সোমবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১১

‘প্রতিবেশীর কাছে মই...’

চট্টগ্রামের কবি-পণ্ডিত আলাওল (১৬০৭-১৬৮০) তাঁর ‘পদ্মাবতী’ কাব্যে লিখেছেন - “পড়শি হইলে শত্রু গৃহে সুখ নাই। নৃপতি হইলে ক্রোধ দেশে নাই ঠাঁই ॥” এ কারণে অনেকে সন্দেহ করেন, দেশে যে সুখ-শান্তি নেই এর নেপথ্যে আমাদের প্রতিবেশীদের কোনও ভূমিকা আছে কিনা। তাঁরা আমাদের কতখানি কি মিত্র বা বৈরী সে হিসাবও করা হয় এ সূত্রে। আর সে হিসাবে ভালয় মন্দয় মিশিয়ে এক রকম একটা ধারণা তৈরি হয়ে আছে ইতিহাস থেকে অর্জিত নানা ঘটনা-পরম্পরায়। আসলে প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্কে বাস করার কথা বলাই হয়, মহাজন-বাক্যে বা কূটনৈতিক বর্ক্তৃতা-বিবৃতিতে, আদতে প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রায় কারওই থাকে না। পৃথিবীর সব দেশেরই সব প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ত। ‘পালামৌ’ (১৮৮০-১৮৮২) ভ্রমণবৃত্তান্তে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৪-১৮৮৯) লিখেছেন, “বঙ্গবাসীমাত্রই সজ্জন; বঙ্গে কেবল প্রতিবাসীরাই দুরাত্মা। যাহা নিন্দা শুনা যায় তাহা কেবল প্রতিবাসীর। প্রতিবাসীরা পরশ্রীকাতর, দাম্ভিক, কলহপ্রিয়, লোভী, কৃপণ, বঞ্চক। তাহারা আপনাদের সন্তানকে ভাল কাপড়, ভাল জুতা পরায়, কেবল আমাদের সন্তানকে কাঁদাইবার জন্য।... যাহাদের প্রতিবাসী নাই, তাহাদের ক্রোধ নাই। তাহাদেরই নাম ঋষি। ঋষি কেবল প্রতিবাসী-পরিত্যাগী গৃহী। ঋষিদের আশ্রম পার্শ্বে প্রতিবাসী বসাও, তিন দিনের মধ্যে ঋষির ঋষিত্ব যাইবে।” একালের সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়-ও লিখেছেন, “প্রতিবেশীর কাছে মই চেয়ে দেখেছি, বলেছেন সিন্দুকে আছে। জাল চেয়ে দেখেছি, বলেছেন জালে সরষে বাঁধা আছে। বিপন্ন আত্মীয়কে মধ্যরাতে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি চেয়ে দেখেছি, বলেছেন ড্রাইভারের কাছে চাবি, ওঃ অফুলি সরি, গামছা দিয়ে বেঁধে রাখুন, পরানটাকে বেঁধে রাখা যায় জীবনটাকেও এক রাত বেঁধে রাখা যাবে।” (‘কলিকাতা আছে কলিকাতাতেই’)
    এই তো মোটামুটি প্রতিবেশীচিত্র। এ অবস্থায় সৎপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক বজায় রাখার অঙ্গীকার করে আমরা কি করছি এবং আমাদের প্রতিবেশীরা কি করছেন?
    আমাদের দুই প্রতিবেশী -৩২০ কিলোমিটার সীমান্ত নিয়ে সেনাশাসিত বিশ্ববর্জিত মিয়ানমার, আর ৪০০০  কিলোমিটার সীমান্ত নিয়ে গণতন্ত্রী বিশ্ববিশ্র“ত ভারত। সীমান্ত অল্প হলেও সমস্যা অধিক সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার। রোহিঙ্গা শরণার্থী, নাসাকা বাহিনীর উৎপাত, সীমান্তে গুলিবর্ষণ, সশস্ত্র চরমপন্থিদের আনাগোনা, অস্ত্র ও মাদক চক্রের দৌরাত্ম্য, বঙ্গোপসাগরের সম্পদে ভাগ দাবি, যুদ্ধাবস্থা - আরও নানা কিছু হয়ে উঠেছে স্থায়ী মাথাব্যথা। আর সুদীর্ঘ সীমান্ত নিয়ে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের তালিকাটিও সুদীর্ঘ। বেরুবাড়ি, ফারাক্কা, ছিটমহল ও অপদখলীয় জমি, কাঁটাতার, সীমান্তহত্যা, ফেনী ও তিস্তা নদীর পানিবণ্টন, আমদানি-রপ্তানি, ভিসা, চোরাচালান, ক্ষুদ্র অস্ত্র, মাদক, নারী ও শিশু পাচার, ট্রানজিট, করিডোর, সশস্ত্র চরমপন্থি, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা, দাঙ্গা, আধিপত্য ও সম্প্রসারণবাদ, বিরোধিতার জিগির, ধর্মোন্মাদনা, মৌলবাদ. দুর্বৃত্তদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ইত্যাদি-ইত্যাদি অনেক কিছু। এসবের পরও মিয়ানমার থেকে চাল, মাছ, কাঠ, লুঙ্গি, জুতা, চীনামাটির তৈজসপত্র, ভেষজ দ্রব্যাদি ও আরও অনেক কিছু আসছে সীমান্তপথে, সাগর- ও আকাশপথে। আমাদেরও এমন অনেক কিছু যাচ্ছে একই ভাবে। গ্যাসবাহী পাইপলাইন বসানোর ব্যাপারে আমরা হতাশা সৃষ্টি করলেও এখন আশা জাগাতে চাইছি চীন পর্যন্ত সংযোগ-সড়ক নির্মাণের উদ্যোগে শামিল হয়ে।
    আর ভারতের সঙ্গে? সেই ছোটবেলা থেকে ভালবেসে এসেছি কলেজ স্ট্রিট, টালিগঞ্জ, দমদম, বলিউড। জানি না আর কাদের এত ভালবেসেছি! দুঃখও আছে। বাল্যবন্ধুদের হারানোর দুঃখ। স্কুলে কলেজে পড়ার কোন ফাঁকে কিছু না বলে কখন চলে গেছে তারা, তারপর আর কখনও একটু যোগাযোগও করে নি কেউ - সে অভিমান আছে। তা-ও ভুলেছি একাত্তরে। মন ভরে গেছে কৃতজ্ঞতায়। ভেবেছি এবার তো হলো রক্তের বন্ধন। কিন্তু যেভাবে সম্পর্ক গড়ে ওঠার কথা তা গড়ে উঠলো না কেমন করে। ১৯৯২ সালের অকটোবরে প্রথম সার্ক সাংস্কৃতিক সম্মেলনে যোগ দিতে ভারতের বিভিন্ন শহরে গিয়েছিলাম নাট্যকার সাঈদ আহমেদ, আসাদ চৌধুরী ও সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সঙ্গী হয়ে। তখন সময়টা ভাল ছিল না। রথযাত্রা শুরু হয়েছিল লালকৃষ্ণ আদবানি’র নেতৃত্বে। কলকাতা, ব্যাঙ্গালোর, তিরুবানন্তপুরম - যে শহরেই গিয়েছি পেয়েছি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার আভাস। দাঙ্গার খবরও শুনেছি।  ওই সময় বাংলাদেশ ও ভারত দু’ দেশের সম্পর্ক নিয়ে অনেক প্রশ্ন, কৌতূহল ও বিরাগের মুখোমুখি হয়েছি আমরা। এর কিছু দিন আগে নীরদ চৌধুরীর এক লেখায় বাংলাদেশ সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য থাকায় সাপ্তাহিক দেশ নিষিদ্ধ  করেছিল তৎকালীন বিএনপি সরকার। এ নিয়ে বেশ উত্তেজনা ছিল কলকাতায়। ম্যাক্সমুলার ভবনে আয়োজিত আলোচনা সভার প্রশ্নোত্তর পর্বে একজন শ্রোতা এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে। তিনি উত্তর দেন, “আমার দেশকে যে অবৈধ বা বেজন্মা বলবে, আমার বাপ হলেও, তাঁকে গুলি করবো।” তিরুবানন্তপুরম-এ আয়োজিত এক আলোচনা সভার এক ফাঁকে স্থানীয় একজন সাহিত্যিক-সাংবাদিক আসাদ চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “দু’ দেশের সম্পর্ক নষ্ট হলো কেন? শেখ মুজিব না হয় ভারতের জন্য ভুল লোক ছিলেন, অন্যেরা কি করলেন?” তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন ইংরেজিতে। ‘ভুল লোক’ বোঝাতে তিনি বলেছিলেন ‘রং হর্স’। আসাদ চৌধুরী উত্তর দেন, সম্পর্ক নষ্ট করেছে ভারতের স্মাগলার আর সাউথ ব্লকের আমলা। একাত্তরের পর তারা যুদ্ধে জেতা কলোনি ভেবেছিল বাংলাদেশকে। ২০০৫ সালে আমি গিয়েছিলাম ফারাক্কা-য়, বঙ্গভঙ্গের শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে। সেখানে আলোচনার প্রশ্ন-উত্তর পর্বে এক শিক্ষিকা বেশ রাগত ভঙ্গিতে আমার কাছে জানতে চান, কেন দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে তসলিমা নাসরিনকে? আমি উত্তর দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আয়োজনকারীরা তার আগেই ঘোষণা দেন - উনি আমাদের অতিথি। তাঁকে কোনও বিতর্কে জড়াবো না আমরা। পরে ওই জিজ্ঞাসার জবাব দেন কবি সৈয়দ হাসমত জালাল। তিনি বলেন, দেশকে ‘জারজ’ বলায় দেশবাসী ক্ষুব্ধ হয়েছে। তিনি পালটা প্রশ্ন রাখেন, এখানে যদি কেউ এ দেশ নিয়ে এমন কথা বলে তখন কি করবো আমরা?
    গত ৬-৭ই সেপটেম্বরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর সফর ও দু’ দেশের সম্পর্ক নিয়ে অনেক আশাবাদ জাগিয়ে রাখা হয়েছিল আমাদের মিডিয়ায়। তবে যাঁরা ভারতীয় মিডিয়ার দিকে নজর রেখেছিলেন তাঁরা লক্ষ্য করেছেন, সেখানে অত কিছু উচ্ছ্বাস ছিল না। তাঁরা সব কিছু বলেছেন সতর্কতার সঙ্গে। ভারতীয়দের দেশপ্রেম আমি বেশ ভালই বুঝি, সেখানে খাদ নেই এতটুকু। দেশপ্রেম কি এবং কাকে বলে তা বলিউডের সি-গ্রেড ছবি থেকেও শিখে নিতে পারেন যে কেউ। কাজেই তাঁরা চুক্তি, চুক্তি-খসড়া (প্রটোকল), সমঝোতা স্মারক যা-ই স্বাক্ষর করুন নিজেদের হিসাবের বাইরে যাবেন না এতটুকুও।
তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি হবে না -এটা জানা গিয়েছিল আগেই। নয়া দিল্লি’র রফি মার্গ-এ শ্রম শক্তি ভবন থেকে পানি সম্পদ মন্ত্রী পবন কুমার বনসাল যে ঢাকায় আসছেন না তা জানা গিয়েছিল দু’ দিন আগেই। তখনই প্রশ্ন উঠেছিল, তিনি না এলে কিভাবে স্বাক্ষর হবে পানিবণ্টন চুক্তি? তিস্তার সঙ্গে এখন ঝুলে গেছে ফেনী নদীর পানিবণ্টন চুক্তিও। সীমানা চিহ্নিতকরণ, ছিটমহল ও অপদখলীয় জমি হস্তান্তর সংক্রান্ত খসড়া-চুক্তি আশান্বিত করেছে অনেকে। কিন্তু এর দিন-তারিখ ঠিক হয় নি কিছুই। ওদিকে অসম-এ শুরু হয়েছে ওই হস্তান্তরের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন। একই রকম বিরোধিতা শুরু হয়েছে তৈরী পোশাক শিল্পের ৪৬টি সামগ্রীর বিনাশুল্কে ভারতে প্রবেশাধিকার নিয়ে। ভারতের ব্যবসায়ীরা এটা মানতে চাইছেন না, বলছেন চরম ক্ষতি হবে তাঁদের। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবে পুনর্বিবেচনার। এ রকম পুনর্বিবেচনার দাবি উঠেছে গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়েও। এ দাবি তুলেছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। তিনি ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতাদের একজন। আর সুন্দরবন, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, পুনর্নবায়নযোগ্য জ্বালানি, বিটিভি / দূরদর্শন, ঢাকা / জওয়াহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, ফ্যাশন ইনস্টিউট প্রভৃতি যে সব সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত সেগুলোর বাস্তবায়ন কতখানি কি হয় তা দেখার বিষয়। ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি এখনও বাস্তবায়িত হয় নি পুরোপুরি। তবে হ্যাঁ, প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে ২৪ ঘণ্টা খুলে রাখার ব্যবস্থা হয়েছে তিন বিঘা করিডোর।
    হাসিনা-মনমোহন চুক্তি হিসেবে এখন যা আলোচনার শীর্ষে রয়েছে তা হচ্ছে ‘ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট অন ডেভেলপমেন্ট কোঅপারেশন’। এতে কি আছে এবং এর মাধ্যমে কি হতে যাচ্ছে তা নিয়ে অনেক কথাই বলা হচ্ছে, এবং বলা হবেও। আমি শেষ কথা বলে রাখি রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে-
    “যা-ই বলুক না প্রতিবেশী নিন্দুক
    খুব কষে আঁটা যেন থাকে তব সিন্দুক।” (‘পরিণয়মঙ্গল’)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন