শনিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১২

দেশবাসীর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহ

শ্রীশচন্দ্র দাশের ‘সাহিত্য-সন্দর্শন’ নামে একটি বই আমাদের পাঠ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওই বই পড়ে সাহিত্যের নানা বিষয় ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে নানা ধারণা পেয়েছি আমরা। তবে সাহিত্য সংক্রান্ত সে সব বিচার জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজে লাগে নি তেমন। যেমন, সমালোচনা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, “সহৃদয়তা, রসবোধ ও উদারতা সমালোচকের প্রধান গুণ।” রাজনীতিতে এই তিন গুণের স্থান নিয়েছে বিরোধিতা, নিন্দাবাদ ও গালাগালি। আর সে গালাগলি হয় রীতিমতো বাপ-মা তুলে।
    কবিতা, সাহিত্য বা রাজনীতিতে অনেক ম্যাজিক থাকে, কিন্তু ‘সমালোচনা লজিক হতে বাধ্য’। তা হলেও ‘সমালোচনা কারও পছন্দ নয়, সত্য হলেও নয়।’ রবীন্দ্রনাথও সমালোচনা করেছেন সমালোচকদের, “মূলধন না থাকিলেও দালালির কাজে নামিতে কাহারও বাধে না, তেমনি সাহিত্য সমালোচনায় কোনও প্রকার পুঁজির জন্য কেহ সবুর করে না। কেননা, সমালোচকের পদটা সম্পূর্ণ নিরাপদ।” তবে আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে মূল্যায়ন-বিশ্লেষণের কথা বলা হলেও বাস্তবে প্রশংসা আর নিন্দা ছাড়া কিছুই হয় না শেষ পর্যন্ত। আমরা দেখে-দেখে শুনে-শুনে বাধ্য হয়েছি এ ভবিতব্যই মেনে নিতে। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, “বোধ হয় বড় হলেই লোকে নিন্দে করে।” রবীন্দ্রনাথ কিছুটা কৌতুক করেই বলেছেন, “নিন্দা না থাকিলে পৃথিবীতে জীবনের গৌরব কি থাকিত! একটা ভাল কাজে হাত দিলাম, তাহার নিন্দা কেহ করে না - সে ভাল কাজের দাম কি!” নিন্দাচর্চার একটি ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন:
    “ওকে তুমি বলো নিন্দুক, - তা সত্য।
    সত্যকে বাড়িয়ে তুলে বাঁকিয়ে দিয়ে ও নিন্দে বানায় -
    যার নিন্দে করে তার মন্দ হবে বলে নয়,
    যারা নিন্দে শোনে তাদের ভাল লাগবে বলে।...” (‘অপরাধী’, “পুনশ্চ”)
তবে যা-ই বলুন... তিনিও সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেন নি সমালোচনাকে। তাই নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর বোলপুরে আয়োজিত সংবর্ধনায় নিজের ক্ষোভ আর দমিয়ে রাখতে পারেন নি, সবই উগরে দিয়েছিলেন সমবেত সুধীজনের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনা সম্পর্কে কবি-সমালোচক মেহিতলাল মজুমদার বলেছেন, “... (রবিবাবু) আমাদের শুধু জুতো মরতে বাকি রেখেছে। বললে কিনা... ‘গ্রাম্য বালকেরা যেমন কুকুরের লেজে টিন বেঁধে হাততালি দিয়ে তাড়া করে বেড়ায়, আপনারা তাই করতে এসেছেন।’ সভা ভাঙার পর আমরা সবাই হেঁটে বোলপুর স্টেশনে ফিরছি, তখন রবিবাবু জগদীশ বোসকে নিয়ে আমাদের গায়ে ধুলো ছিটিয়ে টমটম হাঁকিয়ে চলে গেলেন।”
সমবেত সুধীজনের সংবর্ধনা গ্রহণ না করে রবীন্দ্রনাথ সেদিন বলেছিলেন, “আজ আমাকে সমস্ত দেশের নামে আপনারা যে সম্মান দিতে এখানে উপস্থিত হয়েছেন তা অসঙ্কোচে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করি এমন সাধ্য আমার নেই।... দেশের লোকের হাত থেকে যে অপযশ ও অপমান আমার ভাগ্যে পৌঁছেছে তার পরিমাণ নিতান্ত অল্প হয় নি, এবং এতকাল আমি তা নিঃশব্দে বহন করে এসেছি।... যে কারণেই হোক, আজ ইউরোপ আমাকে সম্মানের বরমাল্য দান করেছেন। তার যদি কোনও মূল্য থাকে তবে সে কেবল সেখানকার গুণীজনের রসবোধের মধ্যেই আছে, আমাদের দেশের সঙ্গে তার কোনও আন্তরিক সম্বন্ধ নেই।... অতএব আজ যখন সমস্ত দেশের জনসাধারণের প্রতিনিধিরূপে আপনারা আমাকে সম্মান উপহার দিতে প্রবৃত্ত হয়েছেন, তখন সে সম্মান কেমন করে নির্ল্লজ্জভাবে গ্রহণ করবো? আমার আজকের এই দিন তো চিরকাল থাকবে না। আবার ভাটার বেলা আসবে, তখন পঞ্চতলের সমস্ত দৈন্য আবার তো ধাপে ধাপে প্রকাশ হতে থাকবে।... তাই আমি আপনাদের কাছে করজোড়ে জানাচ্ছি - যা সত্য তা কঠিন হলেও আমি মাথায় পেতে নেবো, কিন্তু সাময়িক উত্তেজনার মায়া যা, তা স্বীকার করে নিতে আমি অক্ষম। কোনও কোনও দেশে বন্ধু ও অতিথিদের সুরা দিয়ে অভ্যর্থনা করা হয়। আজ আপনারা আদর করে সম্মানের যে সুরাপাত্র আমার সম্মুখে ধরেছেন, তা আমি ওষ্ঠের কাছে পর্যন্ত ঠেকাবো, কিন্তু এ মদিরা আমি অন্তরে গ্রহণ করতে পারবো না। এর মত্ততা থেকে আমি চিত্তকে দূরে রাখতে চাই।...”
কিন্তু নিন্দা-সমালোচনা শুধু সাহিত্যের চাপান-উতোর নয়... জীবনের সত্য, রাজনীতির বাস্তবতা। সমালোচনা এড়িয়ে চলতে চাইলে কিছু করা যাবে না, বলা যাবে না, কিছু হওয়াও যাবে না। তা তো সম্ভব নয়। সমালোচনা থাকবে, কাজও থেমে থাকবে না। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চারচিল (১৮৭৪-১৯৬৫) বলেছেন, Criticism may not be agreeable, but it is necessary. It fulfils the same function as pain in the human body. It calls attention to an unhealthy state of things.  মারকিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট (১৮৫৮-১৯১৯) সমালোচনার প্রতি আরও জোর দিয়ে বলেছেন, To announce that there must be no criticism of the president... is morally treasonable to the American public.
এরপর মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন মনে করি।


sazzadqadir@rediffmail.com

উৎসবের উৎসর্গে

জীবনে সংযম, সমাজে কৃচ্ছ্র - কিছুই চোখে পড়ে না তেমন, তারপরও সংযম-অবসানের উৎসব ঈদ উল-ফিতর পালন করেছি আমরা। এবার উৎসর্গের উৎসব ঈদ আল-আজহা। ঈদ-উজ-জুহা। এ উৎসবে কি দেবো উৎসর্গ? প্রায় সব উৎসবই তো উৎসর্গ করে ফেলেছি আমরা, আর কি আছে উৎসর্গের?
    প্রকৃতির বুকে যে শোভা ও সম্পদ ছিল তা আজ কোথায়? বনাঞ্চল উজাড়। পাহাড় কেটে সাফ। নদী নালা খাল বিল হাওর ক্রমশ শুকনো ডাঙ্গা। পশু পাখি মাছ ফল ফুল উধাও। শ্যামলী নিসর্গের বুকে মরুবিস্তারই এখন শুধু এক অব্যাহত বাস্তবতা।
    সামনে ডিসেম্বর।  বিজয়ের মাস। বিজয়ের উৎসব করেছি আমরা। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিজয়। সে সব বিজয়ও তো উৎসর্গ হয়ে গেছে। বিশ্বায়নের বুকে জাতীয়তাবোধ আজ বিলীয়মান। লুটেরা ধনিক শ্রেণীর ক্রমোত্থানে সমাজতন্ত্র নিষিদ্ধ। সামপ্রদায়িকতা-মৌলবাদের গ্রাসে পড়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা। গণতন্ত্র শিকার হয়েছে কলহপরায়ণ রাজনীতির। বিশ্বমোড়লেরা খামচে ধরেছে স্বাধীনতাকে। থাবা এসে পড়েছে সাগরগর্ভের - ভূগর্ভের সম্পদে।
    ওদিকে শিল্পাঞ্চলে বিকাশ ঘটেছে কারখানা ভাঙচুর শিল্পের। শিক্ষাঙ্গন হয়েছে রণাঙ্গন। প্রশাসনে চলে নির্লজ্জ দলীয়করণ। আইন-শৃঙ্খলাকে চ্যালেঞ্জ করে চলে সন্ত্রাস। চলে চাঁদাবাজ-টেন্ডারবাজ - সব রকম বাজের দাপট। নারীর ক্ষমতায়ন পরিণত হয়েছে উত্ত্যক্তিতে। আর উত্ত্যক্তকারীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গেলে আসে নিন্দামন্দ, হুমকি, আরও বিপদ। আমি নিজে পর্যন্ত এর শিকার। পাশাপাশি শতক-প্রাচীন পরদা-অবরোধ প্রথাবিরোধী আন্দোলনের পর এসেছে বোরকা-প্রথার হুমকি। ওদিকে কালো টাকা, খেলাপি সংস্কৃতি, দুর্নীতি বসেছে জাঁকিয়ে। বেপরোয়া হয়ে উঠেছে লুট, জালিয়াতি, সন্ত্রাস।
    তাহলে আজ কি উৎসর্গ আমাদের?
    আগে বলতাম পশুহত্যার কথা। বলতাম এ হত্যা প্রতীকী। আমাদের ভেতর আছে পশুপ্রবৃত্তি। কখনও সে প্রবৃত্তিতাড়িত হই আমরা। সে তাড়নার ধ্বংস এবং এমন আরও যা কিছু আছে অশুভ  সে সবের বিনাশ ঘটাতে সঙ্কল্প করি আমরা এই উৎসর্গের উৎসবে। কিন্তু এখন কি আর এ সব বলে কেউ নিজেদের পরিচয় দেবেন পশুবিদ্বেষী বলে? পাশব, পাশবিক, পাশবিকতা, নরপশু, পশুসুলভ, পশুপ্রবৃত্তি - এ সব শব্দ এখন লিখেন বা বলেন - এমন লোকের সংখ্যা এখন খুবই কম। কারণ পশু সবসময় প্রাকৃতিক আচরণ করে, হত্যা ধর্ষণ ইত্যাদি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে না। মানুষই বরং করে অপ্রাকৃতিক আচরণ। যাবতীয় কুকর্ম, দুষ্কর্ম। পশু নয় মানুষই দুরাচারী। কাজেই পশুহত্যার পুরনো ব্যাখ্যা দেয়া বৃথা। দেশে অপ্রতুল পশুসম্পদ। সে দিক থেকেও তেমন যুক্তি দেয়া যাবে না হত্যার পক্ষে। অমুসলিম দেশে কোরবানির জন্য পশুহত্যার অনুমোদন মেলে না সহজে। কোনও-কোনও দেশে তা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত। ইদানীং মুসলিম-প্রধান দেশেও সক্রিয় হয়ে উঠেছে পশুরক্ষা সমিতি, পশুক্লেশ নিবারণী সংস্থাগুলো।  ফরাসি দেশের সাবেক যৌন তারকা ব্রিজিত বারদো তো কয়েক দশক ধরে রীতিমতো যুদ্ধ করে চলেছেন কোরবানি প্রথার বিরুদ্ধে। এখন তাঁর সে যুদ্ধ দাঁড়িয়েছে সরাসরি ইসলামের বিরুদ্ধে।
    প্রখ্যাত কথাশিল্পী মাহবুব-উল-আলম (১৮৯৮-১৯৮১) তাঁর “তাজিয়া” (১৯৪৬) গল্পগ্রন্থের “কোরবাণী” গল্পে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক দৃশ্যগুলোর একটি সৃষ্টি করেছেন - রমিজ-পরিবারের পোষা গরু ‘মুন্না’কে উৎসর্গ করার বর্ণনায় - “... রমিজ যখন বাড়ীর দরজায় আসিয়া পৌঁছিল, হাফিজ ও আর দুই-তিনটি জোয়ান মুন্নাকে তখন মাটিতে কাৎ করিয়া ফেলিয়াছে। হাফিজ তখন ঘাড়টা বাঁকাইয়া মুখটা এ-ভাবে মাটিতে চাপিয়া ধরিয়াছে যে, তাহার গলাটা উপরে উঠিয়াছে, আর ঠিক ইহারই ঊর্ধ্বে কৃপাণ উদ্যত করিয়া ইমাম বিড় বিড় মন্ত্র পড়িতেছেন।... মুন্না এতগুলি জোয়ানের চাপে ঠির ঠির করিয়া কাঁপিতেছিল। ভয়ে তাহার গলা শুকাইয়া কাঠ হইয়া গিয়াছিল। চোখে সে কিছুই দেখিতে পাইতেছিল না;... প্রাণপণে একবার পা ছুড়িতে চেষ্টা করিল; মুখের অব্যক্ত আওয়াজ সম্মুখে পথ না পাইয়া পেটের ভিতর বাজিয়া উঠিল ‘অঁ -’। আর এমনি সময় ইমাম সাহেব... উহার গলায় কৃপাণ চালাইয়া দিলেন। রমিজ ও বৌয়ের নাম শোনা গেল; আর নামগুলি ফিন্‌কি দিয়া ঘড় ঘড় শব্দে যে রক্ত ছুটিল উহাতে তলাইয়া গেল।... মুন্নার চোখ দু’টি প্রাণহীন মুক্তার ন্যায় অপলকে চাহিয়া আছে, ছিন্ন কণ্ঠনালী ও উহার দু’পাশের মাটিতে রক্ত জমাট বাঁধিয়া সবুজের বুকে যেন মরিচা ধরাইয়া দিয়াছে।... যে রক্তপাত হইয়া গেল উহা যেন মুন্নার নহে, কোথা দিয়া কি করিয়া যেন বাড়িরই হৃৎপিণ্ড হইতে অজস্র রক্ত বাহির হইয়া গিয়াছে।...”
    কিন্তু যতই হৃদয়বিদারক হোক পশুহত্যায় ঘাটতি নেই কোথাও। প্রতি বছর এর জোশ বাড়ছে। ব্যয় বাড়ছে, শান বাড়ছে। কারণ এর সঙ্গে অনেক স্বার্থ এবং বিপুল অর্থ জড়িত। সে স্বার্থ অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক, ধান্দাগত। উট-দুমবা-গরু আমদানি ও চোরাচালান জড়িত এ ব্যবসায়ে। হাট ইজারা, পরিবহন ব্যবসা, পোশাকিদের চাঁদাবাজি, দলীয়দের তোলা আদায়, বাঁশ ফেলে টোল, গাড়ি বা ফেরি আটকে সেলামি, মাইকিং করে ভিক্ষা - এ রকম বহু কিছু জড়িত। মসজিদ-মাদরাসা থেকে চামড়া ও হাড়গোড় শিল্প পর্যন্ত জড়িত। পাড়ার মাসতান, ক্লাব, কল্যাণ সমিতি থেকে মহান নেতানেত্রীদের নামধারী পরিষদ পর্যন্ত জড়িত। মন্ত্রী-এমপি জড়িত। নামীদামিদের সামাজিক মর্যাদা, প্রভাব-প্রতিপত্তি জড়িত। সামনের সকল ইলেকশন জড়িত। ওই সব ইলেকশনে যারা জড়িত তারাও জড়িত।
    তাহলে কবি নজরুল যে লিখেছিলেন “ওরে হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ - সত্যের উদ্বোধন” - সেই সত্য আজ কি? আজ আমাদের কি উৎসর্গ করতে হবে? কি উৎসর্গ করলে সার্থক হবে উৎসব?
    আমি তো মনে করি প্রথমে আমাদের উৎসর্গ করতে হবে যুগে-যুগে জমে ওঠা যাবতীয় জঞ্জাল। সহজ নয় কাজটি। ঘাড়ে চেপে বসে সে জঞ্জাল এখন বিষম ভার হয়ে উঠেছে দেশ জাতি জনগণের জন্য। তবুও যত কঠিনই হোক, ত্যাগ আমাদের করতেই হবে। ভূয়া নেতাদের ভোট দেয়ার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। তাদের সঙ্গে দহরম মহরম বন্ধুত্ব ত্যাগ করতে হবে। দুর্নীতিপরায়ণ আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধবের প্রতি মায়ামমতা ত্যাগ করতে হবে। কুসন্তানকে প্রশ্রয় দেয়া ত্যাগ করতে হবে। পরিবারের বা পাড়ার দুর্বৃত্তদের সহ্য করা ত্যাগ করতে হবে। চেনাজানা ভূয়া ও দুর্জনের মুখোশ উন্মোচনে চক্ষুলজ্জা ত্যাগ করতে হবে। কিছু অভ্যাস, কিছু সহিষ্ণুতা, কিছু ভুল সৌজন্য, মনের কিছু দুর্বলতা, নিজের কিছু প্রাপ্তির আশা - এই সবকে সামান্য ভেবে ত্যাগ করতে পারলে একদিন কিন্তু সত্যি-সত্যিই ঘটতে পারে সত্যের অসামান্য উদ্বোধন। খুব তাড়াতাড়ি কোনও কিছুই হবে না, কিন্তু ত্যাগের অভ্যাস গড়ে তুললে ... আচ্ছা, ভাবতে দোষ কি... একদিন হয়তো ঘুষ-চাঁদা দিতে হবে না, মাসতানের রক্তচক্ষু থাকবে না, নেতার সঙ্গে কর্মী থাকবে কিন্তু ক্যাডার থাকবে না, নকলবাজ ছাত্র ও নকল সরবরাহকারী শিক্ষক থাকবে না, তদবিরবাজ ও ধান্দাবাজ থাকবে না, দলবাজ কবি লেখক সাংবাদিক বিচারক থাকবে না, নারীগঞ্জক থাকবে না, অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা ও চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত মানুষ - ভিখিরি - ফুটপাতে অসহায় জীবন, ক্ষুধার্ত শিশুর কান্না থাকবে না।
    আজ ওই ত্যাগ ও উৎসর্গই বাকি আছে আমাদের উৎসবের জন্য। আসুন সবাই মিলিত হই এ উৎসবে। বলি “সকলের তরে মোরা সবাই, সুখ-দুখ সম-ভাগ ক’রে নেব সকলে ভাই...।”

sazzadqadir@rediffmail.com

বৃহস্পতিবার, ১১ অক্টোবর, ২০১২

পাকা চোর অতিশয়

অনেক কিছু চুরি গেছে আমার। মূল্যবান বইপত্র, বহু কষ্টে সংগৃহীত সিডি-ডিভিডি, প্রিয় সেলফোন সেট, স্মৃতিবাহী আংটি-ঘড়ি, বিদেশ থেকে আনা শিল্প-কর্ম, তৈজসপত্র, সজ্জা ও শয্যা সামগ্রী, আমার অতি সাধের হারকিউলিস সাইকেল... আরও কত শখের ও স্মৃতির জিনিস। নগদ টাকা, স্থাবর সম্পত্তি। আর আমাদের টাঙ্গাইল শহরের আকুরটাকুর পাড়ার বাড়ি থেকে চুরি গেছে এবং এখনও যাচ্ছে কত কি। পুকুরের মাছ, গাছের ফল-ফুল, খোঁয়াড় থেকে হাঁস মোরগ মুরগি ডিম, গোয়াল থেকে ছাগল-খাশি গরু-ছাগল, বাগানের শাকসবজি, বাঁশ গাছ কলা গাছ লতি-লতা... আরও অনেক কিছু। এখন তো চুরি হয়ে গেছে বাড়িটারই অনেকখনি।
এই চোরদের সঙ্গে কখনও দেখা-সাক্ষাৎ হয় না আমার। যারা সিনাজুরি করে, নানা ফন্দি-ফিকির করে, হাতিয়ে নিয়েছে - তাদের নিয়ে কোনও সমস্যা নেই আমার। কারণ পারতপক্ষে আমার সামনেই আসে না তারা। আর যারা গোপনে হাতসাফাই করে সটকে পড়েছে তাদের তো চিনিই না আমি। দু’একজনকে হয়তো সন্দেহ করি, কিন্তু তাতে তো চোর ধরতে পারি না নিশ্চিত হয়ে। রবীন্দ্রনাথের বা অন্নদাশঙ্করের ‘গিন্নি’র মতো জোর দিয়ে কাউকে চোর বলায় বিপদও আছে। রবীন্দ্রনাথের ‘গিন্নি’র দু’চোখের বিষ ‘পুরাতন ভৃত্য’ কেষ্টা। তাই “যা কিছু হারায়, গিন্নি বলেন, কেষ্টা বেটাই চোর!” আর অন্নদাশঙ্করের ‘গিন্নি’র মতে সব নষ্টের গোড়া কম্যুনিস্ট পার্টির লোকজন। তাই যেখানে যা-ই ঘটুক তিনি দোষ দেন তাদের - “মুরশিদাবাদে হয় না বৃষ্টি? মূলে কেটা? গিন্নি বলেন, কম্যুনিস্টি!”
আমাদের এখানেও ‘গিন্নি’ আছেন অমন। ‘চোর’ বা ‘কম্যুনিস্টি’ খুঁজতে বেশি ভাবতে হয় না তাদের। আগে থেকেই সব জেনে বসে থাকেন বলে সঙ্গে-সঙ্গে বলে দেন ফস করে ‘মূলে কেটা’। রোহিঙ্গ্যা কেন এদেশে আসে, বোড়োল্যান্ডে কেন দাঙ্গা লাগে, বিশ্বব্যাংক কেন ঋণ নিয়ে ঘাপলা করে, সোনালী ব্যাংকে কেন ঋণ জালিয়াতি হয়, রামু-পটিয়ায় কেন হাঙ্গামা হয় - সব তাদের জানা। তাই চক্রান্তকারী দুর্বৃত্তদের নাম বলতে দেরি হয় না একটুও।
আমার সমস্যা চোর মহাচোর বিশ্বচোরদের নিয়ে। পত্রিকায় তাদের বৃত্তান্ত পড়ি, টেলিভিশনে কর্মকাণ্ড দেখি, লোকমুখে শুনি, জানি - তারপর এদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় এখানে সেখানে। তখন সালাম আদাব দিতে হয় তাদের, হাসিমুখে কথা কইতে হয়, আদর-আপ্যায়ন করতে হয়, সভা সমাবেশ সেমিনারে সৌজন্য দেখিয়ে নানরকম প্রশংসাও করতে হয়। জেনেশুনে কোনও চোরকে সম্মান-শ্রদ্ধা দেখানো আসলেই খুব কঠিন কাজ। কিন্তু না দেখিয়ে উপায়ই বা কি? সেকালের প্রখ্যাত সাহিত্যিক-সাংবাদিক যোগেন্দ্রচন্দ্র বসু (১৮৫৪-১৯০৫) তাঁর ‘কালাচাঁদ’ উপন্যাসে এক ‘ছোটলোক’ চোরের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন, “চুরি কে না করে? মিথ্যা কথা কে না কয়? বঞ্চনা কাহাতে নাই? তবে বড়লোক ধরা পড়ে না; আমার মতো ছোটলোকেই ধরা পড়ে। ছোটলোকে সিঁধ কাটিয়া চুরি করে, আর বড়লোক কথার কৌশলে, বুদ্ধির জোরে চুরি করে। আমরা অসভ্য চোর, তাহারা সভ্য চোর।”
এ উপন্যাস প্রকাশের পর কেটে গেছে ১০০ বছরের বেশি সময়, কিন্তু পরিবেশ-পরিস্থিতি কি বদলেছে কিছু? আমার মনে হয়, তা বদলেছে অনেকখানি। সেকালে অসভ্য চোর ছিল বেশি, তারপর এই এক শতকে সভ্যতার অগ্রগতি-বিকাশের সঙ্গে-সঙ্গে বেশি হয়েছে সভ্য চোরের সংখ্যা। আজ সব দিকেই দেখতে পাই সভ্য শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত চোর। এরা চুরি করছে পণ্যবাজার শেয়ারবাজার জায়গাজমি নদী খাল বিল ব্যাংক বিশ্ববিদ্যালয় টেন্ডার নিয়োগ ভর্তি পরীক্ষা ফল। তারপর শুনছি তাদের বড় গলা। একেই বলে চুরির চুরি সিনাজুরি। আগের কালো বিড়ালদের এক কান কাটলে তারা যেতো রাসতার পাশ দিয়ে মুখ লুকিয়ে, এখনকার দু’ কানকাটা কালো বিড়ালেরা চলছে রাসতার মাঝখান দিয়ে। তাদের উদ্দেশে বলতে ইচ্ছা হয় -
‘করিব না চুরি’ কভু বলিও না আর।
কেন করিবে না চুরি, ভাবো একবার।
    উন্নতি চাহে যারা
    আগে চুরি করে তারা
চুরি করে হতে হয় নেতা জনতার
একবার চুরি নহে করো শতবার। - ‘চুরি-মাহাত্ম্য’, অমিয়কুমার মুখোপাধ্যায়

sazzadqadir@yahoo.com

বুধবার, ১০ অক্টোবর, ২০১২

কবি বাসুদেব দেব আর নেই

ষাট দশকের শীর্ষস্থানীয় কবি, সাহিত্যপত্র ‘কালপ্রতিমা’র নির্বাহী সম্পাদক, বাসুদেব দেব আর নেই। মঙ্গলবার দুপুর ০১টা ৩০ মিনিটে কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি। বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।
‘ষাটের স্বতন্ত্র কবি’ হিসেবে বিশেষভাবে খ্যাত বাসুদেব দেব-এর জন্ম বরিশালের হিজলতলা গ্রামে, ১৯৩৬ সালের ২০শে ডিসেম্বরে। বৃত্তিতে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সিভিল সারভিসের সদস্য। অবসর নেয়ার পর ছিলেন একটি জাতীয় স্তরের স্বেচ্ছাব্রতী সংস্থার উপদেষ্টা। আর কবিতা সম্পর্কে সমালোচকরা মন্তব্য করেছেন ‘এক আবহমান জীবনের খণ্ড শোভাযাত্রা, আমাদের বহুমাত্রিক অস্তিত্বের সামান্য অনুবাদ’। তিনি নিজেও ছিলেন বহুমাত্রিক লেখক, কবিতার বাইরে ‘মানবিকতার প্রতি নিবিড় আনুগত্য’ নিয়ে বিচরণ করেছেন সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়। তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- কবিতা: একটা গুলির শব্দে, রৌদ্রের ভিতরে চিঠি, রাঙাসখী ভালো থেকো, তোমার ঘুঙুর, আরো কাছে যেতে, নাও আমাকে নাও, দেখা দাও প্রতিদিন, আমাদের আলো অন্ধকার, হেমন্ত সন্ধ্যার গান, আরো কিছু কথা, নির্বাচিত কবিতা; উপন্যাস: পুড়ে যাচ্ছে; স্মৃতিকথা: দেখাশোনা; ছোটগল্প: আমার খুব জ্বর, মাধুরীর ছাতা; প্রবন্ধ: কবিতা কালপ্রতিমা; নাটক: বারণাবতের বাড়ি, বউয়ের খুব অসুখ, নক্ষত্র ও নীবারের গান। এছাড়া রয়েছে তার কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধের বই।
কবি বাসুদেব দেবের আকস্মিক মৃত্যুতে বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রের পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন কবি সাযযাদ কাদির।


বৃহস্পতিবার, ৪ অক্টোবর, ২০১২

নীরব থাকে যারা

অন্যের বাড়িতে যখন আগুন ধরে তখন অনেকে শীতের রাতে তাপ পোহাবার আরাম পায়, অনেকে সুযোগ খোঁজে মূল্যবান জিনিসপত্র হাতাবার, অনেকে মতলব করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার, অনেকে সমালোচনার ছুরি শানায় প্রশাসনের বিরুদ্ধে, অনেকে চুপচাপ থাকে হাত-পা গুটিয়ে। সম্প্রতি পশ্চিম মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে  রাখাইন সম্প্রদায়ের হামলায় রোহিঙ্গ্যা মুসলমানরা হত্যা ধর্ষণ লুণ্ঠন অগ্নিসংযোগের শিকার হওয়ার পর এমন একটি অবস্থাই সৃষ্টি হয় এদেশে। প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গ্যাদের আশ্রয় দেয়া হবে কিনা তা নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন অনেকে। আশ্রয়প্রার্থীদের তাড়িয়ে দেয়া নিয়েও বিতর্ক চলে। একটি মহল রোহিঙ্গ্যাদের বিরুদ্ধে হয়ে ওঠে অভিযোগমুখর। বিতর্কের নামে শুরু হয় ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানো। ফেনিয়ে ওঠে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পও। এর মধ্যে প্রাণ হারায় ৬৫০ জন রোহিঙ্গ্যা, গুম হয় ১২০০ জন, ভিটেছাড়া হয় ৮০ হাজার। আমাদের এখানে বিতর্কে মগ্ন থাকে কয়েকটি মহল, আর কয়েকটি মহল থাকে নীরব। এর পর-পরই উত্তর-পূর্ব ভারতের বোড়োল্যান্ড  টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল-এর কোকরাঝার জেলায় শুরু হয় জাতিগত সহিংসতা। অসমিয়া মুসলমানরা এবার হত্যা ধর্ষণ লুণ্ঠন অগ্নিসংযোগের শিকার। হামলাকারীরা বোড়ো সম্প্রদায়ের। সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে কোকরাঝার ছাড়িয়ে ধুবড়ি, চিরাং ও বড়পেটা জেলাতেও। আমাদের এখানে অবস্থা সেই আগের মতোই। কয়েকটি মহল সরব এবং বিতর্কে লিপ্ত। ঘৃণা, বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা ঘুলিয়ে ওঠে তাদের মগজে। এবারও নীরব একটি মহল। তারপর এখন আমাদের ওপর এসে পড়েছে বর্বরতা। রামু, পটিয়া ও অন্যান্য স্থানে বৌদ্ধ বসতিতে হয়েছে লুট, অগ্নিসংযোগ। হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিদের সামনে। তিন দিন ধরে চলেছে এ ঘৃণ্য তৎপরতা। চলেছে প্রায় বিনা বাধায়। যে বাহিনী, প্রশাসন, সরকার বিরোধীদলকে সভা সমাবেশ মিছিল মানববন্ধন এমনকি রাস্তায় পর্যন্ত দাঁড়াতে দেয় না তারা এত নির্বিকার থাকলো কিভাবে সে প্রশ্ন এখন অনেকের। এ ব্যাপারে গোয়েন্দাদের বিশ্লেষণ - ‘বেসামরিক প্রশাসন সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে রামু’র সহিংসতা ঠেকানো যেতো। পুলিশ ও বেসামরিক প্রশাসন পর্যাপ্ত সময় পেলেও সময়মতো যথাযথ উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে।... শনিবার রাতে রামু সদরে বিক্ষুব্ধ মানুষের সমাগম বাড়তে থাকলে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নেয় নি। এমনকি হামলা শুরুর দু’ ঘণ্টা আগে গোয়েন্দারা প্রশাসনকে সতর্ক করলেও তা আমলে নেয়া হয় নি। রাত সাড়ে ১১টায় গোয়েন্দা সূত্রের খবরে কঙবজার ও টেকনাফ বিজিবি এবং রামু ক্যাম্পের সেনা সদস্যরা সম্ভাব্য সহিংসতা ঠেকাতে প্রস্তুত হয়ে থাকলেও সিভিল প্রশাসন তাদের কোনও সাহায্য চায় নি।... স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন অভিযুক্ত যুবককে আটক করে ঘটনার শুরুতেই বিক্ষোভের প্রশমন ঘটাতে পারতো।... এছাড়া বিক্ষোভ শুরুর তিন ঘণ্টার মধ্যেও যখন প্রশমন করা যাচ্ছিল না, তখন প্রশাসনের উচিত ছিল ১৪৪ ধারা জারি করা; কিন্তু প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের দীর্ঘসূত্রতায় ঘটে যায় নারকীয় ঘটনা।...” (দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ঠা অকটোবর)
ওদিকে আমাদের জাতিগত বিভাজন তো এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। তাই অন্যের ঘরে আগুন লাগলে আমরা কি-কি করি তা তো আগেই বলেছি। মনে পড়ছে জারমান যাজক মারটিন নিয়েমোয়েলার (১৮৯২-১৯৮৪)-এর কথাগুলো:
    “প্রথমে ওরা এসেছিল কমিউনিস্টদের খতম করতে
    আমি উচ্চবাচ্য করি নি, কারণ আমি কমিউনিস্ট নই।
    এরপর ওরা আসে সোস্যালিস্টদের খতম করতে
    আমি প্রতিবাদ করি নি, কারণ আমি সোস্যালিস্ট নই।
    এরপর ওরা আসে ট্রেড ইউনিয়নিস্টদের খতম করতে
    আমি দাঁতে কুটোটিও কাটি নি, কারণ আমি ট্রেড ইউনিয়নিস্ট নই।
    এবার এসেছে ওরা আমাকে খতম করতে
    এখন আমার চারপাশে কেউ নেই টুঁ শব্দটি করার।”
    মারকিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রচারিত এ রচনায় ‘কমিউনিস্টদের’ বদলে রয়েছে ‘ইহুদিদের’ কথাটি। এখানেও দেখতে পাই সেই বিভাজন। এমন বিভাজন আজ দেশে-দেশে। আমাদের বিভাজন তো মনে হয় সব দেশকে ছাড়িয়ে। তাই পদে-পদে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভেদচিন্তা আর বিভেদ-বিভাজন। অথচ সবাই জানি, একটি বিভাজিত জাতির উন্নতির আশা প্রায় দুরাশারই শামিল। জানি না এ বিভাজন থেকে কবে মুক্তি পাবো আমরা। কবে আমরা কেবল বাঙালি অসমিয়া মিয়ানমারিজ  রাখাইন রোহিঙ্গ্যা হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান চাকমা বোড়ো প্রভৃতি না হয়ে মানুষও হবো। এক হবো।

sazzadqadir@rediffmail.com

বুধবার, ৩ অক্টোবর, ২০১২

দুর্নীতি বিষয়ক যৎকিঞ্চিৎ

এক যে আছে হোমরা ও চোমরা। লেখাপড়া, চাকরি ও ব্যবসা - কোনওটাতে সুবিধা করতে না পেরে তারা পার্টি করে খায় এখন। নেতার নামে চালায় সমিতি-সংগঠন। খায় চাঁদা-তোলা তুলে। নাম কা ওয়াস্তে অনুষ্ঠান-কর্মসূচিও করে হুমকি দিয়ে অন্যদের ঘাড় মটকে। সেখানে খরচপাতি করে নামমাত্র, বাকি পুরোটাই গোঁজে ট্যাঁকে। ইলেকশন জনসভা সংবর্ধনা ইত্যাদি থাকলে ওই গোঁজার পরিমাণ বাড়ে অনেক। এ সব করে-করেই গাড়ি বাড়ি নারী সব হয় হোমরা ও চোমরা’র। সমাজ-সম্মানও হয়। আতি থেকে পাঁতি, তারপর নেতাই হয়ে ওঠে।
তাদের এ পর্যন্ত সব ওঠাই কিন্তু পাবলিকের টাকা মেরে। কাজেই ওই মারার অভ্যাস আর যায় না কিছুতে। বাকি জীবন কাটে পরেরটা খেয়ে ও মেরে। নেতা হয়ে সময়-সুযোগ পেয়ে ওই মেরে-মেরেই নমিনেশন কেনে তারা, ইলেকশন করে, জেতে, এমপি-মন্ত্রী হয়। এজন্য ট্যাঁক থেকে খসাতে হয় না কিছু, বরং এ সবই হয়ে ওঠে বড়-বড় দানে ট্যাঁকে গোঁজার উপায়। সরকারে পদ পাওয়ার পর আয়-উপার্জন আরও বাড়ে হোমরা ও চোমরা’র। সেখানে খরচ নেই, সব কিছু সরকারের। সরকারের মাল মানে তো দরিয়া মে ডাল! কিন্তু সরকার বা রাষ্ট্রের অর্থ তো জনগণের অর্থ। সরকারের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী জনগণের অর্থে শিক্ষালাভ করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন জনগণের অর্থে। ওই অর্থ নির্বিশেষে সকল দেশবাসীর, কোনও বিশেষ দলের নয়। এই অর্থে কোনও দলাদলি না করারই কথা, কিন্তু কাজের চেয়ে দলাদলিই  বেশি করেন তাঁদের অনেকে। এই তাঁদেরই কাজে লাগিয়ে, ব্যবহার করে আঙুল ফুলে কলাগাছ থেকে বটগাছ হয় হোমরা ও চোমরা। কোনও খরচ নেই, কেবলই আয় আর আয়। বিত্ত আর সম্পদ। ধন আর ঐশ্বর্য।
কাজ কি হোমরা ও চোমরা’র? আমলা খাটিয়ে খাওয়া। আলিশান বাড়িতে থাকা। লেটেস্ট মডেলের ঝাঁ চকচকে গাড়ি হাঁকানো। সপরিবারে দলে-বলে বিদেশে-বিদেশে ঘোরা। ফাইভ স্টার। শপিং। হাই-ফাই। ছেলেপুলে পড়ানো ইউরোপ-আমেরিকার নামী-দামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। দেশে বাড়ছে জনসংখ্যা, পণ্যমূল্য, গ্যাস পানি বিদ্যুৎ বিভ্রাট, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, কোন্দল-হানাহানি, মাদকাসক্তি, রোগ-ব্যাধি, দারিদ্র্য, শ্রমিক অসন্তোষ, শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা, দুর্নীতি, কুশাসন, জাল-ভেজাল, চোরাকারবার, অনিয়ম, অব্যবস্থা, অনুন্নয়ন। তাতে হোমরা-চোমরার কি? তারা বিবৃতি বক্তৃতা ভাষণ দিয়ে যাচ্ছে গলা ফাটিয়ে। সাজগোজ করে যাচ্ছে সভা, সেমিনার, টিভি-বেতারে। দেশ জাতি জনগণের জন্য জানপাত করে যাচ্ছে দিন-রাত।
আসলে কি তাই? জনগণের কাছ থেকে নেয়া ছাড়া জনগণকে কখনও কিছু দেয় কি হোমরা-চোমরা? নিজেরা কি কিছু করতে পারে তারা? নিজেদের প্রচারের জন্য সরকারের বা অন্যের পত্রিকা বা বেতার-টিভি তাদের ভরসা, নিজেদের কিছু নেই ও সব। থাকলেও পাতে নেয়া যায় না সেগুলো।
হোমরা-চোমরাকে বলি, পরোপকারের নামে আর কত নিজের উপকার করবে? সত্যি-সত্যি কিছু করো পরের জন্য। নাহয় একটা ছোটখাটো রাস্তাই করো। সেতু না পারো অন্তত একটা কালভার্ট করো। লোকজনের জন্য খাবার পানির ব্যবস্থা করো বিভিন্ন ভিড়ের স্থানে। শহরে-শহরে পাবলিক টয়লেট করে দিয়ে নারী শিশু বৃদ্ধদের কষ্ট দূর করো। নোংরা জঞ্জাল আবর্জনা সরাবার ও রিসাইক্লিং করার ব্যবস্থা করলে উপকার হয়, আয়ও হয়। মানে কিছু একটা করো। সামান্য হলেও করো। দেখিয়ে দাও নিজের অর্থে নিজেরা কিছু করতে পারো।
হোমরা-চোমরা বলে, ঠিক বলেছো ভাই। এটা আমাদের মনের কথা। এটা আমরাও চাই। কিন্তু কিভাবে হাত উপুড় করতে হয় তা আগে শিখিয়ে দাও আমাদের।
বলেই কেমন আমতা-আমতা করে হোমরা-চোমরা, মনে হয় শিখলেও হবে না। আমাদের হাতেই তো উপুড় করার সিসটেম নাই! অপারেশন ছাড়া হাত উপুড় হবে না!
॥ ২ ॥
সবাই জানেন, সম্পদ অর্জনের শ্রেষ্ঠ উপায় বাণিজ্য। সেকালের পণ্ডিতেরাও বলেছেন, ধন ও ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মী বাস করেন বাণিজ্যেই। তবে একালে বাণিজ্যের জন্য বণিক হওয়ার প্রয়োজন নেই। এখন যে ধরনের বাণিজ্যের রমরমা চলছে - ভর্তি বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, গ্রেপ্তার বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য, লাইসেন্স-পারমিট বাণিজ্য, শেয়ার বাণিজ্য ইত্যাদি - এ সবে যাঁরা জড়িত তাঁরা পরিচিত অন্য নামে। এখানে আসল ব্যাপার, সোজাই বলি, ঘুস দেয়া-নেয়া। ঘুস খাওয়া। এ খাওয়াটা খারাপ নয়। যদ্দূর জানি, ঘুসে কোনও ভেজাল নেই। একেবারেই খাঁটি ও বিশুদ্ধ বস্তু এই ঘুস। এতে কাঁকর, ইঁটের গুঁড়া, কারবাইড, ফরমালিন, প্রিজারভেটিভ, কেমিক্যাল, রঙ, ওয়াসা’র পানি ইত্যাদি কিছু নেই। এখানে গরুর নামে মোষের গোশত, খাসি’র নামে ছাগল-ভেড়ার গোশত, মুরগির ডিমের নামে কাছিমের ডিম খাওয়ানো চলে না। ওগুলো আছে আমাদের জন্য।
এই আমরা, যারা চলি বাঁধা আয়ে, মাসের শেষ সপ্তাহে যাদের চলতে হয় প্রায় পুরোপুরি কৃচ্ছ্রসাধন করে। এমনিতেও অভ্যস্ত আমরা ব্রেঞ্চ-এ।
ব্রেঞ্চ মানে ব্রেকফাস্ট না করে একটু আগে-আগে লাঞ্চ করা। তা সে ব্রেঞ্চেই বা কি খাই? কোনও জিনিস কি খেতে পারি নিশ্চিত মনে? কিন্তু খাই, বেঁচে থাকার আশায় বাধ্য হয়ে খাই। তারপর শুরু হয় বেঁচে থাকার যাবতীয় যন্ত্রণা। ভেজাল খেয়ে এ অসুখ ও অসুখ বাঁধিয়ে ভুগি। দামি ওষুধ কেনার ভয়ে প্রথম দিকে চলি সহ্য করে। তারপর মর-মর অবস্থা হলে ডাক্তার ও ওষুধের পিছনে যৎসামান্য যা কিছু সঞ্চয় সব ফুরিয়ে আর পথ্য জোটাতে পারি না। ফলে অসুখ আর ছাড়েও না। কিছু দিন দমে থাকে, তারপর সময় সুযোগে এমন চেপে ধরে যে দম উঠে যায় নাকে। তখন চিকিৎসা কি হবে? কিভাবে হবে? পরে দেখা যায়, এমন অসুখ বেঁধে গেছে যে লাখ-লাখ টাকা দরকার। কোত্থেকে আসবে এত টাকা? আমরা যারা ৯৯%, আমাদের সকলের অবস্থা তো একই রকম। আমাদের আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব সকলেরই তো একই দশা। তারপর সাহায্যের জন্য প্রার্থনা। সে এক মহাবিড়ম্বনা। আত্মসম্মান বিসর্জন দেয়ার চেয়েও দুঃসহ হয়ে পড়ে তা কখনও।  সাহায্য পাওয়ার চেয়েও কঠিন হয়ে পড়ে সাহায্য প্রার্থনার প্রকাশ-প্রচার। ফেসবুক-এর বেশির ভাগ বন্ধুই শেয়ার পর্যন্ত করতে চায় না মানবিক সাহায্যের আবেদন। তারপর কোনওক্রমে মিডিয়ায় কিছুটা প্রকাশ-প্রচার করা গেলেও  সাহায্য সহজে জোটে না, সকলের জোটে না। যদি জুটে যাওয়ার মতো অভাবনীয় কিছু ঘটে যায়, তাহলে মরতে-মরতে বাঁচা যায় হয়তো, আর যাদের জোটে না? হাসপাতালের সিঁড়িতে বা বারান্দায়, অথবা আর্থিক অক্ষমতার এক ভয়ঙ্কর বিপন্নতায় নিমজ্জিত স্বজনের চোখের সামনে ধুঁকে-ধুঁকে মরা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে কি তাদের?
    এখন বলুন, এমন পরিণতি কি চান কেউ? সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে সম্পূর্ণ বৈধ জীবন যাপনের এমন প্রতিফল? তাহলে আপৎকালের সম্বল যোগাড় করে রাখার উপায় কি বাণিজ্য ছাড়া? বলবেন, কোন বাণিজ্য? খাঁটি, বিশুদ্ধ ও নির্ভেজাল বাণিজ্য তো ওই একটাই। ঘুস বাণিজ্য। এর বিকল্প আছে কি? আশির দশকের প্রথম দিকে, তখন আমি দৈনিক সংবাদ-এর সহকারী সম্পাদক, এক সম্পাদকীয় বৈঠকে কথায়-কথায় ‘সংবাদ’-সম্পাদক আহমদুল কবির বলেছিলেন সমঝোতার মাধ্যমে এক সমাধানের কাহিনী। ওই সময় তিনি ছিলেন জাতীয় সংসদ সদস্য। তাঁর এলাকার থানার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ‘বেতনের টাকায় সংসার চলে না, কাজেই উপরি চাই... তা মাসে তোমাদের কত হলে আর উপরি লাগবে না, ডিউটি ঠিকমতো করবে, চুরি-ডাকাতি ঠেকাবে?’ হিসাব করে একটা অঙ্ক জানাবার পর এলাকাবাসী নিজেদের উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাসে-মাসে তা জমা দিয়েছে যথাস্থানে। এতে ফল দিয়েছে, এলাকাবাসী থেকেছে নিরুপদ্রব শান্তিতে।
    ভেবে দেখুন, এমন আরও কোনও বিকল্প আছে কিনা!
॥ ৩ ॥
‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে / তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে’ - রবীন্দ্রনাথের ‘নৈবেদ্য’ (১৯০১) কাব্যগ্রন্থের ৭০ সংখ্যক কবিতার এই দু’টি পঙ্‌ক্তি সম্ভবত সর্বাধিক উল্লিখিত বাংলা কবিতাংশগুলোর একটি। এ কথারই প্রতিধ্বনি মেলে আরেকটি উদ্ধৃতিতে - ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ন্যায়সংগত’। গত শতকের ষাটের দশকে একটি রাজনৈতিক সংগঠনের স্লোগান ছিল এ উদ্ধৃতিটি। তখন পোসটারে, ব্যানারে, দেয়াল লিখনে দেখা যেতো এ বিদ্রোহের আহবান। শুনেছিলাম উদ্ধৃতিটি চীনের কমিউনিস্ট নেতা মাও চ্যতোং (১৮৯৩-১৯৭৬)-এর। আরেকটি বিখ্যাত উদ্ধৃতি মারকিন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন (১৭৪৩-১৮২৬)-এর -

“If a law is unjust, a man is not only right to disobey it, he is obligated to do so.”
গত ৯ই এপ্রিল রাতে পিলখানায় ৭০ লাখ টাকা নিয়ে যে ঘনঘোর নাটকের অবতারণা হয় তাতে এ সব উদ্ধৃতি মনে পড়ছিল বারবার। উদ্ভূত নাটকীয় ঘটনাই প্রমাণ করে ওই টাকার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক অন্যায়। সে প্রমাণ পেয়েই অনুসন্ধানে নামে মিডিয়া। আর খুব দ্রুত বেরিয়ে পড়ে থলের কালো বিড়াল। দেখা যায়  ‘রেলগাড়ি ঝমাঝম... পা পিছলে আলুর দম’ গোছের এক কাহিনী। রেলের ট্রেড অ্যাপ্রেনটিস পদে ১৬ কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্যের এক অংশ ওই ৭০ লাখ টাকা। সে অন্যায়ে বহু পক্ষ জড়িত। নিয়োগদাতা, নিয়োগপ্রার্থী, তদবিরকারী, নিয়োগপ্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও আছেন তাঁরা - যাঁদের না দিয়েথুয়ে বড় দাঁও মেরে  ভূরিভোজ করা যায় না।
     রেল নতুন মন্ত্রণালয়। তাই বলে দুর্নীতির ব্যাপারস্যাপার নতুন নয় এখানে। এ মন্ত্রণালয় আগে ছিল যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অংশ। তখন দুর্নীতি সংক্রান্ত ঘাপলা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পর্যন্ত জানাজানি হওয়ায় পদ্মা সেতুর নির্মাণ হয়ে যায় অনিশ্চিত। এর আগে সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপার নিয়ে ঘটে নানা তুলকালাম। এক দুর্ঘটনায় দু’জন খ্যাতিমান ব্যক্তির প্রাণহানির সূত্রে মিডিয়ায় আসে তাদের সে সব কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি। তবে এসব কি কেবল রেলে বা যোগাযোগে চলছে? অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে এদিক-সেদিক কিছু নেই?
    উপন্যাসের পাঠকরা বা টিভি-নাটকের দর্শকরা জানেন, এখন সবচেয়ে ভাল ফরমুলা হচ্ছে - অস্বাভাবিক লোকজনদের নিয়ে উপন্যাস-নাটক লেখা। নায়ক-নায়িকা, মা-বাবা থেকে কাজের লোক বা বুয়া সবাই কথাবার্তা বলবে অদ্ভুত-অদ্ভুত, কাজকর্ম করবে আরও অদ্ভুত-অদ্ভুত অর্থাৎ উপন্যাস বা নাটকের সকল চরিত্রকে চলনে বলনে হতে হবে পাগলা বা পাগলাটে। তাহলেই উপন্যাস হট কেক, টিভি নাটক সুপার হিট। এ রকম হট বা হিট করার ফরমুলা আগেও ছিল। শরৎচন্দ্রের উপন্যাস যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন  ‘পল্লীসমাজ’ (১৯১৬)-এ সবাই খারাপ, কেবল ‘রমা’ ও ‘রমেশ’ ভাল। কথাটির অর্থ, উপন্যাসে শরৎচন্দ্র  সমাজের শতেক দোষ-ত্রুটি দেখালেও নায়ক ও নায়িকাকে রাখতেন প্রায় দেবোপম নিষ্কলঙ্ক। বাস্তবে এমন তো হতে পারে না। কোনও সমাজে মাত্র দু’জন ভাল লোক থাকতে পারে না, যদি ৯৮ জন মানুষ খারাপ হয়। সে রকম কেবল রেল-যোগাযোগ খারাপ আর বাকি সকল মন্ত্রণালয় ভাল - এমন হতে পারে কি? কিন্তু সবার উপরে রাজনীতি। তাই বলছি, সকল শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে পিলখানায় পাওয়া ৭০ লাখ হতে পারে সাদা বিড়াল। সে ম্যাঁও শোনা গেছে এরই মধ্যে। আমার প্রিয় কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই কবে লিখেছেন - “রূপসী তুই রাজনীতি, দিস্‌ ছেলে-ছোকরাদের মাথা ঘুরিয়ে; কিন্তু বুড়ো শয়তানদের সঙ্গে থাকিস্‌ রাত্রে শুয়ে।” তাহলে এই নোংরা রাজনীতি ঠেকাবার উপায় কি? একটাই উপায়। ৯৯ ভাগের বাঁচার রাজনীতি।
॥ ৪ ॥
ম্যাটরিকুলেশন, সংক্ষেপে ‘ম্যাটরিক’, পরীক্ষা চালু করেছিল বৃটিশ রাজ, এর সমাপ্তি ঘটে ১৯৬২ সালে। আমার মনে আছে, কারণ এ পরীক্ষা আমি দিয়েছিলাম ওই বছর। এর পর, ১৯৬৩ সাল থেকে, চালু হয় সেকেন্ডারি স্কুল সারটিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষা। কেটে গেছে প্রায় ৫০ বছর, কিন্তু এখনও সবার মুখে-মুখে চালু আছে ম্যাটরিক পরীক্ষা, এসএসসি কথাটা আর মুখে আসে না কারও। এ রকম অনেক কিছুই বদলে গেছে, কিন্তু আগেরটাই আঁকড়ে ধরে আছি আমরা। নতুনের প্রতি নেতি আর পুরনোর প্রতি প্রীতি কি আমাদের জাতীয় রক্ষণশীলতারই এক বৈশিষ্ট্য? মারকিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩২তম প্রেসিডেন্ট (১৯৩৩-১৯৪৫) ফ্রাঙ্কলিন ডিলানো রুজভেল্ট (১৮৮২-১৯৪৫) বলেছেন, রক্ষণশীলদের পা দু’টো থাকে চমৎকার ? তবে তারা সামনের দিকে চলা শেখে না কখনও। সম্ভবত এ জন্যই ভাষা-ভাষা বলে প্রাণ দিলেও বানান শিখি না, শেখার চেষ্টাও করি না। প্রমিত বানান তো নয়ই। ও সব জানতেও চাই না। ‘ঘুষ’ বানানটি যে ‘ঘুস’ হওয়া উচিত তা বলা হয়েছে অনেক আগে। হিন্দি ‘ঘুস’ থেকে আসা এ অ-তৎসম বিদেশী শব্দের বানান বাংলায় ‘ঘুস’ হওয়ারই কথা। বাংলা একাডেমীর ‘বাংলা বানান-অভিধান’ (পুনর্মুদ্রণ, ১৯৯৫) এ বানানটিই নির্দেশ করেছে, কোনও বিকল্প দেয় নি। তবে ঘুষের সঙ্গে ঘুষাঘুষির একটা ব্যাপার আছে বলেই হয়তো হিন্দি ‘ঘুস’ বাংলায় হয়ে গেছে ‘ঘুষ’। তবে ওই অভিধানে ‘ঘুষি’ ও ‘ঘুষাঘুষি’ও  বিকল্পহীন ‘ঘুসি’ ও ‘ঘুসাঘুসি’। তবে বানান যা-ই হোক ঘুসের অনেক কদর সমাজে। ভাষাতেও। তাই কত নামে ঘুসকে ডাকি আমরা ? উৎকোচ, উপরি, বখশিশ, সেলামি, টু-পাইস, হাতটান, লেনদেন, বাঁ হাতের কামাই, খুশি করা, প্রণোদনা, নজরানা, রিসওয়াত, গোপন পারিতোষিক, গেটিস...! ইংরেজদের কাছেও এর কদর অনেক। ওদের ভাষাতেও অনেক নাম ?
Ò tip, gift, sop, perk, skim, favor, discount, waived fee/ticket, free food, free ad, free trip, free tickets, sweetheart deal, kickback/payback, funding, inflated sale of an object or property, lucrative contract, donation, campaign contribution, fundraiser, sponsorship/backing, higher paying job, stock options, secret commission, or promotion (rise of position/rank)...! Ó আরও অনেক রকম ঘুস আছে। মারকিন নাট্যকার থর্নটন ওয়াইল্ডার (১৮৯৭-১৯৭৫) বলেছেন, বিয়েটাও ঘুষ। এ ঘুষ পেলে বাঁদী নিজেকে বেগম ভাবে।
    তবে ঘুস নিয়ে সামপ্রতিক এক ঘুসাঘুসি জাতীয় ঘটনার খবর জেনেই এত সব কথা বললাম। রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুক তালুকদারের গাড়ি থেকে ৭০ লাখ টাকা উদ্ধার হয়েছে গাড়িচালক আলী আজমের আকস্মিক তৎপরতায়। গাড়িতে আরও ছিলেন পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা ও রেলওয়ে পুলিশের কমান্ডেন্ট এনামুল হক। ১৬ কোটি টাকার ঘুস-বাণিজ্যের একটা ভাগ ওই টাকা। ধরা পড়ার পর ঘুসের টাকা ভাগ-বাটোয়ারার নানা কাহিনী ফাঁস হয়ে পড়ছে মিডিয়ায়।  এ দেশে এ সব ওপেন সিকরেট। তারপরও এমন ঘটনা যে কেন ঘটে! আসলে ঘুস জিনিসটা দিয়ে-থুয়ে খাওয়াই ভাল। তা করলে গাড়িচালক আজমকে হজম করা কঠিন হতো না কিছু। রাজনীতি অত্যন্ত ব্যয়বহুল এখন। নেতা হতে, মন্ত্রী-এমপি হতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় মানে কাঠখরচ করতে হয়। দলের সদস্য হওয়া, তারপর পদ পাওয়া, নির্বাচনে মনোনয়ন জোটানো, জিতে এমপি হওয়া, মন্ত্রীত্ব বাগানো ? এগুলো সহজ কম্ম নয়। কোটি-কোটি-কোটি কাঠখরচ। সে খরচ আসে কোত্থেকে? আসবে কোত্থেকে? রাজনীতিতে হোমরা-চোমরাদের টাকা তো এভাবেই আসে। আর কোনও ভাবে আসে নাকি?
॥ ৫ ॥
দেশের অর্থ-সম্পদ বিদেশে পাচারের কথা প্রায়ই শুনি। মানি লন্ডারিং-এর অভিযোগ অনেকের বিরুদ্ধে। রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, আমলা, চোরাকারবারিদের অনেকে বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ছে - এমন কথা এখন নিয়মিত আইটেম হয়ে পড়েছে বক্তৃতা-বিবৃতির। উচ্চারিত হচ্ছে কত জনের নাম। ১০ বছর আগে প্রণীত হয়েছে প্রিভেনশন অভ মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট, ২০০২ (অ্যাক্ট নং ৭ অভ ২০১২)। এ অ্যাক্টের অধীনে বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক এ পর্যন্ত জারি করেছে ২৬টি সারকুলার। এর মাধ্যমে ব্যাঙ্কিং সেক্টরে নিশ্চয়ই চলছে কড়াকড়ি প্রতিরোধমূলক তৎপরতা, কিন্তু হুন্ডি বন্ধ হয় নি বলেই শোনা যায়। সেই ১৯৯৬ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আই এম এফ) অনুমান করেছিল, বিশ্ব অর্থনীতির ২ থেকে ৫ ভাগ অর্থ লন্ডার করা। তবে আন্তঃসরকার সংগঠন ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স অন মানি লন্ডারিং  (এফ এ টি এফ) বলেছে, এই অর্থের হিসাব করা সম্ভব নয়। এজন্য এ সংক্রান্ত কোন অনুমান বা ধারণা তাঁরা প্রকাশ করেন নি আর।
    অর্থ-সম্পদের অবৈধ পাচার বা চালান ঠেকানোর পাশাপাশি চলছে সে সব উদ্ধারের নানা তৎপরতা। বিদেশে যাঁরা আলিশান বাড়ি বানিয়ে বা কিনে, রমরমা ব্যবসা বাগিয়ে লেটেস্ট মডেলের আউডি বা মাসেরাতি হাঁকিয়ে বেড়ান তাঁদের সুলুক-সন্ধান নিয়ে পাচার করা সম্পদ উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে আনার ঘটনা ঘটছে বিভিন্ন দেশে। কারণ দুর্নীতিবিরোধী সংগ্রামে আন্তর্জাতিক পূর্বিতা যে লুণ্ঠিত সম্পদ উদ্ধার তা সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ করা হয়েছে দুর্নীতিবিরোধী জাতিসংঘ সম্মেলন (২০০৩)-এর পঞ্চম অধ্যায়ে। ওই সম্মেলনেই গঠিত হয় ইউনাইটেড নেশনস্‌ কনভেনশন এগেনস্ট করাপশন (ইউ এন সি এ সি)। এটি কার্যকর হয় ২০০৫ সালের ১৪ই ডিসেম্বর থেকে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সহ ১৪০টি দেশ স্বাক্ষর করেছে এতে। সম্পদ উদ্ধারে নিয়োজিত আছে অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনের মধ্যে রয়েছে - ইউনাইটেড নেশনস্‌ অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম (ইউ এন ও ডি সি), স্টোলেন অ্যাসেট রিকভারি ইনিশিয়েটিভ (বিশ্ব ব্যাঙ্ক) (এসটি এ আর), ইনটারন্যাশনাল সেনটার ফর অ্যাসেট রিকভারি (আই সি এ আর), দি ইনটারন্যাশনাল এসোসিয়েশন ফর অ্যাসেট রিকভারি (আই এ এ আর), অরগানাইজেশন ফর ইকনমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ও ই সি ডি), ট্রান্সপারেন্সি ইনটারন্যাশনাল (টি আই), ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফ এ টি এফ), ইউ৪ অ্যানটি-করাপশন রিসোর্স সেনটার (ইই৪) প্রভৃতি। এছাড়া আঞ্চলিক পর্যায়ে আইন, বিচার ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগের রয়েছে চোরাই সম্পদ উদ্ধারের উদ্যোগ।
    উল্লিখিত সংস্থা-সংগঠনের উদ্যোগের ফলেই নাইজেরিয়ার সামরিক একনায়ক জেনারেল সানি আবাচা (১৯৯৩-৯৮)-র লুণ্ঠিত ৬০ কোটি ডলার বাজেয়াপ্ত করে সুইজারল্যান্ড। পরে সে অর্থ উন্নয়ন-কাজে ব্যয় হয় বিশ্ব ব্যাঙ্কের তদারকে। এছাড়া সুইজারল্যান্ড বাজেয়াপ্ত করেছে জায়ারে’র সাবেক প্রেসিডেন্ট  মোবুতো সেসে সেকো (১৯৬৫-১৯৯৭) ও কেনিয়া’র সাবেক প্রেসিডেন্ট দানিয়েল আরাপ মোই-এর বিপুল অর্থ। ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফারদিনান্দ মারকোস (১৯৬৫-৮৬)-এর বহু সম্পদ ফিরে পেয়েছে দেশ। পেরু’র সাবেক প্রেসিডেন্ট আলবেরতো ফুজিমোরি (১৯৯০-২০০০)-র ডান হাত ভ্লাদিমিরো লেনিন মনতেসিনোস তোরেস-এর পাচারকৃত অর্থ থেকে ১৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার উদ্ধার করেছে আইসিআর। হেইতি’র সাবেক প্রেসিডেন্ট জাঁ-ক্লদ ‘বেবি ডক’ দুভালিয়ার (১৯৭১-১৯৮৬), ইউক্রেন-এর সাবেক প্রধানমন্ত্রী পাভলো লাজারেঙ্কো (১৯৯৬-৯৭), নাইজেরিয়া’র প্ল্যাটো স্টেট-এর সাবেক গভর্নর জোশুয়া দারিয়ে (১৯৯৯-২০০৭) ও বায়েলসা স্টেট-এর সাবেক গভর্নর দিয়েপ্রিয়ে আলামিয়েসেইগা (১৯৯৯-২০০৫), ইন্দোনেশিয়ার ব্যাঙ্কার হেনদ্রা রাহারদজা, চীনের মাকাউ-এর পরিবহন ও পূর্ত বিভাগের প্রথম সচিব আও মান লোং (১৯৯৯-২০০৬) প্রমুখ কর্তৃক অপহৃত সম্পদ উদ্ধার করা হয়েছে অনেকখানি। বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডও হয়েছে ক’জনের।
অপহরণ ও উদ্ধার সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য এখানে তুলে ধরার উদ্দেশ্য একটাই - যাঁরা আমাদের দেশের অর্থ-সম্পদ বিদেশে পাচার করেছেন, করছেন এবং করবেন বলে ভাবছেন - সেই লুটেরাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। দুর্নীতি করে যে পার পাওয়া যায় না সবসময় সে প্রমাণ আছে অনেক। পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতি থেকে সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক কেলেঙ্কারি আজ আর অজানা নয় কারও। ট্রান্সপারেন্সি ইনটারন্যাশনালের র‌্যাংকিং-এ তো দশক ধরেই আছি শীর্ষে আমরা। কাজেই সরকারে-প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রকৃত স্বাধীন, জনগণের তথ্য পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত  দুর্নীতির কালো বিড়াল দিনে-দিনে বাঘ-সিংহের আকারই ধারণ করবে। অসট্রিয়া’র চিন্তাবিদ কার্ল ক্রাউস (১৮৭৪-১৯৩৬) লিখেছেন,
“Corruption is worse than prostitution. The latter might endanger the morals of an individual, the former invariably endangers the morals of the entire country.” এ অবস্থায় জেঁকে বসা স্বৈরতন্ত্র ও চৌর্যতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া আর কি বিকল্প আছে দেশবাসীর সামনে?



sazzadqadir@gmail.com