শনিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১২

দেশবাসীর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহ

শ্রীশচন্দ্র দাশের ‘সাহিত্য-সন্দর্শন’ নামে একটি বই আমাদের পাঠ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওই বই পড়ে সাহিত্যের নানা বিষয় ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে নানা ধারণা পেয়েছি আমরা। তবে সাহিত্য সংক্রান্ত সে সব বিচার জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজে লাগে নি তেমন। যেমন, সমালোচনা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, “সহৃদয়তা, রসবোধ ও উদারতা সমালোচকের প্রধান গুণ।” রাজনীতিতে এই তিন গুণের স্থান নিয়েছে বিরোধিতা, নিন্দাবাদ ও গালাগালি। আর সে গালাগলি হয় রীতিমতো বাপ-মা তুলে।
    কবিতা, সাহিত্য বা রাজনীতিতে অনেক ম্যাজিক থাকে, কিন্তু ‘সমালোচনা লজিক হতে বাধ্য’। তা হলেও ‘সমালোচনা কারও পছন্দ নয়, সত্য হলেও নয়।’ রবীন্দ্রনাথও সমালোচনা করেছেন সমালোচকদের, “মূলধন না থাকিলেও দালালির কাজে নামিতে কাহারও বাধে না, তেমনি সাহিত্য সমালোচনায় কোনও প্রকার পুঁজির জন্য কেহ সবুর করে না। কেননা, সমালোচকের পদটা সম্পূর্ণ নিরাপদ।” তবে আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে মূল্যায়ন-বিশ্লেষণের কথা বলা হলেও বাস্তবে প্রশংসা আর নিন্দা ছাড়া কিছুই হয় না শেষ পর্যন্ত। আমরা দেখে-দেখে শুনে-শুনে বাধ্য হয়েছি এ ভবিতব্যই মেনে নিতে। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, “বোধ হয় বড় হলেই লোকে নিন্দে করে।” রবীন্দ্রনাথ কিছুটা কৌতুক করেই বলেছেন, “নিন্দা না থাকিলে পৃথিবীতে জীবনের গৌরব কি থাকিত! একটা ভাল কাজে হাত দিলাম, তাহার নিন্দা কেহ করে না - সে ভাল কাজের দাম কি!” নিন্দাচর্চার একটি ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন:
    “ওকে তুমি বলো নিন্দুক, - তা সত্য।
    সত্যকে বাড়িয়ে তুলে বাঁকিয়ে দিয়ে ও নিন্দে বানায় -
    যার নিন্দে করে তার মন্দ হবে বলে নয়,
    যারা নিন্দে শোনে তাদের ভাল লাগবে বলে।...” (‘অপরাধী’, “পুনশ্চ”)
তবে যা-ই বলুন... তিনিও সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেন নি সমালোচনাকে। তাই নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর বোলপুরে আয়োজিত সংবর্ধনায় নিজের ক্ষোভ আর দমিয়ে রাখতে পারেন নি, সবই উগরে দিয়েছিলেন সমবেত সুধীজনের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনা সম্পর্কে কবি-সমালোচক মেহিতলাল মজুমদার বলেছেন, “... (রবিবাবু) আমাদের শুধু জুতো মরতে বাকি রেখেছে। বললে কিনা... ‘গ্রাম্য বালকেরা যেমন কুকুরের লেজে টিন বেঁধে হাততালি দিয়ে তাড়া করে বেড়ায়, আপনারা তাই করতে এসেছেন।’ সভা ভাঙার পর আমরা সবাই হেঁটে বোলপুর স্টেশনে ফিরছি, তখন রবিবাবু জগদীশ বোসকে নিয়ে আমাদের গায়ে ধুলো ছিটিয়ে টমটম হাঁকিয়ে চলে গেলেন।”
সমবেত সুধীজনের সংবর্ধনা গ্রহণ না করে রবীন্দ্রনাথ সেদিন বলেছিলেন, “আজ আমাকে সমস্ত দেশের নামে আপনারা যে সম্মান দিতে এখানে উপস্থিত হয়েছেন তা অসঙ্কোচে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করি এমন সাধ্য আমার নেই।... দেশের লোকের হাত থেকে যে অপযশ ও অপমান আমার ভাগ্যে পৌঁছেছে তার পরিমাণ নিতান্ত অল্প হয় নি, এবং এতকাল আমি তা নিঃশব্দে বহন করে এসেছি।... যে কারণেই হোক, আজ ইউরোপ আমাকে সম্মানের বরমাল্য দান করেছেন। তার যদি কোনও মূল্য থাকে তবে সে কেবল সেখানকার গুণীজনের রসবোধের মধ্যেই আছে, আমাদের দেশের সঙ্গে তার কোনও আন্তরিক সম্বন্ধ নেই।... অতএব আজ যখন সমস্ত দেশের জনসাধারণের প্রতিনিধিরূপে আপনারা আমাকে সম্মান উপহার দিতে প্রবৃত্ত হয়েছেন, তখন সে সম্মান কেমন করে নির্ল্লজ্জভাবে গ্রহণ করবো? আমার আজকের এই দিন তো চিরকাল থাকবে না। আবার ভাটার বেলা আসবে, তখন পঞ্চতলের সমস্ত দৈন্য আবার তো ধাপে ধাপে প্রকাশ হতে থাকবে।... তাই আমি আপনাদের কাছে করজোড়ে জানাচ্ছি - যা সত্য তা কঠিন হলেও আমি মাথায় পেতে নেবো, কিন্তু সাময়িক উত্তেজনার মায়া যা, তা স্বীকার করে নিতে আমি অক্ষম। কোনও কোনও দেশে বন্ধু ও অতিথিদের সুরা দিয়ে অভ্যর্থনা করা হয়। আজ আপনারা আদর করে সম্মানের যে সুরাপাত্র আমার সম্মুখে ধরেছেন, তা আমি ওষ্ঠের কাছে পর্যন্ত ঠেকাবো, কিন্তু এ মদিরা আমি অন্তরে গ্রহণ করতে পারবো না। এর মত্ততা থেকে আমি চিত্তকে দূরে রাখতে চাই।...”
কিন্তু নিন্দা-সমালোচনা শুধু সাহিত্যের চাপান-উতোর নয়... জীবনের সত্য, রাজনীতির বাস্তবতা। সমালোচনা এড়িয়ে চলতে চাইলে কিছু করা যাবে না, বলা যাবে না, কিছু হওয়াও যাবে না। তা তো সম্ভব নয়। সমালোচনা থাকবে, কাজও থেমে থাকবে না। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চারচিল (১৮৭৪-১৯৬৫) বলেছেন, Criticism may not be agreeable, but it is necessary. It fulfils the same function as pain in the human body. It calls attention to an unhealthy state of things.  মারকিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট (১৮৫৮-১৯১৯) সমালোচনার প্রতি আরও জোর দিয়ে বলেছেন, To announce that there must be no criticism of the president... is morally treasonable to the American public.
এরপর মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন মনে করি।


sazzadqadir@rediffmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন