এক যে আছে হোমরা ও চোমরা। লেখাপড়া, চাকরি ও ব্যবসা - কোনওটাতে সুবিধা করতে না পেরে তারা পার্টি করে খায় এখন। নেতার নামে চালায় সমিতি-সংগঠন। খায় চাঁদা-তোলা তুলে। নাম কা ওয়াস্তে অনুষ্ঠান-কর্মসূচিও করে হুমকি দিয়ে অন্যদের ঘাড় মটকে। সেখানে খরচপাতি করে নামমাত্র, বাকি পুরোটাই গোঁজে ট্যাঁকে। ইলেকশন জনসভা সংবর্ধনা ইত্যাদি থাকলে ওই গোঁজার পরিমাণ বাড়ে অনেক। এ সব করে-করেই গাড়ি বাড়ি নারী সব হয় হোমরা ও চোমরা’র। সমাজ-সম্মানও হয়। আতি থেকে পাঁতি, তারপর নেতাই হয়ে ওঠে।
তাদের এ পর্যন্ত সব ওঠাই কিন্তু পাবলিকের টাকা মেরে। কাজেই ওই মারার অভ্যাস আর যায় না কিছুতে। বাকি জীবন কাটে পরেরটা খেয়ে ও মেরে। নেতা হয়ে সময়-সুযোগ পেয়ে ওই মেরে-মেরেই নমিনেশন কেনে তারা, ইলেকশন করে, জেতে, এমপি-মন্ত্রী হয়। এজন্য ট্যাঁক থেকে খসাতে হয় না কিছু, বরং এ সবই হয়ে ওঠে বড়-বড় দানে ট্যাঁকে গোঁজার উপায়। সরকারে পদ পাওয়ার পর আয়-উপার্জন আরও বাড়ে হোমরা ও চোমরা’র। সেখানে খরচ নেই, সব কিছু সরকারের। সরকারের মাল মানে তো দরিয়া মে ডাল! কিন্তু সরকার বা রাষ্ট্রের অর্থ তো জনগণের অর্থ। সরকারের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী জনগণের অর্থে শিক্ষালাভ করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন জনগণের অর্থে। ওই অর্থ নির্বিশেষে সকল দেশবাসীর, কোনও বিশেষ দলের নয়। এই অর্থে কোনও দলাদলি না করারই কথা, কিন্তু কাজের চেয়ে দলাদলিই বেশি করেন তাঁদের অনেকে। এই তাঁদেরই কাজে লাগিয়ে, ব্যবহার করে আঙুল ফুলে কলাগাছ থেকে বটগাছ হয় হোমরা ও চোমরা। কোনও খরচ নেই, কেবলই আয় আর আয়। বিত্ত আর সম্পদ। ধন আর ঐশ্বর্য।
কাজ কি হোমরা ও চোমরা’র? আমলা খাটিয়ে খাওয়া। আলিশান বাড়িতে থাকা। লেটেস্ট মডেলের ঝাঁ চকচকে গাড়ি হাঁকানো। সপরিবারে দলে-বলে বিদেশে-বিদেশে ঘোরা। ফাইভ স্টার। শপিং। হাই-ফাই। ছেলেপুলে পড়ানো ইউরোপ-আমেরিকার নামী-দামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। দেশে বাড়ছে জনসংখ্যা, পণ্যমূল্য, গ্যাস পানি বিদ্যুৎ বিভ্রাট, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, কোন্দল-হানাহানি, মাদকাসক্তি, রোগ-ব্যাধি, দারিদ্র্য, শ্রমিক অসন্তোষ, শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা, দুর্নীতি, কুশাসন, জাল-ভেজাল, চোরাকারবার, অনিয়ম, অব্যবস্থা, অনুন্নয়ন। তাতে হোমরা-চোমরার কি? তারা বিবৃতি বক্তৃতা ভাষণ দিয়ে যাচ্ছে গলা ফাটিয়ে। সাজগোজ করে যাচ্ছে সভা, সেমিনার, টিভি-বেতারে। দেশ জাতি জনগণের জন্য জানপাত করে যাচ্ছে দিন-রাত।
আসলে কি তাই? জনগণের কাছ থেকে নেয়া ছাড়া জনগণকে কখনও কিছু দেয় কি হোমরা-চোমরা? নিজেরা কি কিছু করতে পারে তারা? নিজেদের প্রচারের জন্য সরকারের বা অন্যের পত্রিকা বা বেতার-টিভি তাদের ভরসা, নিজেদের কিছু নেই ও সব। থাকলেও পাতে নেয়া যায় না সেগুলো।
হোমরা-চোমরাকে বলি, পরোপকারের নামে আর কত নিজের উপকার করবে? সত্যি-সত্যি কিছু করো পরের জন্য। নাহয় একটা ছোটখাটো রাস্তাই করো। সেতু না পারো অন্তত একটা কালভার্ট করো। লোকজনের জন্য খাবার পানির ব্যবস্থা করো বিভিন্ন ভিড়ের স্থানে। শহরে-শহরে পাবলিক টয়লেট করে দিয়ে নারী শিশু বৃদ্ধদের কষ্ট দূর করো। নোংরা জঞ্জাল আবর্জনা সরাবার ও রিসাইক্লিং করার ব্যবস্থা করলে উপকার হয়, আয়ও হয়। মানে কিছু একটা করো। সামান্য হলেও করো। দেখিয়ে দাও নিজের অর্থে নিজেরা কিছু করতে পারো।
হোমরা-চোমরা বলে, ঠিক বলেছো ভাই। এটা আমাদের মনের কথা। এটা আমরাও চাই। কিন্তু কিভাবে হাত উপুড় করতে হয় তা আগে শিখিয়ে দাও আমাদের।
বলেই কেমন আমতা-আমতা করে হোমরা-চোমরা, মনে হয় শিখলেও হবে না। আমাদের হাতেই তো উপুড় করার সিসটেম নাই! অপারেশন ছাড়া হাত উপুড় হবে না!
॥ ২ ॥
সবাই জানেন, সম্পদ অর্জনের শ্রেষ্ঠ উপায় বাণিজ্য। সেকালের পণ্ডিতেরাও বলেছেন, ধন ও ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মী বাস করেন বাণিজ্যেই। তবে একালে বাণিজ্যের জন্য বণিক হওয়ার প্রয়োজন নেই। এখন যে ধরনের বাণিজ্যের রমরমা চলছে - ভর্তি বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, গ্রেপ্তার বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য, লাইসেন্স-পারমিট বাণিজ্য, শেয়ার বাণিজ্য ইত্যাদি - এ সবে যাঁরা জড়িত তাঁরা পরিচিত অন্য নামে। এখানে আসল ব্যাপার, সোজাই বলি, ঘুস দেয়া-নেয়া। ঘুস খাওয়া। এ খাওয়াটা খারাপ নয়। যদ্দূর জানি, ঘুসে কোনও ভেজাল নেই। একেবারেই খাঁটি ও বিশুদ্ধ বস্তু এই ঘুস। এতে কাঁকর, ইঁটের গুঁড়া, কারবাইড, ফরমালিন, প্রিজারভেটিভ, কেমিক্যাল, রঙ, ওয়াসা’র পানি ইত্যাদি কিছু নেই। এখানে গরুর নামে মোষের গোশত, খাসি’র নামে ছাগল-ভেড়ার গোশত, মুরগির ডিমের নামে কাছিমের ডিম খাওয়ানো চলে না। ওগুলো আছে আমাদের জন্য।
এই আমরা, যারা চলি বাঁধা আয়ে, মাসের শেষ সপ্তাহে যাদের চলতে হয় প্রায় পুরোপুরি কৃচ্ছ্রসাধন করে। এমনিতেও অভ্যস্ত আমরা ব্রেঞ্চ-এ।
ব্রেঞ্চ মানে ব্রেকফাস্ট না করে একটু আগে-আগে লাঞ্চ করা। তা সে ব্রেঞ্চেই বা কি খাই? কোনও জিনিস কি খেতে পারি নিশ্চিত মনে? কিন্তু খাই, বেঁচে থাকার আশায় বাধ্য হয়ে খাই। তারপর শুরু হয় বেঁচে থাকার যাবতীয় যন্ত্রণা। ভেজাল খেয়ে এ অসুখ ও অসুখ বাঁধিয়ে ভুগি। দামি ওষুধ কেনার ভয়ে প্রথম দিকে চলি সহ্য করে। তারপর মর-মর অবস্থা হলে ডাক্তার ও ওষুধের পিছনে যৎসামান্য যা কিছু সঞ্চয় সব ফুরিয়ে আর পথ্য জোটাতে পারি না। ফলে অসুখ আর ছাড়েও না। কিছু দিন দমে থাকে, তারপর সময় সুযোগে এমন চেপে ধরে যে দম উঠে যায় নাকে। তখন চিকিৎসা কি হবে? কিভাবে হবে? পরে দেখা যায়, এমন অসুখ বেঁধে গেছে যে লাখ-লাখ টাকা দরকার। কোত্থেকে আসবে এত টাকা? আমরা যারা ৯৯%, আমাদের সকলের অবস্থা তো একই রকম। আমাদের আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব সকলেরই তো একই দশা। তারপর সাহায্যের জন্য প্রার্থনা। সে এক মহাবিড়ম্বনা। আত্মসম্মান বিসর্জন দেয়ার চেয়েও দুঃসহ হয়ে পড়ে তা কখনও। সাহায্য পাওয়ার চেয়েও কঠিন হয়ে পড়ে সাহায্য প্রার্থনার প্রকাশ-প্রচার। ফেসবুক-এর বেশির ভাগ বন্ধুই শেয়ার পর্যন্ত করতে চায় না মানবিক সাহায্যের আবেদন। তারপর কোনওক্রমে মিডিয়ায় কিছুটা প্রকাশ-প্রচার করা গেলেও সাহায্য সহজে জোটে না, সকলের জোটে না। যদি জুটে যাওয়ার মতো অভাবনীয় কিছু ঘটে যায়, তাহলে মরতে-মরতে বাঁচা যায় হয়তো, আর যাদের জোটে না? হাসপাতালের সিঁড়িতে বা বারান্দায়, অথবা আর্থিক অক্ষমতার এক ভয়ঙ্কর বিপন্নতায় নিমজ্জিত স্বজনের চোখের সামনে ধুঁকে-ধুঁকে মরা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে কি তাদের?
এখন বলুন, এমন পরিণতি কি চান কেউ? সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে সম্পূর্ণ বৈধ জীবন যাপনের এমন প্রতিফল? তাহলে আপৎকালের সম্বল যোগাড় করে রাখার উপায় কি বাণিজ্য ছাড়া? বলবেন, কোন বাণিজ্য? খাঁটি, বিশুদ্ধ ও নির্ভেজাল বাণিজ্য তো ওই একটাই। ঘুস বাণিজ্য। এর বিকল্প আছে কি? আশির দশকের প্রথম দিকে, তখন আমি দৈনিক সংবাদ-এর সহকারী সম্পাদক, এক সম্পাদকীয় বৈঠকে কথায়-কথায় ‘সংবাদ’-সম্পাদক আহমদুল কবির বলেছিলেন সমঝোতার মাধ্যমে এক সমাধানের কাহিনী। ওই সময় তিনি ছিলেন জাতীয় সংসদ সদস্য। তাঁর এলাকার থানার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ‘বেতনের টাকায় সংসার চলে না, কাজেই উপরি চাই... তা মাসে তোমাদের কত হলে আর উপরি লাগবে না, ডিউটি ঠিকমতো করবে, চুরি-ডাকাতি ঠেকাবে?’ হিসাব করে একটা অঙ্ক জানাবার পর এলাকাবাসী নিজেদের উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাসে-মাসে তা জমা দিয়েছে যথাস্থানে। এতে ফল দিয়েছে, এলাকাবাসী থেকেছে নিরুপদ্রব শান্তিতে।
ভেবে দেখুন, এমন আরও কোনও বিকল্প আছে কিনা!
॥ ৩ ॥
‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে / তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে’ - রবীন্দ্রনাথের ‘নৈবেদ্য’ (১৯০১) কাব্যগ্রন্থের ৭০ সংখ্যক কবিতার এই দু’টি পঙ্ক্তি সম্ভবত সর্বাধিক উল্লিখিত বাংলা কবিতাংশগুলোর একটি। এ কথারই প্রতিধ্বনি মেলে আরেকটি উদ্ধৃতিতে - ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ন্যায়সংগত’। গত শতকের ষাটের দশকে একটি রাজনৈতিক সংগঠনের স্লোগান ছিল এ উদ্ধৃতিটি। তখন পোসটারে, ব্যানারে, দেয়াল লিখনে দেখা যেতো এ বিদ্রোহের আহবান। শুনেছিলাম উদ্ধৃতিটি চীনের কমিউনিস্ট নেতা মাও চ্যতোং (১৮৯৩-১৯৭৬)-এর। আরেকটি বিখ্যাত উদ্ধৃতি মারকিন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন (১৭৪৩-১৮২৬)-এর -
“If a law is unjust, a man is not
only right to disobey it, he is obligated to do so.”
গত ৯ই এপ্রিল রাতে পিলখানায় ৭০ লাখ টাকা নিয়ে যে ঘনঘোর নাটকের অবতারণা হয় তাতে এ সব উদ্ধৃতি মনে পড়ছিল বারবার। উদ্ভূত নাটকীয় ঘটনাই প্রমাণ করে ওই টাকার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক অন্যায়। সে প্রমাণ পেয়েই অনুসন্ধানে নামে মিডিয়া। আর খুব দ্রুত বেরিয়ে পড়ে থলের কালো বিড়াল। দেখা যায় ‘রেলগাড়ি ঝমাঝম... পা পিছলে আলুর দম’ গোছের এক কাহিনী। রেলের ট্রেড অ্যাপ্রেনটিস পদে ১৬ কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্যের এক অংশ ওই ৭০ লাখ টাকা। সে অন্যায়ে বহু পক্ষ জড়িত। নিয়োগদাতা, নিয়োগপ্রার্থী, তদবিরকারী, নিয়োগপ্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও আছেন তাঁরা - যাঁদের না দিয়েথুয়ে বড় দাঁও মেরে ভূরিভোজ করা যায় না।
রেল নতুন মন্ত্রণালয়। তাই বলে দুর্নীতির ব্যাপারস্যাপার নতুন নয় এখানে। এ মন্ত্রণালয় আগে ছিল যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অংশ। তখন দুর্নীতি সংক্রান্ত ঘাপলা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পর্যন্ত জানাজানি হওয়ায় পদ্মা সেতুর নির্মাণ হয়ে যায় অনিশ্চিত। এর আগে সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপার নিয়ে ঘটে নানা তুলকালাম। এক দুর্ঘটনায় দু’জন খ্যাতিমান ব্যক্তির প্রাণহানির সূত্রে মিডিয়ায় আসে তাদের সে সব কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি। তবে এসব কি কেবল রেলে বা যোগাযোগে চলছে? অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে এদিক-সেদিক কিছু নেই?
উপন্যাসের পাঠকরা বা টিভি-নাটকের দর্শকরা জানেন, এখন সবচেয়ে ভাল ফরমুলা হচ্ছে - অস্বাভাবিক লোকজনদের নিয়ে উপন্যাস-নাটক লেখা। নায়ক-নায়িকা, মা-বাবা থেকে কাজের লোক বা বুয়া সবাই কথাবার্তা বলবে অদ্ভুত-অদ্ভুত, কাজকর্ম করবে আরও অদ্ভুত-অদ্ভুত অর্থাৎ উপন্যাস বা নাটকের সকল চরিত্রকে চলনে বলনে হতে হবে পাগলা বা পাগলাটে। তাহলেই উপন্যাস হট কেক, টিভি নাটক সুপার হিট। এ রকম হট বা হিট করার ফরমুলা আগেও ছিল। শরৎচন্দ্রের উপন্যাস যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন ‘পল্লীসমাজ’ (১৯১৬)-এ সবাই খারাপ, কেবল ‘রমা’ ও ‘রমেশ’ ভাল। কথাটির অর্থ, উপন্যাসে শরৎচন্দ্র সমাজের শতেক দোষ-ত্রুটি দেখালেও নায়ক ও নায়িকাকে রাখতেন প্রায় দেবোপম নিষ্কলঙ্ক। বাস্তবে এমন তো হতে পারে না। কোনও সমাজে মাত্র দু’জন ভাল লোক থাকতে পারে না, যদি ৯৮ জন মানুষ খারাপ হয়। সে রকম কেবল রেল-যোগাযোগ খারাপ আর বাকি সকল মন্ত্রণালয় ভাল - এমন হতে পারে কি? কিন্তু সবার উপরে রাজনীতি। তাই বলছি, সকল শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে পিলখানায় পাওয়া ৭০ লাখ হতে পারে সাদা বিড়াল। সে ম্যাঁও শোনা গেছে এরই মধ্যে। আমার প্রিয় কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই কবে লিখেছেন - “রূপসী তুই রাজনীতি, দিস্ ছেলে-ছোকরাদের মাথা ঘুরিয়ে; কিন্তু বুড়ো শয়তানদের সঙ্গে থাকিস্ রাত্রে শুয়ে।” তাহলে এই নোংরা রাজনীতি ঠেকাবার উপায় কি? একটাই উপায়। ৯৯ ভাগের বাঁচার রাজনীতি।
॥ ৪ ॥
ম্যাটরিকুলেশন, সংক্ষেপে ‘ম্যাটরিক’, পরীক্ষা চালু করেছিল বৃটিশ রাজ, এর সমাপ্তি ঘটে ১৯৬২ সালে। আমার মনে আছে, কারণ এ পরীক্ষা আমি দিয়েছিলাম ওই বছর। এর পর, ১৯৬৩ সাল থেকে, চালু হয় সেকেন্ডারি স্কুল সারটিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষা। কেটে গেছে প্রায় ৫০ বছর, কিন্তু এখনও সবার মুখে-মুখে চালু আছে ম্যাটরিক পরীক্ষা, এসএসসি কথাটা আর মুখে আসে না কারও। এ রকম অনেক কিছুই বদলে গেছে, কিন্তু আগেরটাই আঁকড়ে ধরে আছি আমরা। নতুনের প্রতি নেতি আর পুরনোর প্রতি প্রীতি কি আমাদের জাতীয় রক্ষণশীলতারই এক বৈশিষ্ট্য? মারকিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩২তম প্রেসিডেন্ট (১৯৩৩-১৯৪৫) ফ্রাঙ্কলিন ডিলানো রুজভেল্ট (১৮৮২-১৯৪৫) বলেছেন, রক্ষণশীলদের পা দু’টো থাকে চমৎকার ? তবে তারা সামনের দিকে চলা শেখে না কখনও। সম্ভবত এ জন্যই ভাষা-ভাষা বলে প্রাণ দিলেও বানান শিখি না, শেখার চেষ্টাও করি না। প্রমিত বানান তো নয়ই। ও সব জানতেও চাই না। ‘ঘুষ’ বানানটি যে ‘ঘুস’ হওয়া উচিত তা বলা হয়েছে অনেক আগে। হিন্দি ‘ঘুস’ থেকে আসা এ অ-তৎসম বিদেশী শব্দের বানান বাংলায় ‘ঘুস’ হওয়ারই কথা। বাংলা একাডেমীর ‘বাংলা বানান-অভিধান’ (পুনর্মুদ্রণ, ১৯৯৫) এ বানানটিই নির্দেশ করেছে, কোনও বিকল্প দেয় নি। তবে ঘুষের সঙ্গে ঘুষাঘুষির একটা ব্যাপার আছে বলেই হয়তো হিন্দি ‘ঘুস’ বাংলায় হয়ে গেছে ‘ঘুষ’। তবে ওই অভিধানে ‘ঘুষি’ ও ‘ঘুষাঘুষি’ও বিকল্পহীন ‘ঘুসি’ ও ‘ঘুসাঘুসি’। তবে বানান যা-ই হোক ঘুসের অনেক কদর সমাজে। ভাষাতেও। তাই কত নামে ঘুসকে ডাকি আমরা ? উৎকোচ, উপরি, বখশিশ, সেলামি, টু-পাইস, হাতটান, লেনদেন, বাঁ হাতের কামাই, খুশি করা, প্রণোদনা, নজরানা, রিসওয়াত, গোপন পারিতোষিক, গেটিস...! ইংরেজদের কাছেও এর কদর অনেক। ওদের ভাষাতেও অনেক নাম ?
Ò tip, gift, sop,
perk, skim, favor, discount, waived fee/ticket, free food, free ad, free trip,
free tickets, sweetheart deal, kickback/payback, funding, inflated sale of an
object or property, lucrative contract, donation, campaign contribution,
fundraiser, sponsorship/backing, higher paying job, stock options, secret
commission, or promotion (rise of position/rank)...! Ó আরও অনেক রকম ঘুস আছে। মারকিন নাট্যকার থর্নটন ওয়াইল্ডার (১৮৯৭-১৯৭৫) বলেছেন, বিয়েটাও ঘুষ। এ ঘুষ পেলে বাঁদী নিজেকে বেগম ভাবে।
তবে ঘুস নিয়ে সামপ্রতিক এক ঘুসাঘুসি জাতীয় ঘটনার খবর জেনেই এত সব কথা বললাম। রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুক তালুকদারের গাড়ি থেকে ৭০ লাখ টাকা উদ্ধার হয়েছে গাড়িচালক আলী আজমের আকস্মিক তৎপরতায়। গাড়িতে আরও ছিলেন পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা ও রেলওয়ে পুলিশের কমান্ডেন্ট এনামুল হক। ১৬ কোটি টাকার ঘুস-বাণিজ্যের একটা ভাগ ওই টাকা। ধরা পড়ার পর ঘুসের টাকা ভাগ-বাটোয়ারার নানা কাহিনী ফাঁস হয়ে পড়ছে মিডিয়ায়। এ দেশে এ সব ওপেন সিকরেট। তারপরও এমন ঘটনা যে কেন ঘটে! আসলে ঘুস জিনিসটা দিয়ে-থুয়ে খাওয়াই ভাল। তা করলে গাড়িচালক আজমকে হজম করা কঠিন হতো না কিছু। রাজনীতি অত্যন্ত ব্যয়বহুল এখন। নেতা হতে, মন্ত্রী-এমপি হতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় মানে কাঠখরচ করতে হয়। দলের সদস্য হওয়া, তারপর পদ পাওয়া, নির্বাচনে মনোনয়ন জোটানো, জিতে এমপি হওয়া, মন্ত্রীত্ব বাগানো ? এগুলো সহজ কম্ম নয়। কোটি-কোটি-কোটি কাঠখরচ। সে খরচ আসে কোত্থেকে? আসবে কোত্থেকে? রাজনীতিতে হোমরা-চোমরাদের টাকা তো এভাবেই আসে। আর কোনও ভাবে আসে নাকি?
॥ ৫ ॥
দেশের অর্থ-সম্পদ বিদেশে পাচারের কথা প্রায়ই শুনি। মানি লন্ডারিং-এর অভিযোগ অনেকের বিরুদ্ধে। রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, আমলা, চোরাকারবারিদের অনেকে বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ছে - এমন কথা এখন নিয়মিত আইটেম হয়ে পড়েছে বক্তৃতা-বিবৃতির। উচ্চারিত হচ্ছে কত জনের নাম। ১০ বছর আগে প্রণীত হয়েছে প্রিভেনশন অভ মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট, ২০০২ (অ্যাক্ট নং ৭ অভ ২০১২)। এ অ্যাক্টের অধীনে বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক এ পর্যন্ত জারি করেছে ২৬টি সারকুলার। এর মাধ্যমে ব্যাঙ্কিং সেক্টরে নিশ্চয়ই চলছে কড়াকড়ি প্রতিরোধমূলক তৎপরতা, কিন্তু হুন্ডি বন্ধ হয় নি বলেই শোনা যায়। সেই ১৯৯৬ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আই এম এফ) অনুমান করেছিল, বিশ্ব অর্থনীতির ২ থেকে ৫ ভাগ অর্থ লন্ডার করা। তবে আন্তঃসরকার সংগঠন ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স অন মানি লন্ডারিং (এফ এ টি এফ) বলেছে, এই অর্থের হিসাব করা সম্ভব নয়। এজন্য এ সংক্রান্ত কোন অনুমান বা ধারণা তাঁরা প্রকাশ করেন নি আর।
অর্থ-সম্পদের অবৈধ পাচার বা চালান ঠেকানোর পাশাপাশি চলছে সে সব উদ্ধারের নানা তৎপরতা। বিদেশে যাঁরা আলিশান বাড়ি বানিয়ে বা কিনে, রমরমা ব্যবসা বাগিয়ে লেটেস্ট মডেলের আউডি বা মাসেরাতি হাঁকিয়ে বেড়ান তাঁদের সুলুক-সন্ধান নিয়ে পাচার করা সম্পদ উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে আনার ঘটনা ঘটছে বিভিন্ন দেশে। কারণ দুর্নীতিবিরোধী সংগ্রামে আন্তর্জাতিক পূর্বিতা যে লুণ্ঠিত সম্পদ উদ্ধার তা সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ করা হয়েছে দুর্নীতিবিরোধী জাতিসংঘ সম্মেলন (২০০৩)-এর পঞ্চম অধ্যায়ে। ওই সম্মেলনেই গঠিত হয় ইউনাইটেড নেশনস্ কনভেনশন এগেনস্ট করাপশন (ইউ এন সি এ সি)। এটি কার্যকর হয় ২০০৫ সালের ১৪ই ডিসেম্বর থেকে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সহ ১৪০টি দেশ স্বাক্ষর করেছে এতে। সম্পদ উদ্ধারে নিয়োজিত আছে অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনের মধ্যে রয়েছে - ইউনাইটেড নেশনস্ অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম (ইউ এন ও ডি সি), স্টোলেন অ্যাসেট রিকভারি ইনিশিয়েটিভ (বিশ্ব ব্যাঙ্ক) (এসটি এ আর), ইনটারন্যাশনাল সেনটার ফর অ্যাসেট রিকভারি (আই সি এ আর), দি ইনটারন্যাশনাল এসোসিয়েশন ফর অ্যাসেট রিকভারি (আই এ এ আর), অরগানাইজেশন ফর ইকনমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ও ই সি ডি), ট্রান্সপারেন্সি ইনটারন্যাশনাল (টি আই), ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফ এ টি এফ), ইউ৪ অ্যানটি-করাপশন রিসোর্স সেনটার (ইই৪) প্রভৃতি। এছাড়া আঞ্চলিক পর্যায়ে আইন, বিচার ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগের রয়েছে চোরাই সম্পদ উদ্ধারের উদ্যোগ।
উল্লিখিত সংস্থা-সংগঠনের উদ্যোগের ফলেই নাইজেরিয়ার সামরিক একনায়ক জেনারেল সানি আবাচা (১৯৯৩-৯৮)-র লুণ্ঠিত ৬০ কোটি ডলার বাজেয়াপ্ত করে সুইজারল্যান্ড। পরে সে অর্থ উন্নয়ন-কাজে ব্যয় হয় বিশ্ব ব্যাঙ্কের তদারকে। এছাড়া সুইজারল্যান্ড বাজেয়াপ্ত করেছে জায়ারে’র সাবেক প্রেসিডেন্ট মোবুতো সেসে সেকো (১৯৬৫-১৯৯৭) ও কেনিয়া’র সাবেক প্রেসিডেন্ট দানিয়েল আরাপ মোই-এর বিপুল অর্থ। ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফারদিনান্দ মারকোস (১৯৬৫-৮৬)-এর বহু সম্পদ ফিরে পেয়েছে দেশ। পেরু’র সাবেক প্রেসিডেন্ট আলবেরতো ফুজিমোরি (১৯৯০-২০০০)-র ডান হাত ভ্লাদিমিরো লেনিন মনতেসিনোস তোরেস-এর পাচারকৃত অর্থ থেকে ১৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার উদ্ধার করেছে আইসিআর। হেইতি’র সাবেক প্রেসিডেন্ট জাঁ-ক্লদ ‘বেবি ডক’ দুভালিয়ার (১৯৭১-১৯৮৬), ইউক্রেন-এর সাবেক প্রধানমন্ত্রী পাভলো লাজারেঙ্কো (১৯৯৬-৯৭), নাইজেরিয়া’র প্ল্যাটো স্টেট-এর সাবেক গভর্নর জোশুয়া দারিয়ে (১৯৯৯-২০০৭) ও বায়েলসা স্টেট-এর সাবেক গভর্নর দিয়েপ্রিয়ে আলামিয়েসেইগা (১৯৯৯-২০০৫), ইন্দোনেশিয়ার ব্যাঙ্কার হেনদ্রা রাহারদজা, চীনের মাকাউ-এর পরিবহন ও পূর্ত বিভাগের প্রথম সচিব আও মান লোং (১৯৯৯-২০০৬) প্রমুখ কর্তৃক অপহৃত সম্পদ উদ্ধার করা হয়েছে অনেকখানি। বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডও হয়েছে ক’জনের।
অপহরণ ও উদ্ধার সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য এখানে তুলে ধরার উদ্দেশ্য একটাই - যাঁরা আমাদের দেশের অর্থ-সম্পদ বিদেশে পাচার করেছেন, করছেন এবং করবেন বলে ভাবছেন - সেই লুটেরাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। দুর্নীতি করে যে পার পাওয়া যায় না সবসময় সে প্রমাণ আছে অনেক। পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতি থেকে সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক কেলেঙ্কারি আজ আর অজানা নয় কারও। ট্রান্সপারেন্সি ইনটারন্যাশনালের র্যাংকিং-এ তো দশক ধরেই আছি শীর্ষে আমরা। কাজেই সরকারে-প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রকৃত স্বাধীন, জনগণের তথ্য পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত দুর্নীতির কালো বিড়াল দিনে-দিনে বাঘ-সিংহের আকারই ধারণ করবে। অসট্রিয়া’র চিন্তাবিদ কার্ল ক্রাউস (১৮৭৪-১৯৩৬) লিখেছেন,
“Corruption
is worse than prostitution. The latter might endanger the morals of an
individual, the former invariably endangers the morals of the entire country.” এ অবস্থায় জেঁকে বসা স্বৈরতন্ত্র ও চৌর্যতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া আর কি বিকল্প আছে দেশবাসীর সামনে?
sazzadqadir@gmail.com