সোমবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১২

সংঘাত চারদিকে

সভা নয়, সমাবেশ নয়, মিছিল নয়, মানববন্ধন নয়, এমনকি ঘরের মধ্যে বৈঠক পর্যন্ত নয়। তাহলে রাজনৈতিক কর্মসূচি চলবে কি এই পথে? না। ওই পথে? না। তাহলে কোন পথে? কোনও পথে না। কেননা, নাশকতার আশঙ্কা আছে। গোয়েন্দা সূত্রে খবর আছে ধ্বংসাত্মক তৎপরতার। শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে, জনগণের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে তাই
 বিরোধী দলের প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মসূচির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা, ১৪৪ ধারা জারি, পুলিশি অ্যাকশন, ছাত্রলীগের হামলা চলছে অব্যাহত ভাবে। সরকার ও সরকারি দলের ভাবখানা এরকম- বিরোধী দলের সকল আয়োজন পণ্ড করতে হবে। কারণ তাদের আচরণ অগণতান্ত্রিক, মতলব সহিংসতা সৃষ্টির। আর আমরা গণতান্ত্রিক, তাই আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে গণতন্ত্র-সম্মত ব্যবস্থা নিতে হবে তাদের নিয়ন্ত্রণে।
দেশের রাজনীতি এমন এক সংঘাত-সংঘর্ষমুখী চিন্তার মধ্যে প্রবেশ করেছে এখন। পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে উত্তপ্ত, রাজনীতি উত্তেজনাপূর্ণ, রাজপথ রক্তপাতময়, দেশ অগ্নিগর্ভ। হঠাৎ করে এই অশান্ত অস্থিরতা দেখা দেয়নি দেশে। দিনে দিনে ক্রমে ক্রমে বেড়েছে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, শুরু হয়েছে দলন দমন নির্যাতন। হামলা মামলা গুম খুন। বিরোধী দলকে যেন তেন সকল প্রকারে দাবিয়ে রাখাই যেন একমাত্র রাজনৈতিক কাজ, সকাল-বিকাল তাদের গালমন্দ করাই একমাত্র সরকারি কর্তব্য ও দায়িত্ব। এ অবস্থায় ‘সংঘাতের আশঙ্কা’ বা ‘সংঘাত অনিবার্য’ গোছের কোন বর্ণনা নয়, বলতে হচ্ছে- আমরা যেন এক সংঘাতক্ষেত্রে মুখোমুখি হয়ে পড়েছি পরস্পর প্রতিপক্ষের।
অন্যদিকে বিরোধী দলের ভূমিকাকেও ঠিক দায়িত্বশীল বলা যাবে না। তাদের সংসদ বর্জনের পক্ষে যে যুক্তি তা একেবারেই খোঁড়া। কোন সংসদেই অত সহজ শান্তি থাকে না যত তারা দাবি করেন। তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও সংসদ বর্জন বিরোধী যে ঘোষণা ছিল তা নিজেরাই অমান্য করে চলেছেন তারা। অথচ সুযোগ-সুবিধাগুলো ঠিকমতোই নিচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন জ্বলন্ত ইস্যুতে তাদের কোন কার্যকরী ভূমিকা দেখা যায় না। জনগণের পাশেও দাঁড়াতে দেখা যায় না। কোন সামাজিক ভূমিকাতেও তারা অনুপস্থিত। মধ্যবর্তী নির্বাচনের মতো নন-ইস্যু নিয়েও তাদের অকারণ মাতামাতি দেখা গেছে। এখনও মাঝে মধ্যে জিগির ওঠে। এরপর আছে নির্বাচন বর্জনের খেলা যা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তাদের ব্যর্থতারই প্রমাণ। তাদের আন্দোলন পুরোপুরি নেতিবাচক, ক্ষমতার রাজনীতির লড়াই মাত্র। কিন্তু সে লড়াইয়েও জোর নেই তাদের। তেমন উদ্যোগ-আয়োজন নেই। সমাজের সকল স্তরের মানুষের মধ্যেই আছে নানা অভাব-অভিযোগ। সেগুলোর কোন প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় না বিরোধী দলের বক্তৃতা-বিবৃতিতে, দাবি-দাওয়া ও সমালোচনার ভাষায়।
সর্বশেষ উত্তেজনার শুরু প্রধান বিরোধী দল বিএনপির গণমিছিলের কর্মসূচি নিয়ে। গতকাল এই কর্মসূচি নস্যাৎ করতে পাল্টা কর্মসূচি দেয় সরকারি দল। তারপর যা হয়। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় ও সম্ভাব্য নাশকতা ঠেকাতে পুলিশের নিষেধাজ্ঞা জারি। এ অবস্থায় বিএনপি পিছিয়ে দেয় তাদের কর্মসূচির দিন। কিন্তু রেহাই নেই তবু। সরকারি দল সেদিনও দিয়ে বসেছে পাল্টা কর্মসূচি। এ অবস্থায় চলতে থাকার অর্থ দেশকে অনিবার্য সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়া। পত্রিকান্তরে এ সম্পর্কে অভিমত জানাতে গিয়ে এ কথাই বলেছেন বিশিষ্ট নাগরিকেরা। বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেছেন, রাজনৈতিক কর্মসূচির ধারাবাহিক পথ রুদ্ধ হয় এমন পরিবেশ সৃষ্টি কারও কাম্য নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেছেন, রাজনৈতিক কর্মসূচির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির সিদ্ধান্ত অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে অদূরদর্শী। ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, আইনগতভাবে কিছু করতে যখন কাউকে বাধা দেয়া হয় তখন নাগরিকদের বেআইনি পথে যেতে বাধ্য করা হয়। বিরোধী দলের কর্মসূচিতে পদে পদে বাধা দিয়ে সরকার খুবই বিপজ্জনক পথে পা বাড়াচ্ছে।
সে বিপদ কতখানি ভয়াবহ হয়ে উঠছে তার প্রমাণ মিলেছে এরই মধ্যে। গতকালই দেশের অন্তত ১৬টি জেলায় বিরোধী দলের গণমিছিল আক্রান্ত হয়েছে। পুলিশ ও সরকারি দলের লোকজন বিশেষ করে ছাত্রলীগের কর্মী-ক্যাডার হামলা চালিয়েছে যুগপৎ। গুলিবর্ষণ, লাঠিচার্জ হয়েছে। রক্ত ঝরেছে রাজপথে। প্রাণ দিয়েছেন চারজন, রক্তাক্ত জখম হয়েছেন ১০০ জন। এ মৃত্যু, এ রক্তপাতের জবাব কি?
সরকার ও সরকার দল চোখ থাকতে অন্ধ- একথা নিশ্চয়ই বলবেন না কেউ। তিন বছরে নানা স্লোগান, নানা তৎপরতা থাকলেও দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার রাশ টেনে ধরা যায়নি। গ্যাস-বিদ্যুৎ বিভ্রাট সামলানো যায়নি, তিস্তা-ফেনী নদীর পানি বণ্টন চুক্তি হয়নি। ছিটমহল নিয়ে চুক্তি হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। সীমান্তে হত্যা-নির্যাতন বন্ধে যথাউদ্যোগ নেই। পদ্মা সেতুসহ অনেক উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের সমাধি ঘটেছে কেলেঙ্কারিতে। পুঁজিবাজার আর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি? নিজ দলের মধ্যেই খুনোখুনি, সংঘাত-সংঘর্ষ চলেছে ফ্রি-স্টাইলে, একটির পর একটি নির্বাচনে ভরাডুবি ঘটছে। দেশের ভেতরের বাইরের বৈরী শক্তি নানা নাশকতায় লিপ্ত- এ অবস্থায় সরকার ও সরকারি দল কি চায়?
মনে হয় তাদের কথা একটাই-‘যা কিছু হারায় কেষ্টা বেটাই চোর!’ আর কাজও তো সেই একটাই- সকল প্রকারের বৈরিতাকে শাণিয়ে তোলা। রাজনীতির নামে সংঘাত আর গণতন্ত্রের নামে অসহিষ্ণুতাকে চাঙ্গা করে রাখা। কিন্তু ‘নগর পুড়িলে কি দেবালয় এড়ায়?’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন