বৃহস্পতিবার, ২৩ মে, ২০১৩

এক স্বৈরাচারের বিদায়

এই সেদিন, ১৭ই মে, মারা গেলেন হরহে রাফায়েল বিদেলা। ১৯৭৬-৮১ সালে ছিলেন আরহেনতিনা (আর্জেন্টিনা)-র সশস্ত্র বাহিনীর সিনিয়র কমান্ডার আর বিধিগত ভাবে না হলেও কার্যত দোর্দ- প্রতাপশালী প্রেসিডেন্ট। ক্ষমতায় এসেছিলেন কু দেতা’র মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ইসাবেল মারতিনেজ দে পেরন-কে উৎখাত করে। ১৯৮৩ সালে প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে ব্যাপক মনবাধিকার লঙ্ঘন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিচার শুরু হয় বিদেলা’র। তার পাঁচ বছরের শাসনকালে আরহেনতিনা পরিণত হয়েছিল এক দুঃস্বপ্নের দেশে। বিরোধী রাজনীতিক, আন্দোলন-কর্মীদের অপহরণ, জোর করে গুম, যথেচ্ছ নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যা তখন ছিল নিত্যঘটনা। বিদেলা’র রোষের শিকারদের অনেকে ছিলেন বিরোধী দলীয় রাজনীতিক ও প্রতিবাদী নর-নারী, তবে বেশির ভাগই ছিলেন সন্দেহভাজন ও অভিযুক্ত। কেবল ব্যক্তিরা নন তাদের গোটা পরিবারও হয়েছে একই রকম খুন ও নিপীড়নের লক্ষ্য। গোপন সব নির্যাতন শিবিরে প্রাণ গেছে বহু নর-নারীর। অবৈধ বন্দিশিবিরে আটক মায়েদের কাছ থেকে অসংখ্য শিশুকেও চুরি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তখন।
১৯৮৩ সাল থেকে ২০০৮ সালের ১০ই অকটোবর পর্যন্ত গৃহবন্দি ছিলেন বিদেলা, পরে তাকে পাঠানো হয় সামরিক কারাগারে। কু দেতা’র পর ৩১ জন বন্দিকে হত্যার দায়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয় ২০১০ সালের ২২শে ডিসেম্বর। এ দ- অবশ্য ভোগ করতে হয় বেসামরিক কারাগারে। এরপর ২০১২ সালের ৫ই জুলাই তাকে ৫০ বছরের কারাদ- দেয়া হয় নিয়মমাফিক শ’-শ’ শিশু অপহরণের দায়ে। রাজধানী বুয়েনস এয়ারেস থেকে ৪৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মারকোস পাজ বেসামরিক কারাগারে বিদেলা মারা গেলেন দু’ বছর দ- ভোগ করে। তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। মারকোস পাজ-এর খ্যাতিমান বাসিন্দাদের মধ্যে রয়েছেন ১৯৬৬-৭০ সালে ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট হুয়ান কারলোস ওঙ্গানিয়া কারবালো (১৯১৪-৯৫)।
প্রথমে জানা গিয়েছিল ঘুমের মধ্যে স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করেছেন বিদেলা। পরে জানা গেল দিন পাঁচেক আগে কারাগারে শাওয়ারে পিছলে পড়ে মারাত্মক আহত হয়েছিলেন তিনি। তখন হাড়গোড় ভেঙেছিল কয়েকটি, রক্তক্ষরণও হয়েছিল ভেতরে।
ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সম্পূর্ণ অনুতাপহীন ছিলেন বিদেলা। বিরোধী রাজনীতিক ও আন্দোলন-কর্মীদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘ওরা সন্ত্রাসী... নাশকতাবাদী।’ বিরোধীদের গুম ও শিশু অপহরণের কোনও দায়ও স্বীকার করেন নি তিনি। তার সঙ্গে অভিযুক্ত সেনা-কর্মকর্তারাও নিখোঁজদের ব্যাপারে মুখ খোলে নি আদালতে।
আরহেনতিনা’র রাজনৈতিক অঙ্গনের অনেকেই মত-মন্তব্য প্রকাশ করেছেন বিদেলা’র মৃত্যুতে। র‌্যাডিক্যাল সিভিক ইউনিয়নের ডেপুটি রিকারদো গিল লাভেদরা বলেছেন, মানুষ তাকে স্বৈরশাসক হিসেবেই মনে রাখবে। সানতা ফে প্রদেশের সাবেক গভর্নর হারমিস বিনার শোক প্রকাশ করেছেন বিদেলা’র শাসনকালে নিহত সকলের উদ্দেশ্যে। বুয়েনস এয়ারেস সিটি’র সংস্কৃতি মন্ত্রী হারনান লোমবারদি এক বিবৃতিতে বিদেলা’র বিচার ও তাকে দ- দেয়ার জন্য প্রশংসা করেছেন আরহেনতিনা’র গণতন্ত্রকে। সাবেক প্রেসিডেন্ট রাউল আলফনসিন-এর পুত্র, র‌্যাডিক্যাল সিভিক ইউনিয়নের নেতা রিকারদো আলফনসিন বলেছেন, কারাগারে মৃত্যু - এটাই ঠিক হয়েছে বিদেলা’র জন্য। মন্ত্রীপরিষদের প্রধান হুয়ান মানুয়েল আবাল মেদিনা সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, আরহেনতিনা’র জনগণ কর্তৃক ধিকৃত বিদেলা’র মৃত্যু হয়েছে ন্যায়বিচারে সাজা পেয়ে একটি সাধারণ কারাকক্ষে। এটাই হয়েছে উচিত কাজ। ১৯৮০ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী  আদলফো পেরেজ এসকুইভেল বলেছেন, বিদেলা’র মৃত্যুতে হাসি-আনন্দ করা উচিত নয় কারও। আরও ন্যায়পরায়ণ, আরও মানবিকতাপূর্ণ এক উন্নততর সমাজ গড়ে তোলার কাজ করে যেতে হবে আমাদের - যাতে ক্ষমতাসীন হয়ে অমন বিভীষিকা সৃষ্টি করতে না পারে আর কোনও স্বৈরাচার।
এসকুইভেল ঠিকই বলেছেন। আমাদের অভিজ্ঞতাও তা-ই বলে। স্বৈরাচারী গোখরো ফোঁস-ফোঁস করে ছোবল দেয় - দংশে অনেক, তারপর একদিন জনগণ যখন সাপুড়ে হয়ে বাজিয়ে দেয় বাঁশি, তখন ঢোঁড়া হয়েই মরতে হয় তাকে। নির্জন কারাপ্রকোষ্ঠে একজন সাধারণ কয়েদির মতো মরে গিয়ে এ সত্যটাই আরও অনেক স্বৈরাচারের মতো প্রমাণ করে গেলেন এককালের প্রবল পরাক্রান্ত একনায়ক বিদেলা।

বৃহস্পতিবার, ১৬ মে, ২০১৩

হরতালের মান গেল!




আজ কোনও মত-মন্তব্য নয়, একটি খবর পরিবেশন করছি এ কলামে। খবরটি আমাদের দেশের নয়, পূর্ব আফ্রিকার দেশ কেনিয়া’র। বৃটেনের কাছ থেকে ১৯৬৩ সালে স্বাধীনতা পাওয়া এ দেশটির আয়তন পাঁচ লাখ ৮১ হাজার ৩০৯ কিলোমিটার, লোকসংখ্যা চার কোটি ৩৫ লাখ, মাথাপিছু গড় বার্ষিক আয় ১৮০২ ডলার (বিবিসি’র হিসাবে ১৭০০ ডলার)। এ আয় আমাদের  মাথাপিছু গড় বার্ষিক আয়ের প্রায় তিন গুণ। আমাদের আয় মাত্র ৬৪০ ডলার।
আমাদের সংসদ সদস্যরা কত বেতন-ভাতা পান জানি না, তবে কেনিয়া’র সংসদ সদস্যরা স্থান পেয়েছেন বিশ্বের সর্বাধিক বেতন-ভাতাপ্রাপ্ত সংসদ সদস্যদের তালিকায়। এ নিয়ে ওই দেশের লোকজন সমালোচনায় মুখর হয় প্রায়ই। সেখানকার বেতন ও সম্মানী কমিশন তাদের বেতন-ভাতা নির্ধারণ করে দিয়েছে মাসিক প্রায় ৬৩০০ ডলার। কিন্তু রাজি নন তারা। সব সংসদ সদস্য মিলে দাবি করেছেন তাদের মাসিক বেতন-ভাতা দিতে হবে প্রায় ১০ হাজার ডলার।
কেনিয়ায় প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচন হয়েছে মাস দুই আগে গত মার্চে। নতুন প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াততা জানিয়ে দিয়েছেন, সংসদ সদস্যদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবির সঙ্গে একমত নন তিনি।
কেনিয়া’র সংসদ সদস্য সংখ্যা ৪১৬। এদের ৩৪৯ জন জাতীয় সংসদের এবং ৬৭ জন সিনেটের সদস্য। তারা বলেছেন, দাবি না মানলে বেতন ও সম্মানী কমিশন ভেঙে দেয়ার উদ্যোগ নিতে দ্বিধা করবেন না একটুও। ১০ হাজার ডলার বেতন তাদের প্রাপ্য, কারণ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কঠোর পরিশ্রম করতে হয় তাদের। নির্বাচনী এলাকায় খরচপাতি করতে হয় অনেক, কখনও-কখনও স্কুলের ফি পর্যন্ত দিতে হয় নিজেদের পকেট থেকে।
এই নির্বাচনের আগে, পূর্ববর্তী সংসদে নিজেদের অবসরকালীন বোনাস হিসেবে এক লাখ সাত হাজার ডলার বরাদ্দ পাশ করিয়ে নিয়েছেন তারা। ওই বরাদ্দের মধ্যে আরও আছে সশস্ত্র রক্ষী, কূটনৈতিক পাসপোর্ট ও বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের সুবিধা।
গত মঙ্গলবার প্রেসিডেন্টের আপত্তির খবর প্রচারিত হওয়ার পর-পর ‘সংসদ অবরোধ’ নামের এক সংগঠনের লোকজন রাজধানী নাইরোবি’র রাজপথে মিছিল করে সমবেত হয় সংসদ ভবনের সামনে। সংসদ সদস্যদের ভবনে ঢুকতে বাধা দেয় তারা। বলে, ১০ হাজার ডলার বেতন-ভাতা প্রত্যাখ্যান করে একটি ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করলেই শুধু ভেতরে যেতে দেয়া হবে তাদের। বিবিসি সংবাদদাতা অ্যান মাওয়াথে একজন সংসদ সদস্যকে স্বাক্ষর করতে দেখেছেন, তবে তিনি কিছু বুঝেশুনে স্বাক্ষর করেছেন বলে মনে হয় নি তার।
প্রতিবাদকারীরা একটি ট্রাকে করে ১৩-১৪টি ছানা সহ একটি ধাড়ী মাদী শূকরী নিয়ে আসে সেখানে। ওদের গায়ে স্লোগান লেখা ‘লোভী সংসদ সদস্য, আমাদের রক্ত খা’। সত্যি-সত্যি একজন প্রতিবাদকারী ব্যাগে করে আনা রক্ত ছড়িয়ে দেয় সেখানে। ‘সংসদ অবরোধ’ মিছিলের সংগঠক বনিফেস মোয়ঙ্গি উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, আমরা শূকরের রক্ত ছড়িয়ে দিয়ে এটাই বোঝাতে চেয়েছি যে আমাদের সংসদ সদস্যরা শূকরদের মতো পেটুক ও লোভী।
প্রতিবাদকারীরা এসেছিলেন নাইরোবি’র ফ্রিডম করনার খেকে মিছিল করে। দাঙ্গা পুলিশ বেশিক্ষণ কর্মসূচি চালাতে দেয় নি তাদের। লাঠিচার্জ করে ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে সমবেত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয় তারা। বনিফেস মোয়াঙ্গি ও অন্যান্য সংগঠককে গ্রেফতার করে একই সঙ্গে।
সংবাদদাতা জানিয়েছেন, কাঁদানে গ্যাস নিরস্ত করতে পারে নি শূকরগুলোকে। ওরা রক্ত চেটেই যাচ্ছিল আপন মনে।
এ খবর প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য না করার কথা বলেছি আগেই, তবে এর পরিবেশনের উদ্দেশ্যটা বলি। সেটা হচ্ছে প্রতিবাদ জানানোর বিভিন্ন পদ্ধতির প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। আমরা যে হরতাল, ঘেরাও, মানব বন্ধন, মিছিল ইত্যাদি হাতে গোনা ক’টি কর্মসূচি প্রয়োগ করতে দেখি এগুলোর ধার কমে গেছে বহু আগেই, এখন কোন কার্যকরিতা নেই বললেও চলে। ১৪ দলীয় জোটের বিরুদ্ধে এ সব পদ্ধতি পুনঃ-পুনঃ প্রয়োগ করেও কোন ফল পায় না তাই। এছাড়া এ সব কর্মসূচি করে-করে ওরা এমন অভ্যস্ত যে এগুলো আর গায়ে-পায়ে লাগে না তাদের। আর হরতালের ধার? মান-সম্মানই তো যেতে বসেছে এখন। দেশের কোথায় কি ঘটছে - প্রাকৃতিক দুর্যোগে না মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয়ে মানুষ বিপন্ন হয়ে পড়ছে - তা দেশ-বিদেশের মানুষ জেনে ফেললেও, যাদের বেশি করে জানার কথা তারা একটুও না জেনে ডেকে বসছেন হরতাল। আবার ঢোঁক গিলতে-গিলতে তা প্রত্যাহারও করছেন বাধ্য হয়ে। তবে যারা আবার বেশি জানেন তারাও যা বলছেন! সাভার ট্র্যাজেডি’র পর মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে আসার জন্য কিছু লোকের রানা প্লাজা’য় যাওয়া থেকে ‘ঝাঁকিকম্প’ পর্যন্ত উদাহরণ মিলবে অনেক। সে সব টানতে চাই না এখানে। শুধু বলছি, মিডিয়া ও সরকারের প্রতি আস্থার অভাব কত প্রকট হয়ে উঠেছে এখন যে রেশমা উদ্ধারের ঘটনা নিয়ে প্রতিদিনই ছড়িয়ে পড়ছে নানা প্রশ্ন।


মঙ্গলবার, ১৪ মে, ২০১৩

স্বাধীনতা: হিসাবের পাওনা

দেশ স্বাধীন হয়েছে বিয়াল্লিশ বছর, দেশবাসী স্বাধীন হয়েছে কতখানি? বিশ্বজনীন অধিকারগুলো কতখানি কি পেয়েছি আমরা?
অল্প কথায় এ দু’টি প্রশ্নের উত্তর দেয়া সহজ নয়। কারণ আমাদের এখানে সবকিছুতে অনেক বিভাজন। প্রধান ভাগ দু’টি- ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীন। যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন তাঁরাই সর্বেসর্বা। স্বাধীনতার সর সহ পুরো দুধ খাবেন তাঁরা, অন্যদের জন্য থাকবে চাঁচা হাঁড়ি আর ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা। এ অবস্থার কোনও পরিবর্তন নেই, পরিবর্তনের লক্ষণও নেই।
সরকার আসে, যায়। নতুন সরকার গালমন্দ করে অতীত সরকারকে। আগামী সরকারও গালমন্দ করবে এ সরকারকে। তাঁরা সরকারি কাজ বলে যে সব দরকারি কাজ করেন তাতে হেরফের হয় না তেমন কিছু। রঙ বদলায়, চেহারা বদলায়, আওয়াজ বদলায়- এই যা। সেই ষাটের দশক থেকে দেখে আসছি, দেখছি এখনও। নিশ্চিত জানি, আমাদের পরের প্রজন্মগুলোও দেখে যাবে এ সবই।
সরকারি দলের প্রথম কাজ দলীয়করণ। দলের লোক ছাড়া তাঁদের আদর্শ উদ্দেশ্য লক্ষ্য কর্মসূচি অঙ্গীকার বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলেই এটা খুব জরুরি। তবে বিরোধী দলে থাকাকালে প্রশাসন, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা, আইন-শৃঙ্খলা, বিচার, শিক্ষা, সংস্কৃতি প্রভৃতি বিভাগে নিরপেক্ষতা এবং বেতার-টিভি, একাডেমি, ইনস্টিটিউট প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে স্বায়ত্তশাসন দাবি করলেও সরকার গঠনের পর ওগুলোতেই শুরু হয় সবচেয়ে বেশি হস্তক্ষেপ। দেয়া হয় দলীয় ও অন্যবিধ বিবেচনায় নিয়োগ। যাচাই হয় না প্রকৃত দক্ষতা ও যোগ্যতা। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রয়োজন সুপরিচিত ও মেধাবী ব্যক্তি। সেখানে প্রধান বিবেচ্য হয়ে ওঠে আনুগত্য, তদবির, কানেকশন ও অন্যান্য লেনদেন। এ সব কারণে সরকারি বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানের কাজকর্ম কিভাবে কি চলছে তা জানেন সবাই। ‘সরকারি মাল দরিয়া মে ডাল’ কথাটা তো সেই আদিকাল থেকেই চালু। এমন বেপরোয়া দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থার কারণে প্রতিদিনই বেড়ে চলে সরকারের বিপুল সুখ্যাতি। বেতার-টিভি ও অন্যান্য প্রচার-প্রকাশ প্রতিষ্ঠানে দলের লোকজন দু’ হাত খুলে লেখে, গলা ফাটিয়ে চেঁচায়, দিন-রাত বক-বক করে- কেউ শোনে না, দেখে না, পড়ে না ও সব, বিশ্বাসও করে না। বরং ভাবে, সরকারের কি লাভ এ সব করে?
বলা হয়, বিচারক শিক্ষক শিল্পী সাহিত্যিক সাংবাদিক পুলিশ প্রশাসন দলীয় হয়ে গেলে দেশের মানুষের দাঁড়াবার জায়গা থাকে না আর। সব দলই বলে এ কথা। সরকারে যাওয়ার পরেও বলে। কিন্তু করে কি কাজটা?
দুর্মুখেরা বলে, সরকারি দল যত ভাল কথা বলে তত খারাপ কাজ করে। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিকতা নিয়ে চাপাবাজি করে শত মুখে, কিন্তু তাদের দলেই নেই গণতন্ত্র। ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে বসে থাকে, কিন্তু ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না কোথাও। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির কথায় মুখে ফেনা উঠে যায় নেতাদের, কিন্তু সরকারের প্রেসনোট, বিবরণী, বিবৃতি, বিজ্ঞপ্তি, ভাষ্য ইত্যাদিতে বিশ্বাস করার মতো থাকে না কিছু। মিথ্যাচার, ধামাচাপা, আড়াল করা, এড়িয়ে যাওয়া- এসব কিছুতেই বরং সেগুলোর জুড়ি মেলা ভার। চাঁদাবাজি, লুটপাট, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, খুনোখুনি ইত্যাদিতে দলের লোক জড়িত থাকলে সরকার মুখ দিয়ে কি সব কথা বেড়ায় তা সবারই প্রায় মুখস্থ। টেলিভিশনে সে সব গৎবাঁধা কথার সঙ্গে মিলিয়ে কথা বলতে পারেন দর্শকেরা। অনেক দর্শক পারেন আগে-আগে বলতে। প্রথমত বলা হবে, ‘এখনও জানি না, জেনে বলবো।’ এরপর বলা হবে, ‘রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে, রিপোর্ট আসে নি এখনও।’ পরে বলা হবে, তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এখন কিছু বলা যাবে না, এতে তদন্ত প্রভাবিত হতে পারে। তাই বলে বলা-কওয়া থামবে না একটুও। পুলিশ বলবে, দুষ্কর্মের জন্য কারা দায়ী জানা যায় নি তা। প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশেরা বলবে, চিনতে পারি নি দুর্বৃত্তদের। মামলা হবে আসামিদের অজ্ঞাত উল্লেখ করে। ফরেনসিক ডাক্তার বলবেন, হত্যা নয় আত্মহত্যা বা অন্য কিছু। মন্ত্রী বলবেন, আমাদের দলের কেউ নয় ওরা। অনুপ্রবেশকারী। নাশকতাবাদী। ওদিকে মিডিয়ায় জানাজানি হয়ে গেছে সব। ভিডিও ফুটেজে, ছবিতে শনাক্ত হয়েছে অপরাধীদের নাম ধাম পরিচয়। কিন্তু সরকারের কাছে তারা অনুপ্রবেশকারী এজেন্ট। কিন্তু কোন দলে ‘কনভার্ট’ নেই? ‘স্টলওয়ার্ট’দেরই বরং খোঁজ মেলে না বড়-বড় দলে। প্রায়ই তো অমুক দলের অত জনের অমুক দলে যোগদানের সচিত্র খবর পড়ি পত্রিকায়। সেখানে একটি বিচিত্র ব্যাপার দেখতে পাই প্রায়ই। যোগদানকারীদের যেখানে ফুল দিয়ে বরণ করে নেয়ার কথা, সেখানে তারাই ফুলের বিশাল তোড়া-গুচ্ছ নিয়ে এসে তুলে দেন নেতা-নেত্রীদের হাতে।
সরকারের চিরশত্রু মিডিয়া। আর বিরোধীরা তো আছেই। তাদের বিরোধিতা সরকারের কাছে সরকার-বিরোধিতা, দেশ জাতি সমাজের বিরোধিতা। এমনকি দেশদ্রোহ, রাষ্ট্রদ্রোহ পর্যায়েও পড়ে! তবে অনুগত বিরোধীও আছে। প্রয়োজনে তাদের মাঠে নামায় সরকার। নানা কর্মসূচি পালন করায় নানা উদ্দেশ্য হাসিলের মতলবে। তাদের সহযোগিতা সহায়তা পৃষ্ঠপোষকতা করে সর্বতোভাবে। নিজেদের কোলে ঝোল টানার জন্য এ রকম আরও অনেক কাজ সরকারি দলগুলো করে আসছে জেনেশুনেই। কিন্তু পাবলিক সবজান্তা হলেও যে প্রশ্নের উত্তর জানে না তা হলো, ‘এ সব হাবিজাবি করে লাভ কি সরকারের?’
বিভাজনের কথা বলছিলাম। সে বিভাজন এখন যেমন তীক্ষ্ণ তেমন তীব্র। সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে দু’টি পক্ষে। আমার পক্ষে থাকলে ভাল, বিপক্ষে থাকলে মরতে হবে ধনে-প্রাণে। এখন কেউ যেন মানুষ নয়, পক্ষবিশেষ মাত্র। এবং বধযোগ্য।
পৃথিবীর বহু দেশে যুদ্ধ ও সহিংসতায় নিত্য ঘটছে মানুষকে এমন বধযোগ্য ভাবার নানা মর্মান্তিক ঘটনা। আমাদের দেশে, এ অঞ্চলেও দেখা দিচ্ছে তেমন অনেক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি। গত বছর প্রতিবেশী মিয়ানমারে রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গারা শিকার হয় জাতিগত নিপীড়নের। ওই দেশের গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত থাকায় বাইরের জগতে সামান্যই এসেছে সেখানকার হত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের খবর। তারপর যেটুকু তথ্য ও দৃশ্য দেশী-বিদেশী মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে তা রীতিমতো গা শিউরানো ভয়াবহতায় বীভৎস। ওই সময় শ’-শ’ রোহিঙ্গা নরনারীশিশু প্রাণভয়ে পালিয়েছে ভিটামাটি ছেড়ে। ট্রলারে, নৌকায় চেপে ভেসে পড়েছে অজানার উদ্দেশ্যে। তাদের অনেকেরই সলিল সমাধি ঘটেছে সাগরের বুকে, অনেকে আশ্রয় নিতে ছুটে গেছে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভারতে। অনেকে এসেছে আমাদের দেশে। কিন্তু আগে থেকেই রোহিঙ্গা শরণার্থীতে প্রপীড়িত আমরা, তাই নতুন করে শরণার্থী গ্রহণে অনিচ্ছা দেখিয়েছে সরকার। এ অবস্থায় এক ভয়াবহ মানবিক ট্র্যাজেডি আমরা দেখতে পাই দেশের উপকূল অঞ্চলে। অসহায় আশ্রয় প্রার্থীদের তাড়িয়ে দেয়ার সে দৃশ্য নাড়া দেয় বিশ্ববিবেককে। তাই জাতিসংঘ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা অনুরোধ জানিয়েছে বিতাড়ন বন্ধ করে মানবিক সাহায্য দেয়ার। কিন্তু সরকার অনড়। আরও অনড় সরকার-সমর্থকরা। তাদের অনেকে ওই সময় শুরু করে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা-অভিযান। বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গারা কত বিপজ্জনক, কত সমস্যার কারণ তা শতমুখে প্রচার করতে থাকে তারা। তাদের কথা, রোহিঙ্গারা একটি অপরাধী সম্প্রদায়। তারা অস্ত্র, মাদক, নারী ব্যবসা সহ যাবতীয় দুষ্কর্মে জড়িত। দেশের সব কিছু ধ্বংস করছে তারা। বাংলাদেশী সেজে বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করছে। সেখানে তারা সব ধরনের জঘন্য কুকর্মে লিপ্ত। এছাড়া রোহিঙ্গাদের জামায়াত-শিবির সমর্থক হিসেবেও প্রচার চালানো হয়। ফলে যারা বলতে গিয়েছেন- ওরাও মানুষ, ওদেরও বাঁচার অধিকার আছে, তাদের গালমন্দ করা হয়েছে জঘন্য কটু ভাষায়। ‘রাজাকার’ হিসেবে পর্যন্ত চিহ্নিত করা হয়েছে। তখন নজরুলের মতো “অসহায় জাতি মারছে ডুবিয়া সন্তান মোর মা’র” বলার মতো দৃপ্ত মানুষ দেখেছি খুবই কম। এরপর একই রকম ভয়াবহ মানবিক ট্র্যাজেডি ঘটে আসামের কোকড়াঝাড়-এ। সেখানকার বোড়োদের হামলার শিকার হয় বাংলাভাষী মুসলমানেরা। তাদের বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী অভিহিত করে চলে নিধনযজ্ঞ। সেই সঙ্গে লুট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ। এ সময় প্রায় সবাই ছিলেন নীরব। গণমাধ্যমে সে রক্তপাতময় দাঙ্গা ও প্রাণহানির খবর ছিল না তেমন। ভারতের ‘আউটলুক’ পত্রিকা গুরুত্ব দিয়ে কিছু সচিত্র প্রতিবেদন ছেপেছিল। এছাড়া আর কোনও পত্রিকায় সেভাবে স্থান পায় নি ওই মানবিক বিপর্যয়ের খবর। তখনও দেখা গেছে মহল বিশেষকে কোকড়াঝাড়ের খবর চেপে রাখার জন্য বিশেষভাবে তৎপর। কিছুদিন আগে আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধ সমপ্রদায়ের মঠ-ঘরবাড়ি, সমপ্রতি হিন্দু সমপ্রদায়ের মন্দির-ঘরবাড়ি শিকার হয়েছে হামলার, আবারও রোহিঙ্গা নিধন শুরু হয়েছে মিয়ানমারে। অগ্নিসংযোগ করে ধ্বংস করা হচ্ছে বহু নিরীহ নিরপরাধ পরিবারের আশ্রয়স্থল। এখনও দেখছি কিছু মানুষ ভাল চোখে দেখছে না এসব ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ। তাদের ভেতরে-ভেতরে যেন চাপা উল্লাস। ‘উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল’ কাকে না বিচলিত করে? কিন্তু দেখছি, সবাইকে করে না। রোহিঙ্গা, বাংলাভাষী অসমিয়া, বাঙালি বৌদ্ধ-হিন্দু তবে কি কারও-কারও চোখে আক্রমণযোগ্য? বধযোগ্য? সামপ্রতিক সরকারবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিবর্ষণে হতাহত হয়েছে বহু মানুষ। এভাবে হত্যা কি সমর্থনযোগ্য? কিন্তু এর প্রতিবাদ করা অনেকের কাছে অপরাধতুল্য। নাস্তিক মুরতাদ বা ইসলামিরা এখন বধযোগ্য হয়ে উঠছে কোনও-কোনও পক্ষের কাছে। এ অবস্থায় মনে পড়ে, হিটলারও ইহুদিদের মানুষ মনে করতেন না। ভাবতেন, তাদের হত্যা করলে কিছু আসে যায় না। আমরা কি সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিশাপে আক্রান্ত হয়েছি? কিন্তু এসব প্রশ্ন তোলা-ও তো বিপজ্জনক। বললেই শুনতে হবে  সেই অমোঘ গালি- হয় নাস্তিক নয় রাজাকার!
স্বাধীনতার বিয়াল্লিশ বছর পর বিভাজন গ্রাস করেছে সব সত্যকে, সবচেয়ে বেশি গ্রাস করেছে সত্যের চক্ষু পরিচয়ের দাবিদার আমাদের মিডিয়াকে। পক্ষপাতিত্বের ক্ষেত্রে তার ক্ষমতা তাই অপরিসীম। ‘তিনি চেনালে লেখক। তিনি চাইলে প্রচার। তিনি দিলেই প্রাইজ।’ অর্থাৎ আপনার কাজকর্মের স্বীকৃতি, প্রসার, সম্মাননা- সব নির্ভর করে তার ওপর। তিনি ইচ্ছা করলে আপনি উঠবেন উপরে, নিত্য ঝলমল করবেন খবরে, ঘটনায়, যাবতীয় অনুষ্ঠানে আয়োজনে, পাবেন পদ পদক পুরস্কার পারিতোষিক- দেশ-বিদেশে পাবেন সম্মান সংবর্ধনা। না হলে থাকতে হবে যে আঁধারে সে আঁধারেই। আপনি যত জ্ঞানী গুণী বিজ্ঞ বিশারদ যা-ই হোন কেন, তিনি না চাইলে আপনার সমাদর হবে না, মূল্যায়ন প্রতিষ্ঠা কিছুই হবে না।
আশা করি বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে পাঠকদের কাছে। আর খোলাসা করে কিছু বলতে হবে না আপনাদের। এই গোষ্ঠীপ্রীতি, দলবাজি, গ্রুপিং নতুন কিছু নয় এ দেশে। আগে সরকারি মিডিয়াতেই ছিল এ ব্যাপারগুলো। সেখানে থাকে অলিখিত অঘোষিত কালো তালিকা। বরাবরই থাকে, আছে এখনও। কিন্তু এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে বেসরকারি মিডিয়াতেও। আর সে ছড়িয়ে পড়া যেন সরকারি মিডিয়ার চেয়েও বেশি। কারণ, প্রচার প্রসার প্রভাব এখন তাদেরই বেশি। এ ক্ষমতা তার উত্তরোত্তর বেড়েছে ’৯০-পরবর্তী ‘গণতান্ত্রিক’ যুগ শুরু হওয়ার পর থেকে।
তবে পর্বতের চূড়ায় আরোহণের পর সেখানে বেশিক্ষণ থাকা যায় না, আবার নেমে আসতে হয়। কারণ, জায়গাটি ছোট। আমাদের মিডিয়ারও ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণের পর এবার বুঝি শুরু হয়েছে নিচে নামার পর্ব। তার সামপ্রতিক ভূমিকায় এমন আশঙ্কাই দেখা দিয়েছে।
দেশ এখন চরম সন্ধিক্ষণে। অস্থির উত্তেজনা ক্রমে-ক্রমে গ্রাস করেছে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত। দ্বন্দ্ব সংঘাত সহিংসতা সর্বত্র। রাজনৈতিক বিবাদ বিরোধ ক্রমে ছড়িয়ে পড়েছে পাড়ায়-পাড়ায় ঘরে-ঘরে। মৃত্যু উপত্যকা হয়ে উঠেছে দেশ। ক্ষমতার লড়াইয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিযোগী পক্ষগুলো। এক পক্ষের মানুষের রক্ত ঝরছে, অন্যপক্ষে চলছে আনন্দ উল্লাস। যেন যে আমার পক্ষে নয় তাকে বধ করা চলে। সে যেন মানুষ নয়, তাই তাকে মেরে ফেললে কিছু হয় না। ‘মুর্দাবাদ’, ‘নিপাত যাক’, ‘খতম করো’, ‘জবাই করো’ ইত্যাদি স্লোগান যেন মূর্তিমান রূপ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে জীবনের ওপর। এ মৃত্যুর জন্য দুঃখও করা যাবে না, মানবতার পক্ষেও কথা বলা যাবে না- তাহলেও আপনাকে চিহ্নিত করা হবে কোনও পক্ষের লোক হিসেবে। তারপর আপনাকে চিহ্নিত করা হবে বিশেষ নামে, আপনার ওপর লাগিয়ে দেয়া হবে বিশেষ তকমা। এ এক অভাবনীয় পরিস্থিতি। যেন পালটে গেছে মানবতার সংজ্ঞা, দেশপ্রেমের অর্থ। আগেও বলেছি, মানুষ যেন এখন মানুষ নয়, পক্ষ মাত্র। বিশেষ পরিচয় মাত্র। এমন এক জটিল মানবিক ও জাতীয় বিপর্যয়কালীন পরিস্থিতিতে কি ভূমিকা হবে মিডিয়ার? যুদ্ধবাজ দুই পক্ষের একটিকে বেছে নেয়া, না সাধারণ মানুষের পক্ষ হয়ে পরিস্থিতির ভেতর বাইরের সামগ্রিক দিক নিরপেক্ষ নৈর্ব্যক্তিক ভাবে তুলে ধরা? দুঃখের বিষয়, গভীর হতাশার বিষয়, আমাদের প্রতাপশালী প্রভাবশালী মিডিয়া ঝুঁকে পড়েছে পক্ষপাতের পাঁকে। নিরপেক্ষ নৈর্ব্যক্তিক খবরের আদর্শ ভুলে নিজেও হয়ে উঠেছে যুযুধান। পত্রিকায় মতামত প্রকাশের জন্য সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, কলাম, মন্তব্য প্রতিবেদন অনেক বিভাগ রয়েছে, টিভি চ্যানেলগুলোতে রয়েছে টক শো, সাক্ষাৎকার প্রভৃতি। কিন্তু এখন কি হচ্ছে? একজন প্রবীণ সাংবাদিক লিখেছেন, ‘আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো এবং সংবাদপত্রে রিপোর্টার মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করছেন।’ মনের মতো করে সাজিয়ে দিচ্ছেন ঘটনা, বানিয়ে দিচ্ছেন ভিলেন। মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতার গিন্নির কথা- যা কিছু হারায়, গিন্নি বলেন, ‘কেষ্টা বেটাই চোর।’ আমাদের চারপাশে এখন সেই মুখরা গিন্নি। তিনি চোর বলতে বুঝছেন কেবল কেষ্টাকেই।
তাহলে স্বাধীনতার বিয়াল্লিশ বছরে এ-ই আমাদের হিসাবের পাওনা! 

শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৩

শতবর্ষ আগে-পরে রবীন্দ্রনাথ-ইউনূস

আজ থেকে ১০০ বছর আগে ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান রবীন্দ্রনাথ। এ খবর শান্তিনিকেতনে পৌঁছায় ওই বছরের ১৩ই নভেম্বর বৃহস্পতিবার বিকালে। ২৩শে নভেম্বর রোববার কলকাতা থেকে ট্রেনে বোলপুর স্টেশনে গিয়ে পৌঁছেন প্রায় ৪০০ কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী। তারা ‘বন্দেমাতরম্‌’, ‘রবীন্দ্রনাথের জয়’ প্রভৃতি  স্লোগান দিতে-দিতে এগিয়ে যান শান্তিনিকেতনের দিকে। আশ্রমের কাছে পৌঁছলে তাদের অভ্যর্থনা জানান কবি-পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন, অধ্যাপক অজিতকুমার চক্রবর্তী, কবি-বন্ধু সি এফ অ্যান্ড্রুজ প্রমুখ। অভ্যাগতদের তারা নিয়ে যান আমতলায় সভাস্থলে। সেখানে আশুতোষ চৌধুরীর প্রস্তাবে বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসু গ্রহণ করেন সভাপতির আসন। এরপর গাওয়া হয় ব্রহ্মসংগীত, অনুষ্ঠিত হয় উপাসনা। জগদীশচন্দ্র সংক্ষেপে দু’-চার কথা বলে রবীন্দ্রনাথকে উপহার দেন একটি লজ্জাবতীলতা। এরপর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা প্রশস্তি পাঠ করেন হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, অভিনন্দন জানান বাঙালি মুসলমানদের পক্ষে এ কে ফজলুল হক, একজন সম্ভ্রান্ত জৈন, একজন ইংরেজ পাদরি এবং ইংরেজ রাজকর্মচারী অথবা ব্যবসায়ী। এরপর সংবর্ধনার জবাব দিতে আসন থেকে উঠে দাঁড়ান রবীন্দ্রনাথ। প্রথমেই তিনি বলেন, ‘আজ আমাকে সমস্ত দেশের নামে আপনারা যে সম্মান দিতে এখানে উপস্থিত হয়েছেন তা অসঙ্কোচে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করি এমন সাধ্য আমার নেই।...’ এর কারণ হিসেবে বলেন, ‘দেশের লোকের হাত থেকে যে অপযশ ও অপমান আমার ভাগ্যে পৌঁছেছে তার পরিমাণ নিতান্ত অল্প হয় নি, এবং এতকাল আমি তা নিঃশব্দে বহন করে এসেছি। এখন কি জন্য যে বিদেশ হতে আমি সম্মান লাভ করলুম তা এখন পর্যন্ত আমি নিজেই ভাল করে উপলব্ধি করতে পারি নি।... আমি সমুদ্রের পূর্বতীরে এসে যাঁকে পূজার অঞ্জলি দিয়েছিলেম, তিনি সমুদ্রের পশ্চিম তীরে সেই অর্ঘ্য গ্রহণ করবার জন্য যে তাঁর দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করেছিলেন সে কথা আমি জানতুম না। তাঁর সেই প্রসাদ আমি লাভ করেছি - এই আমার সত্য লাভ।... যা-ই হোক, যে কারণেই হোক, আজ ইউরোপ আমাকে সম্মানের বরমাল্য দান করেছেন। তার যদি কোন মূল্য থাকে তবে সে কেবল সেখানকার গুণীজনের রসবোধের মধ্যেই আছে। আমাদের দেশের সঙ্গে তার কোন আন্তরিক সম্বন্ধ নেই।’ কবি স্পষ্ট করেই বলেন, এ সম্মান দিয়েছেন বিদেশীরা, এ দেয়ার কৃতিত্ব তাঁদেরই - দেশের মানুষের নয়। কারণ দেশের মানুষ তাকে অপমান-লাঞ্ছনাই করেছে পদে-পদে। তাই ওই সংবর্ধনা প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন, ‘অতএব আজ যখন সমস্ত দেশের জনসাধারণের প্রতিনিধি রূপে আপনারা আমাকে সম্মান উপহার দিতে প্রবৃত্ত হয়েছেন, তখন সে সম্মান কেমন করে আমি নির্লজ্জভাবে গ্রহণ করবো?... তাই আমি আপনাদের কাছে করজোড়ে জানাচ্ছি - যা সত্য তা কঠিন হলেও আমি মাথায় করে নেবো, কিন্তু সাময়িক উত্তেজনার সময়ে যা, তা স্বীকার করে নিতে আমি অক্ষম। কোন-কোন দেশে বন্ধু ও অতিথিদের সুরা দিয়ে-দিয়ে অভ্যর্থনা করা হয়। আজ আপনারা আদর করে সম্মানের যে সুরাপাত্র আমার সম্মুখে ধরেছেন, তা আমি ওষ্ঠের কাছে পর্যন্ত ঠেকাবো, কিন্তু এ মদিরা আমি অন্তরে গ্রহণ করতে পারবো না। এর মত্ততা থেকে আমি চিত্তকে দূরে রাখতে চাই।’ এ ঘটনাটি স্মরণ করার বিশেষ কারণ আছে অবশ্যই। ১০০ বছর পর, গত পরশু, আরেক বাঙালি প্রতিভা নোবেল-জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভূষিত হয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল’-এ।  কিন্তু দেশে কি অবস্থা তাঁর? প্রায় প্রতিদিনই সরকারের লোক ও তাদের সমর্থকরা নানাভাবে নিন্দামন্দ কটূক্তি করেই চলেছেন তার। অর্থমন্ত্রী তো তাকে হেয় করার সুযোগ নেন কথায়-কথায়। পদ্মা সেতুর অর্থায়নে বিশ্বব্যাংক নিরস্ত হয়েছে নাকি তার গোপন হস্তক্ষেপে - এ ধরনের নানা অভিযোগ শোনা যায় প্রায়ই। এসব শুনতে-শুনতে সম্ভবত তিক্ত হয়ে পড়েছেন তিনিও। তাই দেশের এই গভীর সঙ্কটকালেও কোন ভূমিকা নিতে দেখি না তাকে। শুনতে পাই না তার কোন আবেদন আহ্বান বক্তব্য। রবীন্দ্রনাথকে তো তবু দেশের জনসাধারণের প্রতিনিধিরা সংবর্ধনা জানাতে গিয়েছিলেন, ড. ইউনূসের জাতীয় বা নাগরিক বা গণ সংবর্ধনার আয়োজন করবে কে বা কারা? করা হলে হয়তো রবীন্দ্রনাথের মতো একই রকম প্রতিক্রিয়া জানাবেন তিনিও। সংবর্ধনা দিতে যাওয়া কবি-অধ্যাপক মোহিতলাল মজুমদারকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘গ্রাম্য বালকেরা যেমন কুকুরের লেজে টিন বেঁধে হাততালি দিয়ে তাড়া করে বেড়ায়, আপনারা তাই করতে এসেছেন।’ হয়তো এমন কিছুই বলবেন তিনিও। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর দু’টি প্রতিক্রিয়া ব্যাপক রূপ ধারণ করে সে সময় (১) তাঁর প্রতি শিক্ষিত বাঙালির বিরূপতা বিদ্বেষে পরিণত হয়, এবং তা বেড়েই চলে; (২) আর তিনি দেশবাসীর প্রতি বিমুখ হয়ে বিদেশীদের মুখাপেক্ষী হয়ে ওঠেন। ইতিহাসের কি বিচিত্র গতি! ১৯১৩ ও ২০১৩ প্রায় অভিন্ন হয়ে ওঠে কিভাবে!
sazzadqadir@gmail.com

রবিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৩

মানুষ নয়, বধযোগ্য

পৃথিবীর বহু দেশে যুদ্ধ ও সহিংসতায় নিত্য ঘটছে মানবিক বিপর্যয়ের নানা বেদনাদায়ক ঘটনা। আমাদের দেশে, এ অঞ্চলেও দেখা দিচ্ছে অনেক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি। গত বছর প্রতিবেশী মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গারা শিকার হয় জাতিগত নিপীড়নের। ওই দেশের গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত থাকায় বাইরের জগতে সামান্যই এসেছে হত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের খবর। তারপর যেটুকু তথ্য ও দৃশ্য দেশী-বিদেশী মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে তা রীতিমতো গা শিউরানো ভয়াবহতায় বীভৎস। ওই সময় শ’ শ’ রোহিঙ্গা নরনারী শিশু প্রাণভয়ে পালিয়েছে ভিটামাটি ছেড়ে। ট্রলারে, নৌকায় চেপে ভেসে পড়েছে অজানার উদ্দেশ্যে। তাদের অনেকেরই সলিল সমাধি ঘটেছে সাগরের বুকে, অনেকে আশ্রয় নিতে ছুটে গেছে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভারতে। অনেকে এসেছে আমাদের দেশে। কিন্তু আগে থেকেই রোহিঙ্গা শরণার্থীতে প্রপীড়িত আমরা, তাই নতুন করে শরণার্থী গ্রহণে অনিচ্ছা দেখিয়েছে সরকার। এ অবস্থায় এক ভয়াবহ মানবিক ট্র্যাজেডি আমরা দেখতে পাই দেশের উপকূল অঞ্চলে। অসহায় আশ্রয়প্রার্থীদের তাড়িয়ে দেয়ার সে দৃশ্য নাড়া দিয়েছে বিশ্ববিবেককে। তাই জাতিসংঘ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা অনুরোধ জানিয়েছে বিতাড়ন বন্ধ করে মানবিক সাহায্য দেয়ার। কিন্তু সরকার অনড়। আরও অনড় সরকার-সমর্থকরা। তারা ওই সময় শুরু করে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা-অভিযান। বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গারা কত বিপজ্জনক, কত সমস্যার কারণ তা শতমুখে প্রচার করতে থাকে তারা। তাদের কথায় রোহিঙ্গারা একটি অপরাধী সমপ্রদায়। তারা অস্ত্র, মাদক, নারী ব্যবসা সহ যাবতীয় দুষ্কর্মে জড়িত। দেশের মুসলমানকে তারা ধ্বংস করছে। বাংলাদেশী সেজে বিদেশে গিয়ে তারা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করছে। সেখানে তারা সব ধরনের জঘন্য কুকর্মে লিপ্ত। এছাড়া রোহিঙ্গাদের জামায়াত-শিবির সমর্থক হিসেবেও প্রচার চালানো হয়। ফলে যারা বলতে গিয়েছেন- ওরাও মানুষ, ওদেরও বাঁচার অধিকার আছে- তাদের জঘন্য কটু ভাষায় গালমন্দ করা হয়েছে। ‘রাজাকার’ চিহ্নিত করা হয়েছে। তখন নজরুলের মতো “অসহায় জাতি মারছে ডুবিয়া সন্তান মোর মা’র” বলার মতো দৃপ্ত মানুষ দেখেছি খুবই কম। এরপর একই রকম ভয়াবহ মানবিক ট্র্যাজেডি ঘটে আসামের কোকড়াঝাড়-এ। সেখানকার বোড়োদের হায়নার শিকার হয় বাংলাভাষী মুসলমানেরা। তাদের বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী অভিহিত করে চলে নিধনযজ্ঞ। সেই সঙ্গে লুট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ। এ সময় প্রায় সকলেই ছিলেন নীরব। গণমাধ্যমে সে রক্তপাতময় দাঙ্গা ও প্রাণহানির খবর যেমন ছিল না। ভারতের ‘আউটলুক’ পত্রিকা গুরুত্ব দিয়ে কিছু সচিত্র প্রতিবেদন ছেপেছিল- এছাড়া আর কোন পত্রিকায় সেভাবে স্থান পায়নি এই মানবিক বিপর্যয়ের খবর। তখনও দেখা গেছে মহল বিশেষকে কোকড়াঝাড়ের খবর চেপে রাখার জন্য বিশেষভাবে তৎপর। কিছুদিন আগে আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধ সমপ্রদায়ের মঠ-ঘরবাড়ি এবং সমপ্রতি হিন্দু সমপ্রদায়ের মন্দির-ঘরবাড়ি শিকার হয়েছে হামলার। অগ্নিসংযোগ করে ধ্বংস করা হয়েছে বহু নিরীহ নিরপরাধ পরিবারের আশ্রয়স্থল। এখনও দেখছি কিছু মানুষ ভাল চোখে দেখছে যা এসব ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ। তাদের ভেতরে ভেতরে যেন চাপা উল্লাস। ‘উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল’ কাকে না বিচলিত করে? দেখছি, সবাইকে করে না। রোহিঙ্গা, বাংলাভাষী অসমিয়া, বাঙালি বৌদ্ধ-হিন্দু তবে কি কারও-কারও চোখে আক্রমণযোগ্য? বধযোগ্য? সামপ্রতিক সরকারবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিবর্ষণে হতাহত হয়েছে বহু মানুষ। এভাবে হত্যা কি সমর্থনযোগ্য? কিন্তু এর প্রতিবাদ করা অনেকের কাছে অপরাধতুল্য। নাস্তিক মুরতাদ বা মৌলবাদী এখন বধযোগ্য হয়ে উঠছে কোন কোন পক্ষের কাছে। এ অবস্থায় মনে পড়ে, হিটলারও ইহুদিদের মানুষ মনে করতেন না। ভাবতেন, তাদের হত্যা করলে কিছু আসে যায় না। আমরা কি সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিশাপে আক্রান্ত হয়েছি? কিন্তু এসব প্রশ্ন তোলাই তো বিপজ্জনক। বললেই শুনতে হবে সেই অমোঘ গালি।
sazzadqadir@gmail.com

শনিবার, ৯ মার্চ, ২০১৩

মনের মাধুরী মিশিয়ে

‘তিনি চেনালে লেখক। তিনি চাইলে প্রচার। তিনি দিলেই প্রাইজ’। অর্থাৎ আপনার কাজকর্মের স্বীকৃতি, প্রসার, সম্মাননা - সব নির্ভর করে তার ওপর। তিনি ইচ্ছা করলে আপনি উঠবেন উপরে, নিত্য ঝলমল করবেন খবরে, ঘটনায়, যাবতীয় অনুষ্ঠানে আয়োজনে, পাবেন পদ পদক পুরস্কার পারিতোষিক- দেশ-বিদেশে পাবেন সম্মান সংবর্ধনা। না হলে থাকতে হবে যে আঁধারে সে আঁধারেই। আপনি যত জ্ঞানী গুণী বিজ্ঞ বিশারদ যা-ই হোন কেন- তিনি না চাইলে আপনার সমাদর হবে না, মূল্যায়ন প্রতিষ্ঠা কিছুই হবে না। উদ্ধৃত কবিতাংশ কবি মতি মুখোপাধ্যায়ের। কবিতাটির নাম ‘মিডিয়া’। আশা করি বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে পাঠকদের কাছে, আর খোলাসা করে কিছু বলতে হবে না আপনাদের। এই গোষ্ঠী প্রীতি, দলবাজি, গ্রুপিং নতুন কিছু নয় এ দেশে। আগে সরকারি মিডিয়াতেই ছিল এ ব্যাপারগুলো। সেখানে অলিখিত অঘোষিত কালো তালিকা থাকে। বরাবরই থাকে, এখনও আছে। কিন্তু এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে বেসরকারি মিডিয়াতেও। আর সে ছড়িয়ে পড়া যেন সরকারি মিডিয়ার চেয়েও বেশি। কারণ প্রচার প্রসার প্রভাব এখন তাদেরই বেশি। এ ক্ষমতা তার উত্তরোত্তর বেড়েছে ৯০-পরবর্তী ‘গণতান্ত্রিক’ যুগ শুরু হওয়ার পর থেকে।
তবে পর্বতের চূড়ায় আরোহণের পর সেখানে বেশি ক্ষণ থাকা যায় না, আবার নেমে আসতে হয়। কারণ জায়গাটি ছোট। আমাদের মিডিয়াও ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণের পর এবার বুঝি নিচে নামার পর্ব শুরু হয়েছে। তার সামপ্রতিক ভূমিকায় এমন আশঙ্কাই দেখা দিয়েছে। দেশ এখন চরম সন্ধিক্ষণে। অস্থির উত্তেজনা ক্রমে ক্রমে গ্রাস করেছে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত। দ্বন্দ্ব সংঘাত সহিংসতা সর্বত্র। রাজনৈতিক বিবাদ বিরোধ ক্রমে ছড়িয়ে পড়েছে পাড়ায় পাড়ায় ঘরে ঘরে। মৃত্যু উপত্যকা হয়ে উঠেছে দেশ। ক্ষমতার লড়াইয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিযোগী পক্ষগুলো। এক পক্ষের মানুষের রক্ত ঝরছে, অন্য পক্ষে চলছে আনন্দ উল্লাস। যেন যে আমার পক্ষে নয় তাকে বধ করা চলে। সে যেন মানুষ নয়, তাই তাকে মেরে ফেললে কিছু হয় না। সেই কবে থেকে চলে আসা ‘মুর্দাবাদ’, ‘নিপাত যাক’, ‘খতম করো’ ইত্যাদি স্লোগান যেন মূর্তিমান রূপ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে জীবনের ওপর। এ মৃত্যুর জন্য দুঃখও করা যাবে না, মানবতার পক্ষেও কথা বলা যাবে না- তাহলেও আপনাকে চিহ্নিত করা হবে কোন পক্ষের লোক হিসেবে। তারপর আপনাকে চিহ্নিত করা হবে বিশেষ নামে, আপনার ওপর লাগিয়ে দেয়া হবে বিশেষ তকমা। এ এক অভাবনীয় পরিস্থিতি। যেন পালটে গেছে মানবতার সংজ্ঞা, দেশপ্রেমের অর্থ। মানুষ যেন মানুষ নয়, পক্ষ মাত্র। বিশেষ পরিচয় মাত্র। এমন এক জটিল মানবিক ও জাতীয় বিপর্যয়কালীন পরিস্থিতিতে কি ভূমিকা হবে মিডিয়ার? যুদ্ধবাজ দুই পক্ষের একটি বেছে নেয়া না সাধারণ মানুষের পক্ষ হয়ে পরিস্থিতির ভেতর বাইর সামগ্রিক দিক নিরপেক্ষ নৈর্ব্যক্তিক ভাবে তুলে ধরা? দুঃখের বিষয়, গভীর হতাশার বিষয়, আমাদের প্রতাপশালী প্রভাবশালী মিডিয়া ঝুঁকে পড়েছে পক্ষপাতের পাঁকে। নিরপেক্ষ নৈর্ব্যক্তিক খবরের আদর্শ ভুলে নিজেও হয়ে উঠেছে যুযুধান। পত্রিকায় মতামত প্রকাশের জন্য সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, কলাম, মন্তব্য প্রতিবেদন অনেক বিভাগ রয়েছে, টিভি চ্যানেলগুলোতে রয়েছে টক শো, সাক্ষাৎকার প্রভৃতি। কিন্তু এখন কি হচ্ছে? একজন প্রবীণ সাংবাদিক লিখেছেন, ‘আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো এবং সংবাদপত্রে রিপোর্টার মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করছেন।’ মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতার গিন্নির কথা- যা কিছু হারায়, গিন্নি বলেন, ‘কেষ্টা বেটাই চোর।’ আমাদের চারপাশে এখন সেই মুখরা গিন্নি।
sazzadqadir@gmail.com

শনিবার, ২ মার্চ, ২০১৩

কথার কথা যেন না হয়

দেশ হাঁটছে সরু সুতোর উপর দিয়ে, ক্রমাগত চাপ বাড়ছে ভারসাম্য বজায় রাখার ওপর। কোন কথা, কোন কাজ কখন কি উত্তেজনা অস্থিরতা ছড়িয়ে দেয় - সে আশঙ্কা নিয়ে চলতে হচ্ছে নাজুক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে। তারপরও যেখানে যত বাঁধন সব যেন আলগা হয়ে পড়ছে, খসে-খসে পড়ছে, ছিঁড়ে-ছিঁড়ে যাচ্ছে এলোমেলো হয়ে। বুদ্ধি-বিবেচনাও ব্যর্থ, বিকল হচ্ছে পদে-পদে। ধৈর্য হারিয়ে ফেলছি আমরা, সহিষ্ণুতা দেখাতে পারছি না সমস্যা-সঙ্কট মোকাবেলা করতে গিয়ে। কথায়-কথায় চরমে উঠছে সামাজিক আস্থা। উগ্রতা ছড়িয়ে পড়ছে জনমানসে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে পড়ছে এর প্রভাব, প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে। এ জন্যই হঠাৎ করেই সেদিন ভেঙে গেছে এত গর্ব ও অহঙ্কারের সাংবাদিক ঐক্য। প্রকাশ্যেই ঘোষণা করা হয়েছে সে ভিন্নতা। ফলে নগ্ন হয়ে পড়েছে ভেতরকার দূরত্ব, বিরোধ, বিবাদ। খুলে গেছে তালি দেয়া জোড়া। অথচ কিছুদিন আগে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের পর শপথ ঘোষণা করা হয়েছিল ঐক্যের। সে ঘোষণা হয়েছিল দৃঢ়তার সঙ্গে। সর্বজনশ্রদ্ধেয় বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা অনুরোধ জানিয়েছিলেন- যে কোন মূল্যে এ ঐক্য অটুট রাখতে। কিন্তু তা অটুট থাকেনি শেষ পর্যন্ত, পরিস্থিতির সামনে টুটে গেছে সকল প্রতিশ্রুতি, শপথ, অঙ্গীকার। এর পর-পরই সাগর-রুনি হত্যার বিচার দাবির আন্দোলন মুখোমুখি হয় নতুন পরিস্থিতির। বলা যায় একেবারে অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাংবাদিক নেতাদের সামনে কথা প্রসঙ্গে মন্তব্য করে বসেন সাগর-রুনির ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে। ইঙ্গিত করেন তাদের অনৈতিক জীবন যাপনের দিকে। বিষয়টি প্রথমে সাংবাদিকদের বিমূঢ় করে তুললেও প্রতিবাদ জানাতে দেরি হয় না তাদের। এরপর সৃষ্টি হয় এক অপ্রীতিকর পরিস্থিতির। উচ্চকণ্ঠ ক্ষোভ প্রকাশ পায় সাংবাদিক নেতাদের প্রতিবাদে। আশঙ্কা জাগে, বিষয়টির শেষ এখানেই নয়। আরও অপ্রীতিকর কিছু হয়তো অপেক্ষা করছে সামনে। আসলে কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি আমরা? মহাকবির অমর পঙ্‌ক্তি উদ্ধৃত করে বলা যায়, ‘একে একে নিভিছে ঢেউটি’। আসলেই আলো সরে যাচ্ছে চারদিক থেকে। নেমে আসছে অন্ধকার। গভীর গভীরতর হয়ে পড়ছে ছায়া। বিভাজনের প্রবল ধাক্কা ছুটে এসে আছড়ে পড়েছে পেশাজীবী কর্মজীবী সংগঠনগুলোর ওপর। ফলে ভাঙছে সব কিছু, খণ্ড-খণ্ড হচ্ছে, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। আর হয়ে পড়ছে দুর্বল, অশক্ত, ভঙ্গুর। হারাচ্ছে জোর প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ক্ষমতা। দর কষাকষির দৃঢ়তা। এতে লাভ হচ্ছে প্রতিপক্ষের। তারা শক্তিমান হচ্ছে আরও। সুযোগ নিচ্ছে পদে-পদে। আগে ছিল ন্যূনতম শর্তে ঐক্য গড়ে তোলার বা ঐক্যবদ্ধ থাকার একটা বিষয়। সেটা-ও শেষ পর্যন্ত থাকেনি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। নেতৃত্বের লড়াই, গ্রুপিং, ক্ষমতার ইঁদুরদৌড় মানে না কোন শর্ত। তখন কেবল কে আগে যায় কখন- সেদিকেই থাকে দৃষ্টি। ব্যতিক্রমও আছে। নীতিনৈতিকতা, আদর্শ, লক্ষ্য প্রভৃতির জন্যও অনেক সময় চ্যালেঞ্জ করতে হয় ঐক্যকে। সেক্ষেত্রে দেখতে হবে তা যেন কথার কথা না হয়। তা যেন সত্যিই হয় স্ব-স্ব নীতি-আদর্শের আপসহীন অবস্থান। তখন কোন ভিন্নমত বা আপত্তি থাকবে না কারও।
sazzadqadir@gmail.com

বুধবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

সাঁকোতে সাবধান

প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়েছেন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও জোটের নেতাদের অতিকথনে। তাদের নির্দেশ দিয়েছেন মিডিয়া ও দলীয় নেতাদের সামনে সংযত হয়ে বক্তব্য দিতে। বলেছেন, সরকারের নীতিনির্ধারকদের অতিকথা অনেক সময় বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে পারে সরকারকে। তাই যে কোন বিষয়ে কথা বলতে হবে সতর্কতার সঙ্গে। পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে পারে এমন উস্কানিমূলক কথাবার্তা থেকে বিরত থাকতে হবে তাই। ২৫শে ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি আরও বলেছেন, আমাদের পক্ষে আগ বাড়িয়ে কিছু করা বা বলা ঠিক হবে না। আপনাদের আগ বাড়ানো বক্তব্যকে কাজে লাগাচ্ছে প্রতিপক্ষরা। দয়া করে ওই ধরনের বক্তব্য দিয়ে সাহায্য করবেন না উস্কানিতে।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর সজাগ দৃষ্টি, রাজনৈতিক মনোভাব ও সরকারি অবস্থান স্পষ্ট। তিনি চাইছেন উদ্ভূত অবস্থার শান্তিপূর্ণ সমাধান অর্থাৎ পরিস্থিতি যেন ঘোলাটে না হয়ে ওঠে, সরকারকে যেন বিব্রত না হতে হয়। শাহবাগ চত্বরের তরুণ-যুব সমাজের মৌলবাদমুক্ত অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার জাগরণ-আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়েছে সরকার, সংসদ, মন্ত্রী, এমপি, সচিব, বেশির ভাগ বিরোধী দল ও পেশাজীবী সংগঠনসহ সবাই। আন্দোলনের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের দিকে যথোচিত উদ্যোগ-কার্যক্রমও নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ঢুকে পড়ে একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং একটি অকথ্য ব্লগ। দ্রুত পালটে যেতে থাকে পরিস্থিতি। তারপর ইস্যু হয়ে ওঠে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ বনাম নাস্তিক্যবাদ। তারপর মহানবীর অবমাননা বনাম জাতীয় পতাকা ও শহীদ মিনারের অবমাননা। দুই পক্ষ মুখোমুখি অবস্থানে এখন। এ অবস্থান মরিয়া। ঘৃণা-বিদ্বেষ-আক্রোশ-আক্রমণ এখন স্থান করে নিয়েছে মুখের ভাষায়। সমবেত হামলায়। স্থান অদল বদল করে নিচ্ছে রাজনীতি ও নাশকতা। রক্ত ঝরছে, স্বজনহারাদের আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠছে আকাশ। হিন্দুস্থান টাইমস লিখেছে, গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশে।
শান্তিভূমি পুণ্যভূমি বাংলাদেশ আবার যুদ্ধভূমি? তাহলে কোথায় সেই শুভবুদ্ধি? সোমবারের ওই বৈঠকেই প্রধানমন্ত্রী ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার নির্দেশ দিয়েছেন বন ও পরিবেশ মন্ত্রী হাছান মাহমুদকে। তিনি জানেন, এই আলোচনার পথই একমাত্র পথ। এ পথেই সমাধান ঘটতে পারে বিরোধ, বিবাদ, বিভ্রান্তির।
কিন্তু সবাই কি তা জানেন? বা সবাই কি তা চান?
বিভাজিত জাতির উন্নতি কঠিন জেনেও আমরা বিভাজিত। এ বিভাজন এখন তীব্র। সবাই জানেন বিচারক, শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিকরা যদি দলীয় হয়ে যান তাহলে দেশের মানুষের দাঁড়াবার আর জায়গা থাকে না, তারপরও আমাদের অনেকের চলন বলন কাজকর্ম তো দলীয় কর্মীদের চেয়েও উগ্র আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে। এর অবসান কোথায়?
প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের খবর ‘মন্ত্রীদের অতিকথনে ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী’ শিরোনামে ছাপা হয়েছে মানবজমিন-এ। খবরটির লিঙ্ক ফেসবুক-এ দেয়ার কিছুক্ষণ পরেই মন্তব্য আসে এক স্নেহভাজন কবি-সাংবাদিকের, ‘চ্যানেলগুলোর... বন্ধ হবে এতে? মন্ত্রীদের ক্যামেরা-প্রীতি থাকবে না... বলেন কি?’
প্রশ্নটি মিডিয়ার প্রতি। কারণ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সে। কিন্তু এ সঙ্কটকালে কি  হতাশার কারণ হয়ে উঠছে তার ভূমিকা? আসলে আমাদের দেশে কি ভূমিকা নেয় মিডিয়া? স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নিজের যে ভূমিকা বেছে নেয় মিডিয়া আসলে তার ওপরই নির্ভর করে সঙ্কটকালীন পরিস্থিতিতে তার ভূমিকা। সে কি সমাজের নেতা? নাকি সংস্কারক? পরিবর্তনের অনুঘটক? নাকি খবর ও মতামতের বাহক মাত্র? বার্তাবাহক হিসেবেও কি সে স্বাধীন নাকি অভ্যন্তরীণ বা বহিঃস্থ চাপ বা শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত?
যা-ই হোন, দয়া করে সাঁকো নাড়তে বলবেন না কাউকে। -

শনিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

আমার যত ভাষা

আমার মাতৃভাষা বাংলা। এ ভাষায় কথা বলি, লিখি। এ ভাষায় লেখা বইপত্র পড়ি। এ ভাষার সূত্রে ঘনিষ্ঠ হয়েছি আরও অন্তত চারটি ভাষার সঙ্গে। ঐতিহ্যিক সূত্রে ওই ভাষা চারটি গ্রথিত হয়েছে আমাদের ভাষায়, আমাদের জীবনে ও কর্মে। ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে ধর্মীয়, প্রশাসনিক ও ঔপনিবেশিক। এসব সূত্রে আমরা পেয়েছি সংস্কৃত, আরবি, ফারসি ও ইংরেজি ভাষাকে। সংস্কৃত ভাষা কেবল ধর্মাচরণে নয়, এ ভাষার সাহিত্য আমাদের সাহিত্যকেও পরিপুষ্ট করেছে। বাংলা ভাষার বেশির ভাগ শব্দ তৎসম অর্থাৎ সংস্কৃত থেকে সরাসরি এসে স্থান করে নিয়েছে নয় উদভূত হয়েছে। আমাদের ব্যাকরণও বহুক্ষেত্রে সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুসারী। অন্যদিকে আরবি বিশেষভাবে ইসলাম ধর্মের ঐতিহ্যে স্থান করে নিয়েছে এ দেশের বেশির ভাগ মানুষের জীবনাচরণে। সেই সঙ্গে লেখা ও পড়ায়। ফারসি-ও কিছুটা যুক্ত ধর্মীয় ঐতিহ্য ও সাহিত্যচর্চার সূত্রে। তবে তুর্কি মুগল পাঠান যুগে এ ভাষাই ছিল রাজভাষা। প্রায় ৭০০ বছর এ ভাষায় চলেছে যাবতীয় রাজকার্য, শাসন-প্রশাসন। ইংরেজ আমলেরও প্রথম প্রায় ১০০ বছর চলেছে এ ভাষার অব্যাহত ব্যবহার। তারপর এসেছে ইংরেজি। এ ভাষা আবার আমাদের প্রথম অগ্রাধিকারের আন্তর্জাতিক ভাষা। সেদিকে লেখা পড়া চর্চায় ইংরেজি হয়ে উঠেছে এ দেশের বাংলাভাষীদের দ্বিতীয় মাতৃভাষা। এখানেই শেষ নয়। আমরা যুক্ত আছি প্রতিবেশী ভাষাগুলোর সঙ্গে। সেগুলোর মধ্যে অসমিয়া, ওড়িশা’র চেয়ে উরদু হয়ে উঠেছে বেশি ঘনিষ্ঠ। এর কারণ বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে উরদুভাষীদের ব্যাপক হারে এ বাংলায় আগমন। তারপর পাকিস্তানি যুগের ২৫ বছরে উরদুর ব্যাপক প্রচলন। এছাড়া লাহোর ও মুম্বইয়ের ছবির ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তার ফলে উরদু’র পাশাপাশি হিন্দিও হয়ে ওঠে আমাদের ঘনিষ্ঠ। এখন টেলিভিশনের ব্যাপক প্রসারের কারণে হিন্দি পরিচিত হয়ে উঠেছে ঘরে ঘরে। কাজেই এই এতগুলো ভাষার সঙ্গে সেই ছোটবেলা থেকেই বড় হয়ে উঠি আমরা। আমাদের কাজে কেবল নয়, এর জোরালো প্রভাব পড়ে আমাদের কথাবার্তাতেও। আমার নিজের কথা বলি। আরবি-ফারসি সম্পর্কে মোটামুটি জানাশোনা থাকলেও, এ দু’টি ভাষার বর্ণমালা চিনলেও, প্রাথমিক ব্যাকরণ জানলেও, আমি সেভাবে পড়তে পারি না, লিখতেও পারি না। আর ইংরেজি আমার জন্য মাতৃভাষা বাংলার মতোই হয়ে উঠেছে। এ ভাষায় যদিও লেখালেখি করি না, কিন্তু করি অন্য সকল কাজ। পড়া, শোনা, দেখা, বলা, অনুবাদ, সাংবাদিকতা, সামাজিক যোগাযোগ ও অন্য অনেক কিছু। এখানেই শেষ নয়। উপমহাদেশের প্রাদেশিক ভাষাগুলো এবং উল্লিখিত ভাষাগুলো ছাড়াও প্রবাসী বাংলাদেশীদের অনেকেই বহু ভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। সুইডিশ, ফরাসি, জার্মান, স্প্যানীশ, ইতালিয়ান, জাপানি, কোরিয়ান, মেকহিকান, মালয়, নেপালি প্রভৃতি  ভাষা জানেন ও বলেন এমন অনেক বন্ধু ও আত্মীয় আমার এই ঢাকা শহরেই আছেন। আমি নিজে চীনা ভাষার সঙ্গে পরিচিত। লিখতে পড়তে না পারলেও এক সময় বলায় দক্ষতা ছিল ১৯৭৮-৮০ সালে চীন দেশে বসবাসের সুবাদে। এ জন্য এখনও ইংরেজি উচ্চারণে ‘বেজিং’ ‘বিজিং’ ‘বেইজিং’ না লিখে আমি বিশুদ্ধ চীনা উচ্চারণেই লিখি ‘পেইচিং’। কথা আছে আরও। আমাদের এই বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়াও আছে অন্যান্য জাতি। তাদের আছে নিজস্ব ভাষা। কোন-কোন ভাষার লিপি আছে। কোন-কোন ভাষার লিপি উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে। মাতৃভাষার প্রতি আমাদের যেমন মমতা, মাতৃভাষাকে নিয়ে আমাদের যেমন অহঙ্কার- ঠিক তেমন মমতা ও অহঙ্কার তাদেরও আছে। উপসংহারে বলি, বাংলাদেশের বাঙালি হলেও একমাত্র বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের জীবন নয়। প্রায় এক ডজন অন্য ভাষা নানা সূত্রে ঘনিষ্ঠ হয়ে আছে আমাদের। এ ঘনিষ্ঠতা প্রায় অবিভাজ্য।  কাজেই সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন সম্ভব নয়। সম্ভব সর্বাধিক স্তরে প্রচলন। তাই আমাদের স্লোগান হওয়া উচিত- সর্বাধিক স্তরে বাংলা চাই। তাহলে আমাদের শিক্ষা, সেই সঙ্গে অগ্রগতি হবে সুনিশ্চিত। এ কথাগুলো বলে আসছি ১৯৭২ সাল থেকে। আজ আবারও বললাম।
sazzadqadir@gmail.com

বৃহস্পতিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

তীর ছুড়তে গেলে

যে যাই বলুন কিন্তু কে কি চান - তা আমরা জানি ভালভাবেই। আওয়ামী লীগ চায় ক্ষমতায় থেকে যেতে। বিএনপি চায় হারানো ক্ষমতা ফিরে পেতে। বামপন্থিরা চায় বিপ্লব ঘটাতে। ধর্মান্ধরা চায় সাম্প্রদায়িক স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু আমরা কি চাই? আমরা এই গণমানুষ। গরিবগুর্বো জনসাধারণ।
    ক্ষমতায় গিয়ে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কি-কি করবে তা অনুমান করা কঠিন নয় কারও পক্ষে। আওয়ামী লীগ চাইবে ৫ আসনের জামায়াতকে ০ আসনে আর ৩০ আসনের বিএনপিকে ৫ আসনে নামিয়ে দিতে। আর বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে আওয়ামী লীগ যা-যা করেছে তার সবই করবে চরম মাত্রায়। ধর্মান্ধদের আশা পূরণ হবে না কখনওই, কারণ এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ ধর্মপ্রাণ - তাঁরা ধর্মান্ধতাকে প্রশ্রয় দেন নি কোনও দিন, দেবেনও না। আর বামপন্থিরা অনেক দুস্তর পথ পাড়ি দিয়ে এ পর্যন্ত এসেছেন, আমার মনে হয় - আরও দুস্তর পথ পাড়ি দিতে হবে তাঁদের। মহামতি লেনিন বলেছেন, A revolution is impossible without a revolutionary situation; furthermore, not every revolutionary situation leads to revolution. অর্থাৎ বৈপ্লবিক পরিস্থিতি ছাড়া বিপ্লব সম্ভব নয়, আবার প্রতিটি বৈপ্লবিক পরিস্থিতি-ও পৌঁছয় না বিপ্লবে। কাজেই বাংলাদেশে কখন সে সঠিক পরিস্থিতি দেখা দেবে তা-ও বলা সম্ভব নয়। ষাটের দশকের শুরুতে বামপন্থিরা বলতেন, নিরঙ্কুশ সাম্যবাদের কথা। সত্তরের দশকে বললেন, সমাজতন্ত্র চাই। আশির দশকে চাইলেন গণতন্ত্র। নব্বই দশক থেকে বলছেন নির্বাচনের কথা। এর মধ্যে অনেক বামপন্থি নিজেকে বিলীন বা বিলুপ্ত করেছেন ডানপন্থায়। এ অবস্থায় মনে হতে পারে, তাঁরা পিছু হটেছেন ক্রমশ। কিন্তু তা ঠিক নয় বলে মনে করি আমি। তীর ছুড়তে গেলে তাকে টেনে পিছন দিকে নিতে হয়। তাহলেই লক্ষ্যের দিকে যেতে পারে তা। বামপন্থিরা বিপ্লবের লক্ষ্যে পৌঁছতে নিজেদের উদ্যত করে নিয়েছেন মাত্র, যথাসময়েই লক্ষ্যভেদী তীর ছুড়বেন তাঁরা। এছাড়া, সুভাষচন্দ্র বসু’র কথায় বলি, “বিপ্লবের পথ একেবারে ঋজু পথ নয়। এ পথে নিরবচ্ছিন্নভাবে সাফল্য আসে না, এ পথ বহু বিঘ্নসঙ্কুল, সুদীর্ঘ এবং সর্পিল।” তবুও বিপ্লব ছাড়া গত্যন্তর কি আমাদের? স্বাধীনতার পর গত বিয়াল্লিশ বছরে এত জঞ্জাল জমেছে যে বৈপ্লবিক শক্তি ছাড়া আর কোনও শক্তির পক্ষে সাফ করা সম্ভব নয় তা। সেই কবে ‘পথের দাবী’ উপন্যাসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “বিপ্লব শান্তি নয়। হিংসার মধ্যে দিয়েই তাকে চিরদিন পা ফেলে আসতে হয় - এই তার বর, এই তার অভিশাপ।... মহামানবের মুক্তি সাগরে মানবের রক্তধারা তরঙ্গ তুলে ছুটে যাবে সেই তো আমার স্বপ্ন। এত কালের পর্বতপ্রমাণ পাপ তবে ধুয়ে যাবে কিসে?” আমাদের তাই বিপ্লব চাই তিমিরবিনাশী। আজ শাহবাগ চত্বরে দেখছি সেই বিনাশী বিপ্লবের পূর্বাভাস। ফাগুনের আগুনে রাঙা এক সূচনা। নূতনের কেতন উড়েছে, জয়ধ্বনি উঠেছে দিকে-দিকে। তাই লিখেছি ‘শাহবাগের মোড় / বিপ্লবের ভোর। / শাহবাগ চত্বর / বাংলার অন্তর।’ এখন থেকে আর কোনও কিছুই সহজ হবে না প্রতিষ্ঠার প্রতিভূদের পক্ষে। এবার দিচ্ছি ফেসবুক-বন্ধু শুভ কিবরিয়া’র দেয়াল থেকে গোলাম মোর্তোজা’র লেখার উদ্ধৃতি: “শুধুমাত্র  ক্ষমতায় যাওয়ার এই রাজনীতি অতি নিম্ন শ্রেণীর রাজনীতি। নিম্ন রুচির রাজনীতি। শাহবাগের আন্দোলন এই রাজনীতির বিপক্ষে। সুস্থ, মঙ্গল চিন্তার প্রত্যশিত রাজনীতির পক্ষে। নবজাগরণের দাবি রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ, যুদ্ধাপরাধীমুক্ত বাংলাদেশ। সরকার কিছুটা রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে, ভোটের রাজনীতির অংশ হিসেবে এই আন্দোলনের পক্ষে। বেশ কিছুটা পক্ষে বাধ্য হয়ে। জনমতকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা সরকারের নেই। এতদিন সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচার করছিল, আবার টালবাহানাও করছিল। নবজাগরণের চাপে টালবাহানা বাদ দিয়েছে কিনা তা এখনও দৃশ্যমান নয়। সরকারকে তা দৃশ্যমান করতে হবে। যদি ট্রাইবুনালের সংখ্যা বাড়ানো হয়, অযোগ্যদের বাদ দিয়ে অথবা রেখে যদি যোগ্য তদন্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বাড়ানো হয়, যদি বাড়ানো হয় দক্ষ, আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত আইনজীবীদের সংখ্যা - তবে দৃশ্যমান হবে বিচার নিয়ে সরকারের আন্তরিকতা। পাশাপাশি সাক্ষীদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে একটি কার্যকর গবেষণা সেল করাটা অতীব জরুরি।”
১৪.০২.২০১৩
sazzadqadir@rediffmail.com

বুধবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

ফুঁসে উঠছে বাংলাদেশ

সাযযাদ কাদির: শাহবাগ চত্বরে আবার সেই ছাত্র-জনতা। সেই উত্তাল তারুণ্য, সেই বাঁধ-ভাঙা উদ্দাম উচ্ছ্বাস, স্লোগানে-স্লোগানে সেই বিক্ষোভ-জ্বালা, সেই প্রত্যয় দৃঢ় শপথ, অঙ্গীকার। যেন এক ঝড়ের উৎস-গর্জন। যে দিকে তাকাই রোদ-ঝলসানো জ্বলজ্বলে মুখ, অতন্দ্র চেতনায় শান্ত কঠিন জাগ্রত জনজোয়ার। দাঁড়াই এ জোয়ারের মাঝখানে, রচনা করি দু’টি পঙ্‌ক্তি - ‘মনে ক্ষোভ পুষে পুষে/ বাংলাদেশ উঠছে ফুঁসে।’ মনে পড়ে কবিকিশোর সুকান্তকে। তার অমর পঙ্‌ক্তিগুলো উচ্চারণ করি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে- ‘টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া হঠাৎ বাংলাদেশ... জ্বলে পুড়ে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ মাথা নত না করার এ উত্থান আমাদের বহুপ্রত্যাশিত, প্রজন্মের এ অভ্যুদয় আশান্বিত করে - বুক ভরে দেয় বিশ্বাসে - আমরা থাকবো না, কিন্তু ওদের হাতে দেশ থাকবে নিরাপদ, পরিবর্তনের গতিধারায় এগিয়ে চলবে জাতি। তখন বাধা দিলে বাধবে লড়াই, সে লড়াই চলবে আপসহীন। দ্রোহী চেতনায়, রক্তের বন্ধনে চিনি এ ছাত্র-জনতাকে। এই জনসমুদ্রের একজন আমি, সে ও আরও অনেকে। বায়ান্ন’র সংগ্রাম-আন্দোলনের চেতনায় আমাদেরও এমন যাত্রা শুরু হয়েছিল বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনে। ছাত্র-জনতা আমরা এমন বিক্ষোভে তখন উত্তাল করে তুলেছি শহর-জনপদ। তারপর ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে, আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে- এই আমরাই ছিলাম। গত পঞ্চাশ বছরে আন্দোলন সংগ্রামে কত ত্যাগ ও তিতিক্ষা, কত রক্ত ও অশ্রু এই ছাত্র-জনতার। মনে পড়ে ১৪৪ ধারা ভেঙে বাষট্টির মিছিলের এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্য, ঊনসত্তরে কারফিউ অগ্রাহ্য করে রাজপথে আকাশ-কাঁপানো স্লোগান দিয়ে নেমে পড়া মানুষের ঢল। পথে-পথ কত কাঁটাতারের ব্যারিকেড তখন, অত্যাচারের স্টিম রোলার, বাতাসে বারুদের গন্ধ। একাত্তরে রণাঙ্গণে অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা এই ছাত্র-জনতাই। সে সময় মুক্তির সোপানতলে কত প্রাণ হলো বলিদান। প্রতিবারই গর্বিত গৌরবের বিজয় ছিনিয়ে এনেছি আমরা, কিন্তু তারপর? পথে পথে সে বিজয়ের উল্লাস-আনন্দ ছড়িয়ে পড়তে না পড়তে শুরু হয়েছে প্রাসাদ-ভবনে নানা শলা-পরামর্শ, ব্যস্ততা, তোড়জোর। বৈঠক, বক্তৃতা, বিবৃতি, আলোচনা। তারপর উড়ে এসে জুড়ে বসা রাজনীতি ছিনিয়ে নিয়েছে বিজয়কে। বিভ্রান্ত হয়েছে ছাত্র-জনতা। রাজনীতির ছদ্মাবরণে ঢুকে পড়েছে নষ্ট নেতা, ভ্রষ্ট বুদ্ধিজীবী, সং সংস্কৃতিজন। আন্দোলন-সংগ্রামের সুফল ধীরে-ধীরে চলে গেছে ফের প্রতিক্রিয়ার শক্তির কাছে। কেবল বদল হয়েছে চেহারার, রঙের, লেবাসের। কিন্তু সেই বঞ্চনা, দুর্নীতি, শোষণ, দুঃশাসন চলতেই থাকে। শক্তের অপরাধ চলে প্রতিকারহীন। এভাবে গত পঞ্চাশ বছরে বারবার প্রতারিত হয়েছে সংগ্রাম-আন্দোলনে উজ্জীবিত ছাত্র-জনতা, বারবার বিজয়ের পতাকা খামচে ধরেছে প্রতিক্রিয়ার কালো হাত। কিন্তু আর কত? শাহবাগ চত্বর এবার রুখে দাঁড়িয়েছে অপরাজনীতির বিরুদ্ধে। বেনো জলের মতো ঢুকে পড়া ছল- কৌশলকে ঠেকাতে চাইছে প্রবল প্রতিরোধে। বক্তৃতার ভাঙা রেকর্ড বাজাতে মানা করেছে তারা। বলেছে, না- কোন রাজনীতি নয়। হুঁশিয়ার করেছে নেতাদের। কাউকে বানিয়ে দিয়েছে খামোশ। কাউকে দিয়েছে তাড়িয়ে। এবার উচ্চারণ একটিই- ফাঁসি চাই ঘাতক দালালের। আপস নয়, আঁতাত নয়। আর বিজয় ছিনতাই নয়।
sazzadqadir@gmail.com

মঙ্গলবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০১৩

‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’য় কবি ও বহুমাত্রিক লেখক সাযযাদ কাদির-এর বই

প্রবন্ধ-গবেষণা
বাংলা আমার। হাজার বছরের কবি ও কবিতা সম্পর্কে প্রতিষ্ঠাবিরোধী আলোচনা। প্রকাশক: প্রিয়মুখ প্রকাশনী
     (স্টল নং ১১৬)
বিচলিত বিবেচনা। সংবাদ, সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ভিন্ন ধারার আলোচনা। প্রকাশক: জ্ঞান বিতরণী
(স্টল নং ১৩৬-১৩৭)
চুপ! গণতন্ত্র চলছে...। সমসাময়িক বিভিন্ন প্রসঙ্গে প্রবন্ধ নিবন্ধ কলাম। প্রকাশক: দিব্য প্রকাশ
(স্টল নং ২১২-২১৪)
সহচিন্তন। ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ব্যতিক্রমী আলোচনা। প্রকাশক: ঝিঙে ফুল (স্টল নং ৪-৫)

শিশুতোষ
তেপান্তর। লোকরচনার সঙ্কলন। প্রকাশক: প্রিয়মুখ প্রকাশনী (স্টল নং ১১৬)
রসচৈনিক। চীনের গল্পকথার সঙ্কলন। প্রকাশক: দিব্য প্রকাশ (স্টল নং ২১২-২১৪)

সম্পাদনা
এই সময়ের কবিতা। বিশাল বাংলার ১০০ কবির রচনা। প্রকাশক: সাহস পাবলিকেশনস্‌ (স্টল নং ১০৩)
শ্রেষ্ঠ কবিতা: শক্তি চট্টোপাধ্যায়। প্রকাশক: হাওলাদার প্রকাশনী (স্টল নং ৪১৫)

সাযযাদ কাদির-এর বই

কবিতা: যথেচ্ছ ধ্রুপদ; রৌদ্রে প্রতিধ্বনি; দূরতমার কাছে; দরজার কাছে নদী; আমার প্রিয়; এই যে আমি; কবিতাসমগ্র;
জানে না কেউ; বিশ্ববিহীন বিজনে; বৃষ্টিবিলীন
গল্প: চন্দনে মৃগপদচিহ্ন; অপর বেলায়; রসরগড়
উপন্যাস: অন্তর্জাল; খেই
গবেষণা: ভাষাতত্ত্ব পরিচয়; হারেমের কাহিনী: জীবন ও যৌনতা; রবীন্দ্রনাথ: মানুষটি; রবীন্দ্রনাথ: শান্তিনিকেতন;
বাংলা আমার; সহচিন্তন; বিচলিত বিবেচনা; চুপ! গণতন্ত্র চলছে...
সঙ্কলন: রাজরূপসী; প্রেমপাঁচালি; পৃথিবীর প্রিয়প্রণয়ী; নারীঘটিত
শিশুতোষ: তেপান্তর; মনপবন; রঙবাহার; বীরবল নামা; এফফেনতি; উপকথন; উপকথন আরও; উপকথন
আবারও; উপকথন ফের; ইউএফও: গ্রহান্তরের আগন্তুক; জমজমাট; জানা আছে জানা নেই; সাগরপার
ভাষান্তর: লাভ স্টোরি; রসচৈনিক; বাংলার লোকরচনা
স্মৃতিকথা: নানা রঙের দিন
সম্পাদনা: প্রবন্ধ সংগ্রহ: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; প্রবন্ধ সংগ্রহ: বেগম রোকেয়া; শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা

শনিবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০১৩

বই ও বইয়ের মেলা

সাযযাদ কাদির: ভাষা শহিদদের স্মৃতিবাহী ফেব্রুয়ারি আসন্ন। আর ক’দিন পরেই রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার থেকে শিল্পকলা একাডেমী পর্যন্ত গোটা রমনা এলাকা মুখরিত হবে সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা অনুষ্ঠান-আয়োজনে। কবিতা উৎসব, নাট্য অনুষ্ঠান, শিল্প প্রদর্শনী, সংগীতের আসর, গ্রন্থমেলাসহ বহু বিচিত্র বর্ণাঢ্য প্রাণচাঞ্চল্য দেখা যাবে এ ঐতিহ্যিক বলয়ে। এমন আয়োজন অবশ্য হবে সারা দেশেই। শহরে, পাড়ায়, গ্রামে। তবুও ওই সংস্কৃতি বলয়ের আয়োজন যেন সব কিছুকে ছাড়িয়ে। এখানে দেশের এ প্রান্ত ও প্রান্ত থেকে আসেন শিল্পী-সাহিত্যিক সকলে। প্রবাসী লেখকরাও আসেন এই সময়টায়। নানা দেশ থেকে গুণীজনেরা আসেন বিভিন্ন আয়োজন-অনুষ্ঠানে। নবীন প্রবীণ সকলের এক মিলনমেলা হয়ে ওঠে গোটা ফেব্রুয়ারি মাস। আর সব আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু বাংলা একাডেমীর ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। এ মেলাতেই আসে বছরের সব নতুন বই, আর বলতে গেলে সারা বছরের বই বিক্রিও এই সময়টায়। কাজেই লেখক, প্রকাশক ও পাঠকদের এ মেলায় নতুনত্বই প্রধান। এখানে আত্মপ্রকাশ করেন নতুন লেখক, চমক জাগান নতুন প্রকাশক। নতুন সৃষ্টি হয়েছে পড়ার নেশা- ভিড় করেন সেই পাঠকরাও।
‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ পাড়ি দিয়ে এসেছে দীর্ঘ পথ। এ পথে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে, সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে- কিন্তু এর আকর্ষণ আছে তেমনই। এবারও উদ্যোগ আছে নতুন কিছুর। শুনেছি সে সব উদ্যোগ মেলাকে প্রকৃত প্রকাশকদের মেলায় পরিণত করার। বিভিন্ন সংগঠন, সমিতি, সংস্থাকে স্টল বরাদ্দ দেয়া হবে না এবার। এ ধরনের উদ্যোগ অতীতেও নেয়া হয়েছে বহুবার। কিন্তু মহলবিশেষের চাপে ফলপ্রসূ হয় নি সে সব উদ্যোগ। এবারও চাপ আছে, তবে মহাপরিচালক তা দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করছেন বলে জেনেছি। এজন্য তিনি সাধুবাদ ও সমর্থন পাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট সকল মহলের- এমন খবরও পেয়েছি। এ ক্ষেত্রে আমরাও আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি তাঁকে।
গ্রন্থমেলা’র বড় সমস্যা প্রচণ্ড ভিড়। এদিকে শাহবাগ, ওদিকে শিক্ষাভবনের কাছ থেকে ধরতে হয় দীর্ঘ লাইন। ভেতরেও ঠেলাঠেলি ভিড়। এবার মেলাকে একাডেমীর ভেতরেই রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জেনেছি- তাতে আশঙ্কা করছি ভিড় আরও প্রচণ্ড হয়ে উঠতে পারে। বইয়ের পাঠক-ক্রেতারা বই কেনেন নেড়ে চেড়ে দেখে, কিন্তু সে সুযোগটা থাকে না ঠেলাঠেলিতে। এতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েরই হতাশ হওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এই হৈহৈ ভিড়ের কারণে নজরুল মঞ্চে বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে অনেক জ্ঞানী-গুণী এলেও তাঁদের একটি কথাও শোনা যায় না। এ অবস্থায় মেলার পরিসর বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারেন একাডেমী কর্তৃপক্ষ। আলোচনা অনুষ্ঠানের চত্বরটিতে স্টল বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন কোনও-কোনও প্রকাশক। এ প্রস্তাবটি ভেবে দেখা যেতে পারে বলে মনে করি আমরা। কারণ আলোচনা-সেমিনারের আয়োজন ভবনের অডিটোরিয়ামে করা হলে তা হবে কোলাহলমুক্ত, বক্তা ও দর্শক-শ্রোতাদের জন্য সুখকর।
তবে বইয়ের দাম দিনে-দিনে বেড়ে যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তা বলতে গেলে সাধারণ ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে এখন। প্রকাশকেরা বলেন, মুদ্রণ সামগ্রী-সরঞ্জামে সরকার যদি কর হ্রাস না করে তবে দাম এমন চড়তেই থাকবে। এছাড়া অডিও-ভিসুয়াল মিডিয়ার ক্রমবিস্তৃতি বইয়ের জগৎকে ফেলেছে চাহিদার সঙ্কটে। আগের মতো আর পাঠক-ক্রেতা নেই বইয়ের। এ অবস্থায় প্রকাশনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা হয়ে উঠেছে অপরিহার্য। আমাদের মনে রাখা দরকার বই মানুষের নিত্যসঙ্গী। এ সঙ্গী আমাদের জীবনের বিকাশে রাখে অন্যতম প্রধান উৎস-ভূমিকা। বই সম্পর্কে কোথাও পড়েছিলাম-
“Books are a man’s soulmate. What would we do without books? Books and readers are inseparable from each other. Right from childhood, a person is taught to value books. He carries books in his bag to school, takes care of them by covering them and attaching a label with his name and feels a sense of pride in being its owner. Books lend a person with a feeling of self-importance as well. Books help us to stretch the frontiers of our knowledge. The more a man reads, the more learned and knowledgeable he becomes.”  এ কথাগুলির গুরুত্ব অনুধাবন করা উচিত সকলেরই।
sazzadqadir@rediffmail.com

বৃহস্পতিবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০১৩

শত্রু শত্রু খেলা

রাজনীতি ও কূটনীতি একটি খেলা। আগেও ছিল, এখনও দেশে দেশে ও দলে দলে এ খেলায় মেতে আছেন কুশলী খেলোয়াড়েরা। নিজেদের অপকর্ম-দুষ্কর্ম আড়াল করতে, ব্যর্থতা ঢেকে রাখতে তারা চালিয়ে যান এ খেলা। জনগণ যাতে প্রতিবাদ না করতে পারে সে জন্য চলে তাদের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘোরানোর চেষ্টা। নানারকম আবেগপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, ভাবাবেগের জোয়ার জাগিয়ে তুলে তাদের ক্ষমতা বা অবস্থান বজায় রাখার চলে প্রাণপাত প্রয়াস। তাই দেখি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো আমাদের এই উপমহাদেশের দু’টি দেশ ভারত ও পাকিস্তান দশকের পর দশক ধরে মেতে আছে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায়। দেশে অভ্যন্তরীণ সঙ্কট তীব্র হয়ে উঠলে তারা ওই খেলাতেই মেতে ওঠেন সমস্বরে। সীমান্তে উত্তেজনা বাড়ে, নেতাদের গলায় জোর বাড়ে, আর জনগণ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে ক্রমাগত হুমকি-ধমকির গর্জনে। বর্তমান দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন এবং অন্যান্য নানা প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ও পরিস্থিতিতে ভারত ও পাকিস্তানের দুই সরকারই হয়ে পড়েছে টালমাটাল। এ অবস্থায় এমন একটি কার্যকর খেলা রক্ষাও করতে পারে তাদের। তবে এমন খেলা খেলতে গিয়ে আগেও কয়েকবার সত্যি-সত্যি যুদ্ধেও জড়িয়ে পড়েছে দু’ দেশ, সীমান্তে বিভিন্ন সময়ে রক্তপাত তো আছেই- এবারও এ খেলার পরিণতি কি হয় তা অবশ্যই দেখার বিষয়।
এসব খেলা দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের দেশের দু’টি বড় দল হয়তো এমন শত্রু শত্রু খেলা খেলেই নিজেদের যাবতীয় ব্যর্থতা-দুর্বলতা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখতে চায় দেশবাসীর। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতাসহ আমাদের গভীর আবেগের আরও নানা বিষয়াদিকে কাজে লাগিয়ে তারা বজায় রাখতে চায় ক্ষমতার খেয়োখেয়ি, দুর্নীতির কারসাজি।
তবে রাজনীতি-কূটনীতির এ রকম অব্যাহত খেলা দেশ জাতি সমাজের ওপর অন্তহীন দুর্ভোগই টেনে আনছে বারবার। মানুষের ভাগ্য ফেরাবার উদ্যোগ আয়োজন নেই, কিন্তু নির্যাতন নিপীড়ন চলছেই। বিশ্বসমাজ চিন্তাচেতনা ধ্যান-ধারণায় দিনে দিনে এগিয়ে গেলেও আমরা এখনও খাবি খাচ্ছি প্রতিক্রিয়ার ঘূর্নাবর্তে। এ ব্যাপারে উদাহরণ টানছি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের তুলনায় অনেকখানি প্রাগ্রসর ভারত থেকে- এ থেকে বুঝবো আমাদের সমাজ এখন কোথায়, এ সমাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন কারা।
গত ১৬ই ডিসেম্বর রাতে নয়া দিল্লি’র একটি বাসে ২৩ বছর বয়সী এক প্যারামেডিক ছাত্রী শিকার হয় গণধর্ষণের। পত্রপত্রিকায় ভারতের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে এ ঘটনা এবং ধর্ষণ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সম্পর্কে।
ধর্ষণের দায়ে গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে তিনজনের পক্ষে আদালতে দাঁড়িয়েছেন আইনজীবী মনোহর লাল শর্মা (৫৬)। তিনি বলেছেন, ঘটনার জন্য ধর্ষিতা ও তার পুরুষবন্ধুই পুরোপুরি দায়ী। অত রাতে অবিবাহিত যুগলের ঘুরে বেড়ানোর কারণে এমনটি ঘটেছে। কোন সম্ভ্রান্ত মহিলা ধর্ষণের শিকার হন নি কখনও। সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েদের গায়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডনরাও হাত দেয় না।
ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র নেতা, ছত্তিশগড়ের রায়পুর আসনের সংসদ রমেশ বৈশ (৬৬) বলেছেন, যুবতী বা মহিলাদের ধর্ষণের ব্যাপারটা বুঝতে পারি। তবে শিশু ও বালিকারা যদি ধর্ষণের শিকার হয় তবে তাকে অবশ্যই জঘন্য অপরাধ বলতে হবে। এ ধরনের অপরাধীকে অবশ্যই ফাঁসি দিতে হবে।
আহমেদাবাদের ধর্মীয় নেতা আসারাম বাপু (৭২) বলেছেন, ধর্ষণের ঘটনার জন্য মেয়েটিই দায়ী। ধর্ষকদের ‘ভাই’ সম্বোধন করে প্রাণভিক্ষা চেয়ে নিজেকে বাঁচাতে পারতো সে।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ-এর সর্সঙ্ঘচালক (সর্বোচ্চ প্রধান) মোহন ভাগবত (৬৩) বলেছেন, ধর্ষণ ঘটে নাগরিক ‘ইন্ডিয়া’য়- গ্রামীণ ‘ভারত’-এ ঘটে না। পশ্চিমা সংস্কৃতির কুফল এটা।
মহারাষ্ট্র সমাজবাদী পার্টি-র রাজ্যপ্রধান ও সাংসদ আবু আজমি (৫৮) বলেছেন, অনাত্মীয় লোকজনের সঙ্গে মেয়েদের বাইরে যাওয়া উচিত নয়। দিল্লিতে ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটেছে পশ্চিমা সংস্কৃতির কারণে। গাখোলা পোশাকে মেয়েরা ঘুরে বেড়ালে পুরুষরা আকৃষ্ট হবেই।
মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা’র প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট বাজ ঠাকরে (৪৫) বলেছেন, নয়া দিল্লিতে ধর্ষণের ঘটনার জন্য বিহারিরা দায়ী। বিহারের বাইরে যেখানে যায় এরা সেখানেই আকাজ-কুকাজ করে।
বিজেপি নেতা, ছত্তিশগড়ের স্বরাষ্ট্র, কারাগার ও সমবায় বিভাগের মন্ত্রী নানকি রাম কাঁওয়ার বলেছেন, মেয়েদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের সংখ্যা বাড়ছে গ্রহদোষে। তাদের গ্রহ এখন প্রতিকূলে।
ছত্তিশগড় রাজ্য নারী কমিশনের প্রধান বিভা রাও বলেছেন, ধর্ষণ ঘটনার জন্য মেয়েরাও সমান দায়ী। তাদের মোটেও যৌন উত্তেজক পোশাক পরা উচিত নয়।
হরিয়ানার হিসার জেলার সামাইন খাপ পঞ্চায়েতের প্রধান সুবে সিং বলেছেন, ধর্ষণের জন্য ফাঁসির বিধান করা হলে এর অপব্যবহার হবে। অনেক মিথ্যা ধর্ষণ মামলা হবে। এর বিচার ৩০২ ধারাতেই সম্ভব।
সিনিয়র সিপিআই-এম নেতা, সাবেক মন্ত্রী আনিসুর রেহমান ধর্ষণ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে পশ্চিমঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, আপনি ধর্ষণের শিকার মেয়েদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে অর্থ দিতে চেয়েছেন- তা আপনাকে কত দিতে হবে? আপনি ধর্ষিত হলে আপনার জন্য ক্ষতিপূরণ কত ধার্য হবে?
বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সাবেক আন্তর্জাতিক প্রধান অশোক সিংহল বলেছেন, পশ্চিমাদের মতো জীবনযাপনের প্রবণতা বিপজ্জক হারে বাড়ছে। এগুলো আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এসবের কারণে ধর্ষণ-নির্যাতন ঘটেছে।
ওদিকে পুদুচেরি সরকার স্কুলের মেয়েদের পোশাক পরিবর্তনের নির্দেশ দিয়েছে। যৌন অপরাধ কমাতে তার স্কুল পোশাকের ওপর ওভারকোট পরতে বলেছে। শিক্ষামন্ত্রী টি তিয়াগর্জন (৫১) বলেছেন, এ রাজ্যের স্কুলছাত্রীদের ওভারকোট পরতে হবে, আলাদা বাসে যাতায়াত করতে হবে আর স্কুলে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা যাবে না।
সিনিয়র বিজেপি নেতা, মধ্যপ্রদেশের শিল্পমন্ত্রী কৈলাশ বিজয়ভার্গিয়া (৫৭) বলেছেন, আসল কথা হলো সীমা। যদি তুমি সীমা লঙ্ঘন করো তবে রামায়নে সীতার যা হয়েছে তোমারও তা-ই হবে। লক্ষ্মণ-রেখা পার হলে রাবণ তোমাকে অপহরণ করবে- সীতাকে যেমন করেছিল।
কংগ্রেস নেতা ও প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির পুত্র অভিজিৎ মুখার্জি (৫৩) বলেছেন, ধর্ষণের প্রতিবাদে মিছিলে যারা আসছে ছাত্রী নামে- তারা আসলে সুন্দরী মহিলা। কড়া মেকআপ গেটআপ নিয়ে তারা আসছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় রূপে সেজে। এ ধরনের মহিলা ডিস্কোতে যায়, সাক্ষাৎকার দেয়- মিছিলে প্রতিবাদে তারা সিরিয়াস নয়।
অন্ধ্র প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি বৎস সত্যনারায়ণ (৫৫) বলেছেন, এত রাতে মেয়েটি কি করছিল বাইরে? মাঝরাতে স্বাধীনতা পেয়েছি বলে কি আমরা মাঝরাতে ঘোরাঘুরি করবো? ওই সময় একটি প্রাইভেট বাসে তার ওঠাই ঠিক হয়নি।
একই প্রসঙ্গে কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে ধর্ষিতা এক মেয়ে সম্পর্কে বলতে গিয়ে পশ্চিমঙ্গ মহিলা কংগ্রেসের সভানেত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ ডা. কাকলি ঘোষ দস্তিদার (৫৪) বলেছেন, এই মেয়েটি আসলে যৌনকর্মী। এটা মোটেও ধর্ষণ নয়। দু’পক্ষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে- মেয়েটি আর তার খদ্দেরের সঙ্গে।
এরপর কোন মন্তব্য নিরর্থক। ভারতে তথা উপমহাদেশে ধর্ষণ সম্পর্কে সমাজনেতা-নেত্রীদের চিন্তাচেতনা কোন পর্যায়ে আছে তা এসব উক্তি থেকেই সহজে অনুমেয়।
sazzadqadir@gmail.com

বৃহস্পতিবার, ৩ জানুয়ারী, ২০১৩

বিশ্বজিৎ দাস: প্রয়াণসম্ভাষণ

সেদিন খুব ভয় পেয়েছিলে তুমি, বিশ্বজিৎ। ৯ই ডিসেম্বর, ২০১২ দিনটি সত্যিই বড় ভয়ের ছিল। ১৮ দলীয় জোট দিয়েছিল সড়ক অবরোধ কর্মসূচি। সরকার দেখিয়েছিল রক্তচক্ষু। মন্ত্রী দিয়েছিলেন হুঙ্কার। ডেকেছিলেন দলীয় ক্যাডারদের মাঠে নেমে ব্যবস্থা নিতে। অস্ত্রশস্ত্রে সেজে তারা মাঠে ছিল সেদিন রক্তপিপাসা নিয়ে। তেমন এক ভয়ানক দিনে পথে বেরিয়েছিলে তুমি, বিশ্বজিৎ দাস। বেরিয়েছিলে জীবিকার টানে। দারিদ্র্যের পীড়নে। সামান্য দরজি দোকানি একটা কাজের দিন অলস কাটাতে পারে না বাড়িতে শুয়ে বসে ঘুমিয়ে। কাজের তাগিদ সেদিন বাড়িছাড়া করেছিল তোমাকে। এর অনেক আগেই বেঁচে থাকার দায়ে হয়েছিলে গ্রামছাড়া, এসেছিলে এই দুঃস্বপ্নের শহরে। দুঃস্বপ্ন বলছি, মাত্র ২৪ বছরের নবীন যুবক, হয়তো স্বপ্নও কিছু ছিল তোমার। ছিল তো নিশ্চয়ই, দারিদ্র্যের পেষণ-পীড়ন মুছে ফেলতে পারে নি সব কিছু, তাই সামনের এই ফেব্রুয়ারিতেই নির্ধারিত ছিল তোমার বিয়ের তারিখ। অপেক্ষা করছিল একজন নববধূ। সাজানো একটা সংসারের সাধ ছিল তারও। কিন্তু সেদিন তুমি চলেছো তোমার কাজের ঠিকানায়... শাঁখারিবাজারের কোন গলিতে। চলেছো নিতান্ত অনিচ্ছায়। হরতাল অবরোধ উত্তেজনা থেকে দূরে থাকা মানুষ তুমি। রাজনীতি তোমাকে টানে না, ক্ষমতার খেয়োখেয়ি  নয় তোমার জন্য। তবুও খদ্দেরের জরুরি প্রয়োজন মেটাতে তোমাকে বেরোতে হয়েছে আপাত নিরাপদ গৃহকোণ থেকে। কিন্তু পথে সেদিন বিরোধীদের কর্মসূচি প্রতিরোধে শুরু হয়েছিল অস্ত্রের মহড়া। ভেবেছিলে আগেভাগে পার হয়ে যেতে পারবে বিপদের ঘেরটুকু। কিন্তু না, তুমি গিয়ে পড়লে ভয় দেখানো ভয়ানকদের মাঝখানে। মিছিল শুরু হলো, বোমা ফাটলো, আর তুমি খুব ভয় পেয়ে গেলে, বিশ্বজিৎ। কি হয়-কি হয় ভয়ে তুমি ছুটলে এদিক-সেদিক, এখানে-ওখানে। তখন তোমার দিকে তাড়া করে আসে ভয়ঙ্করেরা। তোমার পিছু নেয় রক্তপিশাচেরা, ধাওয়া করে তোমাকে। প্রকাশ্যে তারা হামলা চালায় তোমার ওপর। চাপাতি দিয়ে কোপায়, রড দিয়ে পিটায়, ছুরি দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে। কিল ঘুষি চড়-থাপড় লাথি মারে অবিশ্রান্ত গতিতে। ছুটে পালাতে চাও, কিন্তু কোথায় আশ্রয়? খুনের নেশায় ক্ষিপ্ত সেই হিংস্র বর্বরেরা পিছু ছাড়ে না তোমার। টেনেহিঁচড়ে ধরে নিয়ে আসে সব আশ্রয় থেকে, ঘিরে ফেলে তোমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে খুনিচক্র। তখন রাষ্ট্র ছিল কোথায়? ছিল  কাছেই। রাষ্ট্রের সেই সময়কার প্রতিনিধি পুলিশ ও অন্যান্য প্রতিনিধি ছিল নীরব দর্শকের ভূমিকায়। যাতে পরে তারা বলতে পারে ‘আমাদের চোখে কিছু পড়ে নি’, আর চেনা-জানা দুর্বৃত্তদের ‘অজ্ঞাত’ দাবি করে আসামি বানিয়ে কাগুজে মামলা ঠুকতে পারে। ওরা ছাড়াও ছিল সাধারণ মানুষ। জনতা। ছিলেন ২০ টিভি চ্যানেলের ৪০ কর্মী, ২০ পত্রিকা-বার্তা সংস্থার ৪০ সাংবাদিক। সব মিলিয়ে শতাধিক মানুষ। সবার চোখের সামনে ১২-১৩ জন দুর্বৃত্ত পিটিয়ে কুপিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে তোমাকে। কেউ এগিয়ে আসে নি, কথাটি বলে নি। অনেকে ছিল দেখেও না দেখার ভূমিকায়, অনেকে ছিল তথ্য নিয়ে উৎসুক, অনেকে ছিল তোমার নির্মম হত্যার দৃশ্যটি নিখুঁতভাবে ক্যামেরায় ধারণের কাজে ব্যস্ত। নাকি ওরা সবাই সেদিন ছিল ঘাতক পক্ষের সমর্থক? প্রকারান্তরে সহায়ক সহযোগী? নইলে ১০-১২টি চাপাতিধারীর বিরুদ্ধে ১০০র বেশি মানুষ কিছুই করবে না?
    তারপর রক্তাপ্লুত তুমি পড়ে থাকলে রাস্তায়। ছটফট করতে থাকলে জবেহ করা পশুর মতো, কাতরাতে থাকলে মৃত্যু-যন্ত্রণায়। না, সেদিন কেউ এগিয়ে যায় নি তোমার দিকে। কিন্তু গরিব-গুরবো বলে কথা! শেষে তোমার মতো এক গরিবকে তুলে নেয় এক গুরবো রিকশাওয়ালা। ভাড়া মিলবে না জেনেও বয়ে নিয়ে যায় হাসপাতালে। কিন্তু সেখানেও সময়ের চিকিৎসা তোমার জোটে নি, বিশ্বজিৎ। হাতেপায়ে ধরেও চিকিৎসকদের মন গলাতে পারে নি রিকশাওয়ালা। ওই একজন মানুষই কেবল পাশে দাঁড়িয়েছিল তোমার, কিন্তু সে-ও ব্যর্থ হলো শেষে। ঘাতকদের হননেচ্ছাই পূরণ হলো সেদিন। আর হয়েই চললো দিনের পর দিন। সরকারের লোকজন তোমাকে বানাতে চাইলো বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থক, যেন তাহলেই হত্যা করাটা বৈধ হয়ে যায়। বলা হলো, তুমি নিশ্চয়ই বোমাবাজ। আর ঘাতকেরা? পুলিশের গলায়-গলায় চলে তারা, থাকেও। পুলিশ বলে, দেখি নি। চিনি না। মন্ত্রীরা বলে, ও দলে ঢুকে পড়া, ঘাপটি মারা, নাশকতাবাদী!
    বিশ্বজিৎ, আসলে তুমি কেউ নও এ দেশে। জনসংখ্যা শুমারিতে, রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণহানির তালিকায় একটা-একটা সংখ্যা মাত্র। তোমাকে কে মনে রাখে? বড় জোর প্রেস ক্লাবের সামনে একটা দায়সারা মানববন্ধন। তোমার জন্য শহিদ মিনারে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন নয়, সংসদ প্লাজায় শোক-প্রতিবাদ সমাবেশ নয়, সারা দেশে একদিন এক মিনিট নীরবতা পালন নয়। তোমার নামে ৯ই ডিসেম্বর বিশ্বজিৎ দিবস নয়। কিন্ত বিশ্বজিৎ, তুমি আমার আত্মীয়। ছয় দশকের বেশি কালের এই জীবনে পাঁচ দশক ধরে চলেছি কলম পিষে। এ কি এক জীবন! তোমার মতোই দারিদ্র্যের চাপাতি আমাকে কোপায় নিত্য, অসম্মান অপমান উপেক্ষার রড পিটায় ক্রমাগত, ছুরি-চাকু মেরে চলে যাবতীয় বিরুদ্ধতা। আজ তাই তোমার প্রতি আমার এই প্রয়াণসম্ভাষণ। বিশ্বজিৎ, তুমি আমার ভাই। তুমি বাংলাদেশের ভাই।

sazzadqadir@gmail.com

মঙ্গলবার, ১ জানুয়ারী, ২০১৩

ও ছিল উচ্ছল প্রাণময়

ও ছিল উচ্ছল প্রাণময়। মাত্র বিকশিত হতে শুরু করেছিল ওর জীবন। জেগেছিল স্বপ্ন হয়ে ফুটে ওঠার কুঁড়ি। পড়া লেখা আর দেখা শোনা নিয়ে আবর্তিত ছিল দিন ও রাতের সময়। বয়স মাত্র তেইশ। ছিল একজন তরুণী ছাত্রী। তার ভুল ছিল রাতের বেলায় একটি ভুল বাসে উঠে পড়া। অন্তত কয়েকজন বলেছিল সে কথাটাই। আর বড় ভুল তো একটাই- ও একটি মেয়ে। ভুল নয় অপরাধ। রীতিমতো ঘোরতর অপরাধ। তাই একের পর এক ছ’জন পালাক্রমে ধর্ষণ করে তাকে। শিকারের ওপর শিয়াল-কুকুরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে খাবলে কামড়ে ছিন্নভিন্ন করে তার অসহায় শরীরটাকে। তাতেও মেটে নি সেই নরপিশাচদের ক্ষুধা। আক্রোশ। লালসা। তারা একটি লোহার রড ঢুকিয়ে দেয় তার যৌনাঙ্গে। ক্ষতবিক্ষত করে তার গোপন প্রত্যঙ্গ। তখন পেটের ভিতর থেকে ছিঁড়েখুঁড়ে বেরিয়ে আসে তার ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদান্ত্র। সেই পুরুষ নামের পিশাচদের তৃপ্তি আসেনি বোধ হয় তখনও, তাই ওকে তারা ছুড়ে ফেলে দেয় রাস্তায়। যাতে ধুঁকে-ধুঁকে কাতরাতে-কাতরাতে ও মরে যায় কুকুর-বিড়ালের  মতো।
তারপর রাস্তার পাশে ও পড়ে থাকে একা। নগ্ন। ক্ষতবিক্ষত। উদোম। বিধ্বস্ত। ওই পথ দিয়ে যায় অনেকে, কিন্তু  কেউ একটু ফিরেও তাকায় না ওর দিকে। কনকনে শীতে কুঁকড়ে যাওয়া ওর উলঙ্গ শরীরের দিকে এক ফালি কাপড়ও ছুড়ে দেয় না কেউ। হায় হতভাগা মেয়ে! সুস্থ স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন- না, তার জন্য আর ছিল না কোনভাবে। সেই অভিশপ্ত ১৬ই ডিসেম্বর রাতের পর পাঁচ-পাঁচবার জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পৌঁছে যায় ও। তখন কোন চেতনা ছিল না ওর। বোধশক্তি ছিল না। অন্ধকার গ্রাস করেছিল ওকে। আশঙ্কায় কম্পিত ছিল শেষ নিঃশ্বাসটুকু। কেবল কান্নাটি থামেনি কখনও। অবিরল কান্নায় সিক্ত হয়েছে ও।
কিন্তু তাতে আমাদের কি? ও তো আমার বোন নয়। আমার কন্যা নয়। কিন্তু হতে পারতো। আমার, তোমার, আরও অনেকের বোন, কন্যা। সে তো কেবল দিল্লি’র একটি মেয়ে নয়, সে সকল দেশের মেয়ে- সকলের মেয়ে।
এখন একটিই চিৎকার বাকি আছে আমাদের। সকলের সোচ্চার কণ্ঠে বলতে হবে- এই নৃশংসতা বন্ধ হোক। ওই পাষণ্ডদের দাও চরমতম শাস্তি। দৃষ্টান্তমূলক দণ্ড। জঘন্য কুকর্মের হোতা দুর্বৃত্তদের বিচার করো নিষ্করণ কঠোরতার সঙ্গে।
আর কোন কথা নেই আমাদের। কাতর স্বরে, রুদ্ধ কন্ঠে বলি- দিল্লির সেই তরুণী আর নেই। শনিবার ২৮শে ডিসেম্বর নীরবে ও চিরবিদায় নিয়েছে এই বর্বর-অধ্যুষিত সমাজ-সংস্কারের বিভীষিকা থেকে।
কামনা করবো- শান্তি পাক ওর আত্মা? না, প্রার্থনা করবো ওর খুনিদের হোক সম্ভাব্য চরমতম শাস্তি। সে শাস্তিকে করে তুলতে হবে সর্বকালীন, বিশ্বজনীন। এ বীভৎসতা শুধু দিল্লি নয়, দেশ-বিদেশের সকল শহরে গ্রামে ঘটে চলেছে প্রতিকারহীনভাবে। ওই নিষ্ঠুর অন্যায়ের প্রতিকার চাই। নারীর প্রতি সব ধরনের ক্রুর সহিংসতার প্রতিকার চাই। না হলে এ পৃথিবী কি বাসযোগ্য থাকবে আর?
কি নাম মেয়েটির? আমানত, দামিনী, উদয়া- যা-ই হোক। ও কি আর নেই আমাদের মাঝে? না, ও আছে। থাকবে। ওকে আমরা দেখছি। দেখবো।