শনিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১১

আমার মামা

হাসান হাফিজুর রহমান নামটি আমাদের কাছে ছিল এক দ্রোহের প্রতীক। রক্তরাঙা একুশের লড়াই থেকে  স্বায়ত্তশাসনের দাবি তখন রূপ নিয়েছে স্বাধিকারের আন্দোলনে। শুরু হতে যাচ্ছে স্বাধীনতার সংগ্রাম। প্রজ্জ্বলিত পঞ্চাশ তখন সংগ্রাম-সচকিত ষাটে। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ (১৯৫৩) সঙ্কলনটি নিষিদ্ধ, কিন' গোপনে ছাপা হয়ে বাঁশ-কাগজের মলাটের আড়ালে আমাদের হাতে-হাতে। আর মুখে-মুখে তাঁর কবিতা ‘অমর একুশে’ -
    “... আবুল বরকত নেই: সেই অস্বাভাবিক বেড়ে ওঠা
    বিশাল শরীর বালক, মধুর স্টলের ছাদ ছুঁয়ে হাঁটতো যে
    তাঁকে ডেকো না;
    আর একবারও ডাকলে ঘৃণায় তুমি কুঁচকে উঠবে -
    সালাম, রফিকউদ্দিন, জব্বার - কি বিষণ্ন থোকা-থোকা নাম;
    এই এক সারি নাম বর্শার তীক্ষ্ণ ফলার মতো এখন হৃদয়কে হানে...”
    বলিষ্ঠ প্রকাশভঙ্গি আর সমকালীন বাস-বতা - তখনকার পাঠকদের প্রিয় এই দু’টি বৈশিষ্ট্য সবার থেকে আলাদা করেছিল হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতাকে। তবে ‘অমর একুশে’ কবিতাটির আবেদন ছিল তাঁর অন্য সকল রচনাকে ছাড়িয়ে। এ কবিতার শেষ দু’টি পঙ্‌ক্তির ইঙ্গিত বুঝে নিতে একটু বিলম্বও হয় নি কারও -
    “আজ তো জানতে একটুকু বাকি নেই মাগো,
    তুমি কি চাও, তুমি কি চাও, তুমি কি চাও।”
    এ আকুতি যে এক মুক্ত স্বাধীন স্বদেশের জন্য সে কথাও তখন বলাবলি হতো আমাদের মধ্যে। মা যে মাতৃভূমি আর তাঁর চাওয়া যে পূর্ণ স্বাধীনতা - এতে কোনও অস্পষ্টতা নেই কবি হাসান হাফিজুর রহমানের উচ্চারণে। এখানে ‘মা’ সম্বোধন থাকলেও কবিতার শুরুতে সম্বোধন ‘আম্মা’ -
    “আম্মা তাঁর নামটি ধরে একবারও ডাকবে না তবে আর?”
    এ নিয়ে নানা রকম বিতর্ক হয়েছে এ কবিতা প্রকাশের পর-পরই। অনেকে সামপ্রদায়িকতার গন্ধও পেয়েছে এতে। ভুল রাজনীতির কথাও বলেছে অনেকে। কিছু ব্যঙ্গ-বিদ্রূপও শুনেছি কথিত প্রগতিশীলদের কাছে থেকে। তারা বলেছে, ‘ওইটুকু পিয়াজের গন্ধ না থাকাই ছিল ভাল।’ কিন'  দেশকাল-জাতীয় বাস-বতা যে ‘মা’ সম্বোধনের চেয়ে ‘আম্মা’ সম্বোধনেই প্রকাশ পেয়েছে বেশি তা পরে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন সকলেই। বস'ত হাসান হাফিজুর রহমানের চেয়ে প্রগতিপনি' কবি ওই সময়ে কি ছিলেন কেউ - এ প্রশ্ন জাগেই। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে।
    হাসান হাফিজুর রহমানকে প্রথম দেখি ১৯৬৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে। নতুন সংখ্যা ‘কণ্ঠস্বর’ নিয়ে, সম্পাদক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গী হয়ে, গিয়েছিলাম ১ ডিআইটি এভিন্যু’র দৈনিক পাকিস-ান কার্যালয়ে। দোতলার কোণের রুমে তখন বসেন দুই সহকারী সম্পাদক কবি শামসুর রাহমান ও কবি হাসান হাফিজুর রহমান। সেদিন শামসুর রাহমানকেও দেখি প্রথম। দেখা হলেও খুব বেশি কথা হয় নি শামসুর রাহমানের সঙ্গে, তিনি ব্যস- ছিলেন সম্পাদকীয় লেখায়। আমাদের সময় দিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। চা খাওয়ালেন। চায়ের সঙ্গে ছিল সেকালের জনপ্রিয় ‘পারটেক্স’ বিসকুট। সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ নিয়ে কথা বলেন হাসান হাফিজুর রহমান ও সায়ীদ ভাই। আমার সঙ্গেও বলেন দু’ চার কথা। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। থাকি নাখালপাড়ায়। সায়ীদ ভাই কিছু দায়িত্ব দিয়েছেন ‘কণ্ঠস্বর’ প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট কাজে। পত্রিকায় নাম ছাপা হয় ‘সহকারী সম্পাদক’ হিসেবে। মাসে ৬০ টাকা বেতনও পাই।
    এর কিছু দিন আগে দৈনিক পাকিস-ানের সাহিত্য বিভাগে কবি আহসান হাবীব ছেপেছিলেন আমার দু’টি কবিতা একসঙ্গে - ‘শত্রু শত্রু’ ও ‘তিন নম্বর বাস’। সে কথা বলতেই খুব খুশি হয়ে গেলেন হাসান হাফিজুর রহমান। বললেন, এত দিন হাবীব ভাইয়ের কাছে তরুণ কবি ছিলেন ফজল শাহাবুদ্দীন। এখন হলে তুমি।
    সে সময় সপ্তাহে একদিন, বিশেষ করে মঙ্গলবার, অবশ্যই যেতাম হাবীব ভাইয়ের কাছে। কখনও কোনও লেখা নিয়ে, কখনও লেখা ছাড়াই - স্রেফ দেখা করা বা গল্প করার জন্য। তখন অফিসে থাকলে অবশ্যই দেখা করতাম হাসান হাফিজুর রহমানের সঙ্গে। খুব পান খেতেন তিনি, চা-ও খেতেন খুব। আপ্যায়নেও ছিলেন উদার।
    আহসান হাবীবের আদর-স্নেহ পাওয়ার পর আমার বন্ধুদেরও নিয়ে গিয়েছিলাম তাঁর সান্নিধ্যে। আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ, সেলিম আল-দীন সহ অনেককে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম তাঁর সঙ্গে। ওই সূত্রেই ওদের লেখা ছাপা হতে শুরু করে দৈনিক পাকিস-ানে। পরে হাসান হাফিজুর রহমানের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দেই ওদের। ফলে সপ্তাহে এক-দু’দিন দল বেঁধে আমরা যেতামই তাঁর কাছে। তখন দেখতে আমি ছিলাম সবার মধ্যে ছোটখাটো হালকা পাতলা। আমার মুখে ‘হাসান ভাই’ সম্বোধন যেন ঠিক মানায় না। একদিন সে কথাই বললেন হাসান হাফিজুর রহমান, ওরা বলে বলুক। তুমি বলো না।
    তাহলে কি বলবো আমি?
    হাসতে-হাসতে বললেন, তুমি বলবে মামা।
    সেই থেকে প্রকৃত অর্থেই আমার মামা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। আমার যাবতীয় ‘মামার বাড়ির আবদার’ চলতো তাঁর কাছে, তাঁর নামে ‘মামার জোর’ও খাটতো অনেকের কাছে। তাঁর ছোট ভাই খালেদ খালেদুর রহমান ও আমি ওই সুবাদেই ‘মামা’ সম্বোধন করতাম পরস্পরকে।
মামার দু’টি বই পাওয়া যেতো তখন - কবিতার বই ‘বিমুখ প্রান-র’ (১৯৬৩) ও প্রবন্ধ-সঙ্কলন ‘আধুনিক কবি ও কবিতা’ (১৯৬৫)। তবে পত্রপত্রিকায় তাঁর কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ ছাপা হতো নিয়মিত। ওই সময়কার লেখাগুলো পরে সঙ্কলিত হয়েছে তাঁর ‘আর্ত শব্দাবলী’ (কবিতা, ১৯৬৮), ‘আরো দুটি মৃত্যু’ (ছোটগল্প, ১৯৭০) ও ‘মূল্যবোধের জন্যে’ (প্রবন্ধ, ১৯৭০) বই তিনটিতে। তাঁর একটি কবিতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের মুখে-মুখে ফিরতো তখন। ‘পরমাদ’ নামের সে কবিতাটির কথা মনে করতে পারেন অনেকে -

মেয়েরা সব ধারালো-নখ উটকো পাখি
যতই চাই নির্বিবাদে বক্ষে রাখি
চালাক চোখে হঠাৎ আঁকে উড়াল ফাঁকি

হয়তো ওরা এ কদাকার হাওয়ার তোড়ে
মোটেই সুখ  পায় না খুঁজে বাহুর ডোরে
আঁতকে ওঠে কুরূপ-ঘোর মুখের ঘোরে

হয়তো হবেই তাতেই-বা কী! দুচোখ মেলে
দেহের ঘন ক্ষুধার রূঢ় অগ্নি জ্বেলে
আমি তো পুড়ি! কণ্ঠপোড়া গরল ঢেলে

পেতেছি রেখে ভীষণ গূঢ় জিঘাংসার ফাঁদ
প্রেম না পাই প্রতিহিংসা ঘটাবে পরমাদ ॥

মামার ‘আধুনিক কবি ও কবিতা’ বইটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের পাঠ্যসূচিতে অন-র্ভুক্ত ছিল রেফারেন্স বই হিসেবে। কবি-মহলেও বেশ আলোচিত ছিল এ বই তখন। সে আলোচনায় প্রশংসাই ছিল বেশি, আর সমালোচনার মধ্যে একটি ছিল বিদেশী নামের বাংলা উচ্চারণ নিয়ে। অভিযোগ ছিল, ওই উচ্চারণগুলো যথাযথ হয় নি। যেমন, ফার্লিংহেটি-কে তিনি লিখেছেন ফার্লিংঘেট্টি। একবার সাহস করে মামাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, লরেন্স ফার্লিংহেটিকে ফার্লিংঘেট্টি লিখেছেন কেন?
এক মারকিন বন্ধুর কথা বলেছিলেন তখন, অমন উচ্চারণই তাঁর মুখে শুনেছিলেন তিনি। কিছু দিন পর দ্বিতীয় সংস্করণ হয় বইটির। তাতে ‘ফার্লিংঘেট্টি’ অপরিবর্তিতই ছিল।
১৯৬৮ সালের দিকে দৈনিক পাকিস-ান উদ্যোগ নেয় রম্য মাসিক ‘বিচিত্রা’ প্রকাশের। সম্পাদক ‘ছায়াছন্দ’ বিভাগের সম্পাদক কবি ফজল শাহাবুদ্দীন। এক দিন ডেকে তিনি দু’টি ইংরেজি ফিচার দেন আমাকে। বলেন, তিন দিনের মধ্যে অনুবাদ করে দাও আমাকে।
ফিচার দু’টি ছিল এএফপি’র - এডওয়ার্ড অ্যালবি’র নাটকের চিত্ররূপ, মাইক নিকোলস্‌ পরিচালিত, লিজ টেলর ও রিচার্ড বার্টন অভিনীত হু’জ অ্যাফ্রেড অভ ভারজিনিয়া উলফ (১৯৬৬) এবং তখন নির্মীয়মান শেক্সপিয়ারের নাটকের চিত্ররূপ, ফ্রাঙ্কো জেফিরেলি পরিচালিত, লেওনার্ড হোয়াইটিং ও অলিভিয়া হাসি অভিনীত রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট (১৯৬৮) সম্পর্কে।
অনুবাদ পড়ে ফজল ভাই জিজ্ঞেস করেন, চাকরি করবে ‘বিচিত্রা’য়? মাসে ২০০ টাকা পাবে।
এরপর তিনি আমার চাকরির জন্য সুপারিশ করেন কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন' কে বা কারা আপত্তি করে বসেন আমার বিরুদ্ধে। অভিযোগ, আমি রাগি ছোকরা... স্বাক্ষর-কণ্ঠস্বর গোষ্ঠীর বেয়াদবদের একজন... ইত্যাদি, ইত্যাদি।
কিন- ধোপে টেকে না সে সব আপত্তি। কারণ জানতে পেরে মামা গর্জে ওঠেন, রীতিমতো গাল-মন্দ করেন তাদের নাম ধরে। ফলে পিছু হটে বিরোধীরা। আর চাকরি হয়ে যায় আমার। সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করতে থাকি মন-প্রাণ ঢেলে।
 ১৯৬৯’র গণঅভ্যুত্থানকালে দৈনিক পাকিস-ান-মরনিং নিউজ ভবনে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। এতে ক্ষতিগ্রস- হয় মুদ্রণ ও অন্যান্য বিভাগ। এ অবস'ায় বন্ধ হয়ে যায় ‘বিচিত্রা’। মামা তখন আমাকে বলেন পাকিস-ান লেখক সংঘের পত্রিকা ‘পরিক্রম’-এ যোগ দিতে। একই বেতন, একই পদ। ‘পরিক্রম’-এর সম্পাদক তখন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। এরপর অন্য ঘটনা, অন্য অভিজ্ঞতা।
মামা’র কথা এক বারে বলে ফুরাতে পারবো না, বলতে হবে আরও অনেক বার। মাঝে-মাঝে নানা লেখায় চলে আসে তাঁর প্রসঙ্গ। গভীর কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করি আমার জীবনে তাঁর যত অবদানকে। তিনি ছিলেন মহান মানুষ, মহৎ সাহিত্যিক। এমন মহামানবিক ব্যক্তিত্ব অল্প ক’জনই দেখেছি এ জীবনে। তবে তাঁর মূল্যায়ন হয় নি সে ভাবে। কেন হয় নি তা নিজেই তিনি বলে গেছেন:

যখন একদিন শোকসভায় উঠবো আমি,
করতালিতে নয়, অবিরাম দীর্ঘশ্বাসে
মুহূর্তেই জান-ব হয়ে যাবো ফের।
তোমরা বলবে বড্ড প্রয়োজনীয় ছিল লোকটা।
এখন দরকারের ফর্দে আছি উদ্বাহু, ফিরেও তাকাও না।
তোমরা বলবে, অপূরণীয় ক্ষতি হলো
লোকটার তিরোধানে।
এখন সকল ক্ষতি পুরিয়ে দিতে আছি এক পায়ে দাঁড়িয়ে
ফিরেও তাকাও না।
মড়া ছাড়া তোমাদের কিছুই রোচে না।
তোমাদের হিসেবি খাতায়
বীর নেই, শহীদ রয়েছে শুধু। (‘বীর নেই আছে শহীদ’, “আমার ভেতরের বাঘ”)

২টি মন্তব্য:

  1. Sroddhyeo Boro Mama,

    Prothome amar Salam janben. Apnar blog porsi o upobhog korsi. Jante chachci, Bangla kon font babohar korsen? Valo o Shustho thakun.

    Dhonnobadante.

    Mehbub
    Camden, London.

    উত্তরমুছুন
  2. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন