শনিবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০১২

প্রবল পরম পরুষ

বইয়ের মতো বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠাগুলিও কম আকর্ষণীয় নয়। এই পৃষ্ঠাগুলোতে থাকে প্রকাশনা সম্পর্কিত তথ্য (প্রকাশক, মুদ্রাকর ও প্রচ্ছদশিল্পীর নাম, সংস্করণ সংখ্যা, মূল্য), ভূমিকা (নানা শিরোনামে), সূচিপত্র, লেখকের (প্রকাশকেরও) অন্যান্য বইয়ের নাম এবং উৎসর্গ। এগুলোর মধ্যে ‘উৎসর্গ’ নিঃসন্দেহে কৌতূহলী করে বেশির ভাগ পাঠককে। ‘কাকে বা কাদের’ প্রতি বইটি উৎসর্গীকৃত তা নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা ও গবেষণাও হয় লেখকের নানা সম্পর্কের হদিশ নিতে। এ ধরনের কৌতূহল রবীন্দ্রনাথের ‘হ -’ থেকে শামসুর রাহমানের ‘মু. মা.’ পর্যন- অটুট আছে এখনও। অনেক ‘উৎসর্গ’ চমকও সৃষ্টি করে। সনে-াষ কুমার ঘোষ তাঁর একটি বই উৎসর্গ করেছেন “অনেক ভেবেচিনে- শেষে নিজেকেই”। একজন লেখক কাকে বা কাদের কোন বিবেচনায় বই উৎসর্গ করেন তা অস্পষ্ট থাকে না প্রায় ক্ষেত্রেই। তবে লেখক যদি ব্যাপারটা উদ্দিষ্ট ব্যক্তি ও তাঁর মধ্যে রাখতে চান তাহলে পাঠকের জল্পনাই হতে পারে সার। আমি বই উৎসর্গ করেছি কৃতজ্ঞতা জানাতে, স্মরণ করতে। বেশি বই বেরোবে না ভেবে বেশির ভাগ বই-ই উৎসর্গ করেছি একাধিক জনকে। ষাটের দশকে আমার তিন প্রিয় কবি - হাসান হাফিজুর রহমান, শহীদ কাদরী ও রফিক আজাদকে উৎসর্গ করেছি আমার প্রথম কবিতার বই ‘যথেচ্ছ ধ্রুপদ’ (১৯৭০)। দ্বিতীয় কবিতার বই ‘রৌদ্রে প্রতিধ্বনি’ (১৯৭৬) উৎসর্গ করেছি বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে আমার ঘনিষ্ঠ দুই সহপাঠিনী নাজমা ইয়াসমিন ও শামীমা নারগিসকে - যাঁরা অপমৃত্যুর শিকার হয়েছেন অকালে। এভাবে আমার আর ন’টি বই উৎসর্গ করেছি পেইচিং-জীবনের তিন বান্ধবী মারি-আনা লিপোভিৎ, ইয়ানা স-ারকোভা ও ভিলমা সিবার্গ, প্রিয় সহপাঠিনী নিলুফার চৌধুরী, আমার চিকিৎসক ডা. শহীদুল আলম, আদর্শ ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, বাল্যবন্ধু কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম, ‘সংবাদ’-সম্পাদক বজলুর রহমানকে। একটি বই ‘আমার প্রিয়’ কোন ভুলে উৎসর্গ করা হয় নি কাউকে। অন্যান্য বই উৎসর্গ করেছি আমার শিক্ষক শহিদ মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা ও আনিসুজ্জামান, স্কুল-জীবনের সহপাঠী বন্ধু অকালমৃত শিশুসাহিত্যিক মলয় কুমার ভৌমিক, বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে আমার প্রথম দুই বন্ধু কবি হুমায়ুন কবির ও আবুল হাসান, বন্ধু শাহাদত চৌধুরী, প্রকৃতই আমার আপা কথাশিল্পী রাবেয়া খাতুন, প্রিয় কথাশিল্পী কাজী আনোয়ার হোসেন, প্রিয় মানুষ সাহিত্যিক-শিক্ষক জওশন খানকে। শিশুতোষ বইগুলো উৎসর্গ করেছি ভাইবোন, ভাইপো-ভাইঝি, ভাগ্নে-ভাগ্নিকে। এছাড়া আরও কিছু বই উৎসর্গ করেছি বিভিন্ন সময়ে আমার কাছে আসা কয়েকজন নরনারীকে। এই স্মরণীয় বরণীয়দের নিয়ে কিছু ভুলও হয়েছে আমার। একজনকেই দু’বার করেছি উৎসর্গ। তিন জন যোগাযোগ বন্ধ করেছেন, একজন তাঁকে উৎসর্গ করা বইটি পর্যন- নেন নি। এবার বলি আমাকে উৎসর্গ করার ব্যাপার। কথাশিল্পী রাবেয়া খাতুন থেকে কবি হাসান হাফিজ পর্যন- অনেকেই এককভাবে তাঁদের বই উৎসর্গ করে আমাকে বেঁধেছেন কৃতজ্ঞতার বাঁধনে। কোনও-কোনও বছর ১২, ১৩, ১৪টি বইও উৎসর্গ করেছেন স্বজন-সহজনেরা। কবি মুহাম্মদ সামাদ তাঁর দ্বিভাষিক কবিতা-সঙ্কলন ‘সিলেক্টেড পোয়েমস্‌’ আমাকে উৎসর্গ করেছেন ২০০৮ সালে। একই সঙ্গে আরও দু’জন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব উৎসর্গিত হয়েছেন - কবি-কথাশিল্পী সৈয়দ শামসুল হক ও কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত। তাঁদের সঙ্গে আমার নাম যুক্ত করে মুহাম্মদ সামাদ এক বিরল সম্মান জানিয়েছেন আমাকে। ভাবি, আমাদের সমাজে মহাপ্রাণ মানুষের অভাব ঘটে নি এখনও।
    ‘সিলেক্টেড পোয়েমস্‌’ (অনন্যা, ঢাকা) হাতে পাওয়ার পরই ভেবেছিলাম কিছু লিখবো মুহাম্মদ সামাদের কবিতা সম্পর্কে। আবার ভাবি উৎসর্গ করা বই সম্পর্কে ঠিক নিরপেক্ষভাবে লিখতে পারবো কিনা। তারপরও কয়েকবার লিখতে গিয়ে মাঝপথে থেমে যাই। একবার লিখে সম্পাদকের কাছে ই-মেল করতে গিয়ে থামি, মনে হয় কিচ্ছু হয় নি লেখাটি। আরেকবার ই-মেল করার ক’দিন পর সম্পাদককে অনুরোধ করি লেখাটি না ছাপতে। এর মধ্যে বারবার হানা দিয়েছে সেই ১৯৬৮ সাল থেকে শুরু হওয়া আমার এক ঘোরতর ব্যাধি রাইটার’স ব্লক - ‘লেখকের বন্ধ্যাত্ব’। জর্জ অরওয়েল-এর উপন্যাস “কিপ দ্য এসপিডিসট্রা ফ্লাইং” (১৯৩৬)-এর কবি গর্ডন কমস্টক-কে চেপে ধরা ব্লক-এর চেয়েও খারাপ ব্লক চেপে ধরে আমাকে।
    আগেই বলেছি ‘সিলেক্টেড পোয়েমস্‌’ দ্বিভাষিক কবিতার সঙ্কলন। মূল বাংলা কবিতার পাশেই রয়েছে ইংরেজি অনুবাদ। অনুবাদ করেছেন কবীর চৌধুরী, নাজিম মাহমুদ, জাকারিয়া শিরাজী, সিদ্দিক মাহমুদুর রহমান, কে. আশরাফ হোসেন, আবেদিন কাদের,  কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজী আলী রেজা, নিশাত জাহান, আনিসুর রহমান, নাহিদ কায়সার, দেবব্রত মল্লিক, জামিউল করিম। এই অনুবাদ সম্পাদনা করেছেন কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি একটি ভূমিকাও লিখেছেন। এতে তিনি উল্লেখ করেছেন  মুহাম্মদ সামাদের কবিত্ব কিভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর রাজনৈতিক সক্রিয়তা দ্বারা:
... Muhammad Samad ... has earned considerable fame here over time for both his poetry and and various sorts of activism. ... these two have their markedly seperate domains, but are generally found to originate from common source-points, of passions, and to proceed interactively. That means these tend to influence each other. As a result, there’s a risk of one’s perfomance in both or either of these areas suffering. ... now... his poetry rather emerged as a richer volume because of his activism. ...
ওই ‘অ্যাকটিভিজম’-এর কারণেই মুহাম্মদ সামাদ চরিত্রগতভাবে প্রবল প্রাণের অধিকারী। এ প্রবলতা তাঁর প্রকাশ পায় তাঁর জীবনে, কবিতায়, ভাষায়। তীব্র, বেগবান এক কবিভাষা তাঁর কবিতার বড় সম্পদ। রাজনীতি, সমাজ, জীবন, প্রেম - এই চারটি বিষয়কেই প্রধান করে তুলেছেন তিনি কবিতায়। তবে আবেগের তীব্রতার সঙ্গে গভীর মননশীলতা এক স্বতন্ত্র মাত্রা দিয়েছে তাঁর ভাব, ভাষা, নির্মাণকে। এর কারণ মুহাম্মদ সামাদ শিক্ষণ ও গবেষণা ক্ষেত্রে মেধান্বিত চর্চায় নিয়োজিত। তিনি ছিলেন কৃতী ছাত্র, এখন কৃতী শিক্ষক। গবেষণা করেছেন অনেক ব্যাপক পরিসরে, শ্রম দিয়েছেন গভীর নিষ্ঠায়। ভ্রাম্যমাণ অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে, গিয়েছেন চীন ও কোরিয়ায়। তাঁর আরও কৃতিত্ব আছে সংগঠক হিসেবে, সামাজিক ও মানবিক দায়িত্ব পালনে অগ্রণী ভূমিকা নেয়ার ক্ষেত্রে। এ সবই তাঁর কবিতাকে করেছে মেধান্বিত আবেগে দীপ্র। এছাড়া মুহাম্মদ সামাদের কবিতার গঠনে আছে ক্লাসিক বিনির্মাণ। মধুসূদন বাংলা কবিতাকে যে বীর্যবত্তা দিয়েছিলেন, পরবর্তী কালের ভাবাবেগের স্রোতে যা ভেসে যায়, সেই পরুষ উচ্চারণ দেখি তাঁর কবিতার।
    রাজনীতিক, সংগঠক হিসেবে বেশি চোখে পড়েন মুহাম্মদ সামাদ, কিন' অন-র্গত জীবনে তিনি এক কবি-প্রেমিক। রোমান্টিক তো বটেই। এ প্রেম ও রোমান্টিকতা ‘অরুণা’ সিরিজের কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে বেশি, তবে অন্যান্য কবিতাও বঞ্চিত হয় নি। “নীল প্রজাপতি ওড়ে” কবিতার প্রথম স-বক উদ্ধৃত করি এখানে -
    “তোমাকে ছোবল মেরে আমি মরে যাই নিজে
    তুমি নীল হয়ে এলায়ে পড়েছো বুকে - নীল সুখে
    আমি সারারাত কাঁপি  - খুলে রাখি বেদনার ঝাঁপি
    এমন মধুর বিষ  - এ আমার ভালবাসা  - এ আমার পাপ
    আমি প্রতিদিন প্রতিক্ষণ চাই এমন পাপের নিত্য অভিশাপ!...”
    কবিতার অনুবাদে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন সবাই। মুহাম্মদ সামাদের সতেজ সাবলীলতা ইংরেজিতেও চমৎকার প্রকাশ পেয়েছে দেখে অবশ্যই বিস্ময় মানি। নমুনা হিসেবে উপরের স-বকটির অনুবাদ (জাকারিয়া শিরাজী কৃত) উদ্ধৃত করি এখানে:
“After kissing you I myself fall dead
    Turning blue you have sunk into my chest in blue blissfulness;
    I shiver the whole night  keep uncovered the basket of pains.
    Such sweet venom   this is my love   my sin,
    Everyday every moment I want the constant curse of this sin!...”
‘সিলেক্টেড পোয়েমস্‌’-এর প্রায় সব কবিতাই মূলে ও অনুবাদে এমন সমান উপভোগ্য। এখানে কবিতা মনোনয়নে মেলে বিচক্ষণতার প্রমাণ। প্রকাশনাতেও রয়েছে যথেষ্ট যত্নের ছাপ। তবে ফারসি ‘জিন্দাবাদ’কে উরদু বলার মতো ভ্রম আরও আছে কি? সব মিলিয়ে ‘সিলেক্টেড পোয়েমস’ এই দশকের কবিতায় নিঃসন্দেহে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন