রবিবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১১

পলিটিশিয়ালের পলিট্রিক্স

নিজেকে প্রায়ই প্রশ্ন করি, বাংলা ও বাঙালি নিয়ে এত কথা বলি, গর্ব ও গৌরব করি, কিন্তু কোথায় কি আছে বাঙালিত্ব আমাদের? বাংলা ও বাঙালির কোন বৈশিষ্ট্য ধারণ করে আছি আমরা? চেহারা গঠন চলন দেখে তো বিভ্রান্তই হয়ে পড়েন বিদেশীরা। ১৯৭৮-৮০ সালে চীনে ছিলাম, তখন সপরিবারে কোথাও বেড়াতে গিয়ে প্রশ্ন শুনেছি, ভারতীয় নাকি নেপালি? ইনতুকুয়ো রেন? নিয়েপর রেন?  আমাদের রাস্তায় দেখলে অনেক চীনা তরুণ গেয়ে উঠতো ‘মায় আবালা হু’  রাজকাপুর-নারগিস অভিনীত ‘আওয়ারা’ (১৯৫১) ছবির গান ‘ম্যয় আওয়ারা হুঁ’। ছবিটি ওই সময়ে মুক্তি পেয়েছিল চীনের বিভিন্ন শহরের প্রেক্ষাগৃহে, বিপুল দর্শকপ্রিয় হওয়ায় টিভিতেও দেখানো হতো মাঝেমধ্যে। এ ছবির প্রভাবে তরুণদের মধ্যে সাইকেল চুরির প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল বলে জোর অভিযোগ উঠেছিল তখন। অর্থাৎ আমাদের ভারতীয় ভাবতো ওরা। ভুল করার বিপদ থেকে বাঁচতে অনেকে বলতেন, দক্ষিণ এশীয়। আর ভারতীয়রা কি ভাবেন? ১৯৯২ সালের অকটোবরে প্রথম সার্ক সাংস্কৃতিক উৎসবে যোগ দিতে গিয়েছিলাম ভারতের বিভিন্ন শহরে। বেঙ্গালুরু’র অশোক হোটেলে ছিলাম আমরা সাত দেশের কবি-সাহিত্যিক। ২০শে অকটোবর সন্ধ্যায় হোটেলের রেস্তরাঁয় আড্ডা দিচ্ছিলাম কয়েকজন  সাঈদ আহমদ, আসাদ চৌধুরী, মালদাইভস-এর হাবিবা হুসাইন হাবিব ও আবদুল্লা সোদিগ, নেপালের ঈশ্বর বড়াল ও বৈরাগি কাইনলা। পাশের টেবিলে ছিল একটি স্থানীয় পরিবার। তাঁরা কৌতূহলী হয়ে দেখছিলেন আমাদের। এক সময় এক-দু’ কথায় আলাপ জমে যায় তাঁদের সঙ্গেও। জানতে পারি তাঁরা কোনও এক সূত্রে বেঙ্গালুরু’র কীর্তিধন্য সন্তান বসন্ত কুমার শিবশঙ্কর পাড়ুকোন ওরফে গুরু দত্ত (১৯২৫-১৯৬৪)-এর আত্মীয়। এর পর, পরিচালক হিসেবে সত্যজিৎ রায় ও গুরু দত্ত কে কেমন, তা নিয়ে এক গুরুতর আলোচনা শুরু হয়ে যায় আমাদের মধ্যে। এক পর্যায়ে যখন বলি, গুরু দত্তের স্ত্রী গীতা দত্ত (১৯৩০-১৯৭২) যে দেশে জন্মেছেন আমরা তিন জন (নাট্যকার সাঈদ আহমদ, কবি আসাদ চৌধুরী ও আমি) সেই দেশের  তখন খুব বিস্ময় প্রকাশ করেন তাঁরা। বলেন, আমরা ভেবেছিলাম আপনারা আমাদেরই দেশের  উত্তর-পূর্ব ভারতের নাগা, মিজো, মণিপুরি।
    এ তো গেল বাইরের চেহারার ব্যাপার। আমাদের জীবন যাপন? সংস্কৃতি? বাংলার বাংলাভাষী হিসেবে নিজেদের আমরা বাঙালি বললেও অন্য ধর্মাবলম্বীরা আমাদের জানে মুসলমান হিসেবে। ১৯১৭ সালে প্রকাশিত ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের প্রথম পর্বের শুরুতেই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮) লিখেছেন, “ইস্কুলের মাঠে বাঙ্গালী ও মুসলমান ছাত্রদের ‘ফুটবল ম্যাচ’।...” অর্থাৎ অন্য ধর্মাবলম্বীরা বাঙালি হলেও মুসলমানেরা নয়। এজন্য অবশ্য দায়ী আমরাও। বাঙালির চেয়ে মুসলমান পরিচয় এককালে বড় ছিল আমাদের কাছে। বাইরে বাংলা বললেও সম্পন্ন মুসলমানদের বাড়িতে উরদু ভাষার চল আছে এখনও। সেকালে এ চল ছিল বেশি। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি বেগম রোকেয়ার কথা। পারিবারিক ভাবে তাঁরা উরদুভাষী ছিলেন, তাহলেও বাংলা ভাষা ও বাঙালিত্বের প্রতি দৃঢ় অবস্থান ছিল তাঁর। আমাদের স্বাভাবিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে লিখেছেন, “আমরা দুর্বল নিরীহ বাঙ্গালী। এই বাঙ্গালী শব্দে কেমন সুমধুর তরল কোমল ভাব প্রকাশ পায়। আহা! এই অমিয়াসিক্ত বাঙ্গালী কোন বিধাতা গড়িয়াছিলেন? কুসুমের সৌকুমার্য, চন্দ্রের চন্দ্রিমা, মধুর মাধুরী, যূথিকার সৌরভ, সুপ্তির নীরবতা, ভূধরের অচলতা, নবনীর কোমলতা, সলিলের তরলতা  এক কথায় বিশ্বজগতের সমুদয় সৌন্দর্য এবং স্নিগ্ধতা লইয়া বাঙ্গালী গঠিত হইয়াছে, আমাদের নামটি যেমন শ্র“তিমধুর তদ্রƒপ আমাদের সমুদয় ক্রিয়াকলাপও সহজ ও সুন্দর।... ভারতের পুরুষ সমাজে বাঙ্গালী পুরুষিকা।” (‘নিরীহ বাঙ্গালী’, মতিচূর, ১৯০৪)
    একালে শহীদ কাদরী’র পরিবারে শুনেছি চোস্ত উরদু। শামসুর রাহমানের পরিবারে শুনেছি এক ধরনের মিশ্র উরদু  যা পরিচিত ঢাকাইয়া উরদু নামে। পুরান ঢাকায় এ ভাষার চল আছে বহু পরিবারে।
    বাঙালি মুসলমানের ভাষা-বিতর্ক ছিল সেকালেও।
১৫৮৬ সালে রচিত “নবীবংশ” কাব্যে সৈয়দ সুলতান (১৫৫০-১৬৪৮) উল্লেখ করেছেন, বাংলা ভাষায় ধর্মীয় ‘পাঁচালী’ লিখে বিপুল নিন্দার শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। কারণ ‘কিতাবের কথা দিলুঁ হিন্দুয়ানি করি।’ তিনি অবশ্য নিজের বাঙালি পরিচয়ের পক্ষে জোরালো যুক্তি দিয়েছেন  “যারে যেই ভাষে প্রভু করিছে সৃজন। সেই ভাষ হয় তার অমূল্য রতন ॥”
বাংলা ভাষা মুসলমানের ভাষা নয়  এমন ধারণার শিকার হয়েই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন ‘নূরনামা’র কবি আবদুল হাকিম (১৬২০-১৬৯০)  “যে সব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী। সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি ॥” সমকালীন মনোভাব, সেই সঙ্গে বাঙালি পরিচয়ের পক্ষে নিজের দৃঢ় অবস্থান প্রকাশ করেছেন তিনি  “সর্ববাক্য বুঝে প্রভু কিবা হিন্দুয়ানী। বঙ্গদেশী বাক্য কিবা যত ইতি বাণী ॥ মারফত ভেদে যার নাহিক গমন। হিন্দুর অক্ষর হিংসে সে সবের গণ ॥... মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি। দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি ॥”
মুসলমানরাও যে বাঙালি তা প্রমাণ করতে, এ জাতির অভ্যুদয় ঘটাতে রক্ত দিতে হয়েছে আমাদের, প্রয়োজন পড়েছে একটি বায়ান্ন ও একটি একাত্তরের, মুখের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হয়েছে, প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের। তবে পশ্চিমবঙ্গের এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী বাঙালির মানসিক স্বীকৃতি পেতে দেরি হবে আরও। প্রকাশ্যে তাঁরা সবাই আমাদের ‘বাঙালি’ বললেও নিজেদের মধ্যে তা চালু করতে পারেন নি এখনও। কতকাংশে ‘বাঙাল’ হতে পেরেছি মাত্র।
অর্থাৎ পরিচয়গত ঘরোয়া সমস্যা রয়ে গেছে আমাদের। আর বাইরের সমস্যা তো আরও বেশি। সেটা বলতে গেলে আমাদের নিজেদেরই সৃষ্টি। যেমন, অবাঙালিদের প্রতি অবজ্ঞার ভাব  যা প্রকাশ পায় ‘মাওড়া’, ‘ছাতুখোর’, ‘খোট্টা’, ‘উড়ে’ প্রভৃতি শব্দে। পাঠান, শিখ ও অন্যান্য জাতের লোকজন নিয়ে বিচ্ছিরি-বিচ্ছিরি চুটকি (জোক) বলি আমরা, জানি না হয়তো বাঙালি বাবু-বিবিদের নিয়ে তাদেরও আছে চূড়ান্ত রকম বিচ্ছিরি জোক। পেইচিং থাকতে কাঠমণ্ডু’র গোবিন্দ ভাট, দিল্লি’র ত্রিনেত্র যোশী, ইসলামাবাদের সুলতান গাজি ও আরও অনেকের কাছে শুনেছি সে সবের কয়েকটি। একেবারেই সহ্য করার মতো নয়। ও সব চুটকি শুনলে মনে হবে বাঙালির মতো নীচ আর হীন বুঝি আর কেউ নয়। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যে সব চুটকি আছে তাদের সেগুলোকে মর্মান্তিকই মনে হয়েছে আমার।
আসলে বাঙালি হতে চাওয়া মুসলমানদের সমস্যা অনেক। আজিজুল আজিজ লিখেছেন, “বাঙালি মুসলমানদের সামাজিক অবস্থা বড় করুণ। কেউ তাদের দলে নিতে চায় না। বাঙালি হিন্দুদের কাছে তারা শুধু মুসলমান, বাঙালি নয়। আবার বিহারি মুসলমানদের কাছে তারা মুসলমান নয়, বাঙালি। দু’টি সত্তা নিয়ে কোথাও কলকে পাচ্ছে না বাঙালি মুসলমান। আমাদের ভাষা যেহেতু বাংলা, বিহারি মুসলমানদের কাছে বাঙালি মুসলমান নাকি হিন্দুরই সামিল।... বিহারি মুসলমানদের কাছে অচ্ছুত হয়ে বাঙালিদের দলে ভিড়ে নিজেকে গর্বিত করে তোলার চেষ্টা চালালে, সেখানে আবার আর এক ধাক্কা। ‘আরে, আপনাকে তো মুসলমান বলে চেনাই যায় না! ভেবেছিলাম আপনি বাঙালি।’...” (‘বাঙালি মুসলমান’, প্রতিদিন, কলকাতা, ২৬.১০.২০০২)
এভাবে আমাদের বাঙালিত্ব বিভ্রান্তিকর হয়ে আছে ভেতরে বাইরে। পরিচয়ে, চেহারায়, গঠনে, চলনে, বলনে। আমাদের ভাষা ইন্দো-এরিয়ান, কিন্তু আমরা ইন্দো-এরিয়ান নই  অসট্রিক মঙ্গোলয়েড নিগরোয়েড ইত্যাদির এক সংকর। তারপর আমাদের পোশাক, গান, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, শিল্প-সংস্কৃতি, ক্রীড়া, শিক্ষা  এ সবে বাঙালিয়ানা আছে কতখানি কি? রবীন্দ্রনাথের সময় থেকে যে বিশ্বায়ন শুরু হয়েছে তার ‘মেলাবে-মেশাবে’ ধাক্কায় আর অবশিষ্ট আছে কতখানি কি? পহেলা বৈশাখের গামছা লুঙ্গি পান্তা ইলিশ ইত্যাদির মধ্যে যত না বাংলা আছে তার চেয়ে বেশি আছে ধান্দা! তাহলে সেই বাঙালি কোথায় যার সম্পর্কে কবি নবীচন্দ্র সেন (১৮৪৭-১৯০৯) লিখেছেন তাঁর ‘পলাশীর যুদ্ধ’ (১৮৭৫) কাব্যে 
“স্বর্গ মর্ত করে যদি স্থান-বিনিময়,
তথাপি বাঙ্গালী নাহি হবে একমত;
প্রতিজ্ঞায় কল্পতরু, সাহসে দুর্জয়।
কার্যকালে খোঁজে সবে নিজ নিজ পথ।”
নাট্যকার ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ (১৮৬৩-১৯২৭)-ও এমন মন্তব্য করেছেন তাঁর “বঙ্গের প্রতাপ-আদিত্য” (১৯০৩) নাটকে  “অন্য জাতির দশে কার্য, বাঙালির দশে কার্যহানি।” আর কবি সুনির্মল বসু (১৯০২-১৯৫৭) তো স্পষ্ট করেই লিখেছেন  “যেখানে বাঙালী সেখানে কেবল দল আর দলাদলি।” (‘আমরা বাঙালী’)
খুব জানতে ইচ্ছা করে এই ঐকমত্য বিরোধী (গণতান্ত্রিক?), প্রতিজ্ঞাভঙ্গকারী, আপসকামী, স্বার্থপর, কোন্দলপরায়ণ বাঙালি আজ কোথায়? আসল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য চিনেই তো শনাক্ত করতে হবে বাঙালিয়ানাকে? রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন  “... বঙ্গদেশ গোঁফে-তেল গাছে-কাঁঠালের দেশ। যত বড় না মুখ তত বড় কথার দেশ। পেটে পিলে কানে কলম ও মাথায় শামলার দেশ।... এখানে বিচিগুলাই তেরো হাত হইয়া কাঁকুড়কে অতিক্রম করিয়া ওঠে।... বাঙালি জাতির... সাহস হয় না, আশা হয় না, উদ্যম হয় না।... আমাদের শরীর অপটু, বুদ্ধি অপরিপক্ব, উদরান্ন ততোধিক।...” (‘চিঠিপত্র’, ১৮৮৭)
আরও লিখেছেন, “... কেবল দলাদলি, কেবল ‘আমি আমি আমি’ এবং ‘অমুক অমুক অমুক’ করিয়াই মরিতেছি। আমাকে এবং অমুককে অতিক্রম করিয়াও যে দেশের কোনও কাজ, কোনও মহৎ অনুষ্ঠান বিরাজ করিতে পারে, ইহা আমরা মনে করিতে পারি না। এইজন্য আপন আপন অভিমান লইয়াই থাকি। আমাকে বড় চৌকি দেয় নাই, অতএব এ সভায় আমি থাকিব না  আমার পরামর্শ জিজ্ঞাসা করে নাই, কাজেই ও কাজে আমি হাত দিতে পারি না  সে সমাজের সেক্রেটারি অমুক, অতএব সে সমাজে আমার থাকা শোভা পায় না  আমরা কেবল এই ভাবিয়াই মরি। সুপারিশের খাতির এড়াইতে পারি না, চক্ষুলজ্জা অতিক্রম করিতে পারি না, আমার একটা কথা অগ্রাহ্য হইলে সে অপমান সহ্য করিতে পারি না।...” (প্রাগুক্ত)
হ্যাঁ, এবার মনে হয় চিনতে পেরেছি খাঁটি বাঙালি। দেখতেও যেন পাচ্ছি চোখের সমুখে। এই তো এই লোকগুলি 
“... আমরা কেবল ঘরে বসিয়া বড় কথা লইয়া হাসি-তামাশা করিতে পারি, বড় লোককে লইয়া বিদ্রুপ করিতে পারি... আমরা না পড়িয়া পণ্ডিত, আমরা না লড়িয়া বীর, আমরা ধাঁ করিয়া সভ্য, আমরা ফাঁকি দিয়া পেট্রিয়ট  আমাদের রসনার অদ্ভুত রাসায়নিক প্রভাবে জগতে যে তুমুল বিপ্লব উপস্থিত হইবে আমরা তাহারই জন্য অপেক্ষা করিয়া আছি, সমস্ত জগৎও সেই দিকে সবিস্ময়ে নিরীক্ষণ করিয়া আছে।...” (প্রাগুক্ত)
না চেনার কারণ নেই কোনও। ওই ‘রসনা’ কথাতেই চেনা যায় বেশ। এর জোরে সব কিছু চালাবার ক্ষমতা একমাত্র ওঁদেরই আছে!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন