বৃহস্পতিবার, ২২ নভেম্বর, ২০১২

‘সর্বশক্তিমান যোদ্ধা’

আসল নাম একটা থাকে সকলেরই, তারপরও থাকে আরও নাম। লেখক-নাম, ছদ্মনাম, তারকা-নাম। তাই শেখ আজিজুর রহমান হন শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান হন মৈনাক, ঝরনা বসাক হন শবনম। এছাড়া বিয়ে বা ধর্মীয় বা সাংগঠনিক কারণে নাম বদলে যায় অনেকের। বিশেষ করে বিয়ের পর অনেক মহিলা তাঁর স্বামীর নাম বা উপাধি যুক্ত করেন নিজের নামের সঙ্গে। এভাবেই হয়েছে ‘সুফিয়া এন হোসেন’ ও ‘সুফিয়া কামাল’ নাম। অনেকে পিতার নাম বা উপাধিও রেখে দেন নামে। যেমন, শেখ হাসিনা ওয়াজেদ। তবে আমি অন্তত একজন পুরুষকে জানি তিনি স্ত্রীর নাম যুক্ত করেছেন নিজের নামের সঙ্গে। সন্তানের নামের সঙ্গে পিতার নাম বা উপাধিই যুক্ত হয় সাধারণত। অনেকে যুক্ত করেন মায়ের নামও। যেমন, বিখ্যাত সাংবাদিক ও বৃটিশ কমিউনিস্ট পারটি’র তাত্ত্বিক রজনী পাম দত্ত (১৮৯৬-১৯৭৪)। তাঁর পিতার নাম উপেন্দ্র দত্ত, মায়ের নাম আনা পাম। এ রকম আরও উদাহরণ ড্যানিয়েল ডে-লুইস, হেলেনা বনহ্যাম-কারটার, সঞ্জয় লীলা বনশালি। সন্ন্যাস বা অন্য কোনও ব্রত গ্রহণের কারণে নতুন নাম রাখা হয় বিভিন্ন সম্প্রদায়ে। যেমন, বীরেশ্বর তথা নরেন্দ্রনাথ দত্ত হয়েছেন স্বামী বিবেকানন্দ। মিস মারগারেট নোবল হয়েছেন ভগিনী নিবেদিতা।
    তবে অনেকের নামের আগেও থাকে বিশেষ এক নাম। রাজনীতিক, সাহিত্যিক, বিনোদন-তারকা প্রমুখের ক্ষেত্রে তা হয়ে ওঠে উপাধির মতো। আসল নাম ছাড়িয়ে সে নাম বহু ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা পায় সম্বোধনে। এ সব নাম আসে দল, সমর্থক, গুণগ্রাহী, মিডিয়া বা অন্যান্য উৎস থেকে। নিজেরাও এসব ‘টাইটেল’ ম্যানেজ করে নেন নানাভাবে।
    ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথকে গান্ধী ‘গুরুদেব’ সম্বোধন করার পর রবীন্দ্রনাথ আত্মজীবনীতে তাঁকে ‘মহাত্মা’ বলে উল্লেখ করেন বলে জানা যায়। সেই থেকে ‘মহাত্মা গান্ধী’ বলা ও লেখা শুরু বলে দাবি করেন অনেকে। আর রবীন্দ্রনাথ ‘গুরুদেব’ ছাড়াও সম্বোধিত হন ‘কবিগুরু’, ‘বিশ্বকবি’, ‘ঋষি’ হিসেবে। তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্মানিত হতেন ‘মহর্ষি’ নামে। ওই সময়ে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ‘রাষ্ট্রগুরু’, চিত্তরঞ্জন দাশ ‘দেশবন্ধু’, জগদীশচন্দ্র বসু ‘বিজ্ঞানাচার্য’, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ‘বেঙ্গল টাইগার’ বা ‘বাংলার বাঘ’। বাঘ, শার্দুল প্রভৃতি ছিলেন আরও। তবে শেরে বাংলা বলতে এখন একজনই - এ কে ফজলুল হক। ১৯৩৮ সালে মোহাম্মদ আলি জিন্নাহকে ‘কায়েদে আজম’ উপাধিতে ভূষিত করেন দিল্লি’র ‘আমান’ পত্রিকার সম্পাদক মওলানা মজহারউদ্দিন শহিদ। এ দাবি লাহোরের মিয়া ফিরোজউদ্দিন আহমদের পরিবারও করে থাকে। ওদিকে জওয়াহরলাল নেহরু’র পরিচিতি ‘পণ্ডিত’ উপাধিতে। আমাদের মওলানা ভাসানী ‘মজলুম জননেতা’। ১৯৬৯ সালের ২৩শে ফেবরুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ওই অনুষ্ঠানমঞ্চে উপস্থিত ছিলাম আমিও। পরে তাঁকে ভূষিত করা হয়েছে ‘জাতির জনক’ ‘জাতির পিতা’ উপাধিতে। এখন আমাদের আছেন বঙ্গতাজ, দেশরত্ন, জননেত্রী, গণতন্ত্রের মানসকন্যা, দেশনেত্রী, আপসহীন নেত্রী, পল্লীবন্ধু, বঙ্গবীর ও আরও অনেকে।
সাহিত্যে আছেন মহাকবি, বিদ্রোহী কবি, পল্লীকবি, ঐতিহ্যের কবি, প্রধান কবি এবং সব্যসাচী, বহুমাত্রিক, বিতর্কিত, প্রথাবিরোধী, নন্দিত লেখক। উপাধি নিয়ে আছেন আরও অনেকে। চলচ্চিত্রে আছেন নায়করাজ, ড্যাশিং হিরো, বিউটি কুইন...। সংগীতে আছেন গজল কিং, মেলোডি কুইন, পপ সম্রাট, স্বর্ণকণ্ঠী...।
তবে নামে নাকি কিছু যায় আসে না - শেঙপিয়ার বলেছেন। আর এ কথায় কান দেন না এমন মানুষও আছেন অনেক। সংখ্যায় হয়তো তাঁরাই বেশি। এখানে একজনের কথাই বলি। তিনি জায়ারে (কঙ্গো)-র সাবেক একনায়ক মবুতু সেসে সেকো (১৯৩০-১৯৯৭)। তাঁর আসল নাম জোসেফ ডিজাইরে মবুতু। ক্ষমতাসীন হয়ে ধারণ করেন “মবুতু সেসে সেকো কুকু ঙ্গবেনদো ওয়া যা বাঙ্গা” নামটি আর উপাধি গ্রহণ করেন “মবুতু আওয়া, মবুতু কুনা, মবুতু পরতাওত”। মবুতু সেসে সেকো কুকু ঙ্গবেনদো ওয়া যা বাঙ্গা’র আক্ষরিক অনুবাদ - ‘সর্বশক্তিমান যোদ্ধা যিনি জয়ী হবেন ধৈর্য ও ইচ্ছার বলে, করে চলবেন অভিযানের পর অভিযান, যাত্রাপথে রেখে যাবেন জ্বলন্ত অগ্নিরেখা’। আর মবুতু আওয়া, মবুতু কুনা, মবুতু পরতাওত-এর অর্থ ‘মবুতু এখানে, মবুতু সেখানে, মবুতু সবখানে’।
মৃত্যুর কিছু আগে বিদ্রোহে উৎখাত হন এই ‘সর্বশক্তিমান যোদ্ধা’। ট্রান্সপারেন্সি ইনটারন্যাশনালের মতে, সাম্প্রতিক কালে তিনিই ছিলেন আফ্রিকার সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ শাসক। এ ক্ষেত্রে বিশ্বে তাঁর অবস্থান তৃতীয়।
২২.১১.২০১২
sazzadqadir@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন