শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১১

সংবাদপত্র: আড়ম্বরের আসর

সাধারণত অল্প-শিক্ষিত, অর্দ্ধ-শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত ব্যক্তির হৃদয় ও মন নিয়ে সংবাদপত্র গঠিত।
    আজ থেকে ১০০ বছর আগে এ মন-ব্য করেছিলেন সেকালের সাহিত্যিক-গবেষক হারানচন্দ্র রক্ষিত (১৮৬৪-১৯২৬)। তিনি লিখেছিলেন, অনেকটা আড়ম্বর ও দোকানদারি করতে হয় সংবাদপত্রে। না করলে আসর জমে না। খদ্দের জমে না।
সংবাদপত্রের সঙ্গে হারানচন্দ্র রক্ষিত অবশ্য যুক্ত করেছিলেন থিয়েটার-কে। ১৩১৮ বঙ্গাব্দের আশ্বিনে প্রকাশিত “ভিক্টোরিয়া-যুগে বাঙ্গালা সাহিত্য” নামের গবেষণা-প্রবন্ধগ্রনে'র “সংবাদপত্র ও থিয়েটার” শীর্ষক প্রবন্ধে ওই মন-ব্য করেছিলেন তিনি। বিস্ময় ও বেদনার সঙ্গে বলতে হয়, এখনও এ ধরনের মন-ব্য কেউ এভাবে না লিখলেও বা প্রকাশ্যে না বললেও প্রকারান-রে প্রকাশ করেন নানাভাবে। আর তাঁদের সংখ্যা একেবারে কম নয়।
হারানচন্দ্র রক্ষিতের মন-ব্য অবশ্য পূর্বাপর সম্পূর্ণ উল্লেখের দাবি রাখে। নাহলে অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে বিষয়টি। তবে তিনি যেহেতু একালে প্রায় বিস্মৃত এক নাম তাই আগে তাঁর পরিচয় দেয়া আবশ্যক।
হারানচন্দ্র রক্ষিতের জন্ম ১৮৬৪ সালে, কলকাতার দক্ষিণে জয়নগরের মজিলপুর গ্রামে। কলেজের শিক্ষা পান নি তিনি, তবে তাঁর সাহিত্যস্পৃহা ছিল অদম্য, চর্চা ছিল অক্লান-। মাত্র ২৩ বছর বয়সে সাহিত্য ও সমালোচনামূলক পত্রিকা মাসিক কর্ণধার-এর প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক হিসেবে সাহিত্যজগতে প্রবেশ করেন তিনি। সচিত্র মাসিক পত্রিকা জন্মভূমি কেন্দ্রিক লেখকগোষ্ঠীর একজন হিসেবেই অবশ্য তাঁর পরিচিতি বেশি। বঙ্গবাসী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা যোগেন্দ্রচন্দ্র বসু (১৮৫৪-১৯০৫)-র অনুরোধ ও উপদেশে মেরি ল্যাম্ব (১৭৬৪-১৮৪৭) ও চার্লস ল্যাম্ব (১৭৭৫-১৮৩৪)-এর টেলস অভ শেক্সপিয়ার (১৮০৭) অবলম্বনে শেক্সপিয়ারের নাটকের কাহিনী গল্প-আকারে রচনা করেন হারানচন্দ্র রক্ষিত। এ রচনার কৃতিত্বে বিপুল খ্যাতি পান তিনি, সরকারও ‘রায়সাহেব’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন তাঁকে। এখানে তাঁর প্রকাশিত বইগুলোর একটি তালিকা দিচ্ছি, এতে একালের পাঠক-পাঠিকারা কিছুটা ধারণা নিতে পারবেন হারানচন্দ্র রক্ষিতের বহুমাত্রিক প্রতিভা সম্পর্কে -
প্রবন্ধ-গবেষণা: সাহিত্য সাধনা; বঙ্গসাহিত্যে বঙ্কিম; ভিক্টোরিয়া-যুগে বাঙ্গালা সাহিত্য; ফুলের বাগান; সংসার আশ্রম; রামকৃষ্ণ শানি- শতক।
 উপন্যাস: মোহিনী প্রতিমা (১৮৮৭); নিরাশ প্রণয় (১৮৮৮); প্রতিভা সুন্দরী (১৮৯৩); পদ্মিনী (১৮৯৪)। 
নাটক: বঙ্গের শেষ বীর; কামিনী ও কাঞ্চন; দুলালী (১৮৯২); পারিজাত মালা (১৮৯৭); মন্ত্রের সাধন বা রাণা প্রতাপ (১৮৯৯); চিত্রা ও গৌরী (১৯০০); জ্যোতির্ম্ময়ী বা নুরজাহান (১৯০০); রানী ভবানী (১৯০০); প্রতিভাময়ী (১৯০৪); ভক্তের ভগবান (১৯১৫)।  
অনুবাদ: কামিনী কাহওন; সেকসপীয়র (১-৪); হেমহার (১৮৯৫)।
“সংবাদপত্র ও থিয়েটার” প্রবন্ধটি লেখার একটি বিশেষ কারণ বইটিতে সঙ্কলিত আগের প্রবন্ধ “রবীন্দ্রনাথ”-এর শেষ দু’টি বাক্যে উল্ল্লেখ করেছেন হারানচন্দ্র রক্ষিত। লিখেছেন “থিয়েটার ও সংবাদপত্রের অবনতির সহিত দেশের কি অনিষ্ট হইতেছে,... সেই অপ্রিয় প্রসঙ্গের আলোচনায় বাধ্য হইলাম।”
এবার তাঁর উল্ল্লিখিত মন-ব্য দু’টির পূর্বাপর:
“বিলাতী সভ্যতার আলোকে যেমন আমরা অসংখ্য বস' লাভ করিয়াছি, তেমনই সংবাদপত্র ও থিয়েটার জিনিস দু’টিও পাইয়াছি। সাধারণ লোকশিক্ষার হিসাবে, এই দুইটি জিনিস অমোঘ বলশালী। যাহার প্রভাবে, এক দিনেই সমগ্র দেশ মাতিয়া উঠিতে পারে, তাহার শক্তি ও প্রভাব, বোধ হয় কেহ অস্বীকার করিবেন না। সাধারণতঃ, অল্প-শিক্ষিত, অর্দ্ধ-শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত ব্যক্তির হৃদয় ও মন লইয়া জিনিস দুইটি গঠিত।”
তবে তিনি মনে করেন, “অশিক্ষিতের উপভোগ্য বলিয়া যে সেই জিনিস সুশিক্ষিতেরও আদরণীয় হইবে না, এমন কোন অর্থ নাই। এই দেশে এবং প্রায় সকল দেশে এমন অনেক জিনিস আছে, যাহা পণ্ডিত ও মূর্খে সমান আগ্রহে উপভোগ করিতে পারে। এই সংবাদপত্র ও থিয়েটার হইতেও তাহা পারে।”
এরপর আসল কথাটা পাড়েন হারানচন্দ্র রক্ষিত, “তবে আসল কথাটা হইতেছে এই যে, সংবাদপত্র ও থিয়েটার জিনিসটা প্রধানতঃ সধংং বা ‘দল’ লইয়া পরিচালিত। দলের রুচি অনুযায়ী সাময়িক আন্দোলন, হুজুগ, সংস্কার ও নূতন প্রবর্ত্তন, - প্রধানতঃ এই লইয়াই ঐ দুইটি জিনিস চলিয়া থাকে। সুতরাং অনেকটা আড়ম্বর ও দোকানদারী ঐ জিনিস দুটায় করিতে হয়। না করিলে আসর জমে না, খরিদদার জুটে না।”
এবার তিনি ব্যক্ত করেন তাঁর অনুযোগের কারণ, “এ দেশের কথা দূরে যাউক, এই শিক্ষা-সভ্যতার পূর্ণ-আধিপত্যকালে, খাস ইংলণ্ড এবং আমেরিকায়ও ঐ অবস'া। তবে, সেখানে ঐ ব্যবসাদারীর সঙ্গে সঙ্গে, লোকহিতের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি থাকে, এখানে অনেক স'লেই তাহা নাই।... দুঃখের বিষয় এই যে, সাধারণের প্রতিনিধি স্বরূপ হইয়া আমাদের দেশের অধিকাংশ সংবাদপত্র ও থিয়েটার ক্রমেই বড় অবনতির দিকে যাইতেছে। কথাটা উল্টাইয়া বলিলে ইহাই বলা হয় যে, সাধারণ লোকের মতি-গতি ক্রমশই বড় নিম্নগামী হইতেছে। সংবাদপত্র ও থিয়েটার সমাজের দর্পণ-স্বরূপ; সাধারণের প্রতিবিম্ব অনেক সময় সেই দর্পণে প্রতিবিম্বিত হইয়া থাকে। একজন বিদেশী পর্য্যটক কোন দেশে উপনীত হইয়া যদি সর্ব্বাগ্রে সেই দেশের সংবাদপত্র পাঠ করেন এবং থিয়েটার দেখেন, তবে তিনি স্বল্পায়াসে সেই দেশের রীতি-নীতি, আচার-পদ্ধতি, শিক্ষা ও মনের গতি হৃদয়ঙ্গম করিতে পারেন। সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন-স-ম্ভ দেখিয়া যেমন সেই দেশের অভাব অনুযোগ উপলব্ধি হয়, সম্পাদকীয় মন-ব্য পাঠ করিয়াও তেমনি সে দেশের শিক্ষা-দীক্ষা, রুচি-প্রবৃত্তি এবং মানসিক গঠনও জানা গিয়া থাকে। পক্ষান-রে, থিয়েটার দেখিতে গিয়াও দেশের অবস'া কিছুটা বুঝা যায়। সাধারণ লোক কি চায়, কি ভালবাসে, কোন্‌ রসের বেশী ভক্ত, তাহা সেই দর্শক ও শ্রোতৃবৃন্দের মুখের তৎকালীন ভাব দেখিয়া জানা যায়।”
সংবাদপত্রের মতো থিয়েটারেরও যে লোকহিতের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি নেই তা লক্ষ্য করেছেন হারানচন্দ্র রক্ষিত। লিখেছেন, “... শ্রোতা ও দর্শকের মনের ভাব বুঝিয়া অধিকাংশ অভিনেতা ও অভিনেত্রী অভিনয় করিয়া থাকে। সাধারণতঃ ‘বাহবা’ই তাহাদের সম্বল; সমবেত দর্শক ও শ্রোতার তুষ্টি-সাধনই তাহাদের লক্ষ্য; আর রঙ্গমঞ্চের অধিকারী বা অধ্যক্ষের ইঙ্গিত-উপদেশ পালন করাই তাহাদের কার্য্য। তাহার বেশী তাহারা বড় একটা যায় না, - যাইতে পারে না।”
থিয়েটারের পাশাপাশি সংবাদপত্রের অবস'ার দিকে তাকিয়ে ১০০ বছর আগে অন্ধকার দেখেছিলেন হারানচন্দ্র রক্ষিত। বলেছিলেন, “বাঙ্গালী-জীবনে ধিক্কার জন্মে!”
এবার দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিতে হচ্ছে:
“যে সংবাদপত্র বিলাতে প্রবল রাজশক্তির পশ্চাদ্ধাবিত হয়; যে শক্তি সভ্যদেশের ‘চতুর্থ শক্তি’র  মধ্যে গণ্য; যে দেশের সংবাদপত্র-সম্পাদক সাধারণের প্রতিনিধি বলিয়া রাজার ন্যায় সম্মান পান, - তুলনা করাও দূরে থাক্‌, - সে দেশের ও সে জাতির ‘আদর্শে’র ধারণাও যেন আমাদের স্বপ্ন বলিয়া মনে হয়।... মুখসর্ব্বস্ব বাঙ্গালীর যা ধর্ম্ম , বাঙ্গালীর সংবাদপত্রেও ত তার ছায়া পড়িবে। স্বার্থত্যাগী ও সত্যসন্ধ হইতে না পারিলে সম্পাদকের আসন লওয়া বিড়ম্বনা মাত্র।... এখন ব্যক্তিগত কুৎসা ও গালাগালি, বৈরিতা ও দলাদলি, - কোন কোন কাগজের একমাত্র অঙ্গ। সাধারণ শিক্ষা ও লোকহিত কিরূপে হইবে; সমাজ ও দেশ কিরূপে উন্নত হইবে; দেশের অভাব ও অভিযোগ কোন্‌ উপায়ে প্রশমিত হইবে; প্রজার প্রতি রাজার সহানুভূতি কিসে বর্দ্ধিত হইবে, - সে দিকে কাহারও লক্ষ্য নাই। লক্ষ্যের মধ্যে আছে, কিসে পাঠকের মনোরঞ্জন হইবে, - কিসে নিজের দুই পয়সা লাভ হইবে, - আর কিসে গ্রাহক জুটিবে। অথচ ইঁহারাই এখন লোক-শিক্ষকের পদে অভিষিক্ত, - ইঁহারাই এখন “বড়লোক”। ... এখন বিজ্ঞাপনের যুগ!... যার যত বিজ্ঞাপন, তার তত জয়জয়কার! ধর্ম্ম মানিবে না, মনুষ্যত্ব দেখিবে না, সমাজের পানে চাহিবে না, - যেন তেন প্রকারেণ টাকা আসিলেই হইল! সর্ব্বত্রই কেবল “টাকা, টাকা, টাকা” - রব।...”
উপসংহারে হারানচন্দ্র রক্ষিত যা লিখেছেন তা এই ১০০ বছর পর পাঠ করতে হয় অতীব বিস্ময়ের সঙ্গে। তিনি যে “থিয়েটার”-এর কথা লিখেছেন তার স'ান এখন দখল করে নিয়েছে অন্য একটি মাধ্যম। সে মাধ্যমের নাম যে “টিভি চ্যানেল” তা উল্লেখ না করলেও পাঠক বুঝে নিতেন সহজেই।
শেষ কথা হিসেবে তিনি যা লিখেছেন তা এই:
“সংবাদপত্র ও থিয়েটার, - এই দুই প্রবল শক্তি ক্রমেই সাধারণের মন হইতে শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস হারাইতেছে। সংবাদপত্রের সকল কথা এখন আর লোকে সহজে বিশ্বাস করে না। কাহারও সম্বন্ধে প্রশংসা বা নিন্দা প্রকাশ হইলে, পাঠক স্পষ্টই বলিয়া থাকেন, - ঐ লোকটার সঙ্গে এই কাগজওয়ালার কোনরূপ স্বার্থের সম্বন্ধ বা মনোবিবাদ আছে। এইরূপ বিশ্বাস হারাইতে হারাইতে সংবাদপত্রের অসি-ত্ব, - শেষে বিজ্ঞাপনেই পর্যবসিত হইবে। দু’একখানার ঠিক তাহাই হইয়াছে।”
এ অবস'ায় করণীয় কি?
১৯১১ সালে একজন বিক্ষুব্ধ হারানচন্দ্র রক্ষিত লিখেছিলেন, “... সংবাদপত্র ও থিয়েটার সমাজের দর্পণস্বরূপ। যে দর্পণে বাঙ্গালী-জীবনের এমন কুৎসিত প্রতিবিম্ব উঠে, সে দর্পণ ভাঙ্গিয়া ফেলাই ভাল। সে দর্পণকে নির্ম্মল ও উজ্জ্বল করিতে না পারিলে, তাহার অসি-ত্ব লোপ করিয়া, অন্ধকারে চক্ষু মুদিয়া থাকাই বিধেয়।”
২০১১ সালে এমন কিছু আমরা দেখি না, শুনি না, বলি না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন