বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১১

প্রাচীন প্রণয়প্রাণের পদ্য

নর-নারীর প্রেম-ভালবাসা নিয়ে কত কথা ও কাহিনী  কত কীর্তি ও কীর্তন  কিন্তু ভালবাসা কারে কয়? কি অনুভব প্রেমে? কবিতায় গল্পে উপন্যাসে নাটকে চলচ্চিত্রে  শিল্প-সংস্কৃতির কত না মাধ্যমে  হৃদয়ের এই জাগরণ ও কোলাহল নিয়ে কতই না ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বক্তব্য বিবরণ! নানা উপলক্ষে এই নন্দিত বন্দিত বোধ ও বিষয় নিয়ে অনেক ভেবেছি আমি, একবার মনে হয়েছে  আগ্রহই ভালবাসা। প্রথম যৌবনে তাই লিখেছিলাম, “কুসুম পাবো না হয়তো আমরা কেউ, তবুও কুসুমের প্রতি আগ্রহই ভালবাসা।” এই ভাবনা নিয়ে আরও গভীরে গিয়ে বুঝেছি  তীব্র আদর ও আসক্তির আবেগই প্রেম। এ এক আচ্ছন্নতা। এক পূর্ণ গ্রাস। সঙ্গে-সঙ্গে এ-ও জেনেছি, সত্য কথাটি বঙ্কিমচন্দ্র লিখে গেছেন সেই ১৮৮২ সালে তাঁর ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসে, “ভালবাসা দুঃখ মাত্র।” সে দুঃখ কতখানি তা প্রায় ওই সময়েই লিখে গেছেন মহাকবি কায়কোবাদ (মুহম্মদ কাজেম আল কুরায়শী, ১৮৫৭-১৯৫১) 
    “... সে আমার সুখে দুঃখে প্রাণের সঙ্গিনী!
    তারি তরে বেঁচে আছি ভবে!
    জীবন-জলধি-পাড়ে, আর কি পাইব তারে
        এক দুই করে আমি মাস দিন গণি!
    সে চাঁদ উঠে না আর, ঢালে না সে সুধা-ধার,
        আমি তার সে আমার  শুধু এই জানি!
            সে আসিবে কবে!...” (‘প্রেম-প্রতিমা’)
    এই যে আচ্ছন্নতা (‘আমি তার সে আমার  শুধু এই জানি’) ও দুঃখবোধ (‘সে আসিবে কবে’)  এই আকুলতা, আকুতি বাংলার কবিতাকে দিয়েছে মহিমা, বাঙালির প্রেমকে করেছে মহীয়ান। কবি ও প্রেম যেন এক মরমী সুরে বাঁধা। বাংলার কবি তাই প্রেমকে দিয়েছেন বেদনা-সুন্দর রূপ। এ রূপের এক মধুর দুঃখজাগানিয়া ভাষা দিয়েছেন কবি, কথাশিল্পী, গবেষক, সমালোচক ও রাজনীতিবিদ হুমায়ুন কবির (১৯০৬-১৯৬৯) 
    “আমার এ প্রেম সখি শুধু নিবেদন।
    নাই বা জানিলে তুমি আজি মোর মন।
    রচিছে তোমারে ঘেরি’ সোনার স্বপন।...
    আসিবে ঘনায়ে যবে বিদায়ের বেলা 
    লুকায়ে হাসির তলে বেদনার খেলা
    সন্ধ্যার আঁধার পথে ফিরিব একেলা।
    তোমার আনন্দ মাঝে মোর অশ্র“মালা
    ঝুলিবে মুকুতাসম তব কণ্ঠে বালা।” (‘তৃপ্তি’)
    বাংলা কবিতায় প্রেমের এই মহনীয় রূপ (‘লুকায়ে হাসির তলে বেদনার খেলা / সন্ধ্যার আঁধার পথে ফিরিব একেলা’) আমরা পেয়েছি ঐতিহ্যের সূত্রেই। মধ্যযুগের বৈষ্ণব কবিরা দেবলীলার আড়ালে এবং সুফি কবিরা আধ্যাত্মিকতার আবরণে যে মানবিক প্রেমকাব্য রচনা করেছেন সে সবই এমন সহজিয়া অনুরাগ সৃষ্টি করেছে আমাদের কবিতায়। সেকালের প্রণয়োপাখ্যান সম্পর্কিত আলোচনায় ড. ওয়াকিল আহমদ লিখেছেন, প্রেমের ক্ষেত্রে “বিদেশী কবিদের সঙ্গে তুলনায় বাঙালি কবিদের পার্থক্য আছে। তাঁরা স্থূল অশ্লীল হতে দেন নি। বরং বিচিত্র বিন্যাসে, সূক্ষ্ম ব্যাখ্যায় এবং ব্যাপক বিশ্লেষণে শরীরী প্রেমকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি প্রমূর্ত ভাবসত্তায় রূপান্তরিত করেন। প্রেমোপলব্ধির গভীরতা এবং প্রকাশশক্তির তীব্রতার গুণেই তা সম্ভব হয়েছে।... রূপতৃষ্ণা, মোহ, কামনা, মান, অভিমান, অভিসার, বিচ্ছেদ প্রভৃতি মানবিক প্রেমের নানা স্তর কম বেশি সকলের কাব্যে আছে। নরনারীর দেহমিলন প্রেমের চরমতম আনন্দোপলব্ধি বটে কিন্তু পরম প্রাপ্তি নয়। মিলনে প্রেম ভোগমুখী ও আত্মকেন্দ্রিক, মিলনহীন প্রেম দেহের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। অনন্ত বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে প্রেম এই অলৌকিক সাত্ত্বিকতায় উত্তীর্ণ হয়।...” (‘বাংলা রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান’, খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ঢাকা, ২০০৬)
    ড. ওয়াকিল আহমদ আমার শিক্ষক। এখানে প্রসঙ্গক্রমে প্রেম সম্পর্কে স্যরের ধারণাটি উল্লেখ করতে পারি  “প্রেম মানবচিত্তবৃত্তির এক অতি প্রবল ও শ্রেষ্ঠ অনুভূতি। নরনারীর স্বভাবজ আকর্ষণ ও মিলনাকাক্সক্ষা জৈবিক প্রবৃত্তি। জৈবিক প্রবৃত্তি প্রেমের উৎস নয়। যখন কোনও বিশেষ নরনারীর চিত্ত পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট ও নিবিষ্ট হয়, তখন মিলনাকাক্সক্ষায় তাদের অন্তরে দাহ ও ব্যাকুলতা ফুটে ওঠে। মানবহৃদয়ের সেই ভাবানুভূতিকেই প্রেম বলা হয়।...” (প্রাগুক্ত)
    মধ্যপ্রাচ্য থেকে উত্তর ভারত পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূগোলের, সেই সঙ্গে বিশাল বাংলার পৌরাণিক, লৌকিক, ঐতিহাসিক  নানা কাহিনীর সূত্রে এই প্রেমেরই প্রকাশ ঘটেছে রাধা-কৃষ্ণ, শিব-পার্বতী, বিদ্যা-সুন্দর, ইউসুফ-জোলেখা, লায়লী-মজনু, মধুমালতী, হানিফা-কয়রাপরী, সয়ফুলমুলক-বদিউজ্জামাল, সতীময়না-লোরচন্দ্রানী, পদ্মাবতী, চন্দ্রাবতী, লালমতি, গুলে বকাওলী, শাহজালাল-মধুমালা, জেবলমুলুক-শামারোখ, মৃগাবতী, মহুয়া, মলুয়া, কমলা, রূপবতী, কঙ্ক-লীলা, কাজলরেখা, দেওয়ানা মদিনা প্রমুখের রূপে। কেমন সে প্রেম? মুহম্মদ কবীর-এর নায়িকা মধুমালতী প্রেমিক মনোহর-কে বলেছে  “ধরাইতে না পারি চিত্ত তোহ্মা রূপ হেরি। ধড়ফড় করে প্রাণ না দেখিলে মরি ॥” উত্তরে মনোহর বলেছে প্রেমিকা মধুমালতী-কে  “তোহ্মা রূপ হেরি মন গেল তনু ছাড়ি। সুধা তনু যথা তথা রহিবেক পড়ি ॥... তিলেক বিমন নাহি তোহ্মারে পাসরি। তোহ্মা রূপ লৈল আঁখি পলক বিস্মরি ॥”  নওয়াজিস খান-এর নায়ক তাজুলমুলুক-এর অন্তরে বকাওলী’র প্রতি প্রেমের সঞ্চার হয় হয় এভাবে  “চাহিতে চাহিতে রূপ মুহিত বিশেষ। প্রেমালাপ আক্ষি পন্তে হইল প্রবেশ ॥ হ্রিদেতে তরঙ্গ হইল সেই প্রেমানল। দহএ সমস্ত অঙ্গ না হয় শীতল ॥” এরপর সে লেখে প্রেমপত্র  “প্রাণ আদি শক্তি মতি রাখি তোমা সঙ্গে। মৃত্যুবৎ চলি যাই নিজ শূন্য অঙ্গে ॥” কোরেশী মাগন ঠাকুর-এর নায়ক বীরভান প্রেমিকা চন্দ্রাবতীকে একবার দেখার আকুতি প্রকাশ করেছে এভাবে  “হাহা কন্যা চন্দ্রাবতী তুহ্মি প্রাণধন। কর্ণের কুণ্ডল তুহ্মি আঁখির খঞ্জন ॥ নয়ানের জুতি তুহ্মি ভিনে হএ ঘোর। কেমতে দেখিব তোর রূপ মনোহর ॥ কেমতে শুনিব তোর মুখের বচন। কেমতে দেখিব তোর পাএর চলন ॥ কেমতে ভুরুর কালা চন্দ্রিমা। কেমন লোচন চারু পোতলি মিলিব ॥... কেবা মুঞি সূর্য নিয়া চন্দ্রেত মিলাইব। কেবা মোর মিত্র মণি গলে গাঁথি দিব ॥ বিরহ অনল জ্বালা  কথেক তাপিমু। বিরহ সাগর মধ্যে কথেক ভাসিমু ॥...”
    মধ্যযুগের কবিরা এই যে হৃদয়ে তরঙ্গলীলার কথা বলেছেন, নয়নের জ্যোতির কথাই বলেছেন তা-ই পরম্পরাক্রমে একদিন চোখের আলোয় দেখেছে চোখের বাহিরে। কয়েক শতক পেরিয়ে তাঁদের প্রণয়ীদের একই রূপ মুগ্ধ অভিভূত রেখেছে বাংলার কবিদের। তাঁরা হয়েছেন চিরকালের প্রেয়সী। তাই তো কবি নরেন্দ্র দেব (১৮৮৮-১৯৭১) লিখেছেন 
    “... নীলনদের ওই উপকূলে পীরামিডের দেশেযখন ছিলে মিশরমণি তুমি,
    সাগরসীমা সিংহাসনের সব গরিমা ভুলে ধন্য হতেম তোমার চরণ চুমি’।
    মরুর শশী কোন রূপসী জিপসী মেয়ে তুমি, ছিলে সে কোন আঁধার তাঁবুর আলো,
    ক্ষিপ্ত হয়ে তীব্র জ্বালায় দৌড়েছিলেম কত দেশবিদেশে তোমায় বেসে ভাল;
    বজ্রমুঠির তীক্ষè ছুরি রক্ততৃষায় মেতে বিঁধতো গিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী বুকে,
    দুঃসাহসের খিলাত দিতে নওজোয়ানের চিতে আমার ঘোড়ায় উঠতে তুমি সুখে।...
    কোন ইরানের গুলিস্তানে বুলবুলিদের শিসে কণ্ঠ তোমার গাইতো গজল গান,...
    হয়তো ছিলে বেদৌরালো চীনরূপসীর সেরা, উড়িয়ে তোমায় এনেছিলেম কাছে,
    কোন খলিফের বেগম ছিলে হারেম উজল করা বাদশাজাদা ফিরতো পাছে পাছে।...
    কোন হামামের হেনার জলে তোমার সনে শিথিল ক’রে বোরখা কোমরবন্দ্
    তোমার গালের তিলের তরে বিলিয়ে দিছি আমি খাশ বোখারা সাধের সামরখন্দ্...” (‘চিরন্তনী’)
    এভাবেই প্রিয়ার গালের কালো তিলের জন্য বোখারা-সমরখন্দ বিলিয়ে দেয়ার কবি হাফেজ  আছেন বাংলা কবিতায়। তাঁর প্রিয়া এখনও ‘বীণানন্দিত মধুরকণ্ঠে’ জিজ্ঞেস করে, “শূন্যশয়নে আমারে মাগিয়া জাগিয়া কিসের লাগি’?” বাংলার কবি প্রার্থনার ভঙ্গিতে হাত জোড় করে বিগলিত স্বরে বলেন, “নাহি চাই খ্যাতি, যশে কাজ নাই, চাহি না ক’ ধনমান, তোমার স্তবের যোগ্য করিয়া শিখাইয়া দাও গান।” প্রিয়া তখন লীলায়িত হেলায় সেতারটি শুধু টেনে নেয় বুকের কাছে,  আঙুলের ছোঁয়ায় তারগুলিকে ভরে দেয় তার সংগীতে, তারপর কবিকে সেতারটি ফিরিয়ে দিয়ে গভীর আঁধারে মিলিয়ে যায় শিশির-শীতল খর্জ্জুর-বীথির ভিতর দিয়ে 
    “তার পর হ’তে বাজিছে সাহানা সোহিনী সিন্ধু কাফি,
    সাথে সাথে সেই পরম পরশ উঠিতেছে কাঁপি’ কাঁপি’;
    তালে তালে উঠে দুলে’ দুলে’ তারি হৃদয়েরি আকুলতা,
    সুরে সুরে সদা ঘুরে’ ঘুরে’ ফিরে তাহারি গোপন কথা!” (‘হাফিজের স্বপ্ন’, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, ১৮৭৮-১৯৪৮)
    আমাদের প্রাচীন প্রণয়প্রাণ পদকর্তারা কোথায়? সেই মাঙ্গলিক, পদ্যকার, কবিওয়ালা, কবিরা? এখানেই আছেন ওঁরা সবাই। এই সময়ে মুহাম্মদ সামাদ যখন লেখেন “অরুণা, না, আমি আনন্দে যাবো না” তখন ঠিকই মনে পড়ে যায় সন্ধ্যার আঁধার-পথে ফিরে যাওয়া একজন অভিমানী হুমায়ুন কবিরকে, চৌধুরী ফেরদৌস যখন লেখেন ‘সুচে নয়, সুতায় গাঁথিও এই প্রেম’ তখন প্রেমের আগুনে তরঙ্গিত হৃদয়ের নওয়াজিস খান কথা কয়ে ওঠেন যেন, রেজাউদ্দিন স্টালিন যখন লেখেন “ঈভের সন্ধানে ঘোরো নগরে বন্দরে কখনও আউলচাঁদ, বীরভদ্র কখনও লালন হও” তখন যেন “সে আসিবে কবে”র আকুল কায়কোবাদকেই দেখি! আমার তো স্বতঃই মনে পড়ে শ্রীধর কথক (১৮১৬-?)-এর কবি গান 
“ভালবাসিবে বলে ভালবাসি নে
আমার স্বভাব এই তোমা বই আর জানি নে।
বিধুমুখে মধুর হাসি
দেখিলে সুখেতে ভাসি
সেজন্য দেখিতে আসি দেখা দিতে আসি নে ॥”

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন