মঙ্গলবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১২

আকাশের দিকে হা

বড় হয়েছি নদীর সঙ্গে। আমাদের টাঙ্গাইল শহরের পশ্চিম পাশ ঘেঁষে ছিল সেই নদী। নাম লৌহজঙ্গ। বর্ষায় দু’ কূল ছাপিয়ে হয়ে উঠতো প্রবল প্রমত্ত। তখন কি তীব্র স্রোত! বহু দূর থেকে শোনা যেতো নদীর ডাক। তখন কত নৌকা যেতো পাল তুলে, গুণ টেনে। ছোট-বড় মহাজনী নৌকার ভিড় হতো ঘাটে-ঘাটে। নৌকা বাইচ হতো রীতিমতো হৈহল্লা করে, ঢাকঢোল পিটিয়ে। অন্য সময়ে কুলু-কুলু বয়ে যেতো লৌহজঙ্গ, শীতকালে তো রীতিমতো শান্তশিষ্ট।
শহরের বুক চিরেও ছিল একটি খাল। শ্যামবাবুর খাল। শহরের পশ্চিম উপকণ্ঠ দিয়ে বয়ে যাওয়া বংশাই নদীর সঙ্গে লৌহজঙ্গকে যুক্ত করার জন্য কাটা হয়েছিল সেই খাল। সে কাজ করেছিলেন শ্যামবাবু নামের কোনও ঠিকাদার। সেই থেকে খালের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল তাঁর নাম। এ খালেও পানি থাকতো সারা বছর। বর্ষাকালে ভিড় হতো রাজ্যের ছৈওয়ালা নৌকার। শহরের মধ্যেও ছিল অসংখ্য ছোট-বড় খাল আর নালা। তাই আমাদের গত শতকের পঞ্চাশ দশকীয় জীবনের সঙ্গে ভেলা আর নৌকার সম্পর্ক ছিল গভীর। কাঁচা-পাকা পথে কত যে ছিল বাঁশের সাঁকো, কাঠের পুল, ইঁট সিমেন্ট লোহার সেতু, কালভার্ট, ব্রিজ। নদী পার হতে ছিল খেয়া, ফেরি।
 শহরের দক্ষিণ-পুব উপকণ্ঠে, নগর জলফৈ গ্রামের মরা পৌলি বিলের এক প্রান্তে, ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কে এক ব্রিজ নির্মাণ নিয়ে - আহা কত যে উত্তেজনা ছিল আমাদের! স্কুলের ছুটিছাটায় প্রায়ই ছুটে যেতাম সেখানে। ইঁটভাটা থেকে খুঁজে-খুঁজে নিয়ে আসতাম মধ্যিখানে ফুটো গোলাকার চাকা-ইঁট।  সেগুলো দিয়ে গাড়ি বানিয়ে ঘুরতাম পাড়াময়। দু’ পাশ থেকে খাড়া উঁচু হয়ে ওঠা সেই সঙ্কীর্ণ ব্রিজ নির্মাণের দুর্নীতি নিয়ে অনেক কেচ্ছাকাহিনী শুনেছি অনেক। সে ব্রিজে উঠতে নামতে অতিরিক্ত সাবধান হয়ে গাড়ি চালাতে হতো চালকদের, যাত্রীরাও কাঁপতেন থর-থর করে। তারপরও বহু দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি হয়েছে সেখানে।
বর্ষাকালে পানির প্রচণ্ড চাপ পড়ে সড়কের ওপর। তাই দু’ পাশে পানির চলাচল স্বাভাবিক রাখতে বিশেষ ভূমিকা রাখে সেতুগুলি। কিন্তু নগর জলফৈ’র সেই সেতুটি অতিসঙ্কীর্ণ হওয়ায় পানির চাপ বরং বাড়িয়ে দিতো সড়কের ওপর। এতে সেতুর দু’পাশের মাটি ধসে যেতো, সড়কও ভাঙতো। পরে ওই সেতুর অনতিদূরে পর-পর দু’টি কালভার্ট করে কমাতে হয় পানির চাপ।
এখন অবশ্য কিছু নেই সে সব। এই দশ-বিশ বছরের মধ্যে উধাও হয়ে গেছে যাবতীয় খেয়া সাঁকো পুল সেতু ব্রিজ কালভার্ট। শ্যামবাবুর খালের চিহ্ন কেউ খুঁজে পাবেন না শহরের কোথাও। সেই লৌহজঙ্গ-ও নেই। এ সব সেতু-ব্রিজের জন্য কত আন্দোলন হয়েছে এক সময়। মনে আছে টাঙ্গাইলের প্রখ্যাত রাজনীতিক-সাহিত্যিক সৈয়দ আবদুল মতিন অনশন ধর্মঘট করেছিলেন লৌহজঙ্গের বুকে ব্রিজ নির্মাণের জন্য। তখন তিনি জানতেন না, একদিন কোনও জলধারা থাকবে না নদী নালা খাল বিল হাওর বাওড়ের কোথাও। সব কিছু বুজে যাবে চারপাশের বিস্তারে, সেতু সাঁকো পুল ব্রিজ কলভার্ট মাটিচাপা দিয়ে চলে যাবে সড়ক-মহাসড়ক।
কেবল আমাদের টাঙ্গাইলের কথা বলছি কেন, যত জেলা-উপজেলা শহরে যাই... দেখি প্রায় একই অবস্থা। তারপরও বাসে-ট্রেনে যেতে-আসতে মাঝেমধ্যে দেখি বিরান মাঠের বুকে - ধূ-ধূ শূন্য চরাচরের মধ্যে - আকাশের দিকে হা করে আছে কত ইট সিমেন্ট কনক্রিট ইসপাতের সংযোগ। দু’দিকে পাড় নেই কোনও, তবুও তারা আছে বন্ধন হয়ে। যানবাহন চলাচল করছে দিনরাত, আর তাদের নিচে শূন্য ভিটায় চরছে বালু ভরা ট্রাক, ভ্যান। এই ঢাকার কাছে কালিগঙ্গা সেতুর কথাই বলি। ৩৫ বছর আগেও দেখেছি ব্রিজের নিচে প্রমত্ত স্রোতধারা, এখন দেখি খাঁ-খাঁ বালুমহাল। যমুনা সেতু পার হতেও দেখি দু’ পাশে জেগে ওঠা চরভূূমিতে একটা-দু’টা ট্রাক। আজ পদ্মা সেতু নিয়ে এত কাণ্ড, কিন্তু দশক দুই পরে কি হবে তা-ই ভাবি!


sazzadqadir@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন