বুধবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১১

‘অসংস্কৃত যদৃচ্ছের পথে...’

আমার অনেক দোষ। একজন লেখক-সাংবাদিক হিসেবে শুদ্ধ করে লেখার চেষ্টা করি, তাতেও দোষ খুঁজে পান অনেকে। কিন্তু এ চেষ্টা তো সকলেরই করা উচিত। সে রকম চেষ্টাচরিত্র আমিও করি, এর বেশি কিছু নয়। তবে আমি যে কাণ্ডটি করে বসি তাহলো অশুদ্ধ কিছু দেখলে সঙ্গে-সঙ্গে বড্ড চেঁচামেচি শুরু করি। তবে তা করলেও কাজের কাজ হয় না কিচ্ছু। সকল প্রকাশনাতেই নিজস্ব বানানবিধি-প্রয়োগবিধি আছে। তাই আমি ‘মোহ্যমান’ লিখলেও স্বয়ংক্রিয় ভাবে হয়ে যায় ‘মুহ্যমান’। এভাবে ‘আশিস্’ লিখলেও তা হয়ে যায় ‘আশীষ’। যতবার লিখি ‘শয়িত’, ততবার হয়ে যায় ‘শায়িত’। অথচ দু’টি শব্দের অর্থ আলাদা। ‘শায়িত’ অর্থ যাকে শোয়ানো হয়েছে, আর ‘শয়িত’ অর্থ যে শুয়েছে। এ রকম উদাহরণ দিতে পারি অজস্র। এভাবে শুদ্ধ ভাষা, নির্ভুল বানান নিয়ে হৈচৈ করলেও পদে-পদে আমি হেরে যাই ক্ষমতাবানদের কাছে। তবে সবচেয়ে বেশি হারি রবীন্দ্রনাথের কাছে।    কেউ ‘অশ্র“জল’ লিখলে রেগে যাই, কেটে দেই সঙ্গে-সঙ্গে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যখন লেখেন - “... তাই তো তোমায় শুধাই অশ্র“জলে -” (‘প্রশ্ন’) কিংবা “... কেন হেরি অশ্র“জল হৃদয়ের হলাহল, রূপ কেন রাহুগ্রস্ত মানে অভিমানে” (‘পুরুষের উক্তি’) কিংবা “অশ্র“জলে অন্তরের সমস্ত কঠিনতাকে গলাইয়া...” (‘চোখের বালি’) তখন গলা খুসখুস করলেও বলতে পারি না কিছু। ‘শিশিরজল’ও লিখেছেন তিনি - “... মুছে গেছে রাত্রির শিশিরজলে,...” (‘৭’, ‘প্রান্তিক’)।
    ‘শ্রেষ্ঠ’ কথাটির অর্থ - ‘অতি উৎকৃষ্ট, উত্তম, প্রধানতম, সর্বপ্রধান’। অথচ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ (“প্রভু, দণ্ডিতের সাথে / দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে / সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।” - ‘গান্ধারীর আবেদন’)। ‘শ্রেষ্ঠতম’-ও লিখেছেন - “বন্ধু এক আছে শ্রেষ্ঠতম” (‘মালিনী’)।
    রবীন্দ্রনাথ কলেজকে ‘কালেজ’ (‘গোরা’), হাসপাতালকে ‘হাঁসপাতাল’ (‘রসময়ীর রসিকতা’) লিখেছেন। অশুদ্ধ শব্দও লিখেছেন অনেক। যেমন -
কেবলমাত্র: “... ইহার রহস্য কেবল একজনমাত্রই ভেদ করিতে পারিবে,...” (‘গুপ্তধন’); “কেবলমাত্র তপস্যার মধ্য দিয়ে সে হয়েছে জ্ঞানী মানুষ” (‘শেষ কথা’)।
ইতিপূর্বে: “... এমন শৌখিন নাম ইতিপূর্বে কখনো শোনা যায় নাই” (‘দেনাপাওনা’)।
ইতিমধ্যে: “ইতিমধ্যে নবদ্বীপ তাহার বুদ্ধিমান বন্ধুদের সহিত...” (‘রামকানাইয়ের নিবুর্দ্ধিতা’); “ইতিমধ্যে কিছুদূরে আমাদের অর্ধসমাপ্ত কয়লার খনিতে মজুরদের হল স্ট্রাইক” (‘শেষ কথা’)।
এভাবে তাঁর কারণে অনেকে লেখেন - ‘নটিনী’ (শুদ্ধ: নটী), ‘কাঙালিনী’ (শুদ্ধ: কাঙালী), ‘অনাথিনী’ (শুদ্ধ: অনাথা), ‘নীলিমা’ (শুদ্ধ: নীলিম), সকৃতজ্ঞ, সকাতর, সশঙ্কিত, সলজ্জিত (“স্মিতহাস্যে নাহি চল সলজ্জিত বাসরশয্যাতে স্তব্ধ অর্ধরাতে”), ‘মন্থিত’ (শুদ্ধ: মথিত), ‘সৃজন’ (শুদ্ধ: সর্জন, সৃষ্টি), ‘নিরপরাধী’, ‘নিরপরাধিনী’ (শুদ্ধ: নিরপরাধ), ‘নিশি’ (শুদ্ধ: নিশা), ‘নিশীথ রাত্রি’ (নিশীথ অর্থ রাত, মধ্যরাত, অর্ধরাত, গভীর রাত) প্রভৃতি।
ক্রিয়াপদ ‘জাগ্রত’কে রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করেছেন বিশেষণ হিসেবে। ‘প্রশ্বাস’ অর্থে ‘নিশ্বাস’ ব্যবহার করেছেন - “... বুক ভরিয়া একটি মাত্র শেষ নিশ্বাস গ্রহণ করিয়া মরিতে পারি তাহা হইলেও জীবন সার্থক হয়” (‘গুপ্তধন’)। ‘চীর’ অর্থ জীর্ণবস্ত্র। অথচ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “কত শিক্ষা পৃথিবীর / খসে পড়ে জীর্ণচীর / জীবনের সনে,...” (‘মৃত্যুর পরে’)। ব্যাকরণসম্মত নয়, অনাভিধানিক অনেক শব্দ তিনি তৈরি করে নিয়েছেন কবিতায় নানা প্রয়োজনে। দাহনা, যামী, স্থকিত, স্পর্শন, উজ্জ্বালিত, মৈতালি, শিথিলিত  এগুলি কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। রবীন্দ্র-গবেষকদের ভাণ্ডারে আছে আরও অনেক কিছু। সেখান থেকে আহরণ করতে পারি আরও। তবে বানানের কথা কিছু বলা দরকার। এ নিয়ে লিখেছি অনেক। আজ সে সবের একটি সারসংক্ষেপ দিতে চাই।
এ প্রসঙ্গে দুই একাডেমি’র কথাই আসবে বেশি করে - ঢাকার বাংলা একাডেমী ও কলকাতার পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি’র। বাংলা লিপি, বানান ও অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে একাডেমী ও আকাদেমি’র চিন্তা ও উদযোগ, বলতে গেলে, প্রবাহিত হচ্ছে একই ধারায়। একাডেমী বলছে, “এ মুহূর্তে যা আশু প্রয়োজন তা হলো বাংলা লিপির নতুন ডিজাইন (সংস্কার নয়), যাতে সকল ব্যঞ্জন ও যুক্তব্যঞ্জনের সঙ্গে অভিন্ন চিহ্ন যুক্ত করা যায়।” আকাদেমি-ও মনে করে, “আধুনিক মুদ্রণে যেহেতু আর পূর্ব-থেকে-প্রস্তুত-করা ঢালাই হরফের প্রয়োগ বা ব্যবহার অপরিহার্য নয়, তাই হরফের সমতাবিধান বর্তমানে সম্ভব ও সংগত। কেবল সামান্য অভ্যাসেই তা চোখে মানানসই ও ব্যবহারে সন্তোষজনক হতে পারে।” তবে আকাদেমি যে লিপি গ্রহণ করেছে তার সঙ্গে একাডেমী’র নয় - বেশি মিল আমাদের পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের লিপি’র।
    অ-কারের স্বতন্ত্র চিহ্ন নেই বাংলায়। আকাদেমি বলছে, এর প্রয়োজন নেই বলে কোনও চিহ্ন উদ্ভাবনের কথা ভাবেন নি তাঁরা। এ নিয়ে কোনও ভাবনা একাডেমী’রও নেই। কিন্তু ‘প্রয়োজন নেই’? শ’-শ’ উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করা যাবে অ-কারের প্রয়োজন কত তীব্র। এখানে তিনটি উদাহরণই দিচ্ছি - ‘প্রস্তুত’ ও ‘বস্তুত’; ‘ক্রমশ’ ও ‘অবশ’; ‘পণ্ডিত’ ও ‘খণ্ডিত’। বানান এক রকম, উচ্চারণ অন্য রকম। অ-কার থাকলে কি সুবিধা হতো না?
    এছাড়া মান্য বাংলা উচ্চারণে অ্যা অন্যতম স্বতন্ত্র স্বরধ্বনি হলেও এর নিজস্ব বর্ণরূপ নেই কোনও। এরও প্রয়োজন অনুভব করে নি আকাদেমি, আর ভাবনাও ভাবে নি একাডেমী। কিন্তু অ্যা’র বর্ণরূপ, অ্যা-কারের স্বতন্ত্র চিহ্ন যে কত প্রয়োজন তা প্রমাণ করা যাবে অনেক উদাহরণ দিয়ে। এখানে একটিই দিচ্ছি - ‘ব্যাখ্যা’। এর উচ্চারণ কি? “ব্যা+খ্যা” না “ব্যাক্+খা”? আরও দেখুন ‘্যা’র ব্যাপারস্যাপার - ‘খ্যাত’, কিন্তু ‘বিখ্যাত’ (-ক্খ্যা-); ‘ধ্যান’, কিন্তু ‘অধ্যাদেশ’, ‘অধ্যাপক’, ‘অধ্যায়’ (-দ্ধা-)।
    রেফ থাকলে ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব হবে না কোথাও - এ ব্যাপারে কিন্তু আবার ক্ষমাহীন একাডেমী ও আকাদেমি। এমনকি কৃত্তিকা থেকে উৎপন্ন ‘কার্ত্তিক’ হবে কার্তিক, বৃদ্ধ থেকে ‘বার্দ্ধক্য’-ও হবে বার্ধক্য! আরও এমনকি ‘আচার্য্য’ পর্যন্ত হবেন আচার্য! এতে তো আচার্য্যদের প্রায় কেঁদে ফেলার যোগাড়। তাঁদের একজন লিখেছেন:
    “চর - চয়ন বা চলন রয় যাতে।
    চার - চর থেকে জাত।
    আচার - চার-এর আশ্রয় বা আচরণসমূহের আশ্রয় যাতে।
    আচার্য - আচার ধরা থাকে যাতে (অর্থাৎ কাগজ, বই)।
    আচার্য্য - আচার্য ধরা থাকে যাতে (অর্থাৎ সেই বই, নির্দেশাদি যিনি মুখস্থ রাখেন)।
    একটি য-ফলা পূর্ব অর্থকে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত করে দেয়। এখানে য-ফলাহীন আচার্যের অর্থ বই বা কাগজ এবং য-ফলা যুক্ত আচার্য্যরে অর্থ শিক্ষক।”
    এখানে প্রশ্ন: কার্ত্তিক, বার্দ্ধক্য, আচার্য্য প্রভৃতির শুদ্ধতার প্রতি এমন জবরদস্তির প্রয়োজন আছে কি? একাডেমী ও আকাদেমি তো বহু বানানেরই তো বিকল্প মেনে নিয়েছেন, ‘প্রচলন মেনে লেখা’র কথা বলেছেন, ‘অভ্যাসের মধ্যে এসে গেছে’ বলেও স্বীকার করে নিয়েছেন।
    ওদিকে উদ্যোগ ও উদ্যোগ - দু’ রকম বানান ও উচ্চারণ চায় একাডেমী ও আকাদেমি। কেবল উচ্চারণের কারণেই কি এই বোঝা বাড়ানো? আর কোনও প্রয়োজন আছে কি? একই ভাবে হাজারো পবিত্র-অপবিত্র যুক্তি দিয়ে ‘কি’ ও ‘কী’ চান তাঁরা।  যেন বাংলায় অসংখ্য সমোচ্চারিত ভিন্নার্থক শব্দ নেই, অভিন্ন বানান কিন্তু ভিন্ন অর্থের অজস্র উদাহরণ নেই! অব্যয় হলে ‘কি’, আর সর্বনাম, বিশেষণ, বিশেষণের বিশেষণ ও ক্রিয়াবিশেষণ হলে ‘কী’। আর কোথাও কি এমন হয়? ক্রিয়া, বিশেষণ বা বিশেষ্য রূপেও ‘কাটা’ থাকে ‘কাটা’। ‘কাঠ’ বিশেষ্য রূপেও কাঠ, বিশেষণ রূপেও কাঠ। এ রকম উদাহরণ অনেক - যেখানে কোনও সমস্যা হয় নি কিছুমাত্র। একাডেমী ও আকাদেমি’র কারণে আমাদের লিখতে হবে ‘কী রূপ’, কিন্তু ‘কিরূপে’। অথচ সংস্কৃত ‘কিম্’ থেকে প্রাকৃত ‘কিং’ হয়ে ‘কি’ হওয়ার দীর্ঘ পথে ‘কী’ নেই কোথাও। ‘বেশি জোর দিতে’ দীর্ঘ উচ্চারণে ‘কি’র ‘কী’ হওয়ার ব্যাখ্যা আছে ‘চলন্তিকা’য়। কিন্তু বেশি, কম-বেশি বা বেশি-বেশি জোর দেয়া বোঝাতে নতুন-নতুন বানান যদি অভিধানে ঠেসে দেয়া হয় - তাহলে কি অবস্থা দাঁড়াবে শেষ পর্যন্ত? আবার আছে ‘কি না’ (সংশয়, প্রশ্ন) এবং ‘কিনা’ (যেহেতু)। অবশ্য ‘কী’র উৎপাত নেই এখানে। কিন্তু আছে ‘এমনকি’ আর ‘এমন কী’। এখানে বিবেচনার বিষয় উচ্চারণে বল বা শ্বাসাঘাত! কোমলমতি নবীন শিক্ষার্থীদের কথা ভাবুন।
    সকল অ-তৎসম শব্দে ‘ই’ ও ‘উ’ এবং এদের -কার চিহ্ন (ি ও  ু) হবে - কিন্তু ‘গাভী, পরী, রানী’ অব্যাহত রাখতে চায় একাডেমী। তবে ‘ও’ ও ‘ও-কার’ নিয়ে খুব সমস্যা উভয়েরই। ‘অভ্যাসের মধ্যে এসে’ গেলেও তাঁরা ছোট, বড়, বড়দিন, ভাল, ভালবাসা, এগার, তের, চোদ্দ, পনের, ষোল, সতের, আঠার লিখতে চান না। আবার ‘এখনও, কখনও, আরও, আজও, আবারও’ লেখা গেলেও ‘কোনও’ লেখা যাবে না! বোঝা কমাবার নামে বাড়াবার কাজটা না করলেই কি নয়? ‘অর্থ অনুধাবনে ভ্রান্তি বা বিলম্ব’ ঘটার প্রশ্নে তো ‘বলল বলত বলব হল হত পৌঁছল’ প্রভৃতির াে-কার যুক্ত হওয়াই ভাল!
    আকাদেমি ‘মৌলানা’ চায়, তবে একাডেমী ‘মওলানা’ও চায় - যদিও ‘মাওলানা’র প্রচলনই বেশি। একই ভাবে ‘মওসুম’, ‘মওসুমি’ চালু হয়ে গেলেও তাঁরা ৗে-কার নিয়ে আছেন এখনও। ‘রাঙা, রঙিন, রঙের’ চাইলেও তাঁরা ‘রঙ’ চান না, ‘রং’ চান! আকাদেমি ‘জো’ চাইলেও একাডেমী ‘যো’-ও চায়। ওদিকে তাঁরা না চাইলেও ‘যোগ’ সূত্রে ‘যোগাড় যোগান’ এসে গেছে ‘অভ্যাসের মধ্যে’।
    ‘আযান ওযু কাযা নামায মুয়ায্যিন যোহর রমযান’ প্রভৃতি বানানে ‘কেউ ইচ্ছা করলে য-এর পরিবর্তে জ ব্যবহার করতে পারেন’ - এ মত একাডেমী দিলেও আকাদেমি বলেছে, “বাংলায় য দিয়ে ত উচ্চারণ বোঝানোর রীতি মান্যতা পায়নি, তাই এই রীতি গ্রহণযোগ্য হয়নি।”
    “বিদেশী শব্দের বানানে যুক্তবর্ণকে বিশি¬ষ্ট করার প্রবণতা” সম্পর্কে  একাডেমী আশঙ্কা প্রকাশ করলেও সমর্থনও দিয়েছে কিছু। ‘অকটোবর ইসরাফিল মার্কস সেপটেম্বর’ প্রভৃতি বানান মেনেছে, কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামের ‘মাদরাসা’ মানতে চায় নি। বলেছে, ওটা ‘মাদ্রাসা’। ওর উচ্চারণ ‘মাদ্দ্রাসা’! আকাদেমি-ও মানতে রাজি নয় ‘উরদি উরদু ওসতাদ কারতুজ গরদান গিরজা জরদা জারমানি তুরকি পরদা মারকিন মারকেট সরদার’ প্রভৃতি বানান। তাঁরা চান রেফ।
    ‘না নি নে’র মধ্যে ‘নে’ নিয়ে মাথাব্যথা নেই একাডেমীর। এর ব্যবহার নেই বুড়িগঙ্গা-পাড়ে। আকাদেমি বলেছে ‘নি’ যুক্ত থাকবে ক্রিয়ারূপের সঙ্গে, ‘না’ পৃথক থাকবে। তবে অনুরোধে, আহলাদে যুক্ত হবে (‘যাওনা, বলোনা, দেখোনা’)। একাডেমী দু’টিকেই পৃথক রাখার পক্ষে। রবীন্দ্রনাথও তা-ই ছিলেন। মনে হয় ‘তো’ নিয়েও কিছু একটা করতে হবে তাঁদের।
    সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মে অনেক শব্দ ি থেকে ী, আবার -িকারে ফিরে যায়। যেমন - মন্ত্রিন্, গুণিন্, একাকিন্> মন্ত্রী, গুণী, একাকী > মন্ত্রিসভা, গুণিজন, একাকিত্ব প্রভৃতি। এই একই শব্দের দু’ রকম বানান থেকে বাঁচতে  ী-কারান্তগুলোকে বাংলা শব্দ ধরে নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে আকাদেমি। তারপরও দেখছি দু’ রকম বানান - মন্ত্রীগণ / মন্ত্রিগণ; মন্ত্রীপরিষদ / মন্ত্রিপরিষদ; মন্ত্রীবৃন্দ / মন্ত্রিবৃন্দ; মন্ত্রীসভা / মন্ত্রিসভা ইত্যাদি। তবে ‘মন্ত্রীত্ব’ নয়, ‘মন্ত্রিত্ব’। একাডেমী ‘মন্ত্রীদের’ ও ‘মন্ত্রীরা’ পর্যন্ত সহ্য করে, তারপর সব ।ি ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রতিযোগিতা, স্থায়িত্ব’ ইত্যাদি যে কবে বাংলা হবে, বাংলায় ‘প্রতিদ্বন্দ্বীতা প্রতিযোগীতা স্থায়ীত্ব’ হবে কে জানে!
কাজটা সহজ হবে না খুব। হবে না নানা কারণেই। আগে যে ‘আচার্য্য’র উল্লেখ করেছি সেই ‘আচার্য্য’ অমরেন্দ্র গণাই লিখেছেন - “বাঙলা ভাষা বর্ণার্থমূলক বহু অর্থধারী সংস্কৃত’র উত্তরাধিকারী। বিদ্যার নামে কিছু লাঠিয়াল একে ভাঙতে চাইছে। এর চেয়ে বড় অন্তর্ঘাত আর কি হতে পারে? বাঙলা ভাষা সরকারের তৈরি করা তথাকথিত কয়েকজন ভণ্ড’র মাতৃভাষা নয় - ২৫ কোটি মানুষের মাতৃভাষা। ওপার বাঙলা জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে মাতৃভাষার প্রতিষ্ঠা করে গেছে! ২৫ কোটি বাঙলাভাষীর আত্মসম্মান ও নাড়ির যোগকে যারা ধুলোয় মিশিয়ে দিতে চাইছে, ইতিহাস কখনও তাদের ক্ষমা করবে না।”
আচার্য্য গণাই-এর ‘উত্তরাধিকার’-তত্ত্বটি যা-ই হোক ‘লাঠিয়াল’দের ব্যাপারটা বুঝতে পারি বেশ। আকাদেমি অবশ্য বলেছে, “... এগুলিকে পুরোপুরি পছন্দ করবেন না, এমন দু-চারজন জেদি ও প্রত্যয়বান মানুষ থাকতেই পারেন। কিন্তু এঁরা সমস্যা নন।” এ ধারণাটি সমন্বয়বিরোধী। সমাজে বড় শক্তি হিসেবে ‘লাঠিয়াল’ নয়, ওই ‘জেদি ও প্রত্যয়বান’ মানুষই দেখা দেন শেষ পর্যন্ত।
সমালোচক-গবেষক পাঁচুগোপাল বক্সি লিখেছেন, “অনুভূতির তীব্রতা, রসসৃষ্টির সামর্থ্য তথা কবিত্বগুণের অভাব উদ্ভট চিত্রকল্প, অলঙ্কারবাহুল্য বা বাকচাতুরির আড়ম্বরে ঢাকা যায় না। মুখ আর মুখোশের পার্থক্যটা মনে পড়িয়ে দিয়ে কবি (রবীন্দ্রনাথ) মহাপ্রয়াণের প্রায় সাড়ে সাত মাস আগে... আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন: ‘মানুষের কবিত্বই হবে শেষে কলঙ্কভাজন অসংস্কৃত যদৃচ্ছের পথে চলি’।” (‘অরাবীন্দ্রিক রবীন্দ্রনাথ’, কলকাতা, ২০০৭)



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন