বৃহস্পতিবার, ২৬ জুলাই, ২০১২

একালের রূপকথা

এক যে আছে হোমরা ও চোমরা। লেখাপড়া, চাকরি ও ব্যবসা - কোনওটাতে সুবিধা করতে না পেরে তারা পার্টি করে খায় এখন। নেতার নামে চালায় সমিতি-সংগঠন। খায় চাঁদা-তোলা তুলে। নাম কা ওয়াস্তে অনুষ্ঠান-কর্মসূচিও করে হুমকি দিয়ে অন্যদের ঘাড় মটকে। সেখানে খরচপাতি করে নামমাত্র, বাকি পুরোটাই গোঁজে ট্যাঁকে। ইলেকশন জনসভা সংবর্ধনা ইত্যাদি থাকলে ওই গোঁজার পরিমাণ বাড়ে অনেক। এ সব করে-করেই গাড়ি বাড়ি নারী সব হয় হোমরা ও চোমরা’র। সমাজ-সম্মানও হয়। আতি থেকে পাঁতি, তারপর নেতাই হয়ে ওঠে।
তাদের এ পর্যন্ত সব ওঠাই কিন্তু পাবলিকের টাকা মেরে। কাজেই ওই মারার অভ্যাস আর যায় না কিছুতে। বাকি জীবন কাটে পরেরটা খেয়ে ও মেরে। নেতা হয়ে সময়-সুযোগ পেয়ে ওই মেরে-মেরেই নমিনেশন কেনে তারা, ইলেকশন করে, জেতে, এমপি-মন্ত্রী হয়। এজন্য ট্যাঁক থেকে খসাতে হয় না কিছু, বরং এ সবই হয়ে ওঠে বড়-বড় দানে ট্যাঁকে গোঁজার উপায়। সরকারে পদ পাওয়ার পর আয়-উপার্জন আরও বাড়ে হোমরা ও চোমরা’র। সেখানে খরচ নেই, সব কিছু সরকারের। সরকারের মাল মানে তো দরিয়া মে ডাল! কিন্তু সরকার বা রাষ্ট্রের অর্থ তে জনগণের অর্থ। সরকারের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী জনগণের অর্থে শিক্ষালাভ করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন জনগণের অর্থে। ওই অর্থ নির্বিশেষে সকল দেশবাসীর, কোনও বিশেষ দলের নয়। এই অর্থে কোনও দলাদলি না করারই কথা, কিন্তু কাজের চেয়ে দলাদলিই  বেশি করেন তাঁদের অনেকে। এই তাঁদেরই কাজে লাগিয়ে, ব্যবহার করে আঙুল ফুলে কলাগাছ থেকে বটগাছ হয় হোমরা ও চোমরা। কোনও খরচ নেই, কেবলই আয় আর আয়। বিত্ত আর সম্পদ। ধন আর ঐশ্বর্য।
কাজ কি হোমরা ও চোমরা’র? আমলা খাটিয়ে খাওয়া। আলিশান বাড়িতে থাকা। লেটেস্ট মডেলের ঝাঁ চকচকে গাড়ি হাঁকানো। সপরিবারে দলে-বলে বিদেশে-বিদেশে ঘোরা। ফাইভ স্টার। শপিং। হাই-ফাই। ছেলেপুলে পড়ানো ইউরোপ-আমেরিকার নামী-দামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। দেশে বাড়ছে জনসংখ্যা, পণ্যমূল্য, গ্যাস পানি বিদ্যুৎ বিভ্রাট, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, কোন্দল-হানাহানি, মাদকাসক্তি, রোগ-ব্যাধি, দারিদ্র্য, শ্রমিক অসন্তোষ, শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা, দুর্নীতি, কুশাসন, জাল-ভেজাল, চোরাকারবার, অনিয়ম, অব্যবস্থা, অনুন্নয়ন। তাতে হোমরা-চোমরার কি? তারা বিবৃতি বক্তৃতা ভাষণ দিয়ে যাচ্ছে গলা ফাটিয়ে। সাজগোজ করে যাচ্ছে সভা, সেমিনার, টিভি-বেতারে দেশ জাতি জনগণের জন্য জানপাত করে যাচ্ছে দিন-রাত।
আসলে কি তাই? জনগণের কাছ থেকে নেয়া ছাড়া জনগণকে কখনও কিছু দেয় কি হোমরা-চোমরা? নিজেরা কি কিছু করতে পারে তারা? নিজেদের প্রচারের জন্য সরকারের বা অন্যের পত্রিকা বা বেতার-টিভি তাদের ভরসা, নিজেদের কিছু নেই ও সব। থাকলেও পাতে নেয়া যায় না সেগুলো। হোমরা-চোমরাকে বলি, পরোপকারের নামে আর কত নিজের উপকার করবে? সত্যি-সত্যি কিছু করো পরের জন্য। নাহয় একটা ছোটখাটো রাস্তাই করো। সেতু না পারো অন্তত একটা কালভার্ট করো। লোকজনের জন্য খাবার পানির ব্যবস্থা করো বিভিন্ন ভিড়ের স্থানে। শহরে-শহরে পাবলিক টয়লেট করে দিয়ে নারী শিশু বৃদ্ধদের কষ্ট দূর করো। নোংরা জঞ্জাল আবর্জনা সরাবার ও রিসাইক্লিং করার ব্যবস্থা করলে উপকার হয়, আয়ও হয়। মানে কিছু একটা করো। সামান্য হলেও করো। দেখিয়ে দাও নিজের অর্থে নিজেরা কিছু করতে পারো। হোমরা-চোমরা বলে, ঠিক বলেছো ভাই। এটা আমাদের মনের কথা। এটা আমরাও চাই। কিন্তু কিভাবে হাত উপুড় করতে হয় তা আগে শিখিয়ে দাও আমাদের। বলেই কেমন আমতা-আমতা করে হোমরা-চোমরা, মনে হয় শিখলেও হবে না। আমাদের হাতেই তো উপুড় করার সিসটেম নাই! অপারেশন ছাড়া হাত উপুড় হবে না!
sazzadqadir@rediffmail.com

হুমায়ূন আহমেদ, ব্যক্তিগত

হুমায়ূন আহমেদ গুরুতর অসুস্থ - ন’মাস আগে এ খবর পাওয়ার পর থেকে ১৯শে জুলাই রাত ১১-৩০টার পরে ফেসবুকে তাঁর মৃত্যুর খবর পাওয়ার আগ পর্যন্ত - একবারও আমার মনে হয় নি যে সেরে উঠবেন না তিনি। নিউ ইয়র্কের বেলভিউ হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চলছে জেনে আরও নিশ্চিত ছিলাম এ ব্যাপারে। কিন্তু সবাইকে শোকস্তব্ধ করে অকালে অকস্মাৎ বিদায় নিলেন তিনি, এই বিমূঢ় স্তব্ধতা সহসা ঘুচবে না কারও।
    হুমায়ূন আহমেদকে চিনি ১৯৭০ সাল থেকে। সেটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের শেষ বছর। থাকতাম মুহসিন হলে। সেখানেই দেখেছি তাঁকে। ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সখ্য ছিল মাহফুজ উল্লাহ’র সঙ্গে। আহমদ ছফা’র সঙ্গে একবার এসেছিলেন আমার ২১১ নম্বর রুমে। তেমন কোনও কথা হয় নি তখন, লেখালেখি নিয়েও না। ছফা ভাইয়ের সঙ্গে কোনও না কোনও অনুরাগী থাকতেন সব সময়, ভেবেছি তাদেরই একজন। স্বাধীনতার পর এক দিন তাঁকে দেখি আহমদ ছফা’র সঙ্গে। এবার জানা গেল হুমায়ূনের লেখালেখির খবর। ছফা ভাই বললেন, ও দারুণ উপন্যাস লিখেছে একটা। প্রকাশক পাচ্ছি না। শরীফ স্যরের কাছে যাচ্ছি... যদি একটা ভূমিকা লিখে দেন।
    পরে উপন্যাস পড়ে আহমদ শরীফ স্যর ভূমিকা লিখে দেন ওই উপন্যাসের। এরপর রাজি হন প্রকাশক। ছাপা হয় ‘নন্দিত নরকে’। প্রকাশের পর-পরই নানা ভাবে আলোচিত হয় উপন্যাসটি, পাঠকপ্রিয়ও হয়। ওই সময় লেখক শিবির ও বহুবচন নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত আমি। অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। লেখক শিবির উপন্যাসটিকে পুরস্কৃত করে ১৯৭৩ সালে, ১৯৭৫ সালে বহুবচন মঞ্চস্থ এর নাট্যরূপ। বহুবচন ১৯৯০ সালে তাঁর ‘দেবী’ নাটকটিও মঞ্চস্থ করে। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, কৃষ্ণনগর ও চাকদহ-এও এ নাটকের প্রদর্শনী করেছেন তাঁরা। ‘নন্দিত নরকে’র পর হুমায়ূন লেখেন ‘শঙ্খনীল কারাগার’। এ উপন্যাসটিও পাঠকপ্রিয় হয় ‘নন্দিত নরকে’র মতোই।
     লেখালেখিতে হুমায়ূনের ছেদ পড়ে যখন তিনি পিএইচডি গবেষণার জন্য যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভারসিটিতে। সেখানে দু’ বছর তিনি পড়াশোনা করেন ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি নিয়ে, পরে পিএইচডি করেন পলিমার কেমিস্ট্রিতে। ফাঁকে-ফাঁকে অবশ্য কিছু লেখালেখি করেছেন তিনি। মনে আছে, প্রবাস-জীবনের টুকরো-টুকরো নানা কিছু লিখে পাঠাতেন ‘বিচিত্রা’য়, সেগুলো একসঙ্গে ছাপতাম ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে’ শিরোনামের একটি বিভাগে।
    দেশে ফিরে দৈনিক বাংলা-বিচিত্রা বলয় ঘিরে পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠে হুমায়ূনের গল্প-উপন্যাস। ওই বলয়ে প্রধান ছিলেন সালেহ চৌধুরী, আলমগীর রহমান ও হাসান হাফিজ। আলমগীর তাঁর বই প্রকাশনায় (অবসর প্রকাশনীর মাধ্যমে), সালেহ চৌধুরী ও হাসান হাফিজ তাঁকে নিয়ে লেখালেখিতে রেখেছেন বিশেষ ভূমিকা (বিশেষ করে দৈনিক বাংলা-বিচিত্রা’য়)। কাজী আনোয়ার হোসেনের সেবা প্রকাশনীর জন্যও লিখেছেন হুমায়ূন। তবে উইলিয়াম পিটার ব্লেটি’র ‘দি এঙরসিস্ট’ (১৯৭১) অনুবাদ নিয়ে মতান্তর ঘটার পর আর লেখেন নি সেখানে। ওই অনুবাদ সম্পাদনার দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিস্তর খাটতে হয় আমাকে। দেখে কাজী আনোয়ার হোসেন খুশি হন, অন্যান্য বই সম্পাদনা করে যত সম্মানী পেয়েছি তার দ্বিগুণ বরাদ্দ করেন সেবার। কিন্তু সেই সম্পাদিত পাণ্ডুলিপি দেখে হুমায়ূন ক্ষুব্ধ হন খুব। এত কাটাকুটি?  রাগ আর সামলাতে পারেন না তিনি। তখন তাঁকে শান্ত করতে কোথায় কেন কি পরিবর্তন-পরিমার্জন-পুনর্লিখন করতে হয়েছে তা বোঝাবার চেষ্টা করেন কাজী আনোয়ার হোসেন। জানিয়ে দেন, সম্পাদিত রূপটিই শুধু ছাপতে রাজি আছেন তিনি। কিন্তু মানতে পারেন না হুমায়ূন, রাগে দুঃখে ক্ষেপে গিয়ে চলে যান পাণ্ডুলিপি নিয়ে। পরে অবশ্য ফিরে আসেন, বলেন, খুব রেগে গিয়েছিলাম। মাথা ঠিক ছিল না। আপনি সংশোধিত রূপটিই ছাপুন।
    পরে সেই সম্পাদিত রূপেই ছাপা হয় ‘এঙরসিস্ট’। পরে এ নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া দেখি নি তাঁর। দেখা হলে কখনও বুঝতে দেন নি সেই রেগে যাওয়ার বিষয়টি। তাঁর এই মেনে নেয়ার ক্ষমতার উচ্চ মূল্যায়ন করেছেন কাজী আনোয়ার হোসেন। গত ১৯শে জুলাই ছিল তাঁর ৭৬তম জন্মদিন। সেদিন সকালে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে অনেক স্মৃতিচারণ করি আমরা। রাতে হুমায়ূনের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে পরদিন সকালে আবারও ফোনে কথা বলি কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তখন কথায়-কথায় ওঠে ‘এঙরসিস্ট’-এর অনুবাদ ও সম্পাদনার সেই প্রসঙ্গ। বললেন, হুমায়ূন বড় মাপের মানুষ ছিলেন। ওই বইয়ের ঘটনা তো বটেই অন্যান্য বইয়ের ক্ষেত্রেও তার ব্যবহারে বুঝেছি তা।
    দুঃখ করে বললেন, আমার জন্মদিনের তারিখটা তাঁর মৃত্যুদিনের তারিখ হয়ে গেল!
    মনে পড়ে ওই ঘটনার কয়েক বছর পর হুমায়ূন আমাকে উপহার দেন তাঁর ‘সৌরভ’ নামের উপন্যাসটি, লেখেন ‘সাযযাদ কাদির প্রিয়বরেষু...’।  সেদিন ছিল ২০শে জুলাই, ১৯৮৫। কাকতালীয়, কিন্তু কি বিচিত্র!
    আসলেই অত্যন্ত সহৃদয় মানুষ ছিলেন হুমায়ূন, মনটা ছিল বড়। এক সময় তাঁর কড়া সমালোচনা করতেন হুমায়ুন আজাদ। তাঁর উপন্যাসকে বলতেন ‘অপন্যাস’, টিভি নাটককে বলতেন ‘ওয়ান-টাইমার’। কিন্তু এ নিয়ে কখনও কোনও প্রতিক্রিয়া দেখান নি হুমায়ূন আহমেদ। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দু’জনের অন্তরঙ্গতাই লক্ষ্য করেছি বেশি।
একবার ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গে যাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বিভাগে। সেখান থেকে তিনি নিয়ে যান তাঁর বাসায়।  টিভি নাটক নিয়ে কথা হয় অনেকক্ষণ। বলি, তাঁর নাটকে ব্ল্যাক হিউমারের লক্ষণ আছে। এ কথায় উৎসুক হন তিনি। পরে ‘বহুব্রীহি’র পাণ্ডুলিপি দিয়ে বলেন, ঈদ সংখ্যায় ছাপুন। কোনও সম্মানী দিতে হবে না।
তখন আমি ‘তারকালোকে’র সম্পাদক।
ওই সময় হুমায়ূনের চেহারার সঙ্গে সাদৃশ্যের কারণে নানা বিড়ম্বনায় পড়ছিলাম এখানে সেখানে। বইমেলায় তাঁর ভক্ত, টিভির শিল্পী, এমনকি তাঁর ছাত্র-ছাত্রী পর্যন্ত ভুল করে বসতো মাঝেমধ্যে।  সেদিন এ নিয়ে বেশ হাসাহাসি করি আমরা। হুমায়ূন স্ত্রীকে ডেকে বলেন, আছে কোনও মিল সাযযাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার? তিনি একবার তাকিয়েই বলেন, না।
পরে দু’জনে হাঁটতে-হাঁটতে আসি এলিফ্যান্ট রোডে। পথে জিজ্ঞেস করেন, আপনার লেখা দেখি না। আর গল্প লেখেন না? আপনাদের লেখা পড়ে-পড়ে  আমরা লিখতে শুরু করলাম...
    আমার অনূদিত ‘লাভ স্টোরি’ সম্পর্কে বললেন, ওটা পড়ার পর থেকে বেস্টসেলার লিখতে চাইছি। তবে হাতের লেখা নিয়ে সমস্যা। বানান, দাড়ি কমা ড্যাশ...! বাক্য অসমাপ্ত থাকে। আমার দরকার ভাল একজন কমপোজার (ওয়ার্ড প্রসেসর), আর ভাল একজন প্রুফ রিডার।
    পরে শুনেছি অমন দু’একজন পেয়েছেন তিনি।
    তখন ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে তাঁর ‘এই সব দিনরাত্রি’, ‘বহুব্রীহি’ ও ‘অয়োময়’ টিভি সিরিজ। ওই প্রসঙ্গে হুমায়ূন বলেন প্রযোজক নওয়াজিশ আলি খান ও মুস্তাফিজুর রহমান এবং শিল্পী-কলাকুশলীদের কৃতিত্ব ও অবদানের কথা। বলেন, ওদের ইমপ্রোভাইজেশন দারুণ। একটা সাজেশন থেকে দারুণ কিছু করে ফেলতে পারেন তাঁরা।
    তবে হুমায়ূনের ‘কোথাও কেউ নেই’ ও ‘নক্ষত্রের রাত’ সিরিয়াল দু’টি বেশি দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে আগের সিরিয়াল তিনটির চেয়ে। চলচ্চিত্রে অবশ্য অত সাফল্য আসে নি তাঁর। পরিচালক মুস্তাফিজুর রহমানের অনুরোধে, ইসকাটনের মহিলা সমিতিতে গিয়ে, তাঁর ‘শঙ্খনীল কারাগার’ ছবির ছোট্ট একটি দৃশ্যে অভিনয়ের মতো কিছু একটা করতে হয়েছিল আমার। পরে সেন্সর বোর্ডের সদস্য হিসেবে ছবিটি যখন দেখি তখন খেয়াল করি সে দৃশ্যটি নেই ছবিতে। ওই সময় হুমায়ূনের উপন্যাস অবলম্বনে সুভাষ দত্তের পরিচালনায় নির্মিত ‘আকাঙ্খা’ নিয়েও বিতর্ক হয় খুব। ‘আকাঙ্খা’ বানান ভুল, ‘আকাঙ্ক্ষা’ শুদ্ধ। এ বানান শুদ্ধ করার কথা বলি, কিন্তু নির্মাতাদের পক্ষ থেকে সুভাষ দত্ত এ জন্য অনেক খরচ হয়ে যাবে বলে ওই ভুল বানানটিই মেনে নেয়ার অনুরোধ জানান। আমি বাদে অন্য সকল সদস্য মেনে নেন ওই ভুল। তাঁদের বোঝাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর আমার আপত্তি লিপিবদ্ধ করি স্বাক্ষর দেয়ার সময়। ফ্লপ হয়েছিল ‘আকাঙ্খা’, এরপর চলচ্চিত্রকাররা কেউ হুমায়ূনের গল্প-উপন্যাস অবলম্বনে ছবি করেছেন কিনা জানি না।
    বলেছিলাম, হাঁটতে-হাঁটতে এলিফ্যান্ট রোডে আসার কথা। সেদিন হুমায়ূন আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন জিগজ্যাগ ভিডিওতে। গিয়ে বলেন, আমাকে কিছু ইংরেজি সিচুয়েশন কমেডি (সিটকম) বেছে দিন তো!
    জানালেন সারা রাত ছবি দেখেন তিনি। দেখে-দেখে আইডিয়া পান নানা রকম। হুমায়ূন সেদিন নিয়ে যান ১৮টি ক্যাসেট। দোকানের মালিক জানান, কিছু দিন পর-পর এসে তিনি ভিডিও ক্যাসেট নিয়ে যান ২০-২২টি করে।
    টিভি’র মাধ্যমে ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ার পর বইমেলায় বিপুল পাঠকপ্রিয়তা পান হুমায়ূন। এ উদাহরণ কাজে লাগাতে চেয়েছেন অনেকে।  এটা হচ্ছে অগস্ট-সেপটেম্বর থেকে টিভিতে একটা সিরিজ শুরু করে জানুয়ারি পর্যন্ত চালিয়ে গিয়ে ফেবরুয়ারির বইমেলায় ভিড় সৃষ্টি করার ফরমুলা। এ ফন্দি বা ধান্দা করে অবশ্য কিছুটা সাফল্য পেয়েছেন কেউ-কেউ। অন্যেরা পান নি সেই স্বর্গের সিঁড়ি।
হুমায়ূনের সঙ্গে আমার শেষ দেখা ইসকাটনের এক ডুপ্লেঙ কমপ্লেঙের চত্বরে, এক শুক্রবার দুপুরে। আমি গিয়েছিলাম সেখানকার বাসিন্দা জামিল আখতার বীনু আপার কাছে। হঠাৎ ঝড়ো বেগে ঝকঝকে নতুন একটি গাড়ি ঢুকে দু’জন নারীকে নামিয়ে দিয়েই আবার বেরিয়ে যায় সাঁৎ করে। ওই দু’জনকে মা ও মেয়ে মনে হয় আমার। আসা ও যাওয়ার দু’বারই আমার সঙ্গে চোখাচোখি হয় গাড়ির অপর আরোহী হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে। তিনি বোধহয় চিনতে পারেন না আমাকে, অথবা চিনলেও হয়তো বুঝে উঠতে পারেন নি - ওই সময় আমি কেন ওখানে থাকবো!
কিছু দিন পর হুমায়ূনের সঙ্গে গুলতেকিনের বিচ্ছেদ এবং শাওনকে বিয়ের খবর আসে পত্রিকায়। তখন বুঝতে পারি ওই দুই নারীর একজন ছিলেন কিশোরী শাওন।
হুমায়ূনের দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে অনেক বিতর্ক। এর আগে, টিভিতে ‘অয়োময়’ সিরিজ চলাকালে, এক বন্ধুর কিশোরী কন্যার সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে নানা কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি ছাপা হয়েছিল পত্রপত্রিকায়। এ সব ঘটনায় আমার মনে পড়েছিল বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকার চারলি চ্যাপলিন-এর কথা। ৫৪ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেছিলেন প্রখ্যাত নাট্যকার ইউজিন ও’নিল-এর অষ্টাদশী কন্যা উনা-কে। ভ্লাদিমির নবোকভ-এর ‘লোলিটা’ উপন্যাসটির কথাও মনে পড়েছে। ওই উপন্যাসের প্রৌঢ় প্রফেসর হামবার্ট হামবার্ট আকৃষ্ট হন ১২ বছরের এক বালিকার প্রতি।
হুমায়ূনের এ ব্যাপারটি নিয়ে চর্চা  শেষ হয় নি এখনও। তাঁর মৃত্যুর পরও তা প্রকাশ পেয়েছে দুঃখজনক রূপে। এ নিয়ে অন্তত একটি সাড়াজাগানো উপন্যাস লেখা হয়েছে বলে জানি। ‘তালাক’ নামের সে উপন্যাসটি লিখেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক-সাহিত্যিক মিলান ফারাবী।
প্রশ্ন জাগে, নিজের জীবনকে নিজের মতো করে কি সাজিয়ে নিতে পারে না কেউ?
অবশ্য ব্যক্তিগত-পারিবারিক জীবনের ঘটনা-রটনা হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের কাটতিতে প্রভাব ফেলে নি কোনও। যারা কট্টর সমালোচক, ঘোরতর নিন্দুক তাদেরও দেখেছি বইমেলায় দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে তাঁর বই কিনতে। এটা নিঃসন্দেহে এক জাদু-ক্ষমতা।
    নব্বই দশকের শেষ দিকে হুমায়ূনের সাহিত্যিক কৃতিত্ব সম্পর্কে আমাকে লিখতে বলা হয়েছিল পাক্ষিক শৈলী’র পক্ষ থেকে। তাঁর তিনটি বড় সাফল্য নিয়ে তখন আলোচনা করেছিলাম সে লেখায়। প্রথমত, বাংলা বেস্টসেলারে কলকাতার প্রাধান্যকে ছাড়িয়ে তিনি ঢাকার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেন প্রথম। এর আগে নজিবর রহমান সাহিত্যরত্ন থেকে আকবর হোসেন পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন কিছু উদাহরণ থাকলেও বিশেষ ক্ষেত্রে ধারাবহিকতা বজায় রেখেছেন একমাত্র কাজী আনোয়ার হোসেন। তবে হুমায়ূন অবদান রেখেছেন সামগ্রিক পরিসরে। দ্বিতীয়ত, বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমানকে স্থায়ী আসন দিয়েছেন তিনি। এর আগের ১৫০ বছরের উপন্যাস পড়ে তেমন করে বোঝা যায় না যে বাঙালিদের ৬০ ভাগ মুসলমান। তৃতীয়ত, উপন্যাসের কাটতি বাড়াতে তিনি সেঙ বা ভায়োলেন্সের আশ্রয় নেন নি কখনও।
    এর পর কেটেছে প্রায় দুই দশক। বাংলা সাহিত্যের প্রথম বেস্টসেলার লেখক বঙ্কিমচন্দ্র। তাঁকে ছাড়িয়ে যান শরৎচন্দ্র।  সেকালের জনসংখ্যা ও শিক্ষার হারের কথা মনে রেখেও বলা যায়, কাটতিতে হুমায়ূন ছাড়িয়ে গিয়েছেন তাঁকেও। হয়তো বাংলা সাহিত্যে সর্বকালের সেরা বেস্টসেলার লেখক তিনিই। অবশ্য গুণ, মান ও শৈলীর বিচার আসছে না এখানে।  সে বিচারের জন্য কিছু দিন দেরি করতে হবে আমাদের।
হুমায়ূন সাফল্য দেখিয়েছেন আরও নানা ক্ষেত্রে। পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী ‘দেশ’-এর পূজা সংখ্যায় তিনি করে নিয়েছেন স্থায়ী আসন। বাংলাদেশের কোনও লেখকের জন্য এ এক বিরল প্রতিষ্ঠা। এতে এই আশা জেগেছিল আমাদের, বাংলাদেশের মতো পশ্চিমবঙ্গের বইয়ের বাজারেও হয়তো বেস্টসেলার হবে তার বই। সে হওয়াটা অসম্ভব কিছু ছিল না, কিন্তু তার আগেই আমরা হারালাম তাকে। ফলে এই বিশাল সম্ভাবনা এখন সুদূরপরাহত হয়ে রইলো আমাদের কাছে। কারণ তার শূন্য স্থান আর পূরণ হবে না সহজে।
facebook.com/sazpa85

বৃহস্পতিবার, ১৯ জুলাই, ২০১২

হতাশা, তবে অধিক নয়

আশা আর বাসা ছোট করতে নেই - শুনেছি ছোটবেলায়। কিন্তু জীবনে ছোট হয়ে এসেছে দু’টোই। অভিযোগ-অনুযোগ করছি না এ জন্য। কারণ, ভালই হয়েছে এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র থাকা। ঠেকে-ঠেকে শিখেছি  - অধিক প্রত্যাশা না থাকাই ভাল, কারণ তা অধিক হতাশাই ডেকে আনে। ইতিহাসও এ সত্যের সাক্ষী হয়েছে বারবার। পাকিস্তান আন্দোলনের উদ্ভব, বিকাশ ও তীব্রতা এই বাংলাভাষী পূর্ববঙ্গে, অথচ এখানে এসে তখনকার অবিসংবাদিত নেতা মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ বললেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উরদু! তাঁর এ ঘোষণা যে হতাশা সৃষ্টি করে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে তার অনিবার্য পরিণতি রূপে দেখা দেয় স্বাধীন বাংলাদেশ। অন্য নেতাদের কথাও বলি। মহাত্মা গান্ধী’র মতো একজন মহান নেতার উদ্ভট যৌন পরীক্ষা সম্পর্কে জেনে যে পর্যায়ে বিস্ময়হত হয়েছি তা এক ধরনের হতাশাই বৈ কি! ভারত-বিভাগে জওয়াহরলাল নেহরু’র ভূমিকা নিশ্চয়ই ব্যথিত করেছে অনেককে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে, স্বাধীনতা অর্জনে যাঁর অবদান অবিস্মরণীয় - সেই ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে কি হতাশা আছে কোনও? আছে। বাংলাদেশকে ছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে সিমলা চুক্তি নিশ্চয়ই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে অনেককে। ’৭৫-এ তাঁর জরুরি অবস্থা ঘোষণাও ভাল লাগে নি আমার। এবার দেশের কথা বলি মন খুলে - কারও খারাপ লাগলে লাগুক। মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ শত্রুমুক্ত হয়, তারপর গ্রাম থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের ফেরত পাঠিয়ে স্বাধীন দেশের প্রশাসন তুলে দিতে হয় পরাজিত পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রশাসনের হাতে। একে এখানে, ওকে ওখানে বদলি করে অবস্থা দাঁড়ায় সেই থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়! বলতে গেলে এক অর্থে শত্রুপক্ষের হাতেই যায় বিজয়ের ফল। ক’দিন আগে যাদের দেখে গুলি করতো মুক্তিযোদ্ধারা সেই তাদের কাছেই সমর্পণ করতে হয় অস্ত্র। বিষয়টি বেশ হতাশ করে আমাকে। ভেবেছিলাম জাতীয় সরকার গঠিত হবে, দেশ হবে সর্বাধুনিক কল্যাণরাষ্ট্র, বঙ্গবন্ধু স্থান পাবেন সবার ঊর্ধ্বে - হবেন দেশ জাতি জনগণের অভিভাবক, নিজেকে জড়াবেন না ক্ষমতার রাজনীতিতে। কিন্তু হয় নি সে সব কিছু। এসেছে সর্বহারা পার্টি, গণবাহিনী, রক্ষীবাহিনী, চুয়াত্তর। বাকশাল সম্পর্কে মন্তব্য করা ঠিক হবে না, কারণ কার্যকর বা বাস্তবায়িত হয় নি তা। এটুকু বলতে পারি, বাকশাল বাস্তবায়নের দায়িত্ব যাঁদের ওপর দেয়া হয়েছিল তাঁদের সবাই যে যোগ্য ছিলেন না তা প্রমাণিত হয়েছে কিছু পরেই।
    ’৭৫-এর পরের সরকারগুলো সম্পর্কে কোনও প্রত্যাশা ছিল না, তাই তাদের নিয়ে কোনও হতাশাবোধ নেই আমার। স্বৈরতন্ত্র ও চৌর্যতন্ত্রের উল্লাস-নৃত্য আর গণতন্ত্রের ফিয়াসকো দেখে-দেখে একটু ক্লান্ত - এই যা। তবে সম্প্রতি আমাকে বিশেষভাবে হতাশ করেছেন ‘গণতন্ত্রের দেবী’ আখ্যাত নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী মিয়ানমারের ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি পার্টির নেত্রী ড অন সান সু চি। এছাড়া পেয়েছেন বাকস্বাধীনতার সাখারভ প্রাইজ, মানবাধিকারের ভাসলাভ হাভেল প্রাইজ, নেলসন মানদেলা সংগঠিত এলডারস্‌-এরও সদস্য তিনি। কিন্তু সম্প্রতি রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা সম্প্রদায় যখন হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের শিকার হয় তখন একটি কথাও বলেন নি ড সু। পৃথিবীর সবচেয়ে নিগৃহীত এ সম্প্রদায় সম্পর্কে শান্তি, স্বাধীনতা ও অধিকারের পুরস্কার-সম্মাননায় ভূষিত এই মহান নেত্রী বিস্ময়করভাবে নীরব। শুনেছি মিয়ানমারে তাঁর সমালোচকের সংখ্যাও কম নয়। তাঁরা ‘পশ্চিমাদের ট্রয়ের ঘোড়া’ মনে করেন তাঁকে। এ কারণে তাঁর ব্যাপারে আমি হতাশ হলেও তা অধিক নয়। তাহলেও “আশা হৃদয়ের চেয়ে বড়, তাই তারে / হৃদয়ের ব্যথা বলে মনে হয়।” (রবীন্দ্রনাথ)
sazzadqadir@gmail.com

বৃহস্পতিবার, ১২ জুলাই, ২০১২

‘মুই কি হনু রে...’

আমাদের এই ঢাকার কবি-সাংবাদিক হরিশচন্দ্র মিত্র (আ. ১৮৩৮-১৮৭২)-এর কয়েকটি নীতিকবিতা ছোটবেলায় পড়েছি পাঠ্যপুস্তকে, মুখস্থ করেছি, আবার ভাবসম্প্রসারণও লিখেছি পরীক্ষার খাতায়। ‘খেলায় মজিয়া শিশু কাটাও না বেলা / সময়ের প্রতি কভু করিও না হেলা...’ কবিতাটির (‘সময়’, “কবিতা কৌমুদী”, ১৮৬৩) কথা হয়তো মনে আছে অনেকের, তবে তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা সম্ভবত ‘বড় কে?’ (প্রাগুক্ত)। কারণ এখনও তা ফেরে লোকের মুখে-মুখে - “আপনারে বড় বলে, বড় সেই নয় / লোকে যারে বড় বলে, বড় সেই হয়।...” এ কবিতা আমি পড়েছি, আমার সঙ্গে পড়েছে আরও অনেকে। কিন্তু নম্র নত বিনীত হয়ে থাকার ধাত বোধহয় অনেকের থাকেই না। তাই দেখেছি সহপাঠীদের কেউ-কেউ ত্রুটি ধরতো শিক্ষকদের, গুরুজনদের। সাফল্যও যে বিগড়ে দেয় অনেককে তা-ও দেখেছি। তাদের দু’একজন ভুল খুঁজে বেড়াতো যাদবচন্দ্র চক্রবর্তী (১৮৫৫-১৯২৩)-র ‘পাটীগণিত’, কে পি বসু’র ‘জ্যামিতি’ ও ‘বীজগণিত’-এ। ফুটবলে কিছু কসরত শিখেই কেউ-কেউ প্রকাশ্যে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতো মারী গাজি ওমর শোভা নবী চৌধুরীকে। কয়েকটি নাটকে হাততালি পাওয়ার পর যারা নিজেকে উত্তম কুমারের চেয়ে বড় অভিনেতা বা বিধায়ক ভট্টাচার্যের চেয়ে বড় নাট্যকার ভেবেছিল তাদের সম্পর্কে তখনই এক মুরব্বি বলেছিলেন, ‘এ দেশের প্রতিভা গোখরো সাপের মতো আসে, আর ঢোঁড়া সাপ হয়ে মরে যায়!”
    পণ্ডিতেরা বলেন, নিজেকে অতি বড় ভাবা একটা বাতিক। অহঙ্কার, দম্ভ, আত্মম্ভরিতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ এই অতিআত্মমন্যতা। চিকিৎসাশাস্ত্রে এর নাম ‘মেগালোম্যানিয়া’, এটা এক ধরনের মানসিক ব্যাধি, মনোবৈকল্য...“a delusional mental disorder that is marked by feelings of personal omnipotence and grandeur.” সাহিত্য ও সাংবাদিকতার জগতে আছি ৫০ বছর ধরে। এ মনঃবিকলন কম দেখা হলো না এ পর্যন্ত। আর্ট বুকওয়াল্ড (১৯২৫-২০০৭)-কে শিখিয়ে পড়িয়ে দিতে পারেন এমন কলামনিস্ট আছেন এখানে। সাংবাদিক আছেন - যাঁদের কাছে কার্ল বার্নস্টাইন, বব উডওয়ার্ড, রবার্ট ফিস্ক, ওরিয়ানা ফালাচি (১৯২৯-২০০৬), ক্রিসটিয়ান আমানপুর একেবারেই নস্যি। কবিদের মধ্যে অন্তত পাঁচজনকে জানি যাঁরা নিজেদের ভাবেন রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বড় কবি। এঁদের দু’জনকে আলাদা-আলাদা ভাবে বলেছিলাম, আপনার আরবি নামটা সংস্কৃতে অনুবাদ করলে কিন্তু ‘রবীন্দ্রনাথ’ হয়। শুনে খুশি হয়েই হেসেছেন দু’জনে। এ সব অতিআত্মম্মন্যতা নিজেদের ছাড়া আর কারও ক্ষতি করে না, কিন্তু রাজনীতিক-দেশনায়করা যদি মেগালোম্যানিয়াক হয়ে পড়েন তখন কেবল নিজের নয় দেশের মানুষের জীবনেও ডেকে আনেন সর্বনাশ। ইতিহাসে তাঁদের অনেকে কুখ্যাত হয়ে আছেন নানা উদ্ভট চিন্তা ও কা-কীর্তির জন্য। মহাবীর আলেকজান্ডার (৩৫৬-৩২৩ পূর্বাব্দ) শেষ জীবনে নিজেকে ভাবতেন গ্রিক দেবতা জিউস ও মিশরীয় দেবতা আমোন-এর সন্তান। আমোন-এর মতো করে নিজের কল্পিত শিংওয়ালা মাথা তিনি খোদিত করেছিলেন মুদ্রায়। ইতালি’র একনায়ক মুসোলিনি (১৮৮৩-১৯৪৫) বলতেন রোমান সাম্রাজ্যের গৌরব প্রতিষ্ঠার কথা। তাঁর বিশাল প্রশাসনিক ভবনের উপরে তিনি স্থাপন করেছিলেন নিজের অতিকায় মুখাকৃতি। উগান্ডা’র একনায়ক ইদি আমিন দাদা (শাসনকাল ১৯৭১-১৯৭৯) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ছিলেন বৃটিশ বাহিনীর সারজেন্ট। ওই যুদ্ধে সাহসিকতার সর্বোচ্চ পদক ‘ভিকটোরিয়া ক্রস’ তিনি নিজেই দিয়েছিলেন নিজেকে। আরজেনটিনা’র জনপ্রিয় ফার্স্ট লেডি ইভা পেরন (১৯১৯-১৯৫২) ভবিষ্যতে প্রেসিডেন্ট হওয়ার আশায় ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন নির্বাচনে। শোচনীয় ভরাডুবি হয়েছিল তাঁর। ফিলিপাইনের ফার্স্ট লেডি ইমেলদা মারকোস-এর জুতা ছিল প্রায় তিন হাজার জোড়া। উৎখাত হয়ে হাওয়াইয়ে স্বামীর সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার সময় সঙ্গে নিয়েছিলেন ২৪ বার সোনা। আর লুটেপুটে নেয়া বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার তো ছিলই। উত্তর কোরিয়া’র ‘মহান নেতা’ কিম ইল-সুং (১৯১২-১৯৯৪) দাবি করতেন - বালিকে ধান-চাল বানাতে পারেন, পাতায় চড়ে নদী পার হতে পারেন এবং আরও অনেক কিছু। দেশের বিভিন্ন স্থানে নিজের ৩০ হাজার মূর্তি স্থাপন করেছিলেন তিনি। এছাড়া দেশবাসীকে তিনি বাধ্য করেছিলেন তাঁর ছবি সংবলিত ব্যাজ পরতে। মিয়ানমারের স্বৈরশাসক নে উইন (শাসনকাল ১৯৬২-১৯৮২) গোসল করতেন ডলফিনের রক্তে। তাঁর দল বেশি বামপন্থি হয়ে পড়ছে আশঙ্কা করে দেশের সকল সড়কে ডান দিকে চলার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। কুসংস্কার আরও অনেক ছিল তাঁর। তিনি ব্রিজ পার হতেন পেছন দিকে চলে। ধারণা ছিল, ৯০ বছর বাঁচবেন তাই প্রচলন করেছিলেন ১৫, ৩০, ৪৫ ও ৯০ মানের নোট। এতে সঞ্চয় খুইয়ে বসেন মিয়ানমারের মানুষ। আলবেনিয়া’য় দাড়ি রাখা, টাইপরাইটার ও রঙিন টিভি নিষিদ্ধ করেছিলেন একনায়ক এনভার হোজা (আনোয়ার হোসেন, শাসনকাল ১৯৪১-১৯৮৫)। মন্ত্রীপরিষদের সকল পদ নিজের হাতে রেখেছিলেন তিনি। এছাড়া যুগোস্লাভিয়া’র আগ্রাসনের আশঙ্কায় দেশের বিভিন্ন স্থানে সাত লাখ ৫০ হাজার বাঙ্কার তৈরি তাঁর এক বিখ্যাত কীর্তি। আরও অনেক মেগালোম্যানিয়াক কলঙ্কিত করে আছেন বিশ্বের ইতিহাস। কিছু সাফল্য আর বিপুল হাততালি তাদের মধ্যে গড়ে তোলে ‘মুই কি হনু রে’ ভাব। এর পরিণাম শুভ হয় নি কখনও, হবেও না। হরিশচন্দ্র মিত্রের কবিতার বাকি অংশে ফিরে যাই: “বড় হওয়া সংসারেতে কঠিন ব্যাপার / সংসারে সে বড় হয়, বড় গুণ যার। / গুণেতে হইলে বড়, বড় বলে সবে / বড় যদি হতে চাও, ছোট হও তবে।”


sazzadqadir@rediffmail.com

মঙ্গলবার, ৩ জুলাই, ২০১২

সত্যের তাঁবেদার থেকে তাঁবেদারের সত্য

দৈনিক আজাদ-এ সংবাদ শিরোনামে দীর্ঘ ঈ-কারের মাথাটা ভাঙা-ই থাকতো। পড়ে বুঝে নিতে হতো ‘সুখা’ না ‘সুখী’। তাই “ড. শহীদুল্লাহ মারী গিয়াছেন” শিরোনামটিকে “ড. শহীদুল্লাহ মারা গিয়াছেন” দেখাতে কোনও সমস্যায় পড়ে নি আমাদের ক্লাশ ক্যাপটেন খোকা (চিত্রনায়ক মান্না’র চাচা)। শিক্ষকরাও ওটুকু দেখেই ছুটি ঘোষণা করেন স্কুলের। মূল খবরটি পড়ার দরকার মনে করেন নি আর। এ ঘটনা ১৯৫৫ সালের, তখন পড়ি টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী স্কুলে ক্লাশ ফোর-এ।
    সংবাদপত্রের এমন বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল তখন। কথাই ছিল ‘ছাপা জিনিসে ভুল নাই’। পরে অবশ্য ছাপাখানার ভূতের কবলে পড়েছি বহুবার। ভুল পড়েছি, করেছিও। এখন তো থাকি ভূতের ছাপাখানাতেই। ভুল-নির্ভুল সবই ধোঁয়া-ধোঁয়া ছায়া-ছায়া। কোনটা কি তা কিছুই বলতে পারেন না কেউ। বোঝাও যায় না। সংবাদপত্রে পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে সংবাদ ও বিজ্ঞাপন। জায়গা নেয়ার পর জায়গা-বদল হয়েছে কিনা তা বলতে পারেন না কেউ।
    এ বছর সংবাদপত্রের কাজে ও সাংবাদিকতায় ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে আমার। সেই অভিজ্ঞতা ও অবিশ্বাসের কথা ও কাহিনী কিছু বলি এখানে।
    ছোটবেলা থেকেই অনেক কিছু আমি ভুল শিখেছি সংবাদপত্রের কারণে। বানান, অর্থ,... আরও অনেক কিছু। এ সব শুদ্ধ ও সিদ্ধ করে নিতে বহু সময় লেগেছে আমার। কিছু উদাহরণ দিতে পারি এখানে।
পঙ্‌ক্তি, আকাঙক্ষা, সমীচীন, ঊর্ধ্ব, উজ্জ্বল, কর্মজীবী, মোহ্যমান, অগস্ট, ঘুস, সর্বজনীন - এ বানানগুলোর অশুদ্ধ রূপ হরহামেশা ছাপা হয় সংবাদপত্রে। ভুল অর্থে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ক্রন্দসী, ফলশ্রুতি, আপামর ও আরও অনেক শব্দ। ‘পরে’ অর্থে ‘পরবর্তীতে’ লেখা, ‘ডিপার্টমেন্ট স্টোর’কে ‘ডিপার্টমেন্টাল স্টোর’ লেখা সংবাদপত্রেরই দান। আরও অবদান - কৃচ্ছ্রতা, প্রয়োজনীয়তা, রহস্যময়তা, জবাবদিহিতা, অনবধানতা, সিংহভাগ, পাশবিক, উল্লেখিত, অশ্রুসজল, সুস্বাগতম প্রভৃতি ভুল শব্দ; অসুস্থতাজনিত কারণে, চলাকালীন সময়ে, জোরপূর্বক ধর্ষণ, সারা দেশ জুড়ে, হাজার জনতা, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু, অন্যান্য নেতৃবৃন্দ, গুরুত্বারোপ, স্থগিতের সিদ্ধান্ত, নিষিদ্ধের দাবি প্রভৃতি ভুল শব্দবন্ধ।  কোথায় ‘ও’ আর কোথায় ‘ও-কার’ তা গুলিয়ে দিয়েছে সংবাদপত্র। আই ‘আজও’ না লিখে ‘আজো’ লিখি, কিন্তু ‘কালো’ না লিখে লিখি ‘কালও’। দপ্তর, গ্রেপ্তার, করপোরেশন, পন্থি, সরজমিন প্রভৃতি শব্দের এবং ক্রিয়াপদের বানানভেদ এখন বহুপ্রচলিত। বানানভেদের শিকার কাওরানবাজার, ফকিরাপুল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মুন্সীগঞ্জ, ঝালকাঠী, রাঙ্গামাটি, টাঙ্গাইল সহ অনেক স্থান-নাম। মিয়ানমার, ইয়াঙ্গন, প্যারিস, পেইচিং, কেরল, অসম, ওড়িশা, মুম্বই, চেন্নই, নিউ ইয়র্ক, লস অ্যানজেলেস, জোহানেসবার্গ, কুয়ালা লুমপুর প্রভৃতি বিদেশী স্থান-নাম; এসিড, একাউন্ট, এডভোকেট, এলবাম প্রভৃতি বিদেশী শব্দের বানান নিয়ে চলছে যথেচ্ছাচার।
এ তো গেল সংবাদ লেখার ভাষা আমার নিজের ভাষা মাতৃভাষার অবস্থা। বলা হবে, এ সমস্যা অজ্ঞতার। এ অজ্ঞতা থেকে ওসামাকে লেখা হয় লাদেন - যা আসলে তার পিতার নাম। এভাবে ইখতিয়ার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বখতিয়ার নামে। এ সমস্যা অজ্ঞতার নয়, এ কৌশল অজ্ঞতা সৃষ্টির। এভাবেই ভাষাদৌর্বল্যের সুবাদে গোড়াতেই তৈরি হয়ে যায় মিডিয়ার একটা দুর্বল নড়বড়ে ভিত। আর দুর্বলকে তো সহজেই গড়ে তোলা যায় প্রবলের ইচ্ছামতো, তাকে নেয়া যায় নিজের নিয়ন্ত্রণে, রাখা যায় ইচ্ছাধীন। আর সংবাদ - যুদ্ধে ও রাজনীতিতে সত্য যেখানে নিহত হয় প্রথমে সেখানে সে সত্যবাদ মেনে চলে কতখানি? আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলি।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের গর্ব ও গৌরবের অন্ত নেই, আমাদের মিডিয়াও এ আবেগে উচ্ছ্বসিত। এ হিসেবে পৃথিবীর সকল মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আমাদের কেবল সমর্থন নয়, অঙ্গীকারও আছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমরা বড্ড কুণ্ঠিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের  মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা বর্ণনা করি তাদের প্রতিপক্ষের ভাষায়। লিখি, বিচ্ছিন্নতাবাদী। সন্ত্রাসী, জঙ্গি, উগ্রপন্থি, চরমপন্থি, নাশকতাবাদী। হঠাৎ কেউ লেখেন, স্বাধীনতাকামী। এছাড়া বামপন্থি, দক্ষিণপন্থি ইত্যাদি লেবেল আঁটা তো আছেই। জানতে ইচ্ছা করে, ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে নির্ণয় করা হলো আমাদের দশ দিক? একই ভাবে ব্যাখ্যা মেলে না উদারপন্থি, মধ্যপন্থি ইত্যাদি টুপি পরানোরও। মনে আছে, বাবরি মসজিদকে অনেকে উল্লেখ করেছেন ‘বিতর্কিত কাঠামো’ হিসেবে। এটা করা হয়েছিল প্রেস ট্রাস্ট অভ ইনডিয়া (পিটিআই)-এর রিপোর্ট হুবহু অনুবাদ করার কারণে। ১৯৮২ সালের সেপটেম্বর-অকটোবরে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার আন্দোলন চলাকালে বাবরি মসজিদকে ‘ডিসপুটেড স্ট্রাকচার’ বলে উল্লেখ করতো ওই সরকারি ভারতীয় বার্তা সংস্থা। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে শরীরে বোমা বহন করে বিস্ফোরণ ঘটাতো লক্ষ্যস্থলে গিয়ে। তাদের শত্রুপক্ষের ভাষায় আমরা ওই যোদ্ধার পরিচয় লিখেছি ‘আত্মঘাতী’ বা ‘মানববোমা’। কিন্তু আত্মঘাত সমর্থন করে না ইসলাম। ওই মুক্তিযোদ্ধারাও একে আত্মঘাত বলেন না। নিজেদের পরিচয় তাঁরা দেন ‘প্রতিরোধ যোদ্ধা’ হিসেবে।  মধ্যপ্রাচ্যের মিডিয়া-ও ব্যবহার করে এ শব্দটি। কিন্তু আমরা করি না কোন অজ্ঞাত কারণে। প্রকৃত ঘটনা আড়াল করতে এমন ভাষা-চাতুর্য সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে ওই ভাষাদৌর্বল্যের কারণে।
ঘটনা আড়াল করার ঘটনাও তৈরি করা হয় অনেক। সাম্প্রতিক উদাহরণ রোহিঙ্গা পরিস্থিতি। তাদের শরণার্থী অবস্থাটাই বেশি-বেশি করে তুলে ধরেছে মিডিয়া, কিন্তু তারা যে নৃশংস নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের শিকার - সে ব্যাপারে বিস্ময়কররূপে নিশ্চুপ। আরেক জ্বলন্ত উদাহরণ, আমাদের সীমান্তে বিএসএফ-এর বর্বরতার খবর। অনেক খবরে হতাহতদের চোরাচালানি বা দুর্বৃত্ত হিসেবে তুলে ধরে সাফাই গাওয়া হয় বিশেষ উদ্দেশ্যে। এভাবে যে কাউকে হত্যা বা নির্যাতন করা যায় না - এই সত্যটিকেই অস্বীকার করা হয় এভাবে।
প্রতি দিন এ রকম নানা ভাবে ঘটনা, বিষয় ও ভাষাকে বিকৃত করে মিডিয়ায় হত্যা করা হয় সত্যকে। এ দেশে রাজনীতিকরা ইতিহাসচর্চা করেন, ইতিহাসবিদরা প্রকল্প বানিয়ে ধান্দা করেন, ধান্দাবাজরা শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির ব্যবসা করেন, আর ব্যবসায়ীরা করেন রাজনীতি - কাজেই সত্যের তাঁবেদার মিডিয়া সহজেই পরিণত হয় তাঁবেদারের সত্যে। এজন্য এ দেশে মুক্তিযুদ্ধ, মুজিব-জিয়া হত্যা থেকে জনঅভ্যুত্থান পর্যন্ত অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটলেও মিডিয়া ব্যর্থ হয়েছে অনুসন্ধানে ও বিশ্লেষণে।
sazzadqadir@gmail.com

সোমবার, ২ জুলাই, ২০১২

বর্ষার কাব্য পাঠ

বাংলার ছয় ঋতুর ছত্রিশ রূপ। সব রূপই প্রিয় আমাদের। তবু বসন্তকে বলেছি ঋতুরাজ, আর বর্ষাকে ঋতুরানী। বর্ষায় সজল সরসতায় ভূ-প্রকৃতি হয়ে ওঠে সতেজ সজীব। চারপাশে জেগে ওঠা এই প্রাণময়তা মুগ্ধ করে আমাদের, বিশেষভাবে উচ্ছ্বসিত করে কবিদের। শাস্ত্রবিদ জগদীশচন্দ্র ঘোষ লিখেছেন, “বর্ষা আমাদের হৃদয়ের, কালের ও কাব্যের সিংহাসন জুড়ে আছে।” এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের পক্ষপাতিত্ব তো প্রকাশ্যেই। অনেক কবিতা ও গান লিখেছেন তিনি বর্ষার বন্দনা করে। প্রবন্ধ-নিবন্ধও লিখেছেন অনেক। ‘আষাঢ়’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “বর্ষা ঋতুটা বিশেষভাবে কবির ঋতু।” আরও লিখেছেন, “ঋতুর মধ্যে বর্ষাই কেবল একা, একমাত্র। তাহার জুড়ি নাই।” এর কারণও ব্যাখ্যা করেছেন, “বর্ষাকে ক্ষত্রিয় বললে দোষ হয় না। তাহার নকিব আগে আগে গুরুগুরু শব্দে দামামা বাজাইতে বাজাইতে আসে, মেঘের পাগড়ি পরিয়া পশ্চাতে সে নিজে আসিয়া দেখা দেয়। অল্পে তাহার সন্তোষ নাই। দিগ্বিজয় করাই তাহার কাজ।” তবে এ কথাও স্বীকার করেছেন, “বর্ষা ঋতুটা মোটের উপরে শহুরে মনুষ্যসমাজের পক্ষে তেমন সুখকর নহে - ওটা আরণ্য প্রকৃতিরই বিশেষ উপযোগী।” বর্ষাকালীন শহরজীবন সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন একটি বাক্যে, “বর্ষা নামিয়াছে, ট্রামলাইনের মেরামতও শুরু।” শহরের এখানে-ওখানে খোঁড়াখুঁড়ি করে রাস্তা খানাখন্দে বীভৎস করে রাখার এ ঐতিহ্য এখনও অব্যাহত আছে সগৌরবে।
    বর্ষাকে অবশ্য ‘ঋতুপতি’ বলেছেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯)। এ ঋতুর বন্দনায়, রবীন্দ্রনাথের আগে, সম্ভবত তিনিই ছিলেন সব কবিকে ছাড়িয়ে। বর্ষায় প্রকৃতির রূপ এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে লিখেছেন অন্তত এক ডজন দীর্ঘ কবিতা - বর্ষার আবির্ভাব, বর্ষার অভিষেক, বর্ষার রাজ্যাভিষেক, বর্ষার ধুমধাম, বর্ষার অধিকারে গ্রীষ্মের প্রাদুর্ভাব, বর্ষা, বর্ষার বিক্রম বিস্তার, গ্রীষ্ম দমন পূর্ব্বক বর্ষার রাজ্য শাসন, বর্ষা-বর্ণন, বর্ষার ঝড়বৃষ্টি, বর্ষার অত্যাচার, সুবৃষ্টি। কবিতাগুলোর নাম উল্লেখ করলাম - যাতে বিষয়বস্তু সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পেতে পারেন পাঠক। বর্ষায় সেকালের শহরবাসীর দুর্ভোগের বিবরণ মেলে এর অনেক কবিতাতেই:
    “... ঘর দ্বার পথ ঘাট মহা সিন্ধুময়।
    নীরাকারে নীরাকার দৃশ্য সব হয় ॥
    গৃহস্থের কান্নাহাটী রান্নাঘরে এসে।
    হাসিয়া ভাতের হাঁড়ি জলে যায় ভেসে ॥
    জোড়া পায় ঘোড়া নাচে চাকা ডুবে জলে।
    কলের জাহাজ যেন গাড়ী সব চলে ॥
    বালকে পুলক পায় ভাসাইয়া ভেলা।
    কিলি কিলি মীন যত পথে করে খেলা ॥
    পথিকের দশা দেখে নেত্রে জল ঝরে।
    উঠিছে পায়ের জুতা মাথার উপরে ॥
    বিশেষতঃ রমণীর ভাব চমৎকার।
    চলিতে চরণ বাধে বস্ত্র রাখা ভার ॥...” (‘বর্ষার বিক্রম বিস্তার’)
    দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩)-এর কবিতাতেও আছে শহুরে বর্ষার ছবি - ঘরোয়া পরিবেশের, পারিবারিক জীবনের বর্ণনা, কর্মহীন সময়ের অস্বস্তি:
    “বৃষ্টি পড়িতেছে টুপ্‌ টাপ্‌;
    বাতাসে পাতা ঝরে ঝুপ্‌ ঝাপ্‌;
    প্রবল ঝড় বহে - আম্র কাঁটাল সব -
    পড়িছে চারি দিকে ধুপ্‌ ধাপ্‌।
    বজ্র কড়কড় হাঁকে;
    গিন্নী শুয়ে বৌমাকে
    ‘কাপড় তোল্‌ বড়ি তোল্‌’ ঘন হাঁকে;
    অমনি ছাদের উপর দুপ্‌ দাপ্‌।
    আকাশ ঘেরিয়াছে মেঘে,
    জোলো হাওয়া বহে বেগে,
    ছেলেরা বেরতে না পেয়ে, রেগে
    ঘরের ভিতরে করে হুপ্‌ হাপ্‌।
    ...
    বৃষ্টি নামিল তোড়ে;
    রাস্তা কর্দ্দমে পোরে;
    ছত্র মস্তকে রাস্তার মোড়ে
    পিছলে পড়ে সবে ঢুপ্‌ ঢাপ্‌।
    ভিজেছে নির্ঝুম শাখী,
    শালিক ফিঙে টিয়া পাখী,
    আমি কি করি ভেবে না পেয়ে, একাকী -
    ঘরেতে বসে আছি চুপ্‌ চাপ্‌।” - ‘বর্ষা’, “হাসির গান” (১৯০০)
    আসলে সকল ঋতুর মধ্যে বর্ষা ও বসন্তের সঙ্গে যেন বিশেষ সম্পর্ক আছে কবিদের। এ সম্পর্ক তাঁদের রচনার ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ থেকে ‘মীনগণ হীন হয়ে ছিল সরোবরে...’ পর্বের সূত্রপাতেই লক্ষ্য করা যায়। অনেক কবির বাল্যরচনায় প্রাধান্য তাই প্রকৃতি-বর্ণনার। সেখানে প্রাধান্য আবার বর্ষা অথবা বসন্তের। বালক মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩)-ও ব্যতিক্রম ছিলেন না এ ক্ষেত্রে। তাঁর বাল্যরচনা-সঙ্কলনের প্রথমেই রয়েছে ‘বর্ষাকাল’ -
    “গভীর গর্জন সদা করে জলধর,
    উথলিল নদনদী ধরণী উপর।
    রমণী রমণ লয়ে, সুখে কেলি করে,
    দানবাদি, দেব, যক্ষ সুখিত অন্তরে।
    সমীরণ ঘন ঘন ঝন ঝন রব,
    বরুণ প্রবল দেখি প্রবল প্রভাব।
    স্বাধীন হইয়া পাছে পরাধীন হয়,
    কলহ করয়ে কোন মতে শান্ত নয় ॥”
    তবে বর্ষার প্রকৃত রূপ স্যাঁতসেঁতে শহরের বাইরে বিশাল বাংলায়। সেখানে আকাশ-ঢালা উদার বর্ষণ, কল-কল ছল-ছল নদী, জল থৈ থৈ বিল-ঝিল হাওড়-বাঁওড়, প্রকৃতির শ্যামল শোভা, ফুল ফল ফসলের উচ্ছ্বাস। মধুসূদনের সার্থক উত্তরসূরি ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪) লিখেছেন:
    “বৃষ্টি এল... বহুপ্রতীক্ষিত বৃষ্টি! - পদ্মা মেঘনার
    দু’পাশে আবাদি গ্রামে, বৃষ্টি এল পুবের হাওয়ায়,
    বিদগ্ধ আকাশ, মাঠ ঢেকে গেল কাজল ছায়ায়;
    বিদ্যুৎ-রূপসী পরী মেঘে-মেঘে হয়েছে সওয়ার।
    দিকদিগন্তের পথে অপরূপ আভা দেখে তার
    বর্ষণ-মুখর দিনে অরণ্যের কেয়া শিহরায়,
    রৌদ্র-দগ্ধ ধানক্ষেত আজ তার স্পর্শ পেতে চায়,
    নদীর ফাটলে বন্যা আনে পূর্ণ প্রাণের জোয়ার।...” - ‘বৃষ্টি’, “মুহূর্তের কবিতা” (১৯৬৩)
    বর্ষা যেন বাংলার পূর্ণপ্রাণ জাগরণ, জনসত্তার বিপুল প্রকাশ - কবিতার এ মর্মবাণী এ দেশের প্রকৃতিলগ্ন মানুষের জীবনে আবহমানকাল ধরেই সত্য। হাজার বছরের মৃত্যু ধ্বংস বিপর্যয় জয় করে এ সত্য অক্ষয় অমর হয়ে আছে গ্রামবাংলার সমাজনিসর্গে। এ জীবনে বর্ষা-দিনের অন্তরঙ্গ ছবি এঁকেছেন প্রাণবাংলার কবি জসীম উদ্‌দীন (১৯০৪-১০৭৬):
    “আজিকের রোদ ঘুমায়ে পড়িয়া ঘোলাটে-মেঘের আড়ে,
    কেয়া-বন-পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জল-ধারে।
    কাহার ঝিয়ারী কদম্ব-শাখে নিঝ্‌ঝুম নিরালায়,
    ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়!
    বাদলের জলে নাহিয়া সে-মেয়ে হেসে কুটি কুটি হয়,
    সে-হাসি তাহার অধর নিঙাড়ি লুটাইছে বনময়।
    কাননের পথে লহর খেলিছে অবিরাম জল-ধারা
    তারি স্রোতে আজি শুক্‌নো পাতারা ছুটিয়াছে ঘরছাড়া।...
    গাঁয়ের চাষীরা মিলিয়াছে আসি মোড়লের দলিজায়, -
    গল্পের গানে কি জাগাইতে চাহে আজিকার দিনটায়!
    কেউ বসে বসে বাখারী চাঁচিছে, কেউ পাকাইছে রসি,
    কেউবা নতুন দোয়াড়ীর গায়ে চাকা বাঁধে কসি কসি।
    কেউ তুলিতেছে বাঁশের লাঠিতে সুন্দর করে ফুল
    কেউবা গড়িছে সারিন্দা এক কাঠ কেটে নির্ভুল।
    মাঝখানে বসে গাঁয়ের বৃদ্ধ, করুণ ভাটীর সুরে,
    আমীর সাধুর কাহিনী কহিছে সারাটি দলিজা জুড়ে।...
    বউদের আজ কোনও কাজ নাই, বেড়ায় বাঁধিয়া রসি,
    সমুদ্রকলি শিকা বুনাইয়া নীরবে দেখিছে বসি।
    কেউবা রঙিন কাঁথায় মেলিয়া বুকের স্বপনখানি,
    তারে ভাষা দেয় দীঘল সূতার মায়াবী নক্‌সা টানি।
    বৈদেশী কোন বন্ধুর লাগি মন তার কেঁদে ফেরে,
    মিঠে-সুরি-গান কাঁপিয়ে রঙিন ঠোঁটের বাঁধন ছেঁড়ে।
    আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছল ছল জলধারে,
    বেণু-বনে বায়ু নাড়ে  এলোকেশ, মন যেন চায় কারে।”- ‘পল্লী-বর্ষা’, “ধানখেত” (১৯৩৩)
    বর্ষা শুধু প্রকৃতিরই এক রূপবৈচিত্র্য নয়, এর সঙ্গে গভীর সংযোগ রয়েছে জনজীবনের, মানুষের একান্ত আবেগ-অনুভূতিরও। এ জন্য কবির বর্ণনা কেবল বর্ষণমুখর দিন-রাতের দৃশ্যরচনায় সীমিত থাকে না, নর-নারীর অন্তরলোকের নিভৃত অভিব্যক্তিতেও সুন্দর-বিধুর হয়ে ওঠে। প্রাচীন কাব্যের বর্ষাকে আমরা দেখি বিরহী হৃদয়ের বিষাদে আচ্ছন্ন, কিন্তু মধ্যযুগের বৈষ্ণব কবিতায় বর্ষা প্রিয়-সান্নিধ্যে আকুল অভিসারে চকিত চমকে বিহ্বল, আবার বিরহ-জর্জর বেদনায় মধুর। যুগান্তরে রূপান্তরে পরিবেশ পরিস্থিতি ভিন্ন স্বতন্ত্র, তবুও একালের কবিতায়ও বর্ষা ঐতিহ্যচ্যুত হয় নি, - নাগরিক দুর্ভোগ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করে চিরদিনের মিলনপিয়াসী বিরহী, অধীর ব্যাকুল অভিসারিকা রূপেই তাকে দেখি। তবে কৌতুক-রহস্যপ্রিয় বাঙালি এ ঋতুতে কেবল বর্ষণে নয়, সিক্ত থাকে রসেও। তাই নিজের বর্ষা বিষয়ক কবিতাকে প্যারোডি করে রসমধুর চা-বন্দনাগীতি লিখতে পারেন রবীন্দ্রনাথ:
    “হায় হায় হায় দিন চলি যায়।
    চা-স্পৃহ চঞ্চল চাতকদল চল চল চল হে ॥
    টগবগ-উচ্ছল কাথলিতল-জল কলকল হে ॥
    এল চীনগগন হতে পূর্বপবনস্রোতে শ্যামলরসধরপুঞ্জ ॥
    শ্রাবণবাসরে রস ঝরঝর ঝরে, ভুঞ্জ হে ভুঞ্জ দলবল হে ॥...” (‘বিচিত্র’)

sazzadqadir@rediffmail.com