শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৩

শতবর্ষ আগে-পরে রবীন্দ্রনাথ-ইউনূস

আজ থেকে ১০০ বছর আগে ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান রবীন্দ্রনাথ। এ খবর শান্তিনিকেতনে পৌঁছায় ওই বছরের ১৩ই নভেম্বর বৃহস্পতিবার বিকালে। ২৩শে নভেম্বর রোববার কলকাতা থেকে ট্রেনে বোলপুর স্টেশনে গিয়ে পৌঁছেন প্রায় ৪০০ কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী। তারা ‘বন্দেমাতরম্‌’, ‘রবীন্দ্রনাথের জয়’ প্রভৃতি  স্লোগান দিতে-দিতে এগিয়ে যান শান্তিনিকেতনের দিকে। আশ্রমের কাছে পৌঁছলে তাদের অভ্যর্থনা জানান কবি-পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন, অধ্যাপক অজিতকুমার চক্রবর্তী, কবি-বন্ধু সি এফ অ্যান্ড্রুজ প্রমুখ। অভ্যাগতদের তারা নিয়ে যান আমতলায় সভাস্থলে। সেখানে আশুতোষ চৌধুরীর প্রস্তাবে বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসু গ্রহণ করেন সভাপতির আসন। এরপর গাওয়া হয় ব্রহ্মসংগীত, অনুষ্ঠিত হয় উপাসনা। জগদীশচন্দ্র সংক্ষেপে দু’-চার কথা বলে রবীন্দ্রনাথকে উপহার দেন একটি লজ্জাবতীলতা। এরপর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা প্রশস্তি পাঠ করেন হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, অভিনন্দন জানান বাঙালি মুসলমানদের পক্ষে এ কে ফজলুল হক, একজন সম্ভ্রান্ত জৈন, একজন ইংরেজ পাদরি এবং ইংরেজ রাজকর্মচারী অথবা ব্যবসায়ী। এরপর সংবর্ধনার জবাব দিতে আসন থেকে উঠে দাঁড়ান রবীন্দ্রনাথ। প্রথমেই তিনি বলেন, ‘আজ আমাকে সমস্ত দেশের নামে আপনারা যে সম্মান দিতে এখানে উপস্থিত হয়েছেন তা অসঙ্কোচে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করি এমন সাধ্য আমার নেই।...’ এর কারণ হিসেবে বলেন, ‘দেশের লোকের হাত থেকে যে অপযশ ও অপমান আমার ভাগ্যে পৌঁছেছে তার পরিমাণ নিতান্ত অল্প হয় নি, এবং এতকাল আমি তা নিঃশব্দে বহন করে এসেছি। এখন কি জন্য যে বিদেশ হতে আমি সম্মান লাভ করলুম তা এখন পর্যন্ত আমি নিজেই ভাল করে উপলব্ধি করতে পারি নি।... আমি সমুদ্রের পূর্বতীরে এসে যাঁকে পূজার অঞ্জলি দিয়েছিলেম, তিনি সমুদ্রের পশ্চিম তীরে সেই অর্ঘ্য গ্রহণ করবার জন্য যে তাঁর দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করেছিলেন সে কথা আমি জানতুম না। তাঁর সেই প্রসাদ আমি লাভ করেছি - এই আমার সত্য লাভ।... যা-ই হোক, যে কারণেই হোক, আজ ইউরোপ আমাকে সম্মানের বরমাল্য দান করেছেন। তার যদি কোন মূল্য থাকে তবে সে কেবল সেখানকার গুণীজনের রসবোধের মধ্যেই আছে। আমাদের দেশের সঙ্গে তার কোন আন্তরিক সম্বন্ধ নেই।’ কবি স্পষ্ট করেই বলেন, এ সম্মান দিয়েছেন বিদেশীরা, এ দেয়ার কৃতিত্ব তাঁদেরই - দেশের মানুষের নয়। কারণ দেশের মানুষ তাকে অপমান-লাঞ্ছনাই করেছে পদে-পদে। তাই ওই সংবর্ধনা প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন, ‘অতএব আজ যখন সমস্ত দেশের জনসাধারণের প্রতিনিধি রূপে আপনারা আমাকে সম্মান উপহার দিতে প্রবৃত্ত হয়েছেন, তখন সে সম্মান কেমন করে আমি নির্লজ্জভাবে গ্রহণ করবো?... তাই আমি আপনাদের কাছে করজোড়ে জানাচ্ছি - যা সত্য তা কঠিন হলেও আমি মাথায় করে নেবো, কিন্তু সাময়িক উত্তেজনার সময়ে যা, তা স্বীকার করে নিতে আমি অক্ষম। কোন-কোন দেশে বন্ধু ও অতিথিদের সুরা দিয়ে-দিয়ে অভ্যর্থনা করা হয়। আজ আপনারা আদর করে সম্মানের যে সুরাপাত্র আমার সম্মুখে ধরেছেন, তা আমি ওষ্ঠের কাছে পর্যন্ত ঠেকাবো, কিন্তু এ মদিরা আমি অন্তরে গ্রহণ করতে পারবো না। এর মত্ততা থেকে আমি চিত্তকে দূরে রাখতে চাই।’ এ ঘটনাটি স্মরণ করার বিশেষ কারণ আছে অবশ্যই। ১০০ বছর পর, গত পরশু, আরেক বাঙালি প্রতিভা নোবেল-জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভূষিত হয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল’-এ।  কিন্তু দেশে কি অবস্থা তাঁর? প্রায় প্রতিদিনই সরকারের লোক ও তাদের সমর্থকরা নানাভাবে নিন্দামন্দ কটূক্তি করেই চলেছেন তার। অর্থমন্ত্রী তো তাকে হেয় করার সুযোগ নেন কথায়-কথায়। পদ্মা সেতুর অর্থায়নে বিশ্বব্যাংক নিরস্ত হয়েছে নাকি তার গোপন হস্তক্ষেপে - এ ধরনের নানা অভিযোগ শোনা যায় প্রায়ই। এসব শুনতে-শুনতে সম্ভবত তিক্ত হয়ে পড়েছেন তিনিও। তাই দেশের এই গভীর সঙ্কটকালেও কোন ভূমিকা নিতে দেখি না তাকে। শুনতে পাই না তার কোন আবেদন আহ্বান বক্তব্য। রবীন্দ্রনাথকে তো তবু দেশের জনসাধারণের প্রতিনিধিরা সংবর্ধনা জানাতে গিয়েছিলেন, ড. ইউনূসের জাতীয় বা নাগরিক বা গণ সংবর্ধনার আয়োজন করবে কে বা কারা? করা হলে হয়তো রবীন্দ্রনাথের মতো একই রকম প্রতিক্রিয়া জানাবেন তিনিও। সংবর্ধনা দিতে যাওয়া কবি-অধ্যাপক মোহিতলাল মজুমদারকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘গ্রাম্য বালকেরা যেমন কুকুরের লেজে টিন বেঁধে হাততালি দিয়ে তাড়া করে বেড়ায়, আপনারা তাই করতে এসেছেন।’ হয়তো এমন কিছুই বলবেন তিনিও। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর দু’টি প্রতিক্রিয়া ব্যাপক রূপ ধারণ করে সে সময় (১) তাঁর প্রতি শিক্ষিত বাঙালির বিরূপতা বিদ্বেষে পরিণত হয়, এবং তা বেড়েই চলে; (২) আর তিনি দেশবাসীর প্রতি বিমুখ হয়ে বিদেশীদের মুখাপেক্ষী হয়ে ওঠেন। ইতিহাসের কি বিচিত্র গতি! ১৯১৩ ও ২০১৩ প্রায় অভিন্ন হয়ে ওঠে কিভাবে!
sazzadqadir@gmail.com