মঙ্গলবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

বাল্যপ্রেমে অভিসম্পাত থাকে

আমার প্রথম ও সকল প্রেম সম্পর্কে এ নিবন্ধে যা লিখতে চেয়েছি তা ১৪০ বছর আগে বঙ্কিমচন্দ্র লিখে গিয়েছেন - “বালকের ন্যায় কেহ ভালবাসিতে জানে না।... বাল্যকালের ভালবাসায় বুঝি কিছু অভিসম্পাত আছে। যাহাদের বাল্যকালে ভালবাসিয়াছ, তাহাদের কয় জনের সঙ্গে যৌবনে দেখা সাক্ষাৎ হয়? কয় জন বাঁচিয়া থাকে? কয় জন ভালবাসার যোগ্য থাকে? বার্দ্ধক্যে বাল্যপ্রণয়ের স্মৃতিমাত্র থাকে, আর সকল বিলুপ্ত হয়। কিন্তু সেই স্মৃতি কত মধুর!... বালকমাত্রেই কোন সময়ে না কোন সময়ে অনুভূত করিয়াছে যে, ঐ বালিকার মুখমণ্ডল অতি মধুর। উহার চক্ষে কোন বোধাতীত গুণ আছে। খেলা ছাড়িয়া কতবার তাহার মুখপানে চাহিয়া দেখিয়াছে - তাহার পথের ধারে, অন-রালে দাঁড়াইয়া কত বার তাহাকে দেখিয়াছে। কখন বুঝিতে পারে নাই, অথচ ভালবাসিয়াছে। তাহার পর সেই মধুর মুখ - সেই সরল কটাক্ষ - কোথায় কালপ্রভাবে ভাসিয়া গিয়াছে। তাহার জন্য পৃথিবী খুঁজিয়া দেখি - কেবল স্মৃতিমাত্র আছে। বাল্যপ্রণয়ে কোন অভিসম্পাত আছে।...”
    কিন্তু এ অভিসম্পাতের শিকার না হয়ে উপায় কি? যদি উদাসীন বা নিরুৎসুক প্রকৃতির হতাম তাহলে রক্ষা পেতাম হয়তো, কিন্তু জন্মই নিয়েছি যেন অদম্য কৌতূহল, সুতীব্র আগ্রহ ও আকর্ষণ নিয়ে। আশপাশের - চারপাশের জীবন ও জগৎ নিয়ে কত জিজ্ঞাসা আমার! পড়তে শেখার পর ডুবে যাই বইয়ের রাজ্যে। সকল অজানাকে জানতে ও বুঝতে বইকে করে নিই নিত্যসঙ্গী। আমার প্রথম প্রেম তাই সাদা কাগজের বুকে কালো অক্ষরের প্রতিমা। তারপর বয়স বেড়েছে, আর প্রেমও বেড়েছে। গান শোনা, ছবি দেখা - এ সবও নেশা হয়ে যায় ক্রমে-ক্রমে। সেই সঙ্গে জাগরণ ঘটে হৃদয়ের, উন্মুখ এক অনুভূতি ছড়িয়ে থাকে মনপ্রাণ জুড়ে। শুরু হয় মন দেয়া, কিন' নেয়া তো আর হয় না। মুখ ফুটে কখনও বলতে না পারার ভীরুতায় মরেছি হাজার মরণে। বাস-বের মানবীদের ধারেকাছে ঘেঁষতে না পেরে নিবিড় প্রেমে জড়িয়ে থাকি মনোলোকের নায়িকাদের সঙ্গে। তাই বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ (১৮৬৬) পড়ার পর কেমন ‘নবকুমার’ হয়ে যাই মনে-মনে। আবার ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় (১৯০৪-১৯৭৫)-এর ‘চিতা বহ্নিমান’ (১৯৪৫) পড়ে আপাতনির্বিকার প্রেমিক হওয়ার চেষ্টা, আর সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় (১৮৮৪-১৯৬৬)-এর ‘পিয়ারী’ পড়ে স্বর্ণহৃদয়া স্বৈরিণীর প্রতি সহানুভূতিতে আর্দ্র এক প্রেমানুভূতিতে অবগাহন - মনে আছে এখনও। গানের জগতেও ব্যতিক্রম ঘটে নি এর। রেকর্ডে ও রেডিওতে গান শুনতে-শুনতে রীতিমতো প্রেমে পড়েছি সেকালের জনপ্রিয় গায়িকা আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৩৪-২০০৯)-এর। আবার আমাদের টাঙ্গাইলের করোনেশন ড্রামাটিক ক্লাব রঙ্গমঞ্চে আয়োজিত সংগীতানুষ্ঠানে গাইতে আসা দুই কিশোরী বুলা গোস্বামী (পরে বুলা নাজির) ও নীনা (পরে নীনা হামিদ)-র জন্য কেমন করেছে মন। রুপালি পরদার সোনালি নায়িকাদের মধ্যে মুসাররাত নাজির, মালা সিনহা ও নীলো’র প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছি খুব। ‘শাবিস্তান’ (১৯৫১) ও ‘সিন্দাবাদ দ্য সেইলর’ (১৯৫২)-এর নাসিম বানু, ‘জাদু’ (১৯৫১) ও ‘জলপরী’ (১৯৫২)-র নলিনী জয়ন্ত, ‘আলিবাবা আউর ৪০ চোর’ (১৯৫৪)-এর শাকিলা ও ‘হুর-এ-আরব’ (১৯৫৫)-এর চিত্রাকে ভুলতে পারি নি এখনও।
    তবে এবার বলি অভিসম্পাতের কথা। এক বালক ও বালিকা এবং তাদের প্রণয়ের কাহিনী। সে বালক গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে গিয়েছিল গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সেখানে ওই বালিকা ছিল তার খেলার সাথি। বালক তার মন কেমন করা প্রকাশ করতে পারে নি স্বভাবগত সঙ্কোচে, তবে প্রথম দিককার জড়তা কাটানোর পর বালিকার চলন-বলনে মনের ভাব লুকানো ছিল না শেষ পর্যন্ত। একবার কথায়-কথায় কি এক জেদ করে সে বলেই ফেলে, বড় হয়ে বিয়ে করবে তারা।  এরপর বালিকার অভিভাবকরা বাধা হয়ে দাঁড়ায় দু’জনের মেলামেশায়। কারণ বালিকা ছিল গ্রামের এক তরুণের বাগ্‌দত্তা।
    গ্রীষ্মের ছুটি শেষে ওই গ্রাম ছেড়ে চলে আসে বালক। তারপর আর দেখা হয় নি দু’জনের। তবে মাঝেমধ্যে বালিকার আকুলতার খবর পেয়েছে বালক। এর ৩০ বছর পর, ১৯৯০ সালে, সেই বালিকাকে স্মরণ করে লেখা হয় ‘বিলকিস’ নামে একটি কবিতা:

    বয়স হয়েছে।
    চারপাশে ক্লান্তির ভিড়।
    দেহ, মন কিছুই এগোয় না কোনও দিকে।
    তবু স্মৃতি এসে হাত ধরে টানে,
    দাঁড় করিয়ে দেয় কৈশোরের পাশে -
    তোমার মুখোমুখি।

    দেখি, গ্রীষ্মের ছুটির রোদে
    ভরে গেছে সমস্ত ভুবন
    আর, হাঁফাতে-হাঁফাতে ছুটে এসে
    আমাকে দেখে তুমি থমকে দাঁড়ালে।

    আশ্চর্য!
    তোমার নাকের ডগায় ঘামের বিন্দুগুলো
    জ্বলজ্বল করছে এখনও।

    অবশেষে ৪০ বছর পর, ২০০০ সালে, সেই গ্রামে, দেখা হয় দু’জনের। প্রৌঢ় পুরুষ এক ক্ষীণাঙ্গী প্রৌঢ়াকে দেখে চিনতে পারে না সেই ঢলঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণ্যে উচ্ছল বালিকাকে, প্রৌঢ় নারীও জীবনযুদ্ধে বিপর্যস্ত এক পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিকে দেখে চিনতে পারে না সেই হাসিখুশি প্রাণচঞ্চল বালককে। তবে অভিসম্পাত গেল কই? এত বছর পরও অভিভাবকেরা সচেষ্ট হয়ে ওঠে দু’জনকে দূরে-দূরে সরিয়ে রাখার জন্য। ওর মধ্যেই প্রৌঢ়া এক ফাঁকে আসে প্রৌঢ়ের কাছে। নতস্বরে বলে, তোমাকে চিনতে পারি নি প্রথমে, কিছু মনে করো না।
    প্রৌঢ় দেখে, এক অসহায় বালিকার মুখ।
    প্রৌঢ়া শোনে, এক দুঃখী বালকের নীরব দীর্ঘশ্বাস।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন