শনিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১২

উৎসবের উৎসর্গে

জীবনে সংযম, সমাজে কৃচ্ছ্র - কিছুই চোখে পড়ে না তেমন, তারপরও সংযম-অবসানের উৎসব ঈদ উল-ফিতর পালন করেছি আমরা। এবার উৎসর্গের উৎসব ঈদ আল-আজহা। ঈদ-উজ-জুহা। এ উৎসবে কি দেবো উৎসর্গ? প্রায় সব উৎসবই তো উৎসর্গ করে ফেলেছি আমরা, আর কি আছে উৎসর্গের?
    প্রকৃতির বুকে যে শোভা ও সম্পদ ছিল তা আজ কোথায়? বনাঞ্চল উজাড়। পাহাড় কেটে সাফ। নদী নালা খাল বিল হাওর ক্রমশ শুকনো ডাঙ্গা। পশু পাখি মাছ ফল ফুল উধাও। শ্যামলী নিসর্গের বুকে মরুবিস্তারই এখন শুধু এক অব্যাহত বাস্তবতা।
    সামনে ডিসেম্বর।  বিজয়ের মাস। বিজয়ের উৎসব করেছি আমরা। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিজয়। সে সব বিজয়ও তো উৎসর্গ হয়ে গেছে। বিশ্বায়নের বুকে জাতীয়তাবোধ আজ বিলীয়মান। লুটেরা ধনিক শ্রেণীর ক্রমোত্থানে সমাজতন্ত্র নিষিদ্ধ। সামপ্রদায়িকতা-মৌলবাদের গ্রাসে পড়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা। গণতন্ত্র শিকার হয়েছে কলহপরায়ণ রাজনীতির। বিশ্বমোড়লেরা খামচে ধরেছে স্বাধীনতাকে। থাবা এসে পড়েছে সাগরগর্ভের - ভূগর্ভের সম্পদে।
    ওদিকে শিল্পাঞ্চলে বিকাশ ঘটেছে কারখানা ভাঙচুর শিল্পের। শিক্ষাঙ্গন হয়েছে রণাঙ্গন। প্রশাসনে চলে নির্লজ্জ দলীয়করণ। আইন-শৃঙ্খলাকে চ্যালেঞ্জ করে চলে সন্ত্রাস। চলে চাঁদাবাজ-টেন্ডারবাজ - সব রকম বাজের দাপট। নারীর ক্ষমতায়ন পরিণত হয়েছে উত্ত্যক্তিতে। আর উত্ত্যক্তকারীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গেলে আসে নিন্দামন্দ, হুমকি, আরও বিপদ। আমি নিজে পর্যন্ত এর শিকার। পাশাপাশি শতক-প্রাচীন পরদা-অবরোধ প্রথাবিরোধী আন্দোলনের পর এসেছে বোরকা-প্রথার হুমকি। ওদিকে কালো টাকা, খেলাপি সংস্কৃতি, দুর্নীতি বসেছে জাঁকিয়ে। বেপরোয়া হয়ে উঠেছে লুট, জালিয়াতি, সন্ত্রাস।
    তাহলে আজ কি উৎসর্গ আমাদের?
    আগে বলতাম পশুহত্যার কথা। বলতাম এ হত্যা প্রতীকী। আমাদের ভেতর আছে পশুপ্রবৃত্তি। কখনও সে প্রবৃত্তিতাড়িত হই আমরা। সে তাড়নার ধ্বংস এবং এমন আরও যা কিছু আছে অশুভ  সে সবের বিনাশ ঘটাতে সঙ্কল্প করি আমরা এই উৎসর্গের উৎসবে। কিন্তু এখন কি আর এ সব বলে কেউ নিজেদের পরিচয় দেবেন পশুবিদ্বেষী বলে? পাশব, পাশবিক, পাশবিকতা, নরপশু, পশুসুলভ, পশুপ্রবৃত্তি - এ সব শব্দ এখন লিখেন বা বলেন - এমন লোকের সংখ্যা এখন খুবই কম। কারণ পশু সবসময় প্রাকৃতিক আচরণ করে, হত্যা ধর্ষণ ইত্যাদি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে না। মানুষই বরং করে অপ্রাকৃতিক আচরণ। যাবতীয় কুকর্ম, দুষ্কর্ম। পশু নয় মানুষই দুরাচারী। কাজেই পশুহত্যার পুরনো ব্যাখ্যা দেয়া বৃথা। দেশে অপ্রতুল পশুসম্পদ। সে দিক থেকেও তেমন যুক্তি দেয়া যাবে না হত্যার পক্ষে। অমুসলিম দেশে কোরবানির জন্য পশুহত্যার অনুমোদন মেলে না সহজে। কোনও-কোনও দেশে তা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত। ইদানীং মুসলিম-প্রধান দেশেও সক্রিয় হয়ে উঠেছে পশুরক্ষা সমিতি, পশুক্লেশ নিবারণী সংস্থাগুলো।  ফরাসি দেশের সাবেক যৌন তারকা ব্রিজিত বারদো তো কয়েক দশক ধরে রীতিমতো যুদ্ধ করে চলেছেন কোরবানি প্রথার বিরুদ্ধে। এখন তাঁর সে যুদ্ধ দাঁড়িয়েছে সরাসরি ইসলামের বিরুদ্ধে।
    প্রখ্যাত কথাশিল্পী মাহবুব-উল-আলম (১৮৯৮-১৯৮১) তাঁর “তাজিয়া” (১৯৪৬) গল্পগ্রন্থের “কোরবাণী” গল্পে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক দৃশ্যগুলোর একটি সৃষ্টি করেছেন - রমিজ-পরিবারের পোষা গরু ‘মুন্না’কে উৎসর্গ করার বর্ণনায় - “... রমিজ যখন বাড়ীর দরজায় আসিয়া পৌঁছিল, হাফিজ ও আর দুই-তিনটি জোয়ান মুন্নাকে তখন মাটিতে কাৎ করিয়া ফেলিয়াছে। হাফিজ তখন ঘাড়টা বাঁকাইয়া মুখটা এ-ভাবে মাটিতে চাপিয়া ধরিয়াছে যে, তাহার গলাটা উপরে উঠিয়াছে, আর ঠিক ইহারই ঊর্ধ্বে কৃপাণ উদ্যত করিয়া ইমাম বিড় বিড় মন্ত্র পড়িতেছেন।... মুন্না এতগুলি জোয়ানের চাপে ঠির ঠির করিয়া কাঁপিতেছিল। ভয়ে তাহার গলা শুকাইয়া কাঠ হইয়া গিয়াছিল। চোখে সে কিছুই দেখিতে পাইতেছিল না;... প্রাণপণে একবার পা ছুড়িতে চেষ্টা করিল; মুখের অব্যক্ত আওয়াজ সম্মুখে পথ না পাইয়া পেটের ভিতর বাজিয়া উঠিল ‘অঁ -’। আর এমনি সময় ইমাম সাহেব... উহার গলায় কৃপাণ চালাইয়া দিলেন। রমিজ ও বৌয়ের নাম শোনা গেল; আর নামগুলি ফিন্‌কি দিয়া ঘড় ঘড় শব্দে যে রক্ত ছুটিল উহাতে তলাইয়া গেল।... মুন্নার চোখ দু’টি প্রাণহীন মুক্তার ন্যায় অপলকে চাহিয়া আছে, ছিন্ন কণ্ঠনালী ও উহার দু’পাশের মাটিতে রক্ত জমাট বাঁধিয়া সবুজের বুকে যেন মরিচা ধরাইয়া দিয়াছে।... যে রক্তপাত হইয়া গেল উহা যেন মুন্নার নহে, কোথা দিয়া কি করিয়া যেন বাড়িরই হৃৎপিণ্ড হইতে অজস্র রক্ত বাহির হইয়া গিয়াছে।...”
    কিন্তু যতই হৃদয়বিদারক হোক পশুহত্যায় ঘাটতি নেই কোথাও। প্রতি বছর এর জোশ বাড়ছে। ব্যয় বাড়ছে, শান বাড়ছে। কারণ এর সঙ্গে অনেক স্বার্থ এবং বিপুল অর্থ জড়িত। সে স্বার্থ অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক, ধান্দাগত। উট-দুমবা-গরু আমদানি ও চোরাচালান জড়িত এ ব্যবসায়ে। হাট ইজারা, পরিবহন ব্যবসা, পোশাকিদের চাঁদাবাজি, দলীয়দের তোলা আদায়, বাঁশ ফেলে টোল, গাড়ি বা ফেরি আটকে সেলামি, মাইকিং করে ভিক্ষা - এ রকম বহু কিছু জড়িত। মসজিদ-মাদরাসা থেকে চামড়া ও হাড়গোড় শিল্প পর্যন্ত জড়িত। পাড়ার মাসতান, ক্লাব, কল্যাণ সমিতি থেকে মহান নেতানেত্রীদের নামধারী পরিষদ পর্যন্ত জড়িত। মন্ত্রী-এমপি জড়িত। নামীদামিদের সামাজিক মর্যাদা, প্রভাব-প্রতিপত্তি জড়িত। সামনের সকল ইলেকশন জড়িত। ওই সব ইলেকশনে যারা জড়িত তারাও জড়িত।
    তাহলে কবি নজরুল যে লিখেছিলেন “ওরে হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ - সত্যের উদ্বোধন” - সেই সত্য আজ কি? আজ আমাদের কি উৎসর্গ করতে হবে? কি উৎসর্গ করলে সার্থক হবে উৎসব?
    আমি তো মনে করি প্রথমে আমাদের উৎসর্গ করতে হবে যুগে-যুগে জমে ওঠা যাবতীয় জঞ্জাল। সহজ নয় কাজটি। ঘাড়ে চেপে বসে সে জঞ্জাল এখন বিষম ভার হয়ে উঠেছে দেশ জাতি জনগণের জন্য। তবুও যত কঠিনই হোক, ত্যাগ আমাদের করতেই হবে। ভূয়া নেতাদের ভোট দেয়ার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। তাদের সঙ্গে দহরম মহরম বন্ধুত্ব ত্যাগ করতে হবে। দুর্নীতিপরায়ণ আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধবের প্রতি মায়ামমতা ত্যাগ করতে হবে। কুসন্তানকে প্রশ্রয় দেয়া ত্যাগ করতে হবে। পরিবারের বা পাড়ার দুর্বৃত্তদের সহ্য করা ত্যাগ করতে হবে। চেনাজানা ভূয়া ও দুর্জনের মুখোশ উন্মোচনে চক্ষুলজ্জা ত্যাগ করতে হবে। কিছু অভ্যাস, কিছু সহিষ্ণুতা, কিছু ভুল সৌজন্য, মনের কিছু দুর্বলতা, নিজের কিছু প্রাপ্তির আশা - এই সবকে সামান্য ভেবে ত্যাগ করতে পারলে একদিন কিন্তু সত্যি-সত্যিই ঘটতে পারে সত্যের অসামান্য উদ্বোধন। খুব তাড়াতাড়ি কোনও কিছুই হবে না, কিন্তু ত্যাগের অভ্যাস গড়ে তুললে ... আচ্ছা, ভাবতে দোষ কি... একদিন হয়তো ঘুষ-চাঁদা দিতে হবে না, মাসতানের রক্তচক্ষু থাকবে না, নেতার সঙ্গে কর্মী থাকবে কিন্তু ক্যাডার থাকবে না, নকলবাজ ছাত্র ও নকল সরবরাহকারী শিক্ষক থাকবে না, তদবিরবাজ ও ধান্দাবাজ থাকবে না, দলবাজ কবি লেখক সাংবাদিক বিচারক থাকবে না, নারীগঞ্জক থাকবে না, অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা ও চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত মানুষ - ভিখিরি - ফুটপাতে অসহায় জীবন, ক্ষুধার্ত শিশুর কান্না থাকবে না।
    আজ ওই ত্যাগ ও উৎসর্গই বাকি আছে আমাদের উৎসবের জন্য। আসুন সবাই মিলিত হই এ উৎসবে। বলি “সকলের তরে মোরা সবাই, সুখ-দুখ সম-ভাগ ক’রে নেব সকলে ভাই...।”

sazzadqadir@rediffmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন