আমরা বাঙালিরা নাকি খুব ভুলো। সব কিছুই ভুলে যাই সহজে। আমাদের আবেগের স'ায়িত্ব চব্বিশ ঘণ্টাও নয়। রাগ ভুলে যাই, দুঃখকষ্ট ভুলি। ক্ষমা করে দেই, মেনে নেই, আপস করি। আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি ইত্যাদিও ‘বিস্মরণের খেয়া ভরা পালে অকূলে দিয়েছে পাড়ি’। সেই ষাট-সত্তর দশকের মার্কিন-চীন-সউদি বিরোধিতা, বিদ্বেষ, বিরাগ এখন কোথায়? এখন তাদের সঙ্গে কোলাকুলি চলছে খোলাখুলি। দেশের ভেতরেও একই অবস্থা। অতীতের সরকারগুলোর দমন-নির্যাতন, দুঃশাসনও ভুলে যাই আমরা। সে সব রক্ত, অশ্রু, আর্তনাদ, অপমান, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা - কিছুই মনে রাখি না আর। তবে প্রতি বছর, নতুন বছরের শুরুতে, আমরা একবার হলেও ফিরে দেখার চেষ্টা করি ফেলে আসা বছরটিকে। সে ভাবে আমিও গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকার ২০১২ সালকে স্বাগত জানাবার পাশাপাশি একবার তাকাই ২০১১ সালের দিকে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলে থাকা কিশোরী ফেলানি’র লাশ, দোররায় ক্ষতবিক্ষত পল্লীবালা ফাতেমার দেহ, জখমে বিকৃত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রুমানা মনজুরের মুখ, গুলিবিদ্ধ কলেজ-ছাত্র লিমনের অসহায় চেহারা, ঘাতকের নির্মম বুলেটের শিকার মেয়র লোকমানের লাশ - নৃশংস বীভৎসতার সাক্ষ্য এমন আরও অনেক মুখ কি সহজে মুছে যাবে আমাদের স্মৃতি থেকে? আমিনবাজারের অদূরে ঈদের আগের রাতে গণপিটুনিতে নিহত ৬ ছাত্রের কথা কি ভুলে যাবো আমরা? মিরসরাইয়ে দুর্ঘটনায় নিহত ৪৬ স্কুলছাত্র, মানিকগঞ্জে দুর্ঘটনায় নিহত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও টিভি ব্যক্তিত্ব মাশুক মুনীর - ওরাও হারিয়ে যাবে কালের গর্ভে? বিশ্বাস হতে মন চায় না। তারপর পুলিশের বুটের নিচে মিছিলকারীর আর্ত মুখ? না, ভুলে যাবো না। সোমালিয়া জলদস্যুদের কবলে পড়া ‘জাহানমণি’র নাবিক ও এক নাবিক-পত্নীর বিপন্নতার কথাও মনে থাকবে আমার।
সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলে থাকা ফেলানি’র গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত লাশ ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ভঙ্গুরতাকেই দেখিয়ে দিয়েছে চোখে আঙুল দিয়ে। সাউথ ব্লক যেখানে নিজেদের স্বার্থ, সুবিধা, সুযোগ উদ্ধার করে নিতে অভ্যস্ত - সেখানে আমাদের সেগুনবাগিচায় হচ্ছেটা কি? ওদের কাছ থেকে ওসব উদ্ধার করার কৌশলটাও কি শিখতে পারে না এরা? দরাদরি নেই, কষাকষি নেই, এ কেমন কূটনৈতিক লেনাদেনা? যে জন প্রেমের ভাব জানে না তার সঙ্গে সেভাবে লেনাদেনা না করার কথাই তো বলে সবাই। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের এখানে ওখানে টুটাফুটা যা কিছু আছে তা সব সারাতে হবে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে। আমাদের অব্যবহিত বিশাল প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক যেমন অপরিহার্য আমাদের জন্য, তেমনই অবস্থান ও পরিস্থিতিগত কারণে আমরাও তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভারতের জন্য। ব্যবসা, বিনিয়োগ, যোগাযোগ ছাড়াও আরও অনেক ক্ষেত্র আছে যেখানে সমান হিস্যা নিয়ে আমরা উভয়েই হতে পারি লাভবান। এদিকটায় সেগুনবাগিচার উদ্যোগ বা আয়োজন কিছু আছে বলে মনে হয় না। এছাড়া সীমান্তের এপার-ওপারের বাংলাভাষী আমরা এক অভিন্ন ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। এর মধ্যে বিচ্ছিন্নতা থেকে ঘটেছিল দূরত্ব। এখন ১৯৪৬, ১৯৪৭ ও ১৯৬৪’র সেই তিক্ততা ও বিদ্বেষবিষ কাটিয়ে উঠেছে নতুন প্রজন্ম। ভৌগোলিক ভিন্নতা থাকলেও মানসিক ঐক্য তাই আগের যে কোনও সময়ের চেয়ে বেশি। তাই সময় এসেছে খণ্ডিত হওয়ার কারণে জাতিগতভাবে যে অসম্পূর্ণতা সৃষ্টি হয়েছে তাকে সমন্বিত ও সম্পন্ন করে তোলার।
গত বছরের শেষ দিকে একটি ভারতীয় বাংলা ছবি মুক্তি পেয়েছে, অন্তত আরও দু’টি মুক্তি পাবে বলে পত্রিকায় খবর দেখেছি। ১৯৬৫ সালের পর বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কোনও ভারতীয় ছবির বাংলাদেশে মুক্তি এই প্রথম। এর আগে কলকাতা, মুম্বই ও চেন্নই-এ নির্মিত ছবি নিয়মিত চলতো এ দেশের প্রেক্ষাগৃহগুলোতে। ১৯৬২ সালে শেষ মুক্তি পাওয়া দু’টি ছবি ছিল রাজ কাপুর, মালা সিনহা, মেহমুদ অভিনীত ‘পরবরিশ’ (১৯৫৩) এবং মঞ্জুলা বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মলকুমার অভিনীত ‘অগ্নিসম্ভবা’ (১৯৫৯)।
ভারতীয় ছবির মুক্তি পাওয়া নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক শোরগোল হয়েছে, এখনও হচ্ছে। উচ্চারিত হচ্ছে কঠোর-কঠোর কথা। আমার মনে পড়ছে আশির দশকে বিটিভিতে এক সাক্ষাৎকারে প্রয়াত অভিনেতা মুস্তাফা বলেছিলেন, ‘ভারতীয় ছবি এদেশে মুক্তি পেলে ক্ষতি হবে ১২ জন ব্যক্তির, তবে লাভবান হবে ১৫ কোটি মানুষ।’ আমিও কয়েকবার অনুষ্ঠানে কয়েকটি শর্তে ভারতীয় ছবি আমদানির পক্ষে কথা বলেছি, লিখেছিও বিচ্ছিন্নভাবে। কিন্তু এসব কি ছবি আমদানি হচ্ছে ভারত থেকে? এ সব ছবির পক্ষে লিখতে রাজি নই আমি। ভারতে ধুমধাড়াক্কা সস্তা বাণিজ্যিক ছবি তো শুধু নির্মিত হয় না, উন্নত মানের শৈল্পিক ছবিও নির্মিত হয় অনেক। যদি আমদানি করতে হয় তবে সে সব ছবি, বিশেষ করে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবিগুলো থেকে বাছাই করে তা করতে হবে। এ সব ছবি আমদানি করার সুযোগ দিতে হবে তাঁদের - যাঁরা আমাদের এখানে ভাল ছবি প্রযোজনা করেন নিয়মিত। পাকিস্তান আমলে এমন একটা ব্যবস্থা ছিল বলে শুনেছি। এতে প্রযোজকরা পুষিয়ে নিতে পারেন ক্ষতি (যদি হয়)।
গত ২২শে সেপ্টেম্বর বিরোধী দলের মিছিলে পুলিশের অ্যাকশন এর আগের ও পরের অনেক অ্যাকশনের মতোই। লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস, গরম বা রঙিন পানি, রবার বুলেট ইত্যাদি দিয়ে বিক্ষোভকারীদের শায়েস্তা করা, তারপর আটক-গ্রেপ্তার, মামলা, রিমান্ডে নির্যাতন ইত্যাদি দিয়ে ভিন্নমতাবলম্বীদের দলন-নির্যাতন এই ‘গণতান্ত্রিক’ যুগেও চলছে মাত্রা ছাড়িয়ে। শানি-পূর্ণ মিছিল, সমাবেশ এমন কি অতিনিরীহ মানববন্ধনও সহনীয় নয় এখন। প্রবল হিংস্রতা নিয়ে বিরোধী চিন্তাচেতনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া এখন হয়ে উঠেছে সময়ের নিয়ম। সেই নিয়মেরই এক প্রতীকচিত্র হয়ে দেখা দিয়েছে ২২শে সেপ্টেম্বরের ওই ছবিটি - ধাওয়া করে এক মিছিলকারীকে ধরে মারতে-মারতে নিচে ফেলে বুট দিয়ে পেষা এক পুলিশের। এই ছবি ছাপা হতে পারতো ‘বুটের তলায় গণতন্ত্র’ ক্যাপশন নিয়েও। হয়তো সে ভাবে ছাপা হয়েছে কোথাও, না হয়ে থাকলে একদিন হবে কোথাও।
রুমানা মনজুরের সঙ্গে তাঁর স্বামীর সম্পর্ক আগের থেকেই ভাল ছিল না। পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ার পর তাঁর উচিত ছিল বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনকে বিষয়টি জানিয়ে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য জোর উদ্যোগ নেয়া। স্বামীর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারেও সতর্ক থাকা উচিত ছিল তাঁর। এই অসতর্কতার অভাবেই স্বামীর বর্বর আক্রমণের, জঘন্যতম নৃশংসতার শিকার হন তিনি। পরে বন্দি অবস্থায় তাঁর স্বামীর রহস্যময় মৃত্যু নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে জনমনে। রুমানা মনজুর আবার এসেছেন আলোচনায়। ফেলানি, ফাতেমা’র মতো তিনিও ২০১১ সালের এক নির্যাতিত নারীপ্রতীক। এঁদের জন্য দেশের বিভিন্ন অঙ্গনে প্রতিপত্তির সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত, উজ্জ্বল, আলোকিত, আলোচিত নারীদের মুখগুলো ম্লান হয়ে যায় আমার চোখে।
২০১২ এসেছে, কিন্তু অঙ্গীকার নেই কোথাও। ২০১১তে যে নির্মমতা ও নৃশংসতার সাক্ষী বা দর্শী হতে হয়েছে আমাদের সে সবের প্রতিবিধান বা প্রতিকারের কোনও লক্ষণ নেই কোথাও। আগের মতোই সব কিছু চলছে আগের মতোই। কোথাও কোনও গ্যারান্টি নেই। কূটনীতি নিস্ফল, তাই সীমানে- গুলিবর্ষণ চলছেই। ফতোয়া থামছে না, দোররা চলছে। ফাতেমা’র মতো আরও অনেকে নারীই ক্ষতবিক্ষত ও জর্জরিত হচ্ছে কশাঘাতে। উত্তরাঞ্চলের দুই নারীকে দোররা মারার দৃশ্য দেখানো হয়েছে টিভিতেও। অন্যায়ের কত প্রতাপ! কি প্রবল পরাক্রান্ত স্পর্ধা! দেশকে মধ্যযুগের দিকে নিয়ে যাচ্ছে ধর্মান্ধ-দুর্বৃত্ত চক্র, অথচ বাধা দেয়ার কেউ নেই। সত্যিই কি নিজের বাড়িতে আগুন না লাগা পর্যন্ত অন্যের বাড়িতে লাগা আগুনের তাপ তো পায় না কেউ?
২০১১ স্মরণীয় হয়ে থাকবে আরও নানা কারণে। এ বছরেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়েছে, দু’ ভাগ হয়েছে ঢাকা সিটি করপোরেশন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে। এই বছরেই জনঅভ্যুত্থান ঘটেছে আড়িয়ল বিল রক্ষার দাবিতে। আরেক জনঅভ্যুত্থানে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। দেশের প্রথম নারী মেয়র তিনি।
২০১২ সাল নিয়ে আমার প্রত্যাশা বেশি নেই, তবে আশঙ্কা আছে অনেক। রিজার্ভহীন অর্থনীতি, তেলের মূল্যবৃদ্ধি, পণ্যমূল্যের বল্গাহীন দৌড়, শেয়ারবাজারে ধস, সংঘাত-সহিংসতার ক্রমবৃদ্ধি, ক্ষমতার রাজনীতির মরিয়া হুঙ্কার - কোথায় যাচ্ছি আমরা? অতীত ‘বিস্মরণের খেয়া ভরা পালে অকূলে পাড়ি’ দিলেও ভবিষ্যৎ তো ধেয়ে আসে প্রতিক্ষণে?
সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলে থাকা ফেলানি’র গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত লাশ ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ভঙ্গুরতাকেই দেখিয়ে দিয়েছে চোখে আঙুল দিয়ে। সাউথ ব্লক যেখানে নিজেদের স্বার্থ, সুবিধা, সুযোগ উদ্ধার করে নিতে অভ্যস্ত - সেখানে আমাদের সেগুনবাগিচায় হচ্ছেটা কি? ওদের কাছ থেকে ওসব উদ্ধার করার কৌশলটাও কি শিখতে পারে না এরা? দরাদরি নেই, কষাকষি নেই, এ কেমন কূটনৈতিক লেনাদেনা? যে জন প্রেমের ভাব জানে না তার সঙ্গে সেভাবে লেনাদেনা না করার কথাই তো বলে সবাই। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের এখানে ওখানে টুটাফুটা যা কিছু আছে তা সব সারাতে হবে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে। আমাদের অব্যবহিত বিশাল প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক যেমন অপরিহার্য আমাদের জন্য, তেমনই অবস্থান ও পরিস্থিতিগত কারণে আমরাও তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভারতের জন্য। ব্যবসা, বিনিয়োগ, যোগাযোগ ছাড়াও আরও অনেক ক্ষেত্র আছে যেখানে সমান হিস্যা নিয়ে আমরা উভয়েই হতে পারি লাভবান। এদিকটায় সেগুনবাগিচার উদ্যোগ বা আয়োজন কিছু আছে বলে মনে হয় না। এছাড়া সীমান্তের এপার-ওপারের বাংলাভাষী আমরা এক অভিন্ন ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। এর মধ্যে বিচ্ছিন্নতা থেকে ঘটেছিল দূরত্ব। এখন ১৯৪৬, ১৯৪৭ ও ১৯৬৪’র সেই তিক্ততা ও বিদ্বেষবিষ কাটিয়ে উঠেছে নতুন প্রজন্ম। ভৌগোলিক ভিন্নতা থাকলেও মানসিক ঐক্য তাই আগের যে কোনও সময়ের চেয়ে বেশি। তাই সময় এসেছে খণ্ডিত হওয়ার কারণে জাতিগতভাবে যে অসম্পূর্ণতা সৃষ্টি হয়েছে তাকে সমন্বিত ও সম্পন্ন করে তোলার।
গত বছরের শেষ দিকে একটি ভারতীয় বাংলা ছবি মুক্তি পেয়েছে, অন্তত আরও দু’টি মুক্তি পাবে বলে পত্রিকায় খবর দেখেছি। ১৯৬৫ সালের পর বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কোনও ভারতীয় ছবির বাংলাদেশে মুক্তি এই প্রথম। এর আগে কলকাতা, মুম্বই ও চেন্নই-এ নির্মিত ছবি নিয়মিত চলতো এ দেশের প্রেক্ষাগৃহগুলোতে। ১৯৬২ সালে শেষ মুক্তি পাওয়া দু’টি ছবি ছিল রাজ কাপুর, মালা সিনহা, মেহমুদ অভিনীত ‘পরবরিশ’ (১৯৫৩) এবং মঞ্জুলা বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মলকুমার অভিনীত ‘অগ্নিসম্ভবা’ (১৯৫৯)।
ভারতীয় ছবির মুক্তি পাওয়া নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক শোরগোল হয়েছে, এখনও হচ্ছে। উচ্চারিত হচ্ছে কঠোর-কঠোর কথা। আমার মনে পড়ছে আশির দশকে বিটিভিতে এক সাক্ষাৎকারে প্রয়াত অভিনেতা মুস্তাফা বলেছিলেন, ‘ভারতীয় ছবি এদেশে মুক্তি পেলে ক্ষতি হবে ১২ জন ব্যক্তির, তবে লাভবান হবে ১৫ কোটি মানুষ।’ আমিও কয়েকবার অনুষ্ঠানে কয়েকটি শর্তে ভারতীয় ছবি আমদানির পক্ষে কথা বলেছি, লিখেছিও বিচ্ছিন্নভাবে। কিন্তু এসব কি ছবি আমদানি হচ্ছে ভারত থেকে? এ সব ছবির পক্ষে লিখতে রাজি নই আমি। ভারতে ধুমধাড়াক্কা সস্তা বাণিজ্যিক ছবি তো শুধু নির্মিত হয় না, উন্নত মানের শৈল্পিক ছবিও নির্মিত হয় অনেক। যদি আমদানি করতে হয় তবে সে সব ছবি, বিশেষ করে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবিগুলো থেকে বাছাই করে তা করতে হবে। এ সব ছবি আমদানি করার সুযোগ দিতে হবে তাঁদের - যাঁরা আমাদের এখানে ভাল ছবি প্রযোজনা করেন নিয়মিত। পাকিস্তান আমলে এমন একটা ব্যবস্থা ছিল বলে শুনেছি। এতে প্রযোজকরা পুষিয়ে নিতে পারেন ক্ষতি (যদি হয়)।
গত ২২শে সেপ্টেম্বর বিরোধী দলের মিছিলে পুলিশের অ্যাকশন এর আগের ও পরের অনেক অ্যাকশনের মতোই। লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস, গরম বা রঙিন পানি, রবার বুলেট ইত্যাদি দিয়ে বিক্ষোভকারীদের শায়েস্তা করা, তারপর আটক-গ্রেপ্তার, মামলা, রিমান্ডে নির্যাতন ইত্যাদি দিয়ে ভিন্নমতাবলম্বীদের দলন-নির্যাতন এই ‘গণতান্ত্রিক’ যুগেও চলছে মাত্রা ছাড়িয়ে। শানি-পূর্ণ মিছিল, সমাবেশ এমন কি অতিনিরীহ মানববন্ধনও সহনীয় নয় এখন। প্রবল হিংস্রতা নিয়ে বিরোধী চিন্তাচেতনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া এখন হয়ে উঠেছে সময়ের নিয়ম। সেই নিয়মেরই এক প্রতীকচিত্র হয়ে দেখা দিয়েছে ২২শে সেপ্টেম্বরের ওই ছবিটি - ধাওয়া করে এক মিছিলকারীকে ধরে মারতে-মারতে নিচে ফেলে বুট দিয়ে পেষা এক পুলিশের। এই ছবি ছাপা হতে পারতো ‘বুটের তলায় গণতন্ত্র’ ক্যাপশন নিয়েও। হয়তো সে ভাবে ছাপা হয়েছে কোথাও, না হয়ে থাকলে একদিন হবে কোথাও।
রুমানা মনজুরের সঙ্গে তাঁর স্বামীর সম্পর্ক আগের থেকেই ভাল ছিল না। পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ার পর তাঁর উচিত ছিল বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনকে বিষয়টি জানিয়ে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য জোর উদ্যোগ নেয়া। স্বামীর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারেও সতর্ক থাকা উচিত ছিল তাঁর। এই অসতর্কতার অভাবেই স্বামীর বর্বর আক্রমণের, জঘন্যতম নৃশংসতার শিকার হন তিনি। পরে বন্দি অবস্থায় তাঁর স্বামীর রহস্যময় মৃত্যু নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে জনমনে। রুমানা মনজুর আবার এসেছেন আলোচনায়। ফেলানি, ফাতেমা’র মতো তিনিও ২০১১ সালের এক নির্যাতিত নারীপ্রতীক। এঁদের জন্য দেশের বিভিন্ন অঙ্গনে প্রতিপত্তির সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত, উজ্জ্বল, আলোকিত, আলোচিত নারীদের মুখগুলো ম্লান হয়ে যায় আমার চোখে।
২০১২ এসেছে, কিন্তু অঙ্গীকার নেই কোথাও। ২০১১তে যে নির্মমতা ও নৃশংসতার সাক্ষী বা দর্শী হতে হয়েছে আমাদের সে সবের প্রতিবিধান বা প্রতিকারের কোনও লক্ষণ নেই কোথাও। আগের মতোই সব কিছু চলছে আগের মতোই। কোথাও কোনও গ্যারান্টি নেই। কূটনীতি নিস্ফল, তাই সীমানে- গুলিবর্ষণ চলছেই। ফতোয়া থামছে না, দোররা চলছে। ফাতেমা’র মতো আরও অনেকে নারীই ক্ষতবিক্ষত ও জর্জরিত হচ্ছে কশাঘাতে। উত্তরাঞ্চলের দুই নারীকে দোররা মারার দৃশ্য দেখানো হয়েছে টিভিতেও। অন্যায়ের কত প্রতাপ! কি প্রবল পরাক্রান্ত স্পর্ধা! দেশকে মধ্যযুগের দিকে নিয়ে যাচ্ছে ধর্মান্ধ-দুর্বৃত্ত চক্র, অথচ বাধা দেয়ার কেউ নেই। সত্যিই কি নিজের বাড়িতে আগুন না লাগা পর্যন্ত অন্যের বাড়িতে লাগা আগুনের তাপ তো পায় না কেউ?
২০১১ স্মরণীয় হয়ে থাকবে আরও নানা কারণে। এ বছরেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়েছে, দু’ ভাগ হয়েছে ঢাকা সিটি করপোরেশন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে। এই বছরেই জনঅভ্যুত্থান ঘটেছে আড়িয়ল বিল রক্ষার দাবিতে। আরেক জনঅভ্যুত্থানে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। দেশের প্রথম নারী মেয়র তিনি।
২০১২ সাল নিয়ে আমার প্রত্যাশা বেশি নেই, তবে আশঙ্কা আছে অনেক। রিজার্ভহীন অর্থনীতি, তেলের মূল্যবৃদ্ধি, পণ্যমূল্যের বল্গাহীন দৌড়, শেয়ারবাজারে ধস, সংঘাত-সহিংসতার ক্রমবৃদ্ধি, ক্ষমতার রাজনীতির মরিয়া হুঙ্কার - কোথায় যাচ্ছি আমরা? অতীত ‘বিস্মরণের খেয়া ভরা পালে অকূলে পাড়ি’ দিলেও ভবিষ্যৎ তো ধেয়ে আসে প্রতিক্ষণে?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন