শনিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১২

কানেকশনে কালেকশন

কানেকশন ছাড়া কিছুই হয় না এ দেশে। কানেকশন অর্থ যথাস্থানের যথাব্যক্তির সঙ্গে দহরম। প্রভাব, প্রতিপত্তি, প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ওঠবস। ক্ষমতাবলয়ের দল গ্রুপ গোষ্ঠী লবি’র সঙ্গে লেনদেন। এ কানেকশন আপনাকে দেয় প্রমোশন, নমিনেশন, রিকগনিশন, রিসেপশন, একিউমিলেশন। অর্থাৎ কানেকশন থেকে কালেকশন। সব ধরনের কালেকশন। তাতে ধনে মানে তর-তর করে আপনি উঠে যাবেন উপরে। তারপর একদিন হয়তো হয়ে উঠবেন আকাশছোঁয়া। আর আপনার যদি কানেকশন না থাকে তবে আপনি অপাঙ্‌ক্তেয় হয়ে থাকবেন - তা প্রতিভা, মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা আপনার যতই থাকুক। আপনাকে ঠেলে সরিয়ে রাখা হবে এক পাশে। আপনি থাকবেন অবহেলিত, উপেক্ষিত, একঘরে। কোথাও উচ্চারিত হবে না আপনার নাম, কোথাও কোনও তালিকায় নাম থাকলেও তা কেটে দেয়া হবে ঘ্যাঁচ করে। কারণ আপনাকে প্রান্তিক করে না রাখলে বিকাশ ঘটে না অন্যদের মহিমার। সদ্যপ্রয়াত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ক্ষমতা-ব্যবস্থার এ ভয়ঙ্কর রূপটি তুলে ধরেছেন তাঁর একটি বিশিষ্ট রচনা - ‘কর্ণ’ নামের এক মননশীল সন্দর্ভে। ‘মহাভারতে’র কর্ণ এক অতিমানবিক প্রতিভা। তাঁকে বলা হয়েছে সে যুগের সবচেয়ে প্রভাবশালী মানুষ কৃষ্ণের সমকক্ষ। সন্দর্ভটিতে সুনীল দেখিয়েছেন, “কর্ণকে আগাগোড়া প্রান্তিক করে রাখার পিছনে রয়েছে ক্ষমতা-ব্যবস্থার নিষ্ঠুর চক্রান্ত, যা আসলে রাষ্ট্রযন্ত্রের স্থিতাবস্থা বজায় রাখারই প্রয়াস। অর্জুন রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্বাচিত, কর্ণ তার একমাত্র প্রতিপক্ষ, অতএব তাঁকে প্রান্তিক করে রাখাই শ্রেয়। এই কারণেই ভীষ্ম, দ্রোণ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রনেতারা সকলেই তাঁকে বারবার হেয় প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন, তাঁর মনোবল ভেঙে দিতে চেয়েছেন।...” (রাহুল দাশগুপ্ত, ভূমিকা: ‘জীবনের বর্ণচ্ছটা’, ২০১১)
    এ তো গেল প্রতিষ্ঠার কুচক্রীদের কথা। সিংহাসনের কানেকশনের ষড়যন্ত্র। আর এ কানেকশন যখন একিউমিলেশন অর্থাৎ সম্পদ পুঞ্জীভূত করার দিকে ধাবিত হয় তখন কি ঘটে তা আমরা দেখছি হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে। ডেসটিনি, শেয়ারবাজার ও অন্যান্য কেলেঙ্কারিও কানেকশন ছাড়া হয় নি নিশ্চয়। আর যমুনা সেতু? উদাহরণ দেয়া যায় আরও। দেয়া যায় সকল জমানা থেকেই। তবে কানেকশনের এক বীভৎস ও মর্মান্তিক রূপ দেখা গেল শিশু পরাগ মণ্ডল অপহরণ ঘটনায়। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ওই অপহরণের সঙ্গে জড়িত দলবলের কানেকশন বেশ জোরালো। সেই জোরেই এত সিনাজুরি তাদের। তবে তাদের জারিজুরি ফাঁস হতে দেরি হয় নি বেশি। র‌্যাব, গোয়েন্দা ও পুলিশের জোর তৎপরতায় পরাগকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে তাই। বলা চলে, দুর্বৃত্তরা বাধ্য হয়েছে জিম্মি করা পরাগকে ছেড়ে দিতে। তবে শর্ত মানা হয়েছে তাদের। এই মান্যতা আমাদের ব্যথিত, বিস্মিত করে আর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রতি। তারা শুধু একটি শিশুকে যেন নয়, জিম্মি করে ফেলে গোটা ব্যবস্থাকেই। তাই ওই দলবলের নেতানেত্রীদের উদ্দেশ্যে বলি, বড়-বড় কথা আর শোভা পায় না আপনাদের মুখে। গলাবাজি বন্ধ করুন।
    পরাগ উদ্ধারে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও কৌশল ব্যবহার করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তাঁদের এ সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে ‘হোস্টেজ নেগোশিয়েশন’ (জিম্মি নিয়ে কষাকষি) পদ্ধতি। দেশে অপহরণের ঘটনা আকছারই ঘটছে, কিন্তু সর্বত্র এ কৌশল ও পদ্ধতি ব্যবহারে নানা সীমাবদ্ধতা থাকায় অনেক ক্ষেত্রে কানেকশনের জোরে পার পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা। অনেক ঘটনায় আহত-নিহত হচ্ছে জিম্মি হওয়া নর-নারী-শিশু। এ অবস্থায় অপরাধ দমনে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ও পদ্ধতি যাতে সকলের জন্য হয়ে উঠতে পারে তা দেখতে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি সরকারের প্রতি। সেই সঙ্গে জানতে চাইছি বিএনপি-নেতা ইলিয়াস আলী ও তাঁর গাড়িচালক অপহৃত হওয়ার পর কি-কি কৌশল ও পদ্ধতি ব্যবহার করে তাঁদের উদ্ধারে চেষ্টা চালিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। সাগর-রুনি’র হত্যা তদন্তেই বা ব্যবহৃত হয়েছে কি-কি প্রযুক্তি।
    আমরা বিশ্বাস করি, অপরাধীর যত দুর্ধর্ষই হোক - আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে উন্নত প্রযুক্তি, সামগ্রী, সরঞ্জাম থাকলে তাদের দমন করা সম্ভব। তবে কানেকশন বলে কথা। তখন কালেকশন হয়ে যায় ঠিক-ঠিক। তারপর কমিশন বসিয়ে অমিশন।
sazzadqadir@rediffmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন