শনিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১১

সামনের চল্লিশ বছর

বিজয়ের পর চল্লিশ বছর কেটেছে, কিভাবে কেটেছে সবাই জানেন, তাই পিছন ফিরে আর তাকিয়ে দেখছি না, পিছনকে নিয়ে ভাবছি না। রাজনীতিকরা, বুদ্ধিজীবীরা অনেক কথা বলেন, কিন্তু আমরা নিজেরাই তো সব কিছু জানি। আমরা সবাই তো প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী। কে কি করেছেন, কিভাবে কি হয়েছে - তার অনেক কিছুই তো অজানা ছিল না, আর  সে সব কিছু ভুলেও যাই নি এখনও। সত্তর দশকে কেমন ছিল আওয়ামী লীগ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর সম্পর্ক? আওয়ামী লীগ সরকারের রক্ষীবাহিনী আর জাসদ-এর গণবাহিনী মেতেছিল খুনোখুনির খেলায়। এখন দুই দলের নেতাকর্মীরা ঐক্যসূত্রে গ্রথিত, মহাজোটবদ্ধ। কিন্তু সহিংস রাজনীতির বলি সেই শ’-শ’ তরুণের রক্তদান, আত্মদান তো ভুলি নি আজও। ১৯৭২-৭৬ সালে ছিলাম টাঙ্গাইলের করটিয়ার সা’দত কলেজের অধ্যাপক। ওই তরুণদের অনেকেই তখন ছিল আমার ছাত্র। তাদের অনেকের মুখ এখনও ভাসে চোখের সামনে। বৃথা গেছে কি ওদের জীবনোৎসর্গ? আশির দশকেও দেখেছি নূর হোসেন, জেহাদ, ডা. মিলন ও আরও অনেকের প্রাণদান। তখন ছিলাম অবিভক্ত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)-এর কোষাধ্যক্ষ।  সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের সংগ্রামে ছিলাম সামনের সারিতে। ভূমিকা ছিল আরও। কবি-সহজনদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলাম জাতীয় কবিতা পরিষদ। গণতন্ত্রকে মুক্ত করার সেই লড়াইয়ে শামিল ছিলাম আগাগোড়া। কাছে থেকে দেখেছি দমন-নির্যাতন, যুক্ত থেকেছি প্রতিরোধ-সংগ্রামে। কিন্তু কি হয়েছে সেই দশকব্যাপী কষ্টযন্ত্রণার? সেই মায়ের অশ্রুধারার, সন্তানের রক্তস্রোতের?  তখনকার সেই স্বৈরাচার ও স্বৈরাচার-বিরোধীরাও এখন একপ্রাণ, এক মহাজোটবদ্ধ। তাহলে কি বৃথা গেছে সেই সব আত্মোৎসর্গ? নব্বই দশক থেকে আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) যে ভাবে তিক্ত তিক্ততর করে চলেছে সম্পর্ক তাতে, কে জানে, সামনেই হয়তো একদিন ঐক্যবদ্ধ জোটবদ্ধ হবেন তাঁরাও। সত্তর দশকের ঘোরতর শত্রু জাসদ, আশির দশকের প্রবল প্রতিপক্ষ জাতীয় পার্টির সঙ্গে যদি শূন্য দশকে জোট গড়তে পারে আওয়ামী লীগ, তাহলে জানি দুশমন বিএনপি’র সঙ্গেও এক ঘাটে পানি খেতে পারে এই দশ অথবা পরের বিশ দশকে। রাজনীতির শেষ কথা হলো, রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই। কালকের জানি দুশমন আজ জানের জান হতে পারে। দলীয় রাজনীতিতে বিচিত্র শয্যাসঙ্গীর অভাব থাকে না কোনও। তাই হতেই পারে - আজ গোলাগুলি, কাল কোলাকুলি।
    তাহলে ফেলে আসা চল্লিশ বছর নয়, সামনের চল্লিশ বছর নিয়ে কথা বলি আজ। কি আমাদের স্বপ্ন, প্রত্যাশা আর কি প্রাপ্তিই বা সম্ভব! কিন্তু এ চিন্তায় প্রথমেই ছেদ পড়তে চায় যখন ভাবি আমাদের বিভাজিত অবস্থার কথা। পুরো দেশ-জাতি যেন ভাগ হয়ে গেছে দু’দিকে। চিন্তায়, আদর্শে, লক্ষ্যে এ ভাগ তীব্র তীব্রতর হয়ে উঠছে ক্রমে। কথা বলাবলি, মুখ দেখাদেখি প্রায় বন্ধ। সমাজ ভিন্ন হওয়ার পথে, কারণ সামাজিক সম্পর্ক ছিন্ন অনেকখানি। বিভাজন যত বাড়ছে, বিরোধও তত বাড়ছে। রাজনীতি জাতীয় বৈশিষ্ট্য হারিয়ে দলীয় রূপ ধারণ করে পালটাপালটি আর অন্তর্কোন্দলের হানাহানিতে লিপ্ত। দলের ভেতরে গণতন্ত্র নেই, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা তাহলে কিভাবে সম্ভব দলের দ্বারা? ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’ - এটাই এখন দলের কাজ ও প্রধান নীতি। সুযোগ পেলেই এক দল চড়াও হয় আরেক দলের ওপর। কারণ একটাই - ক্ষমতাহীনরা ঈর্ষা করে ক্ষমতাসীনদের, ক্ষমতাসীনরা ভয় পায় ক্ষমতাহীনদের। স্বার্থের দ্বন্দ্ব, পারস্পরিক সন্দেহ আর অবিশ্বাস, দুর্নীতি, তারপর সন্ত্রাস হয়ে ওঠে রাজনীতির নিয়ামক। আমরা এমনই এক পরিস্থিতির মুখে এসে দাঁড়িয়েছি যেন। বিশিষ্ট গবেষক সুনন্দ সান্যালের এক লেখায় ঠিক যেন ফুটে উঠেছে এ পরিস্থিতির ছবিটি:
    “... ‘মারের বদলে মার’ দিয়ে ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করলে সন্ত্রাস হবেই। আর ক্ষমতাসীন দল বিরোধীদের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতায় আসার চেষ্টা যদি মার দিয়ে বন্ধ করতে চায় তাহলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস অনিবার্য হবেই। অথচ মারামারি করে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা বন্ধ করতেই গণতন্ত্র। গণতন্ত্র ও সন্ত্রাস পরস্পরবিরোধী। সহজবোধ্য কারণে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসই সবচেয়ে বিপজ্জনক। কেননা, রাষ্ট্রের চেয়ে বড় সংগঠিত শক্তি আর নেই, তার হাতে পুলিসবাহিনী, সংবিধানসম্মত শক্তি প্রয়োগের অধিকার তার এবং তদুপরি একদিকে আইন ও শৃঙ্খলা আর একদিকে সাধারণ নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার প্রধান দায়িত্বও তারই। তাই রাষ্ট্র নিজেই অগণতান্ত্রিক হয়ে বেপরোয়া শক্তি প্রয়োগ করতে থাকলে সাধারণ জনজীবন দিশাহারা হয়ে পড়ে। তখন সাধারণ নাগরিকের একাংশ... সাতে, পাঁচে নেই... ভদ্রলোক হয়ে প্রাণ বাঁচাতে চেষ্টা করে, কিন্তু তার অপেক্ষাকৃত ছোট একটা অংশ মারের বদলে মার দেয়ার জন্য সংগঠিত হতে থাকে।” (‘বর্তমান’, কলকাতা, ০২.০৮.২০০২)
    কেন যেন আশঙ্কা জাগে এমন একটা দিশাহারা অবস্থাতেই ক্রমশ ঠেলে দেয়া হচ্ছে জনজীবনকে। প্রকাশের ও প্রচারের পথ নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ছে ক্রমে, পরিবর্তনের উপায় দেয়া হচ্ছে বন্ধ করে। অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে মানুষ। সামনে নির্বাচন। বলা হচ্ছে, সে নির্বাচনে বিরোধীদের অবস্থা হবে হাত-পা বেঁধে সাঁতার দেয়ার মতো। তখন ক্ষমতায় থাকবে দলীয় সরকার। নতুন নির্বাচন কমিশন হবে তাদের দ্বারা গঠিত। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)-এ কারচুপির সুযোগ রয়েছে বলে অভিযোগ এর মধ্যেই ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ জয়লাভের যোগাড়যন্ত্র পাকা। অন্তত বিরোধীরা মনে করছেন তাই। এ অবস্থায় নির্বাচন যে তাঁরা বর্জন করবেন তা সুনিশ্চিত। কিন্তু অবরুদ্ধ অবস্থা বড় ভয়ঙ্কর। ঘরের দরজা-জানালা সব বন্ধ করে বিড়ালকে লাঠিপেটা করতে গেলে কি হয়? মরণপণ ফোঁস করে ওঠে বিড়াল। এখানেও সে রকম এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ ফোঁস করে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ। তা কি জনবিস্ফোরণ না গণঅভ্যুত্থান?
    এ বিপদ বুঝেছেন আরও অনেকে। সমাজের বিভিন্ন অংশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আসন্ন বিপদের আশঙ্কা নিশ্চেষ্ট বসে নেই একেবারে। দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশে বড় দুই দল ও জোটের ব্যর্থতার পর এক অভিন্ন অবস্থানে আসতে চাইছেন তাঁরা। তৃতীয় শক্তি বা তৃতীয় পক্ষ - এ সব কথা শোনা যায়, বাস্তবে তেমন কিছু সম্ভব নয় আপাতত। তবে চাপ বা প্রভাব সৃষ্টি করার মতো কোনও বলয় গড়ে উঠতে পারে অদূরভবিষ্যতে। তা অবশ্য তরুণ প্রজন্মের ভূমিকার ওপর নির্ভরশীল। রাজনীতির অচলায়তন ভেঙে বেরিয়ে পড়ার উদ্যম তাঁদের মধ্যে জাগতে পারে - এমন আশা অমূলক হয়তো নয় একেবারে।
    কাজেই সামনের চল্লিশ বছর নিয়ে ভাবনার প্রথমেই বাধা হয়ে দাঁড়ায় আসন্ন পরিস্থিতি। এই আশঙ্কাপূর্ণ পরিস্থিতি ভেদ করে দৃষ্টি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সহজ নয়। অথচ অনেক চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে। সমাজে জীবনে অনেক অনিয়ম অব্যবস্থা গেড়ে বসেছে জগদ্দলের মতো। গত চল্লিশ বছরে এমন অনেক জগদ্দল অপসারণ করতে পারি নি আমরা, বরং নতুন-নতুন বোঝা চেপে উন্নয়নের বদলে বৃদ্ধি করেছে অনুন্নয়নকে। বাজারে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেট - এমনি এক জগদ্দল। একে ভাঙার শক্তিসামর্থ্য আমরা কি পাবো? প্রশাসনের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে দুর্নীতি। এ প্রশাসন কি কখনও আসবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির আওতায়? শিক্ষাঙ্গন কি মুক্তি পাবে সন্ত্রাস থেকে? সমাজের অন্যান্য অঙ্গনকেও কুরে-কুরে খাচ্ছে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি। বিশেষ করে নির্মাণকাজ মুখ থুবড়ে চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজির দৌরাত্ম্যে। শিল্প-কারখানা ব্যবসা-বাণিজ্যে অস্থিরতা নিয়েছে স্থায়ী রূপ। অপরাধ-মাদক ধ্বংস করে চলেছে কিশোর-তরুণদের। পরিবেশ-প্রকৃতি বিপন্ন। বনাঞ্চল উজাড়, নদীনালা মৃত, পাহাড় কেটে সাফ। এ অবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তন জনিত বিপদ আসছে ধেয়ে। তাহলে সামনের চল্লিশ বছরে দেশের ভূপ্রকৃতি দাঁড়াবে কেমন? সাগরগর্ভে তলিয়ে যাবে কতখানি ভূভাগ? সমাজপ্রগতি, দারিদ্র্যবিমোচন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ - সবই হয়তো থেকে যাবে মুখের কথা। পথে-পথে হেঁটে যেতে-যেতে ফুটপাথে দেখি ভুখা-নাঙ্গা মানুষ। বৃষ্টি বাদল কুয়াশায়, শীতে গ্রীষ্মে ওরা কুণ্ডলি পাকিয়ে থাকে টুকরিতে, খুপরিতে। বাতাসে ভাসে নির্যাতিত নারীর চিৎকার, ক্ষুধাতুর শিশুর কান্না। ৯৯ ভাগ মানুষের জীবনে ‘আসিতেছে শুভ দিন’ কেবলই একটি কবিতা! কারণ আমাদের রাজনীতির কেবল অতীত আছে, ভবিষ্যৎ নেই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন