মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১১

একজন উত্তম পুরুষ

সিকান্দার আবু জাফর (১৯১৯-১৯৭৫) আমার প্রিয় কবি, নাট্যকার, অনুবাদক, প্রকাশক এবং সাহিত্য মাসিক ‘সমকাল’ (১৯৫৭-১৯৭০)-এর প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। এখনও কথায়-কথায় উল্লেখ করি তাঁর কবিতা ‘মায়ের বাড়ির পথ’, নাটক ‘সিরাজউদ্দৌলা’, অনুবাদ ‘যাদুর কলস’ (বারনার্ড ম্যালামুড-এর ‘দ্য ম্যাজিক ব্যারেল’), সমকাল প্রকাশনীর মানসম্পন্ন প্রকাশনা এবং আধুনিক সাহিত্যচর্চায় ‘সমকাল’-এর অবদানের কথা। ‘সমকাল’-এর কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, ধারাবাহিক উপন্যাস, গ্রন্থ সমালোচনা, পাঠকের প্রতিক্রিয়া - সবখানে ছিল সমান আকর্ষণ। অনেক আকর্ষণীয় সাহিত্যিক ঘটনারও জন্ম হয়েছে এ পত্রিকাকে ঘিরে। সৈয়দ শামসুল হক ধারাবাহিক উপন্যাসের কিস্তি সময়মতো না দেয়ায় সিকানদার আবু জাফর পৃষ্ঠায় লেখার অংশ রেখেছিলেন সাদা। নিচে লেখকের দায়িত্বহীনতা সম্পর্কে দিয়েছিলেন কড়া সম্পাদকীয় নোট। সদ্যপ্রয়াত কথাসাহিত্যিক রশীদ করিমের ধারাবাহিক উপন্যাস “উত্তম পুরুষ”-এর প্রকাশনাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল একদিন।  উপন্যাসটির মুগ্ধ পাঠক ছিলাম, পুরো মাস তাই অধীর হয়ে অপেক্ষা করতাম ‘সমকাল’-এর জন্য। তাই এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দুঃখ পেয়েছিলাম খুব। সে দুঃখ থাকে নি বেশি দিন। কিছু দিন পরে, ১৯৬১ সালে,  ‘উত্তম পুরুষ’ প্রকাশ করে আনিস ব্রাদার্স। প্রকাশের পর-পরই সাহিত্যিক-সমালোচক মহলের প্রভূত প্রশংসা পায় উপন্যাসটি। সে সব প্রশংসার মধ্যে ‘মাহে নও’ পত্রিকায় আবুল ফজল, ‘পরিক্রম’-এ আহসান হাবীব, ‘পাকিস্তান টাইমস’-এ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়ন প্রমুখের মূল্যায়ন-বিশ্লেষণ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। আহসান হাবীব মুসলমান রচিত কয়েকটি উপন্যাসের নাম উল্লেখ করেও ‘উত্তম পুরুষ’কে বলেছেন বিশিষ্ট। উপন্যাসটি পরে প্রকাশ করেছে ‘মুক্তধারা’ (১৯৮৫) ও ‘বিউটি বুক হাউস’ (২০০১)। এখন স্থান পেয়েছে রশীদ করিমের ‘উপন্যাস সমগ্র’-এ (সাহিত্যপ্রকাশ, ২০০২)। তবে কেন উপন্যাসটির প্রকাশ বন্ধ করেছিলেন সিকান্দার আবু জাফর?
    ‘উত্তম পুরুষ’ শীর্ষক এক নিবন্ধে রশীদ করিম জানিয়েছেন-“... সিকান্দার আবু জাফরকে আমি কলকাতায় থাকাকালীন অবস্থা থেকেই জানতাম। তিনি আমার গল্পের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। ঢাকায় এসেও বিভিন্ন জায়গায় তাঁর এবং অন্যদের সঙ্গে সাহিত্য আলাপ হতো। তিনি যখন শুনলেন, আমি একটি উপন্যাস শেষ করেছি, তখন বললেন, দেরি করছো কেন, আমাদের দিয়ে দাও, সমকাল-এ ছাপতে আরম্ভ করি। তিনি উপন্যাসটি পড়েও দেখলেন না। আমি প্রত্যেক সংখ্যা সমকাল-এর জন্য এক এক কিস্তি লেখা পাঠাতে লাগলাম। এভাবে কয়েকটা ইনস্টলমেন্ট ছাপা হওয়ার পর ‘উত্তম পুরুষ’ প্রকাশ বন্ধ হয়ে গেল। সমকাল-সম্পাদক বললেন, লেখাটা বড্ড কমুনাল।” (‘প্রবন্ধ-সমগ্র’, সাহিত্য প্রকাশ, ২০০৩)


    ‘উত্তম পুরুষ’ সাম্প্রদায়িক? পড়তে-পড়তে ঘুনাক্ষরেও তা মনে হয় নি আমার। এর কিছু দিন আগেই পড়েছিলাম রশীদ করীমের অগ্রজ আবু রুশদ (১৯১৯-২০১০)-এর একই পটভূমিকায় লেখা ‘এলোমেলো’ (১৯৪৬) উপন্যাসটি। পটভূমি কলকাতায় বসবাসকারী সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজ। যখন পড়ি তখন বয়সে আমার চেয়ে কিছুটা বড় ছিল ‘উত্তম পুরুষ’-এর শাকের আর ‘এলোমেলো’র সাজ্জাদ (আমার লেখক-নাম ধারণের নেপথ্যে ভূমিকা আছে এই নামটির)। ওদের কৈশোরিক মনের ভাষা, অনুভূতি বুঝতে তাই একটুও অসুবিধা হয় নি আমার। ওরা মুগ্ধ করেছে আমাকে, মুগ্ধ করেছে বিশেষভাবে ওদের প্রেমানুভূত্রি, জীবনচেতনা এবং সংস্কারমুক্ত ও অসাম্প্রদায়িক অবস্থান। ওদের দ্বারা জীবনে আমি প্রভাবিতও হয়েছি অনেকখানি। অবশ্য এ প্রসঙ্গে মণীশ ঘটক (১৯০২-১৯৭৯)-এর ‘কনখল’ (১৯৬৩) উপন্যাসের কনখল এবং বিমল কর (১৯২১-২০০৩)-এর ‘খড়কুটো’ (১৯৬৩) উপন্যাসের অমল-এর কথাও বলতে হবে আমাকে।
    ‘কমুনাল’ অভিযোগ শুনে ব্যথিত হয়েছিলেন রশীদ করিম। তিনি লিখেছেন, “উত্তম পুরুষ সাম্প্রদায়িক? উপন্যাসটি ৪০ দশকের কলকাতাকে কেন্দ্র করে লেখা। সেই সময় কলকাতার পরিবেশ কেমন ছিল, আমি ঠিক সেভাবেই পরিবেশের কাছে বিশ্বস্ত থেকেই উপন্যাসটি রচনা করেছি। আমি কোনও বাস্তবকে আদর্শায়িত করি নি অথবা কোনও আদর্শকে বাস্তবায়িত করি নি। কলকাতার পরিবেশ যেমন ছিল, ঠিক যথাযথ তা-ই চিত্রিত করেছি। তবে পৃথিবী বদলে যায়। লোকজন বদলে যায়।” (প্রাগুক্ত)
    তবে এ ব্যথা তিনি হয়তো ভুলেছিলেন উপন্যাসটির বিপুল পাঠকপ্রিয়তা ও সাফল্যে। বিশিষ্ট সমালোচক-প্রাবন্ধিক সরদার আবদুস সাত্তার লিখেছেন -“১৯৬১ সালে যখন তাঁর (রশীদ করিমের) বয়স ছত্রিশ বছর, তখন বেরিয়েছিল তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘উত্তম পুরুষ’। প্রকাশের সঙ্গে-সঙ্গে উপন্যাসটি একাদিক্রমে তিনটি সৌভাগ্য করায়ত্ত করতে পেরেছিল। প্রথমত, প্রকাশের বছরই উপন্যাসটি সেই সময়ের লোভনীয় সাহিত্য পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত ‘আদমজী পুরস্কার’ পাওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল। দ্বিতীয়ত, ব্যাপকভাবে সমালোচকদের কাছে প্রশংসিত হয়েছিল। এবং তৃতীয়ত, অভূতপূর্ব পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। মাত্র পনের মাসের মধ্যে প্রথম প্রকাশের ২২৫০ কপি বই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। তাই ১৯৬২ সালের সেপটেম্বর মাসেই বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ বাজারে এসেছিল এবং এবারের মুদ্রণসংখ্যা ছিল প্রথম বারের চেয়ে আরও এক হাজার বেশি অর্থাৎ ৩২৫০ কপি।...” (‘কথাসাহিত্যের আঙিনায় দাঁড়িয়ে’, সুচয়নী পাবলিশার্স, ২০০৯)
    ‘উত্তম পুরুষ’-এর পাঠকপ্রিয়তার কারণ খুঁজেছেন সরদার আবদুস সাত্তার। তিনি লিখেছেন, “এ উপন্যাসের প্রধান আকর্ষণ এর আখ্যান। এবং যে ঘটনাসমূহের সন্নিপাতে এই আখ্যান তার সামগ্রিকতা ও পরিপূর্ণতা অর্জন করেছে তার সবটুকুই চিত্তাকর্ষক এবং গতিময়। লেখক যে একজন নিপুণ কথক, উপন্যাসের কয়েকটি পৃষ্ঠা উলটে গেলেই তা অনুধাবন করা যায় এবং উপন্যাসের শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত সেই অনুভব সতেজ ও অক্ষত থাকে। কাহিনী ও চরিত্রের মধ্যেই যে উপন্যাসের প্রাণশক্তি নিহিত থাকে, ‘উত্তম পুরুষ’ রচনার সময় রশীদ করিম সম্ভবত একবারও তা বিস্মৃত হন নি। আর তাই একটিমাত্র চরিত্রের জীবন অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির সূত্র ধরে যে গতিময় কাহিনীবৃত্ত তিনি এখানে নির্মাণ করেছেন তা পাঠককে যেমন কৌতূহলী, তেমনি আবিষ্ট করে রাখে। তাই শেস পৃষ্ঠায় না পৌঁছা পর্যন্ত পাঠক সাগ্রহে তাঁর উপন্যাসের সবগুলো পাতা উলটে যায়  আনন্দময় পাঠের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে-করতে। ঔপন্যাসিক রশীদ করিম তাঁর পাঠককে কাহিনীর নিবিড় বুনন এবং পাত্র-পাত্রীর আত্মগত উপলব্ধির মনোগ্রাহী বিশ্লেষণের ভিতর দিয়ে অনায়াসেই তন্ময় করে ফেলেন। ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর শক্তিমত্তার এটি এক বড় পরিচয়।” (প্রাগুক্ত)
    তবে সকলেই উচ্ছ্বসিত নন এত। রশীদ করিমের ‘গল্প বলার ক্ষমতা এবং চরিত্রাঙ্কনের নিপুণতা প্রশংসনীয়’ উল্লেখ করেও গবেষক-সমালোচক মনসুর মুসা লিখেছেন, “উত্তম পুরুষ-এ কোনও সুসংবদ্ধ কাহিনী নেই। উত্তম পুরুষ শাকেরের জীবনের একটি খণ্ডিত অংশে যে চরিত্রের সমাগম হয়েছে তাদের কাহিনী উপন্যাসের সমগ্র অবয়বে ছড়িয়ে আছে। আবার এ সব খণ্ডিত কাহিনীতেও কোনও নিজস্ব গুরুত্ব নেই এবং কোনও গুরুত্বপূর্ণ পরিণতির পূর্বধারায় এসব কাহিনী নির্বাচনও নেই। অনাবশ্যক কথাবিস্তারের ধারায় এসেছে অনিমা, মুশতাক, সানী সাহেব, সেলিনা প্রভৃতি চরিত্র।” (‘পূর্ব বাঙলার উপন্যাস’, অ্যাডর্ন পবলিকেশন, ২০০৮)
    রশীদ করিম নিজে বলেছেন, ‘... এখন মনে হয় উত্তম পুরুষ  আরও কিছুটা সুবিন্যস্ত হতে পারতো।” (‘প্রবন্ধ-সমগ্র’)
    উত্তম পুরুষকে প্রথম থেকেই আত্মজৈবনিক মনে হয়েছে আমার। লেখক নিজেও বলেছেন, “উত্তম পুরুষ  বহুলাংশে আত্মজৈবনিক। এই বইয়ে আমার আব্বা, আম্মা ও অব্যবহিত অগ্রজ ভাইয়ের প্রতিকৃতি আছে। তবে মেজো ভাই বলে যাকে চিত্রিত করা হয়েছে তিনি আসলে আমার চতুর্থ ভাই।... আমার স্কুল জীবনের কথাও বেশ কিছুটা বলা হয়েছে। পণ্ডিত মশাই প্রভৃতির কথা অনেক অংশে সত্য। কিন্তু আমাদের ফার্স্ট বয় এবং তার পরিবারবর্গ সম্পর্কে সমুদয় বিবরণ সর্বৈব মিথ্যা ও মনগড়া।...”
    উত্তম পুরুষ  পড়েছি ৫০-৫১ বছর আগে। তখনকার সেই ভাল লাগা এখনও জেগে আছে আমার মনের ভিতর। ২৬শে নভেম্বর উত্তম পুরুষ-এর স্রষ্টা রশীদ করিমের বিদায়ের সংবাদ পেয়ে মনে পড়ে যায় কবেকার সেই ১৩-১৪ বছরের স্কুল বালককে। বুঝি, সেই জেগে থাকা এখনও কত সজ্ঞান সজীব। উত্তম পুরুষ-এর দশম পরিচ্ছেদের চরম উত্তেজনাপূর্ণ ক্যারাম খেলার ছবি যেন চোখের সামনে ভাসে। মিক্সড ডাবলস-এর স্নায়ু থরথর প্রতিযোগিতা। একদিকে মুশতাক ও অনিমা, অন্য দিকে সেলিনা ও শাকের। হয় জয় নয় হার। রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি। স্ট্রাইক শাকেরের। সে-ই উপন্যাসের উত্তম পুরুষ - উভয় অর্থে। তার জবানিতে লিখছেন রশীদ করিম -    “দাঁত দিয়ে রুমালটি ভাল করে চেপে ধরলাম। স্ট্রাইকারটাকে একেবারে বাম দিকে সরিয়ে আনলাম। তারপর আল্লাহ্ নাম নিয়ে লাগালাম এক রিবাউন্ড মার। স্ট্রাইকারটি আমাদের সাদা গুটিটির ঠিক মাথার ওপর বাজপাখির মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো। কালো গুটি দু’টি তারই ধাক্কায় সসম্মানে দু’দিকে সরে গেল, আমাদের সাদা গুটিটি রাজার মতো সমারোহ আর মর্যাদায় গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেল।...”

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন