শনিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১১

হারানো দিনের ছবি

ইংরেজিতে বায়োস্কোপ, টকি, সিনেমা, ফিল্ম, মুভি - আর বাংলায় নির্বাক চিত্র, সবাক চিত্র, চলচ্চিত্র, ছায়াছবি, ছবি। তবে আমাদের টাঙ্গাইলে ‘বই’। আর ঢাকায় ‘পিকচার’। টাঙ্গাইলে ‘কি বই চলতাছে’ ঢাকায় হয়ে যায় ‘কি পিকচার খেলতাছে’!
‘বই’ কেন বলা হয় তা অনুমান করা যায় কিছুটা। সেকালে বেশির ভাগ বাংলা ছবিই হতো গল্প-উপন্যাস থেকে অর্থাৎ ছবি হতো বই থেকে, তার মানে ছবির পরিচয়টা ছিল বইয়ের সূত্রে। এ জন্য আমাদের মফস্বল শহরের কালী সিনেমায় নতুন কোনও ছবি এলে প্রশ্ন করা হতো, কি বই? উত্তরে মিলতো, শরৎচন্দ্রের বই বা তারাশঙ্করের বই। পরে তারকা-যুগে উত্তরটি বদলে হয়ে যায় সূচিত্রা-উত্তমের বই।
ছবি দেখার নেশা সেই ছোটবেলায় আমার হয়েছিল অপরিসীম কৌতূহলের কারণে। ছবি নড়ে, কথা বলে, গান গায়, নাচে, মারপিট করে, - আর বইয়ে যা পড়ি - জলে স্থলে আকাশে যুদ্ধ, লন্ডন টোকিও নিউ ইয়র্ক, প্যারিস, দৈত্যদানব, বাঘ-সিংহ - সব দেখা যায় ছবিতে - এমন বিচিত্র বিস্ময়কে না দেখে  কি থাকা যায়!
আসলেই বিচিত্র বিস্ময় এই ছবি। এখানে-ওখানে খণ্ড-খণ্ড দৃশ্য ধারণ করে, তারপর সেগুলোকে জোড়া দিয়ে-দিয়ে গোটা একটা কাহিনী দাঁড় করানো সোজা কম্ম নয়। আর কাহিনী একটা দাঁড় করালেই কি হলো? তাকে এমনভাবে তুলে ধরতে হবে যাতে দর্শকের আবেগ-অনুভূতিতে সাড়া জাগে নানারকম। এ জন্য ক্যামেরায় ছবি তোলার নানা কায়দা আছে, শিল্পীদের অভিনয়ে আছে নানা কৌশল, সংলাপে সংগীতে ধ্বনি-সংযোজনায় সম্পাদনায় আছে কত রকম কত রীতি! এ যদি বিস্ময় না হয় তাহলে বিস্ময় কি!
দর্শকদেরও নানা ব্যাপার-স্যাপার আছে উপভোগের ক্ষেত্রে। ছবি দেখার পর তাঁদের প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যায় সেসব। আকিরা কুরোসাওয়া’র এক ছবি দেখেছিলাম চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের পাশে বসে। সারাক্ষণ চুপচাপ ছিলেন তিনি। ছবি শেষ হলে বাইরে বেরিয়ে এসে বলেছিলেন, লাইটিং-এ সমস্যা আছে বেশ। ‘ডোন্ট লুক নাউ’ (১৯৭৩) দেখার পর চলচ্চিত্রপ্রেমী শাহাদত চৌধুরী বলেছিলেন, কি কাণ্ড! জুলি ক্রিসটি’র মতো নায়িকারও খোলামেলা হয়ে এসব করতে হয়! ‘আখরি চাট্টান’ (১৯৭০) ছবিটি ১০-১১ বার দেখেছিলেন সাহিত্যিক-সাংবাদিক শেখ আবদুর রহমান ও আখতার-উন-নবী নৃত্যপটয়সী নায়িকা রানী ও তারানা’র জন্য। কবি রফিক আজাদ অনেক ছবি দেখেছেন স্রেফ ‘ডাকু কি লাড়কি’ (১৯৬০) খ্যাত মুসাররাত নাজির ও ‘বানজারান’ (১৯৬২) খ্যাত নীলো’র কারণে।
ছবি দেখতে গিয়ে আমার হয় নানারকম দশা-ছবি দেখার সঙ্গে সঙ্গে আমি দেখতে থাকি এর নির্মিতির নানা দিক। অর্থাৎ প্রতিটি দৃশ্যের চিত্রায়ন হয়েছে কিভাবে - কোথায় ক্যামেরা ছিল, লাইটিংয়ের ব্যবস্থা ছিল কি রকম, কলাকুশলীরা কে কোথায় ছিলেন, রিহার্সাল হয়েছে কতক্ষণ, টেক হয়েছে ক’বার ইত্যাদি ছাড়াও সাউন্ড এফেক্ট, স্পেশ্যাল এফেক্ট-এর নানা কিছু তখন ঘুরপাক খায় মাথায়। এতে অবশ্য উপভোগে কিছু ঘাটতি হয় নি কখনও আমার। বরং উপভোগের মাত্রা যেন বাড়ে আরও। বৈচিত্র্যও যেন আসে বেশি! এখনও নিয়মিত ছবি দেখি, উপভোগও করি বেশ। এই লেখাটি শুরু করার আগে দেখেছি ‘দ্য বাটারফ্লাই এফেক্ট’ (২০০৪) নামের এক ড্রামা/থ্রিলার/সাই-ফি ছবি। কোনও প্রজাপতির একটি পাখার কাঁপন থেকেও ঝড় উঠতে পারে আধা পৃথিবী জুড়ে - এমন একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু হয়েছে ছবিটি। এ ছবির নায়ক ইভান ট্রেবর্ন। তার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে অনেক। কোনও-কোনও ঘটনা ডেকে এনেছে চরম ক্ষতি। সেই ঘটনাগুলো সে মনে রাখতে চায় নি, প্রাণপণে চেষ্টা করেছে ভুলে থাকতে। বড় হয়ে সেসব ঘটনা সে স্মৃতি থেকে উদ্ধারের এক উপায় খুঁজে পায়। এক অলৌকিক উপায়ে তখনকার ভুলগুলো সংশোধনের মাধ্যমে জীবনকে বদলে-বদলে দেখতে থাকে ইভান। এরপর ঘটতে থাকে নাটকীয় সব ঘটনা। শেষ পর্যন্ত নিজের জন্মটাকেই ভুল মনে করে সে উদযোগী হয় সংশোধনের।
প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রুদ্ধশ্বাসে দেখার মতো এ ছবি, প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ্য এ ছবির। হলিউডের এ ছবিটিতে আছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে একটি সংলাপ। ইভান-এর মুখে ওই সংলাপটি এ রকম: “আমার এখন যে অবস্থা তাতে আজ ঘুমিয়ে পড়লে কাল হয়তো জেগে উঠবো বাংলাদেশের কোনও ক্ষেতখামারে!”
ছবি দেখে মজা পেতে শুরু করেছি কবে থেকে তা জানতে চেয়েছি অনেকবার মাথা খুঁড়ে! প্রথম ছবিটি দেখি কবে - কি ছিল সেই ছবি - এ নিয়ে খোঁজাখুঁজি করেছি অনেক। শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেতে যা মনে করতে পেরেছি তাতে নিশ্চিত হয়েছি এ নেশার শুরু আমার সেই ১৯৫৫ সালে, তখন ক্লাশ ফোর-এ পড়ি। প্রথম দেখা ছবিটির নাম ‘সতীর দেহত্যাগ’ (১৯৫৪)। মানু সেন পরিচালিত ও ছবিতে অভিনয় করেছেন দীপ্তি রায়, কমল মিত্র, রাজা মুখার্জি, অঞ্জলি রায় প্রমুখ। এরপর দেখি ডাবল প্রোগ্রাম - এক টিকিটে দুই ছবি - ‘রাশিয়ান সারকাস’ আর ‘ব্যাটল অব স্ট্যালিনগ্রাড’। তবে বিপত্তি দেখা দেয় ছোট বোন বকুল-কে নিয়ে। সে ‘রাশিয়ান সারকাস’-এর সিংহ-ভালুক দেখে ভয় পেয়ে এমন চিৎকার জুড়ে দেয় যে মাথায় উঠে যায় গোটা কালী সিনেমা। আমার মনে হয় না ‘কালী সিনেমা’ আর কখনও অমন বিপদে পড়েছে! সে রাতে আর ছবি দেখা হয় নি আমাদের। দর্শকরা চেচাঁমেচি করে আমাদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বাড়িতে। তবে দু’টি ছবিই আমি দেখেছিলাম পরে। ওই ১৯৫৫-৫৬ সালে দেখা দু’টি বাংলা ছবির কথা মনে আছে এখনও - ‘বাবলা’ (১৯৫১) ও ‘মহাপ্রস্থানের পথে’(১৯৫২)। অগ্রদূত পরিচালিত ‘বাবলা’ ছবির নামভূমিকায় মর্মস্পশী (অভিনয় করেছিল শিশুশিল্পী মা. বীরেন (নীরেন?) ভট্টাচার্য। অন্যান্য ভূমিকায় ছিলেন শোভা সেন, জহর গাঙ্গুলী, পরেশ ব্যানার্জী, পাহাড়ী সান্যাল, ধীরাজ দাস, প্রভা দেবী প্রমুখ। শোভা সেনকে পরে দেখেছি ‘মরণের পরে’, ‘সবার উপরে’, ‘শিল্পী’, ‘পথে হলো দেরী’, ‘কিছুক্ষণ,’ ‘আম্রপালী’, ‘হেডমাস্টার’ প্রভৃতি ছবিতে। তিনি উৎপল দত্তের স্ত্রী। ‘বাবলা’ চিত্রায়িত হয়েছিল সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় (১৮৮৪-১৯৬৬)-এর উপন্যাস থেকে। চিত্রায়িত হওয়ার পর উপন্যাসটির একটি কিশোর সংস্করণও প্রকাশিত হয়েছিল। সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সুচিত্রা মিত্রের পিতা। কার্ত্তিক চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ও চিত্রায়িত হয়েছিল উপন্যাস থেকে। তবে সেটি ভ্রমণ-উপন্যাস। লেখক প্রবোধ কুমার সান্যাল (১৯০৫-৮৩)। তাঁকে দেখেছিলাম ১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলনে, তাঁর অটোগ্রাফও নিয়েছিলাম একটা ছোট্ট খাতায়। ‘মহাপ্রস্থানের পথে’র নায়ক-নায়িকা ছিলেন দুই নবাগত শিল্পী - বসন্ত চৌধুরী ও অরুন্ধতী দেবী। এছাড়া ছিলেন মায়া  মুখার্জি,  তুলসী চক্রবর্তী, কমল মিত্র প্রমুখ। ছবিটির হিন্দি ভার্সানের নাম ছিল ‘যাত্রিক’। ‘বাবলা’ ও ‘মহাপ্রস্থানের পথে’র ছবি দু’টি দেখতে-দেখতে কি কারণে যেন খুব হাপুস কান্না পেয়েছিল আমার, তখন বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন আশপাশের দর্শকরা। এরপর থেকে দুঃখভরা ছবি আর দেখতে চাইতাম না আমি, সুযোগ পেলে দেখতাম ‘নাচ-গান-ফাইটিংয়ে ভরপুর’ ছবি।
১৯৫৫-৫৬ সালে দেখা কয়েকটি হিন্দি ছবির কথা বলি এখানে। পরে আর দেখার সুযোগ পাই নি বলে এ ছবিগুলো আবছা হয়ে আছে স্মৃতিতে। প্রথমে বলি ‘জীবনতারা’ (১৯৫১) ছবিটির কথা। হিন্দিতে ডাব করা দক্ষিণ ভারতীয় ছবি। জোসেফ তেলিয়াত প্রযোজিত-পরিচালিত এ ছবির নামভূমিকায় শিল্পী ছিলেন টি. আর. মহালিঙ্গম  ও টি. আর. রাজকুমারী। বসন্ত দেশাই সুরারোপিত এ ছবির গান অনেকে গুনগুন করতেন সেকালে। টি. আর. রাজকুমারী-কে পরে দেখেছি ‘চন্দ্রলেখা’ (১৯৪৮) ছবির নামভূমিকায়। ‘জীবনতারা’র পর দেখি ‘মুকাদ্দর’ (১৯৫০)। এতে অভিনয় করেছেন কিশোর কুমার, নলিনী জয়ন্ত, কৃষ্ণকান্ত, সজ্জন, ইফতেখার, সোফিয়া, নীলম, স্যামসন প্রমুখ। অরবিন্দ সেন পরিচালিত ও ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন দু’জন - খেমচাঁদ ও শ্রেষ্ঠ। এই ‘মুকাদ্দর’-এর মাধ্যমে প্রথম চিনতে পারি গায়ক-নায়ক কিশোর কুমারকে; আর প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে প্রথম জানতে পারি আশা ভোসলেকে - তিনি লতা মঙ্গেশকরের বোন।
আমার দেখা তৃতীয় হিন্দি ছবির নাম ‘সরকার’(১৯৫১)। ছবিটি কয়েক বার কয়েক সপ্তাহ ধরে চলেছে টাঙ্গাইলে। সম্ভবত গানের জন্য। কে. অমরনাথ পরিচালিত এ ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন গোবিন্দরাম। ছবিটিতে অভিনয় করেছেন অজিত, বীণা, শশিকলা, হীরালাল, উল্লাস, ঊষা কিরণ, কাক্কু, মুরাদ, এস. নাজির, মধুবালা প্রমুখ।
গানের কথা বলছিলাম, গানের জন্য আরেকটি ছবি  কয়েক সপ্তাহ চলেছে আমাদের কালী সিনেমায়। ডাবল প্রোগ্রাম, ট্রিপল প্রোগ্রামেও প্রধান আকর্ষণ ছিল ওই ছবি। ‘খুবসুরত’ (১৯৫২) নামের ওই ছবির শিল্পী ছিলেন সুরাইয়া, নাসির খান, ইয়াকুব, জানকী দাস প্রমুখ। নাসির খান পরিচিত ছিলেন দিলীপ কুমারের ভাই হিসেবে। তিনি একালের ভিলেন আইয়ুব খানের পিতা। এস এফ হাসনাইন পরিচালিত ‘খুবসুরত’ ছবিতে মদন মোহন-এর সুরে সুরাইয়া গেয়েছিলেন কয়েকটি অসাধারণ গান। দু’টি গানের প্রথম পঙ্‌ক্তি মনে আছে এখনও - ‘ইয়ে চাঁদ সিতারে কেয়া জানে’ ও ‘চাঁদনি রাতোঁ যিস দম ইয়াদ আ যাতে হো তুম’।
আরেকটি ছবির কথা বলি। এটি হিন্দিতে ডাব করা দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত জেমিনি পিকচার্স-এর ছবি ‘সংসার’ (১৯৫১)। এস এস ভাসান পরিচালিত এ ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন পার্থসারথি ও শঙ্কর। তাঁদের সুরারোপিত ‘আম্মা রোটি দে, আব্বা রোটি দে’ গানটি এখনও মনে থাকার কথা অনেকের। এ ছবির শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন পুষ্পাবলী, এম. কে. রাধা, আগা, বনজা, ডেভিড, মোহনা প্রমুখ। এঁদের মধ্যে পুষ্পাবলী বলিউড-তারকা রেখা’র মা, এস কে রাধা ‘চন্দ্রলেখা’ ছবির নায়ক বীরসিং, আর আগা বলিউড-চরিত্রাভিনেত্রী ফরিদা জালালের পিতা।
ছবি দেখতে দেখতে ঝোঁক সৃষ্টি হয় ছবি সংক্রান্ত পত্রপত্রিকা পড়ার দিকে। ঢাকা-কলকাতা’র এই সব পত্রপত্রিকার যথেষ্ট আদর ছিল তখন। বাবা  মাঝেমধ্যে কিনতেন, বন্ধু ফারুক কোরেশী’র কাছেও মিলতো অনেক। সে অভ্যাস আছে এখনও। ওই পত্রপত্রিকা নাকেমুখে গেলার কারণে জানি জেমিনি’র ‘ইনসানিয়াত’ (১৯৫৫) ছবির অনেক তারকার পরিচয়। ওই ছবির ভিলেন জয়ন্ত অভিনয় করেছেন দস্যু সরদার জাঙ্গুরা চরিত্রে। তিনি ‘শোলে’ খ্যাত ভিলেন আমজাদ খানের পিতা। ওই ছবিতে তাঁর সংলাপ ‘জাঙ্গুরা খুশ হুয়া’কেই শেখর কাপুর প্রায় একইভাবে ব্যবহার করেছেন ‘মি. ইনডিয়া’ (১৯৮৭) ছবিতে অমরীশ পুরী’র মুখে ‘মোগামবো খুশ হুয়া’। জয়ন্তকে ভিলেন-প্রায় ভিলেন এ ধরনের চরিত্রে আরও দেখেছি ‘দুলারী’ (১৯৪৯), ‘অমর’ (১৯৫৪) প্রভৃতি ছবিতে। এ দু’টি ছবিরই নায়িকা মধুবালা। ‘ইনসানিয়াত’ ছবির দুই নায়ক দিলীপ কুমার ও সদ্যপ্রয়াত দেব আনন্দ পরে আর কখনও অভিনয় করেন নি একই ছবিতে। এর কারণ - দেব আনন্দ পরে জানতে পেরেছিলেন, ছবিতে তাঁর নাকের নিচে বেঢপ গোঁফ লাগানোর আর হাতে এক লম্বা বেখাপ্পা তলোয়ার ধরিয়ে দেয়ার বুদ্ধি পরিচালককে দিয়েছিলেন দিলীপ কুমার। ‘ইনসানিয়াত’-এ শোভনা সমর্থ মা চরিত্র রূপায়িত করেছেন দিলীপ কুমারের। তিনি সেকালের দুই নায়িকা নূতন ও তনুজা’র মা এবং একালের নায়িকা কাজল-এর নানী। ওই ছবিতে পাতি ভিলেন ছিলেন জয়রাজ। তিনি ছিলেন সেকালে বলিউডের জবরদস্ত  নায়ক। ঐতিহাসিক, পৌরাণিক, মারদাঙ্গা ছবিতে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল তাঁর। সুরাইয়া’র বিপরীতে ‘রাজপুত’ ছবিতে দেখেছি তাঁকে, দেখেছি আরও কয়েকটি ছবিতে । মারা গেলেন ক’বছর আগে। বয়স হয়েছিল নব্বইয়ের কমবেশি। বার্ধক্য ও অসুস্থতায় জয়রাজ শয্যাশায়ী ছিলেন দীর্ঘকাল। শোনা যায়, বোঝা টানতে-টানতে নাকি বিরক্ত হয়ে পড়েছিল তাঁর ছেলেরা। তাঁকে সেবাযত্ন করা দূরে থাক, ঠিকমতো খেতেও নাকি দিতো না। ওষুধ খাইয়ে তাকে তারা ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে মাসের পর মাস। পরে ওই অবস্থাতেই মৃত্যু ঘটে জয়রাজের। পত্রপত্রিকায় এসব অভিযোগের খবর প্রকাশিত হলে হৈচৈ পড়ে যায় চারদিকে। পড়ারই কথা। বলিউডের রুপালি পর্দার কোনও মহিমান্বিত নায়কের এমন শোচনীয় জীবনাবসান কি ভাবতে পারেন কেউ?
ষাটের দশকে ঢাকার বেশির ভাগ ছবি দেখেছি টাঙ্গাইলের রওশন টকিজ ও রূপবাণী প্রেক্ষাগৃহে। নতুন মালিকানায় কালী সিনেমা হয়েছিল রওশন টকিজ, আর রূপবাণী’র প্রথম নাম ছিল ‘লিলাক’। ঢাকার প্রথম ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’ (১৯৫৬) তখন দেখা হয় নি অল্পের জন্য। কোনও আগাম ঘোষণা ছাড়া ছবিটি হুট করে মুক্তি পেয়েছিল শুক্রবারে, তেমনি হুট করেই বিদায় নেয় তিন দিনের মাথায়। এমন ঘটনা ঘটে না সাধারণত। সব ছবিই কমপক্ষে চলে সাত রজনী। আমরা সাধারণত দল বেঁধে দেখতে যাই মঙ্গল-বুধবার। তখন ভিড় কমে আসে কিছু। এছাড়া আমরা অপেক্ষা করি ডাবল-ট্রিপল প্রোগ্রামের আশায়। সেখানে এমন একটি ঘটনা! কানাঘুষায় শোনা গেল, ছবির প্রিন্ট নাকি পুড়ে গেছে - তাই ‘মুখ ও মুখোশ’ আর দেখা যাবে না।
সেই সময়ে দেখা আমার ভাল লাগা ঢাকার ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে - আসিয়া (১৯৬০), কখনো আসেনি (১৯৬১), সূর্যস্নান, নতুন সুর (১৯৬২), সংগম, সুতরাং, অনেক দিনের চেনা, শীতবিকেল (১৯৬৪), কার বউ, রাজা সন্ন্যাসী, কাগজের নৌকা (১৯৬৬), আয়না ও অবশিষ্ট, নয়নতারা (১৯৬৭), পিয়াসা (১৯৬৯), জীবন থেকে নেয়া, ছদ্মবেশী (১৯৭০) প্রভৃতি।
‘আসিয়া’ ভাল লেগেছিল এর সংগীতাংশের জন্য। আবহসংগীতেও অসাধারণ সৃষ্টিশীলতার প্রমাণ রেখেছেন আব্বাস উদ্দিন আহমদ। চরম নাট্যমুহূর্ত সৃষ্টিতে তিনি যে ভাবে ঢোলকে ব্যবহার করেছেন তা এখনও শুনতে পাই কানে। ‘কখনো আসেনি’ ভাল লেগেছিল নিরীক্ষাধর্মী আধুনিক মনমানসিকতার ছবি হিসেবে। ‘সূর্যস্নান’-এ নাসিমা খানকে কাজী খালেকের ধর্ষণদৃশ্যের শিল্পিত চিত্রায়ন মনে আছে এখনও। ছবিটি দেখতে মেয়ে কাজী সুরাইয়াকে মানা করেছিলেন কাজী খালেক। ‘নতুন সুর’-এর রোমান্টিকতা মুগ্ধ করেছিল আমাকে। তখন আমি ১৫ বছরের কিশোর। ‘সংগম’-এ দেখেছি অভিযাত্রী যৌবনের প্রাণোচ্ছল, আবার বেদনা-সুন্দর রূপায়ন। ‘সুতরাং’ অবাক করেছিল নায়ক হিসেবে সুভাষ দত্তের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করে। ছবিটির স্বপ্নদৃশ্যের পরিকল্পনা ও চিত্রায়নে ছিল মোহনীয় কবিত্ব। ‘অনেক দিনের চেনা’, ‘কাগজের নৌকা’, ‘ছদ্মবেশী’র রোমান্টিকতা মন ছুঁয়েছিল আমার। তিনটি ছবিকেই তখন মনে হয়েছে বেশ আধুনিক, স্মার্ট। ‘শীতবিকেল’-এ তুলে ধরা সমাজবাস্তবতা নানা বিষয়ে চোখ খুলে দিয়েছিল আমার। ‘কার বউ’ দেখে খুব হেসেছিলাম, মনে আছে। ‘রাজা সন্ন্যাসী’র নাটকীয়তা, ‘নয়নতারা’র অলৌকিকতা, ‘আয়না ও অবশিষ্ট’র বৈচিত্র্য উপভোগ করেছি। নীরব গভীর প্রেমের এক মর্মান্তিক পরিণতির ছবি ‘পিয়াসা’। রহমান ও সুচন্দা উভয়ই সম্ভবত জীবনের সেরা অভিনয় করেছেন এ ছবিতে। ‘জীবন থেকে নেয়া’ প্রেরণা দিয়েছে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে, আমাদের আত্মোৎসর্গকে।
ওই সময়ে আমার না দেখা বেশ কিছু ছবি সম্প্রতি দেখার সুযোগ পেয়েছি ডিভিডি হিসেবে বাজারে আসায়। আমার না দেখা আরও কিছু ছবি এখন পাওয়া যাচ্ছে অনলাইনে। যেমন - আখরি স্টেশন (১৯৬৫), চকোরি, ছোটে সাহাব (১৯৬৭), কুলি, চাঁদ আউর চাঁদনী, তুম মেরে হো (১৯৬৮), আনাড়ি (১৯৬৯), জ্বলতে সুরজ কে নিচে (১৯৭১) প্রভৃতি। ইচ্ছা আছে ডাউনলোড করবো ছবিগুলো।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন