রবিবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

বই বিষয়ক বিড়ম্বনা

অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র দ্বিতীয় সপ্তাহ চলছে বাংলা একাডেমী চত্বরে। গ্রন্থ বা মেলা যে রকমই হোক প্রচারনার অভাব নেই মিডিয়ায়। সে প্রচার অবশ্য বরাবর যা হয় তা-ই - তেলে জবজবে মাথায় আরও গ্যালন-গ্যালন তেল। সস্তা বাণিজ্যিক বইয়ের সরব রটনা, অথচ খবর নেই গুরুত্বপূর্ণ জরুরি বইপত্রের। আর খবর নেই প্রকাশনার ভেতরকার খবরের। বইয়ের এত দাম কেন, মুদ্রণ ও প্রকাশনা ব্যয় এত বেশি কেন - এ সব তলিয়ে দেখতে রাজি নন কেন। কালি, কাগজ, মুদ্রণ-সংশ্লিষ্ট সামগ্রী-সরঞ্জামের ওপর কি পরিমাণ কর ধার্য করেছে সরকার, তা অন্যান্য দেশের তুলনায় কত কম বা বেশি তার হিসাব খতিয়ে দেখা দরকার। প্রকাশনার ক্ষেত্রে আরও যে সমস্যা গুরুতর হয়ে উঠেছে তা নিয়ে লিখেছিলাম এই কলামে।  ‘মেলায় হেলা-ফেলার খেলা’ শিরোনামে দিন পনেরো আগে প্রকাশিত ওই লেখায় উল্লেখ করেছিলাম: “অনেক প্রকাশক নিজেদের বই ছাপেন কম, তাঁরা বেশির ভাগ বই ছাপেন লেখকদের অর্থে। সেখানে আবার নানা শর্ত। দরও নানা রকম। খোঁজ নিয়ে জেনেছি - ফরমা প্রতি চার হাজার থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন- নেয়া হয় লেখকদের কাছ থেকে। আরও নানা রকম দর থাকতে পারে, যা জানতে পারি নি। আবার হাজার দশেক টাকায় পাঁচ-ছয় ফরমার বই ছেপে দেন এমন প্রকাশকও আছেন। অনেকে আবার ১০০ বা ২০০ বই লেখক কিনে নেবেন এ শর্তেও বই ছাপেন। এ নিয়ে অভিযোগও আছে লেখকদের। তাঁরা বলেন, প্রকাশক ১২৫ বা ২২৫ কপির বেশি বই ছাপেন না। প্রচারনা, পরিবেশনা, বেচাবিক্রি করেন না ঠিকমতো। অভিযোগ আছে পাঠকদের দিক থেকেও। লেখকদের অর্থে ছাপানো বইগুলোর প্রকাশনা-মান সাধারণত উন্নত হয় না। বইগুলো সম্পাদিত দূরে থাক ঠিকমতো সংশোধিত (প্রুফ দেখার মাধ্যমে) পর্যন- হয় না। পাঠক-ক্রেতারা বলেন, মেলায় এ ধরনের বই-ই বেশি। ফলে প্রতি মেলায় গড়ে হাজার তিনেক নতুন বই এলেও সাহিত্যক্ষেত্রে তেমন প্রভাব পড়ে না, ‘উৎকর্ষ’ বা ‘অবদান’ ধরনের কোনও মূল্যায়নও হয় না।”
    বিষয়টি নিয়ে পীড়িত ও ভাবিত অনেকেই। ক’দিন আগে এ নিয়ে এক নোট দিয়েছেন কবি জুলফিকার শাহাদাত। ওই নোটে তিনি যা লিখেছেন তা মোটামুটি এ রকম:
    লিখে কিছু আয়-উপার্জন করেন এ দেশে এমন লেখক আছেন হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র। বেশির ভাগ লেখকই কিছু পান না তাঁর লেখার বিনিময়ে। তাঁদের শ্রম, মেধা থাকে উপেক্ষিত। প্রতি বছর বহু লেখক বিভিন্ন প্রকাশকের মাধ্যমে বই প্রকাশ করেন নানা শর্ত মেনে নিয়ে।  নগদ অর্থে বা নির্দিষ্ট সংখ্যক বই কেনার শর্তে রাজি হতে হয় তাঁদের। তারপর তাঁরাই আবার নিজেদের বইয়ের বিজ্ঞাপক, বিপণনকারী, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ বিক্রেতাও। বইয়ের বিক্রি বাড়াতে, বিজ্ঞাপিত করতে তাঁরা মেলায় যান গাঁটের টাকা খরচ করে, আর মেলা শেষে ফেরেন খালি হাতে। তারপরও আছে নানান ভোগানি-। সে সব ভোগানি-র মধ্যে আছে নির্দিষ্ট সময়ে বই না আসা, প্রতারণার শিকার হওয়া, বই না পাওয়া ইত্যাদি।
    জুলফিকার শাহাদাত যথেষ্ট ক্ষুব্ধ হয়েই লিখেছেন, “যে প্রকাশকের দু’ লাইন শুদ্ধ বাংলা লেখার ক্ষমতা নেই তাঁর কাছ থেকে শুনতে হয় নানা হিতোপদেশ। আর বইমেলা শুরু হলে তাঁর টিকিও আর খুঁজেও পান না লেখক। তখন প্রকাশকের সেলফোন বন্ধ থাকবে অথবা অজস্র মিথ্যা কথার খৈ ফোটাবেন তিনি। কারণ লেখকদের টাকায়, শ্রমে, ঘামে বই ছাপিয়ে তিনি তখন বিরাট প্রকাশক। মুনাফা ও মূলধন দু’টোই তাঁর হাতে। মিডিয়ায় তাঁর প্রকাশনার কত ফিরিসি-। নিজেও মিডিয়ার সামনে পিছনে মুখ দেখিয়ে বাহবা নেন কত। আর লেখকরাও চেপে যান টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করা বুকের কষ্টগুলো। নইলে যে তাঁর লেখককৃতির বেলুন ফুটো হয়ে যায় আবার। এই হলো পরিসি'তির নির্মমতা। অল্প ক’জন ব্যতিক্রমকে বাদ দিলে বেশির ভাগ প্রকাশকের ক্ষেত্রে একই রকম অভিযোগ ওঠে প্রায়ই।” তিনি মনে করেন, এ অবস'ার পরিবর্তনের জন্য লেখকদের সংগঠিত হওয়া প্রয়োজন। নিজেদের টাকা, শ্রম ও ঘাম দিয়ে, এত কষ্ট করে, অন্যকে দিয়ে বই প্রকাশের দরকার কি? নিজেদের বই নিজেরা প্রকাশ, নিজেরা প্রচার করলেই ভাল।
    জুলফিকার শাহাদাত উদ্যোগী মানুষ। তাই লেখকদের মালিকানায় সমবায় ভিত্তিক প্রকাশনা গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছেন এর মধ্যে। একটি চুক্তিপত্র সম্পাদনের মাধ্যমে এ প্রকাশনার শেয়ারহোল্ডার হওয়া যাবে।
    এ ধরনের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাতে হয়, সেই সঙ্গে ভাবতে হয় এর বাস-বায়ন ও সাফল্য সম্পর্কে। বই লেখা, ছাপা ও প্রচারের কাজ ভালই পারেন অনেক লেখক, কিন' সব লেখক কি পারেন? তারপর আছে প্রকাশিত বইয়ের বিক্রির জন্য শোরুম, সংরক্ষণের জন্য গুদাম, পরিবেশনা, ব্যবস'াপনা, হিসাবনিকাশ প্রভৃতি। এ সব কাজ সুষ্ঠু ভাবে করা পেশাদার ছাড়া সম্ভব নয়। আশা করি জুলফিকার শাহাদাত বিষয়টির সামগ্রিকতা বিবেচনায় নিয়েই উদ্যোগী হয়েছেন।
    প্রকাশনায় লেখকদের জড়ানো নতুন কোনও ঘটনা নয়। রবীন্দ্রনাথকে নিজের বই নিজেরই ছাপার ব্যবস'া করে নিতে হয়েছে। নজরুল-ও ছেপেছেন নিজের বই। কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে মঈনুদ্দীন (আলহামরা লাইব্রেরী), আহসান হাবীব (কথাবিতান), সিকান্‌দার আবু জাফর (সমকাল প্রকাশনী), আবু জাফর শামসুদ্দীন (কিতাবিস-ান), আকবর হোসেন, মোস-ফা কামাল (বুক সোসাইটি), গোলাম রহমান, কাজী আনোয়ার হোসেন (সেবা প্রকাশনী), মইনুল আহসান সাবের (দিব্য প্রকাশ) প্রমুখ কমবেশি সাফল্য অর্জন করেছেন প্রকাশক হিসেবে। পশ্চিমবঙ্গে ‘মায়াবী’ খ্যাত পাঁচকড়ি দে, ‘দস্যু মোহন’ খ্যাত শশধর দত্ত, মনোজ বসু (বেঙ্গল পাবলিশার্স), গজেন্দ্রকুমার মিত্র ও সুমথনাথ ঘোষ (মিত্র ও ঘোষ) প্রমুখের সাফল্য অজানা নয় কারও। তবে লেখক সমবায় সাফল্য পেয়েছে বলে শোনা যায় নি এখনও। আমি নিজে কয়েকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি, পশ্চিমবঙ্গেও এমন নজির আছে ব্যর্থতার। প্রকাশনা সংস'া ‘ভারবি’ প্রথমে কয়েকজন লেখকের সামবায়িক উদ্যোগেই গড়ে উঠেছিল। সে সমবায় টেকে নি বেশি দিন। এ অবস'ায় জুলফিকার শাহাদাতকে এগোতে হবে অনেক ভেবেচিনে-। আমার মতে, যদি প্রকাশক ও লেখকদের যৌথ সমবায় গড়ে তোলা যায় তবে সেটাই হতে পারে এক আদর্শ প্রকাশনা ও বিপণন উদ্যোগ। প্রকাশকদের চাই লেখক, লেখকদের চাই প্রকাশক। দু’জনের চাওয়া মিলিয়ে হতে পারে কোনও সফল প্রয়াস।
    দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে বলে যাঁরা ভেবেছিলেন বইয়ের পাঠকসংখ্যাও বাড়বে তাঁদের সে ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। অবসর বিনোদনের বিভিন্ন মাধ্যমের চমৎকারিত্ব যে শনৈঃ শনৈঃ গতিতে বেড়েছে, সে গতিতে বাড়ে নি বইয়ের প্রতি আকর্ষণ বা পাঠাভ্যাস। সংবাদপত্র, চলচ্চিত্র, টেলিভিশিন, কমপিউটার, ইনটারনেট, গেমস, ফেসবুক, সেলফোন - সবই গত ১০০ বছর ধরে দখল করে নিচ্ছে বই পড়ার সময়টুকু। নিত্য-নিত্য বাড়ছে এগুলোর নানারকম বৈচিত্র্য। বইয়ের মধ্যে কি ওই হারে বাড়ছে কোনও চমৎকারিত্ব? বরং বইয়ের নামে ‘অখাদ্য’ই বেশি ছাপা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায় পাঠক-পাঠিকাদের কাছ থেকে। এমন অভিযোগ সে কালেও ছিল। সেই কবে ইংরেজ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স (১৮১২-১৮৭০) লিখেছেন, “There are books of which the backs and covers are by far the best parts” (অনেক বই আছে সামনে-পিছনের মলাট / প্রচ্ছদ যেগুলোর সেরা অংশ)। তাঁর সমকালীন আমাদের মধুসূদন-ও আবর্জনা-সাহিত্যের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে পুস-ক পোড়াতে বলেছিলেন চণ্ডালের হাত দিয়ে, পুড়িয়ে ভাসিয়ে দিতে বলেছিলেন কীর্তিনাশার জলে। কাজেই আমাদের চাই ভাল বই। ১৯৯৬ সালে কলকাতার বইমেলার স্লোগান ছিল ‘আরও বই কেনো’। সে স্লোগান সম্পর্কে উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, “আরও বই কেনো - খুব ভাল কথা; কিন' ভাল বই কেনো - আরও ভাল কথা।... ভাল বই বলতে আমি বোঝাতে চাচ্ছি সৎ বই - অর্থাৎ সুলিখিত সাহিত্য-শিল্পসমৃদ্ধ বই, অসৎ বস'র মালিন্য থেকে যে বই মুক্ত। এবং অসৎ বস' অর্থে আমি বলতে যাচ্ছি সেই সমাজবিরোধী অশ্লীল কার্যকলাপের অপরিমিত বিলসন, যা পাঠকচিত্তকে খুশি যত না করুক, তাকে বহু গুণ করে উত্তেজিত।”
    ‘ভাল’ বইয়ের জন্য তাই ‘ভাল’ লেখক, প্রকৃত লেখক চাই। সাহিত্যশিল্পী চাই। লেখক সমবায়ে যদি আমলেখক  ঢুকে পড়ে তবে উদ্দেশ্য যত মহৎই হোক তা ব্যাহত হতে বাধ্য। লেখকদের সকলই লেখক নয়, আছে লেখক নামধারী অনেকে। শৌখিন, প্রচারপাগল, খ্যাতির কাঙাল, ধান্দাবাজ নানা রকম চরিত্র ভিড় করে আছে লেখক-অলেখকদের মাঝে। সেখান থেকে বেছে নিতে হবে খাঁটি শিল্পসাধককে।
    বই সম্পর্কে একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করবো এ আলোচনা। ২০০৩ সালে কলকাতা’র ‘বর্তমান’ পত্রিকায় প্রকাশিত শ্যামল চক্রবর্তী’র নিবন্ধ থেকে এ উদ্ধৃতি:
    “টিভি নয়, কমপিউটার নয়, শেষ ভরসা বলুন অথবা শেষ বন্ধু দি আলটিমেট ফ্রেন্ড, সেই বই-ই। পড়তেই হবে, কেননা বিকল্প নেই। নিজের মনের মধ্যে নিত্য নতুন ‘জ্ঞানচক্ষু’ ফোটাতে নিজের মধ্যে ‘একান- জগৎ’ তৈরি করে দিতে পারে না কমপিউটার, পারে শুধু বই। যত বাড়বে ‘জ্ঞানচক্ষু’, নতুন-নতুন জগৎ তৈরি হবে মনে বই পড়তে-পড়তে, তত কমবে হতাশা, উদ্বেগ। পার্থিব শোকতাপ, দুঃখযন্ত্রণা, না-পাওয়া, মান-অপমান ভুলে থাকা সহজ হবে ততই। সহজে গায়ে লাগবে না জীবনের হাজারটা আঘাত, ওঠানামা। বিশুদ্ধ আনন্দ পেতে, আনন্দ আর দুঃখকে একই রকম অবিচল থেকে মেনে নিতে শিখতে টিভির দিক থেকে ঘোরাতেই হবে মুখ বইয়ের দিকে।... দয়া করে কেনা বইগুলোকে ঘর সাজানোর সামগ্রীতে পরিণত করে ফেলবেন না। ‘স্ট্যাটাস’ বাড়ানো ছাড়াও বইয়ের কাজ অনেক। বই যে অমূল্য।... ওমর খৈয়ামের সেই কথাগুলো মাথায় রাখুন, ‘মদ রুটি ফুরিয়ে যাবে, ঘোলাটে হয়ে আসবে প্রিয়ার কালো চোখ, বই তবু চিরযৌবনা - যদি তেমন বই হয়।’...”

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন