বুধবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

সাঁকোতে সাবধান

প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়েছেন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও জোটের নেতাদের অতিকথনে। তাদের নির্দেশ দিয়েছেন মিডিয়া ও দলীয় নেতাদের সামনে সংযত হয়ে বক্তব্য দিতে। বলেছেন, সরকারের নীতিনির্ধারকদের অতিকথা অনেক সময় বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে পারে সরকারকে। তাই যে কোন বিষয়ে কথা বলতে হবে সতর্কতার সঙ্গে। পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে পারে এমন উস্কানিমূলক কথাবার্তা থেকে বিরত থাকতে হবে তাই। ২৫শে ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি আরও বলেছেন, আমাদের পক্ষে আগ বাড়িয়ে কিছু করা বা বলা ঠিক হবে না। আপনাদের আগ বাড়ানো বক্তব্যকে কাজে লাগাচ্ছে প্রতিপক্ষরা। দয়া করে ওই ধরনের বক্তব্য দিয়ে সাহায্য করবেন না উস্কানিতে।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর সজাগ দৃষ্টি, রাজনৈতিক মনোভাব ও সরকারি অবস্থান স্পষ্ট। তিনি চাইছেন উদ্ভূত অবস্থার শান্তিপূর্ণ সমাধান অর্থাৎ পরিস্থিতি যেন ঘোলাটে না হয়ে ওঠে, সরকারকে যেন বিব্রত না হতে হয়। শাহবাগ চত্বরের তরুণ-যুব সমাজের মৌলবাদমুক্ত অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার জাগরণ-আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়েছে সরকার, সংসদ, মন্ত্রী, এমপি, সচিব, বেশির ভাগ বিরোধী দল ও পেশাজীবী সংগঠনসহ সবাই। আন্দোলনের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের দিকে যথোচিত উদ্যোগ-কার্যক্রমও নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ঢুকে পড়ে একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং একটি অকথ্য ব্লগ। দ্রুত পালটে যেতে থাকে পরিস্থিতি। তারপর ইস্যু হয়ে ওঠে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ বনাম নাস্তিক্যবাদ। তারপর মহানবীর অবমাননা বনাম জাতীয় পতাকা ও শহীদ মিনারের অবমাননা। দুই পক্ষ মুখোমুখি অবস্থানে এখন। এ অবস্থান মরিয়া। ঘৃণা-বিদ্বেষ-আক্রোশ-আক্রমণ এখন স্থান করে নিয়েছে মুখের ভাষায়। সমবেত হামলায়। স্থান অদল বদল করে নিচ্ছে রাজনীতি ও নাশকতা। রক্ত ঝরছে, স্বজনহারাদের আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠছে আকাশ। হিন্দুস্থান টাইমস লিখেছে, গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশে।
শান্তিভূমি পুণ্যভূমি বাংলাদেশ আবার যুদ্ধভূমি? তাহলে কোথায় সেই শুভবুদ্ধি? সোমবারের ওই বৈঠকেই প্রধানমন্ত্রী ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার নির্দেশ দিয়েছেন বন ও পরিবেশ মন্ত্রী হাছান মাহমুদকে। তিনি জানেন, এই আলোচনার পথই একমাত্র পথ। এ পথেই সমাধান ঘটতে পারে বিরোধ, বিবাদ, বিভ্রান্তির।
কিন্তু সবাই কি তা জানেন? বা সবাই কি তা চান?
বিভাজিত জাতির উন্নতি কঠিন জেনেও আমরা বিভাজিত। এ বিভাজন এখন তীব্র। সবাই জানেন বিচারক, শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিকরা যদি দলীয় হয়ে যান তাহলে দেশের মানুষের দাঁড়াবার আর জায়গা থাকে না, তারপরও আমাদের অনেকের চলন বলন কাজকর্ম তো দলীয় কর্মীদের চেয়েও উগ্র আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে। এর অবসান কোথায়?
প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের খবর ‘মন্ত্রীদের অতিকথনে ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী’ শিরোনামে ছাপা হয়েছে মানবজমিন-এ। খবরটির লিঙ্ক ফেসবুক-এ দেয়ার কিছুক্ষণ পরেই মন্তব্য আসে এক স্নেহভাজন কবি-সাংবাদিকের, ‘চ্যানেলগুলোর... বন্ধ হবে এতে? মন্ত্রীদের ক্যামেরা-প্রীতি থাকবে না... বলেন কি?’
প্রশ্নটি মিডিয়ার প্রতি। কারণ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সে। কিন্তু এ সঙ্কটকালে কি  হতাশার কারণ হয়ে উঠছে তার ভূমিকা? আসলে আমাদের দেশে কি ভূমিকা নেয় মিডিয়া? স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নিজের যে ভূমিকা বেছে নেয় মিডিয়া আসলে তার ওপরই নির্ভর করে সঙ্কটকালীন পরিস্থিতিতে তার ভূমিকা। সে কি সমাজের নেতা? নাকি সংস্কারক? পরিবর্তনের অনুঘটক? নাকি খবর ও মতামতের বাহক মাত্র? বার্তাবাহক হিসেবেও কি সে স্বাধীন নাকি অভ্যন্তরীণ বা বহিঃস্থ চাপ বা শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত?
যা-ই হোন, দয়া করে সাঁকো নাড়তে বলবেন না কাউকে। -

শনিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

আমার যত ভাষা

আমার মাতৃভাষা বাংলা। এ ভাষায় কথা বলি, লিখি। এ ভাষায় লেখা বইপত্র পড়ি। এ ভাষার সূত্রে ঘনিষ্ঠ হয়েছি আরও অন্তত চারটি ভাষার সঙ্গে। ঐতিহ্যিক সূত্রে ওই ভাষা চারটি গ্রথিত হয়েছে আমাদের ভাষায়, আমাদের জীবনে ও কর্মে। ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে ধর্মীয়, প্রশাসনিক ও ঔপনিবেশিক। এসব সূত্রে আমরা পেয়েছি সংস্কৃত, আরবি, ফারসি ও ইংরেজি ভাষাকে। সংস্কৃত ভাষা কেবল ধর্মাচরণে নয়, এ ভাষার সাহিত্য আমাদের সাহিত্যকেও পরিপুষ্ট করেছে। বাংলা ভাষার বেশির ভাগ শব্দ তৎসম অর্থাৎ সংস্কৃত থেকে সরাসরি এসে স্থান করে নিয়েছে নয় উদভূত হয়েছে। আমাদের ব্যাকরণও বহুক্ষেত্রে সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুসারী। অন্যদিকে আরবি বিশেষভাবে ইসলাম ধর্মের ঐতিহ্যে স্থান করে নিয়েছে এ দেশের বেশির ভাগ মানুষের জীবনাচরণে। সেই সঙ্গে লেখা ও পড়ায়। ফারসি-ও কিছুটা যুক্ত ধর্মীয় ঐতিহ্য ও সাহিত্যচর্চার সূত্রে। তবে তুর্কি মুগল পাঠান যুগে এ ভাষাই ছিল রাজভাষা। প্রায় ৭০০ বছর এ ভাষায় চলেছে যাবতীয় রাজকার্য, শাসন-প্রশাসন। ইংরেজ আমলেরও প্রথম প্রায় ১০০ বছর চলেছে এ ভাষার অব্যাহত ব্যবহার। তারপর এসেছে ইংরেজি। এ ভাষা আবার আমাদের প্রথম অগ্রাধিকারের আন্তর্জাতিক ভাষা। সেদিকে লেখা পড়া চর্চায় ইংরেজি হয়ে উঠেছে এ দেশের বাংলাভাষীদের দ্বিতীয় মাতৃভাষা। এখানেই শেষ নয়। আমরা যুক্ত আছি প্রতিবেশী ভাষাগুলোর সঙ্গে। সেগুলোর মধ্যে অসমিয়া, ওড়িশা’র চেয়ে উরদু হয়ে উঠেছে বেশি ঘনিষ্ঠ। এর কারণ বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে উরদুভাষীদের ব্যাপক হারে এ বাংলায় আগমন। তারপর পাকিস্তানি যুগের ২৫ বছরে উরদুর ব্যাপক প্রচলন। এছাড়া লাহোর ও মুম্বইয়ের ছবির ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তার ফলে উরদু’র পাশাপাশি হিন্দিও হয়ে ওঠে আমাদের ঘনিষ্ঠ। এখন টেলিভিশনের ব্যাপক প্রসারের কারণে হিন্দি পরিচিত হয়ে উঠেছে ঘরে ঘরে। কাজেই এই এতগুলো ভাষার সঙ্গে সেই ছোটবেলা থেকেই বড় হয়ে উঠি আমরা। আমাদের কাজে কেবল নয়, এর জোরালো প্রভাব পড়ে আমাদের কথাবার্তাতেও। আমার নিজের কথা বলি। আরবি-ফারসি সম্পর্কে মোটামুটি জানাশোনা থাকলেও, এ দু’টি ভাষার বর্ণমালা চিনলেও, প্রাথমিক ব্যাকরণ জানলেও, আমি সেভাবে পড়তে পারি না, লিখতেও পারি না। আর ইংরেজি আমার জন্য মাতৃভাষা বাংলার মতোই হয়ে উঠেছে। এ ভাষায় যদিও লেখালেখি করি না, কিন্তু করি অন্য সকল কাজ। পড়া, শোনা, দেখা, বলা, অনুবাদ, সাংবাদিকতা, সামাজিক যোগাযোগ ও অন্য অনেক কিছু। এখানেই শেষ নয়। উপমহাদেশের প্রাদেশিক ভাষাগুলো এবং উল্লিখিত ভাষাগুলো ছাড়াও প্রবাসী বাংলাদেশীদের অনেকেই বহু ভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। সুইডিশ, ফরাসি, জার্মান, স্প্যানীশ, ইতালিয়ান, জাপানি, কোরিয়ান, মেকহিকান, মালয়, নেপালি প্রভৃতি  ভাষা জানেন ও বলেন এমন অনেক বন্ধু ও আত্মীয় আমার এই ঢাকা শহরেই আছেন। আমি নিজে চীনা ভাষার সঙ্গে পরিচিত। লিখতে পড়তে না পারলেও এক সময় বলায় দক্ষতা ছিল ১৯৭৮-৮০ সালে চীন দেশে বসবাসের সুবাদে। এ জন্য এখনও ইংরেজি উচ্চারণে ‘বেজিং’ ‘বিজিং’ ‘বেইজিং’ না লিখে আমি বিশুদ্ধ চীনা উচ্চারণেই লিখি ‘পেইচিং’। কথা আছে আরও। আমাদের এই বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়াও আছে অন্যান্য জাতি। তাদের আছে নিজস্ব ভাষা। কোন-কোন ভাষার লিপি আছে। কোন-কোন ভাষার লিপি উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে। মাতৃভাষার প্রতি আমাদের যেমন মমতা, মাতৃভাষাকে নিয়ে আমাদের যেমন অহঙ্কার- ঠিক তেমন মমতা ও অহঙ্কার তাদেরও আছে। উপসংহারে বলি, বাংলাদেশের বাঙালি হলেও একমাত্র বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের জীবন নয়। প্রায় এক ডজন অন্য ভাষা নানা সূত্রে ঘনিষ্ঠ হয়ে আছে আমাদের। এ ঘনিষ্ঠতা প্রায় অবিভাজ্য।  কাজেই সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন সম্ভব নয়। সম্ভব সর্বাধিক স্তরে প্রচলন। তাই আমাদের স্লোগান হওয়া উচিত- সর্বাধিক স্তরে বাংলা চাই। তাহলে আমাদের শিক্ষা, সেই সঙ্গে অগ্রগতি হবে সুনিশ্চিত। এ কথাগুলো বলে আসছি ১৯৭২ সাল থেকে। আজ আবারও বললাম।
sazzadqadir@gmail.com

বৃহস্পতিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

তীর ছুড়তে গেলে

যে যাই বলুন কিন্তু কে কি চান - তা আমরা জানি ভালভাবেই। আওয়ামী লীগ চায় ক্ষমতায় থেকে যেতে। বিএনপি চায় হারানো ক্ষমতা ফিরে পেতে। বামপন্থিরা চায় বিপ্লব ঘটাতে। ধর্মান্ধরা চায় সাম্প্রদায়িক স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু আমরা কি চাই? আমরা এই গণমানুষ। গরিবগুর্বো জনসাধারণ।
    ক্ষমতায় গিয়ে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কি-কি করবে তা অনুমান করা কঠিন নয় কারও পক্ষে। আওয়ামী লীগ চাইবে ৫ আসনের জামায়াতকে ০ আসনে আর ৩০ আসনের বিএনপিকে ৫ আসনে নামিয়ে দিতে। আর বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে আওয়ামী লীগ যা-যা করেছে তার সবই করবে চরম মাত্রায়। ধর্মান্ধদের আশা পূরণ হবে না কখনওই, কারণ এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ ধর্মপ্রাণ - তাঁরা ধর্মান্ধতাকে প্রশ্রয় দেন নি কোনও দিন, দেবেনও না। আর বামপন্থিরা অনেক দুস্তর পথ পাড়ি দিয়ে এ পর্যন্ত এসেছেন, আমার মনে হয় - আরও দুস্তর পথ পাড়ি দিতে হবে তাঁদের। মহামতি লেনিন বলেছেন, A revolution is impossible without a revolutionary situation; furthermore, not every revolutionary situation leads to revolution. অর্থাৎ বৈপ্লবিক পরিস্থিতি ছাড়া বিপ্লব সম্ভব নয়, আবার প্রতিটি বৈপ্লবিক পরিস্থিতি-ও পৌঁছয় না বিপ্লবে। কাজেই বাংলাদেশে কখন সে সঠিক পরিস্থিতি দেখা দেবে তা-ও বলা সম্ভব নয়। ষাটের দশকের শুরুতে বামপন্থিরা বলতেন, নিরঙ্কুশ সাম্যবাদের কথা। সত্তরের দশকে বললেন, সমাজতন্ত্র চাই। আশির দশকে চাইলেন গণতন্ত্র। নব্বই দশক থেকে বলছেন নির্বাচনের কথা। এর মধ্যে অনেক বামপন্থি নিজেকে বিলীন বা বিলুপ্ত করেছেন ডানপন্থায়। এ অবস্থায় মনে হতে পারে, তাঁরা পিছু হটেছেন ক্রমশ। কিন্তু তা ঠিক নয় বলে মনে করি আমি। তীর ছুড়তে গেলে তাকে টেনে পিছন দিকে নিতে হয়। তাহলেই লক্ষ্যের দিকে যেতে পারে তা। বামপন্থিরা বিপ্লবের লক্ষ্যে পৌঁছতে নিজেদের উদ্যত করে নিয়েছেন মাত্র, যথাসময়েই লক্ষ্যভেদী তীর ছুড়বেন তাঁরা। এছাড়া, সুভাষচন্দ্র বসু’র কথায় বলি, “বিপ্লবের পথ একেবারে ঋজু পথ নয়। এ পথে নিরবচ্ছিন্নভাবে সাফল্য আসে না, এ পথ বহু বিঘ্নসঙ্কুল, সুদীর্ঘ এবং সর্পিল।” তবুও বিপ্লব ছাড়া গত্যন্তর কি আমাদের? স্বাধীনতার পর গত বিয়াল্লিশ বছরে এত জঞ্জাল জমেছে যে বৈপ্লবিক শক্তি ছাড়া আর কোনও শক্তির পক্ষে সাফ করা সম্ভব নয় তা। সেই কবে ‘পথের দাবী’ উপন্যাসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “বিপ্লব শান্তি নয়। হিংসার মধ্যে দিয়েই তাকে চিরদিন পা ফেলে আসতে হয় - এই তার বর, এই তার অভিশাপ।... মহামানবের মুক্তি সাগরে মানবের রক্তধারা তরঙ্গ তুলে ছুটে যাবে সেই তো আমার স্বপ্ন। এত কালের পর্বতপ্রমাণ পাপ তবে ধুয়ে যাবে কিসে?” আমাদের তাই বিপ্লব চাই তিমিরবিনাশী। আজ শাহবাগ চত্বরে দেখছি সেই বিনাশী বিপ্লবের পূর্বাভাস। ফাগুনের আগুনে রাঙা এক সূচনা। নূতনের কেতন উড়েছে, জয়ধ্বনি উঠেছে দিকে-দিকে। তাই লিখেছি ‘শাহবাগের মোড় / বিপ্লবের ভোর। / শাহবাগ চত্বর / বাংলার অন্তর।’ এখন থেকে আর কোনও কিছুই সহজ হবে না প্রতিষ্ঠার প্রতিভূদের পক্ষে। এবার দিচ্ছি ফেসবুক-বন্ধু শুভ কিবরিয়া’র দেয়াল থেকে গোলাম মোর্তোজা’র লেখার উদ্ধৃতি: “শুধুমাত্র  ক্ষমতায় যাওয়ার এই রাজনীতি অতি নিম্ন শ্রেণীর রাজনীতি। নিম্ন রুচির রাজনীতি। শাহবাগের আন্দোলন এই রাজনীতির বিপক্ষে। সুস্থ, মঙ্গল চিন্তার প্রত্যশিত রাজনীতির পক্ষে। নবজাগরণের দাবি রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ, যুদ্ধাপরাধীমুক্ত বাংলাদেশ। সরকার কিছুটা রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে, ভোটের রাজনীতির অংশ হিসেবে এই আন্দোলনের পক্ষে। বেশ কিছুটা পক্ষে বাধ্য হয়ে। জনমতকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা সরকারের নেই। এতদিন সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচার করছিল, আবার টালবাহানাও করছিল। নবজাগরণের চাপে টালবাহানা বাদ দিয়েছে কিনা তা এখনও দৃশ্যমান নয়। সরকারকে তা দৃশ্যমান করতে হবে। যদি ট্রাইবুনালের সংখ্যা বাড়ানো হয়, অযোগ্যদের বাদ দিয়ে অথবা রেখে যদি যোগ্য তদন্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বাড়ানো হয়, যদি বাড়ানো হয় দক্ষ, আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত আইনজীবীদের সংখ্যা - তবে দৃশ্যমান হবে বিচার নিয়ে সরকারের আন্তরিকতা। পাশাপাশি সাক্ষীদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে একটি কার্যকর গবেষণা সেল করাটা অতীব জরুরি।”
১৪.০২.২০১৩
sazzadqadir@rediffmail.com

বুধবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

ফুঁসে উঠছে বাংলাদেশ

সাযযাদ কাদির: শাহবাগ চত্বরে আবার সেই ছাত্র-জনতা। সেই উত্তাল তারুণ্য, সেই বাঁধ-ভাঙা উদ্দাম উচ্ছ্বাস, স্লোগানে-স্লোগানে সেই বিক্ষোভ-জ্বালা, সেই প্রত্যয় দৃঢ় শপথ, অঙ্গীকার। যেন এক ঝড়ের উৎস-গর্জন। যে দিকে তাকাই রোদ-ঝলসানো জ্বলজ্বলে মুখ, অতন্দ্র চেতনায় শান্ত কঠিন জাগ্রত জনজোয়ার। দাঁড়াই এ জোয়ারের মাঝখানে, রচনা করি দু’টি পঙ্‌ক্তি - ‘মনে ক্ষোভ পুষে পুষে/ বাংলাদেশ উঠছে ফুঁসে।’ মনে পড়ে কবিকিশোর সুকান্তকে। তার অমর পঙ্‌ক্তিগুলো উচ্চারণ করি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে- ‘টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া হঠাৎ বাংলাদেশ... জ্বলে পুড়ে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ মাথা নত না করার এ উত্থান আমাদের বহুপ্রত্যাশিত, প্রজন্মের এ অভ্যুদয় আশান্বিত করে - বুক ভরে দেয় বিশ্বাসে - আমরা থাকবো না, কিন্তু ওদের হাতে দেশ থাকবে নিরাপদ, পরিবর্তনের গতিধারায় এগিয়ে চলবে জাতি। তখন বাধা দিলে বাধবে লড়াই, সে লড়াই চলবে আপসহীন। দ্রোহী চেতনায়, রক্তের বন্ধনে চিনি এ ছাত্র-জনতাকে। এই জনসমুদ্রের একজন আমি, সে ও আরও অনেকে। বায়ান্ন’র সংগ্রাম-আন্দোলনের চেতনায় আমাদেরও এমন যাত্রা শুরু হয়েছিল বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনে। ছাত্র-জনতা আমরা এমন বিক্ষোভে তখন উত্তাল করে তুলেছি শহর-জনপদ। তারপর ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে, আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে- এই আমরাই ছিলাম। গত পঞ্চাশ বছরে আন্দোলন সংগ্রামে কত ত্যাগ ও তিতিক্ষা, কত রক্ত ও অশ্রু এই ছাত্র-জনতার। মনে পড়ে ১৪৪ ধারা ভেঙে বাষট্টির মিছিলের এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্য, ঊনসত্তরে কারফিউ অগ্রাহ্য করে রাজপথে আকাশ-কাঁপানো স্লোগান দিয়ে নেমে পড়া মানুষের ঢল। পথে-পথ কত কাঁটাতারের ব্যারিকেড তখন, অত্যাচারের স্টিম রোলার, বাতাসে বারুদের গন্ধ। একাত্তরে রণাঙ্গণে অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা এই ছাত্র-জনতাই। সে সময় মুক্তির সোপানতলে কত প্রাণ হলো বলিদান। প্রতিবারই গর্বিত গৌরবের বিজয় ছিনিয়ে এনেছি আমরা, কিন্তু তারপর? পথে পথে সে বিজয়ের উল্লাস-আনন্দ ছড়িয়ে পড়তে না পড়তে শুরু হয়েছে প্রাসাদ-ভবনে নানা শলা-পরামর্শ, ব্যস্ততা, তোড়জোর। বৈঠক, বক্তৃতা, বিবৃতি, আলোচনা। তারপর উড়ে এসে জুড়ে বসা রাজনীতি ছিনিয়ে নিয়েছে বিজয়কে। বিভ্রান্ত হয়েছে ছাত্র-জনতা। রাজনীতির ছদ্মাবরণে ঢুকে পড়েছে নষ্ট নেতা, ভ্রষ্ট বুদ্ধিজীবী, সং সংস্কৃতিজন। আন্দোলন-সংগ্রামের সুফল ধীরে-ধীরে চলে গেছে ফের প্রতিক্রিয়ার শক্তির কাছে। কেবল বদল হয়েছে চেহারার, রঙের, লেবাসের। কিন্তু সেই বঞ্চনা, দুর্নীতি, শোষণ, দুঃশাসন চলতেই থাকে। শক্তের অপরাধ চলে প্রতিকারহীন। এভাবে গত পঞ্চাশ বছরে বারবার প্রতারিত হয়েছে সংগ্রাম-আন্দোলনে উজ্জীবিত ছাত্র-জনতা, বারবার বিজয়ের পতাকা খামচে ধরেছে প্রতিক্রিয়ার কালো হাত। কিন্তু আর কত? শাহবাগ চত্বর এবার রুখে দাঁড়িয়েছে অপরাজনীতির বিরুদ্ধে। বেনো জলের মতো ঢুকে পড়া ছল- কৌশলকে ঠেকাতে চাইছে প্রবল প্রতিরোধে। বক্তৃতার ভাঙা রেকর্ড বাজাতে মানা করেছে তারা। বলেছে, না- কোন রাজনীতি নয়। হুঁশিয়ার করেছে নেতাদের। কাউকে বানিয়ে দিয়েছে খামোশ। কাউকে দিয়েছে তাড়িয়ে। এবার উচ্চারণ একটিই- ফাঁসি চাই ঘাতক দালালের। আপস নয়, আঁতাত নয়। আর বিজয় ছিনতাই নয়।
sazzadqadir@gmail.com