বৃহস্পতিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

সবই আছে, কিছুই নেই

চারপাশে চোখ মেলে তাকালে দেখি, সবই আছে আমাদের। কি নেই? একটু ভাবতে গিয়ে দেখি, কিছুই নেই। আর বেশি ভাবতে গেলে মনে হয় এই ‘নেই’টাই শুধু আছে আমাদের। যেন মুঠো আছে ভরা, কিন্তু খুলতেই নেই। এ এক ‘নেই আছে’র দেশ বুঝি! এখানেই কি থাকি আমরা?
আমাদের রাজনৈতিক দল আছে, জোট আছে, কিন্তু রাজনীতি নেই। আছে দলাদলি, কোন্দল, দখল, সংঘাত, সহিংসতা, খেয়োখেয়ি আর খুনোখুনি। দল আছে, শৃঙ্খলা নেই। নেতা-নেত্রী আছেন, নেতৃত্ব নেই। ভোগ আছে, ত্যাগ নেই। পরিকল্পনা আছে। আছে বলতে কল্পনাটুকু, পরি নেই। তা উড়ে বা উবে যায়।
আমাদের আছে সুরম্য সংসদ ভবন। লুই কান-এর বিশ্বখ্যাত এ স্থাপত্যকীর্তি ‘ইষ্টকে গীতিকাব্য’ নামে নন্দিত বন্দিত। কিন্তু এ সংসদ অচল। নির্বাচনে যারা পরাজিত হন তারা বর্জন করেন একে। অশ্রাব্য গালাগালি, ছোড়াছুড়ি, তেড়েমেরে ধাওয়া ইত্যাদিরও চর্চা হয় এখানে। আর নির্বাচন? তা নিয়ে অভিযোগ আছে, সমাধান নেই। তাই বলতে হয় ? কারচুপি আর চরদখল আছে, নির্বাচন নেই। নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতি আছে, ঘোষণা আছে, ইশতেহার আছে সকল দলের। নির্বাচনের পর? আর কোনও কথা নেই। সব বেমালুম ভুলে গিয়ে সবাই একেবারে ভুলো!
আমাদের শিক্ষাঙ্গন আছে, শিক্ষা নেই। প্রায়ই রণাঙ্গন হয়ে ওঠে তা। দলাদলি, দখল, মারপিট, খুন, শ্লীলতাহানির ঘটনা নিয়মিত খবর হয়ে আসে সংবাদপত্রে। সেখানে আরও আছে ভুয়া জাল জালিয়াতির কারবার। ভুয়া সারটিফিকেট, ডিগ্রি, ভর্তি ছাড়াও আছে ডোনেশন দুর্নীতি। আমাদের সরকারি হাসপাতাল আছে, দরকারি চিকিৎসা নেই। সেখানে ডাক্তার-নার্স মেলে না সময়মতো। তবে দলাদলি আছে, তা কখনও খুনোখুনি পর্যন্ত গড়ায়। আমাদের সড়ক আছে, সংস্কার নেই। দুর্ঘটনা আছে, প্রতিকার নেই। আমাদের ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, অপহরণ, গুমখুন আছে। বিচার নেই। আমাদের ভক্ষক আছে, রক্ষক নেই। আমাদের বেড়া খায় আমাদের বাগান। বন-মালী হয় বন-খেকো।
খুব জানতে ইচ্ছা করে কেন সব থাকতে কিছু নেই আমার। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - “... বঙ্গদেশ গোঁফে-তেল গাছে-কাঁঠালের দেশ। যত বড় না মুখ তত বড় কথার দেশ। পেটে পিলে কানে কলম ও মাথায় শামলার দেশ।... এখানে বিচিগুলাই তেরো হাত হইয়া কাঁকুড়কে অতিক্রম করিয়া ওঠে।... বাঙালি জাতির... সাহস হয় না, আশা হয় না, উদ্যম হয় না।... আমাদের শরীর অপটু, বুদ্ধি অপরিপক্ব, উদরান্ন ততোধিক।... কেবল দলাদলি, কেবল ‘আমি আমি আমি’ এবং ‘অমুক অমুক অমুক’ করিয়াই মরিতেছি। আমাকে এবং অমুককে অতিক্রম করিয়াও যে দেশের কোনও কাজ, কোনও মহৎ অনুষ্ঠান বিরাজ করিতে পারে, ইহা আমরা মনে করিতে পারি না। এইজন্য আপন আপন অভিমান লইয়াই থাকি। আমাকে বড় চৌকি দেয় নাই, অতএব এ সভায় আমি থাকিব না - আমার পরামর্শ জিজ্ঞাসা করে নাই, কাজেই ও কাজে আমি হাত দিতে পারি না - সে সমাজের সেক্রেটারি অমুক, অতএব সে সমাজে আমার থাকা শোভা পায় না - আমরা কেবল এই ভাবিয়াই মরি। সুপারিশের খাতির এড়াইতে পারি না, চক্ষুলজ্জা অতিক্রম করিতে পারি না, আমার একটা কথা অগ্রাহ্য হইলে সে অপমান সহ্য করিতে পারি না।... আমরা কেবল ঘরে বসিয়া বড় কথা লইয়া হাসি-তামাশা করিতে পারি, বড় লোককে লইয়া বিদ্রূপ করিতে পারি... আমরা না পড়িয়া পণ্ডিত, আমরা না লড়িয়া বীর, আমরা ধাঁ করিয়া সভ্য, আমরা ফাঁকি দিয়া পেট্রিয়ট - আমাদের রসনার অদ্ভুত রাসায়নিক প্রভাবে জগতে যে তুমুল বিপ্ল্লব উপস্থিত হইবে আমরা তাহারই জন্য অপেক্ষা করিয়া আছি, সমস্ত জগৎও সেই দিকে সবিস্ময়ে নিরীক্ষণ করিয়া আছে।...”
সেই কবে, ১৮৮৭ সালে, লেখা এ সব কথা। উদ্ধার করতে গিয়ে কিছু যোগ-বিয়োগ করা গেল না এই ১২৫ বছর পরেও!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন