বৃহস্পতিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১১

রশীদ করিম: সাহিত্যচিন্তা

গত শতকের ষাট দশকের শুরুর তিন-চার বছরের মধ্যে ক’জন স্কুল বালকের সঙ্গে পরিচয় হয় আমার। তখন আমিও স্কুল বালক, কিছু দিন পর অবশ্য কলেজ কিশোর। ওই বালকেরাও অমনি। বালক কিশোর তরুণ। তবে ওরা বয়সে আমার চেয়ে কিছুটা বড়। তাতে অবশ্য সমস্যা হয় নি তেমন। বয়সের তুলনায় পাকা ছিলাম বলে একাত্ম হতে পেরেছিলাম ওদের ভাব, অনুভূতি সব কিছুর সঙ্গেই। ওই তিন জনের নাম শাকের, কনখল ও অমল। শাকেরের ঠাঁইঠিকানা রশীদ করিম (১৯২৫-২০১১)-এর ‘উত্তম পুরুষ’ (১৯৬১), কনখলের ঘরবাড়ি মণীশ ঘটক (১৯০২-১৯৭৯)-এর ‘কনখল’ (১৯৬৩), অমলের বাসভূমি বিমল কর (১৯২১-২০০৩)-এর ‘খড়কুটো’ (১৯৬৩)। গ্রন্থভুক্ত হওয়ার আগে শাকের ছিল ‘সমকাল’-এ, আর কনখল ছিল ‘চতুরঙ্গ’-এ। অমল-ও অমন কোনও পত্রিকায় ধারাবাহিক ছিল বলে কেন যেন ভাবছি বারবার। ‘সমকাল’-এ বেশি দিন থাকা হয় নি শাকেরের। সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফর ‘কমুনাল’ অভিযোগ করে প্রকাশ বন্ধ করে দেন ‘উত্তম পুরুষ’-এর। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়ে অবশ্য বিপুল ভাবে সংবর্ধিত হয় উপন্যাসটি। পত্রপত্রিকায় প্রশংসিত হয় উচ্ছ্বসিত ভাষায়, সে আমলের সবচেয়ে নামী আদমজী পুরস্কার পায়, সংস্করণও হয়ে যায় একাধিক।
    সেই কবে, ৫০-৫১ বছর আগে, ‘সমকাল’-এ ‘উত্তম পুরুষ’ পড়েছি মুগ্ধ মোহিত হয়ে! আজ অবাক হয়ে ভাবি, সেই মুগ্ধতার অবশেষ এখনও কিভাবে রয়ে গেছে অনেকখানি। গত ২৬শে নভেম্বর রশীদ করিম চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে। এ খবর পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে প্রথমেই মনে পড়ে যায় শাকের, সেলিনা, অনিমা, মুশতাক, নিহার ভাবী ও আরও অনেকের কথা। চোখের সামনে ভেসে ওঠে কলকাতার মুসলমান পাড়াগুলো  পার্ক সারকাস, মারকুইস স্ট্রিট, সদর স্ট্রিট, রাজাবাজার, খিদিরপুর, ইকবালপুর, আলীপুর, চিৎপুর, চাঁদনী চক...
অনিমার জন্মদিন,  উপহার কিনতে বেরিয়েছে শাকের  “এসপ্লানেডের ট্রামে উঠলাম। তখনও আমীর আলী এভিনিউ, গড়িয়াহাট রোডে ট্রাম লাইন বসে নি। তাই পার্ক সার্কাস থেকে এসপ্লানেড ঘুরে বালীগঞ্জে যেতে হতো। অবশ্য দশ নম্বর বাস ধরতে পারতাম; কিন্তু বাসে এত ভিড় যে সে প্রস্তাব মনেও আসে না। এসপ্লানেডে পৌঁছলে মুশতাক বললো: আগে একবার নিউ মার্কেট যেতে হবে।... আমি ফুলের একটা তোড়া কিনলাম। মুশতাক কিনলো ভ্যানিটি ব্যাগ। তারপর দু’জনেই গিয়ে উঠলাম বালীগঞ্জের ট্রামে।...”
তবে সকলের অত ভাল লাগে নি ‘উত্তম পুরুষ’। সমালোচক-গবেষক মনসুর মুসা লিখেছেন  ‘কোনও সুসংবদ্ধ কাহিনী নেই’ এ উপন্যাসে। খণ্ডিত কাহিনী আছে, তবে সেগুলোর ‘কোনও নিজস্ব গুরুত্ব নেই’। তিনি আরও লিখেছেন, উপন্যাসে বিভিন্ন চরিত্র এসেছে ‘অনাবশ্যক কথা বিস্তারের ধারায়’। তাঁর মতে, উত্তম পুরুষ-এর চেয়ে তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস প্রসন্ন পাষাণ ‘অধিক সুলিখিত উপন্যাস  এতে সন্দেহ নেই।’ (‘পূর্ব বাঙলার উপন্যাস’, অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ২০০৮)
আমি অবশ্য প্রসন্ন পাষাণ পড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি কয়েকবার। শুরু করে কিছু পৃষ্ঠা পার হয়েছি, তারপর এগোতে পারি নি আর। এরপর তিনি উপন্যাস লিখেছেন দশটি। এর মাত্র একটি, প্রেম একটি লাল গোলাপ, আমি পড়েছি দু’বার। এর বিশেষ কারণও ছিল। উপন্যাসটি ছেপেছিলাম ঈদ সংখ্যা ‘বিচিত্রা’য় ১৯৭৭ সালে। প্রেসে পাঠাবার আগে একবার পড়েছিলাম তখন, আর সেলোফেন করার আগে চূড়ান্ত প্র“ফ পড়েছিলাম একবার। কিন্তু উত্তম পুরুষ-এর সেই রশীদ করিমকে খুঁজে পাই নি আর। তিনি লিখেছেন, “আমার শ্রেষ্ঠ বই কোনটি তার বিচারক পাঠক সমাজ, আমি নই।” আরও লিখেছেন, “আমার উপন্যাসে আমি যা লিখেছি শুধু তাই বলার অধিকার আছে আমার। তার বাইরে কোনও অতিরিক্ত ঘটনা আমার বলার অধিকার নেই। যদি বলি তবে সেটা হবে উপন্যাসের বহির্ভূত একটি অংশ। আমার একাধিক উপন্যাসই কোনও না কোনও বাস্তব চরিত্র বা ঘটনাকে অবলম্বন করে লেখা। অনেকে প্রশ্ন করেন, আমি তো কাজকর্ম করি, লিখবার সময় পাই কোথায়? লেখকের সংসারের কাজ, দায়িত্ব, অফিসের কাজ ও দায়িত্ব সব কিছুকে অতিক্রম করে সাহিত্যচিন্তা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। লেখক যখন সংসারের দায়িত্ব, অফিসের দায়িত্ব প্রভৃতি পালন করেন তখনও ফল্গুধারার মতো সাহিত্যচিন্তা সর্বক্ষণ তাঁর মনের মধ্যে থাকে। এমনকি যখন তিনি বিশ্রাম করতে রাত্রে শয়ন করেন তখনও সাহিত্যচিন্তা তাঁর মধ্যে আনাগোনা করে।”
কি ছিল তাঁর নিজের সাহিত্যচিন্তা? ১২টি উপন্যাস ছাড়াও রশীদ করিম লিখেছেন অন্তত ৮৩টি প্রবন্ধ-নিবন্ধ। এগুলো স্থান পেয়েছে তাঁর প্রবন্ধ-গ্রন্থ “আর এক দৃষ্টিকোণ” (১৯৮৯), “অতীত হয় নূতন পুনরায়” (১৯৯২), “মনের গহনে তোমার মুরতিখানি” (১৯৯৭) ও “প্রবন্ধ সমগ্র” (২০০৩)-এ। এ সব প্রবন্ধে-নিবন্ধে তাঁর সাহিত্যচিন্তা প্রকাশ পেয়েছে নানা ভাবে। উপন্যাস, কবিতা, চলচ্চিত্র প্রভৃতি সম্পর্কে আলোচনায়, লেখকদের সম্পর্কে নানা মত-মন্তব্যে রয়েছে সেই চিন্তার প্রতিফলন।
ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার নেশা ছিল রশীদ করিম। পড়তে-পড়তেই ঝুঁকে পড়েছিলেন লেখালেখির দিকে। তারপর সারা জীবন পড়েছেন ও লিখেছেন প্রায় সমান তালে। এ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, “একজন লেখক হচ্ছেন একজন বড় পাঠক, আমি তাই মনে করি। নানা রকমের বই পড়ে একজন লেখকের বহু নতুন কথা শেখার আছে। তার অর্থ এই নয় যে লেখক অনুকরণ করছেন। আমার লেখালেখিতে প্রত্যক্ষ প্রেরণা হিসেবে কোনও একজন কাজ করেন নি। তবে শরৎচন্দ্রের লেখা ছেলেবেলায় খুব পড়তাম। সাহিত্যের একটা পরিবেশ ছিল আমাদের পরিবারে। সেটাও আমার লেখালেখিতে উৎসাহ যুগিয়েছে।” (‘সাহিত্যের বর্তমান মান’, “প্রবন্ধ-সমগ্র”)
রশীদ করিমের লেখায় অনেকের মধ্যে এক বিশেষ প্রেরণা ছিলেন শরৎচন্দ্র। ছোটবেলা থেকে সারা জীবনই তাঁর বিষম ভক্ত ছিলেন তিনি। ভাল লাগা বই / উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে শরৎচন্দ্রের নামই তিনি উল্লেখ করতেন বারবার। যেমন বলেছেন তাঁর বিবেচনায় সে রকম বই একাধিক আছে যার গুরুত্ব শেষ হবে না কখনও। এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন চারটি বইয়ের নাম  এর মধ্যে শরৎচন্দ্রের দু’টি  ‘গৃহদাহ’ ও ‘শ্রীকান্ত’। অন্য দু’টি বই রবীন্দ্রনাথের  ‘গীতাঞ্জলি’ ও ‘সঞ্চয়িতা’। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ পাঁচটি বইয়ের নাম বলতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেছিলেন চারটি বইয়ের নাম। এর একটি শরৎচন্দ্রের ‘গৃহদাহ’। অন্য তিনটি  বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ’, রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’। ‘গোরা’ উপন্যাসটির কথা তিনি নানা আলোচনায় উল্লেখ করেছেন বারবার। বলেছেন ‘গোরা’ তাঁর ‘খুব প্রিয় বই’। শরৎচন্দ্রের বইগুলোর মতো এ বইটিও তিনি পড়েছেন একাধিক বার। লিখেছেন, “আজকাল তো বহু উপন্যাস লেখা হচ্ছে। সেগুলোতে বহু নতুন নায়িকা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আমার মনে আজও ‘গোরা’র ললিতা দাগ কেটে আছে।”
রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের উপন্যাস সম্পর্কে এক পর্যায়ে রশীদ করিম স্পষ্ট করেই বলেছেন, “... সব মিলিয়ে আমার মনে হয় ঔপন্যাসিক হিসেবে শরৎচন্দ্র ছিলেন রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ভাল।” এত ভক্তি সত্ত্বেও শরৎচন্দ্র যে ঘোরতর সাম্প্রদায়িক ও মুসলিম বিদ্বেষী ছিলেন তা-ও উত্তম পুরুষ উপন্যাসে তিনি প্রকাশ করেছেন নায়ক শাকেরের সংলাপে  “... মনে আছে, এই শরৎচন্দ্রই বলেছিলেন, ‘বস্তুত মুসলমান যদিও কখনও বলে  হিন্দুর সহিত মিলন করিতে চাই, সে যে ছলনা ছাড়া আর কি হইতে পারে, ভাবিয়া পাওয়া কঠিন। একদিন মুসলমান লুণ্ঠনের জন্যই ভারতে প্রবেশ করিয়াছিল, রাজ্য-প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য আসে নাই। সেদিন কেবল লুঠ করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, মন্দির ধ্বংস করিয়াছে, প্রতিমা চূর্ণ করিয়াছে, নারীর সতীত্ব হানি করিয়াছে, বস্তুত অপরের ধর্ম ও মনুষ্যত্বের ওপরে যতখানি আঘাত করা যায়, কোথাও কোনও সঙ্কোচ মানে নাই।... হিন্দু নারী হরণ ব্যাপারে সংবাদপত্রওয়ালারা প্রায়ই দেখি প্রশ্ন করেন, মুসলমান নেতারা নীরব কেন? তাঁদের সম্প্রদায়ের লোকেরা যে পুনঃপুনঃ এত বড় অপরাধ করিতেছে, তথাপি প্রতিবাদ করিতেছেন না কিসের জন্য? মুখ বুজিয়া নিঃশব্দে থাকিবার অর্থ কি? কিন্তু আমার তো মনে হয় অর্থ অতিশয় প্রাঞ্জল। তাঁরা শুধু অতি বিনয়বশতই মুখ ফুটিয়া বলিতে পারেন না, বাপু, আপত্তি করবো কি, সময় ও সুযোগ পেলে ও কাজে আমরাও লেগে যেতে পারি।’...”
রবীন্দ্রনাথকেও ছেড়ে কথা বলে নি শাকের  “রবীন্দ্রনাথের কাব্য-প্রতিভাকে আমি শ্রদ্ধা করি, ... কিন্তু সে কেবল তিনি অতুল কাব্য-প্রতিভার অধিকারী বলে। মুসলমানকে তিনি কোনও দিন আপন মনে করেন নি। তিনি মুসলমানকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছেন।”
এ তো গেল রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র, অন্য ঔপন্যাসিকদের সম্পর্কে কি মূল্যায়ন ছিল রশীদ করিমের? “সাহিত্যের বর্তমান মান” নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, “তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমার খুব ভাল লাগে নি তাঁর ভাষার কারণে, তবে তাঁর কবি বইটির কথা মনে পড়ে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা ও পদ্মানদীর মাঝি যে রকম উচ্চপ্রশংসিত সে রকম মনে হয় না। বিশেষ করে এই দু’টি উপন্যাসের নায়িকাকে আমার একই রকম মনে হয়। অনেকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র লাল সালু উপন্যাসের খুব উচ্চ প্রশংসা করেন। কিন্তু এই বইয়ের প্রথম ২৫ পৃষ্ঠা সম্পূর্ণ অনাবশ্যক। তাছাড়া এই উপন্যাসের পরিধি খুবই সঙ্কীর্ণ।”
এ প্রসঙ্গে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে রশীদ করিমের মূল্যায়নের কিছু অংশ উদ্ধার করা যেতে পারে 
“লাল সালু উৎকৃষ্ট উপন্যাস। খুবই উৎকৃষ্ট, নিঃসন্দেহে। কিন্তু এ উপন্যাসের ব্যাপ্তি তো তত বড় নয়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এ উপন্যাসে মুক্ত বিচরণের জায়গা খুব একটা দেন নি। তাঁর চৌহদ্দি খুবই সঙ্কীর্ণ। এর কাহিনী বেদনাদায়কভাবে সীমাবদ্ধ।... তিনি কিছু ছোটগল্প এবং কিছু প্রহসন লিখেছেন। দু’টোই দ্বিতীয় শ্রেণীর। কতিপয় সমালোচক তাঁর প্রহসনগুলোকে নাটক বলে দাবি করে। করতে দিন। ওগুলো নাটক নয়। এসব প্রহসন কাঁচাভাবে লেখা। তার চেয়ে বড় কথা, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র মতো একজন পরিশীলিত লেখকের পরিপ্রেক্ষিতে এগুলো রীতিমতো অপকৃষ্ট রুচির। আমি জানি, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র সমস্ত লেখা যাঁরা বাইবেল পাঠের মতো ভক্তি ভরে পড়েন, তারা আমার এ কথায় ক্ষুব্ধ হবেন। আমি নিজেও ওয়ালীউল্লাহ’র দারুণ ভক্ত। কিন্তু মন্দ-সাহিত্যের বন্দনা গাইতে আমি রাজি নই। আশা করি, অন্যদের মতো আমারও নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি পোষণের অধিকার আছে।... আমি বলবো, তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাসটি শেষটির চেয়ে ভাল। আবার দ্বিতীয়টি প্রথমটির চেয়ে খারাপ।...” (‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সঙ্গে একটি দিন’, প্রাগুক্ত)
সাম্প্রতিক সাহিত্য নিয়ে হতাশা ছিল রশীদ করিমের। লিখেছেন, “বর্তমান সাহিত্যের মান পৃথিবীর সর্বত্র পড়ে গেছে। এখন যাঁরা নোবেল প্রাইজ পান তাঁদের লেখা পড়বার কোনও উৎসাহও পাই না...।”

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন