বৃহস্পতিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

যাহা চাই তাহা...


বিদেশী প্রেমের কবিতা পড়েছিলাম কোথাও। কবির নাম মনে নেই। স্মৃতি থেকে লিখছি, কবিতাটি ছিল এ রকম: ‘বলেছিলে, বৃষ্টি ভালবাসো। কিন্তু বৃষ্টি নামতেই তুমি মেলে ধরলে ছাতা। বলেছিলে, রোদ ভালবাসো। কিন্তু রোদ ছড়িয়ে পড়তেই তুমি খুঁজে নিলে ছায়া। বলেছিলে, বাতাস ভালবাসো। কিন্তু বাতাস ঢেউ তুলতেই তুমি বন্ধ করলে জানালা। তাই ভাবছি, বলেছিলে ? আমাকে তুমি ভালবাসো...।’ ভাবি, এ পরিস্থিতি শুধু প্রেমের নয়। আমাদের জীবন, সমাজ, জাতি, দেশ-ও বারবার দুর্ভোগ-দুর্দশার শিকার হচ্ছে এমন চাওয়া-পাওয়ার বিচিত্র পরিস্থিতিতে, প্রার্থনা ও প্রাপ্তির দ্বন্দ্ব-বিরোধে। এই ‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না’র যে জ্বালা-যন্ত্রণা তার খেসারত আর কত দেবে দেশের মানুষ? সেই ষাটের দশকে একনায়কতন্ত্রের লড়েছি গণতন্ত্রের জন্য। সহজ ছিল না সে লড়াই। এ জন্য মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা আনতে হয়েছে। তারপর সেই সংসদীয় গণতন্ত্র বেশি দিন ভাল লাগে নি আমাদের। একদলীয় প্রেসিডেন্ট-শাসিত পদ্ধতি বহালের চেষ্টা করেছি। সেটা ভাল লাগে নি কাদের, ঘটেছে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। কিছু দিন অনিশ্চয়তার পর স্থিতাবস্থা এলে বলা হলো, এক দলীয় নয় ? আমরা চাই বহুদলীয় গণতন্ত্র। সেটা বহাল হতে না হতে এসে গেল একনায়কতন্ত্র। স্বৈরতন্ত্র। যাঁরা বহুদলীয় গণতন্ত্র চেয়েছিলেন তাঁরা অবশ্য খুব বেজার হলেন না এতে। কিছু দিন দহরম মহরমের পর দাবি উঠলো: স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক। চললো আবার গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম। জনতার বিজয় হলো, পতন ঘটলো স্বৈরাচারের। শুরু হলো গণতন্ত্রের অভিযাত্রা। কিন্তু এবার প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি চাই না, চাই সেই সংসদীয় পদ্ধতি। কিছু দিন পর আবার, উঁহু! চাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। হুড়হাঙ্গামা চললো আবার, তারপর এলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি। কিছু দিন পর এটাও ভাল লাগলো না আমাদের। কাজেই বাতিল। বিদায়। কিন্তু আবার দাবি উঠেছে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চাই। হুজ্জত-হ্যাঙ্গাম এই লাগলো বলে। তো কথা হচ্ছে, এ সব আর কত? এক সরকার পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, খেয়াল-খুশি, কামড়াকামড়ি তো কম হলো না চল্লিশ বছরে, কবে একটা স্থায়ী পদ্ধতি আমরা পাবো দুনিয়ার আর সকল সভ্য দেশের মতো? দেশ জাতি জনগণের তো আরও কাজ আছে, নাকি? তাদের কষ্ট ক্লেশ যন্ত্রণা বাড়িয়ে, তাদের রক্ত অশ্রু ঘাম মাড়িয়ে, আর কত বাজাতে হবে অপরাজনীতির জয়ডঙ্কা? অন্নকে আক্রা করে, বস্ত্রশিল্পে শোষণ চালিয়ে, বাসস্থানে ঘুঘু চড়িয়ে, শিক্ষাঙ্গনকে রণাঙ্গন করে, হাসপাতালকে পাতাল বানিয়ে অর্থ ও অস্ত্রের এই খেয়োখেয়ি কি চলতেই থাকবে? সবই চলে কিন্তু দেশ ও জাতির স্বার্থে, জনগণ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে! এখানেও শরণ করতে হয় রবীন্দ্রনাথকে। তিনি লিখেছেন, “রাষ্ট্রহিতৈষার চেষ্টাবেগ যতই বাড়িতে থাকে ততই সত্য-মিথ্যা ন্যায়-অন্যায়ের বুদ্ধি তিরোহিত হইতে থাকে। ইতিহাসকে অলীক করিয়া, প্রতিজ্ঞাকে লঙ্ঘন করিয়া, ভদ্রনীতিকে উপেক্ষা করিয়া, রাষ্ট্রমহিমাকে বড় করিবার চেষ্টা হয়; অন্ধ অহঙ্কারকে প্রতিদিন অভ্রভেদী করিয়া তোলাকেও শ্রেয় বলিয়া বোধ হইতে থাকে...।”
এরপর আর কোনও কথা থাকতে পারে না আমার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন