শনিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১২

ফিরে দেখা ২০১২

বছর শেষে পিছন ফিরে তাকাতে গিয়ে প্রথমেই মনের পরদায় ভেসে ওঠে হারিয়ে যাওয়া কাছের মানুষ, প্রিয় মানুষগুলোর মুখ। মনে পড়ে কত কথা। কত স্মৃতি। একটা হু-হু দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুক ভেদ করে। ভাবি, এই তো ছিলাম এক সঙ্গে... কথা বলেছি, হাসি-ঠাট্টায় মেতেছি, দুঃখ-অভিমানও করেছি। কখনও মনে হয়নি বিচ্ছেদ ঘটবে তাঁদের সঙ্গে, কিন্তু সত্যিই তো চোখের আড়াল হয়েছেন রাজনীতিবিদ শামসুর রহমান খান শাহজাহান (২রা জানুয়ারি), ছড়াকার-সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ (২০শে ফেব্রুয়ারি), সাংবাদিক বাহাউদ্দিন চৌধুরী (১৬ই মে), কবি কবিরুল ইসলাম ও জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ (১৯শে জুলাই), কথাশিল্পী সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ (৪ঠা সেপ্টেম্বর), সাংবাদিক আতাউস সামাদ (২৬শে সেপটেম্বর), কবি বাসুদেব দেব (৯ই অক্টোবর), বহুমাত্রিক লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (২৩শে অক্টোবর), চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত (১৬ই নভেম্বর), কবি অর্ধেন্দু চক্রবর্তী (২৫শে নভেম্বর)... আরও কত ভাললাগা মানুষ। এ পর্যন্ত লিখতেই খবর এলো আরও এক প্রিয় শিল্পীর চিরবিদায়ের খবর। নজরুলগীতির নন্দিত গায়ক সোহরাব হোসেন আর নেই (২৭শে ডিসেম্বর)। খবরটা শুনতেই কানে ভেসে আসে তাঁর মধুকণ্ঠের গান। মনে পড়ে সংগীত জগতের আরও দুই নক্ষত্রকে হারিয়েছি এই বিদায়ী বছরে। সুরকার-সংগীত পরিচালক রবি (৭ই মার্চ) ও মেহেদি হাসান (১৩ই জুন)-এর কথা বলছি। তারা হারালেও তাদের গান কি হারাবে কখনও? না। আমাদের হারিয়ে যাওয়ার পরেও তাদের গান থেকে যাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। এখানে যাদের কথা বললাম এরা সকলেই কৃতিত্বে কীর্তিতে অমর হয়ে থাকবেন সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে। তাদের মনে রাখবে দেশ, সম্মান শ্রদ্ধা জানাবে আন্তর্জাতিক বিদগ্ধ মহল। তবে আমি আরও দু’জনকে আজ স্মরণ করতে চাই বিশেষ করে। তারা খ্যাতিমান কেউ নন, বরণীয় স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব নন, হতেও চাননি... সাধারণ মানুষের মতোই বেঁচে থেকে নীরবে চলে গেছেন এই বিদায়ী বছরে। তবে চরিত্রে অসাধারণত্ব ছিল তাদের। যথাসময়ে যথাভূমিকা রাখার মতো মহিমাও ছিল। সে প্রমাণ রেখেছেন তারা। তখন বড় দুঃসময়। উনিশ শ’ একাত্তর। হানাদার পাকিবাহিনীর হত্যাবিভীষিকা দেশজুড়ে। তাদের দোসর ঘাতক দালালদের রক্তচক্ষু আরও ভয়ঙ্কর। অবরুদ্ধ শহরে উদ্যত সঙ্গীনের নিচে জীবন। যখন তখন হুমকিধমকি, ধরপাকড়, খুনজখম। হঠাৎ করে হামলা, পাকড়াও। তারপর বন্দিশিবিরে বধ্যশিবিরে নৃশংস মৃত্যু। কেউ কোনও মতে ধুঁকে-ধুঁকে প্রাণটা নিয়ে ফিরে আসে নানা তদবির, কাকুতি-মিনতি, অনুনয়-বিনয়, ক্ষমাভিক্ষা করে... কিন্তু ফেরে না অনেকেই। আটক হয়ে, নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়ে, ক্ষতবিক্ষত দেহে, চরম লাঞ্ছনা-গঞ্জনা ও অপমান-অসম্মানের মধ্যে তখন অবরুদ্ধ শহর টাঙ্গাইলে চরম পরিণতির প্রতীক্ষা করছি আমরা- গোলাম আম্বিয়া নূরী, আখতার বোখারী, আনোয়ার বখশ, মোয়াজ্জেম হোসেন, এস এম রেজা, আবদুর রহমান রক্কু, নূরুন্নবী মাস্টার, খন্দকার বাবুল চৌধুরী, আমি ও আরও ক’জন। এদের মধ্যে ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন আনোয়ার বখশ (এখন আওয়ামীলীগের নেতা) ও মোয়াজ্জেম হোসেন (প্রয়াত), ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন এস এম রেজা (প্রয়াত) ও আবদুর রহমান রক্কু (পরে খ্যাতিমান নাট্যজন, প্রয়াত), শিবনাথ হাইস্কুলের শিক্ষক নূরুন্নবী মাস্টার ছিলেন ন্যাপ-নেতা। গোলাম আম্বিয়া নূরী এখন খ্যাতিমান নাট্যকার, খন্দকার বাবুল চৌধুরী বিএনপি’র নেতা। শহরে তখন প্রায়ই চোরাগোপ্তা অপারেশন চলে কাদেরিয়া বাহিনীর। এক-একটি অপারেশনের পর পাকিরা পাকড়াও করে কয়েকজন করে কিশোর-তরুণকে, চলে অত্যাচার-নির্যাতন, হত্যাও। কিন্তু বন্ধ হয় না অপারেশন। তখন পাকিরা বলে, পাড়ায়-পাড়ায় পাহারা দাও। কোনও বোমা যেন না ফাটে, গুলি যেন না চলে। চললেই তোমাদের কল্লা ঘ্যাচাং। ওই সময় আমাদের আকুরটাকুর পাড়ায় অসীম সাহস ও ঝুঁকি নিয়ে যারা রাত জেগে পাহারার ব্যবস্থা করেছিলেন তাদের একজন আমার প্রতিবেশী খাজা মিঞা। আমি ডাকতাম খাজা কাকা বা খাজাক্কা বলে। পাড়ার কিশোর তরুণ যুবকদের তিনি একত্রিত করেছিলেন এ কাজে। সে তরুণদের একজন আলমগীর। আমার কলেজ-জীবনের বন্ধু জাহাঙ্গীরের ছোট ভাই, স্বাধীনতার পর আমার ছাত্র। রেজাউল হাসান বাবুল (সাংবাদিক, বর্তমানে মার্কিন প্রবাসী), ইকবাল হাসান (স্বাধীনতার পর গুম) এবং আরও অনেকের সঙ্গে তারা দু’জন সময়োপযোগী ভূমিকা রাখায় সেই মৃত্যুভয়াল দুঃসময়ে আর কোনও মৃত্যু হানা দেয়নি আমাদের পাড়ায়। এ কৌশল পরে অন্যান্য পাড়াও গ্রহণ করে সমর্থ হয় আত্মরক্ষায়। ফলে শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের আসা-যাওয়া, আশ্রয় নেয়া, খবর সংগ্রহ, অপারেশন চালানো সহজ হয় অনেকখানি। বিদায়ী বছরে হারিয়েছি প্রিয় খাজাক্কাকে, স্নেহের আলমগীরকে। বিপদে পাশে থাকার ভূমিকা নিয়ে তারা যে অবদান রেখেছেন তা যেন পাড়ার আমরা কেউ ভুলে না যাই কখনও। একাত্তরের আক্রান্ত জনপদে আরও অনেকে নিশ্চয়ই এমন মমতাময় ভূমিকা রেখেছেন তাদের মতো। তাদেরও স্মরণ করি আজ।
sazzadqadir@gmail.com

বৃহস্পতিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১২

লাভ কি সরকারের?

সরকার আসে, যায়। নতুন সরকার গালমন্দ করে অতীত সরকারকে। আগামী সরকারও গালমন্দ করবে এ সরকারকে। তাঁরা সরকারি কাজ বলে যে সব দরকারি কাজ করেন তাতে হেরফের হয় না তেমন কিছু। রঙ বদলায়, চেহারা বদলায়, আওয়াজ বদলায় - এই যা। সেই ষাটের দশক থেকে দেখে আসছি, দেখছি এখনও। নিশ্চিত জানি, আমাদের পরের প্রজন্মগুলোও দেখে যাবে এ সবই।
    সরকারি দলের প্রথম কাজ দলীয়করণ। দলের লোক ছাড়া তাঁদের আদর্শ উদ্দেশ্য লক্ষ্য কর্মসূচি অঙ্গীকার বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলেই এটা খুব জরুরি। তবে বিরোধী দলে থাকাকালে প্রশাসন, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা, আইন-শৃঙ্খলা, বিচার, শিক্ষা, সংস্কৃতি প্রভৃতি বিভাগে নিরপেক্ষতা এবং বেতার-টিভি, একাডেমি, ইনস্টিটিউট প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে স্বায়ত্তশাসন দাবি করলেও সরকার গঠনের পর ওগুলোতেই শুরু হয় সবচেয়ে বেশি হস্তক্ষেপ। দেয়া হয় দলীয় ও অন্যবিধ বিবেচনায় নিয়োগ। যাচাই হয় না প্রকৃত দক্ষতা ও যোগ্যতা। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রয়োজন সুপরিচিত ও মেধাবী ব্যক্তি। সেখানে প্রধান বিবেচ্য আনুগত্য, তদবির, কানেকশন ও অন্যান্য লেনদেন। এ সব কারণে সরকারি বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানের কাজকর্ম কিভাবে কি চলছে তা জানেন সবাই। ‘সরকারি মাল দরিয়া মে ডাল’ কথাটা তো সেই আদ্যিকাল থেকেই চালু - এখন বেপরোয়া দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থার কারণে প্রতিদিনই বেড়ে চলে সরকারের বিপুল সুখ্যাতি। বেতার-টিভি ও অন্যান্য প্রচার-প্রকাশ প্রতিষ্ঠানে দলের লোকজন দু’ হাত খুলে লেখে, গলা ফাটিয়ে চেঁচায়, দিন-রাত বক-বক করে - কেউ শোনে না, দেখে না, পড়ে না ও সব, বিশ্বাসও করে না। বরং ভাবে, সরকারের কি লাভ এ সব করে?
    বলা হয়, বিচারক শিক্ষক শিল্পী সাহিত্যিক সাংবাদিক পুলিশ দলীয় হয়ে গেলে দেশের মানুষের দাঁড়াবার জায়গা থাকে না আর। সব দলই বলে এ কথা। সরকারে যাওয়ার পরেও বলে। কিন্তু করে কি কাজটা?
    দুর্মুখেরা বলে, সরকারি দল যত ভাল কথা বলে তত খারাপ কাজ করে। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিকতা নিয়ে চাপাবাজি করে শত মুখে, কিন্তু তাদের দলেই নেই গণতন্ত্র। ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে বসে থাকে, কিন্তু ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না কোথাও। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির কথায় মুখে ফেনা উঠে যায় নেতাদের, কিন্তু সরকারের প্রেসনোট, বিবরণী, বিবৃতি, বিজ্ঞপ্তি, ভাষ্য বিশ্বাস করে না কেউ। মিথ্যাচার, ধামাচাপা, আড়াল করা, এড়িয়ে যাওয়া ইত্যাদিতে তাঁদের জুড়ি মেলা ভার। চাঁদাবাজি, লুটপাট, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, খুনোখুনি ইত্যাদিতে দলের লোক জড়িত থাকলে সরকারের মুখ দিয়ে কি সব কথা বেড়ায় তা সকলেরই প্রায় মুখস্থ। টেলিভিশনে সে সব গৎবাঁধা কথার সঙ্গে মিলিয়ে কথা বলতে পারেন দর্শকেরা। অনেক দর্শক পারেন আগে-আগে বলতে। প্রথমত বলা হবে, ‘এখনও জানি না, জেনে বলবো।’ এর পর বলা হবে, ‘রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে, রিপোর্ট আসে নি এখনও।’ পরে বলা হবে, তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এখন কিছু বলা যাবে না, এতে তদন্ত প্রভাবিত হতে পারে। তাই বলে বলা-কওয়া থামবে না একটুও। পুলিশ বলবে, দুষ্কর্মের জন্য কারা দায়ী জানা যায় নি তা। প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশেরা বলবে, চিনতে পারি নি দুর্বৃত্তদের। মামলা হবে আসামিদের অজ্ঞাত উল্লেখ করে। ফরেনসিক ডাক্তার বলবেন, হত্যা নয় আত্মহত্যা বা অন্য কিছু। মন্ত্রী বলবেন, আমাদের দলের কেউ নয় ওরা। অনুপ্রবেশকারী। নাশকতাবাদী। ওদিকে মিডিয়ায় জানাজানি হয়ে গেছে সব। ভিডিও ফুটেজে, ছবিতে শনাক্ত হয়েছে অপরাধীদের নাম ধাম পরিচয়। কিন্তু সরকারের কাছে তারা অনুপ্রবেশকারী এজেন্ট। কিন্তু কোন দলে ‘কনভার্ট’ নেই? ‘স্টলওয়ার্ট’দেরই বরং খোঁজ মেলে না বড়-বড় দলে। প্রায়ই তো অমুক দলের অত জনের অমুক দলে যোগদানের সচিত্র খবর পড়ি পত্রিকায়। সেখানে একটি বিচিত্র ব্যাপার দেখতে পাই প্রায়ই। যোগদানকারীদের যেখানে ফুল দিয়ে বরণ করে নেয়ার কথা, সেখানে তাঁরাই ফুলের বিশাল তোড়া-গুচ্ছ নিয়ে এসে তুলে দেন নেতা-নেত্রীদের হাতে।
    সরকারের চিরশত্রু মিডিয়া। আর বিরোধীরা তো আছেই। তাদের বিরোধিতা সরকারের কাছে সরকার-বিরোধিতা নয়, দেশ জাতি সমাজের বিরোধিতা। এমনকি দেশদ্রোহ, রাষ্ট্রদ্রোহ। তবে অনুগত বিরোধীও আছে। প্রয়োজনে তাদের মাঠে নামায় সরকার। নানা কর্মসূচি পালন করায় নানা উদ্দেশ্য হাসিলের মতলবে। তাদের সহযোগিতা সহায়তা পৃষ্ঠপোষকতা করে সর্বতোভাবে। নিজেদের কোলে ঝোল টানার জন্য এ রকম আরও অনেক কাজ সরকারি দলগুলো করে আসছে জেনেশুনেই। কিন্তু পাবলিক সবজান্তা হলেও যে প্রশ্নের উত্তর জানে না তা হলো,  ‘এ সব করে লাভ কি সরকারের?’
sazzadqadir@gmail.com

শনিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১২

বিজয়ের সুফল, হিসাবের পাওনা

পালন-উদযাপনের জন্য উপলক্ষ আছে আমাদের অনেক। উৎসব, দিবস, মাস আছে বছর জুড়ে। ধর্মীয় ও জাতীয় উৎসব আছে। আন্তর্জাতিক, জাতীয়, স্থানীয়, আঞ্চলিক দিবস আছে। তবে পালন-উদযাপনের মাস সবই আমাদের নিজস্ব। জাতীয়। ফেব্রুয়ারি ভাষার মাস, মার্চ স্বাধীনতার মাস, আগস্ট শোকের মাস, ডিসেম্বর বিজয়ের মাস। শোকের মাসে দলীয় প্রাধান্য থাকলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে তা নিয়ে বিতর্ক নেই কোনও। এসব উপলক্ষ-আয়োজন নিয়ে বিশ্বের সর্বত্র যা হয় আমরাও ব্যতিক্রম নই তার। আনুষ্ঠানিকতা ক্রমে ক্রমে গ্রাস করে এই স্মৃতিবাহী ঐতিহ্যগুলোকে। দেখা দেয় প্রাণহীন অন্তঃসারশূন্য অনুষ্ঠানসর্বস্বতা। বাড়ে দায়সারাভাবে পালনের প্রবণতা। বেদনা বা উচ্ছ্বাস সবই যেন হয়ে পড়ে কৃত্রিম। লোকদেখানো। মতলবি। তবে উদ্যোগ-আয়োজনে খামতি থাকে না মিডিয়ার কল্যাণে। তারা পাল্লা দিয়ে নেমে পড়ে সরব সোচ্চার প্রতিযোগিতায়। মাতে জমজমাট জৌলুষে জমকালো জেল্লাইয়ে। নেপথ্যে থাকে প্রচার-বিজ্ঞাপনের ইঁদুরদৌড়। থাকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নানা ব্যবসায়িক কামাই-কৌশল। এ ছাড়া রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব প্রতিষ্ঠা-প্রতিপত্তির ধুন্ধুমার লড়াই চলে ক্ষমতাবলয়ে। সুবিধা পেতে কে কাকে ল্যাং মেরে এগিয়ে যাবে এই সুযোগে - সে কোন্দল-কাড়াকাড়িও হয়ে ওঠে বিকট বিটকেল। তখন দেখি ভক্তির চেয়ে আড়ম্বর বেশি, কীর্তির চেয়ে কীর্তন অধিক, শাসনের চেয়ে ভাষণ ভূরি-ভূরি, কাব্যের চেয়ে বাক্য অজস্র। ভাষার মাসে অনেক ভাষণ শোনা যায় - কিন্তু অশিক্ষা-কুশিক্ষার প্রভাবে ভাষার যে বিকৃতি চলছে, সাহিত্য যে সস্তা হয়ে উঠছে সে কথা বলেন না কেউ। শিল্প-সাহিত্যের কাজ যেন স্রোতে ভাসা - এটাই যেন ভাষার মাসের শিক্ষা। একই ভাবে স্বাধীনতা ও বিজয়ের মাসে স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুফল ঘরে-ঘরে পৌঁছে দেয়ার কথা বললেও তা নিজেদের ঘরে-ঘরে তোলার আয়োজনই দেখা যায় সর্বত্র। তখন দেখেছি ভূয়াদের দৌরাত্ম্য, এখন দেখছি ধূর্ত ধান্দাবাজদের দাপট। তাহলেও এসব উৎসবের মাহাত্ম্য, দিবসের তাৎপর্য, মাসের মহিমা এখনও ম্লান হয়ে যায়নি একেবারে, এখনও তা আনন্দ ও প্রত্যাশার আলো হয়ে আছে আমাদের জীবনে। তাই একুশ এলেই জেগে উঠি মাথা নত না করার আহ্বানে, মার্চে গৌরব করি ত্যাগ-তিতিক্ষায় স্বপ্ন-সাধনায় পাওয়া স্বাধীনতার, শোকের আগস্টে দেখি শক্তি সঞ্চয়ের জাগরণ, বিজয়ের আনন্দে দেখি বীরের রক্তস্রোত আর মায়ের অশ্রুস্রোতের ছবি। তাই বলি, এত হত্যা, লুণ্ঠন, ধ্বংস, অত্যাচার-নির্যাতনের পর পাওয়া এই বিজয়কে যেন ভুলে না যাই এই বিজয়ের মাসে, যেন মনে থাকে সে সব রক্তক্ষয়ী যুদ্ধদিনের কথা। যারা লড়েছেন, প্রাণ দিয়েছেন, নিপীড়ন সয়েছেন, লাঞ্ছনা-গঞ্জনার শিকার হয়েছেন - তাদের যেন স্মরণ করি। বিজয়ের সুফল এখনও ভাগ করে নেয়া বাকি। এখনও হিসাবের পাওনা পায়নি নিরানব্বই জন। আজও পথে-ফুটপাথে দেখি নিরাশ্রয় মানুষ, রাত জেগে শুনি ক্ষুধার্ত শিশুর কান্না। আজও নারীরা নিয়ত নির্যাতনের শিকার, প্রকাশ্যে চলে লুটেরা-সন্ত্রাসীদের উল্লাস-নৃত্য, দুর্নীতি ক্রমশ বেপরোয়া, অনৈতিকতা দিনে দিনে উদ্ধত ও দুর্বিনীত। প্রশ্ন জাগে, বিজয়ের সুফল কি তবে এই?

sazzadqadir@rediffmail.com