বৃহস্পতিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

যাহা চাই তাহা...


বিদেশী প্রেমের কবিতা পড়েছিলাম কোথাও। কবির নাম মনে নেই। স্মৃতি থেকে লিখছি, কবিতাটি ছিল এ রকম: ‘বলেছিলে, বৃষ্টি ভালবাসো। কিন্তু বৃষ্টি নামতেই তুমি মেলে ধরলে ছাতা। বলেছিলে, রোদ ভালবাসো। কিন্তু রোদ ছড়িয়ে পড়তেই তুমি খুঁজে নিলে ছায়া। বলেছিলে, বাতাস ভালবাসো। কিন্তু বাতাস ঢেউ তুলতেই তুমি বন্ধ করলে জানালা। তাই ভাবছি, বলেছিলে ? আমাকে তুমি ভালবাসো...।’ ভাবি, এ পরিস্থিতি শুধু প্রেমের নয়। আমাদের জীবন, সমাজ, জাতি, দেশ-ও বারবার দুর্ভোগ-দুর্দশার শিকার হচ্ছে এমন চাওয়া-পাওয়ার বিচিত্র পরিস্থিতিতে, প্রার্থনা ও প্রাপ্তির দ্বন্দ্ব-বিরোধে। এই ‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না’র যে জ্বালা-যন্ত্রণা তার খেসারত আর কত দেবে দেশের মানুষ? সেই ষাটের দশকে একনায়কতন্ত্রের লড়েছি গণতন্ত্রের জন্য। সহজ ছিল না সে লড়াই। এ জন্য মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা আনতে হয়েছে। তারপর সেই সংসদীয় গণতন্ত্র বেশি দিন ভাল লাগে নি আমাদের। একদলীয় প্রেসিডেন্ট-শাসিত পদ্ধতি বহালের চেষ্টা করেছি। সেটা ভাল লাগে নি কাদের, ঘটেছে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। কিছু দিন অনিশ্চয়তার পর স্থিতাবস্থা এলে বলা হলো, এক দলীয় নয় ? আমরা চাই বহুদলীয় গণতন্ত্র। সেটা বহাল হতে না হতে এসে গেল একনায়কতন্ত্র। স্বৈরতন্ত্র। যাঁরা বহুদলীয় গণতন্ত্র চেয়েছিলেন তাঁরা অবশ্য খুব বেজার হলেন না এতে। কিছু দিন দহরম মহরমের পর দাবি উঠলো: স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক। চললো আবার গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম। জনতার বিজয় হলো, পতন ঘটলো স্বৈরাচারের। শুরু হলো গণতন্ত্রের অভিযাত্রা। কিন্তু এবার প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি চাই না, চাই সেই সংসদীয় পদ্ধতি। কিছু দিন পর আবার, উঁহু! চাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। হুড়হাঙ্গামা চললো আবার, তারপর এলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি। কিছু দিন পর এটাও ভাল লাগলো না আমাদের। কাজেই বাতিল। বিদায়। কিন্তু আবার দাবি উঠেছে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চাই। হুজ্জত-হ্যাঙ্গাম এই লাগলো বলে। তো কথা হচ্ছে, এ সব আর কত? এক সরকার পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, খেয়াল-খুশি, কামড়াকামড়ি তো কম হলো না চল্লিশ বছরে, কবে একটা স্থায়ী পদ্ধতি আমরা পাবো দুনিয়ার আর সকল সভ্য দেশের মতো? দেশ জাতি জনগণের তো আরও কাজ আছে, নাকি? তাদের কষ্ট ক্লেশ যন্ত্রণা বাড়িয়ে, তাদের রক্ত অশ্রু ঘাম মাড়িয়ে, আর কত বাজাতে হবে অপরাজনীতির জয়ডঙ্কা? অন্নকে আক্রা করে, বস্ত্রশিল্পে শোষণ চালিয়ে, বাসস্থানে ঘুঘু চড়িয়ে, শিক্ষাঙ্গনকে রণাঙ্গন করে, হাসপাতালকে পাতাল বানিয়ে অর্থ ও অস্ত্রের এই খেয়োখেয়ি কি চলতেই থাকবে? সবই চলে কিন্তু দেশ ও জাতির স্বার্থে, জনগণ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে! এখানেও শরণ করতে হয় রবীন্দ্রনাথকে। তিনি লিখেছেন, “রাষ্ট্রহিতৈষার চেষ্টাবেগ যতই বাড়িতে থাকে ততই সত্য-মিথ্যা ন্যায়-অন্যায়ের বুদ্ধি তিরোহিত হইতে থাকে। ইতিহাসকে অলীক করিয়া, প্রতিজ্ঞাকে লঙ্ঘন করিয়া, ভদ্রনীতিকে উপেক্ষা করিয়া, রাষ্ট্রমহিমাকে বড় করিবার চেষ্টা হয়; অন্ধ অহঙ্কারকে প্রতিদিন অভ্রভেদী করিয়া তোলাকেও শ্রেয় বলিয়া বোধ হইতে থাকে...।”
এরপর আর কোনও কথা থাকতে পারে না আমার।

বৃহস্পতিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

সবই আছে, কিছুই নেই

চারপাশে চোখ মেলে তাকালে দেখি, সবই আছে আমাদের। কি নেই? একটু ভাবতে গিয়ে দেখি, কিছুই নেই। আর বেশি ভাবতে গেলে মনে হয় এই ‘নেই’টাই শুধু আছে আমাদের। যেন মুঠো আছে ভরা, কিন্তু খুলতেই নেই। এ এক ‘নেই আছে’র দেশ বুঝি! এখানেই কি থাকি আমরা?
আমাদের রাজনৈতিক দল আছে, জোট আছে, কিন্তু রাজনীতি নেই। আছে দলাদলি, কোন্দল, দখল, সংঘাত, সহিংসতা, খেয়োখেয়ি আর খুনোখুনি। দল আছে, শৃঙ্খলা নেই। নেতা-নেত্রী আছেন, নেতৃত্ব নেই। ভোগ আছে, ত্যাগ নেই। পরিকল্পনা আছে। আছে বলতে কল্পনাটুকু, পরি নেই। তা উড়ে বা উবে যায়।
আমাদের আছে সুরম্য সংসদ ভবন। লুই কান-এর বিশ্বখ্যাত এ স্থাপত্যকীর্তি ‘ইষ্টকে গীতিকাব্য’ নামে নন্দিত বন্দিত। কিন্তু এ সংসদ অচল। নির্বাচনে যারা পরাজিত হন তারা বর্জন করেন একে। অশ্রাব্য গালাগালি, ছোড়াছুড়ি, তেড়েমেরে ধাওয়া ইত্যাদিরও চর্চা হয় এখানে। আর নির্বাচন? তা নিয়ে অভিযোগ আছে, সমাধান নেই। তাই বলতে হয় ? কারচুপি আর চরদখল আছে, নির্বাচন নেই। নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতি আছে, ঘোষণা আছে, ইশতেহার আছে সকল দলের। নির্বাচনের পর? আর কোনও কথা নেই। সব বেমালুম ভুলে গিয়ে সবাই একেবারে ভুলো!
আমাদের শিক্ষাঙ্গন আছে, শিক্ষা নেই। প্রায়ই রণাঙ্গন হয়ে ওঠে তা। দলাদলি, দখল, মারপিট, খুন, শ্লীলতাহানির ঘটনা নিয়মিত খবর হয়ে আসে সংবাদপত্রে। সেখানে আরও আছে ভুয়া জাল জালিয়াতির কারবার। ভুয়া সারটিফিকেট, ডিগ্রি, ভর্তি ছাড়াও আছে ডোনেশন দুর্নীতি। আমাদের সরকারি হাসপাতাল আছে, দরকারি চিকিৎসা নেই। সেখানে ডাক্তার-নার্স মেলে না সময়মতো। তবে দলাদলি আছে, তা কখনও খুনোখুনি পর্যন্ত গড়ায়। আমাদের সড়ক আছে, সংস্কার নেই। দুর্ঘটনা আছে, প্রতিকার নেই। আমাদের ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, অপহরণ, গুমখুন আছে। বিচার নেই। আমাদের ভক্ষক আছে, রক্ষক নেই। আমাদের বেড়া খায় আমাদের বাগান। বন-মালী হয় বন-খেকো।
খুব জানতে ইচ্ছা করে কেন সব থাকতে কিছু নেই আমার। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - “... বঙ্গদেশ গোঁফে-তেল গাছে-কাঁঠালের দেশ। যত বড় না মুখ তত বড় কথার দেশ। পেটে পিলে কানে কলম ও মাথায় শামলার দেশ।... এখানে বিচিগুলাই তেরো হাত হইয়া কাঁকুড়কে অতিক্রম করিয়া ওঠে।... বাঙালি জাতির... সাহস হয় না, আশা হয় না, উদ্যম হয় না।... আমাদের শরীর অপটু, বুদ্ধি অপরিপক্ব, উদরান্ন ততোধিক।... কেবল দলাদলি, কেবল ‘আমি আমি আমি’ এবং ‘অমুক অমুক অমুক’ করিয়াই মরিতেছি। আমাকে এবং অমুককে অতিক্রম করিয়াও যে দেশের কোনও কাজ, কোনও মহৎ অনুষ্ঠান বিরাজ করিতে পারে, ইহা আমরা মনে করিতে পারি না। এইজন্য আপন আপন অভিমান লইয়াই থাকি। আমাকে বড় চৌকি দেয় নাই, অতএব এ সভায় আমি থাকিব না - আমার পরামর্শ জিজ্ঞাসা করে নাই, কাজেই ও কাজে আমি হাত দিতে পারি না - সে সমাজের সেক্রেটারি অমুক, অতএব সে সমাজে আমার থাকা শোভা পায় না - আমরা কেবল এই ভাবিয়াই মরি। সুপারিশের খাতির এড়াইতে পারি না, চক্ষুলজ্জা অতিক্রম করিতে পারি না, আমার একটা কথা অগ্রাহ্য হইলে সে অপমান সহ্য করিতে পারি না।... আমরা কেবল ঘরে বসিয়া বড় কথা লইয়া হাসি-তামাশা করিতে পারি, বড় লোককে লইয়া বিদ্রূপ করিতে পারি... আমরা না পড়িয়া পণ্ডিত, আমরা না লড়িয়া বীর, আমরা ধাঁ করিয়া সভ্য, আমরা ফাঁকি দিয়া পেট্রিয়ট - আমাদের রসনার অদ্ভুত রাসায়নিক প্রভাবে জগতে যে তুমুল বিপ্ল্লব উপস্থিত হইবে আমরা তাহারই জন্য অপেক্ষা করিয়া আছি, সমস্ত জগৎও সেই দিকে সবিস্ময়ে নিরীক্ষণ করিয়া আছে।...”
সেই কবে, ১৮৮৭ সালে, লেখা এ সব কথা। উদ্ধার করতে গিয়ে কিছু যোগ-বিয়োগ করা গেল না এই ১২৫ বছর পরেও!

রবিবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

বই বিষয়ক বিড়ম্বনা

অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র দ্বিতীয় সপ্তাহ চলছে বাংলা একাডেমী চত্বরে। গ্রন্থ বা মেলা যে রকমই হোক প্রচারনার অভাব নেই মিডিয়ায়। সে প্রচার অবশ্য বরাবর যা হয় তা-ই - তেলে জবজবে মাথায় আরও গ্যালন-গ্যালন তেল। সস্তা বাণিজ্যিক বইয়ের সরব রটনা, অথচ খবর নেই গুরুত্বপূর্ণ জরুরি বইপত্রের। আর খবর নেই প্রকাশনার ভেতরকার খবরের। বইয়ের এত দাম কেন, মুদ্রণ ও প্রকাশনা ব্যয় এত বেশি কেন - এ সব তলিয়ে দেখতে রাজি নন কেন। কালি, কাগজ, মুদ্রণ-সংশ্লিষ্ট সামগ্রী-সরঞ্জামের ওপর কি পরিমাণ কর ধার্য করেছে সরকার, তা অন্যান্য দেশের তুলনায় কত কম বা বেশি তার হিসাব খতিয়ে দেখা দরকার। প্রকাশনার ক্ষেত্রে আরও যে সমস্যা গুরুতর হয়ে উঠেছে তা নিয়ে লিখেছিলাম এই কলামে।  ‘মেলায় হেলা-ফেলার খেলা’ শিরোনামে দিন পনেরো আগে প্রকাশিত ওই লেখায় উল্লেখ করেছিলাম: “অনেক প্রকাশক নিজেদের বই ছাপেন কম, তাঁরা বেশির ভাগ বই ছাপেন লেখকদের অর্থে। সেখানে আবার নানা শর্ত। দরও নানা রকম। খোঁজ নিয়ে জেনেছি - ফরমা প্রতি চার হাজার থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন- নেয়া হয় লেখকদের কাছ থেকে। আরও নানা রকম দর থাকতে পারে, যা জানতে পারি নি। আবার হাজার দশেক টাকায় পাঁচ-ছয় ফরমার বই ছেপে দেন এমন প্রকাশকও আছেন। অনেকে আবার ১০০ বা ২০০ বই লেখক কিনে নেবেন এ শর্তেও বই ছাপেন। এ নিয়ে অভিযোগও আছে লেখকদের। তাঁরা বলেন, প্রকাশক ১২৫ বা ২২৫ কপির বেশি বই ছাপেন না। প্রচারনা, পরিবেশনা, বেচাবিক্রি করেন না ঠিকমতো। অভিযোগ আছে পাঠকদের দিক থেকেও। লেখকদের অর্থে ছাপানো বইগুলোর প্রকাশনা-মান সাধারণত উন্নত হয় না। বইগুলো সম্পাদিত দূরে থাক ঠিকমতো সংশোধিত (প্রুফ দেখার মাধ্যমে) পর্যন- হয় না। পাঠক-ক্রেতারা বলেন, মেলায় এ ধরনের বই-ই বেশি। ফলে প্রতি মেলায় গড়ে হাজার তিনেক নতুন বই এলেও সাহিত্যক্ষেত্রে তেমন প্রভাব পড়ে না, ‘উৎকর্ষ’ বা ‘অবদান’ ধরনের কোনও মূল্যায়নও হয় না।”
    বিষয়টি নিয়ে পীড়িত ও ভাবিত অনেকেই। ক’দিন আগে এ নিয়ে এক নোট দিয়েছেন কবি জুলফিকার শাহাদাত। ওই নোটে তিনি যা লিখেছেন তা মোটামুটি এ রকম:
    লিখে কিছু আয়-উপার্জন করেন এ দেশে এমন লেখক আছেন হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র। বেশির ভাগ লেখকই কিছু পান না তাঁর লেখার বিনিময়ে। তাঁদের শ্রম, মেধা থাকে উপেক্ষিত। প্রতি বছর বহু লেখক বিভিন্ন প্রকাশকের মাধ্যমে বই প্রকাশ করেন নানা শর্ত মেনে নিয়ে।  নগদ অর্থে বা নির্দিষ্ট সংখ্যক বই কেনার শর্তে রাজি হতে হয় তাঁদের। তারপর তাঁরাই আবার নিজেদের বইয়ের বিজ্ঞাপক, বিপণনকারী, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ বিক্রেতাও। বইয়ের বিক্রি বাড়াতে, বিজ্ঞাপিত করতে তাঁরা মেলায় যান গাঁটের টাকা খরচ করে, আর মেলা শেষে ফেরেন খালি হাতে। তারপরও আছে নানান ভোগানি-। সে সব ভোগানি-র মধ্যে আছে নির্দিষ্ট সময়ে বই না আসা, প্রতারণার শিকার হওয়া, বই না পাওয়া ইত্যাদি।
    জুলফিকার শাহাদাত যথেষ্ট ক্ষুব্ধ হয়েই লিখেছেন, “যে প্রকাশকের দু’ লাইন শুদ্ধ বাংলা লেখার ক্ষমতা নেই তাঁর কাছ থেকে শুনতে হয় নানা হিতোপদেশ। আর বইমেলা শুরু হলে তাঁর টিকিও আর খুঁজেও পান না লেখক। তখন প্রকাশকের সেলফোন বন্ধ থাকবে অথবা অজস্র মিথ্যা কথার খৈ ফোটাবেন তিনি। কারণ লেখকদের টাকায়, শ্রমে, ঘামে বই ছাপিয়ে তিনি তখন বিরাট প্রকাশক। মুনাফা ও মূলধন দু’টোই তাঁর হাতে। মিডিয়ায় তাঁর প্রকাশনার কত ফিরিসি-। নিজেও মিডিয়ার সামনে পিছনে মুখ দেখিয়ে বাহবা নেন কত। আর লেখকরাও চেপে যান টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করা বুকের কষ্টগুলো। নইলে যে তাঁর লেখককৃতির বেলুন ফুটো হয়ে যায় আবার। এই হলো পরিসি'তির নির্মমতা। অল্প ক’জন ব্যতিক্রমকে বাদ দিলে বেশির ভাগ প্রকাশকের ক্ষেত্রে একই রকম অভিযোগ ওঠে প্রায়ই।” তিনি মনে করেন, এ অবস'ার পরিবর্তনের জন্য লেখকদের সংগঠিত হওয়া প্রয়োজন। নিজেদের টাকা, শ্রম ও ঘাম দিয়ে, এত কষ্ট করে, অন্যকে দিয়ে বই প্রকাশের দরকার কি? নিজেদের বই নিজেরা প্রকাশ, নিজেরা প্রচার করলেই ভাল।
    জুলফিকার শাহাদাত উদ্যোগী মানুষ। তাই লেখকদের মালিকানায় সমবায় ভিত্তিক প্রকাশনা গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছেন এর মধ্যে। একটি চুক্তিপত্র সম্পাদনের মাধ্যমে এ প্রকাশনার শেয়ারহোল্ডার হওয়া যাবে।
    এ ধরনের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাতে হয়, সেই সঙ্গে ভাবতে হয় এর বাস-বায়ন ও সাফল্য সম্পর্কে। বই লেখা, ছাপা ও প্রচারের কাজ ভালই পারেন অনেক লেখক, কিন' সব লেখক কি পারেন? তারপর আছে প্রকাশিত বইয়ের বিক্রির জন্য শোরুম, সংরক্ষণের জন্য গুদাম, পরিবেশনা, ব্যবস'াপনা, হিসাবনিকাশ প্রভৃতি। এ সব কাজ সুষ্ঠু ভাবে করা পেশাদার ছাড়া সম্ভব নয়। আশা করি জুলফিকার শাহাদাত বিষয়টির সামগ্রিকতা বিবেচনায় নিয়েই উদ্যোগী হয়েছেন।
    প্রকাশনায় লেখকদের জড়ানো নতুন কোনও ঘটনা নয়। রবীন্দ্রনাথকে নিজের বই নিজেরই ছাপার ব্যবস'া করে নিতে হয়েছে। নজরুল-ও ছেপেছেন নিজের বই। কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে মঈনুদ্দীন (আলহামরা লাইব্রেরী), আহসান হাবীব (কথাবিতান), সিকান্‌দার আবু জাফর (সমকাল প্রকাশনী), আবু জাফর শামসুদ্দীন (কিতাবিস-ান), আকবর হোসেন, মোস-ফা কামাল (বুক সোসাইটি), গোলাম রহমান, কাজী আনোয়ার হোসেন (সেবা প্রকাশনী), মইনুল আহসান সাবের (দিব্য প্রকাশ) প্রমুখ কমবেশি সাফল্য অর্জন করেছেন প্রকাশক হিসেবে। পশ্চিমবঙ্গে ‘মায়াবী’ খ্যাত পাঁচকড়ি দে, ‘দস্যু মোহন’ খ্যাত শশধর দত্ত, মনোজ বসু (বেঙ্গল পাবলিশার্স), গজেন্দ্রকুমার মিত্র ও সুমথনাথ ঘোষ (মিত্র ও ঘোষ) প্রমুখের সাফল্য অজানা নয় কারও। তবে লেখক সমবায় সাফল্য পেয়েছে বলে শোনা যায় নি এখনও। আমি নিজে কয়েকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি, পশ্চিমবঙ্গেও এমন নজির আছে ব্যর্থতার। প্রকাশনা সংস'া ‘ভারবি’ প্রথমে কয়েকজন লেখকের সামবায়িক উদ্যোগেই গড়ে উঠেছিল। সে সমবায় টেকে নি বেশি দিন। এ অবস'ায় জুলফিকার শাহাদাতকে এগোতে হবে অনেক ভেবেচিনে-। আমার মতে, যদি প্রকাশক ও লেখকদের যৌথ সমবায় গড়ে তোলা যায় তবে সেটাই হতে পারে এক আদর্শ প্রকাশনা ও বিপণন উদ্যোগ। প্রকাশকদের চাই লেখক, লেখকদের চাই প্রকাশক। দু’জনের চাওয়া মিলিয়ে হতে পারে কোনও সফল প্রয়াস।
    দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে বলে যাঁরা ভেবেছিলেন বইয়ের পাঠকসংখ্যাও বাড়বে তাঁদের সে ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। অবসর বিনোদনের বিভিন্ন মাধ্যমের চমৎকারিত্ব যে শনৈঃ শনৈঃ গতিতে বেড়েছে, সে গতিতে বাড়ে নি বইয়ের প্রতি আকর্ষণ বা পাঠাভ্যাস। সংবাদপত্র, চলচ্চিত্র, টেলিভিশিন, কমপিউটার, ইনটারনেট, গেমস, ফেসবুক, সেলফোন - সবই গত ১০০ বছর ধরে দখল করে নিচ্ছে বই পড়ার সময়টুকু। নিত্য-নিত্য বাড়ছে এগুলোর নানারকম বৈচিত্র্য। বইয়ের মধ্যে কি ওই হারে বাড়ছে কোনও চমৎকারিত্ব? বরং বইয়ের নামে ‘অখাদ্য’ই বেশি ছাপা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায় পাঠক-পাঠিকাদের কাছ থেকে। এমন অভিযোগ সে কালেও ছিল। সেই কবে ইংরেজ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স (১৮১২-১৮৭০) লিখেছেন, “There are books of which the backs and covers are by far the best parts” (অনেক বই আছে সামনে-পিছনের মলাট / প্রচ্ছদ যেগুলোর সেরা অংশ)। তাঁর সমকালীন আমাদের মধুসূদন-ও আবর্জনা-সাহিত্যের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে পুস-ক পোড়াতে বলেছিলেন চণ্ডালের হাত দিয়ে, পুড়িয়ে ভাসিয়ে দিতে বলেছিলেন কীর্তিনাশার জলে। কাজেই আমাদের চাই ভাল বই। ১৯৯৬ সালে কলকাতার বইমেলার স্লোগান ছিল ‘আরও বই কেনো’। সে স্লোগান সম্পর্কে উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, “আরও বই কেনো - খুব ভাল কথা; কিন' ভাল বই কেনো - আরও ভাল কথা।... ভাল বই বলতে আমি বোঝাতে চাচ্ছি সৎ বই - অর্থাৎ সুলিখিত সাহিত্য-শিল্পসমৃদ্ধ বই, অসৎ বস'র মালিন্য থেকে যে বই মুক্ত। এবং অসৎ বস' অর্থে আমি বলতে যাচ্ছি সেই সমাজবিরোধী অশ্লীল কার্যকলাপের অপরিমিত বিলসন, যা পাঠকচিত্তকে খুশি যত না করুক, তাকে বহু গুণ করে উত্তেজিত।”
    ‘ভাল’ বইয়ের জন্য তাই ‘ভাল’ লেখক, প্রকৃত লেখক চাই। সাহিত্যশিল্পী চাই। লেখক সমবায়ে যদি আমলেখক  ঢুকে পড়ে তবে উদ্দেশ্য যত মহৎই হোক তা ব্যাহত হতে বাধ্য। লেখকদের সকলই লেখক নয়, আছে লেখক নামধারী অনেকে। শৌখিন, প্রচারপাগল, খ্যাতির কাঙাল, ধান্দাবাজ নানা রকম চরিত্র ভিড় করে আছে লেখক-অলেখকদের মাঝে। সেখান থেকে বেছে নিতে হবে খাঁটি শিল্পসাধককে।
    বই সম্পর্কে একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করবো এ আলোচনা। ২০০৩ সালে কলকাতা’র ‘বর্তমান’ পত্রিকায় প্রকাশিত শ্যামল চক্রবর্তী’র নিবন্ধ থেকে এ উদ্ধৃতি:
    “টিভি নয়, কমপিউটার নয়, শেষ ভরসা বলুন অথবা শেষ বন্ধু দি আলটিমেট ফ্রেন্ড, সেই বই-ই। পড়তেই হবে, কেননা বিকল্প নেই। নিজের মনের মধ্যে নিত্য নতুন ‘জ্ঞানচক্ষু’ ফোটাতে নিজের মধ্যে ‘একান- জগৎ’ তৈরি করে দিতে পারে না কমপিউটার, পারে শুধু বই। যত বাড়বে ‘জ্ঞানচক্ষু’, নতুন-নতুন জগৎ তৈরি হবে মনে বই পড়তে-পড়তে, তত কমবে হতাশা, উদ্বেগ। পার্থিব শোকতাপ, দুঃখযন্ত্রণা, না-পাওয়া, মান-অপমান ভুলে থাকা সহজ হবে ততই। সহজে গায়ে লাগবে না জীবনের হাজারটা আঘাত, ওঠানামা। বিশুদ্ধ আনন্দ পেতে, আনন্দ আর দুঃখকে একই রকম অবিচল থেকে মেনে নিতে শিখতে টিভির দিক থেকে ঘোরাতেই হবে মুখ বইয়ের দিকে।... দয়া করে কেনা বইগুলোকে ঘর সাজানোর সামগ্রীতে পরিণত করে ফেলবেন না। ‘স্ট্যাটাস’ বাড়ানো ছাড়াও বইয়ের কাজ অনেক। বই যে অমূল্য।... ওমর খৈয়ামের সেই কথাগুলো মাথায় রাখুন, ‘মদ রুটি ফুরিয়ে যাবে, ঘোলাটে হয়ে আসবে প্রিয়ার কালো চোখ, বই তবু চিরযৌবনা - যদি তেমন বই হয়।’...”

শনিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

আমার বাংলা ভাষা

গত শতকের প্রথম চার দশকে পাঠকপ্রিয়তায় শীর্ষস্থানীয় লেখক ছিলেন পাঁচকড়ি দে (১৮৭৩-১৯৪৫)। তিনি লিখতেন অপরাধ কাহিনী। শরৎচন্দ্রের সামাজিক উপন্যাসের পাশাপাশি তাঁর লেখা কালফণী, কালসর্পী, কুলীনকন্যা, গোবিন্দরাম (১৯০৫), ছদ্মবেশী, জয়-পরাজয় (১৯০৭), জীবন্মৃত-রহস্য, নরবলি, নরাধম, নীলবসনা সুন্দরী (১৯০৪), ভীষণ প্রতিশোধ, ভীষণ প্রতিহিংসা, পরিমল, প্রতিজ্ঞা-পালন (১৯০৭), বিদেশিনী, বিষম-বৈসূচন, মনোরমা, মরিয়ম, মায়াবিনী, মায়াবী, মৃত্যু-বিভীষিকা, মৃত্যুরঙ্গিণী, রঘু ডাকাত, রহস্য-বিপ্লব, লক্ষ-টাকা (১৯০৮), শকদুহিতা, শোণিততর্পণ, সতী সীমনি-নী, সহধর্ম্মিণী, সুহাসিনী (১৯০৮), সেলিনা সুন্দরী, হত্যাকারী কে?, হত্যা-রহস্য, হরতনের নওলা প্রভৃতি গোয়েন্দা উপন্যাস এবং বাঙ্গালীর বীরত্ব, নন্দবংশোচ্ছেদ, সিরাজদ্দৌলা, কৃষ্ণযাত্রা, ঢপ কীর্ত্তন প্রভৃতি গ্রন্থ বিক্রি হয়েছে দেদার। তাঁর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পাল ব্রাদার্স ও ছাপাখানা বাণী প্রেস থেকে এ সব বইয়ের একের পর এক সংস্করণ ছাপা হয়েছে বছরের পর বছর ধরে। বস্তুত শ্রীকান্ত, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, কাশীনাথ, মহেশ, মহিম, সুরেশ, বিপ্রদাস প্রমুখের পাশাপাশি পাঁচকড়ি দে’র অক্ষয়কুমার, অমরনাথ দে, অরিন্দম বসু, জয়মল্ল, দেবেন্দ্রবিজয় মিত্র, ধনদাস পাকড়াশী, নগেন্দ্রনাথ, ফতেহ আলি, রাজীবলোচন প্রমুখ গোয়েন্দাও ছিলেন সেকালের পাঠকমহলে বিশেষ ভাবে আলোচিত ব্যক্তিত্ব।
    ভাবে ভিন্ন হলেও পাঁচকড়ি দে ভাষা ও নির্মাণে ছিলেন বঙ্কিম-বিদ্যাসাগরের অনুসারী। নমুনা হিসেবে “হত্যাকারী কে?” উপন্যাস থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি এখানে:
    “... জ্যোৎস্নাপ্লাবনে নক্ষত্রোজ্জ্বল নির্মেঘ আকাশ কর্পূরকুন্দধবল। অদূরবর্ত্তিনী প্রবহমানা তটিনীর সুমধুর কলগীতি অস্পষ্ট শ্রুত হইতেছিল।... প্রদীপের আলো আসিয়া সেই উপবিষ্টা স্ত্রীলোকের অধিলুলিতচিবুক, প্রকটগণ্ডাস্থি অরক্তাধর ম্রিয়মাণ মুখের একপার্শ্বে পড়িয়াছে।... লীলার সেই শরন্মেঘমুক্তচন্দ্রোপম স্মিত মুখমণ্ডল রৌদ্রক্লিষ্ট স্থলপদ্মের ন্যায় একান্ত বিবর্ণ এবং একান্ত বিষণ্ন। সেই ফুল্লেন্দীবরতুল্য স্নেহপ্রফুল্ল্ল আকর্ণবিশ্রান্ত চক্ষু কালিমাঙ্কিত! বিষাদ-বিদীর্ণ হৃদয়ে লীলাকে দেখিতে লাগিলাম - ক্ষণেকে আমার আপাদমস্তক স্বেদাক্ত হইল।...”
    পাঁচকড়ি দে’র সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় রহস্য উপন্যাস “মায়াবী” থেকেও নমুনা হিসেবে কিছুটা উদ্ধৃত করা যায় এখানে:
    “... প্রকোষ্ঠ সকল ভগ্ন, মলিন, আবর্জ্জনাবহুল, মনুষ্যসমাগম-চিহ্নবিরহিত। সেই নির্জ্জন ভাঙাবাড়ীর অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার কোন একটা প্রকোষ্ঠে অনিন্দিতগৌরকান্তি স্নিগ্ধজ্যোতির্ম্ময়রূপিনী অনতীতবাল্যা একটি বালিকা নীরবে অশ্রুবর্ষণ করিতেছিল। মণিষিক্তপদ্মবৎ তাহার মুখ অশ্রুপ্লাবনে একান্ত মলিন; তাহার লাবণ্যোজ্জ্বল দেহ কালিমাবৃত এবং কঙ্কালাবশেষ।... সেই আয়ত চক্ষুর মধুরোজ্জ্বল লীলাচঞ্চল দৃষ্টি সেই ম্লানমুখখানিতে এক অননুভূতপূর্ব্ব সৌন্দর্য্য বিকাশ করিয়া রাখিয়াছিল।... সেই বিষাদমেঘাচ্ছন্ন মলিন অশ্রুবিবর্ণীকৃত মুখখানি ঢাকিতে লাগিল।... বালিকা একদৃষ্টে দেখিতেছিল, দৃষ্টি-সীমায় স্নিগ্ধোজ্জ্বল রক্তাভ-নীলিমাময় বেলাপ্রান্তে কেমন ধীরে ধীরে আরক্তরবি ক্রমশঃ ডুবিয়া যাইতেছিল; এবং আরও কিছুদূরে কি ভয়ঙ্কর মুর্ত্তিতে নিবিড় মেঘমালা গোধূলির হেমকিরণপরিব্যাপ্ত দিক্‌চক্রবালে আকাশের সেই মধুর কোমলচ্ছবি ব্যাপিয়া, পুঞ্জীকৃত হইয়া, সতূপীকৃত হইয়া অল্পে অল্পে চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িতেছিল। ... অদূরস্থিত প্রচুর ভিন্ন জাতীয় সদ্যঃপ্রস্ফুট বন্যকুসুমের স্নিগ্ধ পরিমল একত্রে মিশিয়া, সেই সংমিশ্রণে আরও মধুর হইয়া, এক অপার্থিব উপহারবৎ নিদাঘসায়াহ্নসমীরণ বহিয়া যেখানে সেই রোরুদ্যমানা, ধূলিধূসরিতা, বিগলিতাশ্রুনয়না, বিপদ্‌-বিহ্বলা বালিকা প্রস-রগঠিতের প্রায় একখানি মূর্ত্তিমান্‌ দুঃখের জীর্ণ ছবিটির মত, নীরবে ঈষদুত্তোলিত মুখে দাঁড়াইয়া ছিল, সেইখানে সেই অলোকসম্ভবারূপিণী কিশোরীর চারিদিকে বিস্তৃত হইতেছিল। দূর বনান্তর হইতে কোন কোন মধুরকণ্ঠ পাখীর অমৃতবর্ষিণী কলকণ্ঠগীতি সেই বালিকার নিকটবর্ত্তী সকল স্থানই মুখরিত করিয়া রাখিয়াছিল।...”
    এক শ’ বছর আগের ‘পপুলার লিটারেচার’-এর ভাষা এই! এর অনেক শব্দ ও শব্দবন্ধ অব্যবহারে অপ্রচলিত এখন। এসবের অর্থ বুঝতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হবে একালের অনেক পাঠকের। আর কেউ যদি কষ্ট করে অভিধান হাতড়াতে যান, তবে ওই খোঁজাখুঁজি ঘাঁটাঘাঁটিই সার হবে তাঁর। এ কারণে পাঁচকড়ি দে’র ব্যবহৃত অনেক শব্দের অর্থ বাক্যে প্রয়োগ দেখে বুঝে নিতে হয়:
    ক. রমণী সলজ্জভাবে ভূন্যস্তদৃষ্টিতে দাঁড়াইয়া রহিল। (মাটির দিকে তাকানো, চোখ নিচু করা)
    খ. হুজুরীমল বড় বাজারের মধ্যে একজন জানিত লোক। (জানাশোনা, সুপরিচিত)
    গ. ... নিজের হস্তাবমর্ষণ করিতে করিতে... (হাত কচলানো)
    ঘ. ... তাঁহার অমোঘ একজ্ঞায়িতার শোচনীয় পরিণাম... (একগুঁয়েমি)
    ঙ. ... প্রকৃতিস্থ হইয়া দেখিলাম, অয়ষ্কঙ্কণে আমার হস্তদ্বয় শোভিত... (লোহার হাতকড়া, হ্যান্ডকাফ)
    চ. অনন্তবিধ চিন্তায় তাঁহার মস্তিষ্ক পূর্ণ হইয়া গেল। (অসংখ্য রকম)
    ছ. আকাশে মেঘ, তনিম্নে অন্ধকার... (তার নিচে)
    জ. অবক্তব্য হইলেও আমি তাহা আপনাকে বলিব। (বলার মতো নয়)
    ঝ. ... ঘন ঘন উভয় করতল নিষ্পীড়ন করিতে লাগিলেন। (কচলানো)
    ঞ. ... সেই মনের কথাগুলি স্বহস্তস্থিত লিপির ন্যায় পাঠ করিলেন। (নিজের হাতে থাকা)
    ট. ... তদুভয়ের মধ্যে কে প্রকৃত মিথ্যাবাদী। (তারা দু’জন)
    ঠ. ... পশ্চাদ্ভাগে হাত দুইখানি গোট করিয়া ... (জোড়)
    সেকালের ‘পপুলার’ লেখক থাক, একালের ‘পপুলার’ কবি জীবনানন্দ দাশেরও অবস্থা একই। তাঁর “রূপসী বাংলা” তো বটেই, অন্যান্য কাব্যগ্রন্থেও ব্যবহৃত অনেক শব্দ, শব্দবন্ধ, নাম এখনও, এই এতগুলো বছর পরও, অভিধানে খুঁজে পাওয়া কঠিন। অক্ষান্ত, অবলেশ, উত্তরসামরিকী, কানসোনা, শিশুসূর্য, শাদাছিট, ছুঁয়ে ছেনে, সময়গ্রন্থি, কিন্নরকণ্ঠ, খোড়ো, গিরেবাজ, মচকাফুল, বেরিন, শঙ্খিনীমালা, ধানসিড়ি, উত্তেজ, তনুবাত, তক্ষিত, তুণ্ডসমীচীন, থ্যাঁতা, অন-র্দান, ঊষাপুরুষ, স্বতরুৎসারা, মরখুটে, মনোবীজ, মর্ত্যনারকী, সৃষ্টিবিসারী, নিপল, পুষ্পসেনী, প্রাণরণন, রেণুসূর্যশিখা, ব্রহ্মশব্দ, ফিরেফিরতি, ছাতকুড়ো, জননীতিক, জনমানুষ, পাখিনী, বালিছুট, কর্মোরেন্ট, তলতা, চাপেলী, টেঁশে (যাওয়া), একভিড়, পায়রাচাঁদা, লিঙ্গশরীরী, মিরুজিন, শকুন্ত-ক্রান্তি, পররতিময়, মঞ্জুভাষা, সৎবিজ্ঞাতা, ধ্বক, এঁটিলি, গেৎসিমানি, মধুকূপী, মলয়ালী - এমন অনেক শব্দ কি হারিয়ে যাবে একদিন? এ শব্দগুলি জীবনানন্দের কবিতায় এসেছে ৬০-৭০ বছর আগে, আর ৩০-৪০ বছরের মধ্যে এগুলোও কি ‘জানিত’ থাকবে আর?
    সকল কবিই শব্দচয়নে গভীর মনোযোগী, সৃষ্টিশীল। তাঁরা “শবদে শবদে বিবাহ” দিয়ে নতুন-নতুন সাঙ্কেতিক ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেন ভাব, ভাষা ও নির্মাণের শিল্পে। তাই কেবল জীবনানন্দ নন - মধুসূদন, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, কায়কোবাদ, রবীন্দ্রনাথ, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, সত্যেন্দ্রনাথ, যতীন্দ্রনাথ, মোহিতলাল, শাহাদাৎ হোসেন, নজরুল, সুধীন্দ্রনাথ, অমিয় চক্রবর্তী, জসীম উদ্‌দীন, আবদুল কাদির, বুদ্ধদেব, বিষ্ণু দে, ফররুখ আহমদ প্রমুখ যাঁরা অনেক অবদান রেখেছেন শব্দশিল্পে - তাঁদের সে সব সৃষ্টি এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে। কিন্তু চর্যাপদ থেকে আজ পর্যন্ত পাওয়া কোনও বাংলা শব্দই হারাতে দিতে রাজি নই আমরা। হাজার বছরের বাংলা কবিতায়, সাহিত্যে ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দই তো বাংলা ও বাঙালির সম্পদ, ঐশ্বর্য।
    কিন্তু এ সম্পদ আমরা রক্ষা করবো কিভাবে?
    অভিধান বা কোষগ্রন্থের কথাই বলবো আমরা। এ ক্ষেত্রে চাইবো খণ্ডে-খণ্ডে সম্পাদিত বৃহৎ অভিধান। বলবো নানা ধরনের বিশেষায়িত অভিধান প্রণয়নের কথা। রবীন্দ্র-অভিধান, নজরুল-অভিধান, জীবনানন্দ-অভিধান প্রভৃতির কথাও বলবো আমরা।
    কিন্তু কাজটি করবেন কে বা কারা?
    বছরের একটি মাসে বাংলা ভাষার জন্য যে গর্বিত জনতা প্রভাতফেরি ও গ্রন্থমেলায় যান, শহিদ মিনারে দীর্ঘ সারি বেঁধে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেন, বইপত্র-সঙ্কলন প্রকাশ করেন, অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন, পাজামা পানজাবি চাদর পরেন, কেমন একটা ইয়ে হয়ে যান বাংলা-বাঙালি করে-করে - তাঁরা কি ভূমিকা রাখবেন কোনও? কিংবা এ মাসের আবেগকে কাজে লাগিয়ে প্রকাশ ও প্রচার জগতের যাঁরা কোটি-কোটি টাকার বাণিজ্য করছেন, তাঁরা কি কোনও না কোনও ভাবে সহায়তা দেবেন এ কাজে? “খবরের কাগজের ঔদার্য, প্রভাবশালী বন্ধুগোষ্ঠী, রেডিও-টিভি ইত্যাদির অকৃপণতা এবং পত্রপত্রিকার পিঠচাপড়ানি পেয়ে অনেকেই” যাঁরা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি জগতের প্রবাদপুরুষ হয়ে উঠেছেন, এগিয়ে আসবেন কি তাঁরা? বাংলা নাম ধারণকারী যত সংগঠন, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, দপ্তর - তাঁরা কি করবেন কিছু? মাত্র একদিনের কোনও একটি বিশেষ ঘটনার স্মৃতি নিয়ে - সবাই নন, তবে অনেকে যাঁরা আজীবন ভাষাসৈনিক হয়ে আছেন, তাঁরা কি প্রমাণ দেবেন কথায় না কাজে?
    আসলে নানা ধরনের অনেক অভিধান দরকার আমাদের। খাঁটি অভিধান দরকার। খাঁটি বাংলা ব্যাকরণ দরকার। বানানে শৃঙ্খলা দরকার। কেজো পরিভাষা দরকার। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, ব্যাকরণ, ছন্দ, অলঙ্কার প্রভৃতির কোষগ্রন্থ দরকার। অনুবাদ কেন্দ্র দরকার - আমাদের কীর্তিকর্ম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য। আমরা বিদেশ থেকে ভাল-মন্দ অনেক কিছু অনুবাদ করে ছাড়ছি আমাদের বাজারে, কিন্তু আমাদের বাজার থেকে কোনও কিছু পাঠাতে পারছি না বিদেশের বাজারে। তবে প্রশ্ন তো সেই, কাজটি করবেন কে বা কারা?
    খাঁটি অভিধানের কথা বলছি, কেমন হবে তা? ২০০০ সালের ২১শে ফেবরুয়ারিতে প্রকাশিত মানবজমিন-এর বিশেষ সংখ্যায় লিখেছিলাম - এ জন্য প্রয়োজন: (১) প্রতিটি ভুক্তির গঠনগত, অন্বয়গত ও বাগর্থগত বিবৃতি; (২) শব্দ-নির্বাচনে হাজার বছরের ঐতিহ্য সন্ধান; (৩) বর্ণক্রমের সমস্যা সমাধান; (৪) অর্থনির্দেশ - প্রতিশব্দ, সংজ্ঞার্থ, ব্যাখ্যা, শব্দার্থ পরিবর্তন, ব্যুৎপত্তিগত অর্থ / বাচ্যার্থ, রূঢ়ি / যোগরূঢ় অর্থ, বাক্যে শব্দের প্রয়োগ; (৫) বানান; (৬) উচ্চারণ (আন-র্জাতিক ধ্বনিলিপি অনুযায়ী)। অভিধানে “বিদেশী” শব্দের ধারণাটিও স্পষ্ট থাকা দরকার। যে শব্দ বেশির ভাগ বাঙালি বোঝেন তাকে বাংলা শব্দ হিসেবে গ্রহণে আপত্তি থাকার কথা নয় কারও। তবে “সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে বাংলা অভিধান-প্রণয়নের কতকগুলি সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে। ভাষাবিজ্ঞান-চর্চার অগ্রগতির জন্য অভিধান বা শব্দকোষ সম্পর্কে ধারণাও কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। তাই আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের আলোকে অভিধান-প্রণয়নের ব্যাপারটি পর্যালোচনা করে দেখবার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বানান, বর্ণক্রম, অর্থনির্দেশ প্রভৃতি বিষয়ে নতুন-নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থিত হয়েছে। সেগুলি সম্পর্কে রীতিমতো অভিনিবেশ দরকার।” (সুভাষ ভট্টাচার্য, ‘বাংলাভাষা চর্চা’, ১৯৯২)
    খাঁটি বাংলা ব্যাকরণ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা সম্ভব নয় এখানে। তবে একটি উদ্ধৃতি, কিছুটা দীর্ঘ হলেও, দেবো: “... আক্ষেপের কথা, আজ পর্যন- যথার্থ বাংলা ব্যাকরণ একখানিও লেখা হয়ে ওঠে নি।... বহুকাল পর্যন্ত যে সব ব্যাকরণ রচিত হয়েছে সে সবই বলতে গেলে সংস্কৃত ব্যাকরণের আদলে এবং সংস্কৃত ব্যাকরণের আধারে বাংলা ব্যাকরণ। এই ব্যাকরণ বাংলা ভাষার ব্যাকরণ নয়। তা বাংলা ভাষার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলোকে ব্যাখ্যা করতে বা সেগুলোকে বুঝতে কোনও সাহায্যই করে না।... ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ‘ভাষাপ্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ (১৯৩৯) নামে যে ব্যাকরণ-গ্রন্থটি লিখলেন তাতে পুরোপুরি মুখের ভাষার ব্যাকরণই যে পাওয়া গেল তা নয় অবশ্য, তবে এই প্রথম সংস্কৃত ব্যাকরণের আওতা থেকে কিছুটা বেরিয়ে এলো বাংলা ব্যাকরণ - কিছুটা, কিন্তু পুরোপুরি নয়। কতকগুলো ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী প্রথাগত ব্যাকরণকে অনুসরণ করেছেন তিনিও। তবু এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে তাঁর ওই ব্যাকরণই প্রথম পদক্ষেপ। জ্যোতিভূষণ চাকী’র ‘বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’ (১৯৯৬) প্রকৃতপক্ষে ব্যাকরণচিন্তার বই।... পবিত্র সরকার ‘পকেট বাংলা ব্যাকরণ’ (১৯৯৪) নামে একখানা অতি কৃশকায় বই লিখেছেন বাংলা ব্যাকরণ বিষয়ে। বলতে কোনও দ্বিধা নেই যে এই প্রথম খাঁটি বাংলা ভাষার ব্যাকরণের একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা পাওয়া গেছে। তবে একই সঙ্গে বলবো এটি রূপরেখা মাত্র। এই রূপরেখা অনুসরণ করে তিনি নিজে কিংবা অন্য কোনও যোগ্য ব্যক্তি যদি পূর্ণাঙ্গ বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনা করেন, তবে তাতে বাঙালি মাত্রেই উপকৃত হবেন। বাংলা ভাষার বিধিবদ্ধতার দিকে সেটা হবে এক দীর্ঘ দৃঢ় পদক্ষেপ।” (সুভাষ ভট্টাচার্য, “বাংলা ভাষার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ”, ২০০০)
    বাংলা বানান প্রসঙ্গে বলতে হয়, এ নিয়ে সমস্যা এখনও অনেক। আশির দশকের প্রথম দিকে ড. আহমদ শরীফের উদ্যোগে এবং মুহম্মদ হাবিবুল্লাহ’র তৎপরতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশ ভাষা সমিতি’। এর আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে এক সেমিনারের আয়োজন করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  শিক্ষক-ছাত্র কেন্দ্রে। ওই সেমিনারে আমি একটি প্রবন্ধ পড়ি। বানান-বিভ্রাট, বানানভেদ, বিকল্প বানানের আধিক্য ইত্যাদি সমস্যা কিভাবে বাংলা ভাষাকে যাবতীয় যথেচ্ছাচারের শিকার করে তুলছে - তা তুলে ধরি তাতে। কিছু অভিন্ন বানান চালু করা নিয়ে কিছু প্রস্তাবও করি প্রসঙ্গত। আলোচকদের মধ্যে আমার বক্তব্য সমর্থন করে এবং প্রস্তাবের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ মতামত দেন বশীর আলহেলাল ও ড. হুমায়ূন আজাদ। পরে এ ক্ষেত্রে যথোচিত উদ্যোগ নিতে বশীর আলহেলালের নেতৃত্বে এক কমিটি গঠন করে সমিতি। তবে আমার স্থান হয় না ওই কমিটিতে।
যাহোক, এর কয়েক বছর পর পাঠ্যপুস্তকে বাংলা বানানে ‘সমতা বিধানের লক্ষ্যে’ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস-ক বোর্ড-এর উদ্যোগে কুমিল্ল্লা’য় এক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৮ সালের ২১-২৩ অকটোবর। ওই কর্মশালায় গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ড. আনিসুজ্জামানের সম্পাদনায় “পাঠ্য বইয়ের বানান” (নভেম্বর, ১৯৯২) নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে বোর্ড। ওই পুস্তিকায় নির্দেশিত নিয়ম অনুসারে সেই থেকে ছাপা হচ্ছে বোর্ডের যাবতীয় পাঠ্য বই। পরে বাংলা বানানকে অভিন্ন ও প্রমিত করার উদ্যোগ নেয় বাংলা একাডেমী। তাদের “প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম” প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে। এর পরিমার্জিত সংস্করণ ১৯৯৪ সালের জানুয়ারি এবং সংশোধিত সংস্করণ ২০০০ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত হয়। তবে এ নিয়ম প্রচলনের ক্ষেত্রে কোনও কার্যকর উদ্যোগ নেয় নি একাডেমী। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস-ক বোর্ড, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় দৈনিক ও টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ, প্রকাশক সমিতি এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মহলের সঙ্গে তাদের আলোচনা-পরামর্শ হওয়া জরুরি।
    বিদেশী নামের বানান কোন নিয়মে লিখবো? প্যারিস, প্রাগ, বেইজিং, সারাজেভো, আলবেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া লিখবো - নাকি লিখবো পারি, প্রাহা, পেইচিং, সারায়েভো, স্কিপেরা, হ্রবস্কা? ঐশ্বর্যা লিখবো না ঐশ্বরিয়া? Jimenez কি জিমেনেজ না হিমেনেথ? Cicero কি সিসেরো না কিকেরো? এ সম্পর্কে পণ্ডিতজনের পরামর্শ: “যে সব বিদেশি নামের তদ্দেশীয় উচ্চারণ আমাদের জানা আছে সেগুলির সেই অনুসারে প্রতিবর্ণীকরণ করে অন্যান্য নাম ইংরেজি উচ্চারণ অনুসারে বাংলায় প্রতিবর্ণীকরণ করা অন্যায় নয়। এটা কোনও কুনীতিও নয়, এটা স্বাভাবিক। দীর্ঘকাল ধরে বহু দেশে এই রীতিই চলে আসছে।” (সুভাষ ভট্টাচার্য, “বিদেশি নামের উচ্চারণ ও বাংলা প্রতিবর্ণীকরণ”, ১৯৯২) এ পরামর্শ নেয়া যায় বলে আমি মনে করি।
    তবে বানান প্রমিতকরণের কাজ এখনও বেশ বাকি। কি না কী, কার্তিক না কার্ত্তিক (< কৃত্তিকা), বর্ধন না বর্দ্ধন, বার্ধক্য না বার্দ্ধক্য (দ্বিত্ব নয়), আচার্য (যাতে আচার ধরা থাকে, কাগজ, বই) না আচার্য্য (যাতে আচার্য ধরা থাকে, শিক্ষক) - এ সব ছাড়াও প্রশ্ন আছে অনেক। উজ্জ্বল, উর্ধ্ব, উচ্ছ্বাস প্রভৃতি শব্দে ব-ফলা কি অপরিহার্য? এ রকম তিন অক্ষরে যুক্ত শব্দগুলোকে দু’ অক্ষরে যুক্ত রাখলে দোষ কি? লক্ষ্মণ, লক্ষ্মী তো অন্য ভাষায় লছমন, লছমি হয়ে গেছে; আমরা কি লক্ষণ / লকখন, লক্ষী / লকখি লিখতে পারি না? যক্ষ্মাকে যক্ষা লিখলে কি রক্ষা থাকবে না? পঙ্‌ক্তি, আকাঙ্ক্ষা, দ্বন্দ্ব, তীক্ষ্ণ, সত্ত্ব, সন্ন্যাসী, সন্ধ্যা, সূক্ষ্ম, বৈশিষ্ট্য, দারিদ্র্য, স্বাতন্ত্র্য - এ সব শব্দ কি ক্রমশ নির্ভার  হবে না অন্য অনেক শব্দের মতো?  গুণী, মন্ত্রী প্রভৃতি শব্দের দু’ রকম বানান কেন? গুণী লিখতে ঈ-কার, কিন্তু গুণিসম্মাননায় ই-কার। একই ভাবে মন্ত্রী ঈ-কার, কিন্তু মন্ত্রিত্ব, মন্ত্রিপরিষদ, মন্ত্রিবর, মন্ত্রিবৃন্দ, মন্ত্রিমণ্ডল, মন্ত্রিসভা - সবখানে ই-কার কেন?
    পরিভাষা প্রসঙ্গে বলতে হয়, সরকারি নিয়ম, বিধি, সিদ্ধান্ত, প্রস্তাব প্রভৃতি যে সব ইংরেজিতে ছিল সেগুলো বাংলাতে করে চলেছে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের “বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ”। এই কোষে কাজ করেছি বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে। সে হিসেবে ধারণা করি, তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সাফল্যের সঙ্গেই তাঁরা শেষ করেছেন ইতিমধ্যে। এ কাজ করতে গিয়ে অনেক পরিভাষা তৈরি করে নিতে হয়েছে তাঁদের। ‘সাচিবিক’ বাংলা নিয়ে যতই ঠাট্টা-মশকরা করি না কেন ওই কোষের কৃতিত্বকে খাটো করে দেখার উপায় নেই কোনও। তারপরও ‘ইনজাংশন’-এর বাংলা কি? আদেশ, হুকুম, নিষেধাজ্ঞা না আসেধাজ্ঞা? ‘প্রোভোকেশন’ কি উসকানি না উৎক্ষোভন? ‘সাবোটাজ’ না ‘অন্তর্ঘাত’ লিখবো? ‘টিরেসট্রিয়াল’ না ‘স্থজল’ লিখবো? অনেক বিদেশী শব্দকে আমরা বাংলা করে নেবো তা ঠিক, তারপরও পরিভাষা প্রণয়নের প্রয়োজন থেকে যাবে। লেখক-সাংবাদিকদের এ প্রয়োজনে পড়তে হয় প্রতিদিন। ওই প্রয়োজন থেকেই ‘বর্ষপত্র’, ‘সমরপ্রভু’, ‘মাদকপ্রভু’, ‘কূটনীতিক’, ‘লাগসই প্রযুক্তি’, ‘টেকসই উন্নতি’ প্রভৃতি অনেক নতুন শব্দ ও  প্রয়োগ উপহার দিয়েছে সাপ্তাহিক বিচিত্রা (১৯৭৬-৮২) - যাতে, বলতেই হয়, বিশেষ ভূমিকা ছিল আমার।
    সর্বস্তরে বাংলা চালু করার স্লোগান রীতিমতো আক্রমণাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল স্বাধীনতার পর-পর, ১৯৭২-৭৩ সালে। ওই উগ্রতার প্রতিবাদ করেছি যথাসাধ্য। তখন আমি করটিয়া’র সা’দত কলেজের অধ্যাপক, পাশাপাশি টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সংকেত-এর সম্পাদক। এ পত্রিকাটির প্রকাশক ছিলেন বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা সদ্যপ্রয়াত শামসুর রহমান খান শাহজাহান। সম্পাদকীয় লিখে, সভা-সেমিনারে যোগ দিয়ে, ক্লাশে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছেও বলেছি: সর্বস্তরে বাংলা চালু করার স্লোগানটি উৎকট জাত্যাভিমানী। এ দেশে অন্যভাষী জাতি আছে আরও। মায়ের ভাষার প্রতি তাঁদের ভালবাসা কম নয় আমাদের চেয়ে। বাংলা অনেক বেশি স-রে চালু করা প্রয়োজন, কিন' সকল স-রে তা সম্ভব নয় - উচিত নয়। আন-র্জাতিক ক্ষেত্রে অন্যান্য ভাষার সহায়তা নিতে হবে আমাদের; স্বদেশেও সহায়তা দিতে হবে অন্যান্য ভাষাকে - বিশেষ করে পিছিয়ে আছে যে সব ভাষা। প্রয়োজনে ওই সব ভাষার জন্য লিপি, বর্ণমালা থেকে ব্যাকরণ পর্যন্ত সবই তৈরি করার কাজে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের।
    এ প্রতিবাদের অনেক প্রতিবাদ হয়েছে তখন। কঠোর সমালোচনা হয়েছে নানা মহল থেকে। বিস্তর নিন্দা ও কুৎসাও জুটেছে একই সঙ্গে। তবে দমি নি কখনও। এ বিষয়ে বলেছি ও লিখেছি উপলক্ষ পাওয়া মাত্রই। শেষে একদিন কথা বলি বাংলা একাডেমী’র তৎকালীন পরিচালক, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের সঙ্গে। বিষয়টি তিনি গ্রহণ করেন গুরুত্বের সঙ্গে। পরে মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে এক বিশেষ আয়োজন করে বাংলা একাডেমী। এর উদ্দেশ্য ছিল দেশের অন্যভাষীদের মাতৃভাষা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা, এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার উদ্যোগ নেয়া। সে আয়োজনে যাওয়া হয় নি আমার, ডাক দেন নি কেউ। এর আগে সাহিত্যকোষ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অভিধান প্রভৃতি প্রণয়নের ব্যাপারে প্রস্তাব রেখেছিলাম বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালকের কাছে, তৎকালীন চেয়ারম্যান কবি শামসুর রাহমান তাতে জোর সুপারিশ করেছেন বলে জানিয়েছিলেন। শেষে কিছু একটা হয়েছে বলে শুনেছি, কি হয়েছে তা জানতে পারি নি আর।
    বাংলা ভাষার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হয় আশির দশকের মধ্যভাগে। ডেস্কটপ পাবলিকেশন (ডিটিপি) রীতিমতো চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে প্রকাশনা জগতে। তবে শহীদলিপি, মইনুললিপি থেকে আজকের ‘বিজয়’ পর্যন- যে উত্তরণ এর প্রাণপুরুষ অবশ্যই মোস্তাফা জব্বার, তবে এই  উত্তরণের সূচনালগ্নে অত্যন- প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করেছে রতনলিপি, উদয়নলিপি ও পাক্ষিক তারকালোক। ডিটিপি’র অবদান হিসেবে মোস্তাফা জব্বারের ‘আনন্দপত্র’ পথিকৃৎ হলেও এর প্রথম সার্থক ব্যবহার ঘটে ‘তারকালোক’-এ (১লা অকটোবর, ১৯৮৭)। যথোচিত পৃষ্ঠাসজ্জার মাধ্যমে সেই প্রকাশনা রাতারাতি জনপ্রিয় করে তোলে ডিটিপিকে।  ‘আনন্দপত্রে’র এক সম্পাদকীয়তে এ কৃতিত্বের স্বীকৃতি দিয়ে বলা হয়েছিল, এই সাফল্য ছাড়া সম্ভব ছিল না ডিটিপি’র দ্রুত উত্থান। পরে অবশ্য সবাই বেমালুম চেপে যান বিষয়টি। তাহলেও ‘তারকালোক’ পরিবারের প্রধান আরেফিন বাদলের উদ্যোগ ও আয়োজন, সম্পাদক  হিসেবে আমার এবং আমার দুই সহকারী মবিন খান ও নূরজাহান বেগমের শ্রম ও নিষ্ঠা একেবারে অস্বীকৃত থাকবে - তা আমি মনে করি না।
    বাংলা ভাষার জন্য কাজ করে তারকাখ্যাতি পেয়ে সাড়া জাগাবেন কেউ - তা সম্ভব নয়। এ বিষয়টিই শোরগোল করার জন্য, এর কাজ নিয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই কারও। এজন্যই অনেক প্রকৃত কর্মোদ্যোগী সংগঠন-সমিতির মতো আমার প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র’-এরও উদ্যোগে গত চার-পাঁচ বছর ধরে যত গঠনমূলক কাজকর্ম হয়েছে তা তেমন দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে নি অনেকেরই। অবশ্য মিডিয়া ও পাবলিকের চোখে পড়তে চাইলে ইয়া গোঁফ, দাড়ি, বাবড়ি ও বাঁদরামি দরকার। এর কারণ - “... শান্ত শমিত পরিকল্পিত জীবনচর্চার মানুষদের আমরা দূর থেকে সম্ভ্রমের চোখে দেখি - অনুসরণ করার কথা ভাবি না। আমাদের পক্ষপাত বিশৃঙ্খল, উড়নচণ্ডী, পরিকল্পনাহীন মানুষদের দিকে। শরৎচন্দ্র, নজরুল, ঋত্বিক ঘটক, রামকিঙ্কর, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার সম্পর্কে মানুষের দুর্বলতার অন্ত নেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবিতকালে ততটা জনপ্রিয় ছিলেন না, ছিলেন যেন সুদূর নক্ষত্রের মতো। বরং আমজনতার চোখের মণি ছিলেন শরৎচন্দ্র ও নজরুল। অনেকে সত্যজিতের চেয়ে ঋত্বিককে পছন্দ করেন এবং তাঁকে উন্নততর প্রতিভা বলে বিশ্বাস করেন। যে নদী মরুপথে বিলীন হয়ে যায় তাকে কে না ভালবাসে? আমাদের কালেই দেখেছি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের চেয়ে কাব্যপাঠকের বেশি অনুরাগ ছিল সমর সেনের প্রতি - কেননা তাঁর কাব্যধারা ব্যাহত এবং তিনি ছিলেন তির্যক দৃষ্টিকোণের পরিহাসপ্রবণ কবি। নন্দলাল ও বিনোদবিহারীর চেয়ে রামকিঙ্কর অনেক বেশি সমাদৃত তাঁর অদ্ভুত যাপন আর অসামাজিক অবস্থানের কারণে। গায়কদের মধ্যে মান্না দে’র চেয়ে কিশোর কুমার সমকালের শ্রোতাদের মধ্যে অনেক বেশি গৃহীত, কারণ তাঁর ক্ষ্যাপামি ও গানের সঙ্গে গলার কারদানি - অথচ ভাল করে গানবিদ্যাটাই তো তিনি আয়ত্ত করেন নি কোনও দিন। শীর্ষেন্দু ও মতি নন্দী’র চেয়ে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে অনেকে পছন্দ করতেন, কেননা শ্যামল অদ্ভুত কথা বলতেন, চমৎকার মিশুকে ছিলেন, খারাপ কথা বলতেন নির্বিকারভাবে। কবি হিসেবে সুনীল অনেক ভারসাম্যময়, কিন্তু শক্তিও তুল্যমূল্য বড় কবি - কিন্তু তাঁর দিকেই পাল্লা ভারি। তার কারণ শক্তি সম্পর্কে প্রচুর মিথ বাজারে চালু ছিল, তাঁর মদ্যপানজনিত কাণ্ডকারখানার পল্ল্লবিত বিবরণ ব্যাপক প্রচারিত। অনেক সময় তাই মনে হয়, এই মিথের ফলে তাঁর কবিতা তেমন করে পড়া হয় নি। বিনয় মজুমদার কি ততটা পঠিত, যতটা তাঁর অসুস'তা বা তাঁর মানস বিপর্যয় নিয়ে রটিত?” (সুধীর চক্রবর্তী, “ঘরানা বাহিরানা”, ২০০৭)
    সবশেষে বলি, বাংলা ভাষায় পড়ালেখার জন্য আরও দু’টি -কার দরকার: অ-কার ও অ্যা-কার। অ-কার না থাকায় ‘কেরল’ (কবৎধষধ = কের’ল’)-কে  ‘কেরালা’ লেখেন অনেকে, যাতে ‘কেরল্‌’ উচ্চারণ না করেন কেউ। উচ্চারণ জানা না থাকায় অনেকে তারাব, বেলাব, আমলাব, উসলাব প্রভৃতিকে বলেন তারাব্‌, বেলাব্‌, আমলাব্‌, উসলাব্‌। এ সমস্যা মেটাতে ‘বাসাব’, ‘জিরাব’  হয়েছে ‘বাসাবো’, ‘জিরাবো’। অবসান, অবতার, অবগত, অবহিত, অনিকেত, নরসিংদি, মেঘনাদ, মেঘদূত, প্রস'ত, বস'ত, খড়গ, ওয়াকফ, প্রগলভ, মত, হত প্রভৃতি শব্দের উচ্চারণে বিভ্রানি- দূর হবে অ-কার থাকলে। আরও উদাহরণ দেয়া যায় এ সমস্যার। এখানে দিচ্ছি না সে সব। ্যা-কার সমস্যারও উদাহরণ দেবো না বেশি। য-ফলা -য় আ-কার  দিয়ে লেখায় সমস্যা হচ্ছে অনেক। এক ‘ব্যাখ্যা’র উদাহরণ থেকেই বোঝা যায় তা। ‘ব্যা’+‘খ্যা’ হলেও আমরা এর উচ্চারণ করি ‘ব্যাক্‌খা’।
অনেকে বলবেন, এ সব কাজে এগিয়ে আসা চাই সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের । অনেকে বলবেন, একাডেমিক কাজ বাংলা একাডেমীর করা উচিত। কিন্তু এ দেশে যাঁর যা কাজ তিনি কি তা করতে পারেন? বাংলা একাডেমীকে আয়োজন করতে হয় গ্রন্থমেলা, পুরস্কার, সাংস্কৃতিক  অনুষ্ঠান এবং আরও কত কি। অথচ গ্রন্থমেলার জন্য জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, পদক-পুরস্কারের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে বিশেষ কমিটি আছে, সাংস্কৃতিক আয়োজনের জন্য শিল্পকলা একাডেমী আছে।  যে ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের কোনও যোগাযোগ নেই - সেই চর্যাপদ আবিষ্কারের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে বর্ণাঢ্য বিশেষ সংখ্যা বের করতে হয় - সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড প্রচারের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের মুখপত্র “সচিত্র বাংলাদেশ”কে! (“... ২০০৭ সালে চর্যাপদ আবিষ্কারের শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলায় অনেক কিছুই হতে পারতো। নীরব দেখছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগও। এই প্রেক্ষাপটেই সচিত্র বাংলাদেশ ফেব্রুয়ারি ২০০৮-এর প্রথম পর্বের সংখ্যায় চর্যাপদ আবিষ্কারের ১০০ বছর উপস্থাপনা।...”) এ উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠান এর আগে, ২০০৭ সালের ৪ঠা সেপটেম্বর, গোয়েটে ইনস্টিটিউট-ও করেছিল। অথচ এ ধরনের একটি আয়োজনকে প্রকৃত অর্থে অর্থবহ করে তুলতে পারতো প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় জাদুঘর, এসিয়াটিক সোসাইটি, ইতিহাস পরিষদ এবং বলাই বাহুল্য - গত ৮৭ বছর ধরে যাঁদের সোৎসাহ প্রযত্নে পঠনপাঠন চলছে চর্যাপদের - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই বাংলা বিভাগ, সেই সঙ্গে সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের বাংলা বিভাগগুলো। মনে হয় ভবিষ্যতে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের “নিরীক্ষা”কে ছাপতে হবে কবিতা আর জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের “বই” পত্রিকায় স্থান পাবে যাবতীয় অর্থনৈতিক সমীক্ষা। 

বৃহস্পতিবার, ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

খেই

সাযযাদ কাদির ব্যতিক্রমী কবি, বহুমাত্রিক লেখক। শিল্পচর্চায় তিনি নিরীক্ষাপ্রবণ, নতুনত্ব ও বৈচিত্র্যের সতত সন্ধানী। ষাটের দশকে কবিতার পাশাপাশি তাঁর ভিন্নধর্মী গল্প চমৎকৃত করেছিল পাঠকদের, পরে লিখেছেন ছোট উপন্যাস। সেগুলোর বেশির ভাগই রয়ে গেছে পত্রপত্রিকার বিশেষ সংখ্যায়, বই আকারে বেরিয়েছে শুধু ‘অপর বেলায়’, ‘অন্তর্জাল’ আর ‘খেই’। ‘অপর বেলায়’ যাত্রাদলের শিল্পীদের নিয়ে লেখা বাংলাদেশের প্রথম উপন্যাস। ‘অন্তর্জাল’ - যা ইনটারনেট-এর প্রতিশব্দ - তা অন্তর্জালিক বয়নে রচিত বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস। ‘খেই’ ওই অর্থে পথিকৃৎ না হলেও ভাব, ভাষা, নির্মাণে অবশ্যই ব্যতিক্রমী। এ উপন্যাসের কাহিনী যাকে নিয়ে আবর্তিত  তার নাম শাইখ। সে ভালমানুষ, তবে অত নিপাট ভালমানুষ নয়। তারপরও তার সামান্য জীবন কাটে নানা রকম বিভ্রম আর বাস্তবের সঙ্গে বোঝাপড়া করে। এক সকালে তার ভাঙা নড়বড়ে বাসায় হাজির হয় এক চরমপন্থি গলা-কাটা নেতা, দুপুরে আসে এক সন্ত্রাসী টপটেরর, আর সন্ধ্যার পর ঢুকে পড়ে এক বিকারগ্রস্ত লুচ্চা। একা নয়, লুচ্চার সঙ্গে আসে এক নিলাজ রমণী। যেন ঘূর্ণিস্রোতে পড়ে যায় শাইখ। ক্রমশ তলিয়ে যেতে থাকে সে অবিশ্বাস্য পরিণতির দিকে এগিয়ে চলা রুদ্ধশ্বাস ঘটনাপ্রবাহের পাকচক্রে।
    ‘খেই’ প্রকাশ করেছে অগ্রদূত (মেলায় স্টল নং ৬২৭)।

বুধবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

শেষ প্রচ্ছদ, ফ্ল্যাপ ও অন্যান্য

ছেলেবেলায় রঙ-রঙিন সব কিছুই ভাল লাগতো বেশি,  তারপরও রবীন্দ্রনাথের বই ভাল লাগতো সাদামাটা প্রচ্ছদেই। হলদেটে বা নীলচে মোটা কাগজে লাল বা খয়েরি রঙে বইয়ের নাম, একই রঙে রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরিত নাম, পেছনের প্রচ্ছদে ওই একই রঙে দেবনাগরী লিপিতে প্রকাশকের  নাম (‘বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ’) এবং মূল্য। শরৎচন্দ্রের বইয়ের প্রচ্ছদও ছিল ওই রকমই। বাড়তি ছিল তাঁর ছবি। সে ছবি প্রচ্ছদে থাকলে স্কেচ, ভেতরে থাকলে আলোকচিত্র। বিশেষ কারণ ছিল ওই ছবি সংযোজনের। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৮২-১৯৪৫) নামে আরেকজন লেখক যথেষ্ট পাঠকপ্রিয় ছিলেন একই সময়ে। মাসিক গল্পলহরী (১৯৩০-১৯৪১)-র সম্পাদক ছিলেন তিনি, উপন্যাস লিখেছেন কমপক্ষে ১১টি - শান্তিজল, জয়পতাকা, চাঁদমুখ, মুখরক্ষা (১৯২২), পথের সন্ধান (১৯২৫), শুভলগ্ন (১৯২৬), সুপ্রভাত (১৯২৭), বারুণী, যৌতুক, বৈরাগ্যের পথে, অভিমানিনী। এগুলোর মধ্যে ‘চাঁদমুখ’ ছিল সেরাকাটতি। সে কাটতি ছাড়িয়ে যায় ১৯১৭-১৯২০ সালে প্রকাশিত ‘দেবদাস’, ‘চরিত্রহীন’, ‘শ্রীকান্ত’, ‘দত্তা’, ‘গৃহদাহ’, ‘বামুনের মেয়ে’কেও। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন শরৎচন্দ্র ও তাঁর প্রকাশক। তাঁরা কথা বলেন সম্পাদক শরৎচন্দ্র ও তাঁর প্রকাশকের সঙ্গে। কিন্তু কেউই রাজি নন পিতৃদত্ত নাম পরিবর্তনে। না ‘চাঁদমুখ’ শরৎচন্দ্র, না ‘চরিত্রহীন’ শরৎচন্দ্র। অনেক শলাপরামর্শের পর বইয়ে ছবি সংযোজনের প্রস্তাব ওঠে শেষে। কিন্তু দু’জনেরই মুখে দাড়ি। ছবিতে কি আলাদা করে চেনা যাবে অত? শেষে বড় শখের ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ির মায়া ছাড়তে হয় শরৎচন্দ্রকে। সেই থেকে তাঁর ক্লিনশেভ মুখের ছবি শোভা পাচ্ছে প্রতিটি বইয়ে।
    প্রচ্ছদে রাবীন্দ্রিক-শরৎচন্দ্রীয় ধারা সীমিত পর্যায়েই আছে এখনও। মুদ্রণ ও বাঁধাই প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে-সঙ্গে প্রচ্ছদ হয়ে ওঠে বর্ণাঢ্য ও বোর্ড-মজবুত। মনে পড়ে দেব সাহিত্য কুটীরের বইগুলোর কথা। তাদের প্রতিটি বইয়ের প্রচ্ছদ ছিল, এখনও আছে, সিনেমার পোস্টারের মতো। এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে বই-প্রকাশনায়। এ প্রভাব অমন ব্যাপক হয়ে আছে এখনও। তবে তাদের মূর্ত রীতির প্রচ্ছদের পাশাপাশি ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে প্রচ্ছদ বিমূর্ত অঙ্কনের চমৎকারিত্ব। কলকাতায় সত্যজিৎ রায় ও পূর্ণেন্দু পত্রী, ঢাকায় কাইয়ুম চৌধুরী, কালাম মাহমুদ, আশীষ চৌধুরী খ্যাতি পান এ ধারার প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে। এঁরা পাঠকরুচির সঙ্গে-সঙ্গে পালটে দেন দর্শকরুচিকেও।
    প্রচ্ছদ নিয়ে শিল্পী, লেখক ও প্রকাশকদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিল বরাবরই। বই ও লেখক সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য তাঁরা নানাভাবে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন বইয়ের মলাটে। ষাট-সত্তর দশকে শেষ প্রচ্ছদে বেশ সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে পরিচয় উল্লেখের বিষয়টি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল খুব। ওই লেখাগুলো লেখকেরাই লিখে থাকেন সাধারণত। এর ব্যতিক্রমও আছে। প্রকাশকও নিজে অথবা কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নেন ওই পরিচিতি। যেমন, জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রনে'র ১৯৭৬ সালের সংস্করণের শেষ প্রচ্ছদের লেখা:
রবীন্দ্রোত্তর যুগের
অসামান্য কবি
জীবনানন্দ দাশ
যদি কোনও একটি মাত্র গ্রন্থে
তাঁর সার্থকতম পরিচয়
রেখে গিয়ে থাকেন
সে গ্রন্থ ‘বনলতা সেন’।
তাঁর কাব্যের প্রধান গুণ
রবীন্দ্রনাথের ভাষায়
‘চিত্ররূপময়’।
‘প্রসন্ন বেদনায় কোমল উজ্জ্বল
বড়ই নতুন এবং নিজস্ব
তাঁর লেখা: বাংলা কাব্যের
কোথাও তার তুলনা পাই না।’
এই বলে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন
অমিয় চক্রবর্তী।
একক ভাবে শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ
‘বনলতা সেন’-এর
এটি দ্বাদশ সংস্করণ।
    একটি ভুল আছে এই পরিচিতিতে। সংস্করণটি দ্বাদশ নয়, ত্রয়োদশ।
    একই ধারার পরিচিতির আরেকটি নমুনা দিচ্ছি এখানে। এটি ছিল কবি নরেশ গুহ-এর কাব্যগ্রন্থ ‘দুরন্ত দুপুর’-এর ১৯৬৯ সালে দ্বিতীয় মুদ্রণের শেষ প্রচ্ছদে:
তরুণতরদের মধ্যে
সবচেয়ে
সুরেলা কবি
নরেশ গুহ,
বলেছে কবিতা পত্রিকা।
ছন্দের
বিচিত্র ব্যবহারে,
সুরের
একান্ত নিজস্বতায়
তিনি বিশিষ্ট।
বাংলা কবিতার
সামপ্রতিক অবক্ষয়
যাঁদের
ক্রমশই হতাশ করছে,
এই সুকুমার
কবিস্বভাবের
পরিচয় পেয়ে
তাঁরা
আনন্দিত হবেন।
    এর পর, নব্বই দশক থেকে, বই ও লেখক পরিচিতির স্থান বদলে যায় প্রচ্ছদে। শেষ প্রচ্ছদ থেকে পরিচিতি দু’ ভাগ হয়ে যায় মলাটের দুই ভাঁজে। এর নাম হয়ে যায় ফ্ল্যাপ। প্রথম প্রচ্ছদের ভাঁজ বা ফ্ল্যাপে বই পরিচিতি, শেষ প্রচ্ছদের ভাঁজে লেখক পরিচিতি। দু’টি পরিচিতিই ছবি সহ।
    ওই ফ্ল্যাপ লেখার কাজ সাধারণত করে থাকেন লেখকেরাই। অনেক লেখক লিখিয়ে নেন অন্য লেখকদের দিয়ে। ওই লেখকদের কেউ-কেউ আবার রীতিমতো সমাদর পেয়ে থাকেন ফ্ল্যাপ রচনার কুশলতার জন্য। তেমন সমাদৃত ফ্ল্যাপ-লেখকদের একজন এই আমি স্বয়ং। বেশ অসঙ্কোচেই বলছি কথাটা। কারণ গত ৪০ বছরে ৪০০’র বেশি বইয়ের শেষ প্রচ্ছদের  পরিচিতি অথবা ফ্ল্যাপ লিখেছি। এখনও গড়ে সাত-আটটি বইয়ের ফ্ল্যাপ লিখে চলেছি প্রতি বছর। এ বছর আমার লেখা একটি ফ্ল্যাপ উদ্ধৃত করছি এখানে:
“প্রায়ই আমার দিনের শুরু হয় কঙ্কা জামিলের সঙ্গে। তাঁর কণ্ঠের সৌরভ ছড়িয়ে থাকে আমার গ্রিন রোডের এই ছোট্ট নীড়ের স্নিগ্ধ সকাল জুড়ে। তাঁর কথার লাবণ্য-দীপ্তি ক্রমে-ক্রমে  মিশে যায় আকাশভরা ভোরের স্ফুটনোন্মুখ আলোয়। আমি অবগাহন করি, মগ্ন নিমজ্জিত হই এক অনির্বচনীয় স্বতঃসুবাসিত সুরধারায়। এভাবে কঙ্কার গানে সাড়া পাই তাঁর প্রাণের, স্পর্শ পাই তাঁর আত্মার। তাঁর শিল্পীহৃদয়-সত্তা আমাকে, আমার মতো আরও অনেককে, প্রায়ই প্রাণিত করে নতুন-নতুন সৃষ্টিশীলতা উপহার দিয়ে। তিনি লেখেন, সেই লেখায় সুর দেন, তারপর গান করেন, উপহার দেন সকল সহজনকে। কঙ্কা কবি, সুরকার, শিল্পী এবং সমাজমর্মী। তাঁর উপস্থাপনা অনাড়ম্বর, কিন্তু প্রাণের ঐশ্বর্যে তাঁর গান রাজসিক মহিমায় সমৃদ্ধ। কবিতাতেও কঙ্কা সহজ করে সরল ভাষায় প্রকাশ করেন নিজেকে। তিনি লেখেন ব্যক্তির বিভ্রম ও সমাজের অসংগতির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। জীবনের যেখানে অন্ধকার সেখানে তিনি চান আলো জ্বালতে; দাঁড়াতে চান বিপন্ন, রোগাক্রান্ত, নির্যাতিত নর নারী শিশুর পাশে। তাঁর কবিতা হাত বাড়ায় বঞ্চিত লাঞ্ছিত নিষ্পিষ্ট মানবতার দিকে। তাদের দুঃখ-ব্যথা দূর করতে চায়, সুখী সমৃদ্ধ জীবনের স্বপ্ন দেখতে চায়। সমাজবিরোধী অশুভ অসুন্দরের স্বরূপ উদ্ঘাটন করেন কঙ্কা। তবে প্রতিবাদ করেন না দুর্বলের মতো। তিনি আঘাত করেন সরাসরি। কারণ তিনি সবল, শক্তিমত্তায় প্রবল। দৃঢ়। এভাবেই তাঁর সহজ ভাষার সরল কবিতা বিপুল মহিমায় হয়ে ওঠে সবেগে সমুদ্যত। গানে যেমন মরমী কঙ্কা, কবিতায়ও তেমন দরদি। মরমিয়া অনুভব তাঁকে মহিমা দিয়েছে, আর জনদরদ তাঁকে করেছে মহীয়ান। কঙ্কা কল্যাণী নারী, মরমী শিল্পী, দরদি কবি - তাঁকে অভিবাদন।”
এ লেখায় ফেসবুক-এর মাধ্যমে কঙ্কা জামিলের সঙ্গে আমার পরিচয় ও যোগাযোগ এবং ফেসবুক-ভিত্তিক তাঁর বিভিন্ন কর্মপ্রয়াস সূত্রে সৃষ্ট অনুভবের বিষয়টিই প্রাধান্য পেয়েছে, আসলে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে মাত্র দু’বার। তা-ও অল্প ক্ষণের জন্য। আমি চেয়েছিলাম তাঁকে নিয়ে একটি তথ্যপূর্ণ ফ্ল্যাপ লিখতে - যেমনটি লেখা হয় না সাধারণত। একটি বহুভাবনা-মণ্ডিত বইয়ের মূল বিষয়গুলো ১৫০-১৭৫ শব্দের ফ্ল্যাপে তুলে ধরা সহজ মনে হয় নি আমার কাছে। আমি তাই পারি নি মনোমতো ফ্ল্যাপ লিখতে, যদিও চেষ্টা করেছি মনেপ্রাণে।
জিজ্ঞেস করতে পারেন, আমার পছন্দের ফ্ল্যাপ হবে কেমন? ইংরেজি বই থেকে অনেক উদাহরণ দিতে পারবো, বাংলা বই থেকে খুব বেশি দিতে পারবো বলে মনে হয় না। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তো “কত বড় আমি - কহে নকল হীরাটি / তাই তো সন্দেহ করি, নহ তুমি খাঁটি।” তবে একটি আদর্শ ফ্ল্যাপের উদাহরণ দিতে পারি এখানে - মিনার মনসুরের “হাসান হাফিজুর রহমান: বিমুখ প্রান-রে অনির্বাণ বাতিঘর” (বাংলা একাডেমী, ১৯৯৯)-এর প্রথম প্রচ্ছদের ফ্ল্যাপ উদ্ধৃত করে:
“বাস-বিকই এক বিমুখ প্রান-রের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। প্রাবন্ধিক-গল্পকার-সম্পাদক-সংগঠক-অধ্যাপক-সাংবাদিক-কূটনীতিক ও কর্মমুখর জীবন ব্যয়িত হলেও, তিনি ছিলেন মূলত কবি। তাঁর ব্যক্তিত্বের সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশও ঘটেছে কবিতায়। কবিতাকে যে শেষ পর্যন- কবিতাই হয়ে উঠতে হবে - এ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সংশয় ছিল না তাঁর। কিন্তু তাঁর কাছে আর সবই ছিল তুচ্ছ, গৌণ; মুখ্য ছিল তাঁর দেশ। সে জন্য সমকালের অন্য কবিদের মতো স্বদেশের আনন্দ-বেদনায় সাড়া দেয়ার মধ্যেই সীমিত নয় তাঁর কবিতার ভূমিকা; তাঁর কবিতা তাঁর যাপিত কালের প্রতারক শূন্যতার বিপরীতে সমগ্র মানবজাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে ভবিষ্যতের দুর্লভ সেতুবন্ধন নির্মাণ করে; হতাশায় নিমজ্জিত মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে সংগ্রামে; অন্ধকারের সমুদ্রে দিগ্‌ভ্রান্ত মানুষকে দেয় আলোকিত ভবিষ্যতের পথ-নির্দেশনা। বিমুখ প্রান্তরে অনির্বাণ এক বাতিঘরের মতো আমৃত্যু তিনি পালন করে গেছেন কবি ও কর্মীর এই অনন্য ভূমিকা। কি কবিতায়, কি রাজনীতিতে - আমাদের সমাজে অত্যন্ত বিরল এই ভূমিকাটিরই উপর আলো ফেলা হয়েছে বর্তমান গ্রন্থে। পঞ্চাশের পরবর্তী দশকগুলিতে সমাজ পরিবর্তনের যে-বৈপ্লবিক দর্শন পৃথিবীকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল, তা বর্তমানে দৃশ্যপট থেকে অন্তর্হিত হলেও - সেই সময়, সেই সময়ের প্রকৃত প্রতিনিধিত্বকারী একজন বাঙালি কবির বিশেষ মনোভঙ্গির ব্যাপক ও বিশ্বস্ত ভাষ্য ‘হাসান হাফিজুর রহমান: বিমুখ প্রান্তরে অনির্বাণ বাতিঘর’।”
কবি হাসান হাফিজুর রহমান এবং তাঁর জীবন ও কর্ম ভিত্তিক একটি বই সম্পর্কে অল্প কথায় এই যে এত অধিক বলা, তা খুব সহজ কি?

মঙ্গলবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

বাল্যপ্রেমে অভিসম্পাত থাকে

আমার প্রথম ও সকল প্রেম সম্পর্কে এ নিবন্ধে যা লিখতে চেয়েছি তা ১৪০ বছর আগে বঙ্কিমচন্দ্র লিখে গিয়েছেন - “বালকের ন্যায় কেহ ভালবাসিতে জানে না।... বাল্যকালের ভালবাসায় বুঝি কিছু অভিসম্পাত আছে। যাহাদের বাল্যকালে ভালবাসিয়াছ, তাহাদের কয় জনের সঙ্গে যৌবনে দেখা সাক্ষাৎ হয়? কয় জন বাঁচিয়া থাকে? কয় জন ভালবাসার যোগ্য থাকে? বার্দ্ধক্যে বাল্যপ্রণয়ের স্মৃতিমাত্র থাকে, আর সকল বিলুপ্ত হয়। কিন্তু সেই স্মৃতি কত মধুর!... বালকমাত্রেই কোন সময়ে না কোন সময়ে অনুভূত করিয়াছে যে, ঐ বালিকার মুখমণ্ডল অতি মধুর। উহার চক্ষে কোন বোধাতীত গুণ আছে। খেলা ছাড়িয়া কতবার তাহার মুখপানে চাহিয়া দেখিয়াছে - তাহার পথের ধারে, অন-রালে দাঁড়াইয়া কত বার তাহাকে দেখিয়াছে। কখন বুঝিতে পারে নাই, অথচ ভালবাসিয়াছে। তাহার পর সেই মধুর মুখ - সেই সরল কটাক্ষ - কোথায় কালপ্রভাবে ভাসিয়া গিয়াছে। তাহার জন্য পৃথিবী খুঁজিয়া দেখি - কেবল স্মৃতিমাত্র আছে। বাল্যপ্রণয়ে কোন অভিসম্পাত আছে।...”
    কিন্তু এ অভিসম্পাতের শিকার না হয়ে উপায় কি? যদি উদাসীন বা নিরুৎসুক প্রকৃতির হতাম তাহলে রক্ষা পেতাম হয়তো, কিন্তু জন্মই নিয়েছি যেন অদম্য কৌতূহল, সুতীব্র আগ্রহ ও আকর্ষণ নিয়ে। আশপাশের - চারপাশের জীবন ও জগৎ নিয়ে কত জিজ্ঞাসা আমার! পড়তে শেখার পর ডুবে যাই বইয়ের রাজ্যে। সকল অজানাকে জানতে ও বুঝতে বইকে করে নিই নিত্যসঙ্গী। আমার প্রথম প্রেম তাই সাদা কাগজের বুকে কালো অক্ষরের প্রতিমা। তারপর বয়স বেড়েছে, আর প্রেমও বেড়েছে। গান শোনা, ছবি দেখা - এ সবও নেশা হয়ে যায় ক্রমে-ক্রমে। সেই সঙ্গে জাগরণ ঘটে হৃদয়ের, উন্মুখ এক অনুভূতি ছড়িয়ে থাকে মনপ্রাণ জুড়ে। শুরু হয় মন দেয়া, কিন' নেয়া তো আর হয় না। মুখ ফুটে কখনও বলতে না পারার ভীরুতায় মরেছি হাজার মরণে। বাস-বের মানবীদের ধারেকাছে ঘেঁষতে না পেরে নিবিড় প্রেমে জড়িয়ে থাকি মনোলোকের নায়িকাদের সঙ্গে। তাই বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ (১৮৬৬) পড়ার পর কেমন ‘নবকুমার’ হয়ে যাই মনে-মনে। আবার ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় (১৯০৪-১৯৭৫)-এর ‘চিতা বহ্নিমান’ (১৯৪৫) পড়ে আপাতনির্বিকার প্রেমিক হওয়ার চেষ্টা, আর সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় (১৮৮৪-১৯৬৬)-এর ‘পিয়ারী’ পড়ে স্বর্ণহৃদয়া স্বৈরিণীর প্রতি সহানুভূতিতে আর্দ্র এক প্রেমানুভূতিতে অবগাহন - মনে আছে এখনও। গানের জগতেও ব্যতিক্রম ঘটে নি এর। রেকর্ডে ও রেডিওতে গান শুনতে-শুনতে রীতিমতো প্রেমে পড়েছি সেকালের জনপ্রিয় গায়িকা আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৩৪-২০০৯)-এর। আবার আমাদের টাঙ্গাইলের করোনেশন ড্রামাটিক ক্লাব রঙ্গমঞ্চে আয়োজিত সংগীতানুষ্ঠানে গাইতে আসা দুই কিশোরী বুলা গোস্বামী (পরে বুলা নাজির) ও নীনা (পরে নীনা হামিদ)-র জন্য কেমন করেছে মন। রুপালি পরদার সোনালি নায়িকাদের মধ্যে মুসাররাত নাজির, মালা সিনহা ও নীলো’র প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছি খুব। ‘শাবিস্তান’ (১৯৫১) ও ‘সিন্দাবাদ দ্য সেইলর’ (১৯৫২)-এর নাসিম বানু, ‘জাদু’ (১৯৫১) ও ‘জলপরী’ (১৯৫২)-র নলিনী জয়ন্ত, ‘আলিবাবা আউর ৪০ চোর’ (১৯৫৪)-এর শাকিলা ও ‘হুর-এ-আরব’ (১৯৫৫)-এর চিত্রাকে ভুলতে পারি নি এখনও।
    তবে এবার বলি অভিসম্পাতের কথা। এক বালক ও বালিকা এবং তাদের প্রণয়ের কাহিনী। সে বালক গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে গিয়েছিল গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সেখানে ওই বালিকা ছিল তার খেলার সাথি। বালক তার মন কেমন করা প্রকাশ করতে পারে নি স্বভাবগত সঙ্কোচে, তবে প্রথম দিককার জড়তা কাটানোর পর বালিকার চলন-বলনে মনের ভাব লুকানো ছিল না শেষ পর্যন্ত। একবার কথায়-কথায় কি এক জেদ করে সে বলেই ফেলে, বড় হয়ে বিয়ে করবে তারা।  এরপর বালিকার অভিভাবকরা বাধা হয়ে দাঁড়ায় দু’জনের মেলামেশায়। কারণ বালিকা ছিল গ্রামের এক তরুণের বাগ্‌দত্তা।
    গ্রীষ্মের ছুটি শেষে ওই গ্রাম ছেড়ে চলে আসে বালক। তারপর আর দেখা হয় নি দু’জনের। তবে মাঝেমধ্যে বালিকার আকুলতার খবর পেয়েছে বালক। এর ৩০ বছর পর, ১৯৯০ সালে, সেই বালিকাকে স্মরণ করে লেখা হয় ‘বিলকিস’ নামে একটি কবিতা:

    বয়স হয়েছে।
    চারপাশে ক্লান্তির ভিড়।
    দেহ, মন কিছুই এগোয় না কোনও দিকে।
    তবু স্মৃতি এসে হাত ধরে টানে,
    দাঁড় করিয়ে দেয় কৈশোরের পাশে -
    তোমার মুখোমুখি।

    দেখি, গ্রীষ্মের ছুটির রোদে
    ভরে গেছে সমস্ত ভুবন
    আর, হাঁফাতে-হাঁফাতে ছুটে এসে
    আমাকে দেখে তুমি থমকে দাঁড়ালে।

    আশ্চর্য!
    তোমার নাকের ডগায় ঘামের বিন্দুগুলো
    জ্বলজ্বল করছে এখনও।

    অবশেষে ৪০ বছর পর, ২০০০ সালে, সেই গ্রামে, দেখা হয় দু’জনের। প্রৌঢ় পুরুষ এক ক্ষীণাঙ্গী প্রৌঢ়াকে দেখে চিনতে পারে না সেই ঢলঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণ্যে উচ্ছল বালিকাকে, প্রৌঢ় নারীও জীবনযুদ্ধে বিপর্যস্ত এক পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিকে দেখে চিনতে পারে না সেই হাসিখুশি প্রাণচঞ্চল বালককে। তবে অভিসম্পাত গেল কই? এত বছর পরও অভিভাবকেরা সচেষ্ট হয়ে ওঠে দু’জনকে দূরে-দূরে সরিয়ে রাখার জন্য। ওর মধ্যেই প্রৌঢ়া এক ফাঁকে আসে প্রৌঢ়ের কাছে। নতস্বরে বলে, তোমাকে চিনতে পারি নি প্রথমে, কিছু মনে করো না।
    প্রৌঢ় দেখে, এক অসহায় বালিকার মুখ।
    প্রৌঢ়া শোনে, এক দুঃখী বালকের নীরব দীর্ঘশ্বাস।

সোমবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

শিমবোরস্কা আর নেই

১৯৯৬ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী পোলিশ কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক ভিসওয়াভা শিমবোরস্কা আর নেই। গত ১লা ফেব্রুয়ারি পোলান্ডের প্রাচীন নগরী ক্রাকুফ-এ নিজের বাড়িতে ঘুমের মধ্যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। দীর্ঘকাল ধরে ফুসফুসের ক্যানসারে ভুগছিলেন ভিসওয়াভা। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর।
    নোবেল কমিটি জানিয়েছিল, ভিসওয়াভা’র পুরস্কার পাওয়ার কারণ “কবিতায় শ্লেষাত্মক ইঙ্গিতে মানবিক বাস্তবতার ভগ্নাংশে ঐতিহাসিক ও জীববৈজ্ঞানিক প্রসঙ্গের আলোকপাত”। পোলান্ডের প্রেসিডেন্ট ব্রোনিসোয়াফ কোমোরোফস্কি এক শোকবার্তায় বলেছেন, তিনি ছিলেন আমাদের অভিভাবক সত্তা। তাঁর কবিতায় আমরা পাই অনেক গভীর সুপরামর্শ, তাতে আমাদের চারপাশের জগৎ ও জীবনকে আমরা বুঝতে পারি সহজে।
    শারীরিক সমস্যা ছিল, তবুও ভিসওয়াভা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন নতুন-নতুন কবিতা লিখতে। তবে সেগুলিকে গ্রন্থভুক্ত করার সময় হয় নি তাঁর। এ বছরের শেষ দিকে বইটি ছাপা হবে বলে জানা গেছে।
    ভিসওয়াভা’র জন্ম ১৯২৩ সালের ২রা জুলাই, পশ্চিম পোলান্ডের বিনিন শহরে। চার বছর বয়স থেকে তাঁর কবিতা লেখা শুরু। তবে প্রথম কবিতা ছাপা হয় ১৯৪৫ সালে, দিয়েনিক পোলস্কি নামের এক পোলিশ দৈনিক সংবাদপত্রে। তাঁর ওই প্রথম প্রকাশিত কবিতার নাম “শুকাম স্লোভা” (আমি খুঁজছি একটি শব্দ)। পত্রিকাটির সম্পাদক, কবি ও অনুবাদক আদাম ফ্লোদেক (১৯২২-১৯৮৬)-এর সঙ্গে ভিসওয়াভা’র বিয়ে হয় ১৯৪৮ সালে, বিচ্ছেদ ঘটে ১৯৫৪ সালে। পরে সহবাস করেছেন বিশিষ্ট লেখক করনেল ফিলিপোভিশ (১৯১৩-১৯৯০)-এর সঙ্গে। কোনও সম্পর্কের সূত্রেই মা হন নি তিনি।
    ভিসওয়াভা’র ‘প্রথম দেখায় প্রেম’ কবিতাটির অনুপ্রেরণায় ‘থ্রি কালারস্‌: রেড’ (১৯৯৪) ছবিটি নির্মাণ করেছেন বরেণ্য পোলিশ চলচ্চিত্রকার ক্রিসটোফ কিয়েস্লোফস্কি (১৯৪১-১৯৯৬)। তবে রচনার পরিমাণ খুব বেশি নয় ভিসওয়াভা’র। কবিতা লিখেছেন ২৫০-এরও কম। এত কম কবিতা লেখার কারণ জানতে চাইলে উত্তর দিয়েছেন, আমার বাড়িতে একটা বাজে কাগজের ঝুড়ি আছে!