সোমবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১১

অপারেশন খুকরি

একাত্তরে সিলেট রণাঙ্গনে আহত হয়েছিলেন মেজর জেনারেল আয়ান কারদোজো (অব.)। ল্যান্ডমাইনের বিস্ফোরণে উড়ে গিয়েছিল তাঁর একটি পা। সেই বিপর্যয় জয় করেছিলেন তিনি। ভারতীয় সেনাবহিনীর প্রথম বিকলাঙ্গ কর্মকর্তা হিসেবে অধিনায়কত্ব করেছেন প্রথমে এক ইনফ্যানট্রি ব্যাটালিয়নের, পরে এক ব্রিগেডের।
    বীরত্বের জন্য সেনা পদকে ভূষিত জেনারেল কারদোজো এখন ‘রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল অভ ইনডিয়া’র চেয়ারম্যান। যুদ্ধদিনের স্মৃতি ও ইতিহাস নিয়ে তিনি লিখেছেন দু’টি মূল্যবান দলিলগ্রন্থ - “দ্য সিনকিং অভ আইএনএস খুকরি - সারভাইভরস্ স্টোরিজ ” এবং “পরম বীর - আওয়ার হিরোস্ ইন ব্যাটল”।
    সম্প্রতি বিশিষ্ট সাংবাদিক ক্লদ আরপি’র সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জেনারেল কারদোজো স্মৃতিচারণ করেছেন সিলেট রণাঙ্গনের সেই সব রুদ্ধশ্বাস দিন-রাতের। সেখানে অসম সাহসে লড়েছিল ফিফথ গোর্খা রাইফেলস্। সে যুদ্ধে তরুণ মেজর কারদোজো আর তাঁর সঙ্গীরা পালন করেছিলেন এক নির্ধারক ভূমিকা।
    সিলেট রণাঙ্গনে তাঁর নেতৃত্বাধীন ব্যাটেলিয়ন ‘ফিফথ গোর্খা রাইফেলস্’-এর অভিযান সম্পর্কে ক্লদ আরপি জানতে চাইলে তিনি বলেন:
“তখন আমি ছিলাম স্টাফ কলেজে, কোর্স করছিলাম একটা। আমার ব্যাটেলিয়ন আগেই চলে গিয়েছিল ফ্রন্টে। সেখানে এর মধ্যেই নিহত হয়েছেন সেকেন্ড ইন কমান্ড। এ অবস্থায় আর্মি ভাবছে, তাঁর জায়গায় পাঠানো যায় কাকে। চারদিকে খোঁজাখুঁজি করে তারা শেষে স্টাফ কলেজে খুঁজে পায় এই আমাকে। পদায়ন বাতিল করে আমাকে তখন পাঠানো হয় ফ্রন্টে।
স্ত্রী ও তিন পুত্র নিয়ে আমার পরিবার। তাদের বাড়িতে রেখে আসার অনুমতি দেয়া হয় আমাকে। তা-ই করি। ওদের বাড়িতে রেখে ট্রেনে দিল্লি ফিরে আসি ৩রা ডিসেম্বর।
যুদ্ধ তখন শুরু হয়ে গেছে, কিন্তু আমরা জানতাম না কিছু। যদিও মাথার উপরে দেখতাম জঙ্গি বিমানের ঘন-ঘন চক্কর, শুনতাম কান-ফাটানো গর্জন। দিল্লি তখন নিষ্প্রদীপ। পরদিন সকালে যাই পালাম বিমানবন্দরে, আসামে যাওয়ার প্লেন ধরতে। গিয়ে দেখি সহজ লক্ষ্যবস্তু হওয়ার আশঙ্কায় বাতিল করা হয়েছে সে ফ্লাইট।
তাড়াতাড়ি উঠে বসি ট্যাক্সিতে, ছুটি রেলস্টেশনে। ট্রেন তখন যাচ্ছে প্লাটফর্ম ছেড়ে, কোনও রকমে টানি চেন, তারপর উঠি গাড়িতে। পরদিন রাতে পৌঁছাই ধর্মনগর নামের এক জায়গায়।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর ঠিকাদারদের এক অদ্ভুত ব্যবস্থা আছে - যা পৃথিবীর অন্য কোনও দেশে নেই। যেমন, এক-একটি ঠিকাদার পরিবার আর্মির এক-একটা ইউনিটকে সেবা দিয়ে আসছে ১৫০ বছরেরও আগে থেকে। ধর্মনগরে অমন এক পরিবারের সদস্য অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। সে বলে, সাহেব, হসপিটাল ট্রেন আসছে। আমাদের ইউনিটের আহত অফিসাররা আছে ওই ট্রেনে। তাঁদের সঙ্গে আপনার দেখা করা উচিত।
ট্রেনে উঠে চারজন গুরুতর আহত তরুণ অফিসারকে দেখি আমি। এরপর উঠি এক জিপে। সারা রাত, তারপর সারা দিন সে জিপ চালিয়ে পৌঁছি আমার ব্যাটেলিয়নে।
সময়মতো আমার পৌঁছানো ছিল খুব জরুরি। কারণ ফিফথ গোর্খা রাইফেলস্ ছিল হেলিবোর্ন অপারেশনের অংশ, আর কমান্ডিং অফিসার (সিও, একজন কর্নেল) অপেক্ষা করছিলেন আমার জন্য। আমাদের যেতে হবে বাংলাদেশের ভেতরে।
নির্ধারিত স্থানে আমি পৌঁছাই রাত তিনটায়। চারটি হেলিকপটার তখন ওড়ার জন্য প্রস্তুত সেখানে। আরও চারটি বাংলাদেশের ভেতরে দায়িত্ব শেষ করে ফিরে আসার পথে। তিন জনকে দেখলাম দাঁড়িয়ে থাকতে। কাছে যেতেই একজন জিজ্ঞেস করেন, কে ওখানে? কে তুমি?
উত্তর দেই, আমি মেজর কারদোজো, স্যর।
তিনি বলেন, আমি জেনারেল রাও। (পরে চিফ অভ দ্য আর্মি স্টাফ কৃষ্ণ রাও)
সেখানে অন্য একজন ছিলেন আমার ব্রিগেড কমান্ডার, আরেকজন ছিলেন ইঞ্জিনিয়ারস্ কোরের একজন কর্মকর্তা। তাঁরা বলেন, সাবাশ! ঠিক সময়ে এসেছো।
হেলিকপটারে তখন ফিরিয়ে আনা হচ্ছিল আহতদের। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইতিহাসে সেই প্রথম আমরা যাচ্ছিলাম এক হেলিবোর্ন অপারেশনে।
স্টাফ কলেজে সেনা ও বিমান বাহিনীর অফিসারদের বসে এ ধরনের একটি অপারেশনের পরিকল্পনা করতে কেটে যায় দু’-তিন দিন। তাঁরা বিশদ ভাবে আলোচনা করেন রুট, অস্ত্র ও গোলাবারুদের যোগান ইত্যাদি সব কিছু নিয়ে। সেদিন সকাল ন’টায় মাত্র ব্যাটেলিয়নকে বলা হয়েছে, তোমাদের রওনা হতে হবে বিকাল আড়াইটায়। কিভাবে কি করবে সে পরিকল্পনা করে নাও এর মধ্যে। সকাল ১০টায় রেকি (রিকনিসনস্: তথ্যানুসন্ধান অভিযান) হবে একটা।
মনে পড়ছে, আটগ্রামে এক ব্যাটেলিয়ন পাকড়াও করতে অভিযান চালিয়েছিলাম আমরা। সাধারণত একটি ব্রিগেড (প্রায় ৩০০০ সৈন্য) পাকড়াও করে একটি ব্যাটেলিয়ন (প্রায় ৭৫০ সৈন্য)। আর সেদিন এক ব্যাটেলিয়নকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল এক ব্যাটেলিয়নকে পাকড়াও করতে, তা-ও আবার গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তা ছাড়া। অথচ অবিরাম গোলাবর্ষণের মুখেই শত্রুপক্ষ বাধ্য হয় মাথা নোয়াতে, তারপর শুরু করা যায় আক্রমণ।
আমার সিও প্রশ্ন করেছিলেন, কামানের সমর্থন ছাড়া কিভাবে আমার ব্যাটেলিয়নকে দিয়ে পাকড়াও করবো এক ব্যাটেলিয়ন? উত্তর এসেছিল, তোমার সামনে কোনও বিকল্প নেই। করতে হবে, এটাই কথা। আমেরিকান ও চীন ঢুকে পড়ার তালে আছে, সব অপারেশন জলদি শেষ করতে হবে আমাদের।
সিও অনুরোধ করেন, আমি দু’টি রাত চাই রেকি করতে।
প্রথম রাতে আমরা যোগাযোগ করি মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে। ওদের সঙ্গে মিশে স্লোগান দিতে থাকি, ‘জয় বাংলা! জয় বাংলা!’ পাকিস্তানি বাহিনী গুলিবর্ষণ শুরু করে সঙ্গে-সঙ্গে। ফলে ওদের এলএমজি (লাইট মেশিন গান) কোথায় তা বুঝতে পারি, ওদের মর্টারগুলিও দেখে ফেলি গোলাগুলির ঝলকে। একই কৌশল অনুসরণ করি পরের রাতেও। শত্রুপক্ষ এবার কম সতর্ক, গুলিবর্ষণও কম।
সিদ্ধান্ত হয় পরের রাতে আক্রমণ চালানোর। সিও নির্দেশ দেন, এ অভিযানে আমাদের অস্ত্র খুকরি (নেপালি বাঁকা ছোরা, ভোজালি, কুকরি)। আমরা ব্যবহার করবো শুধু খুকরি আর গ্রেনেড। ক্ষেতের ভিতর দিয়ে যাবে বাঙ্কারে, ভেতরে গ্রেনেড ছুড়বে, তারপর চালাবে খুকরি।
দুই তরুণ অফিসারের জোশ ছিল বেশি। সিও’র কথা শোনে নি তারা। সোজা গিয়ে হামলে পড়ে বাঙ্কারে। প্রাণ হারায় দু’জনেই - একজন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ও একজন ক্যাপটেন। তবে ৩২ শত্রুর ধড়-মুণ্ডু আলাদা হয়েছিল সেদিন।
সিও এসে দেখেন চারপাশে অনেক লাশ। তবে তিনি বুঝতে পারেন নি পাকিস্তানি সিনিয়র কোম্পানি কমান্ডার ভান করে আছে মরার। কাছে যেতেই তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় সে। সিও ঝাঁপিয়ে পড়েন তার ওপর। একজন আরেকজনকে চেপে ধরে গলা টিপে মারার চেষ্টা করে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে-খেতে। প্রথমে কিছুক্ষণের জন্য হকচকিয়ে যায় গোর্খারা, পরে তারা খতম করে পাকিস্তানি অফিসারকে।
ওই আটগ্রামের যুদ্ধে আমরা হারাই দু’জন অফিসার, তিনজন জেসিও (জুনিয়র কমিশনড্ অফিসার) ও তিনজন ওআর (আদার র‌্যাঙ্কস্)। গোলন্দাজ বাহিনীর সমর্থন ছাড়া এ ধরনের এক অভিযানে প্রাণহানি ঘটতে পারতো এর চেয়ে অনেক বেশি।
এরপর আমাদের সবচেয়ে উদ্যমী কমান্ডারদের একজন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল সগৎ সিং (কমান্ডিং ৪ কোর), নির্দেশ দেন, ফিফথ গোর্খাদের পাঠাও গাজিপুরে।
কেন? প্রথমে দিকে এক ব্যাটেলিয়ন পাঠানো হয়েছিল সেখানে। কাজ হয় নি। পরে পাঠানো হয়েছিল আরেক ব্যাটেলিয়ন। ব্যর্থ হয়েছে তারাও।
সগৎ সিং বলেন, এ কাজ পারবে ফিফথ গোর্খা।
আমাদের ব্যাটেলিয়নে প্রাণহানি ঘটেছে অনেক। নিহত হয়েছেন সেকেন্ড ইন কমান্ড। প্রাণ দিয়েছেন অনেক জওয়ান। সিও অনুরোধ করেন, আমাদের এখন বিরতি দেয়া উচিত।
সগৎ সিং বলেন, না।
ভারতীয় সেনাবাহিনী ঢাকা দখলের কথা ভাবে নি প্রথমে। কিন্তু অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে দ্রুত পরিবর্তন ঘটছিল পরিস্থিতির। শত্রুপক্ষের জোরদার অবস্থানকে পাশ কাটিয়ে দুর্বল অবস্থান ধরে এগিয়ে যাওয়ার কৌশলে কাজ দিচ্ছিল খুব। ফলে ঢাকা দখলের সম্ভাবনা হয়ে উঠেছিল সুস্পষ্ট।
সগৎ সিং বলেন, সবার আগে আমি পৌঁছতে চাই ঢাকায়।
কিন্তু তার আগে তো দখল করতে হবে সিলেট।
কিভাবে যাবো সেখানে?
উত্তর আসে, হেলিকপটারে।
কারা যাবে?
৪/৫ গোর্খা ব্যাটেলিয়ন।
সিও বলেন, আমি অনেক অফিসার হারিয়েছি হতাহত হওয়ার কারণে।
সগৎ সিং বলেন, তোমাকে যেতেই হবে। ওখানে পাকিস্তানি ২০২ ব্রিগেড ছিল, এখন নেই - চলে গেছে ঢাকায়। মাত্র ২০০-৩০০ রাজাকার আছে। কি সমস্যা তোমার?
তখন আমাদের ব্যাটেলিয়নে সৈন্য ছিল মাত্র ৪৮০ জন।
৭ই ডিসেম্বর হেলিকপটারে রেকি করতে যান ব্রিগেড কমান্ডার সহ ক’জন। ফিরে এসে তাঁরা বলেন, শত্রুদের কোনও তৎপরতা নেই, কোনও গোলাগুলি নেই। সবাই মনে করে কোর কমান্ডারের কথাই ঠিক, শত্রুদের কেউ নেই ওদিকে।
অফিসারদের বলা হয়, জলদি তৈরি হয়ে নাও। আমাদের হাতে তখন না ছিল সময় পরিকল্পনা আঁটবার, না ছিল সময় কৌশল বাতলাবার। হুকুম ছিল সোজাসাপটা - “দখল করো এলাকা, তারপর এগিয়ে যাও, ছড়িয়ে পড়ো ক্রমে!”
সিলেটে প্রথম অভিযানে গিয়ে তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ি আমরা। তখন জানতাম না, ২০২ ব্রিগেড ঢাকা না গিয়ে ওখানেই ছিল। ওদিক থেকে কামান-মর্টারের গোলা আসছিল প্রচুর, কিন্তু ভেবেছি একটি ব্যাটেলিয়নই হবে। বুঝতে পারি নি ওটা ছিল একটি ব্রিগেড।
শেষ অভিযানে যাই আমি। আমার কোমপানির ‘জনি’ (জওয়ান)-রা আমার নাম ‘কারদোজো’ উচ্চারণ করতে পারতো না ঠিকমতো। ওরা বলতো ‘কারতুস সাহিব’।
হেলিকপটারগুলো নামার পর প্রতিটি হেলিকপটার খুঁজে ওরা বের করে আমাকে, তারপর উল্লাস করতে থাকে শূন্যে গুলি ছুড়ে। শত্রুপক্ষের গোলাগুলি আসছে, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ ছিল না ওদের। আমাকে কাঁধে তুলে নিয়ে ওরা চেঁচামেচি করতে থাকে, কারতুস সাহিব এসে গেছেন... সঙ্গে আছেন... চলো এখন সামনে যাই!
সিও’র সঙ্গে দেখা করতে যাই সেখান থেকে, আমাকে দেখে তিনিও খুশি হন খুব।
শুরু হয় লড়াই। কিছুক্ষণের মধ্যে ১০০০ বাই ১৫০০ মিটার জায়গা আসে আমাদের অধিকারে। সিও বলেছিলেন, শক্তি বাড়াতে আমাদের সঙ্গে সংযুক্তি (লিঙ্ক-আপ) ঘটবে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে। প্যারা-কমান্ডোদের জন্য অবশ্যই সংযুক্তি ঘটাতে হবে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে, নাহলে খতম হয়ে যাবে তারা।
কোনও খাবার ছিল না আমাদের সঙ্গে। ছিল শুধু অস্ত্রশস্ত্র, কিছু গ্রেনেড, এক মুঠো শাকরপরা (মিষ্টি গোল্লা), একটি ব্যান্ডেজ, এক বোতল পানি, আর মাটিতে পেতে ঘুমাবার জন্য একটা বরসাত্তি। কম্বল নেই, কাপড় নেই, জুতা নেই, আর কিচ্ছু নেই।
সে সময় যুদ্ধের খবর প্রচার করতো বিবিসি, আকাশবাণী (অল ইনডিয়া রেডিও) ও রেডিও পাকিস্তান। কেউ বিশ্বাস করতো না রেডিও পাকিস্তানের খবর। অল ইনডিয়া রেডিও খবর দিতো সব সময় দু’ দিন পর, কারণ সেনা সদর দপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া যুদ্ধের কোনও খবর প্রচার করতে পারতেন না তাঁরা। কিন্তু বিবিসি খবর দিতো ঘটনাস্থল থেকে। তাঁদের রণাঙ্গন সংবাদদাতারা ছিল অত্যন্ত নিবেদিত, আর বিভিন্ন অভিযানের খবর সংগ্রহের ব্যাপারে বিশেষ অনুমতি দেয়া হয়েছিল তাঁদের।
আমরা সবাই শুনতাম বিবিসি। সেদিন আমরা শুনলাম, ‘এক ব্রিগেড গোর্খা সৈন্য সিলেটে নেমেছে।’
সিও-কে বললাম, স্যর, পাকিস্তানিরা বিবিসি শোনে, আমরাও বিবিসি শুনি। ওরা ওখানে আছে এক ব্যাটেলিয়নের বেশি, কাজেই আমরা যেন একটি ব্রিগেড সে রকমই ভান করি। ব্রিগেডের মতো করেই ছড়িয়ে পড়ি ব্যূহ থেকে।
এতে ঝুঁকি ছিল একটি। আলাদা-আলাদা ভাবে টার্গেট নিয়ে আমাদের খতম করতে পারে ওরা। তাহলেও ঝুঁকিটা নিয়ে ফেলি আমরা।  কোম্পানিগুলোর ফাঁক ভরাতে এলএমজি বসাই এমন ভাবে যেন শত্রুরা ধরতে না পারে চালাকিটা।
একদিন এক পাকিস্তানি সামরিক যান আসছিল আমাদের দিকে। সেটাকে আক্রমণ চালিয়ে টেনে বের করি অফিসারদের, তারপর চালিয়ে দেই খুকরি। এর পর আরও চাপ বাড়ে আমাদের ওপর। মনে হয়, আমাদের খতম করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ওরা। এ অবস্থায় পরের ক’দিন ধরে অব্যাহতভাবে চলতে থাকে অপারেশন।
দিনের বেলায় বিমান বাহিনীর সমর্থন পেতাম আমরা। হানটার ও মিগগুলো তছনছ করে দিতো শত্রুদের আক্রমণ। রাতে আমাদের মতো করেই চালাতে হতো আমাদের যুদ্ধ।
একদিন এক পাকিস্তানি সন্ধানী দল ঢুকে পড়ে আমাদের কোম্পানিগুলোর মধ্যে। আমরা বুঝতে পারি, ওরা টের পেয়েছে আমরা এক ব্রিগেড নই। তখন আমাদের গুলি-গ্রেনেড প্রায় শেষ। সিদ্ধান্ত নেই, ব্যাটেলিয়ন হিসেবে আবার একত্র হয়ে লড়ে যাবো মরণপণ করে।
সন্ধ্যার দিকে প্রত্যাহার করা হয় কোম্পানিগুলোকে, যাতে আমাদের নড়াচড়া দেখতে না পায় শত্রুরা।
এক কোম্পানি চলে আসে ঠিকঠাক, কিন্তু আরেক কোম্পানি আগেভাগে চলে আসায় নজরে পড়ে যায় শত্রুপক্ষের। সিও ও আমি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখছিলাম সন্ধ্যার অন্ধকারে ওদের ফিরে আসা। হঠাৎ শুনি, আল্লাহু আকবর, চার্জ!
সঙ্গে-সঙ্গে খুকরি উঁচিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় গুর্খারা, গর্জন করে ওঠে, আইও গুর্খালি!
কি লড়াটাই না লড়লো তারা! একসময় চিৎকার, যুদ্ধের হুঙ্কার থামে, নেমে আসে নিস্তব্ধতা। কোম্পানি চলে আসে আমাদের কাছে। পাঁচ-ছ’জনের খোঁজ মেলে না, দূর থেকে ভেসে আসে আহতদের গোঙানি।
আমাদের সঙ্গে পাকিস্তানিদের একটা অঘোষিত চুক্তি ছিল - আমাদের লোক নিয়ে আসতাম আমরা, একই কাজ ওরা করতো ওদের ছোকরাদের দিয়ে।
যুদ্ধ চলে পরদিনও। কিন্তু জেনারেল (পরে ফিল্ড মার্শাল) স্যাম মানেকশ’ চরমপত্র দিয়েছিলেন পাকিস্তানকে, আত্মসমর্পণ করো নাহলো সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করবো তোমাদের।
১৫ই ডিসেম্বর সকালে সাদা পতাকা হাতে ওদের ১৫০০ জন (আমরা ছিলাম ৪৮০ জন) বেরিয়ে আসে। কোম্পানি কমান্ডাররা জিজ্ঞেস করে সিও-কে, ওরা তো সংখ্যায় অনেক বেশি, এখন কি করবো আমরা?
সিও বলেন, ওদের প্রতিনিধি ক’জনকে আসতে দাও। তবে ওরা যদি জানতে পারে আমরা মোটে ৪৮০ জন, তাহলে অন্য মূর্তি ধরতে পারে।
প্রতিনিধিরা এলে সিও বলেন, তোমাদের আত্মসমর্পণ গ্রহণের আদেশ এখনও পাই নি আমরা। বরং আগামীকাল আসো তোমরা।
তারা বলে, আমরা এখনই আত্মসমর্পণ করতে চাই।
সিও বলেন, না। আগামীকাল আসো।
আমরা ব্রিগেড কমান্ডারকে রেডিও মারফত বলি (তামিল ভাষায়), ভগবানের দিব্যি, এখানে এসে আত্মসমর্পণ গ্রহণ করুন।
পরদিন সকালে পাকিস্তানিরা আসে আবার। এর মধ্যে হেলিকপটারে এসেছেন ব্রিগেড কমান্ডার। পাকিস্তানিরা জিজ্ঞেস করে তাঁকে, আপনি এলেন কোথা থেকে?
তিনি বলেন, অমুক আর অমুক জায়গা থেকে।
পাকিস্তানিরা জানতে চায়, এখানে কি এটা, ব্রিগেড?
তিনি বলেন, একটা ব্যাটেলিয়ন মাত্র।
মাত্র একটা ব্যাটেলিয়ন? বিশ্বাস করতে পারে না ওরা। আমরা যে একটা ব্রিগেড নই তা ওরা বুঝতে পারে নি কখনও। তাদের জন্য এটা ছিল এক বিরাট বিস্ময়।
বিস্ময় ছিল আমাদের জন্যও। আমরা ভেবেছিলাম ওরা একটি ব্রিগেড, তখন দেখি দু’টি ব্রিগেড (২০২ ও ৩১৩ ইনফ্যানট্রি ব্রিগেড)! ফলে আমরা আত্মসমর্পণ গ্রহণ করি তিনজন ব্রিগেডিয়ার, একজন পূর্ণ কর্নেল, ১০৭ জন অফিসার, ২১৯ জন জেসিও আর ৭০০০ সৈন্যের।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল  এ এ কে নিয়াজি (কমান্ডিং দ্য পাকিস্তান আর্মি ইন ঈস্ট পাকিস্তান) আদেশ দিয়েছিলেন, ঢাকা প্রতিরক্ষার জন্য সিলেটকে মজুত থাকতে হবে। যেদিন আমরা যাই সেদিনই পাকিস্তানি দ্বিতীয় ব্রিগেডটি নেমেছিল সিলেট রণাঙ্গনে। আমরা আসলে একসঙ্গে লড়েছি দু’টি ব্রিগেডের সঙ্গে।
যাহোক, আমরা তখন কাহিল ছিলাম ঠাণ্ডায়। তাই এক পাকিস্তানি জেসিও-কে জিজ্ঞেস করি, সাব, আপ কে পাস কম্বল হ্যায় স্টোর মেঁ?
হাঁ সাহিব।
আমি বলি, ম্যয় আপ কো রিসিপ্ট দে দুঙ্গা। আমার লোকদের জন্য কম্বল দিতে পারেন?
কম্বল নাহিঁ লায়ে,  সাব?
হাম শোনে কি লিয়ে নাহিঁ আয়ে, আপ কো বরবাদ করনে কে লিয়ে আয়ে।
আমার খোঁচাটা হজম করে সে। পরে আমি বলি, আগার কুছ কম্বল রহে যাতে হ্যায়, হামারে অফসার সাহিবা কো দে সাকতে হ্যায়?
কেয়া বাত করতে হ্যায় সাব, আফসার সাহিবা ভি কম্বল নাহিঁ লায়ে?
তখন আমি বলি, সাব, আগার জওয়ানো কে পাস কম্বল নাহি হ্যায়, তো অফসার সাহিবা কে লিয়ে কম্বল কেয়সে হো সকতা হ্যায়?
সে অ্যাটেনশন হয়ে স্যালুট করে আমাকে, বলে, জনাব, আগার হামারি ফৌজ মেঁ ভারত যেয়সা অফসার হোতে, ইয়ে দিন হামনে দেখনা থা!”

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন