বৃহস্পতিবার, ৪ অক্টোবর, ২০১২

নীরব থাকে যারা

অন্যের বাড়িতে যখন আগুন ধরে তখন অনেকে শীতের রাতে তাপ পোহাবার আরাম পায়, অনেকে সুযোগ খোঁজে মূল্যবান জিনিসপত্র হাতাবার, অনেকে মতলব করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার, অনেকে সমালোচনার ছুরি শানায় প্রশাসনের বিরুদ্ধে, অনেকে চুপচাপ থাকে হাত-পা গুটিয়ে। সম্প্রতি পশ্চিম মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে  রাখাইন সম্প্রদায়ের হামলায় রোহিঙ্গ্যা মুসলমানরা হত্যা ধর্ষণ লুণ্ঠন অগ্নিসংযোগের শিকার হওয়ার পর এমন একটি অবস্থাই সৃষ্টি হয় এদেশে। প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গ্যাদের আশ্রয় দেয়া হবে কিনা তা নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন অনেকে। আশ্রয়প্রার্থীদের তাড়িয়ে দেয়া নিয়েও বিতর্ক চলে। একটি মহল রোহিঙ্গ্যাদের বিরুদ্ধে হয়ে ওঠে অভিযোগমুখর। বিতর্কের নামে শুরু হয় ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানো। ফেনিয়ে ওঠে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পও। এর মধ্যে প্রাণ হারায় ৬৫০ জন রোহিঙ্গ্যা, গুম হয় ১২০০ জন, ভিটেছাড়া হয় ৮০ হাজার। আমাদের এখানে বিতর্কে মগ্ন থাকে কয়েকটি মহল, আর কয়েকটি মহল থাকে নীরব। এর পর-পরই উত্তর-পূর্ব ভারতের বোড়োল্যান্ড  টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল-এর কোকরাঝার জেলায় শুরু হয় জাতিগত সহিংসতা। অসমিয়া মুসলমানরা এবার হত্যা ধর্ষণ লুণ্ঠন অগ্নিসংযোগের শিকার। হামলাকারীরা বোড়ো সম্প্রদায়ের। সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে কোকরাঝার ছাড়িয়ে ধুবড়ি, চিরাং ও বড়পেটা জেলাতেও। আমাদের এখানে অবস্থা সেই আগের মতোই। কয়েকটি মহল সরব এবং বিতর্কে লিপ্ত। ঘৃণা, বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা ঘুলিয়ে ওঠে তাদের মগজে। এবারও নীরব একটি মহল। তারপর এখন আমাদের ওপর এসে পড়েছে বর্বরতা। রামু, পটিয়া ও অন্যান্য স্থানে বৌদ্ধ বসতিতে হয়েছে লুট, অগ্নিসংযোগ। হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিদের সামনে। তিন দিন ধরে চলেছে এ ঘৃণ্য তৎপরতা। চলেছে প্রায় বিনা বাধায়। যে বাহিনী, প্রশাসন, সরকার বিরোধীদলকে সভা সমাবেশ মিছিল মানববন্ধন এমনকি রাস্তায় পর্যন্ত দাঁড়াতে দেয় না তারা এত নির্বিকার থাকলো কিভাবে সে প্রশ্ন এখন অনেকের। এ ব্যাপারে গোয়েন্দাদের বিশ্লেষণ - ‘বেসামরিক প্রশাসন সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে রামু’র সহিংসতা ঠেকানো যেতো। পুলিশ ও বেসামরিক প্রশাসন পর্যাপ্ত সময় পেলেও সময়মতো যথাযথ উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে।... শনিবার রাতে রামু সদরে বিক্ষুব্ধ মানুষের সমাগম বাড়তে থাকলে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নেয় নি। এমনকি হামলা শুরুর দু’ ঘণ্টা আগে গোয়েন্দারা প্রশাসনকে সতর্ক করলেও তা আমলে নেয়া হয় নি। রাত সাড়ে ১১টায় গোয়েন্দা সূত্রের খবরে কঙবজার ও টেকনাফ বিজিবি এবং রামু ক্যাম্পের সেনা সদস্যরা সম্ভাব্য সহিংসতা ঠেকাতে প্রস্তুত হয়ে থাকলেও সিভিল প্রশাসন তাদের কোনও সাহায্য চায় নি।... স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন অভিযুক্ত যুবককে আটক করে ঘটনার শুরুতেই বিক্ষোভের প্রশমন ঘটাতে পারতো।... এছাড়া বিক্ষোভ শুরুর তিন ঘণ্টার মধ্যেও যখন প্রশমন করা যাচ্ছিল না, তখন প্রশাসনের উচিত ছিল ১৪৪ ধারা জারি করা; কিন্তু প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের দীর্ঘসূত্রতায় ঘটে যায় নারকীয় ঘটনা।...” (দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ঠা অকটোবর)
ওদিকে আমাদের জাতিগত বিভাজন তো এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। তাই অন্যের ঘরে আগুন লাগলে আমরা কি-কি করি তা তো আগেই বলেছি। মনে পড়ছে জারমান যাজক মারটিন নিয়েমোয়েলার (১৮৯২-১৯৮৪)-এর কথাগুলো:
    “প্রথমে ওরা এসেছিল কমিউনিস্টদের খতম করতে
    আমি উচ্চবাচ্য করি নি, কারণ আমি কমিউনিস্ট নই।
    এরপর ওরা আসে সোস্যালিস্টদের খতম করতে
    আমি প্রতিবাদ করি নি, কারণ আমি সোস্যালিস্ট নই।
    এরপর ওরা আসে ট্রেড ইউনিয়নিস্টদের খতম করতে
    আমি দাঁতে কুটোটিও কাটি নি, কারণ আমি ট্রেড ইউনিয়নিস্ট নই।
    এবার এসেছে ওরা আমাকে খতম করতে
    এখন আমার চারপাশে কেউ নেই টুঁ শব্দটি করার।”
    মারকিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রচারিত এ রচনায় ‘কমিউনিস্টদের’ বদলে রয়েছে ‘ইহুদিদের’ কথাটি। এখানেও দেখতে পাই সেই বিভাজন। এমন বিভাজন আজ দেশে-দেশে। আমাদের বিভাজন তো মনে হয় সব দেশকে ছাড়িয়ে। তাই পদে-পদে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভেদচিন্তা আর বিভেদ-বিভাজন। অথচ সবাই জানি, একটি বিভাজিত জাতির উন্নতির আশা প্রায় দুরাশারই শামিল। জানি না এ বিভাজন থেকে কবে মুক্তি পাবো আমরা। কবে আমরা কেবল বাঙালি অসমিয়া মিয়ানমারিজ  রাখাইন রোহিঙ্গ্যা হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান চাকমা বোড়ো প্রভৃতি না হয়ে মানুষও হবো। এক হবো।

sazzadqadir@rediffmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন