয়ে উঠতো।...”
    আর আমাদের টাঙ্গাইলের জয়শ্রী সেন, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ নাটকে কুবের-ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপরীতে তাঁর সেই কপিলা’র “হেই মরদ...”, তারপর বুকের রক্তে আগুন ধরানো খলখলে হাসি? জগন্নাথ বসু ঠিকই লিখেছেন, “জয়শ্রী সেনের ফিসফিসিয়ে বলা প্রলুব্ধকারী সংলাপ...”। আর তাঁর ঊর্মিমালা সম্পর্কে - “বিবিধভারতী থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে বেতার অভিনয়ে পরিণত হয়েছেন ঊর্মিমালা। কণ্ঠ ও বাচনভঙ্গিমাকে এক লহমায় বদলে ফেলে তিনি নানান ধরনের চরিত্রে সাবলীল হয়েছেন।”


sazzadqadir@gmail.com

শনিবার, ২৬ মে, ২০১২

খাঁটি, বিশুদ্ধ এবং নির্ভেজাল

সবাই জানেন, সম্পদ অর্জনের শ্রেষ্ঠ উপায় বাণিজ্য। সেকালের পণ্ডিতেরাও বলেছেন, ধন ও ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মী বাস করেন বাণিজ্যেই। তবে একালে বাণিজ্যের জন্য বণিক হওয়ার প্রয়োজন নেই। এখন যে ধরনের বাণিজ্যের রমরমা চলছে- ভর্তি বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, গ্রেপ্তার বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য, লাইসেন্স-পারমিট বাণিজ্য, শেয়ার বাণিজ্য ইত্যাদি- এ সবে যাঁরা জড়িত তাঁরা পরিচিত অন্য নামে। এখানে আসল ব্যাপার, সোজাই বলি, ঘুষ দেয়া-নেয়া। ঘুষ খাওয়া। এ খাওয়াটা খারাপ নয়। যদ্দূর জানি, ঘুষে কোনও ভেজাল নেই। একেবারেই খাঁটি ও বিশুদ্ধ বস্তু এই ঘুষ। এতে কাঁকর, ইঁটের গুঁড়া, কারবাইড, ফরমালিন, প্রিজারভেটিভ, কেমিক্যাল, রঙ, পোড়া মবিল, ওয়াসা’র পানি ইত্যাদি কিছু নেই। এখানে গরুর নামে মোষের গোশত, খাসি’র নামে ছাগল-ভেড়ার গোশত, মুরগির নামে কাছিমের ডিম খাওয়ানো চলে না। ওগুলো আছে আমাদের জন্য। আমরা মানে এই যারা চলি বাঁধা আয়ে, মাসের শেষ সপ্তাহে যারা চলি প্রায় পুরোপুরি কৃচ্ছ্রসাধন করে, দিনের এক বেলা ব্রেঞ্চ খেয়ে। অবশ্য এমনিতেও অভ্যস্ত আমরা ব্রেঞ্চ-এ। ব্রেঞ্চ মানে ব্রেকফাস্ট না করে একটু আগে-আগে লাঞ্চ সারা। তা সে ব্রেঞ্চেই বা কি খাই? কোন জিনিস কি খেতে পারি নিশ্চিত মনে? কিন্তু খাই, বেঁচে থাকার আশায় বাধ্য হয়ে খাই। তারপর শুরু হয় বেঁচে থাকার যাবতীয় যন্ত্রণা। ভেজাল খেয়ে এ অসুখ ও অসুখ বাঁধিয়ে ভুগি। দামি ওষুধ কেনার ভয়ে প্রথম দিকে চলি সহ্য করে। তারপর মর-মর অবস্থা হলে ডাক্তার ও ওষুধের পেছনে যৎসামান্য যা কিছু সঞ্চয় সব ফুরিয়ে আর পথ্য জোটাতে পারি না। ফলে অসুখ আর ছাড়েও না। কিছু দিন দমে থাকে, তারপর সময় সুযোগে এমন চেপে ধরে যে দম উঠে যায় নাকে। তখন চিকিৎসা কি হবে? কিভাবে হবে? না, দেশের চিকিৎসা-ব্যবস্থার কথা বলছি না- সে সব সবাই জানেন আপনারা, না হয় আরেক দিন বলবো। পরে দেখা যায়, এমন অসুখ বেঁধে গেছে যে লাখ-লাখ টাকা দরকার। কোত্থেকে আসবে এত টাকা? আমরা যারা ৯৯%, আমাদের সকলের অবস্থা তো একই রকম। আমাদের আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব সবারই তো একই দশা। তারপর সাহায্যের জন্য প্রার্থনা। সে এক মহাবিড়ম্বনা। আত্মসম্মান বিসর্জন দেয়ার চেয়েও দুঃসহ হয়ে পড়ে তা কখনও। সাহায্য পাওয়ার চেয়েও কঠিন হয়ে পড়ে সাহায্য প্রার্থনার প্রকাশ-প্রচার। ফেসবুক-এর বেশির ভাগ বন্ধুই শেয়ার পর্যন্ত করতে চান না মানবিক সাহায্যের আবেদন। তারপর কোনক্রমে মিডিয়ায় কিছুটা প্রকাশ-প্রচার করা গেলেও সাহায্য সহজে জোটে না, সবার জোটে না। যদি জুটে যাওয়ার মতো অভাবনীয় কিছু ঘটে যায়, তাহলে মরতে-মরতে বাঁচা যায় হয়তো, আর যাদের জোটে না? হাসপাতালের সিঁড়িতে বা বারান্দায়, অথবা আর্থিক অক্ষমতার এক ভয়ঙ্কর বিপন্নতায় নিমজ্জিত স্বজনের চোখের সামনে ধুঁকে-ধুঁকে মরা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে কি তাদের?
এখন বলুন, এমন পরিণতি কি চান কেউ? সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে সম্পূর্ণ বৈধ জীবন যাপনের এমন প্রতিফল? তাহলে আপৎকালের সম্বল যোগাড় করে রাখার উপায় কি বাণিজ্য ছাড়া? বলবেন, কোন বাণিজ্য? খাঁটি, বিশুদ্ধ ও নির্ভেজাল বাণিজ্য তো ওই একটাই। ঘুষ বাণিজ্য। এর বিকল্প আছে কি? আশির দশকের প্রথম দিকে, তখন আমি দৈনিক সংবাদ-এর সহকারী সম্পাদক, এক সম্পাদকীয় বৈঠকে কথায়-কথায় ‘সংবাদ’-সম্পাদক আহমদুল কবির বলেছিলেন সমঝোতার মাধ্যমে এক সমাধানের কাহিনী। ওই সময় তিনি ছিলেন জাতীয় সংসদ সদস্য। তাঁর এলাকার থানার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ‘বেতনের টাকায় সংসার চলে না, কাজেই উপরি চাই... তা মাসে তোমাদের কত হলে আর উপরি লাগবে না, ডিউটি ঠিকমতো করবে, চুরি-ডাকাতি ঠেকাবে?’ হিসাব করে একটা অঙ্ক জানাবার পর এলাকাবাসী নিজেদের উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাসে-মাসে তা জমা দিয়েছে যথাস্থানে। এতে ফল দিয়েছে, এলাকাবাসী থেকেছে নিরুপদ্রব শান্তিতে।
ভেবে দেখুন, এমন আরও কোনও বিকল্প আছে কিনা!
sazzadqadir@gmail.com

শনিবার, ১৯ মে, ২০১২

না বাবা, না!

একটা সময় ছিল যখন রাজনীতিকদের মুখের ভাষার মতো তাদের পরনের জামা-কাপড়ও ছিল বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এ নিয়ে একটা ছড়াও জনপ্রিয় ছিল তখন- ‘জনতা আমার হার্ট, পতাকা আমার শার্ট’। তাদের জীবন ছিল রাজনৈতিক তৎপরতায় যেমন কর্মময়, তেমন সংঘাত ও উত্তেজনাপূর্ণ। মাইক-মঞ্চ ভাঙচুর, প্রতিপক্ষের হামলা, পুলিশের লাঠিপেটা, মামলা, কারাভোগ- এসব ছিল রাজনীতিকদের জন্য পুষ্পচন্দন। পাশাপাশি রিলিফের কম্বল-গম, লাইসেন্স-পারমিট, টেন্ডার, চাঁদা, হুন্ডা-গুন্ডা, তদবির, কমিশন, কালো টাকা, কালো বিড়াল ইত্যাদিও শিরোভূষণ হয়েছে তাঁদের। এখন চিত্র পালটেছে অনেক। নেতানেত্রীদের ধারেকাছে যাওয়া সম্ভব হয় না সাধারণ মানুষের পক্ষে। হাতা-চামচারাই তাদের আগলে রাখে সবসময়। পাজেরো-নোয়া হাঁকিয়ে তারা জনসভায় আসেন, সোজা গিয়ে মঞ্চে ওঠেন, ভাঙা রেকর্ড বাজান গলা ফাটিয়ে, তারপর আবারও পাজেরো-নোয়া হাঁকিয়ে চলে যান জনতার মুখে ধুলো ছুড়তে-ছুড়তে। থাকেন অভিজাত গুলশান-বারিধারায়। হাই-ফাই লাইফ। এমনিতে ফিটফাট চমৎকার সব কিছু। ক্ষমতা গেলেও কানেকশন যায় না, কালেকশন-ও থাকেই। মুশকিল হয় যখন আন্দোলন এসে পড়ে। তখন মফস্বলে গিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে না, রাজপথে গ্যাস-লাঠি খেতে মন চায় না, আর হাজতবাস-কারাবাস? অনশন-পদযাত্রা? না বাবা, না। এসি, ফ্রিজ, হোম থিয়েটার লালিত-পালিত জেট-সেট জীবনে নাদুসনুদুস হয়ে পড়া শরীরে কি আর সইবে ও সব? নেলসন মানদেলা’র কারাজীবনের কাহিনী বলে মুখে তুবড়ি ছোটানো যায়, নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করে ভেঙে সব লোপাট করা যায়- কিন্তু কারাদুর্ভোগ মোকাবেলা? দিনের পর দিন অনশন? পদযাত্রা? না বাবা, না। য পলায়তি স জীবতি। সেটাই রাজনৈতিক কৌশল।
পৃথিবীর সকলের কাছে সকল কাজের পক্ষেই যুক্তি আছে, আর রাজনীতিতে তো শেষ কথা বলে কিছু নেই। সে কাজে প্রয়োজনমতো যা কিছু বলা যায়, আবার ঠেকায় পড়লে তার উলটো কাঁদুনি-ও গাওয়া যায়। এজন্য রাজনীতিকরা কখনও সিক্ত হন পুষ্পবৃষ্টিতে, আবার কখনও ক্ষতাক্ত রক্তাক্ত হন ইট-পাটকেলে। কখনও তাঁদের মাথায় তুলে নাচে জনতা, কখনও আবার জনতার ধাওয়া খেয়ে তাদের হতে হয় দৌড় সালাউদ্দিন। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘কাজের চেয়ে প্রতিশ্রুতি বড়। সবসে বড়া রাজনীতি। নীতি মানে নিয়ম বা নিষ্ঠা নয়, ক্ষমতা অধিকারের শক্তি। সেই শক্তি হলো বক্তৃতা। বক্তৃতা হলো শব্দের সমষ্টি। শব্দই ব্রহ্ম।’ এই ‘প্রতিশ্রুতিশীল’ রাজনীতি সম্পর্কে সোভিয়েত নেতা নিকিতা সেরগেয়েভিচ খ্রুশচেভ (১৮৯৪-১৯৭১) একবার এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে নির্বাচন হয় ব্যালট বক্সের মাধ্যমে। সে নির্বাচনে ভোটের জন্য প্রচার চালাতে হয় জোরেশোরে। ভোটদাতাদের খুশি করার জন্য প্রার্থীরা দেন নানারকম আকর্ষণীয় প্রতিশ্রুতি। এ রকম এক প্রার্থী নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে বলেন, আপনারা যদি আমাকে ভোট দিয়ে জেতান তাহলে এলাকায় আমি স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল করবো। রাস্তা পাকা করবো। জনতা বলে, এসব তো অমুক প্রার্থী করবে বলে গেছে। আপনি অন্য কি করবেন তা-ই বলুন? তখন সেই প্রার্থী বলেন, এলাকায় আসতে গিয়ে দেখলাম কোথাও কোনও ব্রিজ নেই। তাই আমি কথা দিচ্ছি, নির্বাচনে জেতার পর আমার প্রথম কাজ হবে এলাকায় একটি ব্রিজ তৈরি করা। জনতা বলে, কোথায় ব্রিজ তৈরি করবেন? এ এলাকায় কোনও নদী নেই। প্রার্থী দমেন না। বলেন, তাতে কি? প্রয়োজনে আগে নদী খুঁড়বো, তারপর ব্রিজ করবো।’
রাজনীতিতে এক দলকে কারাগারে পাঠিয়ে আরেক দল ভাবে দমন-নির্যাতন চালালেই ঢিঢ হবে প্রতিপক্ষ। কিন্তু তারা জানেন না, প্রতিপক্ষ ঢিঢ হওয়ার চেয়ে বেশি হয় দমন-নির্যাতন বিশেষজ্ঞ। সেই বিশেষ জ্ঞান তারা যথেষ্ট সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগ করেন ক্ষমতাসীন হওয়ার পর। গত চল্লিশ বছর ধরে এভাবেই দল, সরকার, প্রশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য, দুর্নীতি, দুরাচার ইত্যাদি শিক্ষাগ্রহণ ও প্রয়োগকরণ চলছে একাক্রিমে। ওদিকে যে দল কারাগারে যেতে ভয় পায় তারা আবার জানেন না- তাদের যারা কারাগারে পাঠান তারাও আছেন এক ঘোরতর কারাগারে। সে কারাগার প্রতিশ্রুতির। তারা শ’ শ’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নির্বাচনের আগে। সেগুলোর বাস্তবায়ন কতখানি কি করেছেন ক্ষমতাসীন হয়ে- সে সব প্রশ্ন তুলে তাদেরও তারা রাখাতে পারেন জনতার নিত্য কারাগারে। তখন তারাও কানে আঙুল দিয়ে বলতে চাইবেন- না বাবা, না!
sazzadqadir.rediffmail.com

মঙ্গলবার, ১৫ মে, ২০১২

একটি আবেদন

এ আবেদন পৃথিবীর সকল অতি আদরের ছোট ভাইদের একজন শাহ নূর মাসুদ-এর জন্য। আমার পরে তিন বোন ও এক ভাই, তারপর ও। বয়স আমার চেয়ে ১০ বছরের কম। জন্ম নেয়ার পর বড় হয়েছে আমার কোলে-পিঠে। ওর সেই ছোট-ছোট কোমল হাতের স্পর্শ এখনও লেগে আছে আমার হাতে-মুখে। ভালবাসতো আমার গলা ধরে ঝুলে থাকতে। সেই স্পর্শ এখনও পাই আমার গলায়, বুকে-পিঠে। জিভ একটু ভারি ছিল ছোটবেলায়। মোটরকে মডর, মাসটারকে মাসডর বলতো তখন। ডাকনাম তৈমুর। ওই নামই, মারমুখো কোনও চরিত্রই নয় ও। সারা জীবন মারই খেয়েছে বরং। ১৯৮৩ সালের ১৪ই ফেবরুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কালো দিবস। সেদিন স্বৈরাচারের বাহিনী ক্যামপাস থেকে প্রতিবাদী ছাত্রদের এলোপাতাড়ি ধরে নিয়ে যায়, গুম-নিখোঁজ করে রাখে মাসের পর মাস। ওই বাহিনীর হাতে আটক হয়ে তৈমুর নিখোঁজ ছিল এক মাসের বেশি। কুমিল্লা জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর কেবল জানতে পারি ও কোথায় ছিল কিভাবে। কারাকক্ষে ওর সঙ্গীদের একজন ছিলেন তখনকার উদীয়মান ছাত্রনেতা শামসুজ্জামান দুদু। আটক অবস্থায় নৃশংস নির্যাতনের শিকার হয়েছিল তৈমুর, একাত্তরে আমি যেমন হয়েছিলাম হানাদার বাহিনী ও তার দোসরদের হত্যাশিবিরে। ওই নির্যাতনে শারীরিক ও মানসিক ভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয় তৈমুর। শিক্ষাজীবন ব্যাহত হয় ওর। একাউন্টেসিতে অনার্স পাস করলেও মাসটার্স করা সম্ভব হয় নি ওই রকম এক বিপর্যস্ত অবস্থায়। ফলে আশানুরূপ কেরিয়ার গড়ে তুলতে পারে নি ও। সাধারণ একজন কর্মজীবী হিসেবে সততা ও সুনামের সঙ্গে জীবন কাটিয়েছে আহমদুল কবির, সৈয়দ ফাহিম মুনএম, শামীম আল মামুন, তৌফিক এম সেরাজ প্রমুখ পরিচালিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। সীমিত আয়ে কৃচ্ছ্রসাধন করে চলেছে বংশানুক্রমিক পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী। স্ত্রী খুরশিদা আকতার হিলালি গৃহিণী, কন্যা অন্তরা রাজধানীর সিটি কলেজে বিবিএ প্রথম বর্ষের ছাত্রী। এ অবস্থায় জটিল Guillain-Barré Syndrome-এ আক্রান্ত হয়ে তৈমুর গত ২রা মে থেকে চিকিৎসাধীন আছে বারডেম-এর আইসিইউ-তে। অত্যন্ত ব্যয়বহুল এ চিকিৎসার ভার বহন করা ওর পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয় কোনও মতে। তৈমুরের মতো ওর আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব সকলেই প্রায় অসচ্ছল ও বিত্তহীন। আর্থিক অক্ষমতা যে কত ভয়ঙ্কর তা  বিপন্ন ছোট ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে একজন বড় ভাই হিসেবে গভীরভাবে হৃদয়ঙ্গম করছি আজ। এ অবস্থায় সমাজের কাছে, দেশ-বিদেশের সকলের কাছে মানবিক সাহায্যের জন্য আমার এই আবেদন -  তৈমুরকে বাঁচিয়ে রাখতে চিকিৎসা অব্যাহত রাখার সহযোগিতায় এগিয়ে আসুন। একটি নিঃস্ব রিক্ত পরিবার আপনাদের অপেক্ষায় আছে প্রতিটি মুহূর্তে। - সাহায্য পাঠানোর ঠিকানা: Khurshida Akter, SB a/c no 10813, Islami Bank, Dhanmondi Branch, Dhaka. Cell. 01712 859026.

বৃহস্পতিবার, ১০ মে, ২০১২

আপনি মোড়ল ও বিশ্ব গাড়ল

রাজশাহী থেকে শামীম হোসেনের সম্পাদনায় বেরোয় ‘শিল্প সাহিত্যের ছোটকাগজ’ নদী। এ পর্যন্ত বেরিয়েছে ১১টি সংখ্যা। সর্বশেষ সংখ্যা এপ্রিল ২০১২ হাতে পেলাম এই মাত্র। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ। মোহাম্মদ নূরুল হক লিখেছেন, “... কবিতার সবচেয়ে বড় শত্রু ‘উপকবি’। এ উপকবিই পাঠকমনে কবিতা সম্পর্কে বিরূপ ধারণার জন্ম দেয়ার জন্য দায়ী। তাই ‘উপকবি’কে কবির ছায়ার নিচে মাড়িয়ে দিলে সে ছায়া থেকে বড় কবির আত্ম-উদ্বোধন সম্ভব।” প্রবন্ধকার ‘উপকবি’র পরিচয় একটু খোলাসা করে দিলে বেশ উপকার হতো আমার। সাহিত্যজগতে এই উপগ্রহ ধরনের কিছু প্রাণীকে দেখা যায় সবসময়েই। এরা প্রচার-প্রকাশ মাধ্যমগুলো এক প্রকার দখল করেই রাখে, আর পুরস্কার-পদক সব বাগায় অবলীলাক্রমে। তবে এ জেল্লা বেশি দিন থাকে না তাদের। কিছু দিন পর অন্য উপগ্রহরা ঢুকে পড়ে ক্রমে-ক্রমে। আমরা ‘উপগ্রহ’ বলি যাদের - মোহাম্মদ নূরুল হক তাদেরই ‘উপকবি’ বলছেন না কিনা তা বুঝতে পারতাম যদি বর্ণনায় একটু বিশদ হতেন তিনি। আমরা অবশ্য কখনওই উপগ্রহদের দাপট ও চোটপাট নিয়ে ভাবি নি কিছু, কারণ আমাদের বরাবরই ধারণা - স্রোতে মরা মাছই ভাসে।
    নদীর এ সংখ্যার বিশেষ চমৎকারিত্ব দু’ পর্বের সম্পাদকীয়। এর শিরোনামটিও সে চমৎকারিত্বের এক বিশেষ অংশ: “কোনো অধ্যাপকীয় কিংবা মোড়লীয় মনোভাব নিয়ে এই সম্পাদকীয় পড়বেন না”। এতে বলা হয়েছে  ‘আনুকূল্য ও করুণালোভী’দের কথা, ‘শক্তিশালী লেখক’দের দংশনকারী ‘সুযোগসন্ধানী সাপ’দের কথা। মনে হয় এদের কাউকে-কাউকে আমি চিনি। কারও-কারও আনুকূল্য পেতে ওই ‘সাপ’গুলি দেখলাম আপনি মোড়ল সেজে তকমা বিলিয়ে বেড়াচ্ছে বেছে-বেছে। এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে ওই ‘অধ্যাপকীয়’ চরিত্ররা। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানে চাকরি বাগিয়ে এদের কেউ-কেউ ভাবছে, এই বাগানোর যোগ্যতাই বুঝি সব কিছু বলা বা লেখার যোগ্যতা। তাই লিখতে গিয়ে প্রমাণ করছে তারা আদি ও অকৃত্রিম গাড়ল। বিশ্ব গাড়ল। ওই আপনি মোড়লদের মতোই। এদের মোড়লি-গাড়লি বেশি ধরা পড়েছে যখন ষাটের দশকের কবি ও কবিতা নিয়ে কি সব লিখেছে তারা। ওই দশক সম্পর্কে আবছা ধারণা, পড়াশোনার অভাব ছাড়াও ওই ধান্দাবাজদের মতলববাজি স্পষ্ট বোঝা যায় তাদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ অনুযায়ী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ মন্তব্য-মূল্যায়ন পড়লেই। অথচ ওই দশকের সাহিত্যিক দলিলপত্র দুর্লভ নয় একেবারে, ওই সময়ের প্রতিনিধিস্থানীয় কবি-সাহিত্যিকদের অনেকে জীবিত আছেন এখনও। ওই সব দলিলপত্র সংগ্রহ করে, ব্যক্তিত্বদের সাক্ষাৎকার নিয়ে কিছু লেখে নি এই মোড়ল-গাড়লদের কেউ, তা লিখলে তো ধান্দা হয় না, মতলব হাসিল হয় না, ‘আনুকূল্য ও করুণা’ পেতে ‘দংশন’ করা হয় না।
গত শতকের ষাটের দশক অন্যান্য দশকের চেয়ে একটু দীর্ঘ। ১৯৬০ সালে শুরু হয়ে ১৯৬৯ সালে শেষ না হয়ে পাড়ি দিয়েছে ১৯৭০ সালও। পৌঁছেছে ১৯৭১-এর মার্চ পর্যন্ত। অন্যান্য দশকের সঙ্গে হিসাবে আমাদের এ ভিন্নতার কারণ মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের সূচনা বায়ান্নতে হলেও ষাটে মোকাবেলা পৌঁছেছিল চরমে। ফলে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন থেকে স্বাধিকারের সংগ্রাম হয়ে স্বাধীনতার লড়াইয়ে পূর্ণতা পায় এই এক দশকেই। ওই সময় রাজনীতির সঙ্গে-সঙ্গে দ্রোহ ছড়িয়ে গিয়েছিল সাহিত্য-সংস্কৃতির সকল ক্ষেত্রেই। কেবল আমাদের দেশে নয়, পৃথিবী জুড়েই। ঘরের কাছে পশ্চিমবঙ্গে তখন চলছিল নকশালবাড়ি আন্দোলন, চলছিল চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লব, ফ্রান্সে ছাত্র-শ্রমিকদের প্রতিবাদ-সংগ্রাম, যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনাম বিরোধী শান্তি আন্দোলন, এশিয়া আফরিকা লাতিন আমেরিকায় উপনিবেশবাদ বিরোধী লড়াই, প্যালেস্টাইন আলজেরিয়া কিউবা লাওস কমবোডিয়া ইনদোনেশিয়ায় -  দেশে-দেশে জনযুদ্ধ। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সকল শাখায় প্রবল প্রভাব পড়ে এই মুখর অস্থিরতায়। সাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, নাটক, চিত্রকলা - সবকিছুতে প্রতিষ্ঠা পায় প্রতিষ্ঠা-বিরোধিতা, নিয়ম ভাঙার নিয়ম। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ষাটের দশক বা ‘দ্য সিঙটিস্‌’-এর সময়কাল অবশ্য ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত - গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার উদ্ভব, বিকাশ ও পরিণতির নিরিখে। সংক্ষেপে একটি বিবরণ দেয়া যাক সেই ষাটের:
   “... The 1960s term also refers to an era more often called The Sixties, denoting the complex of inter-related cultural and political trends across the globe. This "cultural decade" is more loosely defined than the actual decade, beginning around 1963 and ending around 1974.
... "the Sixties", as they are known in popular culture, is a term used by historians, journalists, and other objective academics; in some cases nostalgically to describe the counterculture and social revolution near the end of the decade; and pejoratively to describe the era as one of irresponsible excess and flamboyance. The decade was also labeled the Swinging Sixties because of the fall or relaxation of some social taboos especially relating to sexism and racism that occurred during this time.
The 1960s have become synonymous with the new, radical, and subversive events and trends of the period, which continued to develop in the 1970s, 1980s, 1990s and beyond. In Africa the 1960s was a period of radical political change as 32 countries gained independence from their European colonial rulers.
Some commentators have seen in this era a classical Jungian nightmare cycle, where a rigid culture, unable to contain the demands for greater individual freedom, broke free of the social constraints of the previous age through extreme deviation from the norm. Christopher Booker charts the rise, success, fall/nightmare and explosion in the London scene of the 1960s. This does not alone however explain the mass nature of the phenomenon.
Several governments turned to the left in the early 1960s. In the United States, John F. Kennedy, a Keynesian and staunch anti-communist, pushed for social reforms such as civil rights for African Americans and healthcare for the elderly and the poor. He was elected to the Presidency, also pledging to land a man on the Moon by the end of the decade, a feat that was accomplished in 1969. Italy formed its first left-of-centre government in March 1962 with a coalition of Christian Democrats, Social Democrats, and moderate Republicans. Socialists joined the ruling block in December 1963. In Britain, the Labour Party gained power in 1964. In Brazil, João Goulart became president after Jânio Quadros resigned....”
    এ দেশের পরিস্থিতি তখন কেমন ছিল তার একটা বিবরণ দিয়েছেন সমালোচক-গবেষক মানবর্দ্ধন পাল: “... সে সময়ের রাষ্ট্র-রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি, অর্থনীতি-বাণিজ্য, উৎপাদন-বণ্টন - এক কথায় সমাজের অন্তর্কাঠামো এবং উপরিকাঠামো - সর্বত্রই জন-অগ্নিগিরির লাভায় উত্তপ্ত, গণবিদ্রোহের ভূমিকম্পে টলটলায়মান। স্বৈরশাসিত রাষ্ট্র ও রাজনীতির প্রতিক্রিয়াশীলতা, দুর্বৃত্তায়িত প্রশাসনের নির্যাতন, পূর্ববাংলায় বৈষম্য ও শোষণমূলক ব্যবস্থা স্থায়ীকরণের অপচেষ্টা, শৃঙ্খলিত সংস্কৃতি, পদদলিত মানবাধিকার ইত্যাদিতে এ দেশের মানুষের জীবনে এক দিকে মুমূর্ষুর নাভিশ্বাস, অন্যদিকে হতাশার কালো গহ্বরে নিমজ্জন।... ষাটদশকী এই জাতীয় দুর্যোগের সৃজন-বেদনকালে বেহিসেবি-বেপরোয়া একদল তরুণ কবি-লেখকদের আবির্ভাব ঘটেছিল। ওঁরা এসেছিল সেইভাবে যেভাবে আগুন-লাগা স্থানে চারদিক থেকে হু-হু করে বাতাস বইতে থাকে। এই অদম্য-অসহিষ্ণু এবং দুর্বিনীত লেখক-কবিকুল ছিল ষাটদশকী সমাজজীবন ও শিল্প-সাহিত্যে অনেক অঘটন ঘটনের ক্রীড়নক। কিংবা বলা যেতে পারে, সময়ের মার, কালের চাবুক এবং যুগের প্রহার তাঁদের মধ্যে যে উপপ্লবের সৃষ্টি করেছিল তারই বিষামৃত তাঁরা উদগীরণ করেছিলেন  সে সময়ের পত্রপত্রিকায়, লিটলম্যাগে - বিকল্পধারার সাহিত্য-বাহনে। চিন্তায়-চরিত্রে, ভাবনায়-বক্তব্যে, ভাষায়-প্রকাশভঙ্গিতে এঁরা ছিলেন প্রচলিত সমাজজীবন বিগর্হিত। যুগের যন্ত্রণায় এবং কালের কালবিষে তাঁরা এমনই জর্জরিত যে, কোনও ধরনের শুভবোধ, কল্যাণধর্ম ও মানবিক মঙ্গলচিন্তার বিপরীতে জীবনবিধ্বংসী হতাশা-শূন্যতা, আত্মপীড়ন-অন্ধকার বন্দনা ও যৌনতা-পাপাচারই এঁদের একমাত্র আরাধ্য হয়ে ওঠে।...” (‘মহাদেব সাহা:কবির আঙুলে কত জাদু’, কলি প্রকাশনী, ২০১২)
    এই প্রথা ও প্রতিষ্ঠাবিরোধী সাহিত্যধারার জয়ধ্বজাবাহী মুখপত্র ‘কণ্ঠস্বর’-এ এক ঘোষণাপত্রে ষাটদশকী কবি-লেখকদের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছিল ‘সাহিত্যের সনিষ্ঠ প্রেমিক, ... শিল্পে উন্মোচিত, সৎ, অকপট, রক্তাক্ত, শব্দতাড়িত, যন্ত্রণাকাতর, ... উন্মাদ, অপচয়ী, বিকারগ্রস্ত, অসন্তুষ্ট, বিবরবাসী, তরুণ, প্রতিভাবান, অপ্রতিষ্ঠিত, শ্রদ্ধাশীল, অনুপ্রাণিত,... পঙ্গু, অহঙ্কারী, যৌনতাস্পৃষ্ট’ হিসেবে। ঘৃণা প্রকাশ করা হয়েছিল ‘প্রবীণ মোড়ল, নবীন অধ্যাপক, পেশাদার লেখক, মূর্খ সাংবাদিক, পবিত্র সাহিত্যিক, গৃহপালিত সমালোচক’দের বিরুদ্ধে।
    এখন সেই প্রথা ও প্রতিষ্ঠাবিরোধীরা কে কোথায় কি করছেন - সে খোঁজখবর বিশেষভাবে নেয়া দরকার। কারা আপস করেছেন, কারা করেন নি - তা দেখতে হবে। কারা ভঙ্গিসর্বস্ব চটকদারি করেছেন, আর কারা ছিলেন প্রকৃত অঙ্গীকারবদ্ধ - তা জানতে হবে। নাহলে আপনি মোড়ল ও বিশ্ব গাড়লরা কোন মতলবে কি ধান্দা করছে তা স্পষ্ট হবে না অনেকের কাছে।

facebook.com/sazpa85

এক যে ছিলেন জমিদার

প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬)-এর বিপুল সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। রক্ষা পেয়েছিল শুধু ওড়িশা এবং পূর্ববঙ্গের সাজাদপুর, পতিসর ও শিলাইদহের জমিদারি। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) শেষ উইল করেন ১৮৯৯ সালের ৮ই সেপটেম্বর। সে অনুযায়ী ওড়িশার জমিদারি পান তাঁর তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৪-১৮৮৪); দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ পান শিলাইদহ (প্রাচীন নাম খোরশেদপুর), সাজাদপুর ও পতিসরের জমিদারি। উইলে জমিদারির আয় থেকে ব্যয় বরাদ্দ করা হয় এভাবে - ছোটভাই নগেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৯-১৮৫৮)-এর স্ত্রী ত্রিপুরাসুন্দরী দেবীকে মাসে ১০০০ টাকা, পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ১২৫০ টাকা, সোমেন্দ্রনাথকে ২০০ টাকা, রবীন্দ্রনাথকে ২০০ টাকা, বীরেন্দ্রনাথকে ১০০ টাকা, তাঁর স্ত্রী প্রফুল্লময়ীকে ১০০ টাকা, তাঁর পুত্রবধূ সাহানা দেবীকে ১০০ টাকা, কন্যা সৌদামিনী দেবীকে ২৫ টাকা, তাঁর জামাতা সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়কে ৫০ টাকা, কন্যা শরৎকুমারী দেবীকে ২০০ টাকা, স্বর্ণকুমারী দেবীকে ১০০ টাকা, বর্ণকুমারী দেবীকে ১০০ টাকা, আদি ব্রাহ্মসমাজকে ২০০ টাকা, শান্তিনিকেতন ট্রাস্টকে ৩০০ টাকা, দেবসেবার জন্য ২০০ টাকা, পৌত্র দ্বিপেন্দ্রনাথকে ৫০০ টাকা। মাসে এই বিপুল অর্থ যোগানোর জন্য দায়বদ্ধ ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ। ১৯১২ সালে দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁর হিস্যার এক-তৃতীয়াংশ বছরে ৪৪,০০০ টাকার বিনিময়ে ইজারা পাট্টা দেন সত্যেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের কাছে। সিভিল সারভিসের চাকরিসূত্রে সত্যেন্দ্রনাথ থাকতেন বাংলার বাইরে। কাজেই বছরে ৯৭, ৪০০ টাকার জন্য দায়ী রইলেন রবীন্দ্রনাথই। এছাড়া জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির ব্যয় ও জমিদারি পরিচালনার জন্য বছরে কমপক্ষে খরচ হতো কমপক্ষে দুই লাখ টাকা। আর তিন জমিদারির সদর খাজনা দিতে হতো ৫০,০০০ টাকা। শিলাইদহের সদর খাজনা ছিল ১৬,৯০২ টাকা।
    জমিদারি কাজকর্মের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের ওপর পূর্ণ আস্থা ছিল দেবেন্দ্রনাথের। তবুও ১৮৯০ সাল থেকে পুরো পাঁচটি বছর জমিদারি তদারকের দায়িত্ব দিয়ে তাঁকে তিনি সরজমিন প্রশিক্ষণ দেন এ বিষয়ে। ১৮৯৬ সালের ৮ই অগস্ট পাওয়ার অভ অ্যাটর্নির মাধ্যমে সমগ্র সম্পত্তির সর্বময় কর্তৃত্ব রবীন্দ্রনাথের ওপর ছেড়ে দেন দেবেন্দ্রনাথ। ১৮৯০ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৪৭ বছর শিলাইদহ, সাজাদপুর ও পতিসরের জমিদার হিসেবে রবীন্দ্রনাথ বহন করেছেন পিতার দেয়া গুরুভার। তাঁর প্রজাদের বেশির ভাগই কৃষক। কৃষিতে উন্নতি ছাড়া তাদের জীবনে উন্নতি ঘটবে না, তাঁর জমিদারি বা দেশেরও উন্নতি হবে না। তাই জমিদারিতে চালু করেছিলেন ম-লিপ্রথা, সালিশী, হিতৈষীসভা প্রভৃতি ব্যবস্থা। নোবেল প্রাইজের এক লাখ ২০ হাজার টাকা জমা রেখেছিলেন পতিসরের এগ্রিকালচারাল ব্যাংকে। তাঁর কৃষক প্রজারা স্বল্প সুদে ঋণ পেতেন ওই ব্যাংক থেকে। এতে মুসলমান কৃষকরা উপকৃত হলেও হিন্দু সুদ-ব্যবসায়ী ‘সাহা’রা ক্ষেপে যায় রবীন্দ্রনাথের ওপর। তারা নানা ষড়যন্ত্র শুরু করে জমিদারির বিরুদ্ধে।
তবে দমেন নি রবীন্দ্রনাথ। প্রজারা যাতে অল্প জমিতে অধিক ফসল উৎপাদন করতে পারে এজন্য কৃষি ল্যাবরেটরি স্থাপন করেছিলেন তিনি। বাস্তবায়িত করেছিলেন সমবায় নীতি। প্রজাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন নিখরচায়। জমিদারিতে পুণ্যাহ সভায় আসন বণ্টনে তুলে দিয়েছিলেন জাতিভেদ প্রথা।
    প্রজাদের কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতেন রবীন্দ্রনাথ। মাঝেমধ্যে একাই বেরিয়ে পড়তেন প্রজাদের কথা শুনতে। প্রজাদের কাছ থেকে শুনেছেন আমলাদের অত্যাচারের কথা, বিশ্বাসও করেছেন সে সব কথা। সতর্ক করার পর একই ভুল করলে বরখাস্ত করেছেন তাদের।
    ১৮৯৫ সালে কুষ্টিয়ায় টেগোর অ্যান্ড কোং চালু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। চাষিদের ধান, পাট ও ভুষিমাল কিনে বাজারে বিক্রি করতো এ কোমপানি। তাঁরা আখ মাড়াইয়ের কলও বসিয়েছিলেন কুষ্টিয়ায়। ম্যানেজার টাকা চুরি করে পালিয়ে যাওয়ায় ব্যবসা ছাড়তে বাধ্য হন রবীন্দ্রনাথ। পরে নামমাত্র খাজনায় ওই ব্যবসা দান করেন এক কর্মচারিকে। জমিদারির সেরেস্তার কাজে গোড়া থেকেই আধুনিক ব্যবস্থা চালু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জমা ওয়াশিল কাগজের পরিবর্তে ছিল কার্ড ইনডেঙ প্রথা।
    রবীন্দ্রনাথের বেশির ভাগ ছিল প্রজা ছিল মুসলমান। জমিদারিতে তারা পেতো শুধু বরকন্দাজের কাজ। হিন্দুরা করতো আমলার কাজ। এ নিয়ে সৃষ্ট ক্ষোভ দূর করতে আমিন, মহুরি, তহশিলদার প্রভৃতি পদে শিক্ষিত মুসলমান প্রজাদের নিয়োগ করেন রবীন্দ্রনাথ। এতে হিন্দু আমলা ও প্রজারা প্রাত্যহিক কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটাতে থাকে নানাভাবে। তখন বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে শিক্ষিত হিন্দু যুবকদের নিয়ে এসে বিভিন্ন পদে নিয়োগ করেন তিনি।
    প্রজাদের বিদ্যাচর্চার জন্য শিক্ষালয় স্থাপন করেছেন রবীন্দ্রনাথ, শরীরচর্চার জন্যও চালু করেছিলেন লাঠিখেলা সহ বিভিন্ন খেলাধুলা। গ্রামীণ শিল্প ও বিনোদনচর্চাকে উৎসাহ দিতে প্রতি বছর আয়োজন করতেন পক্ষকালব্যাপী কাত্যায়নী মেলা।
    রবীন্দ্রনাথের জন্য ভাতা বরাদ্দ ছিল ২০০ টাকা, জমিদারি কাজের জন্য আর পেতেন ১০০ টাকা। এই মাত্র ৩০০ টাকায় পাঁচ পুত্র-কন্যা সহ সাত জনের সংসার চালাতেন জমিদার-পত্নী মৃণালিনী দেবী। এছাড়া ছেলেমেয়েদের গৃহশিক্ষক, অতিথি আপ্যায়ন, স্বামী ও সন্তানদের বই কেনা প্রভৃতির খরচ তো ছিলই। কলকাতা থেকে আত্মীয়-স্বজনও এসে থাকতেন প্রায়ই। এস্টেটের দারোয়ান, গ্রামের কাজের মহিলা, দূরের কর্মচারিদেরও ছিল মেসবাড়ি।
    আজ যাঁরা শিলাইদহ, সাজাদপুর ও পতিসরের ‘জমিদার’ তাঁরা কিভাবে কি করছেন জানতে বড় ইচ্ছা করে। দেশের সরকার ও প্রশাসক ‘জমিদার’রাই কেমন থাকেন, কেমন চলেন ও বলেন তা-ও তুলনা করে দেখতে ইচ্ছা করে। আজ যাঁরা ভক্তির চেয়ে আড়ম্বরে বেশি উৎসাহী তাঁরা যে পূজার ছলে তাঁকে ভুলেই থাকে - তা তিনি সেই তখনই জানতেন।

sazzadqadir@rediffmail.com

শনিবার, ৫ মে, ২০১২

সেই এক এসডিও

ময়মনসিংহ জেলার অন্যতম মহকুমা (সাবডিভিশন) হিসেবে টাঙ্গাইলের আত্মপ্রকাশ ১৮৭০ সালে। এর ৯৯ বছর পর, ১৯৬৯ সালে, এর নতুন পরিচয় ঘটে জেলা হিসেবে। তা হলেও মহকুমা প্রশাসন অব্যাহত ছিল আশির দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন টাঙ্গাইলের মহকুমা কর্মকর্তা/প্রশাসক (সাবডিভিশনাল অফিসার-এসডিও)। বাংলাদেশে ভারতের প্রথম হাইকমিশনার সুবিমল দত্ত টাঙ্গাইলের এসডিও ছিলেন বৃটিশ আমলে। স্বাধীনতার পর ঢাকায় আসার কিছু দিন পর গিয়েছিলেন টাঙ্গাইলে। ঘুরেফিরে দেখেছেন শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এসডিও সাহেবের সেই লাল রঙের বাংলো বাড়িটি। পাকিস্তান আমলে এসডিও ছিলেন খালেদ শামস, আর শেষের দিকে ছিলেন আমার দুই পরম সুহৃদ নাসিরুদ্দিন আল মনসুর (প্রয়াত) ও অরবিন্দ কর। তবে টাঙ্গাইলবাসীর মনে যিনি এখনও এসডিও হিসেবে জ্বলন্ত হয়ে আছেন তাঁর নাম জি এম কাদরি। অবাঙালি, তবে ভালই বুঝতেন বাংলা। ষাটের দশকে দোর্দণ্ড প্রতাপে তিনি শাসন করেছেন টাঙ্গাইল মহকুমা। সেই প্রতাপ বেশি দেখিয়েছেন নানা আদেশ-নির্দেশ জারি করে, আর আয়ুব-মোনেম বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় সামনের সারির নেতাদের নানা রকম হয়রানিতে জেরবার করে। হয়রানির মধ্যে বেশি ছিল আজেবাজে মামলায় জড়িয়ে হেনস্তা করা। এমনিতে সভা-সমাবেশ করা প্রায় অসম্ভব ছিল তখন। জি এম কাদরি ১৪৪ ধারা জারি করে দিতেন প্রস্তাবিত সভাস্থলে। মিছিল করা যেতো না। একসঙ্গে পাঁচজনের চলাচল নিষিদ্ধ করে দিতেন। ১০-১২ জনকে একসঙ্গে দেখলেই লাঠিচার্জ। ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগের সম্মেলনে প্রধান অতিথি-বিশেষ অতিথি হয়ে এসেছিলেন ‘ইত্তেফাক’-সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও কবি সুফিয়া কামাল। তাঁরা যাতে টাঙ্গাইল শহরে প্রবেশ করতে না পারেন সেজন্য পথে-পথে পুলিশ দিয়ে নানা ধরনের বাধা দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন জি এম কাদরি। তাঁদের গাড়ি আটকাবার চেষ্টা করা হয়েছিল নানা জায়গায়। কিন্তু মানিক মিয়া ছিলেন অদম্য। সব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে তিনি টাঙ্গাইল পৌঁছেন কয়েক ঘণ্টা দেরিতে। দুপুরশেষে। এর আগেই অনুষ্ঠানে মাইক ব্যবহার বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন জি এম কাদরি। মানিক মিয়া ও সুফিয়া কামাল দু’জনে বক্তৃতা করেন মাইক ছাড়াই। তাঁদের বক্তৃতায়, বলাবাহুল্য, জি এম কাদরি’র স্বেচ্ছাচারিতার প্রসঙ্গ এসেছিল বারবার। মানিক মিয়া বলেছিলেন, ‘তুমি যদি জি এম কাদরি হও, মনে রেখো আমিও মানিক মিয়া। তুমি কত ক্ষমতা ধরো তা আমি দেখবো।’ যদ্দূর মনে পড়ে, ঢাকায় ফিরে টাঙ্গাইলের অভিজ্ঞতা তিনি লিখেছিলেন তাঁর কলামে।
মামলার প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ছিল জি এম কাদরি’র। রাজনীতিকদের অপমানিত করে সাজা দিতে ছিল তাঁর পরম উৎসাহ। তখন ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল দেশ। টাঙ্গাইলে বাধা বেশি, আন্দোলনের তীব্রতা - উত্তালতাও বেশি। আন্দোলনরত ছাত্রদের বিরুদ্ধে পুলিশ ছাড়াও হামলা চালাতো দালাল ছাত্রদের সংগঠন জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন- ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন। সংক্ষেপে এনএসএফ। আমরা বলতাম নসফ। ওদের নিয়ে একটা গানও ছিল আমাদের- ‘নসফ দালাল রে...’! চিত্রনায়ক ওয়াসিম  (মেসবাহউদ্দিন আহমেদ) ছিলেন ওই সংগঠনের সদস্য। বডিবিল্ডার। মি. ইস্ট পাকিস্তান। ময়মনসিংহ থেকে দলেবলে এসেছিলেন করটিয়া সা’দত কলেজে। কিন্তু সুবিধা হয়নি, বিরোধী ছাত্রনেতা-কর্মীদের প্রচণ্ড  পালটা মারের চোটে গুরুতর আহত হওয়ায় জীবন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল তাঁর। এ নিয়ে মামলা হয়, মহাঝামেলায় পড়েন বহু ছাত্রনেতা।
একবার ছাত্রনেতারা কোন ব্যাপারে ডেপুটেশনে গিয়েছিলেন  জি এম কাদরি’র অফিসে। অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করে তাঁদের প্রায় তাড়িয়েই দেন তিনি। নেতারাও অবশ্য কথা বলেননি ছেড়ে। পরে জি এম কাদরি তাঁদের সহ আরও কয়েকজনের নামে দেন চুরির মামলা। তাঁরা নাকি তাঁর অফিস থেকে গোপনে সরিয়েছেন অনেক মূল্যবান কাগজপত্র। ওই মামলায় অন্যতম আসামি ছিলেন বর্তমান মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। এ ধরনের অনেক মামলা দিয়ে হয়রানি করা ছিল জি এম কাদরি’র বিশেষ কৌশল। সে সময় এসব মামলা বিনা ফি-তে পরিচালনা করতেন টাঙ্গাইলের বিশিষ্ট আইনজীবী আবদুল আলী সিদ্দিকী (লতিফ সিদ্দিকী-কাদের সিদ্দিকী’র পিতা)। এ কারণে তাঁর আইনজীবীর সনদ বাতিল করে দিয়েছিলেন জি এম কাদরি।
ষাট দশকের সেই আন্দোলনমুখর দিনগুলোর কথা মনে পড়ে নানা কারণেই। অনেক নির্যাতনকারী শাশুড়ি ভুলে যান এক দিন বধূ ছিলেন তিনি, অনেক দুর্ব্যবহারকারী বধূ ভুলে যান একদিন শাশুড়ি হবেন তিনি। আসলে নির্যাতিতরা বিশেষভাবে মনে রাখে নির্যাতনের নানা কৌশল, পরে সেগুলোই প্রয়োগ করে তারা। তাই সেই দোর্দণ্ড এসডিও জি এম কাদরি নেই এ কথা সত্য নয়, গত চার দশক ধরেই তিনি আছেন ভিন্ন-ভিন্ন নামে।
facebook.com/sazpa85