মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১১

একজন উত্তম পুরুষ

সিকান্দার আবু জাফর (১৯১৯-১৯৭৫) আমার প্রিয় কবি, নাট্যকার, অনুবাদক, প্রকাশক এবং সাহিত্য মাসিক ‘সমকাল’ (১৯৫৭-১৯৭০)-এর প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। এখনও কথায়-কথায় উল্লেখ করি তাঁর কবিতা ‘মায়ের বাড়ির পথ’, নাটক ‘সিরাজউদ্দৌলা’, অনুবাদ ‘যাদুর কলস’ (বারনার্ড ম্যালামুড-এর ‘দ্য ম্যাজিক ব্যারেল’), সমকাল প্রকাশনীর মানসম্পন্ন প্রকাশনা এবং আধুনিক সাহিত্যচর্চায় ‘সমকাল’-এর অবদানের কথা। ‘সমকাল’-এর কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, ধারাবাহিক উপন্যাস, গ্রন্থ সমালোচনা, পাঠকের প্রতিক্রিয়া - সবখানে ছিল সমান আকর্ষণ। অনেক আকর্ষণীয় সাহিত্যিক ঘটনারও জন্ম হয়েছে এ পত্রিকাকে ঘিরে। সৈয়দ শামসুল হক ধারাবাহিক উপন্যাসের কিস্তি সময়মতো না দেয়ায় সিকানদার আবু জাফর পৃষ্ঠায় লেখার অংশ রেখেছিলেন সাদা। নিচে লেখকের দায়িত্বহীনতা সম্পর্কে দিয়েছিলেন কড়া সম্পাদকীয় নোট। সদ্যপ্রয়াত কথাসাহিত্যিক রশীদ করিমের ধারাবাহিক উপন্যাস “উত্তম পুরুষ”-এর প্রকাশনাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল একদিন।  উপন্যাসটির মুগ্ধ পাঠক ছিলাম, পুরো মাস তাই অধীর হয়ে অপেক্ষা করতাম ‘সমকাল’-এর জন্য। তাই এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দুঃখ পেয়েছিলাম খুব। সে দুঃখ থাকে নি বেশি দিন। কিছু দিন পরে, ১৯৬১ সালে,  ‘উত্তম পুরুষ’ প্রকাশ করে আনিস ব্রাদার্স। প্রকাশের পর-পরই সাহিত্যিক-সমালোচক মহলের প্রভূত প্রশংসা পায় উপন্যাসটি। সে সব প্রশংসার মধ্যে ‘মাহে নও’ পত্রিকায় আবুল ফজল, ‘পরিক্রম’-এ আহসান হাবীব, ‘পাকিস্তান টাইমস’-এ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়ন প্রমুখের মূল্যায়ন-বিশ্লেষণ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। আহসান হাবীব মুসলমান রচিত কয়েকটি উপন্যাসের নাম উল্লেখ করেও ‘উত্তম পুরুষ’কে বলেছেন বিশিষ্ট। উপন্যাসটি পরে প্রকাশ করেছে ‘মুক্তধারা’ (১৯৮৫) ও ‘বিউটি বুক হাউস’ (২০০১)। এখন স্থান পেয়েছে রশীদ করিমের ‘উপন্যাস সমগ্র’-এ (সাহিত্যপ্রকাশ, ২০০২)। তবে কেন উপন্যাসটির প্রকাশ বন্ধ করেছিলেন সিকান্দার আবু জাফর?
    ‘উত্তম পুরুষ’ শীর্ষক এক নিবন্ধে রশীদ করিম জানিয়েছেন-“... সিকান্দার আবু জাফরকে আমি কলকাতায় থাকাকালীন অবস্থা থেকেই জানতাম। তিনি আমার গল্পের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। ঢাকায় এসেও বিভিন্ন জায়গায় তাঁর এবং অন্যদের সঙ্গে সাহিত্য আলাপ হতো। তিনি যখন শুনলেন, আমি একটি উপন্যাস শেষ করেছি, তখন বললেন, দেরি করছো কেন, আমাদের দিয়ে দাও, সমকাল-এ ছাপতে আরম্ভ করি। তিনি উপন্যাসটি পড়েও দেখলেন না। আমি প্রত্যেক সংখ্যা সমকাল-এর জন্য এক এক কিস্তি লেখা পাঠাতে লাগলাম। এভাবে কয়েকটা ইনস্টলমেন্ট ছাপা হওয়ার পর ‘উত্তম পুরুষ’ প্রকাশ বন্ধ হয়ে গেল। সমকাল-সম্পাদক বললেন, লেখাটা বড্ড কমুনাল।” (‘প্রবন্ধ-সমগ্র’, সাহিত্য প্রকাশ, ২০০৩)


    ‘উত্তম পুরুষ’ সাম্প্রদায়িক? পড়তে-পড়তে ঘুনাক্ষরেও তা মনে হয় নি আমার। এর কিছু দিন আগেই পড়েছিলাম রশীদ করীমের অগ্রজ আবু রুশদ (১৯১৯-২০১০)-এর একই পটভূমিকায় লেখা ‘এলোমেলো’ (১৯৪৬) উপন্যাসটি। পটভূমি কলকাতায় বসবাসকারী সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজ। যখন পড়ি তখন বয়সে আমার চেয়ে কিছুটা বড় ছিল ‘উত্তম পুরুষ’-এর শাকের আর ‘এলোমেলো’র সাজ্জাদ (আমার লেখক-নাম ধারণের নেপথ্যে ভূমিকা আছে এই নামটির)। ওদের কৈশোরিক মনের ভাষা, অনুভূতি বুঝতে তাই একটুও অসুবিধা হয় নি আমার। ওরা মুগ্ধ করেছে আমাকে, মুগ্ধ করেছে বিশেষভাবে ওদের প্রেমানুভূত্রি, জীবনচেতনা এবং সংস্কারমুক্ত ও অসাম্প্রদায়িক অবস্থান। ওদের দ্বারা জীবনে আমি প্রভাবিতও হয়েছি অনেকখানি। অবশ্য এ প্রসঙ্গে মণীশ ঘটক (১৯০২-১৯৭৯)-এর ‘কনখল’ (১৯৬৩) উপন্যাসের কনখল এবং বিমল কর (১৯২১-২০০৩)-এর ‘খড়কুটো’ (১৯৬৩) উপন্যাসের অমল-এর কথাও বলতে হবে আমাকে।
    ‘কমুনাল’ অভিযোগ শুনে ব্যথিত হয়েছিলেন রশীদ করিম। তিনি লিখেছেন, “উত্তম পুরুষ সাম্প্রদায়িক? উপন্যাসটি ৪০ দশকের কলকাতাকে কেন্দ্র করে লেখা। সেই সময় কলকাতার পরিবেশ কেমন ছিল, আমি ঠিক সেভাবেই পরিবেশের কাছে বিশ্বস্ত থেকেই উপন্যাসটি রচনা করেছি। আমি কোনও বাস্তবকে আদর্শায়িত করি নি অথবা কোনও আদর্শকে বাস্তবায়িত করি নি। কলকাতার পরিবেশ যেমন ছিল, ঠিক যথাযথ তা-ই চিত্রিত করেছি। তবে পৃথিবী বদলে যায়। লোকজন বদলে যায়।” (প্রাগুক্ত)
    তবে এ ব্যথা তিনি হয়তো ভুলেছিলেন উপন্যাসটির বিপুল পাঠকপ্রিয়তা ও সাফল্যে। বিশিষ্ট সমালোচক-প্রাবন্ধিক সরদার আবদুস সাত্তার লিখেছেন -“১৯৬১ সালে যখন তাঁর (রশীদ করিমের) বয়স ছত্রিশ বছর, তখন বেরিয়েছিল তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘উত্তম পুরুষ’। প্রকাশের সঙ্গে-সঙ্গে উপন্যাসটি একাদিক্রমে তিনটি সৌভাগ্য করায়ত্ত করতে পেরেছিল। প্রথমত, প্রকাশের বছরই উপন্যাসটি সেই সময়ের লোভনীয় সাহিত্য পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত ‘আদমজী পুরস্কার’ পাওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল। দ্বিতীয়ত, ব্যাপকভাবে সমালোচকদের কাছে প্রশংসিত হয়েছিল। এবং তৃতীয়ত, অভূতপূর্ব পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। মাত্র পনের মাসের মধ্যে প্রথম প্রকাশের ২২৫০ কপি বই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। তাই ১৯৬২ সালের সেপটেম্বর মাসেই বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ বাজারে এসেছিল এবং এবারের মুদ্রণসংখ্যা ছিল প্রথম বারের চেয়ে আরও এক হাজার বেশি অর্থাৎ ৩২৫০ কপি।...” (‘কথাসাহিত্যের আঙিনায় দাঁড়িয়ে’, সুচয়নী পাবলিশার্স, ২০০৯)
    ‘উত্তম পুরুষ’-এর পাঠকপ্রিয়তার কারণ খুঁজেছেন সরদার আবদুস সাত্তার। তিনি লিখেছেন, “এ উপন্যাসের প্রধান আকর্ষণ এর আখ্যান। এবং যে ঘটনাসমূহের সন্নিপাতে এই আখ্যান তার সামগ্রিকতা ও পরিপূর্ণতা অর্জন করেছে তার সবটুকুই চিত্তাকর্ষক এবং গতিময়। লেখক যে একজন নিপুণ কথক, উপন্যাসের কয়েকটি পৃষ্ঠা উলটে গেলেই তা অনুধাবন করা যায় এবং উপন্যাসের শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত সেই অনুভব সতেজ ও অক্ষত থাকে। কাহিনী ও চরিত্রের মধ্যেই যে উপন্যাসের প্রাণশক্তি নিহিত থাকে, ‘উত্তম পুরুষ’ রচনার সময় রশীদ করিম সম্ভবত একবারও তা বিস্মৃত হন নি। আর তাই একটিমাত্র চরিত্রের জীবন অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির সূত্র ধরে যে গতিময় কাহিনীবৃত্ত তিনি এখানে নির্মাণ করেছেন তা পাঠককে যেমন কৌতূহলী, তেমনি আবিষ্ট করে রাখে। তাই শেস পৃষ্ঠায় না পৌঁছা পর্যন্ত পাঠক সাগ্রহে তাঁর উপন্যাসের সবগুলো পাতা উলটে যায়  আনন্দময় পাঠের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে-করতে। ঔপন্যাসিক রশীদ করিম তাঁর পাঠককে কাহিনীর নিবিড় বুনন এবং পাত্র-পাত্রীর আত্মগত উপলব্ধির মনোগ্রাহী বিশ্লেষণের ভিতর দিয়ে অনায়াসেই তন্ময় করে ফেলেন। ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর শক্তিমত্তার এটি এক বড় পরিচয়।” (প্রাগুক্ত)
    তবে সকলেই উচ্ছ্বসিত নন এত। রশীদ করিমের ‘গল্প বলার ক্ষমতা এবং চরিত্রাঙ্কনের নিপুণতা প্রশংসনীয়’ উল্লেখ করেও গবেষক-সমালোচক মনসুর মুসা লিখেছেন, “উত্তম পুরুষ-এ কোনও সুসংবদ্ধ কাহিনী নেই। উত্তম পুরুষ শাকেরের জীবনের একটি খণ্ডিত অংশে যে চরিত্রের সমাগম হয়েছে তাদের কাহিনী উপন্যাসের সমগ্র অবয়বে ছড়িয়ে আছে। আবার এ সব খণ্ডিত কাহিনীতেও কোনও নিজস্ব গুরুত্ব নেই এবং কোনও গুরুত্বপূর্ণ পরিণতির পূর্বধারায় এসব কাহিনী নির্বাচনও নেই। অনাবশ্যক কথাবিস্তারের ধারায় এসেছে অনিমা, মুশতাক, সানী সাহেব, সেলিনা প্রভৃতি চরিত্র।” (‘পূর্ব বাঙলার উপন্যাস’, অ্যাডর্ন পবলিকেশন, ২০০৮)
    রশীদ করিম নিজে বলেছেন, ‘... এখন মনে হয় উত্তম পুরুষ  আরও কিছুটা সুবিন্যস্ত হতে পারতো।” (‘প্রবন্ধ-সমগ্র’)
    উত্তম পুরুষকে প্রথম থেকেই আত্মজৈবনিক মনে হয়েছে আমার। লেখক নিজেও বলেছেন, “উত্তম পুরুষ  বহুলাংশে আত্মজৈবনিক। এই বইয়ে আমার আব্বা, আম্মা ও অব্যবহিত অগ্রজ ভাইয়ের প্রতিকৃতি আছে। তবে মেজো ভাই বলে যাকে চিত্রিত করা হয়েছে তিনি আসলে আমার চতুর্থ ভাই।... আমার স্কুল জীবনের কথাও বেশ কিছুটা বলা হয়েছে। পণ্ডিত মশাই প্রভৃতির কথা অনেক অংশে সত্য। কিন্তু আমাদের ফার্স্ট বয় এবং তার পরিবারবর্গ সম্পর্কে সমুদয় বিবরণ সর্বৈব মিথ্যা ও মনগড়া।...”
    উত্তম পুরুষ  পড়েছি ৫০-৫১ বছর আগে। তখনকার সেই ভাল লাগা এখনও জেগে আছে আমার মনের ভিতর। ২৬শে নভেম্বর উত্তম পুরুষ-এর স্রষ্টা রশীদ করিমের বিদায়ের সংবাদ পেয়ে মনে পড়ে যায় কবেকার সেই ১৩-১৪ বছরের স্কুল বালককে। বুঝি, সেই জেগে থাকা এখনও কত সজ্ঞান সজীব। উত্তম পুরুষ-এর দশম পরিচ্ছেদের চরম উত্তেজনাপূর্ণ ক্যারাম খেলার ছবি যেন চোখের সামনে ভাসে। মিক্সড ডাবলস-এর স্নায়ু থরথর প্রতিযোগিতা। একদিকে মুশতাক ও অনিমা, অন্য দিকে সেলিনা ও শাকের। হয় জয় নয় হার। রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি। স্ট্রাইক শাকেরের। সে-ই উপন্যাসের উত্তম পুরুষ - উভয় অর্থে। তার জবানিতে লিখছেন রশীদ করিম -    “দাঁত দিয়ে রুমালটি ভাল করে চেপে ধরলাম। স্ট্রাইকারটাকে একেবারে বাম দিকে সরিয়ে আনলাম। তারপর আল্লাহ্ নাম নিয়ে লাগালাম এক রিবাউন্ড মার। স্ট্রাইকারটি আমাদের সাদা গুটিটির ঠিক মাথার ওপর বাজপাখির মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো। কালো গুটি দু’টি তারই ধাক্কায় সসম্মানে দু’দিকে সরে গেল, আমাদের সাদা গুটিটি রাজার মতো সমারোহ আর মর্যাদায় গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেল।...”

সোমবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১১

‘প্রতিবেশীর কাছে মই...’

চট্টগ্রামের কবি-পণ্ডিত আলাওল (১৬০৭-১৬৮০) তাঁর ‘পদ্মাবতী’ কাব্যে লিখেছেন - “পড়শি হইলে শত্রু গৃহে সুখ নাই। নৃপতি হইলে ক্রোধ দেশে নাই ঠাঁই ॥” এ কারণে অনেকে সন্দেহ করেন, দেশে যে সুখ-শান্তি নেই এর নেপথ্যে আমাদের প্রতিবেশীদের কোনও ভূমিকা আছে কিনা। তাঁরা আমাদের কতখানি কি মিত্র বা বৈরী সে হিসাবও করা হয় এ সূত্রে। আর সে হিসাবে ভালয় মন্দয় মিশিয়ে এক রকম একটা ধারণা তৈরি হয়ে আছে ইতিহাস থেকে অর্জিত নানা ঘটনা-পরম্পরায়। আসলে প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্কে বাস করার কথা বলাই হয়, মহাজন-বাক্যে বা কূটনৈতিক বর্ক্তৃতা-বিবৃতিতে, আদতে প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রায় কারওই থাকে না। পৃথিবীর সব দেশেরই সব প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ত। ‘পালামৌ’ (১৮৮০-১৮৮২) ভ্রমণবৃত্তান্তে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৪-১৮৮৯) লিখেছেন, “বঙ্গবাসীমাত্রই সজ্জন; বঙ্গে কেবল প্রতিবাসীরাই দুরাত্মা। যাহা নিন্দা শুনা যায় তাহা কেবল প্রতিবাসীর। প্রতিবাসীরা পরশ্রীকাতর, দাম্ভিক, কলহপ্রিয়, লোভী, কৃপণ, বঞ্চক। তাহারা আপনাদের সন্তানকে ভাল কাপড়, ভাল জুতা পরায়, কেবল আমাদের সন্তানকে কাঁদাইবার জন্য।... যাহাদের প্রতিবাসী নাই, তাহাদের ক্রোধ নাই। তাহাদেরই নাম ঋষি। ঋষি কেবল প্রতিবাসী-পরিত্যাগী গৃহী। ঋষিদের আশ্রম পার্শ্বে প্রতিবাসী বসাও, তিন দিনের মধ্যে ঋষির ঋষিত্ব যাইবে।” একালের সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়-ও লিখেছেন, “প্রতিবেশীর কাছে মই চেয়ে দেখেছি, বলেছেন সিন্দুকে আছে। জাল চেয়ে দেখেছি, বলেছেন জালে সরষে বাঁধা আছে। বিপন্ন আত্মীয়কে মধ্যরাতে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি চেয়ে দেখেছি, বলেছেন ড্রাইভারের কাছে চাবি, ওঃ অফুলি সরি, গামছা দিয়ে বেঁধে রাখুন, পরানটাকে বেঁধে রাখা যায় জীবনটাকেও এক রাত বেঁধে রাখা যাবে।” (‘কলিকাতা আছে কলিকাতাতেই’)
    এই তো মোটামুটি প্রতিবেশীচিত্র। এ অবস্থায় সৎপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক বজায় রাখার অঙ্গীকার করে আমরা কি করছি এবং আমাদের প্রতিবেশীরা কি করছেন?
    আমাদের দুই প্রতিবেশী -৩২০ কিলোমিটার সীমান্ত নিয়ে সেনাশাসিত বিশ্ববর্জিত মিয়ানমার, আর ৪০০০  কিলোমিটার সীমান্ত নিয়ে গণতন্ত্রী বিশ্ববিশ্র“ত ভারত। সীমান্ত অল্প হলেও সমস্যা অধিক সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার। রোহিঙ্গা শরণার্থী, নাসাকা বাহিনীর উৎপাত, সীমান্তে গুলিবর্ষণ, সশস্ত্র চরমপন্থিদের আনাগোনা, অস্ত্র ও মাদক চক্রের দৌরাত্ম্য, বঙ্গোপসাগরের সম্পদে ভাগ দাবি, যুদ্ধাবস্থা - আরও নানা কিছু হয়ে উঠেছে স্থায়ী মাথাব্যথা। আর সুদীর্ঘ সীমান্ত নিয়ে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের তালিকাটিও সুদীর্ঘ। বেরুবাড়ি, ফারাক্কা, ছিটমহল ও অপদখলীয় জমি, কাঁটাতার, সীমান্তহত্যা, ফেনী ও তিস্তা নদীর পানিবণ্টন, আমদানি-রপ্তানি, ভিসা, চোরাচালান, ক্ষুদ্র অস্ত্র, মাদক, নারী ও শিশু পাচার, ট্রানজিট, করিডোর, সশস্ত্র চরমপন্থি, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা, দাঙ্গা, আধিপত্য ও সম্প্রসারণবাদ, বিরোধিতার জিগির, ধর্মোন্মাদনা, মৌলবাদ. দুর্বৃত্তদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ইত্যাদি-ইত্যাদি অনেক কিছু। এসবের পরও মিয়ানমার থেকে চাল, মাছ, কাঠ, লুঙ্গি, জুতা, চীনামাটির তৈজসপত্র, ভেষজ দ্রব্যাদি ও আরও অনেক কিছু আসছে সীমান্তপথে, সাগর- ও আকাশপথে। আমাদেরও এমন অনেক কিছু যাচ্ছে একই ভাবে। গ্যাসবাহী পাইপলাইন বসানোর ব্যাপারে আমরা হতাশা সৃষ্টি করলেও এখন আশা জাগাতে চাইছি চীন পর্যন্ত সংযোগ-সড়ক নির্মাণের উদ্যোগে শামিল হয়ে।
    আর ভারতের সঙ্গে? সেই ছোটবেলা থেকে ভালবেসে এসেছি কলেজ স্ট্রিট, টালিগঞ্জ, দমদম, বলিউড। জানি না আর কাদের এত ভালবেসেছি! দুঃখও আছে। বাল্যবন্ধুদের হারানোর দুঃখ। স্কুলে কলেজে পড়ার কোন ফাঁকে কিছু না বলে কখন চলে গেছে তারা, তারপর আর কখনও একটু যোগাযোগও করে নি কেউ - সে অভিমান আছে। তা-ও ভুলেছি একাত্তরে। মন ভরে গেছে কৃতজ্ঞতায়। ভেবেছি এবার তো হলো রক্তের বন্ধন। কিন্তু যেভাবে সম্পর্ক গড়ে ওঠার কথা তা গড়ে উঠলো না কেমন করে। ১৯৯২ সালের অকটোবরে প্রথম সার্ক সাংস্কৃতিক সম্মেলনে যোগ দিতে ভারতের বিভিন্ন শহরে গিয়েছিলাম নাট্যকার সাঈদ আহমেদ, আসাদ চৌধুরী ও সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সঙ্গী হয়ে। তখন সময়টা ভাল ছিল না। রথযাত্রা শুরু হয়েছিল লালকৃষ্ণ আদবানি’র নেতৃত্বে। কলকাতা, ব্যাঙ্গালোর, তিরুবানন্তপুরম - যে শহরেই গিয়েছি পেয়েছি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার আভাস। দাঙ্গার খবরও শুনেছি।  ওই সময় বাংলাদেশ ও ভারত দু’ দেশের সম্পর্ক নিয়ে অনেক প্রশ্ন, কৌতূহল ও বিরাগের মুখোমুখি হয়েছি আমরা। এর কিছু দিন আগে নীরদ চৌধুরীর এক লেখায় বাংলাদেশ সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য থাকায় সাপ্তাহিক দেশ নিষিদ্ধ  করেছিল তৎকালীন বিএনপি সরকার। এ নিয়ে বেশ উত্তেজনা ছিল কলকাতায়। ম্যাক্সমুলার ভবনে আয়োজিত আলোচনা সভার প্রশ্নোত্তর পর্বে একজন শ্রোতা এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে। তিনি উত্তর দেন, “আমার দেশকে যে অবৈধ বা বেজন্মা বলবে, আমার বাপ হলেও, তাঁকে গুলি করবো।” তিরুবানন্তপুরম-এ আয়োজিত এক আলোচনা সভার এক ফাঁকে স্থানীয় একজন সাহিত্যিক-সাংবাদিক আসাদ চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “দু’ দেশের সম্পর্ক নষ্ট হলো কেন? শেখ মুজিব না হয় ভারতের জন্য ভুল লোক ছিলেন, অন্যেরা কি করলেন?” তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন ইংরেজিতে। ‘ভুল লোক’ বোঝাতে তিনি বলেছিলেন ‘রং হর্স’। আসাদ চৌধুরী উত্তর দেন, সম্পর্ক নষ্ট করেছে ভারতের স্মাগলার আর সাউথ ব্লকের আমলা। একাত্তরের পর তারা যুদ্ধে জেতা কলোনি ভেবেছিল বাংলাদেশকে। ২০০৫ সালে আমি গিয়েছিলাম ফারাক্কা-য়, বঙ্গভঙ্গের শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে। সেখানে আলোচনার প্রশ্ন-উত্তর পর্বে এক শিক্ষিকা বেশ রাগত ভঙ্গিতে আমার কাছে জানতে চান, কেন দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে তসলিমা নাসরিনকে? আমি উত্তর দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আয়োজনকারীরা তার আগেই ঘোষণা দেন - উনি আমাদের অতিথি। তাঁকে কোনও বিতর্কে জড়াবো না আমরা। পরে ওই জিজ্ঞাসার জবাব দেন কবি সৈয়দ হাসমত জালাল। তিনি বলেন, দেশকে ‘জারজ’ বলায় দেশবাসী ক্ষুব্ধ হয়েছে। তিনি পালটা প্রশ্ন রাখেন, এখানে যদি কেউ এ দেশ নিয়ে এমন কথা বলে তখন কি করবো আমরা?
    গত ৬-৭ই সেপটেম্বরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর সফর ও দু’ দেশের সম্পর্ক নিয়ে অনেক আশাবাদ জাগিয়ে রাখা হয়েছিল আমাদের মিডিয়ায়। তবে যাঁরা ভারতীয় মিডিয়ার দিকে নজর রেখেছিলেন তাঁরা লক্ষ্য করেছেন, সেখানে অত কিছু উচ্ছ্বাস ছিল না। তাঁরা সব কিছু বলেছেন সতর্কতার সঙ্গে। ভারতীয়দের দেশপ্রেম আমি বেশ ভালই বুঝি, সেখানে খাদ নেই এতটুকু। দেশপ্রেম কি এবং কাকে বলে তা বলিউডের সি-গ্রেড ছবি থেকেও শিখে নিতে পারেন যে কেউ। কাজেই তাঁরা চুক্তি, চুক্তি-খসড়া (প্রটোকল), সমঝোতা স্মারক যা-ই স্বাক্ষর করুন নিজেদের হিসাবের বাইরে যাবেন না এতটুকুও।
তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি হবে না -এটা জানা গিয়েছিল আগেই। নয়া দিল্লি’র রফি মার্গ-এ শ্রম শক্তি ভবন থেকে পানি সম্পদ মন্ত্রী পবন কুমার বনসাল যে ঢাকায় আসছেন না তা জানা গিয়েছিল দু’ দিন আগেই। তখনই প্রশ্ন উঠেছিল, তিনি না এলে কিভাবে স্বাক্ষর হবে পানিবণ্টন চুক্তি? তিস্তার সঙ্গে এখন ঝুলে গেছে ফেনী নদীর পানিবণ্টন চুক্তিও। সীমানা চিহ্নিতকরণ, ছিটমহল ও অপদখলীয় জমি হস্তান্তর সংক্রান্ত খসড়া-চুক্তি আশান্বিত করেছে অনেকে। কিন্তু এর দিন-তারিখ ঠিক হয় নি কিছুই। ওদিকে অসম-এ শুরু হয়েছে ওই হস্তান্তরের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন। একই রকম বিরোধিতা শুরু হয়েছে তৈরী পোশাক শিল্পের ৪৬টি সামগ্রীর বিনাশুল্কে ভারতে প্রবেশাধিকার নিয়ে। ভারতের ব্যবসায়ীরা এটা মানতে চাইছেন না, বলছেন চরম ক্ষতি হবে তাঁদের। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবে পুনর্বিবেচনার। এ রকম পুনর্বিবেচনার দাবি উঠেছে গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়েও। এ দাবি তুলেছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। তিনি ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতাদের একজন। আর সুন্দরবন, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, পুনর্নবায়নযোগ্য জ্বালানি, বিটিভি / দূরদর্শন, ঢাকা / জওয়াহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, ফ্যাশন ইনস্টিউট প্রভৃতি যে সব সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত সেগুলোর বাস্তবায়ন কতখানি কি হয় তা দেখার বিষয়। ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি এখনও বাস্তবায়িত হয় নি পুরোপুরি। তবে হ্যাঁ, প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে ২৪ ঘণ্টা খুলে রাখার ব্যবস্থা হয়েছে তিন বিঘা করিডোর।
    হাসিনা-মনমোহন চুক্তি হিসেবে এখন যা আলোচনার শীর্ষে রয়েছে তা হচ্ছে ‘ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট অন ডেভেলপমেন্ট কোঅপারেশন’। এতে কি আছে এবং এর মাধ্যমে কি হতে যাচ্ছে তা নিয়ে অনেক কথাই বলা হচ্ছে, এবং বলা হবেও। আমি শেষ কথা বলে রাখি রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে-
    “যা-ই বলুক না প্রতিবেশী নিন্দুক
    খুব কষে আঁটা যেন থাকে তব সিন্দুক।” (‘পরিণয়মঙ্গল’)

রবিবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১১

স্বাধীন দেশের রাজাকার

অনেকের মনে থাকতে পারে, ১৯৭৪ সালে আমার লেখা “সাড়ে সাত শ’ সিংহ” নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল শিল্পকলা একাডেমী মিলনায়তনে। ওই নাটকের এক চরিত্রের সংলাপ ছিল, ‘পরাধীন দেশের মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীন দেশে রাজাকার হয়ে যায়।’ নাটকের সংলাপ যা হয় সেই সাঙ্কেতিকতা ছিল ওই উচ্চারণে। একটি সাধারণ অর্থ এবং একাধিক গূঢ় অর্থ। শ্রোতা-দর্শকেরা অর্থ-উপলব্ধি করে নেন যাঁর-যাঁর পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী। ওই সময় অবশ্য কাদের সিদ্দিকী থেকে মেজর (অব) আবদুল জলিল পর্যন্ত অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধাই নানারকম বিরোধিতা ও সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন রাজনৈতিক রণাঙ্গনে। তখন মেজর (অব) আবদুল জলিল নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সরকার-বিরোধী আন্দোলন-মুখর রাজনৈতিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর। আর কাদের সিদ্দিকী মোকাবেলা করছিলেন নিজ দলেরই একাংশের চোরাস্রোতের। সেই একাংশ জয়ী হতে পারে নি শেষ পর্যন্ত। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ-বাকশাল প্রতিষ্ঠিত হলে কাদের সিদ্দিকীকেই টাঙ্গাইলের গভর্নর করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তবে স্বাধীনতার ৪০তম বর্ষে সত্যি-সত্যি তাঁকে ‘রাজাকার’ অভিহিত করে স্লোগান দেয়া হয়েছে টাঙ্গাইল শহরে আয়োজিত এক মিছিল থেকে। পরে টাঙ্গাইলের সখীপুরে আয়োজিত এক সভা-সমাবেশ থেকে তাঁকে ‘যুদ্ধাপরাধী’ ঘোষণা করে বিচার দাবি করা হয়েছে তাঁর। দাবি করেছেন ওই সখীপুর আসনে তাঁর নির্বাচনী ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী শওকত মোমেন শাহজাহান। এ দাবি করার কারণ  একাত্তুরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কাদের সিদ্দিকী নাকি অনেক হত্যা ধর্ষণ অগ্নিসংযোগ লুটপাট করেছেন, যা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিচারযোগ্য। প্রকাশ্যে তাঁর বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ এই প্রথম। একাত্তুরে কিংবা এর আগে বা পরে কেউ কাদের সিদ্দিকী দ্বারা ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ হয়েছে  এমন কেউ কোনও অভিযোগ করে নি এর আগে। শওকত মোমেন শাহজাহান নিজে হয়েছেন কিনা তা বলেন নি অবশ্য, তবে যাদের কথা কথা বলেছেন তারা কি করেছে কখনও? লুটের শিকার কোনও ব্যাঙ্ক? কোনও জমিদার? টাঙ্গাইলের মানুষ তো কাদের সিদ্দিকীকে একমত হয়ে বরণ করে নিয়েছে ‘বঙ্গবীর’ উপাধিতে ভূষিত করে।
    কাদের সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে একটি অভিযোগই প্রচার পেয়েছিল বিশ্ব মিডিয়ায়। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর টাঙ্গাইল ও ঢাকায় কয়েকজন দুর্বৃত্তকে প্রকাশ্যে বেয়নেট চার্জ করে হত্যার অভিযোগ। সে ঘটনার ছবি প্রকাশিত হয়েছিল বিশ্ব মিডিয়ায়, এখনও প্রকাশ করা হয় মাঝেমধ্যে। ক’দিন আগে দেখলাম বিবিসি অনলাইনে। ওই ঘটনার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী জননেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী  “১৭ই ডিসেম্বর টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করে।... বিকেলে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের এক সমাবেশ। কাদের সিদ্দিকী তার দলবল নিয়ে এখানে উপস্থিত হন। লুটপাট ও ছিনতাইয়ের অভিযোগে সকালে আজিমপুর এলাকা থেকে আটক চারজনকে এ সমাবেশে উপস্থিত জনতার রায় নিয়ে প্রকাশ্যে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। সমাবেশে বলা হয়, স্বাধীন দেশে যারা অন্যায় অপকর্মে লিপ্ত হবে তাদেরকে এভাবে গণ আদালতে বিচার করে তাৎক্ষণিকভাবে সাজা দেয়া হবে।” (‘রাজনীতির তিনকাল’, ঢাকা, ২০০১)
    কিছু দিন আগে বরেণ্য চিন্তাবিদ বদরুদ্দিন উমর এ ঘটনাটিকে ‘যুদ্ধাপরাধ’ বলে উল্লেখ করেছিলেন এক কলামে, তবে শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক-সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী এর প্রতিবাদ করে বলেছেন, এটা ধিৎপৎরসব (যুদ্ধাপরাধ) নয়, ধঃৎড়পরঃু (নৃশংসতা)। চব্বিশ বছর বয়সী কাদের সিদ্দিকীর কাছে সেদিন দীঘ নয় মাস ধরে নিপীড়িত জনতার রায়-ই ছিল অমোঘ নির্দেশ। ওই চার জন ছিল আসলে যুদ্ধাপরাধী। কথাপ্রসঙ্গে কাদের সিদ্দিকী আমাকে বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধ অংশ নেয়ার দোহাই দিয়ে ওরা শুরু করেছিল চরম দুষ্কর্ম। ১০-১২ জন অবাঙালি বিহারি মেয়েকে বিভিন্ন বাড়িতে আটকে রেখে ওরা নৃশংস নির্যাতন করছিল দলেবলে।
    বঙ্গবন্ধুর কাছে কাদের সিদ্দিকী অস্ত্র সমর্পণ করেন ১৯৭২ সালের ২৪শে জানুয়ারি। সেদিন মঞ্চের খুব কাছে দাঁড়িয়েছিলাম ভাষণ শোনা ছাড়াও একটি বিশেষ কারণে। সে কারণটি ছিল  অনুষ্ঠানের শুরুর দিকে মানপত্র পাঠ শুনে বঙ্গবন্ধুর মুখে কি ভাব হয় তা দেখা। মানপত্রের পাঠক ছিলেন আনোয়ার উল আলম শহীদ, লেখক ছিলাম আমি। মানপত্রের ভাষা, আবেগ, বক্তব্য যে বঙ্গবন্ধুকে প্রীত করেছিল তা বুঝতে পেরেছিলাম তখনই। বাঁধাই করা সে মানপত্রটি ৩২ নম্বরের বাড়িতে সযতেœ টাঙানো ছিল বলে এই কিছু দিন আগে আমাকে জানিয়েছেন আনোয়ার উল আলম শহীদ।
    সেদিনের সেই অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে কাদের সিদ্দিকীকে উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “কাদের, তুই চার জনকে মেরেছিস্, চার শ’ লোক মারলেও আমি তোকে কিছুই বলতাম না!” মিজানুর রহমান চৌধুরী এ উক্তিটিও উদ্ধৃত করেছেন ‘রাজনীতির তিনকাল’-এ। তখনকার বাস্তবতা ছিল এ রকমই। বঙ্গবন্ধু’র ওই উক্তির প্রতিবাদ করেছিলেন শুধু তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টাঙ্গাইলের আবদুল মান্নান। স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির প্রথম সভায় তিনি বলেছিলেন, “প্রকাশ্য জনসভায় সরকার-প্রধানের এই বক্তব্যের পর দেশে আইন-শৃঙ্খলা কি করে প্রতিষ্ঠা হবে?”
    শওকত মোমেন শাহজাহানের অভিযোগের মূলে রয়েছে সখীপুরে গত ১৫ই নভেম্বর পালিত ‘ভোট ডাকাতি দিবস’। ১৯৯৯ সালের ওই দিনে সখীপুরের উপনির্বাচনে তিনি ছিলেন সরকার দলীয় প্রার্থী, কাদের সিদ্দিকী ছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। ওই নির্বাচনে পরাজিত হন কাদের সিদ্দিকী। অভিযোগ ওঠে, ভোট ডাকাতির মাধ্যমে সেদিন পরাজিত করা হয়েছে তাঁকে। এ অভিযোগ কতখানি সত্য তা ওই সময়কার পত্রপত্রিকাতেই আছে।
    এবার ভোট ডাকাতি দিবস উপলক্ষে সখীপুরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কাদের সিদ্দিকী, কর্নেল (অব.) অলি, জেনারেল (অব.) মুহাম্মদ ইবরাহিম। তাঁরা যথাক্রমে বীরউত্তম, বীরবিক্রম, বীরপ্রতীক। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রের উচ্চ মর্যাদা ও সম্মানের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। আরও ছিলেন আ স ম আবদুর রব। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের, মুক্তিযুদ্ধের শীর্ষ নেতাদের একজন। একজন বীরউত্তমকে ‘রাজাকার’ ‘যুদ্ধাপরাধী’ আখ্যায়িত করে তাঁর সহজনদেরও তো অবমূল্যায়িত করা হলো একই ভাবে।
    মনে হচ্ছে, আমরা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি হিসেবে কেবল মুক্তিযুদ্ধেরই পক্ষে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কি? তবে কি মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের ছাড়া  এই সব ভুয়া আর ষোড়শ বাহিনী দিয়ে?

পলিটিশিয়ালের পলিট্রিক্স

নিজেকে প্রায়ই প্রশ্ন করি, বাংলা ও বাঙালি নিয়ে এত কথা বলি, গর্ব ও গৌরব করি, কিন্তু কোথায় কি আছে বাঙালিত্ব আমাদের? বাংলা ও বাঙালির কোন বৈশিষ্ট্য ধারণ করে আছি আমরা? চেহারা গঠন চলন দেখে তো বিভ্রান্তই হয়ে পড়েন বিদেশীরা। ১৯৭৮-৮০ সালে চীনে ছিলাম, তখন সপরিবারে কোথাও বেড়াতে গিয়ে প্রশ্ন শুনেছি, ভারতীয় নাকি নেপালি? ইনতুকুয়ো রেন? নিয়েপর রেন?  আমাদের রাস্তায় দেখলে অনেক চীনা তরুণ গেয়ে উঠতো ‘মায় আবালা হু’  রাজকাপুর-নারগিস অভিনীত ‘আওয়ারা’ (১৯৫১) ছবির গান ‘ম্যয় আওয়ারা হুঁ’। ছবিটি ওই সময়ে মুক্তি পেয়েছিল চীনের বিভিন্ন শহরের প্রেক্ষাগৃহে, বিপুল দর্শকপ্রিয় হওয়ায় টিভিতেও দেখানো হতো মাঝেমধ্যে। এ ছবির প্রভাবে তরুণদের মধ্যে সাইকেল চুরির প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল বলে জোর অভিযোগ উঠেছিল তখন। অর্থাৎ আমাদের ভারতীয় ভাবতো ওরা। ভুল করার বিপদ থেকে বাঁচতে অনেকে বলতেন, দক্ষিণ এশীয়। আর ভারতীয়রা কি ভাবেন? ১৯৯২ সালের অকটোবরে প্রথম সার্ক সাংস্কৃতিক উৎসবে যোগ দিতে গিয়েছিলাম ভারতের বিভিন্ন শহরে। বেঙ্গালুরু’র অশোক হোটেলে ছিলাম আমরা সাত দেশের কবি-সাহিত্যিক। ২০শে অকটোবর সন্ধ্যায় হোটেলের রেস্তরাঁয় আড্ডা দিচ্ছিলাম কয়েকজন  সাঈদ আহমদ, আসাদ চৌধুরী, মালদাইভস-এর হাবিবা হুসাইন হাবিব ও আবদুল্লা সোদিগ, নেপালের ঈশ্বর বড়াল ও বৈরাগি কাইনলা। পাশের টেবিলে ছিল একটি স্থানীয় পরিবার। তাঁরা কৌতূহলী হয়ে দেখছিলেন আমাদের। এক সময় এক-দু’ কথায় আলাপ জমে যায় তাঁদের সঙ্গেও। জানতে পারি তাঁরা কোনও এক সূত্রে বেঙ্গালুরু’র কীর্তিধন্য সন্তান বসন্ত কুমার শিবশঙ্কর পাড়ুকোন ওরফে গুরু দত্ত (১৯২৫-১৯৬৪)-এর আত্মীয়। এর পর, পরিচালক হিসেবে সত্যজিৎ রায় ও গুরু দত্ত কে কেমন, তা নিয়ে এক গুরুতর আলোচনা শুরু হয়ে যায় আমাদের মধ্যে। এক পর্যায়ে যখন বলি, গুরু দত্তের স্ত্রী গীতা দত্ত (১৯৩০-১৯৭২) যে দেশে জন্মেছেন আমরা তিন জন (নাট্যকার সাঈদ আহমদ, কবি আসাদ চৌধুরী ও আমি) সেই দেশের  তখন খুব বিস্ময় প্রকাশ করেন তাঁরা। বলেন, আমরা ভেবেছিলাম আপনারা আমাদেরই দেশের  উত্তর-পূর্ব ভারতের নাগা, মিজো, মণিপুরি।
    এ তো গেল বাইরের চেহারার ব্যাপার। আমাদের জীবন যাপন? সংস্কৃতি? বাংলার বাংলাভাষী হিসেবে নিজেদের আমরা বাঙালি বললেও অন্য ধর্মাবলম্বীরা আমাদের জানে মুসলমান হিসেবে। ১৯১৭ সালে প্রকাশিত ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের প্রথম পর্বের শুরুতেই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮) লিখেছেন, “ইস্কুলের মাঠে বাঙ্গালী ও মুসলমান ছাত্রদের ‘ফুটবল ম্যাচ’।...” অর্থাৎ অন্য ধর্মাবলম্বীরা বাঙালি হলেও মুসলমানেরা নয়। এজন্য অবশ্য দায়ী আমরাও। বাঙালির চেয়ে মুসলমান পরিচয় এককালে বড় ছিল আমাদের কাছে। বাইরে বাংলা বললেও সম্পন্ন মুসলমানদের বাড়িতে উরদু ভাষার চল আছে এখনও। সেকালে এ চল ছিল বেশি। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি বেগম রোকেয়ার কথা। পারিবারিক ভাবে তাঁরা উরদুভাষী ছিলেন, তাহলেও বাংলা ভাষা ও বাঙালিত্বের প্রতি দৃঢ় অবস্থান ছিল তাঁর। আমাদের স্বাভাবিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে লিখেছেন, “আমরা দুর্বল নিরীহ বাঙ্গালী। এই বাঙ্গালী শব্দে কেমন সুমধুর তরল কোমল ভাব প্রকাশ পায়। আহা! এই অমিয়াসিক্ত বাঙ্গালী কোন বিধাতা গড়িয়াছিলেন? কুসুমের সৌকুমার্য, চন্দ্রের চন্দ্রিমা, মধুর মাধুরী, যূথিকার সৌরভ, সুপ্তির নীরবতা, ভূধরের অচলতা, নবনীর কোমলতা, সলিলের তরলতা  এক কথায় বিশ্বজগতের সমুদয় সৌন্দর্য এবং স্নিগ্ধতা লইয়া বাঙ্গালী গঠিত হইয়াছে, আমাদের নামটি যেমন শ্র“তিমধুর তদ্রƒপ আমাদের সমুদয় ক্রিয়াকলাপও সহজ ও সুন্দর।... ভারতের পুরুষ সমাজে বাঙ্গালী পুরুষিকা।” (‘নিরীহ বাঙ্গালী’, মতিচূর, ১৯০৪)
    একালে শহীদ কাদরী’র পরিবারে শুনেছি চোস্ত উরদু। শামসুর রাহমানের পরিবারে শুনেছি এক ধরনের মিশ্র উরদু  যা পরিচিত ঢাকাইয়া উরদু নামে। পুরান ঢাকায় এ ভাষার চল আছে বহু পরিবারে।
    বাঙালি মুসলমানের ভাষা-বিতর্ক ছিল সেকালেও।
১৫৮৬ সালে রচিত “নবীবংশ” কাব্যে সৈয়দ সুলতান (১৫৫০-১৬৪৮) উল্লেখ করেছেন, বাংলা ভাষায় ধর্মীয় ‘পাঁচালী’ লিখে বিপুল নিন্দার শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। কারণ ‘কিতাবের কথা দিলুঁ হিন্দুয়ানি করি।’ তিনি অবশ্য নিজের বাঙালি পরিচয়ের পক্ষে জোরালো যুক্তি দিয়েছেন  “যারে যেই ভাষে প্রভু করিছে সৃজন। সেই ভাষ হয় তার অমূল্য রতন ॥”
বাংলা ভাষা মুসলমানের ভাষা নয়  এমন ধারণার শিকার হয়েই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন ‘নূরনামা’র কবি আবদুল হাকিম (১৬২০-১৬৯০)  “যে সব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী। সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি ॥” সমকালীন মনোভাব, সেই সঙ্গে বাঙালি পরিচয়ের পক্ষে নিজের দৃঢ় অবস্থান প্রকাশ করেছেন তিনি  “সর্ববাক্য বুঝে প্রভু কিবা হিন্দুয়ানী। বঙ্গদেশী বাক্য কিবা যত ইতি বাণী ॥ মারফত ভেদে যার নাহিক গমন। হিন্দুর অক্ষর হিংসে সে সবের গণ ॥... মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি। দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি ॥”
মুসলমানরাও যে বাঙালি তা প্রমাণ করতে, এ জাতির অভ্যুদয় ঘটাতে রক্ত দিতে হয়েছে আমাদের, প্রয়োজন পড়েছে একটি বায়ান্ন ও একটি একাত্তরের, মুখের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হয়েছে, প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের। তবে পশ্চিমবঙ্গের এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী বাঙালির মানসিক স্বীকৃতি পেতে দেরি হবে আরও। প্রকাশ্যে তাঁরা সবাই আমাদের ‘বাঙালি’ বললেও নিজেদের মধ্যে তা চালু করতে পারেন নি এখনও। কতকাংশে ‘বাঙাল’ হতে পেরেছি মাত্র।
অর্থাৎ পরিচয়গত ঘরোয়া সমস্যা রয়ে গেছে আমাদের। আর বাইরের সমস্যা তো আরও বেশি। সেটা বলতে গেলে আমাদের নিজেদেরই সৃষ্টি। যেমন, অবাঙালিদের প্রতি অবজ্ঞার ভাব  যা প্রকাশ পায় ‘মাওড়া’, ‘ছাতুখোর’, ‘খোট্টা’, ‘উড়ে’ প্রভৃতি শব্দে। পাঠান, শিখ ও অন্যান্য জাতের লোকজন নিয়ে বিচ্ছিরি-বিচ্ছিরি চুটকি (জোক) বলি আমরা, জানি না হয়তো বাঙালি বাবু-বিবিদের নিয়ে তাদেরও আছে চূড়ান্ত রকম বিচ্ছিরি জোক। পেইচিং থাকতে কাঠমণ্ডু’র গোবিন্দ ভাট, দিল্লি’র ত্রিনেত্র যোশী, ইসলামাবাদের সুলতান গাজি ও আরও অনেকের কাছে শুনেছি সে সবের কয়েকটি। একেবারেই সহ্য করার মতো নয়। ও সব চুটকি শুনলে মনে হবে বাঙালির মতো নীচ আর হীন বুঝি আর কেউ নয়। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যে সব চুটকি আছে তাদের সেগুলোকে মর্মান্তিকই মনে হয়েছে আমার।
আসলে বাঙালি হতে চাওয়া মুসলমানদের সমস্যা অনেক। আজিজুল আজিজ লিখেছেন, “বাঙালি মুসলমানদের সামাজিক অবস্থা বড় করুণ। কেউ তাদের দলে নিতে চায় না। বাঙালি হিন্দুদের কাছে তারা শুধু মুসলমান, বাঙালি নয়। আবার বিহারি মুসলমানদের কাছে তারা মুসলমান নয়, বাঙালি। দু’টি সত্তা নিয়ে কোথাও কলকে পাচ্ছে না বাঙালি মুসলমান। আমাদের ভাষা যেহেতু বাংলা, বিহারি মুসলমানদের কাছে বাঙালি মুসলমান নাকি হিন্দুরই সামিল।... বিহারি মুসলমানদের কাছে অচ্ছুত হয়ে বাঙালিদের দলে ভিড়ে নিজেকে গর্বিত করে তোলার চেষ্টা চালালে, সেখানে আবার আর এক ধাক্কা। ‘আরে, আপনাকে তো মুসলমান বলে চেনাই যায় না! ভেবেছিলাম আপনি বাঙালি।’...” (‘বাঙালি মুসলমান’, প্রতিদিন, কলকাতা, ২৬.১০.২০০২)
এভাবে আমাদের বাঙালিত্ব বিভ্রান্তিকর হয়ে আছে ভেতরে বাইরে। পরিচয়ে, চেহারায়, গঠনে, চলনে, বলনে। আমাদের ভাষা ইন্দো-এরিয়ান, কিন্তু আমরা ইন্দো-এরিয়ান নই  অসট্রিক মঙ্গোলয়েড নিগরোয়েড ইত্যাদির এক সংকর। তারপর আমাদের পোশাক, গান, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, শিল্প-সংস্কৃতি, ক্রীড়া, শিক্ষা  এ সবে বাঙালিয়ানা আছে কতখানি কি? রবীন্দ্রনাথের সময় থেকে যে বিশ্বায়ন শুরু হয়েছে তার ‘মেলাবে-মেশাবে’ ধাক্কায় আর অবশিষ্ট আছে কতখানি কি? পহেলা বৈশাখের গামছা লুঙ্গি পান্তা ইলিশ ইত্যাদির মধ্যে যত না বাংলা আছে তার চেয়ে বেশি আছে ধান্দা! তাহলে সেই বাঙালি কোথায় যার সম্পর্কে কবি নবীচন্দ্র সেন (১৮৪৭-১৯০৯) লিখেছেন তাঁর ‘পলাশীর যুদ্ধ’ (১৮৭৫) কাব্যে 
“স্বর্গ মর্ত করে যদি স্থান-বিনিময়,
তথাপি বাঙ্গালী নাহি হবে একমত;
প্রতিজ্ঞায় কল্পতরু, সাহসে দুর্জয়।
কার্যকালে খোঁজে সবে নিজ নিজ পথ।”
নাট্যকার ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ (১৮৬৩-১৯২৭)-ও এমন মন্তব্য করেছেন তাঁর “বঙ্গের প্রতাপ-আদিত্য” (১৯০৩) নাটকে  “অন্য জাতির দশে কার্য, বাঙালির দশে কার্যহানি।” আর কবি সুনির্মল বসু (১৯০২-১৯৫৭) তো স্পষ্ট করেই লিখেছেন  “যেখানে বাঙালী সেখানে কেবল দল আর দলাদলি।” (‘আমরা বাঙালী’)
খুব জানতে ইচ্ছা করে এই ঐকমত্য বিরোধী (গণতান্ত্রিক?), প্রতিজ্ঞাভঙ্গকারী, আপসকামী, স্বার্থপর, কোন্দলপরায়ণ বাঙালি আজ কোথায়? আসল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য চিনেই তো শনাক্ত করতে হবে বাঙালিয়ানাকে? রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন  “... বঙ্গদেশ গোঁফে-তেল গাছে-কাঁঠালের দেশ। যত বড় না মুখ তত বড় কথার দেশ। পেটে পিলে কানে কলম ও মাথায় শামলার দেশ।... এখানে বিচিগুলাই তেরো হাত হইয়া কাঁকুড়কে অতিক্রম করিয়া ওঠে।... বাঙালি জাতির... সাহস হয় না, আশা হয় না, উদ্যম হয় না।... আমাদের শরীর অপটু, বুদ্ধি অপরিপক্ব, উদরান্ন ততোধিক।...” (‘চিঠিপত্র’, ১৮৮৭)
আরও লিখেছেন, “... কেবল দলাদলি, কেবল ‘আমি আমি আমি’ এবং ‘অমুক অমুক অমুক’ করিয়াই মরিতেছি। আমাকে এবং অমুককে অতিক্রম করিয়াও যে দেশের কোনও কাজ, কোনও মহৎ অনুষ্ঠান বিরাজ করিতে পারে, ইহা আমরা মনে করিতে পারি না। এইজন্য আপন আপন অভিমান লইয়াই থাকি। আমাকে বড় চৌকি দেয় নাই, অতএব এ সভায় আমি থাকিব না  আমার পরামর্শ জিজ্ঞাসা করে নাই, কাজেই ও কাজে আমি হাত দিতে পারি না  সে সমাজের সেক্রেটারি অমুক, অতএব সে সমাজে আমার থাকা শোভা পায় না  আমরা কেবল এই ভাবিয়াই মরি। সুপারিশের খাতির এড়াইতে পারি না, চক্ষুলজ্জা অতিক্রম করিতে পারি না, আমার একটা কথা অগ্রাহ্য হইলে সে অপমান সহ্য করিতে পারি না।...” (প্রাগুক্ত)
হ্যাঁ, এবার মনে হয় চিনতে পেরেছি খাঁটি বাঙালি। দেখতেও যেন পাচ্ছি চোখের সমুখে। এই তো এই লোকগুলি 
“... আমরা কেবল ঘরে বসিয়া বড় কথা লইয়া হাসি-তামাশা করিতে পারি, বড় লোককে লইয়া বিদ্রুপ করিতে পারি... আমরা না পড়িয়া পণ্ডিত, আমরা না লড়িয়া বীর, আমরা ধাঁ করিয়া সভ্য, আমরা ফাঁকি দিয়া পেট্রিয়ট  আমাদের রসনার অদ্ভুত রাসায়নিক প্রভাবে জগতে যে তুমুল বিপ্লব উপস্থিত হইবে আমরা তাহারই জন্য অপেক্ষা করিয়া আছি, সমস্ত জগৎও সেই দিকে সবিস্ময়ে নিরীক্ষণ করিয়া আছে।...” (প্রাগুক্ত)
না চেনার কারণ নেই কোনও। ওই ‘রসনা’ কথাতেই চেনা যায় বেশ। এর জোরে সব কিছু চালাবার ক্ষমতা একমাত্র ওঁদেরই আছে!

বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১১

প্রাচীন প্রণয়প্রাণের পদ্য

নর-নারীর প্রেম-ভালবাসা নিয়ে কত কথা ও কাহিনী  কত কীর্তি ও কীর্তন  কিন্তু ভালবাসা কারে কয়? কি অনুভব প্রেমে? কবিতায় গল্পে উপন্যাসে নাটকে চলচ্চিত্রে  শিল্প-সংস্কৃতির কত না মাধ্যমে  হৃদয়ের এই জাগরণ ও কোলাহল নিয়ে কতই না ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বক্তব্য বিবরণ! নানা উপলক্ষে এই নন্দিত বন্দিত বোধ ও বিষয় নিয়ে অনেক ভেবেছি আমি, একবার মনে হয়েছে  আগ্রহই ভালবাসা। প্রথম যৌবনে তাই লিখেছিলাম, “কুসুম পাবো না হয়তো আমরা কেউ, তবুও কুসুমের প্রতি আগ্রহই ভালবাসা।” এই ভাবনা নিয়ে আরও গভীরে গিয়ে বুঝেছি  তীব্র আদর ও আসক্তির আবেগই প্রেম। এ এক আচ্ছন্নতা। এক পূর্ণ গ্রাস। সঙ্গে-সঙ্গে এ-ও জেনেছি, সত্য কথাটি বঙ্কিমচন্দ্র লিখে গেছেন সেই ১৮৮২ সালে তাঁর ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসে, “ভালবাসা দুঃখ মাত্র।” সে দুঃখ কতখানি তা প্রায় ওই সময়েই লিখে গেছেন মহাকবি কায়কোবাদ (মুহম্মদ কাজেম আল কুরায়শী, ১৮৫৭-১৯৫১) 
    “... সে আমার সুখে দুঃখে প্রাণের সঙ্গিনী!
    তারি তরে বেঁচে আছি ভবে!
    জীবন-জলধি-পাড়ে, আর কি পাইব তারে
        এক দুই করে আমি মাস দিন গণি!
    সে চাঁদ উঠে না আর, ঢালে না সে সুধা-ধার,
        আমি তার সে আমার  শুধু এই জানি!
            সে আসিবে কবে!...” (‘প্রেম-প্রতিমা’)
    এই যে আচ্ছন্নতা (‘আমি তার সে আমার  শুধু এই জানি’) ও দুঃখবোধ (‘সে আসিবে কবে’)  এই আকুলতা, আকুতি বাংলার কবিতাকে দিয়েছে মহিমা, বাঙালির প্রেমকে করেছে মহীয়ান। কবি ও প্রেম যেন এক মরমী সুরে বাঁধা। বাংলার কবি তাই প্রেমকে দিয়েছেন বেদনা-সুন্দর রূপ। এ রূপের এক মধুর দুঃখজাগানিয়া ভাষা দিয়েছেন কবি, কথাশিল্পী, গবেষক, সমালোচক ও রাজনীতিবিদ হুমায়ুন কবির (১৯০৬-১৯৬৯) 
    “আমার এ প্রেম সখি শুধু নিবেদন।
    নাই বা জানিলে তুমি আজি মোর মন।
    রচিছে তোমারে ঘেরি’ সোনার স্বপন।...
    আসিবে ঘনায়ে যবে বিদায়ের বেলা 
    লুকায়ে হাসির তলে বেদনার খেলা
    সন্ধ্যার আঁধার পথে ফিরিব একেলা।
    তোমার আনন্দ মাঝে মোর অশ্র“মালা
    ঝুলিবে মুকুতাসম তব কণ্ঠে বালা।” (‘তৃপ্তি’)
    বাংলা কবিতায় প্রেমের এই মহনীয় রূপ (‘লুকায়ে হাসির তলে বেদনার খেলা / সন্ধ্যার আঁধার পথে ফিরিব একেলা’) আমরা পেয়েছি ঐতিহ্যের সূত্রেই। মধ্যযুগের বৈষ্ণব কবিরা দেবলীলার আড়ালে এবং সুফি কবিরা আধ্যাত্মিকতার আবরণে যে মানবিক প্রেমকাব্য রচনা করেছেন সে সবই এমন সহজিয়া অনুরাগ সৃষ্টি করেছে আমাদের কবিতায়। সেকালের প্রণয়োপাখ্যান সম্পর্কিত আলোচনায় ড. ওয়াকিল আহমদ লিখেছেন, প্রেমের ক্ষেত্রে “বিদেশী কবিদের সঙ্গে তুলনায় বাঙালি কবিদের পার্থক্য আছে। তাঁরা স্থূল অশ্লীল হতে দেন নি। বরং বিচিত্র বিন্যাসে, সূক্ষ্ম ব্যাখ্যায় এবং ব্যাপক বিশ্লেষণে শরীরী প্রেমকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি প্রমূর্ত ভাবসত্তায় রূপান্তরিত করেন। প্রেমোপলব্ধির গভীরতা এবং প্রকাশশক্তির তীব্রতার গুণেই তা সম্ভব হয়েছে।... রূপতৃষ্ণা, মোহ, কামনা, মান, অভিমান, অভিসার, বিচ্ছেদ প্রভৃতি মানবিক প্রেমের নানা স্তর কম বেশি সকলের কাব্যে আছে। নরনারীর দেহমিলন প্রেমের চরমতম আনন্দোপলব্ধি বটে কিন্তু পরম প্রাপ্তি নয়। মিলনে প্রেম ভোগমুখী ও আত্মকেন্দ্রিক, মিলনহীন প্রেম দেহের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। অনন্ত বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে প্রেম এই অলৌকিক সাত্ত্বিকতায় উত্তীর্ণ হয়।...” (‘বাংলা রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান’, খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ঢাকা, ২০০৬)
    ড. ওয়াকিল আহমদ আমার শিক্ষক। এখানে প্রসঙ্গক্রমে প্রেম সম্পর্কে স্যরের ধারণাটি উল্লেখ করতে পারি  “প্রেম মানবচিত্তবৃত্তির এক অতি প্রবল ও শ্রেষ্ঠ অনুভূতি। নরনারীর স্বভাবজ আকর্ষণ ও মিলনাকাক্সক্ষা জৈবিক প্রবৃত্তি। জৈবিক প্রবৃত্তি প্রেমের উৎস নয়। যখন কোনও বিশেষ নরনারীর চিত্ত পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট ও নিবিষ্ট হয়, তখন মিলনাকাক্সক্ষায় তাদের অন্তরে দাহ ও ব্যাকুলতা ফুটে ওঠে। মানবহৃদয়ের সেই ভাবানুভূতিকেই প্রেম বলা হয়।...” (প্রাগুক্ত)
    মধ্যপ্রাচ্য থেকে উত্তর ভারত পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূগোলের, সেই সঙ্গে বিশাল বাংলার পৌরাণিক, লৌকিক, ঐতিহাসিক  নানা কাহিনীর সূত্রে এই প্রেমেরই প্রকাশ ঘটেছে রাধা-কৃষ্ণ, শিব-পার্বতী, বিদ্যা-সুন্দর, ইউসুফ-জোলেখা, লায়লী-মজনু, মধুমালতী, হানিফা-কয়রাপরী, সয়ফুলমুলক-বদিউজ্জামাল, সতীময়না-লোরচন্দ্রানী, পদ্মাবতী, চন্দ্রাবতী, লালমতি, গুলে বকাওলী, শাহজালাল-মধুমালা, জেবলমুলুক-শামারোখ, মৃগাবতী, মহুয়া, মলুয়া, কমলা, রূপবতী, কঙ্ক-লীলা, কাজলরেখা, দেওয়ানা মদিনা প্রমুখের রূপে। কেমন সে প্রেম? মুহম্মদ কবীর-এর নায়িকা মধুমালতী প্রেমিক মনোহর-কে বলেছে  “ধরাইতে না পারি চিত্ত তোহ্মা রূপ হেরি। ধড়ফড় করে প্রাণ না দেখিলে মরি ॥” উত্তরে মনোহর বলেছে প্রেমিকা মধুমালতী-কে  “তোহ্মা রূপ হেরি মন গেল তনু ছাড়ি। সুধা তনু যথা তথা রহিবেক পড়ি ॥... তিলেক বিমন নাহি তোহ্মারে পাসরি। তোহ্মা রূপ লৈল আঁখি পলক বিস্মরি ॥”  নওয়াজিস খান-এর নায়ক তাজুলমুলুক-এর অন্তরে বকাওলী’র প্রতি প্রেমের সঞ্চার হয় হয় এভাবে  “চাহিতে চাহিতে রূপ মুহিত বিশেষ। প্রেমালাপ আক্ষি পন্তে হইল প্রবেশ ॥ হ্রিদেতে তরঙ্গ হইল সেই প্রেমানল। দহএ সমস্ত অঙ্গ না হয় শীতল ॥” এরপর সে লেখে প্রেমপত্র  “প্রাণ আদি শক্তি মতি রাখি তোমা সঙ্গে। মৃত্যুবৎ চলি যাই নিজ শূন্য অঙ্গে ॥” কোরেশী মাগন ঠাকুর-এর নায়ক বীরভান প্রেমিকা চন্দ্রাবতীকে একবার দেখার আকুতি প্রকাশ করেছে এভাবে  “হাহা কন্যা চন্দ্রাবতী তুহ্মি প্রাণধন। কর্ণের কুণ্ডল তুহ্মি আঁখির খঞ্জন ॥ নয়ানের জুতি তুহ্মি ভিনে হএ ঘোর। কেমতে দেখিব তোর রূপ মনোহর ॥ কেমতে শুনিব তোর মুখের বচন। কেমতে দেখিব তোর পাএর চলন ॥ কেমতে ভুরুর কালা চন্দ্রিমা। কেমন লোচন চারু পোতলি মিলিব ॥... কেবা মুঞি সূর্য নিয়া চন্দ্রেত মিলাইব। কেবা মোর মিত্র মণি গলে গাঁথি দিব ॥ বিরহ অনল জ্বালা  কথেক তাপিমু। বিরহ সাগর মধ্যে কথেক ভাসিমু ॥...”
    মধ্যযুগের কবিরা এই যে হৃদয়ে তরঙ্গলীলার কথা বলেছেন, নয়নের জ্যোতির কথাই বলেছেন তা-ই পরম্পরাক্রমে একদিন চোখের আলোয় দেখেছে চোখের বাহিরে। কয়েক শতক পেরিয়ে তাঁদের প্রণয়ীদের একই রূপ মুগ্ধ অভিভূত রেখেছে বাংলার কবিদের। তাঁরা হয়েছেন চিরকালের প্রেয়সী। তাই তো কবি নরেন্দ্র দেব (১৮৮৮-১৯৭১) লিখেছেন 
    “... নীলনদের ওই উপকূলে পীরামিডের দেশেযখন ছিলে মিশরমণি তুমি,
    সাগরসীমা সিংহাসনের সব গরিমা ভুলে ধন্য হতেম তোমার চরণ চুমি’।
    মরুর শশী কোন রূপসী জিপসী মেয়ে তুমি, ছিলে সে কোন আঁধার তাঁবুর আলো,
    ক্ষিপ্ত হয়ে তীব্র জ্বালায় দৌড়েছিলেম কত দেশবিদেশে তোমায় বেসে ভাল;
    বজ্রমুঠির তীক্ষè ছুরি রক্ততৃষায় মেতে বিঁধতো গিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী বুকে,
    দুঃসাহসের খিলাত দিতে নওজোয়ানের চিতে আমার ঘোড়ায় উঠতে তুমি সুখে।...
    কোন ইরানের গুলিস্তানে বুলবুলিদের শিসে কণ্ঠ তোমার গাইতো গজল গান,...
    হয়তো ছিলে বেদৌরালো চীনরূপসীর সেরা, উড়িয়ে তোমায় এনেছিলেম কাছে,
    কোন খলিফের বেগম ছিলে হারেম উজল করা বাদশাজাদা ফিরতো পাছে পাছে।...
    কোন হামামের হেনার জলে তোমার সনে শিথিল ক’রে বোরখা কোমরবন্দ্
    তোমার গালের তিলের তরে বিলিয়ে দিছি আমি খাশ বোখারা সাধের সামরখন্দ্...” (‘চিরন্তনী’)
    এভাবেই প্রিয়ার গালের কালো তিলের জন্য বোখারা-সমরখন্দ বিলিয়ে দেয়ার কবি হাফেজ  আছেন বাংলা কবিতায়। তাঁর প্রিয়া এখনও ‘বীণানন্দিত মধুরকণ্ঠে’ জিজ্ঞেস করে, “শূন্যশয়নে আমারে মাগিয়া জাগিয়া কিসের লাগি’?” বাংলার কবি প্রার্থনার ভঙ্গিতে হাত জোড় করে বিগলিত স্বরে বলেন, “নাহি চাই খ্যাতি, যশে কাজ নাই, চাহি না ক’ ধনমান, তোমার স্তবের যোগ্য করিয়া শিখাইয়া দাও গান।” প্রিয়া তখন লীলায়িত হেলায় সেতারটি শুধু টেনে নেয় বুকের কাছে,  আঙুলের ছোঁয়ায় তারগুলিকে ভরে দেয় তার সংগীতে, তারপর কবিকে সেতারটি ফিরিয়ে দিয়ে গভীর আঁধারে মিলিয়ে যায় শিশির-শীতল খর্জ্জুর-বীথির ভিতর দিয়ে 
    “তার পর হ’তে বাজিছে সাহানা সোহিনী সিন্ধু কাফি,
    সাথে সাথে সেই পরম পরশ উঠিতেছে কাঁপি’ কাঁপি’;
    তালে তালে উঠে দুলে’ দুলে’ তারি হৃদয়েরি আকুলতা,
    সুরে সুরে সদা ঘুরে’ ঘুরে’ ফিরে তাহারি গোপন কথা!” (‘হাফিজের স্বপ্ন’, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, ১৮৭৮-১৯৪৮)
    আমাদের প্রাচীন প্রণয়প্রাণ পদকর্তারা কোথায়? সেই মাঙ্গলিক, পদ্যকার, কবিওয়ালা, কবিরা? এখানেই আছেন ওঁরা সবাই। এই সময়ে মুহাম্মদ সামাদ যখন লেখেন “অরুণা, না, আমি আনন্দে যাবো না” তখন ঠিকই মনে পড়ে যায় সন্ধ্যার আঁধার-পথে ফিরে যাওয়া একজন অভিমানী হুমায়ুন কবিরকে, চৌধুরী ফেরদৌস যখন লেখেন ‘সুচে নয়, সুতায় গাঁথিও এই প্রেম’ তখন প্রেমের আগুনে তরঙ্গিত হৃদয়ের নওয়াজিস খান কথা কয়ে ওঠেন যেন, রেজাউদ্দিন স্টালিন যখন লেখেন “ঈভের সন্ধানে ঘোরো নগরে বন্দরে কখনও আউলচাঁদ, বীরভদ্র কখনও লালন হও” তখন যেন “সে আসিবে কবে”র আকুল কায়কোবাদকেই দেখি! আমার তো স্বতঃই মনে পড়ে শ্রীধর কথক (১৮১৬-?)-এর কবি গান 
“ভালবাসিবে বলে ভালবাসি নে
আমার স্বভাব এই তোমা বই আর জানি নে।
বিধুমুখে মধুর হাসি
দেখিলে সুখেতে ভাসি
সেজন্য দেখিতে আসি দেখা দিতে আসি নে ॥”

বুধবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১১

‘অসংস্কৃত যদৃচ্ছের পথে...’

আমার অনেক দোষ। একজন লেখক-সাংবাদিক হিসেবে শুদ্ধ করে লেখার চেষ্টা করি, তাতেও দোষ খুঁজে পান অনেকে। কিন্তু এ চেষ্টা তো সকলেরই করা উচিত। সে রকম চেষ্টাচরিত্র আমিও করি, এর বেশি কিছু নয়। তবে আমি যে কাণ্ডটি করে বসি তাহলো অশুদ্ধ কিছু দেখলে সঙ্গে-সঙ্গে বড্ড চেঁচামেচি শুরু করি। তবে তা করলেও কাজের কাজ হয় না কিচ্ছু। সকল প্রকাশনাতেই নিজস্ব বানানবিধি-প্রয়োগবিধি আছে। তাই আমি ‘মোহ্যমান’ লিখলেও স্বয়ংক্রিয় ভাবে হয়ে যায় ‘মুহ্যমান’। এভাবে ‘আশিস্’ লিখলেও তা হয়ে যায় ‘আশীষ’। যতবার লিখি ‘শয়িত’, ততবার হয়ে যায় ‘শায়িত’। অথচ দু’টি শব্দের অর্থ আলাদা। ‘শায়িত’ অর্থ যাকে শোয়ানো হয়েছে, আর ‘শয়িত’ অর্থ যে শুয়েছে। এ রকম উদাহরণ দিতে পারি অজস্র। এভাবে শুদ্ধ ভাষা, নির্ভুল বানান নিয়ে হৈচৈ করলেও পদে-পদে আমি হেরে যাই ক্ষমতাবানদের কাছে। তবে সবচেয়ে বেশি হারি রবীন্দ্রনাথের কাছে।    কেউ ‘অশ্র“জল’ লিখলে রেগে যাই, কেটে দেই সঙ্গে-সঙ্গে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যখন লেখেন - “... তাই তো তোমায় শুধাই অশ্র“জলে -” (‘প্রশ্ন’) কিংবা “... কেন হেরি অশ্র“জল হৃদয়ের হলাহল, রূপ কেন রাহুগ্রস্ত মানে অভিমানে” (‘পুরুষের উক্তি’) কিংবা “অশ্র“জলে অন্তরের সমস্ত কঠিনতাকে গলাইয়া...” (‘চোখের বালি’) তখন গলা খুসখুস করলেও বলতে পারি না কিছু। ‘শিশিরজল’ও লিখেছেন তিনি - “... মুছে গেছে রাত্রির শিশিরজলে,...” (‘৭’, ‘প্রান্তিক’)।
    ‘শ্রেষ্ঠ’ কথাটির অর্থ - ‘অতি উৎকৃষ্ট, উত্তম, প্রধানতম, সর্বপ্রধান’। অথচ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ (“প্রভু, দণ্ডিতের সাথে / দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে / সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।” - ‘গান্ধারীর আবেদন’)। ‘শ্রেষ্ঠতম’-ও লিখেছেন - “বন্ধু এক আছে শ্রেষ্ঠতম” (‘মালিনী’)।
    রবীন্দ্রনাথ কলেজকে ‘কালেজ’ (‘গোরা’), হাসপাতালকে ‘হাঁসপাতাল’ (‘রসময়ীর রসিকতা’) লিখেছেন। অশুদ্ধ শব্দও লিখেছেন অনেক। যেমন -
কেবলমাত্র: “... ইহার রহস্য কেবল একজনমাত্রই ভেদ করিতে পারিবে,...” (‘গুপ্তধন’); “কেবলমাত্র তপস্যার মধ্য দিয়ে সে হয়েছে জ্ঞানী মানুষ” (‘শেষ কথা’)।
ইতিপূর্বে: “... এমন শৌখিন নাম ইতিপূর্বে কখনো শোনা যায় নাই” (‘দেনাপাওনা’)।
ইতিমধ্যে: “ইতিমধ্যে নবদ্বীপ তাহার বুদ্ধিমান বন্ধুদের সহিত...” (‘রামকানাইয়ের নিবুর্দ্ধিতা’); “ইতিমধ্যে কিছুদূরে আমাদের অর্ধসমাপ্ত কয়লার খনিতে মজুরদের হল স্ট্রাইক” (‘শেষ কথা’)।
এভাবে তাঁর কারণে অনেকে লেখেন - ‘নটিনী’ (শুদ্ধ: নটী), ‘কাঙালিনী’ (শুদ্ধ: কাঙালী), ‘অনাথিনী’ (শুদ্ধ: অনাথা), ‘নীলিমা’ (শুদ্ধ: নীলিম), সকৃতজ্ঞ, সকাতর, সশঙ্কিত, সলজ্জিত (“স্মিতহাস্যে নাহি চল সলজ্জিত বাসরশয্যাতে স্তব্ধ অর্ধরাতে”), ‘মন্থিত’ (শুদ্ধ: মথিত), ‘সৃজন’ (শুদ্ধ: সর্জন, সৃষ্টি), ‘নিরপরাধী’, ‘নিরপরাধিনী’ (শুদ্ধ: নিরপরাধ), ‘নিশি’ (শুদ্ধ: নিশা), ‘নিশীথ রাত্রি’ (নিশীথ অর্থ রাত, মধ্যরাত, অর্ধরাত, গভীর রাত) প্রভৃতি।
ক্রিয়াপদ ‘জাগ্রত’কে রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করেছেন বিশেষণ হিসেবে। ‘প্রশ্বাস’ অর্থে ‘নিশ্বাস’ ব্যবহার করেছেন - “... বুক ভরিয়া একটি মাত্র শেষ নিশ্বাস গ্রহণ করিয়া মরিতে পারি তাহা হইলেও জীবন সার্থক হয়” (‘গুপ্তধন’)। ‘চীর’ অর্থ জীর্ণবস্ত্র। অথচ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “কত শিক্ষা পৃথিবীর / খসে পড়ে জীর্ণচীর / জীবনের সনে,...” (‘মৃত্যুর পরে’)। ব্যাকরণসম্মত নয়, অনাভিধানিক অনেক শব্দ তিনি তৈরি করে নিয়েছেন কবিতায় নানা প্রয়োজনে। দাহনা, যামী, স্থকিত, স্পর্শন, উজ্জ্বালিত, মৈতালি, শিথিলিত  এগুলি কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। রবীন্দ্র-গবেষকদের ভাণ্ডারে আছে আরও অনেক কিছু। সেখান থেকে আহরণ করতে পারি আরও। তবে বানানের কথা কিছু বলা দরকার। এ নিয়ে লিখেছি অনেক। আজ সে সবের একটি সারসংক্ষেপ দিতে চাই।
এ প্রসঙ্গে দুই একাডেমি’র কথাই আসবে বেশি করে - ঢাকার বাংলা একাডেমী ও কলকাতার পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি’র। বাংলা লিপি, বানান ও অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে একাডেমী ও আকাদেমি’র চিন্তা ও উদযোগ, বলতে গেলে, প্রবাহিত হচ্ছে একই ধারায়। একাডেমী বলছে, “এ মুহূর্তে যা আশু প্রয়োজন তা হলো বাংলা লিপির নতুন ডিজাইন (সংস্কার নয়), যাতে সকল ব্যঞ্জন ও যুক্তব্যঞ্জনের সঙ্গে অভিন্ন চিহ্ন যুক্ত করা যায়।” আকাদেমি-ও মনে করে, “আধুনিক মুদ্রণে যেহেতু আর পূর্ব-থেকে-প্রস্তুত-করা ঢালাই হরফের প্রয়োগ বা ব্যবহার অপরিহার্য নয়, তাই হরফের সমতাবিধান বর্তমানে সম্ভব ও সংগত। কেবল সামান্য অভ্যাসেই তা চোখে মানানসই ও ব্যবহারে সন্তোষজনক হতে পারে।” তবে আকাদেমি যে লিপি গ্রহণ করেছে তার সঙ্গে একাডেমী’র নয় - বেশি মিল আমাদের পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের লিপি’র।
    অ-কারের স্বতন্ত্র চিহ্ন নেই বাংলায়। আকাদেমি বলছে, এর প্রয়োজন নেই বলে কোনও চিহ্ন উদ্ভাবনের কথা ভাবেন নি তাঁরা। এ নিয়ে কোনও ভাবনা একাডেমী’রও নেই। কিন্তু ‘প্রয়োজন নেই’? শ’-শ’ উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করা যাবে অ-কারের প্রয়োজন কত তীব্র। এখানে তিনটি উদাহরণই দিচ্ছি - ‘প্রস্তুত’ ও ‘বস্তুত’; ‘ক্রমশ’ ও ‘অবশ’; ‘পণ্ডিত’ ও ‘খণ্ডিত’। বানান এক রকম, উচ্চারণ অন্য রকম। অ-কার থাকলে কি সুবিধা হতো না?
    এছাড়া মান্য বাংলা উচ্চারণে অ্যা অন্যতম স্বতন্ত্র স্বরধ্বনি হলেও এর নিজস্ব বর্ণরূপ নেই কোনও। এরও প্রয়োজন অনুভব করে নি আকাদেমি, আর ভাবনাও ভাবে নি একাডেমী। কিন্তু অ্যা’র বর্ণরূপ, অ্যা-কারের স্বতন্ত্র চিহ্ন যে কত প্রয়োজন তা প্রমাণ করা যাবে অনেক উদাহরণ দিয়ে। এখানে একটিই দিচ্ছি - ‘ব্যাখ্যা’। এর উচ্চারণ কি? “ব্যা+খ্যা” না “ব্যাক্+খা”? আরও দেখুন ‘্যা’র ব্যাপারস্যাপার - ‘খ্যাত’, কিন্তু ‘বিখ্যাত’ (-ক্খ্যা-); ‘ধ্যান’, কিন্তু ‘অধ্যাদেশ’, ‘অধ্যাপক’, ‘অধ্যায়’ (-দ্ধা-)।
    রেফ থাকলে ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব হবে না কোথাও - এ ব্যাপারে কিন্তু আবার ক্ষমাহীন একাডেমী ও আকাদেমি। এমনকি কৃত্তিকা থেকে উৎপন্ন ‘কার্ত্তিক’ হবে কার্তিক, বৃদ্ধ থেকে ‘বার্দ্ধক্য’-ও হবে বার্ধক্য! আরও এমনকি ‘আচার্য্য’ পর্যন্ত হবেন আচার্য! এতে তো আচার্য্যদের প্রায় কেঁদে ফেলার যোগাড়। তাঁদের একজন লিখেছেন:
    “চর - চয়ন বা চলন রয় যাতে।
    চার - চর থেকে জাত।
    আচার - চার-এর আশ্রয় বা আচরণসমূহের আশ্রয় যাতে।
    আচার্য - আচার ধরা থাকে যাতে (অর্থাৎ কাগজ, বই)।
    আচার্য্য - আচার্য ধরা থাকে যাতে (অর্থাৎ সেই বই, নির্দেশাদি যিনি মুখস্থ রাখেন)।
    একটি য-ফলা পূর্ব অর্থকে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত করে দেয়। এখানে য-ফলাহীন আচার্যের অর্থ বই বা কাগজ এবং য-ফলা যুক্ত আচার্য্যরে অর্থ শিক্ষক।”
    এখানে প্রশ্ন: কার্ত্তিক, বার্দ্ধক্য, আচার্য্য প্রভৃতির শুদ্ধতার প্রতি এমন জবরদস্তির প্রয়োজন আছে কি? একাডেমী ও আকাদেমি তো বহু বানানেরই তো বিকল্প মেনে নিয়েছেন, ‘প্রচলন মেনে লেখা’র কথা বলেছেন, ‘অভ্যাসের মধ্যে এসে গেছে’ বলেও স্বীকার করে নিয়েছেন।
    ওদিকে উদ্যোগ ও উদ্যোগ - দু’ রকম বানান ও উচ্চারণ চায় একাডেমী ও আকাদেমি। কেবল উচ্চারণের কারণেই কি এই বোঝা বাড়ানো? আর কোনও প্রয়োজন আছে কি? একই ভাবে হাজারো পবিত্র-অপবিত্র যুক্তি দিয়ে ‘কি’ ও ‘কী’ চান তাঁরা।  যেন বাংলায় অসংখ্য সমোচ্চারিত ভিন্নার্থক শব্দ নেই, অভিন্ন বানান কিন্তু ভিন্ন অর্থের অজস্র উদাহরণ নেই! অব্যয় হলে ‘কি’, আর সর্বনাম, বিশেষণ, বিশেষণের বিশেষণ ও ক্রিয়াবিশেষণ হলে ‘কী’। আর কোথাও কি এমন হয়? ক্রিয়া, বিশেষণ বা বিশেষ্য রূপেও ‘কাটা’ থাকে ‘কাটা’। ‘কাঠ’ বিশেষ্য রূপেও কাঠ, বিশেষণ রূপেও কাঠ। এ রকম উদাহরণ অনেক - যেখানে কোনও সমস্যা হয় নি কিছুমাত্র। একাডেমী ও আকাদেমি’র কারণে আমাদের লিখতে হবে ‘কী রূপ’, কিন্তু ‘কিরূপে’। অথচ সংস্কৃত ‘কিম্’ থেকে প্রাকৃত ‘কিং’ হয়ে ‘কি’ হওয়ার দীর্ঘ পথে ‘কী’ নেই কোথাও। ‘বেশি জোর দিতে’ দীর্ঘ উচ্চারণে ‘কি’র ‘কী’ হওয়ার ব্যাখ্যা আছে ‘চলন্তিকা’য়। কিন্তু বেশি, কম-বেশি বা বেশি-বেশি জোর দেয়া বোঝাতে নতুন-নতুন বানান যদি অভিধানে ঠেসে দেয়া হয় - তাহলে কি অবস্থা দাঁড়াবে শেষ পর্যন্ত? আবার আছে ‘কি না’ (সংশয়, প্রশ্ন) এবং ‘কিনা’ (যেহেতু)। অবশ্য ‘কী’র উৎপাত নেই এখানে। কিন্তু আছে ‘এমনকি’ আর ‘এমন কী’। এখানে বিবেচনার বিষয় উচ্চারণে বল বা শ্বাসাঘাত! কোমলমতি নবীন শিক্ষার্থীদের কথা ভাবুন।
    সকল অ-তৎসম শব্দে ‘ই’ ও ‘উ’ এবং এদের -কার চিহ্ন (ি ও  ু) হবে - কিন্তু ‘গাভী, পরী, রানী’ অব্যাহত রাখতে চায় একাডেমী। তবে ‘ও’ ও ‘ও-কার’ নিয়ে খুব সমস্যা উভয়েরই। ‘অভ্যাসের মধ্যে এসে’ গেলেও তাঁরা ছোট, বড়, বড়দিন, ভাল, ভালবাসা, এগার, তের, চোদ্দ, পনের, ষোল, সতের, আঠার লিখতে চান না। আবার ‘এখনও, কখনও, আরও, আজও, আবারও’ লেখা গেলেও ‘কোনও’ লেখা যাবে না! বোঝা কমাবার নামে বাড়াবার কাজটা না করলেই কি নয়? ‘অর্থ অনুধাবনে ভ্রান্তি বা বিলম্ব’ ঘটার প্রশ্নে তো ‘বলল বলত বলব হল হত পৌঁছল’ প্রভৃতির াে-কার যুক্ত হওয়াই ভাল!
    আকাদেমি ‘মৌলানা’ চায়, তবে একাডেমী ‘মওলানা’ও চায় - যদিও ‘মাওলানা’র প্রচলনই বেশি। একই ভাবে ‘মওসুম’, ‘মওসুমি’ চালু হয়ে গেলেও তাঁরা ৗে-কার নিয়ে আছেন এখনও। ‘রাঙা, রঙিন, রঙের’ চাইলেও তাঁরা ‘রঙ’ চান না, ‘রং’ চান! আকাদেমি ‘জো’ চাইলেও একাডেমী ‘যো’-ও চায়। ওদিকে তাঁরা না চাইলেও ‘যোগ’ সূত্রে ‘যোগাড় যোগান’ এসে গেছে ‘অভ্যাসের মধ্যে’।
    ‘আযান ওযু কাযা নামায মুয়ায্যিন যোহর রমযান’ প্রভৃতি বানানে ‘কেউ ইচ্ছা করলে য-এর পরিবর্তে জ ব্যবহার করতে পারেন’ - এ মত একাডেমী দিলেও আকাদেমি বলেছে, “বাংলায় য দিয়ে ত উচ্চারণ বোঝানোর রীতি মান্যতা পায়নি, তাই এই রীতি গ্রহণযোগ্য হয়নি।”
    “বিদেশী শব্দের বানানে যুক্তবর্ণকে বিশি¬ষ্ট করার প্রবণতা” সম্পর্কে  একাডেমী আশঙ্কা প্রকাশ করলেও সমর্থনও দিয়েছে কিছু। ‘অকটোবর ইসরাফিল মার্কস সেপটেম্বর’ প্রভৃতি বানান মেনেছে, কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামের ‘মাদরাসা’ মানতে চায় নি। বলেছে, ওটা ‘মাদ্রাসা’। ওর উচ্চারণ ‘মাদ্দ্রাসা’! আকাদেমি-ও মানতে রাজি নয় ‘উরদি উরদু ওসতাদ কারতুজ গরদান গিরজা জরদা জারমানি তুরকি পরদা মারকিন মারকেট সরদার’ প্রভৃতি বানান। তাঁরা চান রেফ।
    ‘না নি নে’র মধ্যে ‘নে’ নিয়ে মাথাব্যথা নেই একাডেমীর। এর ব্যবহার নেই বুড়িগঙ্গা-পাড়ে। আকাদেমি বলেছে ‘নি’ যুক্ত থাকবে ক্রিয়ারূপের সঙ্গে, ‘না’ পৃথক থাকবে। তবে অনুরোধে, আহলাদে যুক্ত হবে (‘যাওনা, বলোনা, দেখোনা’)। একাডেমী দু’টিকেই পৃথক রাখার পক্ষে। রবীন্দ্রনাথও তা-ই ছিলেন। মনে হয় ‘তো’ নিয়েও কিছু একটা করতে হবে তাঁদের।
    সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মে অনেক শব্দ ি থেকে ী, আবার -িকারে ফিরে যায়। যেমন - মন্ত্রিন্, গুণিন্, একাকিন্> মন্ত্রী, গুণী, একাকী > মন্ত্রিসভা, গুণিজন, একাকিত্ব প্রভৃতি। এই একই শব্দের দু’ রকম বানান থেকে বাঁচতে  ী-কারান্তগুলোকে বাংলা শব্দ ধরে নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে আকাদেমি। তারপরও দেখছি দু’ রকম বানান - মন্ত্রীগণ / মন্ত্রিগণ; মন্ত্রীপরিষদ / মন্ত্রিপরিষদ; মন্ত্রীবৃন্দ / মন্ত্রিবৃন্দ; মন্ত্রীসভা / মন্ত্রিসভা ইত্যাদি। তবে ‘মন্ত্রীত্ব’ নয়, ‘মন্ত্রিত্ব’। একাডেমী ‘মন্ত্রীদের’ ও ‘মন্ত্রীরা’ পর্যন্ত সহ্য করে, তারপর সব ।ি ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রতিযোগিতা, স্থায়িত্ব’ ইত্যাদি যে কবে বাংলা হবে, বাংলায় ‘প্রতিদ্বন্দ্বীতা প্রতিযোগীতা স্থায়ীত্ব’ হবে কে জানে!
কাজটা সহজ হবে না খুব। হবে না নানা কারণেই। আগে যে ‘আচার্য্য’র উল্লেখ করেছি সেই ‘আচার্য্য’ অমরেন্দ্র গণাই লিখেছেন - “বাঙলা ভাষা বর্ণার্থমূলক বহু অর্থধারী সংস্কৃত’র উত্তরাধিকারী। বিদ্যার নামে কিছু লাঠিয়াল একে ভাঙতে চাইছে। এর চেয়ে বড় অন্তর্ঘাত আর কি হতে পারে? বাঙলা ভাষা সরকারের তৈরি করা তথাকথিত কয়েকজন ভণ্ড’র মাতৃভাষা নয় - ২৫ কোটি মানুষের মাতৃভাষা। ওপার বাঙলা জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে মাতৃভাষার প্রতিষ্ঠা করে গেছে! ২৫ কোটি বাঙলাভাষীর আত্মসম্মান ও নাড়ির যোগকে যারা ধুলোয় মিশিয়ে দিতে চাইছে, ইতিহাস কখনও তাদের ক্ষমা করবে না।”
আচার্য্য গণাই-এর ‘উত্তরাধিকার’-তত্ত্বটি যা-ই হোক ‘লাঠিয়াল’দের ব্যাপারটা বুঝতে পারি বেশ। আকাদেমি অবশ্য বলেছে, “... এগুলিকে পুরোপুরি পছন্দ করবেন না, এমন দু-চারজন জেদি ও প্রত্যয়বান মানুষ থাকতেই পারেন। কিন্তু এঁরা সমস্যা নন।” এ ধারণাটি সমন্বয়বিরোধী। সমাজে বড় শক্তি হিসেবে ‘লাঠিয়াল’ নয়, ওই ‘জেদি ও প্রত্যয়বান’ মানুষই দেখা দেন শেষ পর্যন্ত।
সমালোচক-গবেষক পাঁচুগোপাল বক্সি লিখেছেন, “অনুভূতির তীব্রতা, রসসৃষ্টির সামর্থ্য তথা কবিত্বগুণের অভাব উদ্ভট চিত্রকল্প, অলঙ্কারবাহুল্য বা বাকচাতুরির আড়ম্বরে ঢাকা যায় না। মুখ আর মুখোশের পার্থক্যটা মনে পড়িয়ে দিয়ে কবি (রবীন্দ্রনাথ) মহাপ্রয়াণের প্রায় সাড়ে সাত মাস আগে... আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন: ‘মানুষের কবিত্বই হবে শেষে কলঙ্কভাজন অসংস্কৃত যদৃচ্ছের পথে চলি’।” (‘অরাবীন্দ্রিক রবীন্দ্রনাথ’, কলকাতা, ২০০৭)



রাশিচক্রে আপনার ছেলেমেয়ের দেখভাল

বাচ্চাদের মন মেজাজ মরজি ভাব ভঙ্গি বোঝা দায়  কখন কোথায় কেন যে কি করে বসে ওরা! ওদের সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খান অনেক মা-বাবা। আর এই সামলানোর ঝক্কিটা মায়ের ওপর দিয়েই যায় বেশি  তাই ওঁরা শিশুর যত্ন পরিচর্যা লালন পালন ইত্যাদি নানা বিষয়ে বুদ্ধি-পরামর্শ নেন মুরুব্বিদের, অনেকে এ সব বিষয়ের নানা বই ঘেঁটে হন হদ্দ। আমরা বলছি, সময় পেলে রাশিচক্রটাও দেখে নিন একটু। দেখুন এ শাস্ত্র কি পরামর্শ দিচ্ছে ছেলেমেয়েদের দেখভালের ব্যাপারে।
মেষ
২১শে মার্চ থেকে ২০শে এপ্রিলের মধ্যে যাঁদের জন্ম ওঁরা মেষ রাশির জাতক-জাতিকা। এ রাশির শিশুরা দুরন্ত, দুর্ধর্ষ, অস্থির, চঞ্চল প্রকৃতির। ডাকাবুকো স্বভাবের কারণে ঝগড়া বাঁধিয়ে মারপিটও করতে পারে যখন তখন। তবে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাক্যুদ্ধই ঘটবে, কিল ঘুষি চড়-থাপ্পড় লাথি পর্যন্ত গড়াবে না হয়তো। মেষ রাশির শিশুরা স্বাধীনচেতা, মৌলিক চিন্তা-ভাবনার অধিকারী, ক্রীড়া-অনুরাগী হয়ে থাকে। স্কুলের যাবতীয় কার্যক্রমে ওদের দেখা যাবে সক্রিয় ভূমিকায়। এ কারণে ওরা ভোগ করবে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা। ফলে নিঃসঙ্গতায় ভোগার অবকাশই পাবে না।
    মেষ শিশুদের অস্থিরচিত্ততা দেখা দেয় গুরুতর সমস্যা হিসেবে। এই ছটফট স্বভাবকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, যদি মা-বাবা ধৈর্যের সঙ্গে দেখভাল করেন। ওদের বলতে হবে, লাফাবার আগে তাকিয়ে দেখো। যে কোনও কাজই করতে হবে ভেবেচিন্তে। আগে ভাবি, পরে করি। আরও বলতে হবে, অতীত থেকে শিক্ষা নাও। আগে যে ভুলগুলো হয়েছে তা যেন আর না হয়। সে সব ভুলের ব্যাপারে সতর্ক থাকো। কিছু না বললে বা না বোঝালে ওরা এ সব  থেকে আর শিক্ষা নেবে না কিছু।
    মেষ শিশুরা সবল স্বাস্থ্যের অধিকারী হয়, ওদের সমস্যা কেবল মাথা নিয়ে। দুর্ঘটনা ঘটলে আঘাত লাগে ওখানেই। এজন্য সবসময় চলতে হবে মাথাটিকে রক্ষা করে।
    মেষ শিশুর মা যদি হন মেষ বা মীন আর বাবা হন সিংহ বা ধনু রাশির তাহলে মিলমিশ হবে চমৎকার। তবে মা যদি হন মকর বা কর্কট আর বাবা যদি হন তুলা বা বৃশ্চিক রাশির তাহলে চেঁচামেচি লেগেই থাকতে পারে দিন-রাত।
বৃষ
যাঁদের জন্ম ২১শে এপ্রিল থেকে ২০শে মে’র মধ্যে ওঁরা বৃষ রাশির জাতক-জাতিকা। এ রাশির শিশুরা সাধারণত একমুখী স্বভাবের হয়ে থাকে। তেমন মিশুক হয় না ওরা। একা-একা থাকতেই ভালবাসে বেশি। গান গাওয়া, ছবি আঁকা বা অন্য কোনও সৃষ্টিশীলতায় উৎসাহী হতে পারে। খেলাধুলার মধ্যে আগ্রহী হতে পারে একমাত্র বল জাতীয় খেলায়। অনেক সময় অলসতা পেয়ে বসে ওদের। পরে এ দোষ পরিণত হতে পারে স্বভাবে। মা-বাবাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, কাজ দিয়ে, চেষ্টা চালাতে হবে  যাতে যতখানি সম্ভব কমিয়ে আনা যায় ওই অলসতা। অন্য কোনও দিকে আগ্রহী করে তুলতে পারলে নিজে থেকেই সক্রিয় হয়ে উঠবে ওরা। তবে বেশ ধৈর্য ধরতে হবে এ জন্য। খুব চাপ দিয়ে-দিয়ে কিছু করা ঠিক হবে না। কারণ ওদের মধ্যে গোঁ আছে খুব। একবার জেদ ধরে বসলে আর মানতে চাইবে না সহজে। ধমকে শাসিয়ে বাগে আনতে চাইলে বিগড়ে যেতে পারে একেবারে।
    মুটিয়ে যাওয়ার বিপদ আছে বৃষ শিশুদের। এ ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে আগে থেকেই। বেশি আহলাদ দেয়া যাবে না ওদের। পরে বায়না রোগ থেকে বাঁচানো যাবে না আর। বৃষ শিশুরা সাধারণত গলার অসুখবিসুখে ভোগে। তাই  খেয়াল রাখতে হবে এদিকটায়।
    বৃষ শিশুর মা যদি হন কর্কট বা বৃষ আর বাবা যদি হন মকর বা কন্যা রাশির তাহলে তো সোনায় সোহাগা। তবে মা যদি হন কুম্ভ বা ধনু আর বাবা যদি হন মেষ বা সিংহ রাশির তাহলে হুঁশ করেই চলতে হবে।
মিথুন
২১শে মে থেকে ২০শে জুনের মধ্যে যাঁদের জন্ম ওঁরা মিথুন রাশির জাতক-জাতিকা। এ রাশির শিশুদের সম্পর্কে বলা হয়  সবই সম্ভব, কিন্তু শান্ত শিষ্ট মিথুন শিশু সম্ভব নয়। ওরা ভাবে দ্রুত, বলেও দ্রুত। কৌতূহলের কোনও সীমা নেই ওদের। দিনে-রাতে হাজারটা প্রশ্ন শুনতে-শুনতে পাগল হওয়ার যোগাড় হবে মা-বাবার। শেষে যখন দেখা যাবে প্রশ্ন করাই সার, উত্তর শোনার জন্য একটু বসতেও পারছে না  তখন তা পৌঁছে যাবে বিরক্তির চরম সীমায়। কোনও কিছুতে মনোযোগ নেই, তাই শুরু করতে না করতে শেষ হয়ে যায় ওদের অনেক কাজ। সবচেয়ে ভাল ওদের একা থাকতে দেয়া। যখন যা করতে চায় তাতেই সায় দেয়া। কারণ ওরা সবসময়ই নানা কিছু নিয়ে মেতে থাকবে, শিখবে, জানবে, পরীক্ষা করে দেখবে। কোনও কিছু করতে বললে ওরা জিজ্ঞেস করবে, ‘কেন?’ যদি বলা হয়, ‘আমি বলেছি তাই’  তাহলেও শুনবে না ওরা। মা-বাবার জ্ঞানগম্যি ও সততা ওরা পরীক্ষা করে দেখে সব সময়।
    মিথুন শিশুরা সব সময় মেতে থাকতে চায় কোনও না কোনও কিছুতে। এর প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় শরীরে, স্বাস্থ্যে। এজন্য যতই চেঁচামেচি করুক বা অজুহাত দেখাক যথেষ্ট ঘুম ও বিশ্রাম নিশ্চিত করতে হবে ওদের জন্য।
    মিথুন শিশুর মা যদি হন তুলা বা মিথুন আর বাবা যদি হন কুম্ভ বা সিংহ রাশির তাহলে ভাবনার কিছু নেই। তবে মা যদি হন বৃশ্চিক বা মীন আর বাবা যদি হন কন্যা বা ধনু রাশির তবে বুঝেশুনে কাজ করাই ভাল।
কর্কট
যাঁদের জন্ম ২১শে জুন থেকে ২২শে জুলাইয়ের মধ্যে ওঁরা কর্কট রাশির জাতক-জাতিকা। এ রাশির শিশুরা অত্যন্ত স্পর্শকাতর, ভদ্র শান্ত ও কল্পনাপ্রবণ। এজন্য নিঃসঙ্গ থাকে। মোটাসোটা গড়ন এবং আস্তে ধীরে চলে ও কাজ করে বলে ওরা ঠাট্টা-বিদ্রƒপের শিকার হয় পাড়ায় ও স্কুলে। মা-বাবাকে তাই স্নেহ-আদরে ভরিয়ে রাখতে হবে ওদের। কর্কট শিশুরা যথেষ্ট মায়া-মমতাময়, তবে ওদের অভিমানও বেশি। এজন্য আত্মঘাতী কাজ করে বসে কখনও। এজন্য মা-বাবাকে কৌশলী হতে হবে, নানাভাবে বোঝাতে হবে অভিমান ও আত্মঘাত খুবই হাস্যকর ব্যাপার।
    বুক ও শ্বাসনালীর অসুখে ভোগার আশঙ্কা আছে কর্কট শিশুদের। দেখুন ঠাণ্ডা যাতে না লাগে। পরে বড় সমস্যা হতে পারে।
    কর্কট শিশুর মা যদি হন মীন বা কর্কট আর বাবা যদি হন বৃশ্চিক বা বৃষ রাশির তবে মানানসই হবে খুব। এর উলটো হবে যদি মা হন সিংহ বা তুলা আর বাবা হন মেষ বা ধনু রাশির।
সিংহ
২৩শে জুলাই থেকে ২২শে অগস্টের মধ্যে যাঁদের জন্ম ওঁরা সিংহ রাশির জাতক-জাতিকা। এই রাশির শিশুদের সহজেই দলের মধ্যে চেনা যায় আলাদা করে। দলে ও থাকে নেতা, কর্মী নয়। নেতৃত্ব হারালে ও গড়ে নেয় আলাদা দল। স্বভাবে ও অহঙ্কারী, বেপরোয়া। এমনিতে মনে হয় না কোনও আদর-সোহাগের ধার ধারে, কিন্তু বাইরের ওই দুর্ধর্ষ ভাবের আড়ালে রয়েছে স্নেহময় প্রীতিপূর্ণ কোমল মন। ওই মন মা-বাবার আদর-সোহাগের কাঙাল।
    বড় হয়ে টাকা-পয়সা বড্ড ফেলাছড়া করে সিংহ রাশির জাতক-জাতিকারা। আরাম আয়েশ বিলাস ব্যসনে মত্ত থাকে। তাই ছোটবেলাতেই ওদের মগজে ঢুকিয়ে দিতে হবে আর্থিক বিষয়বুদ্ধি। বোঝাতে হবে  জীবনে ভাল কিছু পেতে হলে টাকা লাগে। আর টাকা পাওয়া যায় কাজ করে, উদ্যোগ নিয়ে।
    সিংহ শিশুদের শরীর স্বাস্থ্য যেমন থাকতে পারে সুস্থ সবল তেমন সারা বছর অসুখবিসুখও লেগে থাকতে পারে। মাঝেমধ্যে গোলমাল বাঁধিয়ে বসতে পারে পাকস্থলী। কাজেই নজর রাখতে হবে ওটার দিকে।
    সিংহ শিশুর মা যদি হন সিংহ বা মীন আর বাবা যদি হন ধনু বা মেষ তাহলে মানিয়ে যাবে বেশ। তবে মা যদি হন মকর বা কন্যা আর বাবা যদি হন বৃশ্চিক বা কর্কট রাশির তাহলে বিড়ম্বনা ঘটতে পারে পদে-পদে।
কন্যা
যাঁদের জন্ম ২৩শে অগস্ট থেকে ২২শে সেপটেম্বরের মধ্যে ওঁরা কন্যা রাশির জাতক-জাতিকা। এই রাশির শিশুরা সব কিছু সাজানো গোছানো দেখতে ভালবাসে। ওদের এই সুশৃঙ্খল স্বভাব মা-বাবাকে খুশি করে, তবে কিছু পরেই বেরিয়ে আসে ওদের খুঁতখুঁতে স্বভাব। সেই খুঁত ধরার ঝোঁক থেকে রেহাই পান না মা-বাবাও। কন্যা শিশুরা জন্ম থেকেই যেন আসে বুদ্ধি-বিবেচনা নিয়ে, আর্থিক ব্যাপারেও দেখা যায় ওদের বিশেষ বিবেচনা। জীবনকে উপভোগ করা, ভালবাসা  এ সব ওরা অত বোঝে না। তাই মা-বাবাকে এ গুণগুলি শেখাতে বোঝাতে হবে ওদের।
    কন্যা শিশু খুব খেটেখুটে সব কাজ করতে চায়। এই অতিরিক্ত খাটুনির চাপ পড়ে ওদের শরীর স্বাস্থ্যে। এজন্য ওদের মধ্যে অবসর অবকাশ ভোগ করার, হাসিখুশিতে মেতে ওঠার মন গড়ে দিতে হবে।
    কন্যা শিশুর মা যদি হন কন্যা বা তুলা আর বাবা যদি হন বৃষ বা মকর রাশির তাহলে মিলমিশটা হবে ভাল। তবে মা যদি হন মিথুন বা কুম্ভ আর বাবা যদি হন বৃশ্চিক বা সিংহ রাশির তাহলে খিটিমিটি লেগেই থাকবে।
তুলা
২৩শে সেপটেম্বর থেকে ২২শে অকটোবরের মধ্যে যাঁদের জন্ম ওঁরা তুলা রাশির জাতক-জাতিকা। এ রাশির শিশুরা থাকে হাসিখুশি প্রাণচঞ্চল। আকর্ষণীয় স্বভাবের জন্য ওদের বন্ধুবান্ধব থাকে অনেক। গান গাওয়া, ছবি আঁকা বা অন্য কোনও সৃষ্টিশীল কাজে জড়িত হয় ওরা। অল্প বয়সেই আকৃষ্ট হয় বিপরীত লিঙ্গের প্রতি। মজা করতে এক বন্ধুর সঙ্গে আরেক বন্ধুর ঝগড়া লাগিয়ে দেয় প্রায়ই। মা-বাবাও হন ওদের এই ‘মজার খেলা’র শিকার। তুলা শিশুদের তাই বিশেষ যতœ নিয়ে শেখাতে হবে আনুগত্য ও অকপটতা বিষয়ক কিছু নীতি ও রীতি।
    তুলা শিশুরা সুস্থ সবলই থাকে, পরবর্তী জীবনে ভুগতে দেখা দেয় কিডনি সংক্রান্ত জটিলতায়।
    ওদের মা যদি হন মিথুন বা তুলা আর বাবা যদি হন কুম্ভ বা সিংহ রাশির তাহলে কোনও সমস্যা হবে না লালন পালনে। কিন্তু মা কর্কট বা মকর আর বাবা মেষ বা মীন রাশির হলে মুশকিল হতেই পারে।
বৃশ্চিক
যাঁদের জন্ম ২৩শে অকটোবর থেকে ২১শে নভেম্বরের মধ্যে ওঁরা বৃশ্চিক রাশির জাতক-জাতিকা। এ রাশির শিশুরা অত সামাজিক হয় না, নিজেদের মধ্যেই গুটিয়ে থাকে অনেকখানি। বাইরের জীবনের অনেক কিছুই গ্রহণ বা অবলম্বন করতে পারে না ওরা। চারপাশের নানা কিছু দেখে হতাশায় ভোগে, সন্দেহপ্রবণও হয়ে পড়ে। কোনও সঙ্ঘ-সমিতির কাজে জড়িয়ে দিতে পারলে এ অবস্থার উন্নতি হবে কিছুটা। ওদের প্রতি দিতে হবে প্রচুর মনোযোগ, আদরও ঢেলে দিতে হবে প্রচুর। বাইরে কঠিন দেখালেও বৃশ্চিক শিশুরা ভেতরে-ভেতরে যথেষ্ট মায়ামমতাময়। ঈর্ষাতেও কাতর হয় ওরা। নিজেকে অবহেলিত ভাবলে ফুঁসে ওঠে মুহূর্তে। তবে ওদের বেশির ভাগ ফোঁসফোঁসানি মা-বাবার আদর কাড়ার জন্যই।
    বৃশ্চিক শিশুরা অসুখ-বিসুখে ভোগে না তেমন, তবে শরীর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে মনোযোগী নয় ওরা। এজন্য নজর দিতে হবে এদিকে।
    বৃশ্চিক শিশুদের মা যদি হন বৃশ্চিক বা কন্যা আর বাবা যদি হন মীন বা কর্কট রাশির তাহলে ভাবনার কিছু নেই। কিন্তু মা যদি হন মকর বা ধনু আর বাবা যদি হন সিংহ বা মেষ তাহলে খবর আছে।
ধনু
২২শে নভেম্বর থেকে ২১শে ডিসেম্বরের মধ্যে যাঁদের জন্ম ওঁরা ধনু রাশির জাতক-জাতিকা। এ রাশির শিশুরা খেলাধুলা খুব ভালবাসে, তাই সঙ্গীসাথির কোনও অভাব হয় না ওদের। ওরা ভাবে, পৃথিবীটা আমোদ-স্ফূর্তির জন্য। এজন্য লেখাপড়ায় মনোযোগী করাতে চাইলে একটু কঠোর হতে হবে মা-বাবাকে। স্বাধীনতা ভাল, কিন্তু স্বেচ্ছাচার ভাল নয়  এটা ভাল করে বোঝাতে হবে ওদের। সেই সঙ্গে সচেতন করতে হবে নিয়মকানুন বিধিবিধান সম্পর্কে।
    বাধা পেলে বিদ্রোহ করে বসে ধনু শিশু, এজন্য ওদের শৃঙ্খলার মধ্যে আনা হয়ে পড়ে বেশ কঠিন। তবে সোহাগে শাসনে সম্ভব হতে পারে আপাত অসম্ভবও।
    ধনু শিশুরা নিজেরই কারণে কোথাও চোট পেয়ে ভুগতে পারে, এমনিতে অসুখে বিসুখে ভোগার আশঙ্কা কম।
    ধনু শিশুদের মা যদি হন ধনু বা তুলা আর বাবা যদি হন মেষ বা সিংহ রাশির তাহলে মিলমিশটা হবে ভাল। কিন্তু মা যদি হন বৃশ্চিক বা মিথুন আর বাবা যদি হন কর্কট বা মীন রাশির তাহলে খিটিমিটি লেগেই থাকবে হয়তো।
মকর
যাঁদের জন্ম ২২শে ডিসেম্বর থেকে ১৯শে জানুয়ারির মধ্যে ওঁরা মকর রাশির জাতক-জাতিকা। এ রাশির শিশুরা লেখাপড়ায় মনোযোগী থাকে বেশ। ভবিষ্যতে বড় কিছু হওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগোয় ওরা। তবে এই এগোনোর গতি দ্রুত নয়, ধীর। এজন্য ওদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা ঠিক হবে না। ওদের সাফল্য আসবে বিলম্বেই। মকর শিশুদের জন্য বড় বিপদ হয়ে আসে মন-মরা ভাব। এ ব্যাপারে ঠিকমতো ওদের বোঝানো-সোঝানো না গেলে এটা হয়ে উঠতে পারে স্থায়ী এক সমস্যা। জোর দিতে হবে ওদের বুদ্ধি-বিবেচনার ওপর। এই বিবেচনার মাধ্যমেই কাটতে পারে ওদের নৈরাশ্য ভাব।
    মন-মরা ভাব আর স্নায়বিক চাপের সূত্রে পাকস্থলীর জটিলতায় ভুগতে পারে মকর শিশুরা। এমনিতে শরীর স্বাস্থ্য ওদের ভালই থাকবে।
    মকর শিশুর মা মকর বা কর্কট আর বাবা বৃষ বা কন্যা রাশির হলে খুব ভাল। তবে মা মেষ বা কুম্ভ আর বাবা ধনু বা সিংহ রাশির হলে বুঝেসুঝে চলাই ভাল।
কুম্ভ
২০শে জানুয়ারি থেকে ১৯শে ফেব্র“য়ারির মধ্যে যাঁদের জন্ম ওঁরা কুম্ভ রাশির জাতক-জাতিকা। এই রাশির শিশুরা সব কিছু চায় ঠিকঠাক জানতে। ওরা ভালবাসে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর সত্যের অন্বেষণ। মিছে কথা বললে মা-বাবাও শ্রদ্ধা হারাবে ওদের। নির্লিপ্ত ও মায়ামমতাহীন ভাবের কারণে ওরা ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়, আসলে ওদের স্নেহ-ভালবাসার ভঙ্গি অমনই উচ্ছ্বাসহীন। তবে মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব উষ্ণতা দেখালে সহজ হয়ে পড়বে ওরা। তবে ওই উষ্ণতা যেন দেখানো না হয় বেশি মাত্রায়।
    কুম্ভ শিশুদের আছে রক্তদুষ্টির আশঙ্কা, এমনিতে সুস্থ সবল থাকে ওরা।
    ওদের মা যদি হন কুম্ভ বা মীন আর বাবা যদি হন কন্যা বা মিথুন রাশির তাহলে চিন্তার কিছু থাকে না। কিন্তু মা যদি হন মকর বা কর্কট আর বাবা যদি হন কন্যা বা বৃষ রাশির তাহলে নানা রকম বিপত্তির আশঙ্কা থাকতেই পারে।
মীন
যাঁদের জন্ম ২০শে ফেব্র“য়ারি থেকে ২০শে মার্চের মধ্যে ওঁরা মীন রাশির জাতক-জাতিকা। এই রাশির শিশুরা হয়ে থাকে মধুর স্বভাবের, সবাই ভালবাসে ওদের। এজন্য আবার আদরে আহলাদে  বখেও যেতে পারে ওরা। তারপর ওদের আছে নিজেদের মতো করে চলার বুদ্ধি আর গোপনীয়তা বজায় রাখার প্রবণতা। এ ক্ষেত্রে মা-বাবার প্রায় কিছুই করার থাকে না  সন্তানের জন্য আক্কেল সেলামি দেয়া ছাড়া। মীন শিশুকে শৃঙ্খলায় আনতে কিছু কঠোরই হতে হবে মা-বাবাকে। কারণ ও যদি সব সময় নিজের মতো করে চলতে চায় তাহলে শৈশবে যা-ই হোক সাবালক জীবনে দুর্ভাগ্য ডেকে আনতে পারে তা। এ জন্য ওর মধ্যে এ প্রবণতাকে বেশি বাড়তে দেয়া ঠিক হবে না। ওদের নিয়ে আরেক সমস্যা  খাবার প্রায় মুখেই তুলতে চায় না ওরা। এদিকটায়ও নজর রাখতে হবে মা-বাবার।
    মীন শিশু অল্পতেই কাবু হয়ে পড়ে শরীর স্বাস্থ্যে, তবে এটা সম্ভব হবে কাটিয়ে ওঠা। পা নিয়ে সমস্যা থাকে ওদের। খেয়াল রাখতে হবে ওদিকে।
    মীন শিশুদের জন্য মা ভাল কর্কট বা বৃষ আর বাবা ভাল বৃশ্চিক বা মীন রাশির। কিন্তু মা সিংহ বা মকর আর বাবা কন্যা বা ধনু রাশির হলে সমস্যা হতেই পারে।