বৃহস্পতিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

গুগলে গণ্ডগোল

‘ইনোসেন্স অভ মুসলিমস্‌’  নামে গুগল নিয়ন্ত্রিত ইউটিউব-এ প্রচারিত ১৩ মিনিট ৫১ সেকেন্ডের ভিডিও ক্লিপটি ঘরোয়া ভাবে নির্মিত। এর লেখক ও প্রযোজক স্যাম বাসিল ওরফে নাকুলা বাসেলি নাকুলা। বলা হয়েছে, ক্লিপটি আসলে মূল ছবির প্রচারচিত্র (ট্রেলার)। সে ছবির অবশ্য কোনও খোঁজ মেলে নি এখনও। একটি খবরে বলা হয়েছে, গত ২৩শে জুন হলিউড-এর ভাইন থিয়েটারে একবারই প্রদর্শনী হয়েছে ছবিটির। তখন পোসটারে এর নাম ছিল ‘ইনোসেন্স অভ বিন লাদেন’। প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন মাত্র ১০জন দর্শক। জুলাই মাসে ভিডিও ক্লিপটি ইউটিউব-এ আপলোড করা হয় ‘দ্য রিয়াল লাইফ অভ মুহাম্মদ’ ও ‘মুহাম্মদ মুভি ট্রেলার’ নামে। এর আরবি ভার্সন আপলোড করা হয় সেপটেম্বরের গোড়ার দিকে। তখন ইমেইল-এর মাধ্যমে এর প্রচারে ভূমিকা রাখেন মিশরি-মারকিন কপটিক খ্রিস্টান আইনজীবী ও আন্দোলনকর্মী মরিস সাদেক। তিনি ঘোরতর ইসলাম-বিদ্বেষী হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত। নির্মাণকালে ছবিটির নাম ছিল ‘ডেজার্ট ওয়ারিয়র’। শিল্পীদের বলা হয়েছিল, দু’ হাজার বছর আগে আকাশে ধূমকেতুর আবির্ভাবে গোত্রে-গোত্রে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার কাহিনী নিয়ে তৈরি হচ্ছে ছবিটি। চিত্রায়নের পর শিল্পীদের না জানিয়ে ওভারডাবিং করে ইসলাম-বিদ্বেষী বিষয়বস্তু ঢোকানো হয় এতে। ছবিটির প্রচারে মুখ্য ভূমিকা রেখে চলেছেন আমেরিকায় কোরান পোড়ানো আন্দোলনের নেতা প্যাস্টর টেরি জোন্স। তবে মুসলিম পাবলিক এফেয়ার্স কাউন্সিল-এর মরিয়ম মহিউদ্দিন বলেছেন, মূল ছবির কোনও অস্তিত্বই নেই। আমরা তন্ন-তন্ন করে খুঁজেছি অনেক, কিন্তু মেলে নি কিচ্ছু।
    ভিডিও ক্লিপের বিষয়বস্তু ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে মুসলিম বিশ্ব। প্রতিবাদ-বিক্ষোভ চলছে সর্বত্র। সহিংসতা-প্রাণহানি ঘটেছে, রয়েছে আরও ঘটার আশঙ্কা। কিন্তু গুগল কর্তৃপক্ষ রাজি নন ইউটিউব থেকে ট্রেলারটি সরিয়ে দিতে। বিশ্বব্যাপী দাবি ওঠা সত্ত্বেও তাঁরা বলছেন, এতে ক্ষুণ্ন হবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা - লঙ্ঘন করা হবে মারকিন সংবিধানের প্রথম সংশোধনী। (“In the United States, a law against blasphemy, or a prosecution on that ground, would violate the American Constitution. The First Amendment to the United States Constitution provides ‘Congress shall make no law respecting an establishment of religion, or prohibiting the free exercise thereof; or abridging the freedom of speech, or of the press...’ while there are no federal laws which forbid ‘religious vilification’ or ‘religious insult’ or ‘hate speech’, some states have blasphemy statutes.”)
    ভিডিও ক্লিপটি সম্পর্কে সকল মারকিন পত্রপত্রিকায় প্রায় একই ভাষায় লেখা হয়েছে, এটি অত্যন্ত কাঁচাভাবে নির্মিত একটি কদর্য ছবি। সে ক্ষেত্রে বলতে হয়... গুগল কর্তৃপক্ষ প্রকাশের স্বাধীনতার নামে জেনেশুনেই প্রশ্রয় দিচ্ছে উচ্ছৃঙ্খলতা, অশ্লীলতা ও বিকৃত আচারকে। এ প্রশ্রয়ের ফল মারাত্মক হতে বাধ্য। এর পর থেকে যে কোনও উৎসাহী ব্যক্তি যা ইচ্ছা তা-ই ভিডিও আকারে আপলোড করতে পারবে ইউ-টিউবে। তাহলে তো জনপ্রিয় এ মাধ্যমটি ক্রমশ পরিণত হবে ঘৃণা, বিদ্বেষ, হিংসা, আক্রোশের এক জঘন্য হানাহানি-স্থলে। প্রকাশের স্বাধীনতার অজুহাতে এমন বিশৃঙ্খলা ও বিকৃতির স্বাধীনতা দেয়া কি মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়?
    ‘ইনোসেন্স অভ মুসলিমস্‌’-এর অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও অভিযোগ করেছেন, তাঁদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে নির্মাতারা। এ প্রতারণা কি ক্ষুণ্ন করে নি শিল্পীর অধিকারকে? মানবাধিকারকে?
    এরই মধ্যে ইউটিউব-এ বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক ভিডিও আপলোড করে নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘন করায় ব্রাজিলের এক বিচারপতি ওই দেশের গুগল-কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন। এর বিরুদ্ধে অবশ্য আপিল করেছে গুগল। কিন্তু তাদের স্বাধীনতার ব্যাখ্যা যে ভবিষ্যতে এমন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বারবার তাতে সন্দেহ নেই কোনও। তবে আমাদের বিশেষ ভাবে দেখতে হবে, আমরা যেন এমন কিছু না করি যাতে ‘ইনোসেন্স অভ মুসলিমস্‌’-এর নির্মাতাদের মতলব হাসিল হয়ে যায় অবলীলায়। কাঁচা হোক, কদর্য হোক... তারা তো বিশেষ দুরভিসন্ধি নিয়েই করেছে দুষ্কর্মটি?

sazzadqadir@gmail.com

মঙ্গলবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১২

কাজি আফসার উদ্‌দিন আহমদ: সাহিত্যিক-সাংবাদিক

[কাজি আফসার উদ্‌দিন আহমদ: ২৪.০৯.১৯২১ - ২৬.০৩.১৯৭৫]

শিশুতোষ বইপত্র পড়ে-পড়েই আমরা অনেকে ‘বইয়ের পোকা’ হয়েছি সেই ছোটবেলায়। আর আমাদের এই পোকা বানিয়ে দেয়ার জন্য যে সব বই দায়ী সেগুলোকে ভুলি নি কখনও। সেই সঙ্গে ভুলি নি ওই সব বইয়ের লেখকদেরও। তাঁরা জীবনভর প্রিয় হয়ে রয়েছেন আমাদের। এজন্যই এখনও  খুঁজে বেড়াই হারানো দিনের বইপত্র। কখনও হঠাৎ খুঁজে পেয়ে গেলে পড়তে-পড়তে পাতা ওলটাতে-ওলটাতে ফিরে যাই সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোতে। সে সব দিনের এমন অনেক প্রিয় লেখকের একজন কাজি আফসার উদ্‌দিন আহমদ। শিশুতোষ মাসিক ‘খেলাঘর’ (১৯৫৪-?)-এর মাধ্যমে তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচয় আমার। তাঁকে মনে রাখার আরও বিশেষ কারণ - নানা বিচিত্র বিষয়ে লিখতেন তিনি। এছাড়া বিদেশী সাহিত্যের প্রতি আমার মতে অনেকের কৌতূহল ও আকর্ষণ যাঁরা উসকে দিয়েছেন তিনি তাঁদেরই একজন। এদেশের কথাসাহিত্যে বিশেষ অবদান ছাড়াও সাংবাদিকতা ও প্রকাশনার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে কাজি আফসার উদ্‌দিন আহমদের - কিন্তু সে সবের যথাযথ মূল্যায়ন এখনও বাকি। অনেক বই লিখেছেন তিনি, কিন্তু সেগুলোর মুদ্রণ নেই দীর্ঘ দিন ধরে। তাঁর রচনাবলি প্রকাশের কোনও উদ্যোগ আছে বলেও জানা যায় না।
    কাজি আফসার উদ্‌দিন আহমদের জন্ম পাবনা’র চাটমোহর-এ, ১৯২১ সালের ২৫শে সেপটেম্বর। পৈতৃক নিবাস মানিকগঞ্জের কলতা গ্রামে। পিতা কাজী আফাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন কৃতী পুলিশ কর্মকর্তা (দারোগা)। বৃটিশ সরকার ‘খানসাহেব’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেছিল তাঁকে। দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞান প্রভৃতি নানা বিষয়ে গভীর অনুরাগ ছিল তাঁর। অবসর-জীবনে লিখেছিলেন ‘বৈদ্যুতিক দর্শনে কোর-আন শরীফ’ (১৯৪৯) গ্রন্থটি। কাজি আফসার উদ্‌দিন আহমদের ছোট দুই ভাই কাজি আজাহার উদ্‌দিন আহমদ ও কাজি আতাহার উদ্‌দিন আহমদ-ও লেখক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন এক সময়।
কাজি আফসার উদ্‌দিন আহমদের শিক্ষাজীবনের শুরু মানিকগঞ্জের ভিকটোরিয়া হাই স্কুলে। এরপর পড়েছেন রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে (১৯৩৪)। মাঝে আরও কয়েকটি স্কুলে পড়ার পর ১৯৩৭ সালে ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে। সেখানে অষ্টম থেকে নবম শ্রেণীতে ওঠার পর-পরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ইতি ঘটে তাঁর। এরপর কলকাতায় গিয়ে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন তিনি। পাশাপাশি আত্মনিয়োগ করেন গল্প-উপন্যাস রচনায়। পরে সাংবাদিকতাকে ছাড়িয়ে কথাসাহিত্যিক পরিচয়টিই প্রধান হয়ে ওঠে তাঁর।
    কলকাতায় ১৯৪১-৪৬ সালে কাজি আফসার উদ্‌দিন আহমদ সম্পাদক-প্রকাশক ছিলেন দ্বিমাসিক সাহিত্যপত্রিকা ‘মৃত্তিকা’র। মাঝখানে কয়েক বছর সম্পাদনার সূত্রে জড়িত ছিলেন মাসিক ‘সওগাত’, ‘শিশু সওগাত’, সাপ্তাহিক ও দৈনিক ‘কৃষক’ ও সাপ্তাহিক ‘দেশের কথা’-র সঙ্গে (১৯৪৩-১৯৪৪)। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন মাসিক ও সাপ্তাহিক মোহাম্মদী’র (১৯৪৫-১৯৪৭)। ভারত-বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের সর্বপ্রথম দৈনিক সংবাদপত্র “জিন্দেগী”র প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন তিনি। পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ৪ঠা সেপটেম্বর। দৈনিক ‘ইনসাফ’-এরও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন তিনি। কাজি আফসার উদ্‌দিন আহমদ পরে যোগ দেন সরকারের তথ্য বিভাগে সিনিয়র সাব-এডিটর পদে। তখন সম্পাদনা করেছেন সাপ্তাহিক পাক সমাচার (১৯৫১-১৯৭১)। স্বাধীনতার পর সম্পাদনা করেন শিশু-কিশোর সাময়িকী “নবারুণ”। এ ছাড়া স্ত্রী জেবু আহমদের সম্পাদনায় প্রকাশিত দেশের বিখ্যাত ও প্রাচীন শিশু-কিশোর মাসিক “খেলাঘর”-এর নেপথ্যে সক্রিয় ভূমিকা ছিল তাঁর। এ পত্রিকা ছাপা হতো তাঁদের ৯ নয়া পল্টনের বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত জেসমিন প্রিন্টিং প্রেস থেকে। ষাটের দশকে ত্রৈমাসিক ‘মৃত্তিকা’, দ্বিমাসিক ‘স্বদেশ’, মাসিক ‘অবসর’ প্রভৃতি পত্রিকার সম্পাদনা-প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কাজি আফসার উদ্‌দিন আহমদ।
সুলেখিকা জেবু আহমদ-এর আসল নাম বেগম জেবুন্নেসা আহমদ। সিলেটের এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান তিনি। তাঁর বৈমাত্রেয় বড় ভাই  করাচি থেকে প্রকাশিত ‘ডন’ পত্রিকার বিখ্যাত সম্পাদক আলতাফ হুসাইন (১৯০০-১৯৬৮) - যিনি পাকিস্তানের শিল্প ও প্রাকৃতিক সম্পদ দফতরের মন্ত্রীও ছিলেন ১৯৬৫-১৯৬৮ সালে।
১৯৩৭-৪৭ সালে পিতার কর্মস্থল কলকাতায় অবস্থানকালে কাজি আফসার উদ্‌দিন আহমদ লেখালেখি করতেন ‘আলোক দূত’, ‘কুমার নিখিলেশ রুদ্রনারায়ণ সিং’, ‘কুমারী প্রীতিসুধা সিং’, ‘অরূপ আহমদ’ প্রভৃতি ছদ্মনামে। ‘আলোক দূত’ নামে প্রকাশিত হয় তাঁর কিশোর উপন্যাস “মুক্তোর সন্ধানে আফ্রিকায়”। প্রকাশ করে কলকাতার বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা দেব সাহিত্য কুটীর। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৫-১৬ বছর, তিনি চট্টগ্রাম সরকারি কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র। কলকাতা-জীবনে কাজি আফসার উদ্‌দিন আহমদ বেশি পরিচিতি পেয়েছিলেন কুমার নিখিলেশ রুদ্রনারায়ণ সিং নামে। পরে সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন (১৮৯৭-১৯৭৮)-এর পরামর্শে তিনি লিখতে শুরু করেন স্বনামে।
“মুক্তোর সন্ধানে আফ্রিকা” ছাড়া গ্রন্থাকারে প্রকাশিত কাজি আফসার উদ্‌দিন আহমদের উপন্যাসের সংখ্যা ৮ - ‘চর ভাঙা চর’ (১৯৫১), ‘কলাবতী কন্যা’ (১৯৫২), ‘কবীর লস্কর’ (১৯৫৪), ‘বাতাসী’ (১৯৫৬), ‘নোনা পানির ঢেউ’ (১৯৫৮), ‘অমর যৌবনা’ (দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৫৮), ‘সুরের আগুন’ (১৯৬০), ‘নীড় ভাঙা ঝড়’ (১৯৬১)। পত্রিকায় প্রকাশিত কিন্তু গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে - ‘হাসিনার প্রার্থনা’, ‘গদ্য কবিতা’ ও  ‘মরণ ছবির বিভীষিকা’। তাঁর গল্পগ্রন্থ - ‘কোলাহল’ (১৯৪৭), ‘কালনাগিনী’ (১৯৫২), ‘জ্বালাও আলো’ (১৯৫৪), ‘নূতন প্রেম’ (১৯৫৫), ‘নদী ধলেশ্বরী’ (১৯৭০); প্রবন্ধ-গবেষণা - ‘সাহিত্যের পরিধি’ (১৯৬০), ‘ইনকিলাবী যুগের ইতিকথা’ (১৯৭০), ‘সাহিত্য ও জীবন’ (১৯৭০), ‘আঙুর’ (১৯৭০), ‘আমরাও বসে থাকিনি’ (১৯৭০); অনুবাদ - ‘মুসলিম রাজনীতির ঐতিহাসিক পটভূমি’ (১৯৪৫), ‘টেলিফোন’ (১৯৫৭), ‘লেবানন থেকে পাকিস্তান’ (১৯৭০); নাটক - ‘মোগল কুমারী’ (১৯৪৭)।
কাজি আফসার উদ্‌দিন আহমদের বেশির ভাগ উপন্যাসেরই একাধিক সংস্করণ হয়েছে সেকালে। ষাটের দশকে পাঠকপ্রিয়তার তালিকায় ছিল ‘চর ভাঙা চর’, ‘বাতাসী’, ‘নোনা পানির ঢেউ’, ‘অমর যৌবনা’, ‘নীড় ভাঙা ঝড়’। তবে তাঁর প্রথম উপন্যাস “চর ভাঙা চর”ই (১৯৫১) সর্বাধিক আলোচিত উপন্যাস । মাহবুব-উল-আলম লিখেছেন, “... লেখার সুরে কাজি আফসার উদ্‌দিন আহমদ বহুকাল হইতে আমার আত্মীয়। তাঁহার ‘চর ভাঙা চর’-এও রহিয়াছে শক্তির প্রকাশ।... ‘চর ভাঙা চর’ পড়িতে পড়িতে আমার বহুবার মনে হইয়াছে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কালিন্দী’ ও ‘পঞ্চগ্রাম’কে। ধলেশ্বরী ও সপ্তগ্রামের অপরূপ রূপ কাজি সাহেব দেখিতে পাইয়াছেন।...” অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত (১৯০৩-১৯৭৬) লিখেছেন, “... ‘চর ভাঙা চর’ পড়ে খুব তৃপ্তি পেলাম। পূর্ববঙ্গের প্রাণবতী নদী আর উদার উদ্ধত মানুষ চিরকাল আমার মন ভুলিয়েছে। - তারই সৌন্দর্য আর সৌরভ পেলাম আপনার বইয়ে। পূর্ববঙ্গে নিয়ে লেখা বই পূর্ববঙ্গের মতোই মধুর।...” সাপ্তাহিক দেশ লিখেছে, “... ‘চর ভাঙা চর’ এক বলিষ্ঠ নতুনতম পদক্ষেপ। আমাদের জীবনে কাহিনী নেই, অথবা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের বাইরে গল্পের উপকরণ নেই বলে অক্ষম লেখকেরা পালিয়ে থাকতে চান, তাঁদের সামনে এক নতুন দিগন্তের ইশারা এই ‘চর ভাঙা চর’...।” মোহাম্মদ মাহ্‌ফুজউল্লাহ্‌ লিখেছেন, “কাজি আফসার উদ্‌দিন আহমদের রচনায়ও ভিন্নতর পটভূমিতে নদী-নালা পরিবেষ্টিত গ্রাম-বাংলার জীবনের রূপায়ণ লক্ষ্য করা গেছে। শামসুদ্দীন আবুল কালাম যেখানে নদী-কেন্দ্রিক গণজীবনের গতিময় রোমান্স-রূপ অঙ্কন করেছেন, সেখানে কাজি আফসার উদ্‌দিন অঙ্কন করেছেন নদীর ভাঙনধারার পটভূমিতে জীবন-সমস্যার বাস্তবচিত্র। অবশ্য তাঁর ‘চর ভাঙা চর’ উপন্যাসে ভাবাবেগ অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবতাবোধকে বিনষ্ট করে দিয়েছে, ফলে সেখানে নদীর ধ্বংসলীলা এবং গতিময় বন্যাবেগই কবিত্বময়তার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে, নদী কেন্দ্রিক জনজীবন অনেকখানি চাপা পড়ে গিয়েছে। এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তাঁর ‘চর ভাঙা চর’ একটি স্বাতন্ত্র্যধর্মী রচনা।...”
ষাটের দশকে বহুল পঠিত লেখক ছিলেন কাজি আফসার উদ্‌দিন আহমদ। উপন্যাসের মতো তাঁর ছোটগল্প ও শিশুতোষ রচনাও ছিল যথেষ্ট পাঠকপ্রিয়। অনেক বিখ্যাত বিদেশী গ্রন্থের অনুবাদ / ভাবানুবাদ করেছিলেন তিনি কিশোরদের উপযোগী করে। সেগুলো পড়েই দেশের বহু শিশু-কিশোর পরিচয় ও স্বাদ-গন্ধ পেয়েছে বিশ্বসাহিত্যের। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে - ‘খাইবারের ভয়ঙ্কর’ (১৯৫৪), ‘গ্রেট এঙপেকটেশন’, ‘কিডন্যাপড্‌’, ‘সাইলাস মারনার’, ‘জীবনশিল্পী শেখভ’ (১৯৫৫), ‘রহস্যময় বন্দী’, ‘মৃত্যুর অভিশাপ’, ‘টম ব্রাউনের ছেলেবেলা’ (১৯৫৬), ‘টেলিফোন’ (১৯৫৭), ‘গ্রীন ম্যান্‌সন্‌স’, ‘বিশ্বত্রাস চেঙ্গীস খান’ (১৯৫৯), ‘শাশ্বত মনীষা’, ‘মিডশিপম্যান ইজি’ (১৯৬০), ‘দ্য হারিকেন’, ‘মবি ডিক’, ‘মিউটিনি অভ দ্য বাউন্টি’, ‘দুই নগরীর উপাখ্যান’, ‘ম্যাকবেথ’, ‘ব্ল্ল্যাক বিউটি’, ‘দ্য প্রিন্স অ্যান্ড দ্য পপার’, ‘জীবন যেখানে জাগলো’ (১৯৭০) প্রভৃতি। তাঁর অপ্রকাশিত রচনার সংখ্যাও বিপুল বলে জানা যায়।
বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক হিসেবে কাজি আফসার উদ্‌দিন আহমদ সেকালে যথেষ্ট সমাদৃত ছিলেন, কিন্তু একালে তিনি অবহেলিত, অনালোচিত, উপেক্ষিত। তাঁর সাহিত্যকৃতির সেভাবে কোনও মূল্যায়ন হয় নি এখনও। তাই বলে তাঁর সাধনা একেবারে বৃথা গেছে বলে আমি মনে করি না। আমাদের কথাসাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর যথাযোগ্য স্থান নির্ধারিত আছে অবশ্যই। সেই স্থানের সীমাচি??হ্ন ছাড়া যে আমাদের সাহিত্যের কথকতা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে তা অস্বীকার করতে পারেন না কেউ।
কাজি আফসার উদ্‌দিন আহমদ লিখেছেন অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে। ছোট-ছোট বাক্যে তরতরিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছেন কাহিনী, সংলাপ, বিবরণ। পাঠকও তাই তাঁর সঙ্গে এগিয়ে যায় সমান গতিতে। তাঁর এই রচনারীতিতে প্রভাব লক্ষ্য করা যায় সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় (১৮৮৪-১৯৬৬) ও নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় (১৯০৫-১৯৬৪)-এর। জহির রায়হান (১৯৩৫-১৯৭২)-ও অনুপ্রাণিত ছিলেন এ রীতিতে। একালের ‘নন্দিত’ লেখকদের অনেকেই লিখতে চেষ্টা করেন এরকমই।
১৯৬৬ সালে উপন্যাসে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পান কাজি আফসার উদ্‌দিন আহমদ (বাংলা একাডেমী’র “চরিতাভিধান”-এ নামের বানান ‘কাজী আফসরউদ্দীন আহমদ’)। ১৯৭৫ সালের ২৬শে মার্চ ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
কাজি আফসার উদ্‌দিন আহমদের পুত্র জামাল আরসালান, কামাল আরসালান ও আলতামাস পাশা এবং কন্যা শাহানা আফরিন পারিবারিক ঐতিহ্য বজায় রেখেছেন লেখালেখির জগতে নিবেদিত থেকে। তাঁরা সবাই স্ব-স্ব বৈশিষ্ট্যের ছাপ রেখে চলেছেন সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায়।
কৌতূহলী পাঠকদের জন্য এখানে উদ্ধৃত করছি কাজি আফসার উদ্‌দিন আহমদের “বাতাসী” উপন্যাসের অংশবিশেষ:
“বাতাসী আলুলায়িত।
“বিস্রস্ত বসন তার। উন্মাদ বাতাস এতোক্ষণ তাকে নিয়ে খেলেছে। সে ছিলো তন্দ্রায় আচ্ছন্ন। সে ছিলো ভাব-সমুদ্রে ডুবুরীর মতো। জাগ্রত চৈতন্যে তার ভর্‌ ছিলো না।
“এইমাত্র জয়নালের স্পর্শে সে সম্বিৎ ফিরে পেয়েছে।
“মেঘের বর্ষণে ক্ষেতের ধানের শীস্‌ আনন্দে-উল্লাসে সপ্‌সপে। এবার তারাও জাগবে। - এমনি উল্লাস বাতাসীর চোখে।
“শরীরে আব্‌রু আছে কি নেই, সে দেখলো না তা।
“তার দৃষ্টি তার পুরুষের মুখের উপর বন্দি হয়ে গেলো।
“সে দেখ্‌লো জয়নালকে।...”

আকাশের দিকে হা

বড় হয়েছি নদীর সঙ্গে। আমাদের টাঙ্গাইল শহরের পশ্চিম পাশ ঘেঁষে ছিল সেই নদী। নাম লৌহজঙ্গ। বর্ষায় দু’ কূল ছাপিয়ে হয়ে উঠতো প্রবল প্রমত্ত। তখন কি তীব্র স্রোত! বহু দূর থেকে শোনা যেতো নদীর ডাক। তখন কত নৌকা যেতো পাল তুলে, গুণ টেনে। ছোট-বড় মহাজনী নৌকার ভিড় হতো ঘাটে-ঘাটে। নৌকা বাইচ হতো রীতিমতো হৈহল্লা করে, ঢাকঢোল পিটিয়ে। অন্য সময়ে কুলু-কুলু বয়ে যেতো লৌহজঙ্গ, শীতকালে তো রীতিমতো শান্তশিষ্ট।
শহরের বুক চিরেও ছিল একটি খাল। শ্যামবাবুর খাল। শহরের পশ্চিম উপকণ্ঠ দিয়ে বয়ে যাওয়া বংশাই নদীর সঙ্গে লৌহজঙ্গকে যুক্ত করার জন্য কাটা হয়েছিল সেই খাল। সে কাজ করেছিলেন শ্যামবাবু নামের কোনও ঠিকাদার। সেই থেকে খালের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল তাঁর নাম। এ খালেও পানি থাকতো সারা বছর। বর্ষাকালে ভিড় হতো রাজ্যের ছৈওয়ালা নৌকার। শহরের মধ্যেও ছিল অসংখ্য ছোট-বড় খাল আর নালা। তাই আমাদের গত শতকের পঞ্চাশ দশকীয় জীবনের সঙ্গে ভেলা আর নৌকার সম্পর্ক ছিল গভীর। কাঁচা-পাকা পথে কত যে ছিল বাঁশের সাঁকো, কাঠের পুল, ইঁট সিমেন্ট লোহার সেতু, কালভার্ট, ব্রিজ। নদী পার হতে ছিল খেয়া, ফেরি।
 শহরের দক্ষিণ-পুব উপকণ্ঠে, নগর জলফৈ গ্রামের মরা পৌলি বিলের এক প্রান্তে, ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কে এক ব্রিজ নির্মাণ নিয়ে - আহা কত যে উত্তেজনা ছিল আমাদের! স্কুলের ছুটিছাটায় প্রায়ই ছুটে যেতাম সেখানে। ইঁটভাটা থেকে খুঁজে-খুঁজে নিয়ে আসতাম মধ্যিখানে ফুটো গোলাকার চাকা-ইঁট।  সেগুলো দিয়ে গাড়ি বানিয়ে ঘুরতাম পাড়াময়। দু’ পাশ থেকে খাড়া উঁচু হয়ে ওঠা সেই সঙ্কীর্ণ ব্রিজ নির্মাণের দুর্নীতি নিয়ে অনেক কেচ্ছাকাহিনী শুনেছি অনেক। সে ব্রিজে উঠতে নামতে অতিরিক্ত সাবধান হয়ে গাড়ি চালাতে হতো চালকদের, যাত্রীরাও কাঁপতেন থর-থর করে। তারপরও বহু দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি হয়েছে সেখানে।
বর্ষাকালে পানির প্রচণ্ড চাপ পড়ে সড়কের ওপর। তাই দু’ পাশে পানির চলাচল স্বাভাবিক রাখতে বিশেষ ভূমিকা রাখে সেতুগুলি। কিন্তু নগর জলফৈ’র সেই সেতুটি অতিসঙ্কীর্ণ হওয়ায় পানির চাপ বরং বাড়িয়ে দিতো সড়কের ওপর। এতে সেতুর দু’পাশের মাটি ধসে যেতো, সড়কও ভাঙতো। পরে ওই সেতুর অনতিদূরে পর-পর দু’টি কালভার্ট করে কমাতে হয় পানির চাপ।
এখন অবশ্য কিছু নেই সে সব। এই দশ-বিশ বছরের মধ্যে উধাও হয়ে গেছে যাবতীয় খেয়া সাঁকো পুল সেতু ব্রিজ কালভার্ট। শ্যামবাবুর খালের চিহ্ন কেউ খুঁজে পাবেন না শহরের কোথাও। সেই লৌহজঙ্গ-ও নেই। এ সব সেতু-ব্রিজের জন্য কত আন্দোলন হয়েছে এক সময়। মনে আছে টাঙ্গাইলের প্রখ্যাত রাজনীতিক-সাহিত্যিক সৈয়দ আবদুল মতিন অনশন ধর্মঘট করেছিলেন লৌহজঙ্গের বুকে ব্রিজ নির্মাণের জন্য। তখন তিনি জানতেন না, একদিন কোনও জলধারা থাকবে না নদী নালা খাল বিল হাওর বাওড়ের কোথাও। সব কিছু বুজে যাবে চারপাশের বিস্তারে, সেতু সাঁকো পুল ব্রিজ কলভার্ট মাটিচাপা দিয়ে চলে যাবে সড়ক-মহাসড়ক।
কেবল আমাদের টাঙ্গাইলের কথা বলছি কেন, যত জেলা-উপজেলা শহরে যাই... দেখি প্রায় একই অবস্থা। তারপরও বাসে-ট্রেনে যেতে-আসতে মাঝেমধ্যে দেখি বিরান মাঠের বুকে - ধূ-ধূ শূন্য চরাচরের মধ্যে - আকাশের দিকে হা করে আছে কত ইট সিমেন্ট কনক্রিট ইসপাতের সংযোগ। দু’দিকে পাড় নেই কোনও, তবুও তারা আছে বন্ধন হয়ে। যানবাহন চলাচল করছে দিনরাত, আর তাদের নিচে শূন্য ভিটায় চরছে বালু ভরা ট্রাক, ভ্যান। এই ঢাকার কাছে কালিগঙ্গা সেতুর কথাই বলি। ৩৫ বছর আগেও দেখেছি ব্রিজের নিচে প্রমত্ত স্রোতধারা, এখন দেখি খাঁ-খাঁ বালুমহাল। যমুনা সেতু পার হতেও দেখি দু’ পাশে জেগে ওঠা চরভূূমিতে একটা-দু’টা ট্রাক। আজ পদ্মা সেতু নিয়ে এত কাণ্ড, কিন্তু দশক দুই পরে কি হবে তা-ই ভাবি!


sazzadqadir@gmail.com

শনিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১২

স্মাগলারদের পোষ্য যারা

ভারতের বাংলাদেশ-বিরোধিতাকে আমরা বলি ‘দাদাগিরি’, ভারতের সঙ্গে দেয়ানেয়ায় আমরা যখন দেশীয় বা জাতীয় স্বার্থ নিয়ে প্রশ্ন তুলি তখন বলা হয় ‘ভারত-বিরোধিতা’। আসলে সব দেশ ও জাতিই দেখে নিজ-নিজ স্বার্থ। তাতে কিন' দোষ হয় না, কেবল দোষ ঘটে আমাদের বেলায়। অথচ দু’ দেশের স্মাগলার আর কতিপয় দুর্নীতিপরায়ণ ও মতলববাজ আমলার কারণেই শুধু মাঝেমধ্যে দেখা দেয় নানারকম টানাপড়েন। এমনিতে দু’ দেশের জনগণ ও রাজনীতিকদের প্রায় সকলেই অত্যন্ত বন্ধুভাবাপন্ন। অতি অল্প কিছু দুষ্ট সব দেশেই আছে, বাংলাদেশ ও ভারতেও আছে। তাদের দায় কেন নিতে হবে সবাইকে? বাংলাদেশে আইএসআই থাকলে র’ কি নেই? বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যত কথাই বলা হোক, এখানে বাবরি মসজিদ, গুজরাত বা আসামের পর্যায়ে বা মাত্রায় কোনও ঘটনা কখনও ঘটায় নি বাংলাদেশের মানুষ। আসলে ভারত-বিরোধিতা বলতে কিছু নেই বাংলাদেশে। ভারতের বিরুদ্ধে কি করবে বাংলাদেশ? যুদ্ধ না কচু? কিছু লোক ভারত-বিরোধী জিগির তোলে, ভারতীয় পণ্য পোড়ায় - খোঁজ নিলে জানা যাবে, ওরা দু’ দেশের স্মাগলারদের পুষ্যি। ভারতীয় শাড়ি, ড্রেস, প্রসাধনী ও অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের দাম বাজারে কমতে শুরু করলেই মাঠে নামানো হয় তাদের। এজন্য দেখা যায় প্রতি বছর পুলিশ ও অন্যদের দিয়ে দোকানে-দোকানে তল্লাশি চালানো হয় ঈদের আগে-আগে। তাতে পুলিশের তোলা ওঠানোও হয়ে যায়, দামও প্রায় দ্বিগুণ বাড়ানো যায় এক লাফে।
    গত ৪০ বছরে সম্পর্কের নানা পর্যায় পেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ ও ভারত। এতগুলো বছর ধরে ক্রমান্বয়ে অনেক কিছু নিয়মিত হওয়ার পর কিছু-কিছু বিষয় মীমাংসার অপেক্ষায় রয়েছে এখনও। তবে দু’ দেশের বর্তমান সরকারের মধ্যে যে আন্তরিকতা দেখি তাতে সমাধান খুব দূরে নয় আশা করছি। সীমান্তে হত্যা, ছিটমহল হস্তান্তর, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন প্রভৃতি অল্প কয়েকটি বিষয় এখন রয়েছে কষাকষির পর্যায়ে। এ ছাড়া ভিসা ও সীমান্ত অতিক্রম পদ্ধতি সহজতর করা দু’ দেশের জন্যই মঙ্গল। চিকিৎসা, শিক্ষা, তীর্থ দর্শন, ভ্রমণ ও অন্যান্য কাজে অনেক বাংলাদেশী যান এবং আরও অনেক যেতে চান ভারতে। ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়া এতেও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে এবং আরও হতে পারে তাদের। আর হ্যাঁ, সীমান্তে ও অন্যান্য স'ানে এই বৈদেশিক মুদ্রাদাতারা ভাল ব্যবহার আশা করতেই পারেন। আসলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিস্ময় ঘটাবার জাদু একটাই - ভারতের উদার মনোভাব। পরস্পরের স্বার্থে এতটুকু ছাড় না দিয়েও এ মনোভাব বজায় রাখা যায়।
    বর্তমান সরকারের আমলে অনেক ক্ষেত্রেই যোগাযোগ বেড়েছে ভারতের সঙ্গে। ভবিষ্যতে আরও বাড়বে বলে আশা করছি আমরা। ১৯৬৫ সালের পর বন্ধ হয়ে যাওয়া অনেক যোগাযোগ রুট চালু হচ্ছে একে-একে। চলচ্চিত্রও আসছে। কলকাতার বাংলা ছবি এসেছে তিনটি। বলিউডের ন’টি হিন্দি ছবি আসছে শিগগিরই। কিন' আমদানিকারকরা ব্লকবাসটার ছবিগুলো আনতেই বেশি আগ্রহী। আমরা আশা করেছিলাম দর্শক ও সমালোচক উভয় মহলে প্রশংসিত ছবিগুলো এলে আমাদের এখানকার প্রেক্ষাগৃহযাত্রীর সংখ্যা বাড়তো, প্রেক্ষাগৃহগুলোরও পরিবেশ ও ব্যবস'া উন্নত হতো। কিন' সে আশায় দেখছি গুড়ে বালি!
    ভারতীয় পণ্য আসে বৈধ-অবৈধ নানা পথে। তারপরও সীমান্তে শুল্ক, কর, ঘুষ এবং পথে-পথে তোলা-চাঁদা সত্ত্বেও দেখা যায় বাজারে ভারতীয় পিয়াজ ২৫ টাকা হলে দেশী পিয়াজ ৩৫ টাকা। তবে সর্বত্র এমন নয়। অনেক ভারতীয় পণ্য কিনতে হয় দ্বিগুণ-ত্রিগুণ দামে। বিলাস-সামগ্রীর ক্ষেত্রে এটা সহ্য করতে পারেন বিলাসীরা, কিন' আমরা তো আর সে সব না হলেও চলে। আমাদের দরকার বই। ছাত্র, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, লেখক, বিচারক, আমলা, রাজনীতিক - সবার দরকার বই। সে বই-পত্র তো বিলাস-সামগ্রী নয়, তা কেন কিনতে হবে দ্বিগুণ-ত্রিগুণ দামে? এর কারণ নাকি সরকারের চাপানো নানা রকম ট্যাক্স-করের বোঝা। শিক্ষা-সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত পণ্যে এত বোঝা কাম্য নয় আমাদের। সমাজ-উন্নয়নের বৃহত্তর স্বার্থে বিষয়টি কি ভেবে দেখবেন সংশ্লিষ্টরা?

sazzadqadir@gmail.com

আমার ব্যাংক ঋণ

ব্যাংক নিয়ে এত খবর আগে তোলপাড় করে নি সংবাদমাধ্যমকে। প্রথমে গ্রামীণ ব্যাংক, তারপর বিশ্ব ব্যাংক, আর এখন সোনালী ব্যাংক। তিনটি ক্ষেত্রেই সরকার বা সরকারের লোকজন অভিযুক্ত। এর আগে থেকেই অভিযোগ শোনা যাচ্ছিল - সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে দেদার। এ কারণে গ্রাহকদের একটু বেশি অঙ্কের পাওনা টাকা দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো। ঘটনা সত্য। আমার পরিচিত একজনের বিপত্তির খবর জেনে বুঝলাম, কত সর্বনাশের কারণ হয়ে উঠেছে এসব আর্থিক কেলেঙ্কারি। সারা জীবনে তিনি আয়-উপার্জন যা করেছেন তা থেকে কিছুটা সঞ্চয় করেছেন ভবিষ্যতে ঘরবাড়ি নির্মাণের আশায়। ব্যাংকে রাখা সে সঞ্চয় এমন কিছু নয়। তারপরও নির্মাণকাজ শুরু করার পর টাকা তুলতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছেন প্রায়ই।
    এ তো নিজের জমানো টাকা। এ টাকা নিয়েই এত সমস্যা। কিন' সমস্যা নেই ঋণ পেতে। কিছু লোককে খুশ করলে যত খুশি ঋণ নেয়া যায়। অথচ আমার ধারণা ছিল খুব জটিল কঠিন বিষয় এই ঋণ পাওয়াটা। বছর আটেক আগে ফ্ল্যাট কেনার জন্য ঋণ পেতে ব্যাংকে-ব্যাংকে ছুটোছুটি করেছি খুব। কাগজপত্র ঘেঁটে, কথা বলে জেনেছি - ৫০% থেকে ৭০% পর্যন্ত ঋণ পাওয়া যায়, তবে সুদের হার নানা রকম। তারপর ব্যাংক যখন প্রয়োজন মনে করবে তখন তাদের ইচ্ছামাফিক বাড়িয়ে নেবে সুদের হার। এছাড়া বয়সেরও ব্যাপার আছে একটা। চুক্তি দুই পক্ষের মধ্যে হলেও সকল শর্ত থাকবে ব্যাংকের পক্ষে। গ্রহীতার পক্ষে কিছু নেই।
    অনেক মাথা ঘামিয়ে, সুদের হার কিছু কম, এমন এক ব্যাংককে বেছে নিই আবেদন করার জন্য। সেখানকার ঋণপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত একজন পদস' কর্মকর্তার সঙ্গে যাই দেখা করতে। এক সময় সাংবাদিক ছিলেন তিনি, এজন্য আশান্বিত ছিলাম বিশেষভাবে। কিন' আমার সাংবাদিক পরিচয় পেয়েই তিনি বলেন, আমিও সাংবাদিক ছিলাম। কিন' সে পরিচয় আর দিই না এখন। বহু সাংবাদিককে বাড়ি করার জন্য ঋণ দিয়েছি আমরা। কিন' নিয়মিত দূরে থাক কোনও কিস্তিই দেন না তাঁদের অনেকে। চিঠি দিলে রাগারাগি করেন, তেড়ে আসেন, হুমকিও দেন।
    বিড়ম্বনার আরও অনেক কাহিনী শোনান তিনি। শেষে বলেন, ‘সাংবাদিকদের ঋণ আমরা দেবো না - এটা আমাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত।’ ওই কর্মকর্তা এখন ওই ব্যাংকের ব্যবস'াপনা পরিচালক।
    এভাবে ব্যাংক ঋণ পেতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হই আমি। সুদীর্ঘ ৪০ বছর (এখন ৫০ বছর) লেখক-সাংবাদিক হিসেবে শতভাগ সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে ওই জোটে আমার যাবতীয় অযোগ্যতার পুরস্কার। এরপর ঋণ পেতে ব্যাংকে ছুটোছুটি করেন আমার স্ত্রী ও তাঁর পক্ষের আত্মীয়-স্বজন। সেখানকার কর্মকর্তারা রাশি-রাশি কাগজপত্র দাবি করতে থাকেন আর সেগুলো যোগাড় করতে-করতে প্রায় আধখানা হয়ে যান মহিলা। তারপরও শেষ হয় না এ দাবি, ও দাবি। শেষে সরজমিন তদন্তে আসেন এক কর্মকর্তা। কথায়-কথায় তিনি জানান, তাঁর মা আমার ছাত্রী। পরিচয় দিতেই মনে পড়ে যায় আমার সেই ১৯৭২-৭৬ সালের অধ্যাপনা-জীবনে ক্লাশে ও টিউটোরিয়ালে দেখা তরুণীটিকে। মেধাবী ছাত্রী হিসেবে আমার প্রিয় ছিল সে, আমার প্রতিও ছিল তার অনেক শ্রদ্ধা-সম্মান। সেই ছাত্রীর সন্তান? খুব খুশি হই এই আশায় যে, এবার সব ফ্যাকড়া শেষ। কারণ তাঁর রিপোর্টের ভিত্তিতেই মঞ্জুর হবে ঋণ।
    তা অবশ্য হয় নি শেষে। তিনি এমন রিপোর্ট দেন যে তাতে অসম্ভব হয়ে ওঠে আমার ঋণ পাওয়া।


sazzadqadir@rediffmail.com

বাংলা কবিতা দিবস ১লা আশ্বিন

প্রতি বছরের মতো এবারও ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা-উপজেলা শহরে বাংলা কবিতা দিবস পালিত হচ্ছে রোববার ১লা আশ্বিন ১৬ই সেপ্টেম্বর। তবে কোথাও-কোথাও দিবসটি ১৪ ও ১৫ই সেপ্টেম্বরও পালিত হয়েছে। গত শুক্রবার বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র ও পাক্ষিক বৈচিত্র-এর যৌথ উদযোগে বাংলা কবিতা দিবস পালিত হয় ১৫ নিউ বেইলি রোডের দ্বিতীয় ভবনের চতুর্থ তলায়। অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ, আলোচনা-আড্ডায় যোগ দেন কবি সাযযাদ কাদির, শাহীন রেজা, ফেরদৌস সালাম, রোকেয়া ইউসুফ, তাহমিনা কোরাইশী, শামসুনাহার, হোসাইন রিদওয়ান আলী খান, নূর কামরুননাহার, মেহের নিগার, কাফি কামাল, সালমান ফরিদ, শাহানা জেসমিন, কামরুজ্জামান, সাবিত সারোয়ার, জামিল জাহাঙ্গীর, কাজী ফারহানা ইয়াসমিন শান্তা, সেঁজুতি শুভ আহমেদ, তকিউদ্দিন মোহাম্মদ আকরাম প্রমুখ। অনুষ্ঠানের শুরুতে সদ্যপ্রয়াত কবি আপন মাহমুদ স্মরণে শোক নিবেদন করা হয়।