শনিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১২

বিজয়ের সুফল, হিসাবের পাওনা

পালন-উদযাপনের জন্য উপলক্ষ আছে আমাদের অনেক। উৎসব, দিবস, মাস আছে বছর জুড়ে। ধর্মীয় ও জাতীয় উৎসব আছে। আন্তর্জাতিক, জাতীয়, স্থানীয়, আঞ্চলিক দিবস আছে। তবে পালন-উদযাপনের মাস সবই আমাদের নিজস্ব। জাতীয়। ফেব্রুয়ারি ভাষার মাস, মার্চ স্বাধীনতার মাস, আগস্ট শোকের মাস, ডিসেম্বর বিজয়ের মাস। শোকের মাসে দলীয় প্রাধান্য থাকলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে তা নিয়ে বিতর্ক নেই কোনও। এসব উপলক্ষ-আয়োজন নিয়ে বিশ্বের সর্বত্র যা হয় আমরাও ব্যতিক্রম নই তার। আনুষ্ঠানিকতা ক্রমে ক্রমে গ্রাস করে এই স্মৃতিবাহী ঐতিহ্যগুলোকে। দেখা দেয় প্রাণহীন অন্তঃসারশূন্য অনুষ্ঠানসর্বস্বতা। বাড়ে দায়সারাভাবে পালনের প্রবণতা। বেদনা বা উচ্ছ্বাস সবই যেন হয়ে পড়ে কৃত্রিম। লোকদেখানো। মতলবি। তবে উদ্যোগ-আয়োজনে খামতি থাকে না মিডিয়ার কল্যাণে। তারা পাল্লা দিয়ে নেমে পড়ে সরব সোচ্চার প্রতিযোগিতায়। মাতে জমজমাট জৌলুষে জমকালো জেল্লাইয়ে। নেপথ্যে থাকে প্রচার-বিজ্ঞাপনের ইঁদুরদৌড়। থাকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নানা ব্যবসায়িক কামাই-কৌশল। এ ছাড়া রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব প্রতিষ্ঠা-প্রতিপত্তির ধুন্ধুমার লড়াই চলে ক্ষমতাবলয়ে। সুবিধা পেতে কে কাকে ল্যাং মেরে এগিয়ে যাবে এই সুযোগে - সে কোন্দল-কাড়াকাড়িও হয়ে ওঠে বিকট বিটকেল। তখন দেখি ভক্তির চেয়ে আড়ম্বর বেশি, কীর্তির চেয়ে কীর্তন অধিক, শাসনের চেয়ে ভাষণ ভূরি-ভূরি, কাব্যের চেয়ে বাক্য অজস্র। ভাষার মাসে অনেক ভাষণ শোনা যায় - কিন্তু অশিক্ষা-কুশিক্ষার প্রভাবে ভাষার যে বিকৃতি চলছে, সাহিত্য যে সস্তা হয়ে উঠছে সে কথা বলেন না কেউ। শিল্প-সাহিত্যের কাজ যেন স্রোতে ভাসা - এটাই যেন ভাষার মাসের শিক্ষা। একই ভাবে স্বাধীনতা ও বিজয়ের মাসে স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুফল ঘরে-ঘরে পৌঁছে দেয়ার কথা বললেও তা নিজেদের ঘরে-ঘরে তোলার আয়োজনই দেখা যায় সর্বত্র। তখন দেখেছি ভূয়াদের দৌরাত্ম্য, এখন দেখছি ধূর্ত ধান্দাবাজদের দাপট। তাহলেও এসব উৎসবের মাহাত্ম্য, দিবসের তাৎপর্য, মাসের মহিমা এখনও ম্লান হয়ে যায়নি একেবারে, এখনও তা আনন্দ ও প্রত্যাশার আলো হয়ে আছে আমাদের জীবনে। তাই একুশ এলেই জেগে উঠি মাথা নত না করার আহ্বানে, মার্চে গৌরব করি ত্যাগ-তিতিক্ষায় স্বপ্ন-সাধনায় পাওয়া স্বাধীনতার, শোকের আগস্টে দেখি শক্তি সঞ্চয়ের জাগরণ, বিজয়ের আনন্দে দেখি বীরের রক্তস্রোত আর মায়ের অশ্রুস্রোতের ছবি। তাই বলি, এত হত্যা, লুণ্ঠন, ধ্বংস, অত্যাচার-নির্যাতনের পর পাওয়া এই বিজয়কে যেন ভুলে না যাই এই বিজয়ের মাসে, যেন মনে থাকে সে সব রক্তক্ষয়ী যুদ্ধদিনের কথা। যারা লড়েছেন, প্রাণ দিয়েছেন, নিপীড়ন সয়েছেন, লাঞ্ছনা-গঞ্জনার শিকার হয়েছেন - তাদের যেন স্মরণ করি। বিজয়ের সুফল এখনও ভাগ করে নেয়া বাকি। এখনও হিসাবের পাওনা পায়নি নিরানব্বই জন। আজও পথে-ফুটপাথে দেখি নিরাশ্রয় মানুষ, রাত জেগে শুনি ক্ষুধার্ত শিশুর কান্না। আজও নারীরা নিয়ত নির্যাতনের শিকার, প্রকাশ্যে চলে লুটেরা-সন্ত্রাসীদের উল্লাস-নৃত্য, দুর্নীতি ক্রমশ বেপরোয়া, অনৈতিকতা দিনে দিনে উদ্ধত ও দুর্বিনীত। প্রশ্ন জাগে, বিজয়ের সুফল কি তবে এই?

sazzadqadir@rediffmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন