বৃহস্পতিবার, ২৮ জুন, ২০১২

দেশের সম্পদ বিদেশে

দেশের অর্থ-সম্পদ বিদেশে পাচারের কথা প্রায়ই শুনি। মানি লন্ডারিং-এর অভিযোগ অনেকের বিরুদ্ধে। রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, আমলা, চোরাকারবারিদের অনেকে বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ছে - এমন কথা এখন নিয়মিত আইটেম হয়ে পড়েছে বক্তৃতা-বিবৃতির। উচ্চারিত হচ্ছে কত জনের নাম। ১০ বছর আগে প্রণীত হয়েছে প্রিভেনশন অভ মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট, ২০০২ (অ্যাক্ট নং ৭ অভ ২০১২)। এ অ্যাক্টের অধীনে বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক এ পর্যন্ত জারি করেছে ২৬টি সারকুলার। এর মাধ্যমে ব্যাঙ্কিং সেক্টরে নিশ্চয়ই চলছে কড়াকড়ি প্রতিরোধমূলক তৎপরতা, কিন্তু হুন্ডি বন্ধ হয় নি বলেই শোনা যায়। সেই ১৯৯৬ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আই এম এফ) অনুমান করেছিল, বিশ্ব অর্থনীতির ২ থেকে ৫ ভাগ অর্থ লন্ডার করা। তবে আন্তঃসরকার সংগঠন ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স অন মানি লন্ডারিং  (এফ এ টি এফ) বলেছে, এই অর্থের হিসাব করা সম্ভব নয়। এজন্য এ সংক্রান্ত কোন অনুমান বা ধারণা তাঁরা প্রকাশ করেন নি আর।
    অর্থ-সম্পদের অবৈধ পাচার বা চালান ঠেকানোর পাশাপাশি চলছে সে সব উদ্ধারের নানা তৎপরতা। বিদেশে যাঁরা আলিশান বাড়ি বানিয়ে বা কিনে, রমরমা ব্যবসা বাগিয়ে লেটেস্ট মডেলের আউডি বা মাসেরাতি হাঁকিয়ে বেড়ান তাঁদের সুলুক-সন্ধান নিয়ে পাচার করা সম্পদ উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে আনার ঘটনা ঘটছে বিভিন্ন দেশে। কারণ দুর্নীতিবিরোধী সংগ্রামে আন্তর্জাতিক পূর্বিতা যে লুণ্ঠিত সম্পদ উদ্ধার তা সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ করা হয়েছে দুর্নীতিবিরোধী জাতিসংঘ সম্মেলন (২০০৩)-এর পঞ্চম অধ্যায়ে। ওই সম্মেলনেই গঠিত হয় ইউনাইটেড নেশনস্‌ কনভেনশন এগেনস্ট করাপশন (ইউ এন সি এ সি)। এটি কার্যকর হয় ২০০৫ সালের ১৪ই ডিসেম্বর থেকে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সহ ১৪০টি দেশ স্বাক্ষর করেছে এতে। সম্পদ উদ্ধারে নিয়োজিত আছে অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনের মধ্যে রয়েছে - ইউনাইটেড নেশনস্‌ অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম (ইউ এন ও ডি সি), স্টোলেন অ্যাসেট রিকভারি ইনিশিয়েটিভ (বিশ্ব ব্যাঙ্ক) (এসটি এ আর), ইনটারন্যাশনাল সেনটার ফর অ্যাসেট রিকভারি (আই সি এ আর), দি ইনটারন্যাশনাল এসোসিয়েশন ফর অ্যাসেট রিকভারি (আই এ এ আর), অরগানাইজেশন ফর ইকনমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ও ই সি ডি), ট্রান্সপারেন্সি ইনটারন্যাশনাল (টি আই), ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফ এ টি এফ), ইউ৪ অ্যানটি-করাপশন রিসোর্স সেনটার (ইই৪) প্রভৃতি। এছাড়া আঞ্চলিক পর্যায়ে আইন, বিচার ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগের রয়েছে চোরাই সম্পদ উদ্ধারের উদ্যোগ।
    উল্লিখিত সংস্থা-সংগঠনের উদ্যোগের ফলেই নাইজেরিয়ার সামরিক একনায়ক জেনারেল সানি আবাচা (১৯৯৩-৯৮)-র লুণ্ঠিত ৬০ কোটি ডলার বাজেয়াপ্ত করে সুইজারল্যান্ড। পরে সে অর্থ উন্নয়ন-কাজে ব্যয় হয় বিশ্ব ব্যাঙ্কের তদারকে। এছাড়া সুইজারল্যান্ড বাজেয়াপ্ত করেছে জায়ারে’র সাবেক প্রেসিডেন্ট  মোবুতো সেসে সেকো (১৯৬৫-১৯৯৭) ও কেনিয়া’র সাবেক প্রেসিডেন্ট দানিয়েল আরাপ মোই-এর বিপুল অর্থ। ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফারদিনান্দ মারকোস (১৯৬৫-৮৬)-এর বহু সম্পদ ফিরে পেয়েছে দেশ। পেরু’র সাবেক প্রেসিডেন্ট আলবেরতো ফুজিমোরি (১৯৯০-২০০০)-র ডান হাত ভ্লাদিমিরো লেনিন মনতেসিনোস তোরেস-এর পাচারকৃত অর্থ থেকে ১৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার উদ্ধার করেছে আইসিআর। হেইতি’র সাবেক প্রেসিডেন্ট জাঁ-ক্লদ ‘বেবি ডক’ দুভালিয়ার (১৯৭১-১৯৮৬), ইউক্রেন-এর সাবেক প্রধানমন্ত্রী পাভলো লাজারেঙ্কো (১৯৯৬-৯৭), নাইজেরিয়া’র প্ল্যাটো স্টেট-এর সাবেক গভর্নর জোশুয়া দারিয়ে (১৯৯৯-২০০৭) ও বায়েলসা স্টেট-এর সাবেক গভর্নর দিয়েপ্রিয়ে আলামিয়েসেইগা (১৯৯৯-২০০৫), ইন্দোনেশিয়ার ব্যাঙ্কার হেনদ্রা রাহারদজা, চীনের মাকাউ-এর পরিবহন ও পূর্ত বিভাগের প্রথম সচিব আও মান লোং (১৯৯৯-২০০৬) প্রমুখ কর্তৃক অপহৃত সম্পদ উদ্ধার করা হয়েছে অনেকখানি। বিভিন্ন মেয়াদের কারাদ-ও হয়েছে ক’জনের্‌
অপহরণ ও উদ্ধার সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য এখানে তুলে ধরার উদ্দেশ্য একটাই - যাঁরা আমাদের দেশের অর্থ-সম্পদ বিদেশে পাচার করেছেন, করছেন এবং করবেন বলে ভাবছেন - সেই লুটেরাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা।

sazzadqadir@rediffmail.com

বৃহস্পতিবার, ২১ জুন, ২০১২

ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র

বিশ্ব শরণার্থী দিবস ২০শে জুন। পরের দিন ২১শে জুন  বিশ্ব মানবতা দিবস। বিশ্ব শরণার্থী দিবসের এ বছরের বিষয়বস্তু: “Refugees have no choice. You do.”   এই থিম বা স্লোগানে শরণার্থীরা কত অসহায় আর আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য কত বেশি - সেটাই বলা হয়েছে বিশেষ করে। পর-পর এমন দু’টি দিনে রোহিঙ্গাদের কথাই মনে পড়েছে বেশি। ওরা আমাদের প্রতিবেশী। সে হিসেবে ওদের প্রতি নানা কর্তব্য আছে আমাদের। এ দেশেরই প্রবাদ - ঘরের কাছে ঘর, আমি কি তোমার পর? ধর্মেও নির্দেশ আছে প্রতিবেশীদের প্রতি করণীয় সম্পর্কে। মহানবী (স) বলেছেন, প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে নিজে অন্ন গ্রহণ করবে না। নিজের জন্য যা ভাল মনে করবে, প্রতিবেশীর জন্যও তা ভাল মনে করবে। নিজেকে নিরাপদ রাখবে প্রতিবেশীদের জন্য। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি তিন-তিন বার উচ্চারণ করেছেন - যার আচরণ তার প্রতিবেশীর জন্য নিরাপদ নয় সে মুসলমান নয় ("He is not a believer whose neighbor is unsafe from his mischief." )। এক নারী সারা রাত নামাজ-জিকির করেন, দিনে রোজা রাখেন, অনেক দান-খয়রাত করেন, কিন্তু প্রতিবেশীদের সঙ্গে মুখ নাড়েন খুব? তার কি হবে? মহানবী (স) বলেন, সে যাবে জাহান্নামে।  আরেক নারী ধর্মকর্ম পালন করেন কেবল যেটুকু না করলেই নয়, কিন্তু প্রতিবেশীরা গুণগান করেন তাঁর। কি হবে ওই নারীর? মহানবী (স) বলেন, তিনি হবেন বেহেশতবাসী। প্রতিবেশীর অধিকার সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “... help him if he asks your help,  to lend him if he asks to borrow from you, to satisfy his needs  if he becomes poor, to console him if he is visited by an affliction, ... to visit him if he becomes ill,...”। ঈসা (আ.) বলেছেন, নিজেকে যেমন ভালবাসো - প্রতিবেশীকেও তেমন ভালবাসবে। মুসা (আ.)-কে প্রদত্ত ১০ ঐশী বাণীর দশমটিতে বলা হয়েছে - প্রতিবেশীর স্ত্রী, ভৃত্য, পরিচারিকা, ষাঁড়, গাধা, কোনও কিছুর দিকে নজর দেবে না।
    এমন সুবচন অনেক আছে প্রতিবেশী সম্পর্কে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা ভিন্ন। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৪-১৮৯৯) লিখেছেন, “... বঙ্গবাসীমাত্রই সজ্জন; বঙ্গে কেবল প্রতিবাসীরাই দুরাত্মা। যাহা নিন্দা শুনা যায় তাহা কেবল প্রতিবাসীর। প্রতিবাসীরা পরশ্রীকাতর, দাম্ভিক, কলহপ্রিয়, লোভী, কৃপণ, বঞ্চক। ... যাহাদের প্রতিবাসী নাই, তাহাদের ক্রোধ নাই।...” (‘পালামৌ’, ১৮৮০-৮২)।
খুঁজলে দেখবো সকল দেশের সংবিধানেও আছে সৎপ্রতিবেশীমূলক সম্পর্কের অঙ্গীকার, কিন্তু কোনও দেশের সঙ্গেই ভাল সম্পর্ক নেই তার প্রতিবেশীর। আমাদেরও অনেক সমস্যা অন্যতম প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে। বিএসএফ, বাঁধ, ব্যবসা-বাণিজ্য, পানি, ভিসা, যাতায়াত প্রভৃতি নানা ক্ষেত্রে বিরাজমান সমস্যা দূরীকরণে অগ্রগতি নেই আশানুরূপ। দুই দেশের এক শ্রেণীর আমলা, ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারিদের এজন্য দায়ী করেন অনেকে। সেই তুলনায় আরেক প্রতিবেশী মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি ছাড়া আর কোনও সমস্যা নেই বললেই চলে। এ পরিস্থিতি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের। জন্মগত ও অন্যান্য সূত্রে অধিকার থাকা সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে রাজি নয় মিয়ানমার। তাদের পরিচয় দিতে গিয়ে জাতিসংঘ বলেছে, মিয়ানমারে বসবাসকারী মুসলমানরা রাষ্ট্রহীন। তারা বিশ্বের সবচেয়ে নিগৃহীত ও অবহেলিত জনগোষ্ঠী। মিয়ানমারের বৌদ্ধদের ঘৃণা, বিদ্বেষ, নিপীড়ন, নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গারা প্রায়ই দেশ ছেড়ে আশ্রয় খোঁজে বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া ও অন্যান্য দেশে। কিন্তু সে আশ্রয় দিতে রাজি নয় তাদের। হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের শিকার হয়ে সেই সত্তর ও নব্বই দশকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে অনেক রোহিঙ্গা। তাদের সঙ্গে ভাল ব্যবহারই করেছি আমরা। পুরুষদের সস্তা শ্রম নিয়েছি, অপরাধ জগতে ঢুকিয়েছি, রাজনীতির চ্যালাকাঠ বানিয়েছি, আর নারীদের করেছি লালসার শিকার। আর এখন, আবার যখন প্রাণ বাঁচাতে ওই বিপন্ন অসহায় নরনারীশিশুরা আসছে আমাদের দ্বারে, তখন দূর-দূর করে তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছি আমরা। বিভিন্ন দেশে আমাদের অনেকের সঙ্গে যে রকম অমানবিক আচরণ করা হয়, ঠিক সে রকম আচরণই আমরা করছি তাদের প্রতি। শুধু তাই নয়, যে অশ্রাব্য ভাষায় একটি জনগোষ্ঠীকে আমরা কলঙ্কিত ও অপরাধী প্রমাণের চেষ্টা করছি তাতে মনে হয় না, আমাদেরই এক কবি একদিন গেয়েছেন ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। মনে হয় বঙ্গোপসাগরে ভাসমান মানবতার দিকে তাকিয়েই নজরুল লিখেছিলেন : “... অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ, / কা-ারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃ-মুক্তি পণ! ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? / কা-ারী! বলো, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!...” ভাবি, ৬২২ অব্দের সেপটেম্বর-অকটোবরে মককা থেকে মদিনায় যাওয়া মানুষগুলোর কথা, একাত্তরের মার্চ-নভেম্বরে আমাদের ভারতে যাওয়ার কথা। এভাবে যুগে-যুগে মানুষ শরণার্থী হয়েছে, কিন্তু এমন নিষ্ঠুর প্রত্যাখ্যানের দৃষ্টান্ত আছে কি কোথাও? মানবতাবাদী, শান্তিবাদী, আতিথ্যপরায়ন হিসেবে বাঙালির বিশ্বখ্যাতি আজ মুখ ঢাকছে লজ্জায়।
    কিন্তু না, এ লজ্জা আমরা বইবো না। বিশ্বসমাজের সঙ্গে সমস্বরে সাড়া দিতে হবে আমাদের। রোহিঙ্গা সমস্যার দিকে জোর পদক্ষেপ নিয়েছে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মারকিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বিভিন্ন মানবাধিকার গোষ্ঠী। ফলে মিয়ানমার-এর বর্তমান সংস্কারপন্থি সরকার এবং রাজনৈতিক স্বার্থে নিশ্চুপ অং সান সু চি-কে অবশ্যই রোহিঙ্গাদের প্রাপ্য অধিকার দিতে হবে, তাদের প্রতি নিগ্রহ-নির্যাতনের অবসান ঘটাতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশী হিসেবে যথোচিত ভূমিকা নিতে হবে বাংলাদেশকে। আর প্রতিবেশী হিসেবে সে ভূমিকা কেমন হতে পারে তার একটু নমুনা তুলে ধরছি এখানে - যাঁরা নিজেদের ভারতপন্থি বলে গর্ব করেন কিন্তু ভারতের কাছ থেকে ভাল কিছু শেখেন না - তাঁদের জন্য। নমুনাটি উদ্ধৃত করছি পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত বাচিক শিল্পী, আকাশবাণী-দূরদর্শন ব্যক্তিত্ব, জগন্নাথ বসু’র স্মৃতিকথা “বেতারের কথকতা এবং” (কলকাতা, ২০১০) থেকে:
    “... হত্যালীলা চলছে তখন সদ্যভূমিষ্ঠ বাংলাদেশে। ব্যাপারটা যখন চরমে উঠেছে, সে সময় স্টুডিওতে নেমে এলেন থমথমে মুখে অধিকর্তা দিলীপকুমার সেনগুপ্ত। আদেশের সুরে বললেন, ‘জগন্নাথ, টক স্টুডিওতে এসো।’ যেতেই একটা পাতা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এখনই এটি তোমাকে পড়তে হবে।’ তাতে লেখা, ‘প্রতিবেশী বাংলাদেশে যে অরাজকতা ও জনবিরোধী কার্যকলাপ ঘটে চলেছে, ভারত তার প্রতিটি ঘটনাপ্রবাহের প্রতি লক্ষ্য রাখছে। ভারত আরও জানাচ্ছে, এই সব মৌলবাদী অশুভ শক্তি যদি এখনও সংযত না হয়, তা হলে ভারত কিন্তু আর হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না।’ আমি মাইকের সামনে কাগজটি নিয়ে যেতেই উনি আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘দেখো আবার পেলব কণ্ঠে পরিশীলিত উচ্চারণে যেন কথাগুলি বলো না। তোমার ভঙ্গিতে যেন হুমকিটা স্পষ্ট থাকে। কি, পারবে তো গলায় ঝাঁঝ দিয়ে বলতে?’...”

facebook.com/sazpa85

শনিবার, ১৬ জুন, ২০১২

অবিশ্বাস নামের গৃহশত্রু

কোনও মানুষই দোষ-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নন, কাজেই কেউ সমালোচনারও ঊর্ধ্বে নন, তারপরও কোনও-কোনও মানুষ আছেন দোষ বা ত্রুটি কখনও প্রশ্ন বা প্রসঙ্গ হয়ে ওঠে না তাদের ক্ষেত্রে। তারা অলোকসাধারণ অসামান্য ব্যক্তিত্ব। তাদের দেখার সুযোগ মেলে না সহজে, কিন্তু আমার নিজের শতেক দোষ-ত্রুটি থাকলেও শুধু দেখা নয়, সান্নিধ্যও পেয়েছি এমন কয়েকজন ক্ষণজন্মা মহানুভবের। তাদের একজন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। সেই ১৯৬৬ সাল থেকে সঙ্গে আছি তার। কাজেকর্মে থাকি, কাজকর্ম না থাকলে মনে-মনেও থাকি। অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, তবে বিনয়ের সঙ্গেই বলি - এক ধরনের নিবেদন ও সততায় শুদ্ধতা নিয়ে বড় হয়েছি গত শতকের পঞ্চাশ-ষাট দশকের অস্থির সময়ে। এই শুদ্ধ জীবনের প্রেরণা শুধু পারিবারিক সূত্র থেকে ছিল না, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ঘোর আচ্ছন্নতা থেকেও ছিল দায়বদ্ধতা। অগ্রজ তারাপদ রায়, জওশন খান, রফিক আজাদ, বুলবুল খান মাহবুব, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা এবং আরও অনেকে সততায় সুস্থতায় শুদ্ধতায় প্রাণিত করেছেন নানা ভাবে নানা সময়ে। কিন্তু এই যে আমার সৎ ও নিবেদিত থাকার সাধনায় পূর্ণতা সন্ধান - এর মূলে সবচেয়ে বেশি অবদান যার তিনি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তাকে দেখে শিখেছি জীবনচর্চা, তার কাছে জেনেছি শিল্পসুলুক, বুঝেছি সমাজবীক্ষার মর্ম ও মাহাত্ম্য, তারপর প্রতিষ্ঠাবিরোধী হয়েও থেকেছি শ্রদ্ধাবান, ভালবেসেছি যাবতীয় নতুনকে, সমর্থন যুগিয়েছি সকল সম্ভাবনাকে। এই যে অসতের সঙ্গে আপস করি না, অবৈধ অর্থ-সম্পদের দিকে হাত বাড়াই না, সুযোগ সত্ত্বেও চরিত্র রক্ষা করি, অতি অল্প লইয়া থাকি, দুঃখ-দারিদ্র্য কষ্ট-গঞ্জনা সই - আমার এই যে এত ব্যর্থতা - এ সবের জন্য মূলত তাকেই দায়ী করি আমি। কারণ আমার সামনে অত বেশি আদর্শ ছিল না, নেই-ও, এ অবস্থায় সততায় নিবেদিত শুদ্ধ কর্মিষ্ঠ জীবনের এক মহান প্রতীক হয়ে আছেন তিনি। কিন্তু যে সময়ে সমাজে এসে পৌঁছেছি আমরা - তাতে এ সবই এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে তার সবচেয়ে বড় দোষ ও ত্রুটি!
    জাতীয় সংসদে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সমালোচনা, তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ শুনে ভীষণ রাগ হয়েছিল আমার। বিশেষভাবে তার ব্যক্তিচরিত্র নিয়ে কটাক্ষ করায় বেশিই হয়েছিল রাগটা। এক পর্যায়ে চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসার মতো একটা অবস্থাও হয়েছিল তখন। ওই অবস্থাতেই লিখে ফেলেছিলাম ‘ঠাকুরঘরে কে রে?’ নামে এক লেখা। পরে সংবরণ করি রাগ। ভাবি, সায়ীদ ভাই তো আক্রান্ত নন এই প্রথম? সেই স্বাক্ষর-কণ্ঠস্বর যুগে, ষাট দশকের প্রথম দিকে, ‘পুবালী’র ‘ঢাকায় থাকি’ কলামে ‘নাগরিক’ তাকে গালমন্দ করেছিলেন ‘পালের গোদা’ বলে। তারপর যাদের তিনি ‘কণ্ঠস্বর’-এ তুলে ধরেছেন, লিখেছেন যাদের নিয়ে, সুযোগ করে দিয়েছেন প্রতিষ্ঠার, তারা-ও তো আড়ালে-আবডালে কম নিন্দা করে নি তার। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সম্পর্কেও অনেক অদ্ভুত খবর বেরিয়েছে পত্রপত্রিকায়। কিন্তু সহ্য করেই আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ জয় করেছেন সব কিছু। ওই ‘নাগরিক’কেও। এবার দেখলাম তিনি বিবৃতি দিয়েছেন তার পক্ষ নিয়ে।
    চারপাশে এত ধান্দাবাজ, মিথ্যাবাদী ও বেয়াদব যে সমাজের সুস্থতা সম্পর্কে বিশ্বাস রাখা এখন কঠিন। কিন্তু আশ্চর্য নীতি ও আদর্শের জোর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের। বিশ্বাস তিনি হারান না কখনওই। কোথায় পান এত শক্তি? এত ইতিবাচক প্রাণশক্তি? আমার তো সহ্যই হয় না ধান্দাবাজ, মিথ্যুক আর বেয়াদবদের, কিন্তু দেখেছি তার সহিষ্ণুতা কত বেশি! যে কাউকে আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়ার মতো উদার বিশালতা তার প্রায় অনন্ত অসীম। আর তা কত স্বাভাবিক যে এ নিয়ে কোনও রাগ হয় না তার ওপর, বিন্দুমাত্র সমালোচনার চিন্তাও ঢোকে না মাথায়।
    ভাবি, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পর্কে যারা কটূক্তি করেছেন তারা কি করে ধারণা করতে পারলেন ওই মানুষটি কোনও দুষ্কর্ম করতে পারেন? কখনও কি নিন্দনীয় কিছু শুনেছেন জেনেছেন তাঁর সম্পর্কে? আসলে আমরা বোধহয় বাস করি এমন এক সমাজে যেখানে বিশ্বাস নিহত হয়েছে অনেক আগেই। তাই কেউ সমর্পিত আছেন সততায় তা কারও ধারণাতেই যেন আসে না। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝি। আমার মতো একজন নিঃস্ব ক্লিষ্ট মানুষকেও শুনতে হয়েছে বিপুল অর্থবিত্তের অপবাদ, সেখানে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের গাড়ি-বাড়ি নিয়ে প্রশ্ন ওঠা কি অসম্ভব? সমাজ কি এ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কাউকে বিশ্বাস করার যো নেই? তবে কি অবিশ্বাস নামের গৃহশত্রুকে নিয়েই বাস করে যেতে হবে আমাদের?
facebook.com/sazpa85

বুধবার, ১৩ জুন, ২০১২

ইউনূসকে নিয়ে চলচ্চিত্র, নামভূমিকায় ইরফান খান

মহাজনেরা বলেছেন, স্বদেশে পূজ্যতঃ রাজা, বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে- রাজা সম্মান পান নিজ দেশে, কিন্তু বিদ্বান সম্মান পান সব দেশে। তবে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস শ্রদ্ধা-ভালবাসায় বিশ্বজয়ী হলেও বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন স্বদেশের একটি মহলের। আক্রান্ত হয়েছে এবং হচ্ছে তার গৌরবকীর্তি গ্রামীণ ব্যাংক। কিন্তু যত গঞ্জনা লাঞ্ছনা এই স্বদেশী মহলে, আন্তর্জাতিক মহলে তত শিখরস্পর্শী হয়ে উঠছে তার মান ও মর্যাদা। সর্বশেষ তার প্রতি সম্মান জানিয়ে কথা বলে, চিঠি লিখে ব্যঙ্গ ভ্রুকুটির শিকার হয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন পর্যন্ত। তাহলেও আমাদের এই কীর্তিধন্য মানুষটির প্রতি থেমে নেই বিশ্বসমাজের সশ্রদ্ধ অভিনন্দন। সর্বশেষ প্রখ্যাত ইতালিয়ান চলচ্চিত্রকার মারকো আমেনতা নির্মাণ করতে যাচ্ছেন তার জীবনীচিত্র ‘ব্যাংকার টু দ্য পুওর’। এ ছবিতে নামভূমিকায় অভিনয় করবেন বলিউড-হলিউডের নন্দিত অভিনেতা ইরফান খান। ‘পান সিং তোমার’-এর পর এটি তার দ্বিতীয় জীবনীচিত্র। মীরা নায়ার-এর ‘দ্য নেইমসেক’ ছবিতে এক বাঙালি ভদ্রলোকের চরিত্রে তার অভিনয় দেখার পর ইরফান খানকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চরিত্র মনোনীত করেন পরিচালক।
‘ব্যাংকার টু দ্য পুওর’-এর চিত্রনাট্য রচিত হয়েছে ড. ইউনূসের ২০০৬ সালে নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পাঁচ বছর আগে- ২০০১ সালে প্রকাশিত একই নামের এক বেস্টসেলার অবলম্বনে। তখন আন্তর্জাতিক মহলে তিনি ছিলেন প্রায় অপরিচিত। আমেনতা চিত্রনাট্য লেখেন সেরজো দোনাতি’র সঙ্গে মিলে। এ চিত্রনাট্যের জন্য ট্রাইবেকা চলচ্চিত্র উৎসবে তাকে পুরস্কৃত করেন হলিউডের কিংবদন্তি অভিনেতা রবার্ট ডি নিরো। ওই সময়ই এর চলচ্চিত্র-স্বত্ব কিনে নেন মারকো আমেনতা, সিমোনেতা আমেনতা ও তার ইউরোফিল্ম কোম্পানি।
‘দি অ্যামেজিং স্পাইডারম্যান’-এর পর ইরফান খানের এটি দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ছবি। তিনি বলেন, এ ছবি নিয়ে কথা চলছে অনেক দিন ধরেই। প্রস্তাব পেয়ে সম্মতি জানিয়েছি আমি। তার এক বন্ধু বলেন, এমন একজন বিশ্বখ্যাত জীবিত মানুষের চরিত্র রূপায়ন সহজ কথা নয়। ইরফান তাই শিগগিরই ড. ইউনূসের সঙ্গে দেখা করবেন, যত বেশি সম্ভব তার সঙ্গে সময় কাটাবেন। ‘পান সিং তোমার’ রূপায়নে কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন তিনি, কিন্তু এখানে তো চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি। কারণ এ চরিত্র বাস্তব। এ চরিত্রের অভ্যন্তরে ঢুকতে কয়েক মাস লেগে যাবে তার। ইরফান বলেন, কাজ শুরু হবে ডিসেম্বর থেকে। কাজেই এর মধ্যেই হোমওয়ার্ক সেরে ফেলা সম্ভব হবে আমার পক্ষে।
দ্য সিসিলিয়ান গার্ল (২০০৯), দ্য গোস্ট অভ কোরলিওন (২০০৫), দ্য লাস্ট গডফাদার (২০০৪), ডায়েরি অভ এ সিসিলিয়ান রিবেল (১৯৯৫), লেটার ফ্রম কিউবা, বর্ন ইন বসনিয়া প্রভৃতি কাহিনী ও প্রামাণ্য চিত্রের পরিচালক-প্রযোজক মারকো আমেনতা একজন ফটোজার্নালিস্ট-ও। বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কারে সম্মানিত আমেনতাকে ‘ব্যাংকার টু দ্য পুওর’-এর চিত্রনাট্য রচনায় সহায়তাকারী সেরজো দোনাতি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রনাট্যকার। তার রচিত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে- ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন দ্য ওয়েস্ট (১৯৬৮), ফিস্টফুল অভ ডাইনামাইট (১৯৭১), ওরকা (১৯৭৭), হলোকাস্ট ২০০০ (১৯৭৭), র ডিল (১৯৮৬), ম্যান অন ফায়ার (১৯৮৭) প্রভৃতি।

শনিবার, ৯ জুন, ২০১২

শাহীন রেজা’র কবিতা প্রসঙ্গে

কি বলা যায় শাহীন রেজা ও তাঁর কবিতা সম্পর্কে? আমার সামনে তাঁর দশম কাব্যগ্রন্থ ‘পাখি চলে গেলে কবি বড় একা’। এর আগের ন’টি কাব্যগ্রন্থ দেখি নি আমি, নামও জানি না সেগুলোর। শাহীন রেজাকেও আমি দেখি নি কখনও, তাঁর সঙ্গে তেমন জানাশোনাও নেই আমার। তবে পরিচয় আছে তাঁর কবিতার সঙ্গে, প্রায়ই পড়ি পত্রিকার পাতায়, নিজেও ছেপেছি কিছু। এখন তাঁর সম্পাদিত ‘বৈচিত্র’-এ কলাম লিখছি নিয়মিত। মাঝেমধ্যে হঠাৎ কখনও কথা হয় ফোনে।
    কবিতা পড়ে আমার ধারণা হয়েছিল, শাহীন রেজা’র বয়স  ২০ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। ঝকঝকে তরুণ। এখন বইয়ের শেষ প্রচ্ছদের ফ্ল্যাপ পড়ে জানলাম, আমার ধারণার চেয়ে দু’ গুণ বেশি বয়স তাঁর। ৫০। যে বছর ম্যাটরিক পাশ করে আমি কলেজে ভর্তি হই সেই ১৯৬২ সালে তাঁর জন্ম। কবিতায় অবশ্য কোনও বয়স নেই শাহীন রেজার, সময়ের চিহ্নও নেই। তবে পড়তে গেলে আমার মধ্যে জেগে ওঠে আমার ১৯-২৪ বছরের, বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের, যাবতীয় আবেগ অনুভব বিষাদ বেদনা বোধ ও চেতনার স্মৃতি। নামকবিতায় শাহীন রেজা যেমন লিখেছেন:
    “ফেলে রেখে কয়েকটি পালক চলে গেছে পাখি
    কবির উঠোন ছেড়ে... কবি তাকে দেখে না
    কোথাও... না বারান্দায়... না বৃক্ষের ডালে
    সুবর্ণ পাতার ফাঁকে... নেই নেই সে নেই
    পাখি চলে গেলে পালকেরা শুধুই স্মৃতি...”
    আর ‘সত্যনগর’ তো সব সময়ের কবিতা। চারপাশে যখন রাজলেহী ও কীর্তনিয়াদের ভিড়, তখন ক্ষতি স্বীকারে প্রস্তুত থেকে যিনি ভিন্নমত পোষণের ও সমালোচনার অধিকার সমুন্নত রাখতে পারেন তিনিই তো প্রকৃত কবি। এ কবিতা অনেকখানি আমারই কবিতা। কোনও দলে গ্রুপে গোষ্ঠীতে না থেকে, সকল আক্রমণ সহ্য করে, নিজেকে অব্যাহত রাখার আত্মনাদ এ কবিতা:
    “... চারদিকে গণিকারা যেন অজগর
    আমাকে চেয়েছে তারা ক্ষুধা ও রতিতে
    রাত্রি দিনের মাঝে তীব্র ক্ষতিতে
    আমার চেতনা কেড়ে ক্রমশ অবোধ
    চেয়েছে ছোবল দিতে যেন প্রতিশোধ...”
    তবে শাহীন রেজার মতো প্রেমে ও কামে নারীকে আমিও দেখেছি, তবে তিনি যেন বিচক্ষণ বেশি। ভালবেসে, প্রেমে পড়ে, কবিতার ভাষা ছন্দ সব ভুলভাল, তছনছ করেছি আমি, কিন্তু তা করেন নি তিনি। প্রেমে আবেগতপ্ত হলেও, কখনও বিষাদম্লান, কখনও স্মৃতিদুঃখী হলেও কবিতায় তিনি স্বস্থ। তাঁর নির্মাণ মেধান্বিত, শব্দবয়ন নিপুণ, ভাষা প্রসাধিত, অন্ত্যমিল অপ্রত্যাশিত আনন্দ জাগায়:
    “মৈথুন আনন্দে জাগি সারারাত
    আকাশের প্রপঞ্চ পাখায়
    সুখের করাত হয়ে কেটে চলি নদী-নারী
    এবং জরিনা সখিনা বেহুলার ভ্রূণ...” (‘অবগাহন’)
    “... যে নারী লবঙ্গলতা বেশবাসহীন
    অমরার দ্বার খুলে জেগে থাকে আর কামনার দীপ জ্বালে
    আমি খুঁজি তাকে সনাতন রাতে
    গণিকারা রতি করে মরা গাঙে হাঁসুলীর বাঁকে।” (‘লখিন্দর’)
    “নিজ হাতে ছিঁড়ে ফ্যালো হুক
    অন্ধকারে উদ্ভাসিত শুভ্র ডাহুক
    মাঝরাতে কাচ-চুড়ি শব্দদূষণ
    অদ্ভুত উড়ে যায় লজ্জা ভূষণ...” (‘মাঝরাতে শব্দদূষণ’)
    বইয়ের প্রথম প্রচ্ছদের ফ্ল্যাপে শাহীন রেজা সম্পর্কে বলা হয়েছে - তিনি প্রেম ও প্রকৃতির কাছে সমর্পিত। তাঁর কবিতা যেন মায়াবী জ্যোৎস্নার রাত। বর্তমানের বাস্তবতা এড়াতে কখনও-কখনও তিনি স্মৃতিবাসীও বটে। আরও বলা হয়েছে - শাহীন রেজা’র কবিতা প্রাঞ্জল, সহজ সরল জীবনবোধ ও মানবচেতনায় উজ্জ্বল। নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে তিনি নির্মাণ করেন কবিতাকে। তাঁর কবিতার উচ্চারণ সাহসী, গতি সাবলীল। এ বৈশিষ্ট্যগুলো তাঁর সমকালীনদের থেকে কতখানি স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত করবে তাঁকে তা বলা মুশকিল, কিন্তু সাঙ্কেতিক ব্যঞ্জনা সমৃদ্ধ কাব্যপঙ্‌ক্তি তাঁকে নিশ্চয়ই অলোচিত ও উদ্ধৃত রাখবে বিভিন্ন উপলক্ষে। এমন কয়েকটি পঙ্‌ক্তি উদ্ধার করছি এখানে:
    “যেদিকেই যেতে চাই মাকড়শা বসে আছে
    পেতে রেখে সময়ের জাল” (‘পথ এবং ঋতুবতী নারীদের গল্প’)
    “শালিকের দৃষ্টি থেকে ফসলেরা
    নিজেদের যেভাবে লুকায়...” (‘নীল চোখ’)
    “প্রিয় নারী প্রিয় তুমি
    সব থেকে চেনা
    তোমাকেই হবে তবু
    কড়ি দিয়ে কেনা।” (‘সরল পদ্য’)
    “ভালবাসো তাই
    হৃদ-পাত্র শূন্যে তোলে হাই।” (‘মাঝরাতে শব্দদূষণ’)
    “শহরের সবগুলো বৃক্ষ আমার নয়
    আমাকে তাই বাধ্য হয়ে ধার করতে হয় ছায়া...” (‘ছায়া’)
    এ রকম বচনবৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল পঙ্‌ক্তি ‘পাখি চলে গেলে কবি বড় একা’ থেকে উদ্ধার করা যায় আরও। ডবলিউ এইচ অডেন (১৯০৭-১৯৭৩) কবিতাকে বলেছেন ‘স্মরণীয় পঙ্‌ক্তিমালা’ - সে হিসেবে অমন অনেক পঙ্‌ক্তি রচনা করে কবি-অঙ্গীকার পূরণ করেছেন শাহীন রেজা। তিনি সম্পন্ন কবি। ভাল কবিতা রচনার আদি-অন্ত তাঁর আয়ত্তে - তাই জীবন ও জগতের আরও মহত্তর পরিসরে নতুন-নতুন নিরীক্ষায় তাঁর কবিতা উদ্ভাসিত হোক আরও - এটাই আমাদের প্রত্যাশা। সলমন রুশদি’র একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করছি এ প্রসঙ্গে - “A poet's work is to name the unnameable, to point at frauds, to take sides, start arguments, shape the world, and stop it going to sleep.” একই কথা আমারও।

sazzadqadir@gmail.com

বৃহস্পতিবার, ৭ জুন, ২০১২

এক মন্ত্রী, তাঁর পিএস

শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮৬-১৯৭১) ছিলেন কুমিল্লার খ্যাতিমান আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ।  যুক্ত ছিলেন ইনডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস-এর সঙ্গে, পরে ১৯৫৪ সালে গঠন করেন ‘গণসমিতি’ নামে এক রাজনৈতিক দল। আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে গঠিত পূর্ববঙ্গ সরকারের মন্ত্রীসভায় তিনি ছিলেন মেডিক্যাল, পাবলিক হেলথ ও সোস্যাল ওয়েলফেয়ার মন্ত্রী (সেপটেম্বর ১৯৫৬ - অকটোবর ১৯৫৮)। তার প্রাইভেট সেক্রেটারি (পিএস) ছিলেন আবদুল ওহ্‌হাব (১৯০৪-১৯৯০)। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আগে তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী নীল মিঞা ও মনোরঞ্জন ধরেরও প্রাইভেট সেক্রেটারি ছিলেন অল্প কিছু দিনের জন্য। তখন মন্ত্রীসভার গঠন ও পতন ঘটছিল ঘন-ঘন। মৃত্যুর প্রায় ২২ বছর পর সম্প্রতি আবদুল ওহ্‌হাবের স্মৃতিকথা “একজন মুসলমান বাঙালির জীবনস্মৃতি” (জাগৃতি প্রকাশনী, ঢাকা; পৃষ্ঠা ১৮২; মূল্য ৳ ৩০০.০০) প্রকাশিত হয়েছে পুত্র মো. শাহাবুল আলমের উদযোগে। বইটির ১৭ পৃষ্ঠা জুড়ে (১১০-১২৬) রয়েছে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রাইভেট সেক্রেটারি হিসেবে তাঁর দু’ বছরের নানা অভিজ্ঞতার বিবরণ। সে জীবনের শুরুটা এ রকম - আবদুল ওহহাব লিখেছেন:
    “... ধীরেন্দ্র বাবু কুমিল্লার এডভোকেট। আমার শ্বশুর খাঁন বাহাদুর ফরিদউদ্দিন সাহেবও কুমিল্লার এডভোকেট। সুতরাং উভয়েই বন্ধু। তবে ধীরেন্দ্র বাবু বয়সে বড়। দুইজনই বহুদিন রাজনীতি করেছেন। ধীরেন্দ্র বাবু কংগ্রেসি আর আমার শ্বশুর মুসলিম লীগের।
    ধীরেন্দ্র বাবু মন্ত্রী হিসেবে অফিসে আসার প্রথম দিনেই আমি গিয়ে দাঁড়ালাম দোতলার সিঁড়ির কাছে। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতেই দিলাম তাঁকে সালাম, আর বললাম, স্যার, আমি আপনার প্রাইভেট সেক্রেটারি। এটির চেয়েও বড় কথা হলো, আমি কুমিল্লার হুমায়ূন সাহেবের জামাই।
    এই কথা শুনে তিনি হাসলেন আর বললেন, তাহলে তো আপনি আমাদের আপন লোক।...”
    এ ঘটনা ১৯৫৬ সালের। তখন পাকিস্তান আমল। এখন এই ৫৬ বছর পর, ২০১২ সালে, স্বাধীন দেশের গণতান্ত্রিক আমলে ভাবুন তো দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের দুই নেতার মধ্যে এমন বন্ধুত্ব - এক দলের মন্ত্রীর পিএস আরেক দলের নেতার মেয়ের জামাই?
    আবদুল ওহ্‌হাবের ‘জীবনস্মৃতি’ থেকে উদ্ধৃত করার মতো ঘটনা অনেক, যা আজকের পরিপ্রেক্ষিতে রূপকথাই মনে হবে অনেকের কাছে। কৌতূহলী পাঠকেরা সে সব ‘রূপকথা’র খোঁজ নিতে অবশ্যই বইটি খুঁজে নিয়ে পড়বেন আশা করি। পিএস-এর বর্ণনায় মন্ত্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রথম দিনের ঘটনা উদ্ধৃত করেছি, এবার শেষ দিনের ঘটনা উদ্ধৃত করে এ বৃত্তান্তে যবনিকা টানছি:
    “(মারশাল ল’ জারির খবর) শুনে সঙ্গে-সঙ্গে ছুটে গেলাম তাঁর (ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের) বাসায়। যেতেই বললেন, সেক্রেটারি সাহেব, আজ থেকেই সারা পাকিস্তানে জারি হয়েছে মারশাল ল’। আইয়ুব খান এখন পাকিস্তানের সর্বেসর্বা। আমরা আর কেউ নই মন্ত্রী।
    বলেই বললেন, দেখুন না, নেই টেলিফোন। নেই গার্ড। কুমিল্লা যেতে হবে আজই, কিন্তু যাবো কি করে? হাতে যে নেই টাকা-পয়সা।
    এমন সময় সেখানে এলেন পাবলিক হেলথের চিফ ইনজিনিয়ার লতিফ সাহেব। বললেন তাঁকে, কি করে মালপত্র নেবো স্টেশনে?
    লতিফ সাহেব বললেন, সে জন্য ভাববেন না, স্যার। আমরা আছি কি করতে?
    লতিফ সাহেব বন্দোবস্ত করলেন গাড়ির। ধীরেন্দ্র বাবু বাড়ির সব লোকজনকে নিয়ে চললেন স্টেশনে। আমিও চললাম সঙ্গে।
    স্টেশনে যাওয়ার পর তিনি বললেন একজনকে, একখানা ইনটার ক্লাশের টিকেট করে আন।
    এ কথা শুনে আমি দিলাম বাধা। বললাম, না, তা কিছুতেই হয় না। আপনাকে অন্ততপক্ষে যেতে হবে ফার্স্ট ক্লাশে।
    বললেন তিনি, ফার্স্ট ক্লাশের ভাড়া পাবো কোথায়?
    দুঃখের বিষয় আমার সঙ্গেও ছিল না বেশি টাকা-পয়সা। তাই আমাকে থাকতেই হলো চুপ। তবুও শেষ পর্যন্ত তাঁকে করে দেয়া হলো একখানা সেকেন্ড ক্লাশের টিকেট। অন্যরা গেলেন ইনটার ক্লাশে।...”
    এ রচনার শিরনামা পড়ে যাঁরা ভেবেছিলেন কোনও কালো বিড়ালের কাহিনী পড়বেন তাঁদের নিরাশ করার জন্য দুঃখিত।

facebook.com/sazpa85
   
   

ফররুখ আহমদ: নিবেদিত কবিতা

কবিকে প্রেরণা যোগায় জীবন ও প্রকৃতি। বহমান কাল ভাবিত রাখে তাঁকে। আস্থা তাঁর পরম্পরায়। তাই যুগ-যুগান্তের কবিতা সংলগ্ন থাকে বোধে, চেতনায়। এভাবে কবিতার সঙ্গে পূর্বসূরি কবি-ও থাকেন তাঁর অন্তরাসীন। নিবেদিত কবিতায় সে অনুরাগের স্বীকৃতি ঘোষণা করেন কবি, নিজের শিল্পভাবনাও প্রকাশ করেন সেই সঙ্গে। যুগসন্ধির কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯) অনুরক্ত ছিলেন নবদ্বীপের রাজসভাকবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর (১৭১২-১৭৬০) থেকে ইংরেজ ব্যঙ্গ-কবি আলেকজানডার পোপ (১৬৮৮-১৭৪৪) পর্যন্ত অনেকের। বিশেষ কোনও কবিকে কোনও কবিতা নিবেদন না করলেও তাঁর কবি ও কবিতা বিষয়ক ভাবনা প্রকাশ পেয়েছে ‘কবি’ শীর্ষক কবিতায় - “কবির বর্ণনে দেখি ঈশ্বরীয় লীলা। ভাব-নীরে স্নান করি দ্রব হয় শিলা ॥ তুলারূপে দৃষ্ট হয় ধন আর মন। ভাবরসে মুগ্ধ করে ভাবুকের মন ॥ রসিকজনের আর নাহি থাকে ক্ষুধা। প্রতি পদে বর্ণে বর্ণে কর্ণে যায় সুধা ॥ জগতের মনোহর ধন্য ভাই কবি। ইচ্ছা হয়, হৃদিপটে তুলি তোর ছবি ॥”
    নিবেদিত কবিতার ক্ষেত্রে আদর্শ স্থাপন করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩)। সমকালীন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ছাড়াও সেকালের কীর্তিধন্য কবিদের উদ্দেশে কবিতা নিবেদন করেছেন তিনি। কাশীরাম দাস, কৃত্তিবাস, জয়দেব, কালিদাস, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, দানতে, আলফ্রেড টেনিসন, ভিকতর উগো, বাল্মীকি প্রমুখকে নিবেদিত তাঁর কবিতা কেবল শ্রদ্ধা নিবেদন বা প্রশস্তি নয়, তাঁদের কীর্তির মূল্যায়নও করেছেন প্রসঙ্গক্রমে। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ও ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের প্রতি সরাসরি না হলেও তাঁদের সৃষ্টির সার্থকতাকে কবিতায় তুলে ধরেছেন মধুসূদন। রবীন্দ্রনাথ প্রবন্ধ-নিবন্ধে অনেক কবি-সাহিত্যিককে স্মরণ করলেও তাঁর নিবেদিত কবিতার সংখ্যা মাত্র তিন। এর মধ্যে কালিদাসের প্রতি নিবেদিত কবিতায় আছে তাঁর একাত্মতার অনুভব, আর অতুলপ্রসাদ সেন (১৮৭৪-১৯৩৪) ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২)-কে নিবেদিত কবিতা দু’টি আসলে মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ। অবশ্য ‘বৈষ্ণব কবিতা’য় তিনি বিশেষভাবে মূল্যায়ন করেছেন মহাজন-পদকর্তাদের। কাজী নজরুল ইসলামের নিবেদিত কবিতা ‘সত্য-কবি’ ও ‘সত্যেন্দ্র-প্রয়াণ-গীতি’-ও কবি সত্যেন্দ্রনাথের দত্তের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ। রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত তাঁর ছ’টি কবিতার দু’টিই এ ধরনের  শোকপ্রকাশমূলক।
    বাংলা কবিতায় ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪) যাঁর কীর্তিমান উত্তরসূরি, যাঁর ধীরোদাত্ত ভাষা ও দার্ঢ্য মহিমাকে নিজস্ব ভাব-ব্যঞ্জনায় তিনি অন্যলোকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন, সেই মাইকেল মধুসূদন দত্তকে নিবেদিত কোনও কবিতা তাঁর নেই। তবে অনুসৃতি আছে তাঁর কবিতাদর্শের। নিবেদিত কবিতায় তিনিও মাইকেলের নিবেদিত কবিতার মতোই শ্রদ্ধা নিবেদন ও প্রশস্তির পাশাপাশি তাঁদের কবিকীর্তির মহিমাকে তুলে ধরেছেন, স্বীকৃতি জানিয়েছেন তাঁদের ঐতিহ্যের অংশীদার হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করে। অবশ্যই দু’জনের অংশীদারিত্বে ভিন্নতা আছে। মধুসূদন ঐতিহ্যসূত্র খুঁজেছেন ইউরোপে ও বাংলা-ভারতে, ফররুখ খুঁজেছেন মধ্যপ্রাচ্যের ফারসি ও বাংলার পুঁথি-সাহিত্যে। তাঁর কবিতা নিবেদিত হয়েছে ফেরদৌসী, রুমি, জামি, সাদি, হাফিজ ও শাহ গরীবুল্লাহকে। দিওয়ানা মদিনা, শহিদে কারবালা, তাজকেরাতুল আউলিয়া, কাসাসুল আমবিয়া, আলিফ লায়লা, শাহনামা, চাহার দরবেশ, হাতেম তায়ী প্রভৃতি পুথি, গীতিকা ও লোকসাহিত্যের উদ্দেশ্যে রচিত কবিতাগুলিও আসলে রচয়িতাদের প্রতি নিবেদিত। এই নিবেদন বিচ্ছিন্ন কোনও কাব্যপ্রয়াস নয়, তাঁদের কাব্যভাবনা ও শিল্পবীক্ষারই প্রকাশ।
    কবিতা কি? মধুসূদন লিখেছেন, “মনের উদ্যান-মাঝে কুসুমের সার কবিতা-কুসুম-রত্ন” (‘কবিতা’)। আরও লিখেছেন, কবিতায় যার মন মজে না সে এক ঘোরতর দুর্মতি। বিজ্ঞজনকেই তাই তুষ্ট করতে চেয়েছেন তিনি কবিতার মাধ্যমে। আর কবি কে? মধুসূদনের মতে, তিনিই কবি “কল্পনা সুন্দরী যার মনঃ-কমলেতে পাতেন আসন,” অস্তগামী সূর্যের সোনালি কিরণের যে আভা অমন রূপ প্রকাশ পায় যার “ভাবের সংসারে” (‘কবি’)। ফররুখ আহমদ-ও কবিতাকে বলেছেন, হৃদয়ে জেগে থাকা স্বপ্ন (‘কবিতার প্রতি’)। আরও বলেছেন, জীবনে জন্ম নেয়া রক্তদল (‘দুর্লভ মুহূর্ত’)। তাঁর কাছে কবিতা মুহূর্তের কলতান, কিন্তু আবেদন তার কালজয়ী (‘মুহূর্তের কবিতা’)। তাই মধুসূদন যে মহৎ কল্পনা ও মহৎ ভাবের কথা বলেছেন ফররুখ আহমদের কাছে কবিতা তারও বেশি কিছু। কবির অপরাজেয় সত্তার চিরভাস্বর রূপই কবিতা। তিনি লেখেন ‘কবির প্রতি’ -
    “বজ্র বিদ্যুতের বাসা যে আকাশ, তুমি সে আকাশে, তুমি সে আকাশে
    সহজে নিয়েছ তুলি পাদপিষ্ট ধূলিকণিকারে,
    তারার ঔজ্জ্বল্যে দীপ্ত মহিমায় সাজায়েছ তারে
    যে সত্তা অপরাজেয় তারে মূর্ত করেছ বিশ্বাসে।...”
    কবিতাই পারে ‘পাদপিষ্ট’ জনকে অত্যুচ্চ মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে। নিবেদিত কবিতায় এই বিশ্বাসকে, এই বিশ্বাসের প্রতি সমর্থনকেই শিল্পিত রূপ দিয়েছেন ফররুখ আহমদ। পূর্বসূরিকে নিবেদিত কবিতায় লিখেছেন -
    “...কত তন্দ্রাহীন রাত্রি কেটেছে তোমার নিরলস,
    শ্রান্তিহীন দিনগুলি কেটে গেছে একাগ্র তোমার
    তিক্ততম সাধনায়। পেয়েছো বিদ্রূপ উপেক্ষার,
পেয়েছো লাঞ্ছনা, ঘৃণা, সুনির্মম, বিস্বাদ, বিরস!
চাও নি সুলভ খ্যাতি (সন্ত্রস্ত করে নি অপযশ)
তোমাকে মর্যাদা দিয়ে পাই আমি পাথেয় আমার ॥”
মধুসূদন-ও একই ভাবে স্মরণ করেছেন - মর্যাদা দিয়েছেন মৃত্যুর পর কয়েক বছরের মধ্যেই বিস্মৃত, উপেক্ষিত ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে -
“...নাহি কি কেহ তব বান্ধবের দলে,
তব চিতা-ভস্মরাশি কুড়ায়ে যতনে,
স্নেহ-শিল্পে গড়ি’ মঠ, রাখে তার তলে?
আছিলে রাখাল-রাজ কাব্য-ব্রজধামে
জীবে তুমি; নানা খেলা খেলিলা হরষে;
যমুনা হয়েছ পার; তেঁই গোপগ্রামে
সবে কি ভুলিল তোমা’?...”
ফারসি মহাকাব্য ‘শাহনামা’র কবি হাকিম আবু’ল-কাসিম ফেরদৌসি তুসি (৯৪০-১০২০) নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে। কিন্তু অমর হয়ে আছে তাঁর সৃষ্টি। ফররুখ আহমদ লিখেছেন:
“... শতাব্দীর অন্ধকার দীর্ণ করি’ তাই জেগে আছে
তোমার মহৎ কাব্য অম্লান আভায় জীবনের,
মিশেছে তাজ ও তখত কায়কোবাদ-কায়কাউসের
তোমার অরণ্য তবু সজীব, শ্যামল চারাগাছে,
তোমার প্রতিভা-দীপ্তি মানে নাই শতাব্দীর ঘের
আজও সে বিলায় দ্যুতি দূরতম নক্ষত্রের কাছে ॥”
ফারসি কাব্য ‘হফত আওরঙ্গ’, ‘তুহফাত আল-আহরার’, ‘লায়লা ওয়া-মজনুন’, ‘ফাতিহাত আল-শাবাব’, ‘লাওয়া’ইহ’ ও ‘আল-দুররাহ আল-ফকিরাহ’র রচয়িতা নূর আদ-দিন আবদ আর-রহমান জামি (১৪১৪-১৪৯২)-কে নিবেদিত কবিতায় ফররুখ আহমদ তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, “সত্যান্বেষী প্রাণ যার ঘূর্ণিঝড়ে, রাত্রির তুফানে তুমি সে প্রেমিক সুফি”। আরও বলেছেন, “প্রেমিক আশিক তুমি অফুরন্ত তোমার সঞ্চয় / ভাবের সমুদ্র থেকে দিলে এনে বাণী এ সত্যের...”। এই সত্য ও সুন্দরের প্রসঙ্গ তিনি তুলে ধরেছেন ফারসি কাব্য ‘মসনবি’, ‘দিওয়ান-ই শামস-ই তাবরিজি’ ও ‘ফিহি মা ফিহি’ প্রণেতা জালাল আদ-দিন মুহাম্মদ রুমি (১২০৭-১২৭৩)-কে নিবেদিত কবিতায়ও। লিখেছেন: “... সত্যের নিগূঢ় বার্তা প্রাণকেন্দ্রে যার সংগোপন / (দুস্তর তরঙ্গ ঊর্ধ্বে, মর্মে তার মোতির ভা-ার), / মানে নি, মানে না মানা সত্যাশ্রয়ী, - মিথ্যার বন্ধন; / খুলে দেয় প্রয়াসীকে অফুরন্ত রহস্যের দ্বার।...” ফারসি ভাষায় রুমি যে যুগান্তর আনেন তা-ও বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেছেন তিনি। ফারসি ‘গুলিসতাঁ’ ও ‘বুসতাঁ’র কবি আবু-মুহাম্মদ মুসলিহ আল-দিন বিন আবদাল্লাহ শিরাজি (১১৮৪-১২৮৩), যিনি সা’দি নামে সমধিক পরিচিত, তাঁকে নিবেদিত কবিতায় তাঁর কাব্য সৌন্দর্য, প্রেম ও প্রজ্ঞার প্রশস্তি রচনা করেছেন ফররুখ আহমদ - “... সব মৌসুমের শস্য তুলে নিলো যে তার ভা-ারে, / বিশ্বের গুলিস্তাঁ থেকে কুড়ালো যে ফুলের ফসল / জ্ঞানী সে, মরমী জন, প্রেমপন্থি;... সে চির উজ্জ্বল / নিঃস্বার্থ ত্যাগে সংখ্যাহীন প্রাণের দুয়ারে।...” ফারসি ‘দিওয়ান’-এর কবি খাওয়াজা শামসু দ-দিন মুহাম্মদ হাফেজ-ই শিরাজি (১৩২৫-১৩৮৯)-কে তিনি বলেছেন কানন মুখর করা মৃত্যুহীন বুলবুল। তাঁর ‘দিওয়ান’, গজলকে বলেছেন ‘অমর গীতিকা’। এ গীতিকা অনন্য হয়েছে ভাব ও ভাষার অপূর্ব সম্মিলনে।
কাব্যভাষা-চিন্তা সবসময়েই ছিল ফররুখ আহমদের। মুখের ভাষাকে সাহিত্যের ভাষার ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার চিন্তা করতেন তিনি। সেই চিন্তা থেকেই তিনি ঐতিহ্যের সন্ধান করেছিলেন সতের-আঠারো শতকের পুঁথি-সাহিত্যে। এ সাহিত্যের ‘শ্রেষ্ঠ কবি’ শাহ মুহম্মদ গরীবুল্লাহ (১৮ শতক)-কে নিবেদিত কবিতায় তিনি ‘জীবন্ত ভাষা’ বলেছেন পুঁথির ভাষাকেই:
“... জীবন্ত ভাষার স্রোতে ভেসে গেল কোথায় তখন
মৃত ভাষা (গুরুতর সংস্কৃতের শিখা জগদ্দল)!
সিন্দাবাদ জাহাজীর স্কন্দ হতে জয়ীফ যেমন
জমিনে লুটায়ে পড়ে দিলো ছেড়ে বাধার অর্গল;
চঞ্চল ঝর্নার মতো প্রচলিত ভাষার উচ্ছল
গতিতে উন্মুখ হলে রসান্বেষী জনসাধারণ ॥”
‘চলতি ভাষার পুঁথি’ শীর্ষক কবিতায় এ ভাষাকে ‘জীবন্ত মাতৃভাষা’ ও ‘জীবনের ভাষা’ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি:
“... দুঃসহ দুঃখের পালা শেষ হলো একদা, যেদিন
মুক্তি পেলো জীবনের ভাষা, আর নিরুদ্ধ জবান
জিন্দানের রাত্রিশেষে পেলো খুঁজে রোশনি অমলিন;
আড়ষ্ট প্রহর শেষে যেন সে উচ্ছল বহমান
কূলপ্লাবী নদী এক পূর্ণতার পথে সুরঙিন
জীবন্ত ভাষায় দীপ্ত পরিপূর্ণ যৌবনের গান ॥”
বস্তুত এককালে পুঁথির বিপুল পাঠকপ্রিয়তার মূলে ছিল এর ভাষা। এ ভাষা ছিল বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি। ওই ভাষা-পরীক্ষার সূত্রেই মানবতার কবি হয়েও ‘ইসলামী ঐতিহ্যবাদী’ চিহ্নিত হয়ে যান ফররুখ আহমদ। তবে তাঁর পরীক্ষার বাস্তব ভিত্তি ছিল, তাই একেবারে নিস্ফল হয় নি তা। এখনকার নবীন লেখকদের ভাষায় নানাভাবে ওই একই পরীক্ষা-নিরীক্ষা লক্ষ্য করি, এর পাঠকপ্রিয়তারও ক্রমবৃদ্ধিও লক্ষ্য করি।
facebook.com/sazpa85