বৃহস্পতিবার, ১১ অক্টোবর, ২০১২

পাকা চোর অতিশয়

অনেক কিছু চুরি গেছে আমার। মূল্যবান বইপত্র, বহু কষ্টে সংগৃহীত সিডি-ডিভিডি, প্রিয় সেলফোন সেট, স্মৃতিবাহী আংটি-ঘড়ি, বিদেশ থেকে আনা শিল্প-কর্ম, তৈজসপত্র, সজ্জা ও শয্যা সামগ্রী, আমার অতি সাধের হারকিউলিস সাইকেল... আরও কত শখের ও স্মৃতির জিনিস। নগদ টাকা, স্থাবর সম্পত্তি। আর আমাদের টাঙ্গাইল শহরের আকুরটাকুর পাড়ার বাড়ি থেকে চুরি গেছে এবং এখনও যাচ্ছে কত কি। পুকুরের মাছ, গাছের ফল-ফুল, খোঁয়াড় থেকে হাঁস মোরগ মুরগি ডিম, গোয়াল থেকে ছাগল-খাশি গরু-ছাগল, বাগানের শাকসবজি, বাঁশ গাছ কলা গাছ লতি-লতা... আরও অনেক কিছু। এখন তো চুরি হয়ে গেছে বাড়িটারই অনেকখনি।
এই চোরদের সঙ্গে কখনও দেখা-সাক্ষাৎ হয় না আমার। যারা সিনাজুরি করে, নানা ফন্দি-ফিকির করে, হাতিয়ে নিয়েছে - তাদের নিয়ে কোনও সমস্যা নেই আমার। কারণ পারতপক্ষে আমার সামনেই আসে না তারা। আর যারা গোপনে হাতসাফাই করে সটকে পড়েছে তাদের তো চিনিই না আমি। দু’একজনকে হয়তো সন্দেহ করি, কিন্তু তাতে তো চোর ধরতে পারি না নিশ্চিত হয়ে। রবীন্দ্রনাথের বা অন্নদাশঙ্করের ‘গিন্নি’র মতো জোর দিয়ে কাউকে চোর বলায় বিপদও আছে। রবীন্দ্রনাথের ‘গিন্নি’র দু’চোখের বিষ ‘পুরাতন ভৃত্য’ কেষ্টা। তাই “যা কিছু হারায়, গিন্নি বলেন, কেষ্টা বেটাই চোর!” আর অন্নদাশঙ্করের ‘গিন্নি’র মতে সব নষ্টের গোড়া কম্যুনিস্ট পার্টির লোকজন। তাই যেখানে যা-ই ঘটুক তিনি দোষ দেন তাদের - “মুরশিদাবাদে হয় না বৃষ্টি? মূলে কেটা? গিন্নি বলেন, কম্যুনিস্টি!”
আমাদের এখানেও ‘গিন্নি’ আছেন অমন। ‘চোর’ বা ‘কম্যুনিস্টি’ খুঁজতে বেশি ভাবতে হয় না তাদের। আগে থেকেই সব জেনে বসে থাকেন বলে সঙ্গে-সঙ্গে বলে দেন ফস করে ‘মূলে কেটা’। রোহিঙ্গ্যা কেন এদেশে আসে, বোড়োল্যান্ডে কেন দাঙ্গা লাগে, বিশ্বব্যাংক কেন ঋণ নিয়ে ঘাপলা করে, সোনালী ব্যাংকে কেন ঋণ জালিয়াতি হয়, রামু-পটিয়ায় কেন হাঙ্গামা হয় - সব তাদের জানা। তাই চক্রান্তকারী দুর্বৃত্তদের নাম বলতে দেরি হয় না একটুও।
আমার সমস্যা চোর মহাচোর বিশ্বচোরদের নিয়ে। পত্রিকায় তাদের বৃত্তান্ত পড়ি, টেলিভিশনে কর্মকাণ্ড দেখি, লোকমুখে শুনি, জানি - তারপর এদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় এখানে সেখানে। তখন সালাম আদাব দিতে হয় তাদের, হাসিমুখে কথা কইতে হয়, আদর-আপ্যায়ন করতে হয়, সভা সমাবেশ সেমিনারে সৌজন্য দেখিয়ে নানরকম প্রশংসাও করতে হয়। জেনেশুনে কোনও চোরকে সম্মান-শ্রদ্ধা দেখানো আসলেই খুব কঠিন কাজ। কিন্তু না দেখিয়ে উপায়ই বা কি? সেকালের প্রখ্যাত সাহিত্যিক-সাংবাদিক যোগেন্দ্রচন্দ্র বসু (১৮৫৪-১৯০৫) তাঁর ‘কালাচাঁদ’ উপন্যাসে এক ‘ছোটলোক’ চোরের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন, “চুরি কে না করে? মিথ্যা কথা কে না কয়? বঞ্চনা কাহাতে নাই? তবে বড়লোক ধরা পড়ে না; আমার মতো ছোটলোকেই ধরা পড়ে। ছোটলোকে সিঁধ কাটিয়া চুরি করে, আর বড়লোক কথার কৌশলে, বুদ্ধির জোরে চুরি করে। আমরা অসভ্য চোর, তাহারা সভ্য চোর।”
এ উপন্যাস প্রকাশের পর কেটে গেছে ১০০ বছরের বেশি সময়, কিন্তু পরিবেশ-পরিস্থিতি কি বদলেছে কিছু? আমার মনে হয়, তা বদলেছে অনেকখানি। সেকালে অসভ্য চোর ছিল বেশি, তারপর এই এক শতকে সভ্যতার অগ্রগতি-বিকাশের সঙ্গে-সঙ্গে বেশি হয়েছে সভ্য চোরের সংখ্যা। আজ সব দিকেই দেখতে পাই সভ্য শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত চোর। এরা চুরি করছে পণ্যবাজার শেয়ারবাজার জায়গাজমি নদী খাল বিল ব্যাংক বিশ্ববিদ্যালয় টেন্ডার নিয়োগ ভর্তি পরীক্ষা ফল। তারপর শুনছি তাদের বড় গলা। একেই বলে চুরির চুরি সিনাজুরি। আগের কালো বিড়ালদের এক কান কাটলে তারা যেতো রাসতার পাশ দিয়ে মুখ লুকিয়ে, এখনকার দু’ কানকাটা কালো বিড়ালেরা চলছে রাসতার মাঝখান দিয়ে। তাদের উদ্দেশে বলতে ইচ্ছা হয় -
‘করিব না চুরি’ কভু বলিও না আর।
কেন করিবে না চুরি, ভাবো একবার।
    উন্নতি চাহে যারা
    আগে চুরি করে তারা
চুরি করে হতে হয় নেতা জনতার
একবার চুরি নহে করো শতবার। - ‘চুরি-মাহাত্ম্য’, অমিয়কুমার মুখোপাধ্যায়

sazzadqadir@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন