রবিবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১১

স্বাধীন দেশের রাজাকার

অনেকের মনে থাকতে পারে, ১৯৭৪ সালে আমার লেখা “সাড়ে সাত শ’ সিংহ” নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল শিল্পকলা একাডেমী মিলনায়তনে। ওই নাটকের এক চরিত্রের সংলাপ ছিল, ‘পরাধীন দেশের মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীন দেশে রাজাকার হয়ে যায়।’ নাটকের সংলাপ যা হয় সেই সাঙ্কেতিকতা ছিল ওই উচ্চারণে। একটি সাধারণ অর্থ এবং একাধিক গূঢ় অর্থ। শ্রোতা-দর্শকেরা অর্থ-উপলব্ধি করে নেন যাঁর-যাঁর পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী। ওই সময় অবশ্য কাদের সিদ্দিকী থেকে মেজর (অব) আবদুল জলিল পর্যন্ত অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধাই নানারকম বিরোধিতা ও সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন রাজনৈতিক রণাঙ্গনে। তখন মেজর (অব) আবদুল জলিল নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সরকার-বিরোধী আন্দোলন-মুখর রাজনৈতিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর। আর কাদের সিদ্দিকী মোকাবেলা করছিলেন নিজ দলেরই একাংশের চোরাস্রোতের। সেই একাংশ জয়ী হতে পারে নি শেষ পর্যন্ত। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ-বাকশাল প্রতিষ্ঠিত হলে কাদের সিদ্দিকীকেই টাঙ্গাইলের গভর্নর করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তবে স্বাধীনতার ৪০তম বর্ষে সত্যি-সত্যি তাঁকে ‘রাজাকার’ অভিহিত করে স্লোগান দেয়া হয়েছে টাঙ্গাইল শহরে আয়োজিত এক মিছিল থেকে। পরে টাঙ্গাইলের সখীপুরে আয়োজিত এক সভা-সমাবেশ থেকে তাঁকে ‘যুদ্ধাপরাধী’ ঘোষণা করে বিচার দাবি করা হয়েছে তাঁর। দাবি করেছেন ওই সখীপুর আসনে তাঁর নির্বাচনী ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী শওকত মোমেন শাহজাহান। এ দাবি করার কারণ  একাত্তুরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কাদের সিদ্দিকী নাকি অনেক হত্যা ধর্ষণ অগ্নিসংযোগ লুটপাট করেছেন, যা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিচারযোগ্য। প্রকাশ্যে তাঁর বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ এই প্রথম। একাত্তুরে কিংবা এর আগে বা পরে কেউ কাদের সিদ্দিকী দ্বারা ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ হয়েছে  এমন কেউ কোনও অভিযোগ করে নি এর আগে। শওকত মোমেন শাহজাহান নিজে হয়েছেন কিনা তা বলেন নি অবশ্য, তবে যাদের কথা কথা বলেছেন তারা কি করেছে কখনও? লুটের শিকার কোনও ব্যাঙ্ক? কোনও জমিদার? টাঙ্গাইলের মানুষ তো কাদের সিদ্দিকীকে একমত হয়ে বরণ করে নিয়েছে ‘বঙ্গবীর’ উপাধিতে ভূষিত করে।
    কাদের সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে একটি অভিযোগই প্রচার পেয়েছিল বিশ্ব মিডিয়ায়। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর টাঙ্গাইল ও ঢাকায় কয়েকজন দুর্বৃত্তকে প্রকাশ্যে বেয়নেট চার্জ করে হত্যার অভিযোগ। সে ঘটনার ছবি প্রকাশিত হয়েছিল বিশ্ব মিডিয়ায়, এখনও প্রকাশ করা হয় মাঝেমধ্যে। ক’দিন আগে দেখলাম বিবিসি অনলাইনে। ওই ঘটনার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী জননেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী  “১৭ই ডিসেম্বর টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করে।... বিকেলে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের এক সমাবেশ। কাদের সিদ্দিকী তার দলবল নিয়ে এখানে উপস্থিত হন। লুটপাট ও ছিনতাইয়ের অভিযোগে সকালে আজিমপুর এলাকা থেকে আটক চারজনকে এ সমাবেশে উপস্থিত জনতার রায় নিয়ে প্রকাশ্যে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। সমাবেশে বলা হয়, স্বাধীন দেশে যারা অন্যায় অপকর্মে লিপ্ত হবে তাদেরকে এভাবে গণ আদালতে বিচার করে তাৎক্ষণিকভাবে সাজা দেয়া হবে।” (‘রাজনীতির তিনকাল’, ঢাকা, ২০০১)
    কিছু দিন আগে বরেণ্য চিন্তাবিদ বদরুদ্দিন উমর এ ঘটনাটিকে ‘যুদ্ধাপরাধ’ বলে উল্লেখ করেছিলেন এক কলামে, তবে শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক-সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী এর প্রতিবাদ করে বলেছেন, এটা ধিৎপৎরসব (যুদ্ধাপরাধ) নয়, ধঃৎড়পরঃু (নৃশংসতা)। চব্বিশ বছর বয়সী কাদের সিদ্দিকীর কাছে সেদিন দীঘ নয় মাস ধরে নিপীড়িত জনতার রায়-ই ছিল অমোঘ নির্দেশ। ওই চার জন ছিল আসলে যুদ্ধাপরাধী। কথাপ্রসঙ্গে কাদের সিদ্দিকী আমাকে বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধ অংশ নেয়ার দোহাই দিয়ে ওরা শুরু করেছিল চরম দুষ্কর্ম। ১০-১২ জন অবাঙালি বিহারি মেয়েকে বিভিন্ন বাড়িতে আটকে রেখে ওরা নৃশংস নির্যাতন করছিল দলেবলে।
    বঙ্গবন্ধুর কাছে কাদের সিদ্দিকী অস্ত্র সমর্পণ করেন ১৯৭২ সালের ২৪শে জানুয়ারি। সেদিন মঞ্চের খুব কাছে দাঁড়িয়েছিলাম ভাষণ শোনা ছাড়াও একটি বিশেষ কারণে। সে কারণটি ছিল  অনুষ্ঠানের শুরুর দিকে মানপত্র পাঠ শুনে বঙ্গবন্ধুর মুখে কি ভাব হয় তা দেখা। মানপত্রের পাঠক ছিলেন আনোয়ার উল আলম শহীদ, লেখক ছিলাম আমি। মানপত্রের ভাষা, আবেগ, বক্তব্য যে বঙ্গবন্ধুকে প্রীত করেছিল তা বুঝতে পেরেছিলাম তখনই। বাঁধাই করা সে মানপত্রটি ৩২ নম্বরের বাড়িতে সযতেœ টাঙানো ছিল বলে এই কিছু দিন আগে আমাকে জানিয়েছেন আনোয়ার উল আলম শহীদ।
    সেদিনের সেই অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে কাদের সিদ্দিকীকে উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “কাদের, তুই চার জনকে মেরেছিস্, চার শ’ লোক মারলেও আমি তোকে কিছুই বলতাম না!” মিজানুর রহমান চৌধুরী এ উক্তিটিও উদ্ধৃত করেছেন ‘রাজনীতির তিনকাল’-এ। তখনকার বাস্তবতা ছিল এ রকমই। বঙ্গবন্ধু’র ওই উক্তির প্রতিবাদ করেছিলেন শুধু তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টাঙ্গাইলের আবদুল মান্নান। স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির প্রথম সভায় তিনি বলেছিলেন, “প্রকাশ্য জনসভায় সরকার-প্রধানের এই বক্তব্যের পর দেশে আইন-শৃঙ্খলা কি করে প্রতিষ্ঠা হবে?”
    শওকত মোমেন শাহজাহানের অভিযোগের মূলে রয়েছে সখীপুরে গত ১৫ই নভেম্বর পালিত ‘ভোট ডাকাতি দিবস’। ১৯৯৯ সালের ওই দিনে সখীপুরের উপনির্বাচনে তিনি ছিলেন সরকার দলীয় প্রার্থী, কাদের সিদ্দিকী ছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। ওই নির্বাচনে পরাজিত হন কাদের সিদ্দিকী। অভিযোগ ওঠে, ভোট ডাকাতির মাধ্যমে সেদিন পরাজিত করা হয়েছে তাঁকে। এ অভিযোগ কতখানি সত্য তা ওই সময়কার পত্রপত্রিকাতেই আছে।
    এবার ভোট ডাকাতি দিবস উপলক্ষে সখীপুরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কাদের সিদ্দিকী, কর্নেল (অব.) অলি, জেনারেল (অব.) মুহাম্মদ ইবরাহিম। তাঁরা যথাক্রমে বীরউত্তম, বীরবিক্রম, বীরপ্রতীক। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রের উচ্চ মর্যাদা ও সম্মানের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। আরও ছিলেন আ স ম আবদুর রব। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের, মুক্তিযুদ্ধের শীর্ষ নেতাদের একজন। একজন বীরউত্তমকে ‘রাজাকার’ ‘যুদ্ধাপরাধী’ আখ্যায়িত করে তাঁর সহজনদেরও তো অবমূল্যায়িত করা হলো একই ভাবে।
    মনে হচ্ছে, আমরা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি হিসেবে কেবল মুক্তিযুদ্ধেরই পক্ষে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কি? তবে কি মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের ছাড়া  এই সব ভুয়া আর ষোড়শ বাহিনী দিয়ে?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন