মঙ্গলবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১২

মেলায় হেলা-ফেলার খেলা

১৯৬২’র শিক্ষা আন্দোলনের পর স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের আন্দোলন এগিয়ে চলে ছাত্র রাজনীতিকে ভিত্তি করে। আয়ুবি শাসনের সেই দিনগুলোতে দলীয় রাজনীতি ছিল রুদ্ধশ্বাস। তাই বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে গণরাজনীতিতে ভূমিকা রাখতে হয়েছে ছাত্র সংগঠনগুলোকেই। বিশেষ করে সচেতনতা সৃষ্টিতে তাদের ওপরই নির্ভর করতে হয়েছে মূলধারার রাজনীতিকে। সকল দলই তাদের ছাত্র সংগঠনগুলোর মাধ্যমে পরিচালনা করতো যাবতীয় উদ্যোগ-আয়োজন। তখন একুশকে ঘিরে চলতো বৃহৎ পরিসরের কর্মকাণ্ড। কারণ এই মহত্ আত্মোত্সর্গের মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে নিজেদের রক্তচক্ষু ঘুরিয়ে রাখতে বাধ্য হতো তত্কালীন সরকার। প্রভাতফেরি, পুষ্পমাল্য / শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ, শোক-স্মরণসভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি তরুণ লেখকদের প্রাণোত্সাহে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে একুশের সঙ্কলন প্রকাশ। সেই সঙ্গে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে রাজনৈতিক সাহিত্য। প্রথমে ছাত্র সংগঠনগুলো, পরে সকল ধরনের সমিতি-সংগঠন, সংস্থা-প্রতিষ্ঠান, পাড়ার ক্লাব পর্যন্ত মেতে ওঠে একুশের সঙ্কলন নিয়ে। শেষে শাসক দল ও তাদের তাঁবেদাররাও যোগ দেয় একুশে চর্চায়। সংবাদ, প্রচার ও প্রকাশনা মাধ্যমগুলোতে কলেবর ও পরিসর ক্রমশ বাড়ে।
’৬২-র শিক্ষা আন্দোলনের পর স্বায়ত্তশাসনের দাবি রূপ নেয় স্বাধিকারের আন্দোলনে। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পর সে আন্দোলন রূপ নেয় স্বাধীনতার সংগ্রামে। একুশকে ঘিরে চর্চা তখন পায় নতুন মাত্রা। ব্যাপকতা। একুশের প্রভাতফেরি শুরু হতে থাকে রাত ১২:০১টা থেকে। অনুষ্ঠান হতে থাকে একাধিক দিন ধরে। একুশের প্রভাতফেরির সময় থেকে ফেরি করে বিক্রি করা হতো একুশের সঙ্কলন। ফেরি হতো রাস্তায়... দোকানে... অফিসে। প্রভাতফেরির পর ভোরে বাংলা একাডেমীতে শুরু হতো সংগীত ও কবিতা পাঠের আসর। সঙ্কলনের লেখক-প্রকাশক-উদ্যোক্তা-বিক্রেতা সকলে ভিড় করতেন সেখানে। সঙ্কলন বেশি বিক্রি হতো ওই সমাবেশের আশপাশে। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে, কাগজ বা চাদর পেতে বিক্রি করতেন অনেকে। আকর্ষণীয় লেখা থাকলে, বিষয়ে বৈচিত্র্য থাকলে, প্রকাশনা উন্নত হলে, আকারে প্রকারে ব্যতিক্রমী হলে সঙ্কলনের সমাদর হতো বেশি, বিক্রিও হতো বেশি। ওই সব সঙ্কলন বিবেচিত হতো সংগ্রহের সামগ্রী হিসেবে।
এভাবে গড়ে ওঠে একুশে সাহিত্য। সঙ্কলনের পাশাপাশি একুশে বিষয়ক কিছু-কিছু বই ও পত্রপত্রিকার বিশেষ সংখ্যাও বিক্রি হতে দেখেছি বাংলা একাডেমী চত্বরে। ১৯৭৪ সালে দেখি সঙ্কলন-সাহিত্যের চূড়ান্ত রূপ। ওই বছর এ নিয়ে বিশেষ প্রচ্ছদ প্রতিবেদন রচনা করে সাপ্তাহিক বিচিত্রা। এর মূল রচনাটি ছিল আমার লেখা।
এরপর বাংলা একাডেমীর  একুশে অনুষ্ঠানের আয়োজন বাড়ে, চত্বরে সঙ্কলন বিক্রির সঙ্গে-সঙ্গে বাড়ে নতুন লেখকদের রচিত ও সম্পাদিত বই। ক্রমে-ক্রমে সঙ্কলন-মেলা রূপ নেয় বইমেলার। তরুণ লেখকদের আয়োজন এক সময় চলে যায় প্রকাশকদের অধিকারে। বইমেলা নামটিই চালু হয়, কিন্তু কলকাতার বইমেলা থেকে আলাদা বোঝাতে ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ নাম রাখে “অমর একুশে গ্রন্থমেলা”। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থাকতেও গ্রন্থমেলার আয়োজক হিসেবে তাদের আত্মপ্রকাশ ও প্রতিষ্ঠার ইতিহাস সংক্ষেপে এ রকমই।
সেই মেলা আজ আমাদের প্রাণসংস্কৃতির এক অংশ। বইকে ঘিরে হলেও এতে যোগ হয়েছে জীবনের কত কিছু। রাজনীতিও জড়িত অনেকখানি। কেবল প্রকাশকদের স্টল তো নয়, প্রকাশকদেরও জাত-কুল বিচারের ব্যাপার আছে। স্টল বরাদ্দে আছে ছোট-বড় বিবেচনার বিষয়। বাদ-বাতিলের ঘটনা আছে। পাশাপাশি স্টল আছে সৌখিন, দল-সংগঠন, মুখচেনাদের। এ ব্যাপারটা আছে আলোচনা-অনুষ্ঠানের আয়োজনেও। সেখানে এ রকম এক রীতি দাঁড়িয়ে গেছে অতিথি-বক্তা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে। ফলে ‘মেলা’ বললেও বেশ হেলা ও ফেলা আছে এখানে। প্রতি বছরই নানা রকম অভিযোগ শোনা যায় মেলার আয়োজন নিয়ে। তবে অজ্ঞাত কারণে মিডিয়ার কোনও আগ্রহ নেই বাংলা একাডেমীর ব্যাপারে। একুশের স্মৃতিবাহী এ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কোনও অনুসন্ধান হয়নি এখনও। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত কিভাবে চলেছে বাংলা একাডেমী, এখন চলছে, এর ভেতরে কি আছে, এর কার্যক্রম বা কর্মকাণ্ড কি-এ সব খুঁটিয়ে-খতিয়ে দেখেনি মিডিয়া। অথচ এর কল্যাণের জন্যই মিডিয়ার অনুসন্ধানী ভূমিকার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। বাংলা একাডেমী তো একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শুধু নয়, একটি একাডেমী। সেখানে একাডেমিক কাজ কি কতখানি হয় বা হচ্ছে তার খোঁজ নেয়া দরকার। ১৯৮৩ সাল থেকে বহু লেখায় আমি উল্লেখ করেছি-‘খাঁটি বাংলা ব্যাকরণ ও বাংলা অভিধান আমাদের নেই। প্রয়োজনীয় গবেষণার মাধ্যমে এ অভাব পূরণের উদ্যোগ নেয়া হোক।’ কিন্তু সে গবেষণা কোথায়? ব্যাকরণ ও অভিধানের কাজ কতখানি কি হয়েছে তা খতিয়ে দেখা দরকার।
গ্রন্থমেলা আয়োজনের কাজ জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের হলেও বাংলা একাডেমীই দেশের সবচেয়ে প্রিয় গ্রন্থমেলাটির আয়োজক। বইয়ের পাঠক ও ক্রেতা যেখানে কমে যাচ্ছে প্রতিদিন সেখানে এমন একটি মেলার বড় প্রয়োজন আমাদের।  স্বাধীনতার পর বলাকা ভবনের ‘বই বিচিত্রা’ যখন ‘পদশোভা’য় পরিণত হয় তখন থেকে আমাদের হতাশা শুরু। তারপর দেখছি নিউ মার্কেটের বইয়ের দোকানগুলি একে-একে বদলে যাচ্ছে ফাস্ট ফুডের দোকানে। স্টেডিয়াম, গুলিস্তান, বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে তেজগাঁও রেলস্টেশন পর্যন্ত অনেক এলাকার বইয়ের দোকানগুলো এখন স্মৃতি মাত্র। আজিজ সুপার মার্কেটের বইয়ের দোকানগুলোও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একে-একে। সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে পোশাক-আশাকের দোকান। বাংলাবাজার ছাড়ছেন পুরনো প্রকাশকেরা, নতুন প্রকাশকেরা সমবেত হচ্ছেন কাটাবনে। তবে অনেক প্রকাশক নিজেদের বই ছাপেন কম, তারা বেশিরভাগ বই ছাপেন লেখকদের অর্থে। সেখানে আবার নানা শর্ত। দরও নানা রকম। খোঁজ নিয়ে জেনেছি-ফরমা প্রতি চার হাজার থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়া হয় লেখকদের কাছ থেকে। আরও নানা রকম দর থাকতে পারে, যা জানতে পারিনি। আবার হাজার দশেক টাকায় পাঁচ-ছয় ফরমার বই ছেপে দেন এমন প্রকাশকও আছেন। অনেকে আবার ১০০ বা ২০০ বই লেখক কিনে নেবেন এ শর্তেও বই ছাপেন। এ নিয়ে অভিযোগও আছে লেখকদের। তারা বলেন, প্রকাশক ১২৫ বা ২২৫ কপির বেশি বই ছাপেন না। প্রচারনা, পরিবেশনা, বেচাবিক্রি করেন না ঠিকমতো। অভিযোগ আছে পাঠকদের দিক থেকেও। লেখকদের অর্থে ছাপানো বইগুলোর প্রকাশনা-মান সাধারণত উন্নত হয় না। বইগুলো সম্পাদিত দূরে থাক ঠিকমতো সংশোধিত (প্রুফ দেখার মাধ্যমে) পর্যন্ত হয় না। পাঠক-ক্রেতারা বলেন, মেলায় এ ধরনের বই-ই বেশি। ফলে প্রতি মেলায় গড়ে হাজার তিনেক নতুন বই এলেও সাহিত্যক্ষেত্রে তেমন প্রভাব পড়ে না, ‘উত্কর্ষ’ বা ‘অবদান’ ধরনের কোনও মূল্যায়নও হয় না।
আর মেলায় বই বেচাকেনা? বেচার ব্যাপারে নানা কায়দা নানা স্টলে। কোনও স্টলে শাড়ির দোকানের বিক্রেতাদের কায়দা। কোনও স্টলে রাস্তার পাশে মাইক লাগিয়ে গছানোর চেষ্টা। টানাহেঁচড়াও চলে কোনও স্টলে। কেনার ব্যাপার আবার একেবারেই আলাদা। অনেকে বই কেনেন লেখকের নাম দেখে। অনেকে কেনেন প্রচারে প্রভাবিত হয়ে। এছাড়া আছে পরিচিত জনের বই কেনার একটা ব্যাপার।
প্রচারের কথা বললাম, কিন্তু মিডিয়ায় মেলার খবর যত প্রাধান্য পায় সেভাবে প্রাধান্য পায় না বইয়ের খবর। না পাওয়ারই কথা। বইয়ের খবর তো বিশারদ ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারও পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। বেশিরভাগ পত্রিকা-চ্যানেল জুনিয়র বা শিক্ষানবিশ সাংবাদিকদের নিয়োগ করে এ কাজে। কয়েকজন লেখকের আর কয়েকটি বইয়ের নাম লিখে কাজ সারেন তারা। এছাড়া আছে নানা রকম তালিকা প্রকাশের নানা রকম ফন্দিফিকির। কিছু ধান্দাবাজ এসব কাজে থাকে নিরন্তর উত্সাহী।
বইমেলার আসল ক্রেতা অল্প আয়ের মানুষ। বই কিনবেন বলে প্রতি মাসে কিছু-কিছু করে টাকা জমান তারা। মেলায় তারা আসেন প্রথম দিন থেকেই, ঘুরেফিরে দেখেন, খোঁজখবর নেন। বাছাই করেন কি-কি বই কিনবেন। মেলার শেষ তিন-চার দিনে কেনাকাটা শেষ করেন তারা। তবে আসলের মধ্যে ভেজালও থাকে কিছু। এমন এক ভেজালের দেখা পেয়েছিলাম গতবার। মেলার শেষ দিনে মুঠো ভরা ৫০০ টাকার নোট নিয়ে ঘুরছিলেন তিনি। এক স্টলের সামনে এসে শুরু করেন হম্বিতম্বি (এ বই দে... ও বই দে! তারপর দাম নিয়ে কি কষাকষি! গাউছিয়া মার্কেটকেও ছাড়িয়ে যায় যেন! তাকে অনুনয় করেও কিছু বলা যাবে না আবার! তিনি নিজেও তো রা-রা করেন, পেছনে এসে জোটা আরেকজন রে-রে করেন আরও বেশি (চিনিস্ ব্যাটা কে? খবরদার, সাবধানে কথা বলবি! এই মেলার হুঁ-হুঁ...! নিজ হাতে বই ফেরি করে এ মেলার জন্ম দিয়েছি... জানিস্? স্টলের বিক্রেতা কাঁচুমাচু হয়ে যায় খুব। সে অন্য বই দেখাতে থাকে বিক্রির আশায়। এর মধ্যে ছিল আমারও একটি বই । বইটা হাতে নিয়ে চেহারা একেবারে খারাপ করে ফেলেন তিনি। বলেন, “এ আবার লেখক? এ তো বাংলাই জানে না!” তবে বইটা কেনেন তিনি। তারপর সবাইকে হতভম্ব বানিয়ে করেন এক অদ্ভুত কাণ্ড। স্টল থেকে একটা বই চট করে হাতের ব্যাগে ফেলে হন-হন করে হেঁটে চলে যান দূরে, মিশে যান ভিড়ে। এত অপ্রত্যাশিত... এত দ্রুত সে ঘটনা যে কেউ হৈহৈ করে ওঠার আগেই তা ঘটে যায়!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন