মঙ্গলবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১২

মেলায় হেলা-ফেলার খেলা

১৯৬২’র শিক্ষা আন্দোলনের পর স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের আন্দোলন এগিয়ে চলে ছাত্র রাজনীতিকে ভিত্তি করে। আয়ুবি শাসনের সেই দিনগুলোতে দলীয় রাজনীতি ছিল রুদ্ধশ্বাস। তাই বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে গণরাজনীতিতে ভূমিকা রাখতে হয়েছে ছাত্র সংগঠনগুলোকেই। বিশেষ করে সচেতনতা সৃষ্টিতে তাদের ওপরই নির্ভর করতে হয়েছে মূলধারার রাজনীতিকে। সকল দলই তাদের ছাত্র সংগঠনগুলোর মাধ্যমে পরিচালনা করতো যাবতীয় উদ্যোগ-আয়োজন। তখন একুশকে ঘিরে চলতো বৃহৎ পরিসরের কর্মকাণ্ড। কারণ এই মহত্ আত্মোত্সর্গের মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে নিজেদের রক্তচক্ষু ঘুরিয়ে রাখতে বাধ্য হতো তত্কালীন সরকার। প্রভাতফেরি, পুষ্পমাল্য / শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ, শোক-স্মরণসভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি তরুণ লেখকদের প্রাণোত্সাহে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে একুশের সঙ্কলন প্রকাশ। সেই সঙ্গে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে রাজনৈতিক সাহিত্য। প্রথমে ছাত্র সংগঠনগুলো, পরে সকল ধরনের সমিতি-সংগঠন, সংস্থা-প্রতিষ্ঠান, পাড়ার ক্লাব পর্যন্ত মেতে ওঠে একুশের সঙ্কলন নিয়ে। শেষে শাসক দল ও তাদের তাঁবেদাররাও যোগ দেয় একুশে চর্চায়। সংবাদ, প্রচার ও প্রকাশনা মাধ্যমগুলোতে কলেবর ও পরিসর ক্রমশ বাড়ে।
’৬২-র শিক্ষা আন্দোলনের পর স্বায়ত্তশাসনের দাবি রূপ নেয় স্বাধিকারের আন্দোলনে। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পর সে আন্দোলন রূপ নেয় স্বাধীনতার সংগ্রামে। একুশকে ঘিরে চর্চা তখন পায় নতুন মাত্রা। ব্যাপকতা। একুশের প্রভাতফেরি শুরু হতে থাকে রাত ১২:০১টা থেকে। অনুষ্ঠান হতে থাকে একাধিক দিন ধরে। একুশের প্রভাতফেরির সময় থেকে ফেরি করে বিক্রি করা হতো একুশের সঙ্কলন। ফেরি হতো রাস্তায়... দোকানে... অফিসে। প্রভাতফেরির পর ভোরে বাংলা একাডেমীতে শুরু হতো সংগীত ও কবিতা পাঠের আসর। সঙ্কলনের লেখক-প্রকাশক-উদ্যোক্তা-বিক্রেতা সকলে ভিড় করতেন সেখানে। সঙ্কলন বেশি বিক্রি হতো ওই সমাবেশের আশপাশে। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে, কাগজ বা চাদর পেতে বিক্রি করতেন অনেকে। আকর্ষণীয় লেখা থাকলে, বিষয়ে বৈচিত্র্য থাকলে, প্রকাশনা উন্নত হলে, আকারে প্রকারে ব্যতিক্রমী হলে সঙ্কলনের সমাদর হতো বেশি, বিক্রিও হতো বেশি। ওই সব সঙ্কলন বিবেচিত হতো সংগ্রহের সামগ্রী হিসেবে।
এভাবে গড়ে ওঠে একুশে সাহিত্য। সঙ্কলনের পাশাপাশি একুশে বিষয়ক কিছু-কিছু বই ও পত্রপত্রিকার বিশেষ সংখ্যাও বিক্রি হতে দেখেছি বাংলা একাডেমী চত্বরে। ১৯৭৪ সালে দেখি সঙ্কলন-সাহিত্যের চূড়ান্ত রূপ। ওই বছর এ নিয়ে বিশেষ প্রচ্ছদ প্রতিবেদন রচনা করে সাপ্তাহিক বিচিত্রা। এর মূল রচনাটি ছিল আমার লেখা।
এরপর বাংলা একাডেমীর  একুশে অনুষ্ঠানের আয়োজন বাড়ে, চত্বরে সঙ্কলন বিক্রির সঙ্গে-সঙ্গে বাড়ে নতুন লেখকদের রচিত ও সম্পাদিত বই। ক্রমে-ক্রমে সঙ্কলন-মেলা রূপ নেয় বইমেলার। তরুণ লেখকদের আয়োজন এক সময় চলে যায় প্রকাশকদের অধিকারে। বইমেলা নামটিই চালু হয়, কিন্তু কলকাতার বইমেলা থেকে আলাদা বোঝাতে ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ নাম রাখে “অমর একুশে গ্রন্থমেলা”। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থাকতেও গ্রন্থমেলার আয়োজক হিসেবে তাদের আত্মপ্রকাশ ও প্রতিষ্ঠার ইতিহাস সংক্ষেপে এ রকমই।
সেই মেলা আজ আমাদের প্রাণসংস্কৃতির এক অংশ। বইকে ঘিরে হলেও এতে যোগ হয়েছে জীবনের কত কিছু। রাজনীতিও জড়িত অনেকখানি। কেবল প্রকাশকদের স্টল তো নয়, প্রকাশকদেরও জাত-কুল বিচারের ব্যাপার আছে। স্টল বরাদ্দে আছে ছোট-বড় বিবেচনার বিষয়। বাদ-বাতিলের ঘটনা আছে। পাশাপাশি স্টল আছে সৌখিন, দল-সংগঠন, মুখচেনাদের। এ ব্যাপারটা আছে আলোচনা-অনুষ্ঠানের আয়োজনেও। সেখানে এ রকম এক রীতি দাঁড়িয়ে গেছে অতিথি-বক্তা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে। ফলে ‘মেলা’ বললেও বেশ হেলা ও ফেলা আছে এখানে। প্রতি বছরই নানা রকম অভিযোগ শোনা যায় মেলার আয়োজন নিয়ে। তবে অজ্ঞাত কারণে মিডিয়ার কোনও আগ্রহ নেই বাংলা একাডেমীর ব্যাপারে। একুশের স্মৃতিবাহী এ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কোনও অনুসন্ধান হয়নি এখনও। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত কিভাবে চলেছে বাংলা একাডেমী, এখন চলছে, এর ভেতরে কি আছে, এর কার্যক্রম বা কর্মকাণ্ড কি-এ সব খুঁটিয়ে-খতিয়ে দেখেনি মিডিয়া। অথচ এর কল্যাণের জন্যই মিডিয়ার অনুসন্ধানী ভূমিকার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। বাংলা একাডেমী তো একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শুধু নয়, একটি একাডেমী। সেখানে একাডেমিক কাজ কি কতখানি হয় বা হচ্ছে তার খোঁজ নেয়া দরকার। ১৯৮৩ সাল থেকে বহু লেখায় আমি উল্লেখ করেছি-‘খাঁটি বাংলা ব্যাকরণ ও বাংলা অভিধান আমাদের নেই। প্রয়োজনীয় গবেষণার মাধ্যমে এ অভাব পূরণের উদ্যোগ নেয়া হোক।’ কিন্তু সে গবেষণা কোথায়? ব্যাকরণ ও অভিধানের কাজ কতখানি কি হয়েছে তা খতিয়ে দেখা দরকার।
গ্রন্থমেলা আয়োজনের কাজ জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের হলেও বাংলা একাডেমীই দেশের সবচেয়ে প্রিয় গ্রন্থমেলাটির আয়োজক। বইয়ের পাঠক ও ক্রেতা যেখানে কমে যাচ্ছে প্রতিদিন সেখানে এমন একটি মেলার বড় প্রয়োজন আমাদের।  স্বাধীনতার পর বলাকা ভবনের ‘বই বিচিত্রা’ যখন ‘পদশোভা’য় পরিণত হয় তখন থেকে আমাদের হতাশা শুরু। তারপর দেখছি নিউ মার্কেটের বইয়ের দোকানগুলি একে-একে বদলে যাচ্ছে ফাস্ট ফুডের দোকানে। স্টেডিয়াম, গুলিস্তান, বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে তেজগাঁও রেলস্টেশন পর্যন্ত অনেক এলাকার বইয়ের দোকানগুলো এখন স্মৃতি মাত্র। আজিজ সুপার মার্কেটের বইয়ের দোকানগুলোও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একে-একে। সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে পোশাক-আশাকের দোকান। বাংলাবাজার ছাড়ছেন পুরনো প্রকাশকেরা, নতুন প্রকাশকেরা সমবেত হচ্ছেন কাটাবনে। তবে অনেক প্রকাশক নিজেদের বই ছাপেন কম, তারা বেশিরভাগ বই ছাপেন লেখকদের অর্থে। সেখানে আবার নানা শর্ত। দরও নানা রকম। খোঁজ নিয়ে জেনেছি-ফরমা প্রতি চার হাজার থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়া হয় লেখকদের কাছ থেকে। আরও নানা রকম দর থাকতে পারে, যা জানতে পারিনি। আবার হাজার দশেক টাকায় পাঁচ-ছয় ফরমার বই ছেপে দেন এমন প্রকাশকও আছেন। অনেকে আবার ১০০ বা ২০০ বই লেখক কিনে নেবেন এ শর্তেও বই ছাপেন। এ নিয়ে অভিযোগও আছে লেখকদের। তারা বলেন, প্রকাশক ১২৫ বা ২২৫ কপির বেশি বই ছাপেন না। প্রচারনা, পরিবেশনা, বেচাবিক্রি করেন না ঠিকমতো। অভিযোগ আছে পাঠকদের দিক থেকেও। লেখকদের অর্থে ছাপানো বইগুলোর প্রকাশনা-মান সাধারণত উন্নত হয় না। বইগুলো সম্পাদিত দূরে থাক ঠিকমতো সংশোধিত (প্রুফ দেখার মাধ্যমে) পর্যন্ত হয় না। পাঠক-ক্রেতারা বলেন, মেলায় এ ধরনের বই-ই বেশি। ফলে প্রতি মেলায় গড়ে হাজার তিনেক নতুন বই এলেও সাহিত্যক্ষেত্রে তেমন প্রভাব পড়ে না, ‘উত্কর্ষ’ বা ‘অবদান’ ধরনের কোনও মূল্যায়নও হয় না।
আর মেলায় বই বেচাকেনা? বেচার ব্যাপারে নানা কায়দা নানা স্টলে। কোনও স্টলে শাড়ির দোকানের বিক্রেতাদের কায়দা। কোনও স্টলে রাস্তার পাশে মাইক লাগিয়ে গছানোর চেষ্টা। টানাহেঁচড়াও চলে কোনও স্টলে। কেনার ব্যাপার আবার একেবারেই আলাদা। অনেকে বই কেনেন লেখকের নাম দেখে। অনেকে কেনেন প্রচারে প্রভাবিত হয়ে। এছাড়া আছে পরিচিত জনের বই কেনার একটা ব্যাপার।
প্রচারের কথা বললাম, কিন্তু মিডিয়ায় মেলার খবর যত প্রাধান্য পায় সেভাবে প্রাধান্য পায় না বইয়ের খবর। না পাওয়ারই কথা। বইয়ের খবর তো বিশারদ ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারও পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। বেশিরভাগ পত্রিকা-চ্যানেল জুনিয়র বা শিক্ষানবিশ সাংবাদিকদের নিয়োগ করে এ কাজে। কয়েকজন লেখকের আর কয়েকটি বইয়ের নাম লিখে কাজ সারেন তারা। এছাড়া আছে নানা রকম তালিকা প্রকাশের নানা রকম ফন্দিফিকির। কিছু ধান্দাবাজ এসব কাজে থাকে নিরন্তর উত্সাহী।
বইমেলার আসল ক্রেতা অল্প আয়ের মানুষ। বই কিনবেন বলে প্রতি মাসে কিছু-কিছু করে টাকা জমান তারা। মেলায় তারা আসেন প্রথম দিন থেকেই, ঘুরেফিরে দেখেন, খোঁজখবর নেন। বাছাই করেন কি-কি বই কিনবেন। মেলার শেষ তিন-চার দিনে কেনাকাটা শেষ করেন তারা। তবে আসলের মধ্যে ভেজালও থাকে কিছু। এমন এক ভেজালের দেখা পেয়েছিলাম গতবার। মেলার শেষ দিনে মুঠো ভরা ৫০০ টাকার নোট নিয়ে ঘুরছিলেন তিনি। এক স্টলের সামনে এসে শুরু করেন হম্বিতম্বি (এ বই দে... ও বই দে! তারপর দাম নিয়ে কি কষাকষি! গাউছিয়া মার্কেটকেও ছাড়িয়ে যায় যেন! তাকে অনুনয় করেও কিছু বলা যাবে না আবার! তিনি নিজেও তো রা-রা করেন, পেছনে এসে জোটা আরেকজন রে-রে করেন আরও বেশি (চিনিস্ ব্যাটা কে? খবরদার, সাবধানে কথা বলবি! এই মেলার হুঁ-হুঁ...! নিজ হাতে বই ফেরি করে এ মেলার জন্ম দিয়েছি... জানিস্? স্টলের বিক্রেতা কাঁচুমাচু হয়ে যায় খুব। সে অন্য বই দেখাতে থাকে বিক্রির আশায়। এর মধ্যে ছিল আমারও একটি বই । বইটা হাতে নিয়ে চেহারা একেবারে খারাপ করে ফেলেন তিনি। বলেন, “এ আবার লেখক? এ তো বাংলাই জানে না!” তবে বইটা কেনেন তিনি। তারপর সবাইকে হতভম্ব বানিয়ে করেন এক অদ্ভুত কাণ্ড। স্টল থেকে একটা বই চট করে হাতের ব্যাগে ফেলে হন-হন করে হেঁটে চলে যান দূরে, মিশে যান ভিড়ে। এত অপ্রত্যাশিত... এত দ্রুত সে ঘটনা যে কেউ হৈহৈ করে ওঠার আগেই তা ঘটে যায়!

সোমবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১২

রবীন্দ্রনাথ : শান্তিনিকেতন

রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে মূর্ধন্য প্রকাশনী প্রকাশ করছে রবীন্দ্র-স্মারক গ্রন্থমালা। ১৫১টি গ্রন্থ নিয়ে এ গ্রন্থমালা। এক সঙ্গে এতগুলি বই প্রকাশের আয়োজন আমাদের প্রকাশনা-ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। পৃথিবীর কোনও দেশে এমন কোনও নজির আছে বলেও জানা নেই আমাদের। গ্রন্থমালার সম্পাদক কবি-প্রাবন্ধিক মনজুরে মওলা। উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি কবীর চৌধুরী; সদস্য - খান সারওয়ার মুরশিদ, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও আনিসুজ্জামান। প্রতিটি বইয়ের প্রচ্ছদে ব্যবহৃত হয়েছে শিশুশিল্পীদের আঁকা রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি।
    গ্রন্থমালায় কবি-গবেষক সাযযাদ কাদির লিখেছেন দু’টি বই। এর প্রথমটি ‘রবীন্দ্রনাথ : শান্তিনিকেতন’ প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি। কিভাবে উপাসনাস্থলের একটি ভবন ঘিরে, ছোট এক বোর্ডিং স্কুল থেকে, গড়ে ওঠে আশ্রম, তারপর বিশ্বখ্যাত জ্ঞানচর্চাকেন্দ্র তা অল্প পরিসরেই সবিস্তারে লিখেছেন সাযযাদ কাদির। শান্তিনিকেতনের সঙ্গে-সঙ্গে শ্রীনিকেতনের কাহিনী, বিশ্বভারতীর কার্যক্রম, কবির জীবন ও কর্ম - প্রায় সবই অল্প আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। তাঁর মনোগ্রাহী গদ্য মুগ্ধ বিস্মিত করে রাখে আমাদের, কারণ যত পড়ি তত জানি। বস্তুত জানা-অজানা কত বিষয় যে এই তথ্যাশ্রয়ী রচনাকে সমৃদ্ধ করেছে তা পাঠ-অভিজ্ঞতা ছাড়া বোঝা সহজ হবে না।
    ‘রবীন্দ্রনাথ : শান্তিনিকেতন’-এর প্রচ্ছদে ব্যবহৃত হয়েছে ১১ বছরের সিফাত-ই-মঞ্জুর জেরিন-এর আঁকা ছবি।
                                                           [সাহিত্য বার্তা সংস্থা-সাবাস]
* ‘সাহিত্য বার্তা সংস্থা-সাবাস’ পরিবেশিত সকল সংবাদ / নিবন্ধ স্বীকৃতিসাপেক্ষে ছাপা যেতে পারে। ‘সাবাস’ বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রের একটি সেবামূলক উদ্যোগ।

সংঘাত চারদিকে

সভা নয়, সমাবেশ নয়, মিছিল নয়, মানববন্ধন নয়, এমনকি ঘরের মধ্যে বৈঠক পর্যন্ত নয়। তাহলে রাজনৈতিক কর্মসূচি চলবে কি এই পথে? না। ওই পথে? না। তাহলে কোন পথে? কোনও পথে না। কেননা, নাশকতার আশঙ্কা আছে। গোয়েন্দা সূত্রে খবর আছে ধ্বংসাত্মক তৎপরতার। শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে, জনগণের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে তাই
 বিরোধী দলের প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মসূচির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা, ১৪৪ ধারা জারি, পুলিশি অ্যাকশন, ছাত্রলীগের হামলা চলছে অব্যাহত ভাবে। সরকার ও সরকারি দলের ভাবখানা এরকম- বিরোধী দলের সকল আয়োজন পণ্ড করতে হবে। কারণ তাদের আচরণ অগণতান্ত্রিক, মতলব সহিংসতা সৃষ্টির। আর আমরা গণতান্ত্রিক, তাই আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে গণতন্ত্র-সম্মত ব্যবস্থা নিতে হবে তাদের নিয়ন্ত্রণে।
দেশের রাজনীতি এমন এক সংঘাত-সংঘর্ষমুখী চিন্তার মধ্যে প্রবেশ করেছে এখন। পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে উত্তপ্ত, রাজনীতি উত্তেজনাপূর্ণ, রাজপথ রক্তপাতময়, দেশ অগ্নিগর্ভ। হঠাৎ করে এই অশান্ত অস্থিরতা দেখা দেয়নি দেশে। দিনে দিনে ক্রমে ক্রমে বেড়েছে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, শুরু হয়েছে দলন দমন নির্যাতন। হামলা মামলা গুম খুন। বিরোধী দলকে যেন তেন সকল প্রকারে দাবিয়ে রাখাই যেন একমাত্র রাজনৈতিক কাজ, সকাল-বিকাল তাদের গালমন্দ করাই একমাত্র সরকারি কর্তব্য ও দায়িত্ব। এ অবস্থায় ‘সংঘাতের আশঙ্কা’ বা ‘সংঘাত অনিবার্য’ গোছের কোন বর্ণনা নয়, বলতে হচ্ছে- আমরা যেন এক সংঘাতক্ষেত্রে মুখোমুখি হয়ে পড়েছি পরস্পর প্রতিপক্ষের।
অন্যদিকে বিরোধী দলের ভূমিকাকেও ঠিক দায়িত্বশীল বলা যাবে না। তাদের সংসদ বর্জনের পক্ষে যে যুক্তি তা একেবারেই খোঁড়া। কোন সংসদেই অত সহজ শান্তি থাকে না যত তারা দাবি করেন। তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও সংসদ বর্জন বিরোধী যে ঘোষণা ছিল তা নিজেরাই অমান্য করে চলেছেন তারা। অথচ সুযোগ-সুবিধাগুলো ঠিকমতোই নিচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন জ্বলন্ত ইস্যুতে তাদের কোন কার্যকরী ভূমিকা দেখা যায় না। জনগণের পাশেও দাঁড়াতে দেখা যায় না। কোন সামাজিক ভূমিকাতেও তারা অনুপস্থিত। মধ্যবর্তী নির্বাচনের মতো নন-ইস্যু নিয়েও তাদের অকারণ মাতামাতি দেখা গেছে। এখনও মাঝে মধ্যে জিগির ওঠে। এরপর আছে নির্বাচন বর্জনের খেলা যা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তাদের ব্যর্থতারই প্রমাণ। তাদের আন্দোলন পুরোপুরি নেতিবাচক, ক্ষমতার রাজনীতির লড়াই মাত্র। কিন্তু সে লড়াইয়েও জোর নেই তাদের। তেমন উদ্যোগ-আয়োজন নেই। সমাজের সকল স্তরের মানুষের মধ্যেই আছে নানা অভাব-অভিযোগ। সেগুলোর কোন প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় না বিরোধী দলের বক্তৃতা-বিবৃতিতে, দাবি-দাওয়া ও সমালোচনার ভাষায়।
সর্বশেষ উত্তেজনার শুরু প্রধান বিরোধী দল বিএনপির গণমিছিলের কর্মসূচি নিয়ে। গতকাল এই কর্মসূচি নস্যাৎ করতে পাল্টা কর্মসূচি দেয় সরকারি দল। তারপর যা হয়। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় ও সম্ভাব্য নাশকতা ঠেকাতে পুলিশের নিষেধাজ্ঞা জারি। এ অবস্থায় বিএনপি পিছিয়ে দেয় তাদের কর্মসূচির দিন। কিন্তু রেহাই নেই তবু। সরকারি দল সেদিনও দিয়ে বসেছে পাল্টা কর্মসূচি। এ অবস্থায় চলতে থাকার অর্থ দেশকে অনিবার্য সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়া। পত্রিকান্তরে এ সম্পর্কে অভিমত জানাতে গিয়ে এ কথাই বলেছেন বিশিষ্ট নাগরিকেরা। বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেছেন, রাজনৈতিক কর্মসূচির ধারাবাহিক পথ রুদ্ধ হয় এমন পরিবেশ সৃষ্টি কারও কাম্য নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেছেন, রাজনৈতিক কর্মসূচির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির সিদ্ধান্ত অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে অদূরদর্শী। ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, আইনগতভাবে কিছু করতে যখন কাউকে বাধা দেয়া হয় তখন নাগরিকদের বেআইনি পথে যেতে বাধ্য করা হয়। বিরোধী দলের কর্মসূচিতে পদে পদে বাধা দিয়ে সরকার খুবই বিপজ্জনক পথে পা বাড়াচ্ছে।
সে বিপদ কতখানি ভয়াবহ হয়ে উঠছে তার প্রমাণ মিলেছে এরই মধ্যে। গতকালই দেশের অন্তত ১৬টি জেলায় বিরোধী দলের গণমিছিল আক্রান্ত হয়েছে। পুলিশ ও সরকারি দলের লোকজন বিশেষ করে ছাত্রলীগের কর্মী-ক্যাডার হামলা চালিয়েছে যুগপৎ। গুলিবর্ষণ, লাঠিচার্জ হয়েছে। রক্ত ঝরেছে রাজপথে। প্রাণ দিয়েছেন চারজন, রক্তাক্ত জখম হয়েছেন ১০০ জন। এ মৃত্যু, এ রক্তপাতের জবাব কি?
সরকার ও সরকার দল চোখ থাকতে অন্ধ- একথা নিশ্চয়ই বলবেন না কেউ। তিন বছরে নানা স্লোগান, নানা তৎপরতা থাকলেও দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার রাশ টেনে ধরা যায়নি। গ্যাস-বিদ্যুৎ বিভ্রাট সামলানো যায়নি, তিস্তা-ফেনী নদীর পানি বণ্টন চুক্তি হয়নি। ছিটমহল নিয়ে চুক্তি হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। সীমান্তে হত্যা-নির্যাতন বন্ধে যথাউদ্যোগ নেই। পদ্মা সেতুসহ অনেক উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের সমাধি ঘটেছে কেলেঙ্কারিতে। পুঁজিবাজার আর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি? নিজ দলের মধ্যেই খুনোখুনি, সংঘাত-সংঘর্ষ চলেছে ফ্রি-স্টাইলে, একটির পর একটি নির্বাচনে ভরাডুবি ঘটছে। দেশের ভেতরের বাইরের বৈরী শক্তি নানা নাশকতায় লিপ্ত- এ অবস্থায় সরকার ও সরকারি দল কি চায়?
মনে হয় তাদের কথা একটাই-‘যা কিছু হারায় কেষ্টা বেটাই চোর!’ আর কাজও তো সেই একটাই- সকল প্রকারের বৈরিতাকে শাণিয়ে তোলা। রাজনীতির নামে সংঘাত আর গণতন্ত্রের নামে অসহিষ্ণুতাকে চাঙ্গা করে রাখা। কিন্তু ‘নগর পুড়িলে কি দেবালয় এড়ায়?’

শনিবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০১২

প্রবল পরম পরুষ

বইয়ের মতো বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠাগুলিও কম আকর্ষণীয় নয়। এই পৃষ্ঠাগুলোতে থাকে প্রকাশনা সম্পর্কিত তথ্য (প্রকাশক, মুদ্রাকর ও প্রচ্ছদশিল্পীর নাম, সংস্করণ সংখ্যা, মূল্য), ভূমিকা (নানা শিরোনামে), সূচিপত্র, লেখকের (প্রকাশকেরও) অন্যান্য বইয়ের নাম এবং উৎসর্গ। এগুলোর মধ্যে ‘উৎসর্গ’ নিঃসন্দেহে কৌতূহলী করে বেশির ভাগ পাঠককে। ‘কাকে বা কাদের’ প্রতি বইটি উৎসর্গীকৃত তা নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা ও গবেষণাও হয় লেখকের নানা সম্পর্কের হদিশ নিতে। এ ধরনের কৌতূহল রবীন্দ্রনাথের ‘হ -’ থেকে শামসুর রাহমানের ‘মু. মা.’ পর্যন- অটুট আছে এখনও। অনেক ‘উৎসর্গ’ চমকও সৃষ্টি করে। সনে-াষ কুমার ঘোষ তাঁর একটি বই উৎসর্গ করেছেন “অনেক ভেবেচিনে- শেষে নিজেকেই”। একজন লেখক কাকে বা কাদের কোন বিবেচনায় বই উৎসর্গ করেন তা অস্পষ্ট থাকে না প্রায় ক্ষেত্রেই। তবে লেখক যদি ব্যাপারটা উদ্দিষ্ট ব্যক্তি ও তাঁর মধ্যে রাখতে চান তাহলে পাঠকের জল্পনাই হতে পারে সার। আমি বই উৎসর্গ করেছি কৃতজ্ঞতা জানাতে, স্মরণ করতে। বেশি বই বেরোবে না ভেবে বেশির ভাগ বই-ই উৎসর্গ করেছি একাধিক জনকে। ষাটের দশকে আমার তিন প্রিয় কবি - হাসান হাফিজুর রহমান, শহীদ কাদরী ও রফিক আজাদকে উৎসর্গ করেছি আমার প্রথম কবিতার বই ‘যথেচ্ছ ধ্রুপদ’ (১৯৭০)। দ্বিতীয় কবিতার বই ‘রৌদ্রে প্রতিধ্বনি’ (১৯৭৬) উৎসর্গ করেছি বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে আমার ঘনিষ্ঠ দুই সহপাঠিনী নাজমা ইয়াসমিন ও শামীমা নারগিসকে - যাঁরা অপমৃত্যুর শিকার হয়েছেন অকালে। এভাবে আমার আর ন’টি বই উৎসর্গ করেছি পেইচিং-জীবনের তিন বান্ধবী মারি-আনা লিপোভিৎ, ইয়ানা স-ারকোভা ও ভিলমা সিবার্গ, প্রিয় সহপাঠিনী নিলুফার চৌধুরী, আমার চিকিৎসক ডা. শহীদুল আলম, আদর্শ ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, বাল্যবন্ধু কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম, ‘সংবাদ’-সম্পাদক বজলুর রহমানকে। একটি বই ‘আমার প্রিয়’ কোন ভুলে উৎসর্গ করা হয় নি কাউকে। অন্যান্য বই উৎসর্গ করেছি আমার শিক্ষক শহিদ মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা ও আনিসুজ্জামান, স্কুল-জীবনের সহপাঠী বন্ধু অকালমৃত শিশুসাহিত্যিক মলয় কুমার ভৌমিক, বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে আমার প্রথম দুই বন্ধু কবি হুমায়ুন কবির ও আবুল হাসান, বন্ধু শাহাদত চৌধুরী, প্রকৃতই আমার আপা কথাশিল্পী রাবেয়া খাতুন, প্রিয় কথাশিল্পী কাজী আনোয়ার হোসেন, প্রিয় মানুষ সাহিত্যিক-শিক্ষক জওশন খানকে। শিশুতোষ বইগুলো উৎসর্গ করেছি ভাইবোন, ভাইপো-ভাইঝি, ভাগ্নে-ভাগ্নিকে। এছাড়া আরও কিছু বই উৎসর্গ করেছি বিভিন্ন সময়ে আমার কাছে আসা কয়েকজন নরনারীকে। এই স্মরণীয় বরণীয়দের নিয়ে কিছু ভুলও হয়েছে আমার। একজনকেই দু’বার করেছি উৎসর্গ। তিন জন যোগাযোগ বন্ধ করেছেন, একজন তাঁকে উৎসর্গ করা বইটি পর্যন- নেন নি। এবার বলি আমাকে উৎসর্গ করার ব্যাপার। কথাশিল্পী রাবেয়া খাতুন থেকে কবি হাসান হাফিজ পর্যন- অনেকেই এককভাবে তাঁদের বই উৎসর্গ করে আমাকে বেঁধেছেন কৃতজ্ঞতার বাঁধনে। কোনও-কোনও বছর ১২, ১৩, ১৪টি বইও উৎসর্গ করেছেন স্বজন-সহজনেরা। কবি মুহাম্মদ সামাদ তাঁর দ্বিভাষিক কবিতা-সঙ্কলন ‘সিলেক্টেড পোয়েমস্‌’ আমাকে উৎসর্গ করেছেন ২০০৮ সালে। একই সঙ্গে আরও দু’জন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব উৎসর্গিত হয়েছেন - কবি-কথাশিল্পী সৈয়দ শামসুল হক ও কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত। তাঁদের সঙ্গে আমার নাম যুক্ত করে মুহাম্মদ সামাদ এক বিরল সম্মান জানিয়েছেন আমাকে। ভাবি, আমাদের সমাজে মহাপ্রাণ মানুষের অভাব ঘটে নি এখনও।
    ‘সিলেক্টেড পোয়েমস্‌’ (অনন্যা, ঢাকা) হাতে পাওয়ার পরই ভেবেছিলাম কিছু লিখবো মুহাম্মদ সামাদের কবিতা সম্পর্কে। আবার ভাবি উৎসর্গ করা বই সম্পর্কে ঠিক নিরপেক্ষভাবে লিখতে পারবো কিনা। তারপরও কয়েকবার লিখতে গিয়ে মাঝপথে থেমে যাই। একবার লিখে সম্পাদকের কাছে ই-মেল করতে গিয়ে থামি, মনে হয় কিচ্ছু হয় নি লেখাটি। আরেকবার ই-মেল করার ক’দিন পর সম্পাদককে অনুরোধ করি লেখাটি না ছাপতে। এর মধ্যে বারবার হানা দিয়েছে সেই ১৯৬৮ সাল থেকে শুরু হওয়া আমার এক ঘোরতর ব্যাধি রাইটার’স ব্লক - ‘লেখকের বন্ধ্যাত্ব’। জর্জ অরওয়েল-এর উপন্যাস “কিপ দ্য এসপিডিসট্রা ফ্লাইং” (১৯৩৬)-এর কবি গর্ডন কমস্টক-কে চেপে ধরা ব্লক-এর চেয়েও খারাপ ব্লক চেপে ধরে আমাকে।
    আগেই বলেছি ‘সিলেক্টেড পোয়েমস্‌’ দ্বিভাষিক কবিতার সঙ্কলন। মূল বাংলা কবিতার পাশেই রয়েছে ইংরেজি অনুবাদ। অনুবাদ করেছেন কবীর চৌধুরী, নাজিম মাহমুদ, জাকারিয়া শিরাজী, সিদ্দিক মাহমুদুর রহমান, কে. আশরাফ হোসেন, আবেদিন কাদের,  কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজী আলী রেজা, নিশাত জাহান, আনিসুর রহমান, নাহিদ কায়সার, দেবব্রত মল্লিক, জামিউল করিম। এই অনুবাদ সম্পাদনা করেছেন কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি একটি ভূমিকাও লিখেছেন। এতে তিনি উল্লেখ করেছেন  মুহাম্মদ সামাদের কবিত্ব কিভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর রাজনৈতিক সক্রিয়তা দ্বারা:
... Muhammad Samad ... has earned considerable fame here over time for both his poetry and and various sorts of activism. ... these two have their markedly seperate domains, but are generally found to originate from common source-points, of passions, and to proceed interactively. That means these tend to influence each other. As a result, there’s a risk of one’s perfomance in both or either of these areas suffering. ... now... his poetry rather emerged as a richer volume because of his activism. ...
ওই ‘অ্যাকটিভিজম’-এর কারণেই মুহাম্মদ সামাদ চরিত্রগতভাবে প্রবল প্রাণের অধিকারী। এ প্রবলতা তাঁর প্রকাশ পায় তাঁর জীবনে, কবিতায়, ভাষায়। তীব্র, বেগবান এক কবিভাষা তাঁর কবিতার বড় সম্পদ। রাজনীতি, সমাজ, জীবন, প্রেম - এই চারটি বিষয়কেই প্রধান করে তুলেছেন তিনি কবিতায়। তবে আবেগের তীব্রতার সঙ্গে গভীর মননশীলতা এক স্বতন্ত্র মাত্রা দিয়েছে তাঁর ভাব, ভাষা, নির্মাণকে। এর কারণ মুহাম্মদ সামাদ শিক্ষণ ও গবেষণা ক্ষেত্রে মেধান্বিত চর্চায় নিয়োজিত। তিনি ছিলেন কৃতী ছাত্র, এখন কৃতী শিক্ষক। গবেষণা করেছেন অনেক ব্যাপক পরিসরে, শ্রম দিয়েছেন গভীর নিষ্ঠায়। ভ্রাম্যমাণ অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে, গিয়েছেন চীন ও কোরিয়ায়। তাঁর আরও কৃতিত্ব আছে সংগঠক হিসেবে, সামাজিক ও মানবিক দায়িত্ব পালনে অগ্রণী ভূমিকা নেয়ার ক্ষেত্রে। এ সবই তাঁর কবিতাকে করেছে মেধান্বিত আবেগে দীপ্র। এছাড়া মুহাম্মদ সামাদের কবিতার গঠনে আছে ক্লাসিক বিনির্মাণ। মধুসূদন বাংলা কবিতাকে যে বীর্যবত্তা দিয়েছিলেন, পরবর্তী কালের ভাবাবেগের স্রোতে যা ভেসে যায়, সেই পরুষ উচ্চারণ দেখি তাঁর কবিতার।
    রাজনীতিক, সংগঠক হিসেবে বেশি চোখে পড়েন মুহাম্মদ সামাদ, কিন' অন-র্গত জীবনে তিনি এক কবি-প্রেমিক। রোমান্টিক তো বটেই। এ প্রেম ও রোমান্টিকতা ‘অরুণা’ সিরিজের কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে বেশি, তবে অন্যান্য কবিতাও বঞ্চিত হয় নি। “নীল প্রজাপতি ওড়ে” কবিতার প্রথম স-বক উদ্ধৃত করি এখানে -
    “তোমাকে ছোবল মেরে আমি মরে যাই নিজে
    তুমি নীল হয়ে এলায়ে পড়েছো বুকে - নীল সুখে
    আমি সারারাত কাঁপি  - খুলে রাখি বেদনার ঝাঁপি
    এমন মধুর বিষ  - এ আমার ভালবাসা  - এ আমার পাপ
    আমি প্রতিদিন প্রতিক্ষণ চাই এমন পাপের নিত্য অভিশাপ!...”
    কবিতার অনুবাদে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন সবাই। মুহাম্মদ সামাদের সতেজ সাবলীলতা ইংরেজিতেও চমৎকার প্রকাশ পেয়েছে দেখে অবশ্যই বিস্ময় মানি। নমুনা হিসেবে উপরের স-বকটির অনুবাদ (জাকারিয়া শিরাজী কৃত) উদ্ধৃত করি এখানে:
“After kissing you I myself fall dead
    Turning blue you have sunk into my chest in blue blissfulness;
    I shiver the whole night  keep uncovered the basket of pains.
    Such sweet venom   this is my love   my sin,
    Everyday every moment I want the constant curse of this sin!...”
‘সিলেক্টেড পোয়েমস্‌’-এর প্রায় সব কবিতাই মূলে ও অনুবাদে এমন সমান উপভোগ্য। এখানে কবিতা মনোনয়নে মেলে বিচক্ষণতার প্রমাণ। প্রকাশনাতেও রয়েছে যথেষ্ট যত্নের ছাপ। তবে ফারসি ‘জিন্দাবাদ’কে উরদু বলার মতো ভ্রম আরও আছে কি? সব মিলিয়ে ‘সিলেক্টেড পোয়েমস’ এই দশকের কবিতায় নিঃসন্দেহে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন।

শনিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১২

রসরাজের দয়া

রঙ্গ-রসিক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জীবনে অনেক শোক-তাপ বিদ্বেষ-বৈরিতা সয়েছেন, তারপরও গেয়েছেন দুঃখজয়ের গান, থাকতেন হাসিখুশি রঙিন। কথায় কথায় করতেন কৌতুক, আর সে কৌতুক করতেন প্রায় সকলের সঙ্গেই। পুত্র, পুত্রবধূ, বন্ধু, সেবক, ভৃত্য—সবাই হতেন তাঁর কৌতুকের লক্ষ্য। ভৃত্য বনমালী দেরি করছে চা আনতে। রবীন্দ্রনাথ বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘চা-কর বটে তবে সু-কর নয়।’ এর মধ্যে চা নিয়ে হাজির বনমালী। তখন কপট রাগে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘তুই বোধহয় জানিস না যে তোর অতুলনীয় অকর্মণ্যতায় আমি খুব বেশি পুলকিত হই নি।’
এক পত্রিকা প্রসঙ্গে কথা হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘একদা সম্পাদক ছিলাম আমি এই পত্রের।’ একজন জিজ্ঞেস করেন, তখন অমুক কি সহ-সম্পাদক ছিলেন? সঙ্গে-সঙ্গে উত্তর দেন রবীন্দ্রনাথ, ‘সহ কি দুঃসহ বলতে পারি না, তবে ছিলেন মনে হচ্ছে।’ কবি সুধাকান্ত রায় চৌধুরী (১৮৯৬-১৯৬৯) ছিলেন রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘকালীন সহচর ও একান্ত সচিব। প্রায় ৫০ বছর কাটিয়েছেন বিশ্বভারতী ও শান্তিনিকেতনের নানা বিষয়ক সেবায়। তাঁর মাথা জুড়ে টাক ছড়িয়ে পড়ছে দেখে রবীন্দ্রনাথ একদিন জিজ্ঞেস করেন, ‘তোর শিরোদেশ যে ক্রমেই মেঘমুক্ত দিগন্তের আকার ধরেছে রে!’ সুধাকান্ত বলেন, ‘আমার বাবারও ওই রকম হয়েছিল শেষ জীবনে।’ সশব্দে হেসে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ। বলেন, ‘তাইতেই বুঝি শিরোধার্য করেছিস্ ওটা?’ সাংবাদিক-সাহিত্যিক-গবেষক নন্দগোপাল সেনগুপ্ত (১৯১০-১৯৮৮) ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিব (১৯৩৭-১৯৩৯)। এক লেখার অংশবিশেষ সম্পর্কে তিনি জানতে চান, ‘বাদ দেবো কি এটুকু?’ মুহূর্তেই উত্তর দেন রবীন্দ্রনাথ, ‘নিশ্চয়ই-নিশ্চয়ই, বাদ দাও, নইলে বিবাদ হবে।’
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘রস যোগান দিলেই যে রস ভোগ করা যায় তা নয়, নিজের অন্তরে রসরাজের দয়া থাকা চাই।’ (‘শ্রাবণগাথা’, রবীন্দ্ররচনাবলী ১৩) এ রসরাজের দয়া তিনি পেয়েছিলেন উজাড় করে দেয়া, আর তাকে ছড়িয়ে দিতেও পেরেছিলেন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। সেই ছড়ানো-ছিটানো মানিক-রতন কিছু চয়ন করা হলো এখানে।
গরমের ছুটি। শান্তিনিকেতন ফাঁকা। বেশির ভাগ ছাত্র চলে গেছে বাড়িতে। তাদের বরাদ্দ দুধ প্রতিদিন বাড়তি থাকে তাই। এ কথা রবীন্দ্রনাথকে জানান পরিচালক। কথাটা শুনে একটু ভাবেন রবীন্দ্রনাথ। পরে বলেন, শাস্ত্রী মশাই তো শান্তিনিকেতনে আছেন—তিনি নিরামিষভোজী—তাঁকেই বেশি করে দুধ দিন।
এই বলে একটি চিরকুটে দু’ছত্র লিখে ভৃত্যকে ডেকে পাঠিয়ে দেন বিধুশেখর শাস্ত্রীর কাছে। সে চিরকুট পড়ে শাস্ত্রী মশাই হা। তাতে লেখা, “শাস্ত্রী মশাই, এখন থেকে আপনার কাছে দৈনিক তিন-চার সের দুধ যাবে। আপনাকে দুগ্ধপোষ্য করে রাখবো মনস্থ করেছি।”
শাস্ত্রী মশাই অবশ্য নিরামিষাশী ছিলেন কিছু দিন। সেই সময়ে একবার অসুখ হয় তাঁর। চিকিত্সক তাঁকে পথ্য দেন মাছের ঝোল। কিন্তু তা খেতে তিনি রাজি নন কিছুতেই। শেষে রবীন্দ্রনাথ রোগের ঔষধ হিসেবে মাছের ঝোল খেতে অনুরোধ করেন তাঁকে। এ অনুরোধ ঠেলতে পারেন না তিনি। শাস্ত্রী মশাই যেদিন পথ্য করবেন—সেদিন সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথ গিয়ে হাজির সেখানে। বলেন, আজ উত্সব। শাস্ত্রী মশাই ‘মীনাসনে’ বসবেন!
একদিন ছবি আঁকছেন রবীন্দ্রনাথ। পাশে দাঁড়িয়ে একমনে তা দেখছেন বিধুশেখর শাস্ত্রী। হঠাত্ জিজ্ঞেস করেন, গুরুদেব, আপনি এত কাজকর্ম লেখাপড়ার ভেতরে আঁঁকাটা কিভাবে শিখলেন?
রবীন্দ্রনাথ উত্তর দিলেন গম্ভীরভাবে, সরস্বতী প্রথমে আমাকে নিজের লেখনীটি দয়া করে দিয়েছিলেন, তারপর অনেক দিন কেটে গেল। তিনি ভাবলেন, না কাজটা তো সম্পূর্ণ হয় নি, সম্পূর্ণ করতে হবে, তাই তিনি নিজের তুলিকাটিও আমাকে দান করে গেলেন।
মহামহোপাধ্যায় বিধুশেখর ভট্টাচার্য শাস্ত্রী (১৮৭৮-১৯৫৭) বিশ্বভারতীতে অধ্যাপনা করেছেন একাদিক্রমে ৩০ বছর। তিনি ছিলেন বেদান্ত ও বৌদ্ধ শাস্ত্রে সুপণ্ডিত। ‘দেশিকোত্তম’ পান ১৯৫৭ সালে।
একদিন জরুরি কাজের কথা হচ্ছে, হঠাত্ রবীন্দ্রনাথ বলে ওঠেন, শাস্ত্রী মশাই, আপনি তো বৌদ্ধ শাস্ত্রে অগাধ পণ্ডিত, অথচ আপনার হিংসা প্রবৃত্তি গেল না!
অভিযোগ শুনে শাস্ত্রী মশাই তো ভীষণ অবাক। হিংসার কাজ কি করেছেন, তা ভেবেই পান না! অনেকটা ফ্যাল-ফ্যাল করে চেয়েই আছেন। তখন ইঙ্গিতে তাঁর গোঁফ দেখিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন, বাড়তে দিন—এদের বাড়তে দিন—হিংসা করে গুম্ফহীন হবেন না।
ভাবখানা, তাঁর নিজের সুপুষ্ট গোঁফ নিয়ে বুঝি সবার খুব হিংসা! তবে শাস্ত্রী মশাইয়ের সঙ্গে এমন রসিকতা প্রায়ই করতেন রবীন্দ্রনাথ। আরেক বার... তখন শান্তিনিকেতন আশ্রমের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। সে সব নিয়ে আলোচনা চলছিল, এর মধ্যে শাস্ত্রী মশাই বলেন, গুরুদেব, যদি একটা কাজ করতে পারেন তো অর্থের আর কোনও অনটন থাকবে না। কেবল আশ্রমের নয়, আপনারও নয়, আমাদেরও নয়, বেশ সুখে দিন কেটে যাবে।
কি রকম? জানতে চান রবীন্দ্রনাথ।
সেটা খুব সোজা। আপনি যদি সন্ন্যাস গ্রহণ করতে পারেন। একটা কৌপীন এঁটে যদি কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাটে একবার বসতে পারেন, তবে আর ভাবনা কি? আপনার দাড়ি চুল তো লম্বা আছেই। চেহারাখানাও সুন্দর। লোকে যখন জানবে, রবি ঠাকুর সন্ন্যাসী হয়েছে, তখন টাকা-কড়ি, ফলমূল নানারকম খাদ্য আসতে থাকবে। দেখতে দেখতে শ্বেতপাথরের একটা মন্দিরও হতে পারবে, তাতে আপনাকে স্থাপন করা হবে। সেখানে ভক্ত ও শিষ্যদের ভিড় ঠেলা অসাধ্য হয়ে উঠবে।
কিন্তু আমি যে সংস্কৃত বচন ঝাড়তে পারবো না! অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন রবীন্দ্রনাথ।
সেজন্য ভাবনা কি? ক্ষিতি ও আমি আপনার চেলা হয়ে সঙ্গেই থাকবো। থাকতেই হবে, অন্যথায় ভক্তদের দানগুলি সামলাবে কে? ক্ষিতির বপুখানিও তো স্বয়ং একটি সন্ন্যাসীরই মতো। তাকে বেশ মানাবে। তা ছাড়া আপনি মৌন থাকবেন। যা কিছু বলবার কইবার আমরা দু’জনে করবো।
রবীন্দ্রনাথ বলেন, তা ভালই হবে। আমি মৌনী থেকে একটা আঙুল তুলবো, আর আপনারা তা দেখে দু’টো আঙুল তুলে সেটা যাহোক একটা ব্যাখ্যা করে দেবেন। ভক্তদের তাক লেগে যাবে। তবে তা-ই করুন।
‘ক্ষিতি’ অর্থাত্ ক্ষিতিমোহন সেন (১৮৮০-১৯৬০) রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমে যোগ দেন ১৯০৮ সালে, কর্মজীবন শেষ করেন বিশ্বভারতী বিদ্যাভবনের অধ্যক্ষ হিসেবে। কিছুদিন বিশ্বভারতীর অস্থায়ী উপাচার্যও ছিলেন। বিশ্বভারতীর প্রথম ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি পান তিনি (১৯৫২)।
ক্লাস চলছে শান্তিনিকেতনে। ইংরেজির ক্লাস। পড়াচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। ক্ষিতিমোহন সেন তখন ছাত্র। সন্ধ্যাবেলা। সে বছর শান্তিনিকেতনে দেওয়ালি (শ্যামা) পোকার খুব উত্পাত। পড়াতে ব্যাঘাত ঘটছে রবীন্দ্রনাথের। এক সময় পড়ানো বাদ রেখে একমনে তিনি আলোর দিকে দেখতে থাকেন পোকাগুলির খেলা। বেশ কিছুক্ষণ চলে এভাবে। শেষে ক্ষিতিমোহন বলে ওঠেন, গুরুদেব, এতক্ষণ আপনি আমাদের ওয়ার্ডসওয়ার্থ পড়াচ্ছিলেন, এবার কি কীট (কবধঃং) পড়াচ্ছেন?
রবীন্দ্রনাথ হেসে ওঠেন এ কথায়।
একবার এক গ্রামে বেড়াতে গেছেন রবীন্দ্রনাথ ও ক্ষিতিমোহন। গ্রামবাসীরা ব্যাপক আয়োজন করেন তাঁদের আপ্যায়নের জন্য। বলতে গেলে কোনও ত্রুটি রাখেন নি তাঁরা। এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির বাড়িতে নিমন্ত্রণ হয় তাঁদের ভোজনের। সেখানে ভূরিভোজের ব্যবস্থা। ব্যঞ্জনাদি তৈরি হয়েছে বহু রকম। পাশাপাশি খেতে বসেছেন দু’জনে। গৃহকর্তা নিজে আপ্যায়ন করছেন সামনে দাঁড়িয়ে। ক্ষিতিমোহন খাবেন বলে ডিমে হাত দিয়েই বুঝতে পারেন, সেটি পচা। রবীন্দ্রনাথও বুঝতে পারেন। কিন্তু উপায় কি? রবীন্দ্রনাথ কি করেন, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করেন ক্ষিতিমোহন।
রবীন্দ্রনাথ হাত দেন ডিমে। মুখে দেন ভাতের সঙ্গে। এ অবস্থায় ক্ষিতিমোহনকেও গিলতে হয় পচা ডিম। আর গিলেই বমি করে ফেলেন তিনি।
পরে রবীন্দ্রনাথকে একলা পেয়ে জিজ্ঞেস করেন, আপনি ওই পচা ডিম হজম করলেন কি করে? আমি তো খেয়েই বমি করলুম!
রবীন্দ্রনাথ হেসে বলেন, খেলে কেন? আমি খাই নি, তাই বমিও করি নি।
খান নি? কিন্তু আমি দেখলুম ডিমটা আপনি মুখে দিলেন!
আমি কি সেই ডিম খেয়েছি নাকি? রবীন্দ্রনাথ বলেন, আমি আমার দাড়ির ভেতর দিয়ে সেই ডিম চাপকানের মধ্যে চালান করে দিয়েছি। এখন ফিরতে পারলেই বাঁচি!
শান্তিনিকেতনে একদিন জমজমাট আসর। অনেক লোক বসে আছেন ঘেঁষাঘেঁষি করে। রবীন্দ্রনাথ ঘরে ঢুকে গম্ভীর হয়ে বলেন, নেপালবাবু, আজকাল আপনার অনেক ভুলচুক হচ্ছে, এ ভাল নয়। আপনাকে দণ্ড পেতে হবে।
এই বলে ধীরে-ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
নেপালচন্দ্র রায়ের পরিচয় আগেই দিয়েছি, তিনি তখন শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক। অভিযোগ শুনে ভাবনায় অস্থির হন তিনি। কোন কাজে কি এমন ভুল হয়েছে যে প্রকাশ্যে এমন করে বলা?
আসরে উপস্থিত সকলের মধ্যেই দেখা দেয় একই রকম উত্কণ্ঠা।
এমন সময় একটা লাঠি হাতে করে ঘরে ঢোকেন রবীন্দ্রনাথ। সেটা নেপালচন্দ্র রায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন, এই হলো আপনার দণ্ড (লাঠি), কাল আপনি ভুলে ফেলে গেছেন।
তখন হাসি ফোটে সকলের মুখে।
বিশ্বভারতীর প্রথম যুগের অধ্যাপক নিত্যানন্দবিনোদ গোস্বামী (১৮৯২-১৯৭২) শান্তিনিকেতনে সুপরিচিত ছিলেন ‘গোঁসাইজি’ নামে। শান্তিনিকেতনে বিধুশেখর শাস্ত্রীর অধীনে সংস্কৃত ও পালি বিভাগের গবেষক হয়ে আসেন ১৯২০ সালে। পরে পাঠভবনে যোগ দেন সংস্কৃত ও বাংলার অধ্যাপক হিসেবে। আজীবন কাটিয়েছেন শান্তিনিকেতনেই। বৈষ্ণবশাস্ত্র ও বৌদ্ধদর্শনে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী গোঁসাইজি সংগীত, অভিনয়, চিত্রাঙ্কন ও সাহিত্য সমালোচনায়ও ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। বিশ্বভারতী ‘দেশিকোত্তম’ এবং কলকাতা রবীন্দ্র গবেষণা পরিষদ ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন তাঁকে।
গোঁসাইজি ছিলেন বেশ একটু স্থূলদেহী। তখন তিনি নতুন অধ্যাপক হয়ে এসেছেন শান্তিনিকেতনে। নতুন বলে রবীন্দ্রনাথ ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন তাঁকে। এই ‘আপনি-আপনি’ শুনে বয়সে অনেকে ছোট গোঁসাইজি একদিন অনেক ইতস্তত করে বলেন, আপনি আমাকে ‘আপনি-আপনি’ বলছেন কেন?
রবীন্দ্রনাথ হেসে বলেন, কি করি বাপু! তোমার যে বপুখানি, তার অন্তত মর্যাদা তো দিতে হবে!
পিঠা পুলি খেতে ভালবাসতেন রবীন্দ্রনাথ। শান্তিনিকেতনের এক ভদ্রমহিলা পিঠা তৈরি করে তাঁকে পাঠিয়ে দেন একদিন। ক’দিন পর এসে তিনি জিজ্ঞেস করেন, গুরুদেব, সেদিন যে পিঠা দিয়েছিলাম তা কেমন খেলেন?
রবীন্দ্রনাথ হেসে বলেন, শুনবে? নেহাত্ যখন শুনতে চাও বলি—লোহা কঠিন, পাথর কঠিন, আর কঠিন ইষ্টক/তার অধিক কঠিন কন্যা, তোমার হাতে পিষ্টক!
শুনে উচ্ছ্বসিত হাসিতে ভেঙে পড়েন মহিলাসহ উপস্থিত সকলে।
শান্তিনিকেতনে বসন্ত উত্সব হবে, মহড়া চলছে দিন-রাত। এর মধ্যে সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে মঞ্জরী সেখানে উপস্থিত। তাকে দেখেই দিনেন্দ্রনাথ (১৮৮২-১৯৩৫)-কে রবীন্দ্রনাথ বলে ওঠেন, দিনু, আমাদের আর ভাবনা নেই। আমের মঞ্জরীর পার্টটা তাহলে মঞ্জরীকেই দেয়া হোক, কি বলিস্?
দিনেন্দ্রনাথ বলেন, আমের মঞ্জরীর তো কোনও পার্ট নেই!
রবীন্দ্রনাথ হা-হা করে ওঠেন, আহা, তা নাই থাক, তা বলে নাতনির সঙ্গে একটু পরিহাস করবো না!
কিন্তু পরিহাস আর রইলো না পরের দিন। রবীন্দ্রনাথ গান লিখলেন—‘মঞ্জরী, মঞ্জরী ও আমের মঞ্জরী...’!
সুরেন্দ্রনাথ (১৮৭২-১৯৪০) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র সত্যেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র। দিনেন্দ্রনাথ (১৮৮২-১৯৩৫) দেবেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বিপেন্দ্রনাথের একমাত্র পুত্র।
শান্তিনিকেতনে বেড়াতে এসেছেন কয়েকজন সাহিত্যিক। তাঁদের দেখে ক্ষিতীশ রায়কে বলেন, দেখো ক্ষিতীশ, এঁরা সাহিত্যিক—ভারি সেন্টিমেন্টাল, আদর-যত্নের যেন ত্রুটি না হয়!
তারপর সকলের দিকে চেয়ে বলেন, ঘুম হয়েছিল তো তোমাদের? তোমরা এসেছো এক খারাপ সময়। গরমে কষ্ট হবে, তবে সে দোষ আমার নয়, আকাশের।
সাহিত্যিকদের একজন বলেন, আর কোনও অসুবিধা হয় নি, তবে রাতে কোকিলের ডাকে ঘুম হয় নি।
রবীন্দ্রনাথ বলেন, কোকিলের ডাকে কি কবিদের ঘুম হয় বাপু? আমাদের এখন মাঝে-মাঝে ঘুম হয় না বটে, তবে কোকিলের ডাকে নয়, মশার কামড়ে।
শান্তিনিকেতনে তখন খুব মশা। মাঝে-মাঝে একটা মশা মারার তেল হাতে পায়ে মাখতেন রবীন্দ্রনাথ। কেউ জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে হেসে বলতেন, ভেবো না যেন বুড়ো বয়সে বাত ধরেছে। শান্তিনিকেতনেও মশারা খুব নম্র, সব সময়েই পদসেবা করছে, তাই তাদের আপ্যায়নে এই আয়োজন!
রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ, অনুবাদক ও অধ্যাপক ক্ষিতীশ রায় (১৯১১-১৯৯৫) শান্তিনিকেতনের শিক্ষাভবনে ইংরেজির লেকচারার হিসেবে যোগ দেন ১৯৩৪ সালে। ১৯৩৫ সাল থেকে ‘বিশ্বভারতী কোয়ার্টারলি’র সম্পাদক কৃষ্ণ কৃপালনি’র সহযোগী ছিলেন। পরে সম্পাদক হন পত্রিকাটির। ‘বিশ্বভারতী নিউজ’-এর সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। এছাড়া ছিলেন রবীন্দ্রভবনের প্রধান রূপকার, টেগোর মিউজিয়ামের কিউরেটর এবং বিশ্বভারতী টেক্সট বুক কমিটির সদস্য।
রবীন্দ্রজীবনকথা’র লেখক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (১৮৯২-১৯৮৫) ছিলেন শান্তিনিকেতনের গ্রন্থাধ্যক্ষ। এক বিকালে এক গোছা বই নিয়ে এক মনে যাচ্ছিলেন বারান্দা দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ বসেছিলেন বারান্দার এক কোণে। তাঁকে দেখে সজোরে ডেকে ওঠেন তিনি, ও বৈবাহিক শোনো শোনো!
প্রভাতকুমারকে তাঁর বন্ধুরা এক সম্পর্কের সূত্র ধরে রসিকতা করে মাঝে-মাঝে সম্বোধন করতেন বৈবাহিক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বলেন নি কখনও। তাই তাঁর মুখে বৈবাহিক ডাক শুনে অবাক হয়ে প্রভাতকুমার জিজ্ঞেস করেন, গুরুদেব, আপনি আমায় বলছেন কেন?
রবীন্দ্রনাথ হেসে বলেন, আরে না-না, সে বৈবাহিক নয়। তোমায় আমি ডাকছি ‘বই-বাহিক’ বলে!
বাল্যকালে মৈত্রেয়ী দেবী শান্তিনিকেতনে স্বরচিত একটা কবিতার খাতা নিয়ে দেখিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। তখন দু’-একটা কবিতা পড়ে তাঁকে ছন্দের প্রাথমিক কয়েকটি ভুল দেখিয়ে দেন তিনি। অন্ত্যমিল যে যুগ্ম হওয়া চাই সে কথাও বলেন, যেমন তিন দুই, তিন দুই, তিন দুই, চার-এর মধ্যে হঠাত্ যদি দুই দুই ঢুকিয়ে দাও তো ছন্দপতন হয়ে যাবে।
তারপর তাঁকে নিয়ে লেখা একটি কবিতা পড়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘কবিবর’ ইত্যাদি দুই দুই হয়ে যাচ্ছে। এক কাজ করো। আমায় শুধু ‘কবি’ বললেই যথেষ্ট হবে—‘বর’ না হয় না-ই হলুম!
তারপর মুচকি হেসে বলেন, বরকে বরবাদ করে দাও। আমার ওপর কবিতা লেখা তো সহজ। রবীন্দ্রের সঙ্গে কবীন্দ্র মিলিয়ে দিলেই হবে!
মৈত্রেয়ী দেবী (১৯১৪-১৯৯০) রবীন্দ্রনাথের নিকটচারিণী, ভাবশিষ্যা, রবীন্দ্রজীবনের অন্তরঙ্গ স্মৃতিকথাকার, সুলেখিকা ও সমাজসেবিকা হিসেবে তিনি সুপরিচিত। তাঁর রবীন্দ্র বিষয়ক বইগুলোর মধ্যে রয়েছে—মংপুতে রবীন্দ্রনাথ (১৯৪৩); পঁচিশে বৈশাখ (সম্পাদনা, ১৯৪৬); কবি সার্বভৌম (১৯৫১); জবষরমরড়হ ড়ভ ঞধমড়ত্ব (১৯৫৪); বিশ্বসভায় রবীন্দ্রনাথ (১৯৬১); জধনরহফত্ধহধঃয, ঃযব সধহ নবযরহফ যরং ঢ়ড়বঃত্ু (১৯৭৩); হিন্দু-মুসলমান ও রবীন্দ্রনাথ (১৯৭৪); রবীন্দ্রনাথ : গৃহে ও বিশ্বে।
শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ মাঝে-মাঝে বসে থাকতেন বারান্দায়। প্রায়ই এক পাগল তাঁর কাছে এসে দুটো পয়সা নিয়ে যেতো গাঁজা খাওয়ার নাম করে। রবীন্দ্রনাথ পাগলদের খুব পছন্দ করতেন, তাদের প্রশ্রয়ও দিতেন।
এক দুপুরে সেই পাগলটা এসে একেবারে হাজির রবীন্দ্রনাথের সামনে। এসেই আটখানা হয়ে আহ্লাদে। বলে, না-না, আজ গাঁজা খাওয়ার পয়সা চাইতে আসি নি আপনার কাছে, আজ এসেছি একটা সুখবর দিতে।
কি ব্যাপার? পাগলের মুখে সুখবর শুনতে উন্মুখ হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ।
পাগল এক গাল হেসে বলে, আপনার ছেলেরা আজ বেশ বড় গোছের ডিগ্রি দিয়েছে আমাকে—হ্যাঁ, আপনার চেয়েও বড় ডিগ্রি।
তাই নাকি? তা ডিগ্রিটা কি?
গ.অ.উ.—কেমন, আপনার চেয়ে বড় ডিগ্রি নয়? হ্যাঁ মশাই, আপনার ছেলেদের তারিফ করতে হয় এর জন্যে—আমি তো রীতিমতো গর্বিত!
তা তো বটেই। বেশ ভাল আর আমার চেয়েও বড় ডিগ্রি আপনি পেয়েছেন—তা আমাকে স্বীকার করতেও হবে। তবে এবার থেকে গাঁজা খাওয়া ছেড়ে দিন—অত বড় ডিগ্রি পেয়েছেন—আর গাঁজা খাওয়া ভাল মানায় না।
তা দিলুম... এই আজ থেকেই—
বলেই ছুট।
তবে পাগলটা কিন্তু এরপর থেকে গাঁজা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল একদম।
রবীন্দ্রনাথ যে চিকিত্সায় উত্সাহী, তা জানতেন অনেকে। সুযোগ পেলেই হাতের কাছের রোগীকে হোমিওপ্যাথি-বায়োকেমিক ওষুধ দিয়ে চিকিত্সা করতেন তিনি। ডাক্তারি বই পড়া ছিল তাঁর নেশা। নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন খাদ্যাভ্যাস নিয়ে, আর সঙ্গী-সহযোগীদের বলতেন তা অনুসরণ করতে। কিছু দিন সেদ্ধ তরিতরকারি, সবুজ শাক-সবজি খেয়ে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এ অবস্থায় পরীক্ষা বন্ধ রাখেন, কিন্তু পরাজয় স্বীকার করেন না কিছুতেই। বারবার শুধু বলেন, এই খাদ্যনীতিতে কোনও ত্রুটি নেই, কেবল আমার স্বাস্থ্যই আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। একথা তোমরা স্মরণ রেখো—আমি শুধু কবি নই, আমি কবিরাজ-ও।
কবি অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সহপাঠী বন্ধু। ওই সূত্রে ঠাকুরবাড়ি আসা-যাওয়ার ফলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল তাঁর। সে সময় ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে খুব আলোচনা করতেন তিনি। একদিন রবীন্দ্রনাথ গোঁফ-দাড়ি পরে পার্শী সেজে অক্ষয়চন্দ্রের কাছে এসে বলেন, আমি বোম্বাই (মুম্বই) থেকে এসেছি। আপনার সঙ্গে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে চাই।
অক্ষয়চন্দ্র রাজি হন আলোচনা করতে। রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বরও ধরতে পারেন না তিনি। বায়রন, শেলী, কীটস নিয়ে জোর তর্ক চলে দু’জনের মধ্যে। অন্যেরা বসে আমোদ উপভোগ করেন খুব। এক সময় স্যর তারকনাথ পালিত এসে উপস্থিত। তিনি এসেই “এ কি—রবি?” বলেই তাঁর মাথায় মারেন এক চাপড়। অমনই খসে পড়ে রবীন্দ্রনাথের নকল দাড়ি-গোঁফ। অক্ষয়চন্দ্র বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন ফ্যাল-ফ্যাল করে। অন্য বন্ধুরা কেউ পারেন না হাসি চেপে রাখতে। সেদিন ছিল পয়লা এপ্রিল—অল ফুল্স্ ডে!
অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী (১৮৭৬-১৯৬২) রচিত ও প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: উদাসিনী (১৮৭৪), সাগরসঙ্গমে (১৮৮১), ভারতগাথা (১৮৯৫)। কিশোর রবীন্দ্রনাথকে তিনি উত্সাহিত করেছিলেন সাহিত্যচর্চায়। রবীন্দ্রনাথের ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’ গীতিনাট্যে তাঁর লেখা গান আছে কয়েকটি।
স্যর তারকনাথ পালিত (১৮৩১-১৯১৪) ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহপাঠী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি ১৫ লাখ টাকা দান করেছিলেন রসায়ন ও পদার্থ-বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য। তাঁর ও স্যর রাসবিহারী ঘোষ (১৮৪৫-১৯২১)-এর অর্থে প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা সায়েন্স কলেজ।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৯-১৯২৫) দেবেন্দ্রনাথের ষষ্ঠ সন্তান, পঞ্চম পুত্র। রবীন্দ্রনাথের ‘নতুন দাদা’ তিনি।
এক গানের আসর। গান গাইছেন বিখ্যাত গায়ক গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৮০-১৯৬২)। সেই আসরে উপস্থিত রবীন্দ্রনাথ। গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান হয়ে যাওয়ার পর সবাই গান গাইবার অনুরোধ জানিয়ে চেপে ধরেন রবীন্দ্রনাথকে। সে অনুরোধ শুনে রবীন্দ্রনাথ হেসে বলেন, গোঁফেশ্বরের পর এবার কি দাড়ীশ্বরের পালা?
এক বন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রণে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর আগমনে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েন গৃহস্বামী। এত বড় মানী লোক পা দিয়েছেন বাড়িতে, কি করে অভ্যর্থনা জানাবেন! যথাযোগ্য সমাদর করে একখানি সুন্দর চেয়ার এগিয়ে দিলেন বসার জন্য। চেয়ারটি দেখে বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেন রবীন্দ্রনাথ, চেয়ারটি সজীব নয় তো?
এই গুরুগম্ভীর প্রশ্নে বিস্মিত হন ভদ্রলোক। চেয়ার তো জড় পদার্থ, সজীব হবে কিরূপে! তিনি ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন রবীন্দ্রনাথের দিকে।
বন্ধুর অবস্থা দেখে তিনি হাসতে-হাসতে বলেন, তোমার ভাবনার কিছু নেই। আমি বলছি চেয়ারটি স-জীব অর্থাত্ ওতে ছারপোকা নেই তো?
এতক্ষণে ধাতে এলেন বন্ধুটি।
বঙ্গভঙ্গের আন্দোলন তখন তুঙ্গে। এ আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নানা জায়গায় সভা-সমিতিতে যোগ দিতেন প্রায় প্রতি দিনই।
এমনই এক দিনে নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায় (১৮৬৮-১৯২৬)-এর মেয়ের বিয়ে। মহারাজা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু রবীন্দ্রনাথের। তাই সকাল-সকাল আসতে বলেছিলেন তাঁকে। বিয়ের দিনে সন্ধ্যায় অতিথিদের সংবর্ধনা জানাচ্ছেন মহারাজা, ওই সময় হন্তদন্ত হয়ে সেখানে উপস্থিত হন রবীন্দ্রনাথ।
তাঁকে দেখে অনুযোগের সুরে মহারাজা বলেন, আমার কন্যাদায়, কোথায় আপনি সকাল-সকাল আসবেন—তা না এলেন এত দেরি করে!
রবীন্দ্রনাথ বলেন, মহারাজ, আমারও মাতৃদায় (বঙ্গভঙ্গ)। দু’জায়গায় সভা করে এলুম।
রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ। চিকিত্সার আয়োজনে ত্রুটি নেই কোনও। বড়-বড় ডাক্তার আসছেন, দেখছেন। শেষকালে রবীন্দ্রনাথ বলেন, আমাকে নিয়ে বেজায় বিপদে পড়েছে ডাক্তাররা। হার্ট দেখে, লাংস দেখে, কোথাও কোনও দোষ খুঁজে পায় না... ওদের ভারি মন খুব খারাপ।
নির্মলকুমারী মহলানবিশ কাছেই ছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করেন, মন খারাপ হবে কেন? এতে তো খুশি হওয়ারই কথা!
রবীন্দ্রনাথ উত্তর দেন, তুমি কি বোঝো না? রোগী আছে, রোগ নেই। ওরা চিকিত্সা করবে কার? এতে ওদের মন খারাপ হবে না?
রানী নামে অধিক পরিচিত নির্মলকুমারী (১৯০০-১৯৮১) রবীন্দ্রনাথের কর্মসচিব (১৯২১-১৯৩১) প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ (১৮৯৩-১৯৭২)-এর স্ত্রী।
ভৃত্য বনমালীর খোঁজখবর নেন রবীন্দ্রনাথ— বনমালী, খাওয়া-দাওয়া চলছে কেমন?
বনমালী উত্তর দেয়—আজ্ঞে, তা ভালই চলছে। দিদিমণি আবার আমায় দুধ খাওয়াচ্ছেন।
রবীন্দ্রনাথ বলেন, দুধ খাওয়াচ্ছেন কেন? তার চেয়ে দুধ মাখালেই পারতেন! খেয়ে তো রঙের বেশি উন্নতি হচ্ছে না!
রবীন্দ্রনাথের গৃহে ‘বিচিত্রা সভা’র অধিবেশন। কিছুদিন ধরে সভ্যদের বাইরে রাখা জুতো চুরি যাচ্ছিল।
শরত্চন্দ্র উপস্থিত হন সভায়। কিন্তু চুরি যাওয়ার ভয়ে জুতোটা চুপি-চুপি একটা খবরের কাগজে মুড়ে বগলে করে রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়ে বসেন তিনি।
শরত্চন্দ্রের ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায় নি অনেকের। তাঁদের একজন গোপনে তা জানিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথকে।
রবীন্দ্রনাথ তখন হাসতে-হাসতে জিজ্ঞেস করেন, ও শরত্, তোমার বগলে ওটা কি?
শরত্চন্দ্র আমতা-আমতা করেন।
রবীন্দ্রনাথ তখন জানতে চান, ও ‘পাদুকাপুরাণ’ বুঝি?
চারদিকে জাগে চাপা হাসির কলরব।
সেকালের শীর্ষস্থানীয় মাসিক পত্রিকা ‘বিচিত্রা’র সম্পাদক কথাসাহিত্যিক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৮১-১৯৬০) ছিলেন শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮)-এর মামা। পত্রিকাটির নিয়মিত লেখক, শুভানুধ্যায়ী ও সংশ্লিষ্টদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল ‘বিচিত্রা সভা’।

রবিবার, ১ জানুয়ারী, ২০১২

‘বিস্মরণের খেয়া ভরা পালে...’

আমরা বাঙালিরা নাকি খুব ভুলো।  সব কিছুই ভুলে যাই সহজে। আমাদের আবেগের স'ায়িত্ব চব্বিশ ঘণ্টাও নয়। রাগ ভুলে যাই, দুঃখকষ্ট ভুলি। ক্ষমা করে দেই, মেনে নেই, আপস করি। আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি ইত্যাদিও ‘বিস্মরণের খেয়া ভরা পালে অকূলে দিয়েছে পাড়ি’। সেই ষাট-সত্তর দশকের মার্কিন-চীন-সউদি বিরোধিতা, বিদ্বেষ, বিরাগ এখন কোথায়? এখন তাদের সঙ্গে কোলাকুলি চলছে খোলাখুলি। দেশের ভেতরেও একই অবস্থা। অতীতের সরকারগুলোর দমন-নির্যাতন, দুঃশাসনও ভুলে যাই আমরা। সে সব রক্ত, অশ্রু, আর্তনাদ, অপমান, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা - কিছুই মনে রাখি না আর। তবে প্রতি বছর, নতুন বছরের শুরুতে, আমরা একবার হলেও ফিরে দেখার চেষ্টা করি ফেলে আসা বছরটিকে। সে ভাবে আমিও গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকার ২০১২ সালকে স্বাগত জানাবার পাশাপাশি একবার তাকাই ২০১১ সালের দিকে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলে থাকা কিশোরী ফেলানি’র লাশ, দোররায় ক্ষতবিক্ষত পল্লীবালা ফাতেমার দেহ, জখমে বিকৃত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রুমানা মনজুরের মুখ, গুলিবিদ্ধ কলেজ-ছাত্র লিমনের অসহায় চেহারা, ঘাতকের নির্মম বুলেটের শিকার মেয়র লোকমানের লাশ - নৃশংস বীভৎসতার সাক্ষ্য এমন আরও অনেক মুখ কি সহজে মুছে যাবে আমাদের স্মৃতি থেকে? আমিনবাজারের অদূরে ঈদের আগের রাতে গণপিটুনিতে নিহত ৬ ছাত্রের কথা কি ভুলে যাবো আমরা? মিরসরাইয়ে দুর্ঘটনায় নিহত ৪৬ স্কুলছাত্র, মানিকগঞ্জে দুর্ঘটনায় নিহত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও টিভি ব্যক্তিত্ব মাশুক মুনীর - ওরাও হারিয়ে যাবে কালের গর্ভে? বিশ্বাস হতে মন চায় না। তারপর পুলিশের বুটের নিচে মিছিলকারীর আর্ত মুখ? না, ভুলে যাবো না। সোমালিয়া জলদস্যুদের কবলে পড়া ‘জাহানমণি’র নাবিক ও এক নাবিক-পত্নীর বিপন্নতার কথাও মনে থাকবে আমার।
    সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলে থাকা ফেলানি’র গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত লাশ ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ভঙ্গুরতাকেই দেখিয়ে দিয়েছে চোখে আঙুল দিয়ে। সাউথ ব্লক যেখানে নিজেদের স্বার্থ, সুবিধা, সুযোগ উদ্ধার করে নিতে অভ্যস্ত - সেখানে আমাদের সেগুনবাগিচায় হচ্ছেটা কি? ওদের কাছ থেকে ওসব উদ্ধার করার কৌশলটাও কি শিখতে পারে না এরা? দরাদরি নেই, কষাকষি নেই, এ কেমন কূটনৈতিক লেনাদেনা? যে জন প্রেমের ভাব জানে না তার সঙ্গে সেভাবে লেনাদেনা না করার কথাই তো বলে সবাই। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের এখানে ওখানে টুটাফুটা যা কিছু আছে তা সব সারাতে হবে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে। আমাদের অব্যবহিত বিশাল প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক যেমন অপরিহার্য আমাদের জন্য, তেমনই অবস্থান ও পরিস্থিতিগত কারণে আমরাও তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভারতের জন্য। ব্যবসা, বিনিয়োগ, যোগাযোগ ছাড়াও আরও অনেক ক্ষেত্র আছে যেখানে সমান হিস্যা নিয়ে আমরা উভয়েই হতে পারি লাভবান। এদিকটায় সেগুনবাগিচার উদ্যোগ বা আয়োজন কিছু আছে বলে মনে হয় না। এছাড়া সীমান্তের এপার-ওপারের বাংলাভাষী আমরা এক অভিন্ন ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। এর মধ্যে বিচ্ছিন্নতা থেকে ঘটেছিল দূরত্ব। এখন ১৯৪৬, ১৯৪৭ ও ১৯৬৪’র সেই তিক্ততা ও বিদ্বেষবিষ কাটিয়ে উঠেছে নতুন প্রজন্ম।  ভৌগোলিক ভিন্নতা থাকলেও মানসিক ঐক্য তাই আগের যে কোনও সময়ের চেয়ে বেশি। তাই সময় এসেছে খণ্ডিত হওয়ার কারণে জাতিগতভাবে যে অসম্পূর্ণতা সৃষ্টি হয়েছে তাকে সমন্বিত ও সম্পন্ন করে তোলার।
    গত বছরের শেষ দিকে একটি ভারতীয় বাংলা ছবি মুক্তি পেয়েছে, অন্তত আরও দু’টি মুক্তি পাবে বলে পত্রিকায় খবর দেখেছি। ১৯৬৫ সালের পর বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কোনও ভারতীয় ছবির বাংলাদেশে মুক্তি এই প্রথম। এর আগে কলকাতা, মুম্বই ও চেন্নই-এ নির্মিত ছবি নিয়মিত চলতো এ দেশের প্রেক্ষাগৃহগুলোতে। ১৯৬২ সালে শেষ মুক্তি পাওয়া দু’টি ছবি ছিল রাজ কাপুর, মালা সিনহা, মেহমুদ অভিনীত ‘পরবরিশ’ (১৯৫৩) এবং মঞ্জুলা বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মলকুমার অভিনীত ‘অগ্নিসম্ভবা’ (১৯৫৯)।
    ভারতীয় ছবির মুক্তি পাওয়া নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক শোরগোল হয়েছে, এখনও হচ্ছে। উচ্চারিত হচ্ছে কঠোর-কঠোর কথা। আমার মনে পড়ছে আশির দশকে বিটিভিতে এক সাক্ষাৎকারে প্রয়াত অভিনেতা মুস্তাফা বলেছিলেন, ‘ভারতীয় ছবি এদেশে মুক্তি পেলে ক্ষতি হবে ১২ জন ব্যক্তির, তবে লাভবান হবে ১৫ কোটি মানুষ।’ আমিও কয়েকবার অনুষ্ঠানে কয়েকটি শর্তে ভারতীয় ছবি আমদানির পক্ষে কথা বলেছি, লিখেছিও বিচ্ছিন্নভাবে। কিন্তু এসব কি ছবি আমদানি হচ্ছে ভারত থেকে? এ সব ছবির পক্ষে লিখতে রাজি নই আমি। ভারতে ধুমধাড়াক্কা সস্তা বাণিজ্যিক ছবি তো শুধু নির্মিত হয় না, উন্নত মানের শৈল্পিক ছবিও নির্মিত হয় অনেক। যদি আমদানি করতে হয় তবে সে সব ছবি, বিশেষ করে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবিগুলো থেকে বাছাই করে তা করতে হবে। এ সব ছবি আমদানি করার সুযোগ দিতে হবে তাঁদের - যাঁরা আমাদের এখানে ভাল ছবি প্রযোজনা করেন নিয়মিত। পাকিস্তান আমলে এমন একটা ব্যবস্থা ছিল বলে শুনেছি। এতে প্রযোজকরা পুষিয়ে নিতে পারেন ক্ষতি (যদি হয়)।
    গত ২২শে সেপ্টেম্বর বিরোধী দলের মিছিলে পুলিশের অ্যাকশন এর আগের ও পরের অনেক অ্যাকশনের মতোই। লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস, গরম বা রঙিন পানি, রবার বুলেট ইত্যাদি দিয়ে বিক্ষোভকারীদের শায়েস্তা করা, তারপর আটক-গ্রেপ্তার, মামলা, রিমান্ডে নির্যাতন ইত্যাদি দিয়ে ভিন্নমতাবলম্বীদের দলন-নির্যাতন এই ‘গণতান্ত্রিক’ যুগেও চলছে মাত্রা ছাড়িয়ে। শানি-পূর্ণ মিছিল, সমাবেশ এমন কি অতিনিরীহ মানববন্ধনও সহনীয় নয় এখন। প্রবল হিংস্রতা নিয়ে বিরোধী চিন্তাচেতনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া এখন হয়ে উঠেছে সময়ের নিয়ম। সেই নিয়মেরই এক প্রতীকচিত্র হয়ে দেখা দিয়েছে ২২শে সেপ্টেম্বরের ওই ছবিটি - ধাওয়া করে এক মিছিলকারীকে ধরে মারতে-মারতে নিচে ফেলে বুট দিয়ে পেষা এক পুলিশের। এই ছবি ছাপা হতে পারতো ‘বুটের তলায় গণতন্ত্র’ ক্যাপশন নিয়েও। হয়তো সে ভাবে ছাপা হয়েছে কোথাও, না হয়ে থাকলে একদিন হবে কোথাও।
    রুমানা মনজুরের সঙ্গে তাঁর স্বামীর সম্পর্ক আগের থেকেই ভাল ছিল না। পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ার পর তাঁর উচিত ছিল বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনকে বিষয়টি জানিয়ে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য জোর উদ্যোগ নেয়া। স্বামীর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারেও সতর্ক থাকা উচিত ছিল তাঁর। এই অসতর্কতার অভাবেই স্বামীর বর্বর আক্রমণের, জঘন্যতম নৃশংসতার শিকার হন তিনি। পরে বন্দি অবস্থায় তাঁর স্বামীর রহস্যময় মৃত্যু নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে জনমনে। রুমানা মনজুর আবার এসেছেন আলোচনায়। ফেলানি, ফাতেমা’র মতো তিনিও ২০১১ সালের এক নির্যাতিত নারীপ্রতীক। এঁদের জন্য দেশের বিভিন্ন অঙ্গনে প্রতিপত্তির সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত, উজ্জ্বল, আলোকিত, আলোচিত নারীদের মুখগুলো ম্লান হয়ে যায় আমার চোখে।
    ২০১২ এসেছে, কিন্তু অঙ্গীকার নেই কোথাও। ২০১১তে যে নির্মমতা ও নৃশংসতার সাক্ষী বা দর্শী হতে হয়েছে আমাদের সে সবের প্রতিবিধান বা প্রতিকারের কোনও লক্ষণ নেই কোথাও। আগের মতোই সব কিছু চলছে আগের মতোই। কোথাও কোনও গ্যারান্টি নেই। কূটনীতি নিস্ফল, তাই সীমানে- গুলিবর্ষণ চলছেই। ফতোয়া থামছে না, দোররা চলছে। ফাতেমা’র মতো আরও অনেকে নারীই ক্ষতবিক্ষত ও জর্জরিত হচ্ছে কশাঘাতে। উত্তরাঞ্চলের দুই নারীকে দোররা মারার দৃশ্য দেখানো হয়েছে টিভিতেও। অন্যায়ের কত প্রতাপ! কি প্রবল পরাক্রান্ত স্পর্ধা! দেশকে মধ্যযুগের দিকে নিয়ে যাচ্ছে ধর্মান্ধ-দুর্বৃত্ত চক্র, অথচ বাধা দেয়ার কেউ নেই। সত্যিই কি নিজের বাড়িতে আগুন না লাগা পর্যন্ত অন্যের বাড়িতে লাগা আগুনের তাপ তো পায় না কেউ?
    ২০১১ স্মরণীয় হয়ে থাকবে আরও নানা কারণে। এ বছরেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়েছে, দু’ ভাগ হয়েছে ঢাকা সিটি করপোরেশন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে। এই বছরেই জনঅভ্যুত্থান ঘটেছে আড়িয়ল বিল রক্ষার দাবিতে। আরেক জনঅভ্যুত্থানে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। দেশের প্রথম নারী মেয়র তিনি।
    ২০১২ সাল নিয়ে আমার প্রত্যাশা বেশি নেই, তবে আশঙ্কা আছে অনেক। রিজার্ভহীন অর্থনীতি, তেলের মূল্যবৃদ্ধি, পণ্যমূল্যের বল্গাহীন দৌড়, শেয়ারবাজারে ধস, সংঘাত-সহিংসতার ক্রমবৃদ্ধি, ক্ষমতার রাজনীতির মরিয়া হুঙ্কার - কোথায় যাচ্ছি আমরা? অতীত ‘বিস্মরণের খেয়া ভরা পালে অকূলে পাড়ি’ দিলেও ভবিষ্যৎ তো ধেয়ে আসে প্রতিক্ষণে?