বুধবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

শেষ প্রচ্ছদ, ফ্ল্যাপ ও অন্যান্য

ছেলেবেলায় রঙ-রঙিন সব কিছুই ভাল লাগতো বেশি,  তারপরও রবীন্দ্রনাথের বই ভাল লাগতো সাদামাটা প্রচ্ছদেই। হলদেটে বা নীলচে মোটা কাগজে লাল বা খয়েরি রঙে বইয়ের নাম, একই রঙে রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরিত নাম, পেছনের প্রচ্ছদে ওই একই রঙে দেবনাগরী লিপিতে প্রকাশকের  নাম (‘বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ’) এবং মূল্য। শরৎচন্দ্রের বইয়ের প্রচ্ছদও ছিল ওই রকমই। বাড়তি ছিল তাঁর ছবি। সে ছবি প্রচ্ছদে থাকলে স্কেচ, ভেতরে থাকলে আলোকচিত্র। বিশেষ কারণ ছিল ওই ছবি সংযোজনের। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৮২-১৯৪৫) নামে আরেকজন লেখক যথেষ্ট পাঠকপ্রিয় ছিলেন একই সময়ে। মাসিক গল্পলহরী (১৯৩০-১৯৪১)-র সম্পাদক ছিলেন তিনি, উপন্যাস লিখেছেন কমপক্ষে ১১টি - শান্তিজল, জয়পতাকা, চাঁদমুখ, মুখরক্ষা (১৯২২), পথের সন্ধান (১৯২৫), শুভলগ্ন (১৯২৬), সুপ্রভাত (১৯২৭), বারুণী, যৌতুক, বৈরাগ্যের পথে, অভিমানিনী। এগুলোর মধ্যে ‘চাঁদমুখ’ ছিল সেরাকাটতি। সে কাটতি ছাড়িয়ে যায় ১৯১৭-১৯২০ সালে প্রকাশিত ‘দেবদাস’, ‘চরিত্রহীন’, ‘শ্রীকান্ত’, ‘দত্তা’, ‘গৃহদাহ’, ‘বামুনের মেয়ে’কেও। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন শরৎচন্দ্র ও তাঁর প্রকাশক। তাঁরা কথা বলেন সম্পাদক শরৎচন্দ্র ও তাঁর প্রকাশকের সঙ্গে। কিন্তু কেউই রাজি নন পিতৃদত্ত নাম পরিবর্তনে। না ‘চাঁদমুখ’ শরৎচন্দ্র, না ‘চরিত্রহীন’ শরৎচন্দ্র। অনেক শলাপরামর্শের পর বইয়ে ছবি সংযোজনের প্রস্তাব ওঠে শেষে। কিন্তু দু’জনেরই মুখে দাড়ি। ছবিতে কি আলাদা করে চেনা যাবে অত? শেষে বড় শখের ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ির মায়া ছাড়তে হয় শরৎচন্দ্রকে। সেই থেকে তাঁর ক্লিনশেভ মুখের ছবি শোভা পাচ্ছে প্রতিটি বইয়ে।
    প্রচ্ছদে রাবীন্দ্রিক-শরৎচন্দ্রীয় ধারা সীমিত পর্যায়েই আছে এখনও। মুদ্রণ ও বাঁধাই প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে-সঙ্গে প্রচ্ছদ হয়ে ওঠে বর্ণাঢ্য ও বোর্ড-মজবুত। মনে পড়ে দেব সাহিত্য কুটীরের বইগুলোর কথা। তাদের প্রতিটি বইয়ের প্রচ্ছদ ছিল, এখনও আছে, সিনেমার পোস্টারের মতো। এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে বই-প্রকাশনায়। এ প্রভাব অমন ব্যাপক হয়ে আছে এখনও। তবে তাদের মূর্ত রীতির প্রচ্ছদের পাশাপাশি ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে প্রচ্ছদ বিমূর্ত অঙ্কনের চমৎকারিত্ব। কলকাতায় সত্যজিৎ রায় ও পূর্ণেন্দু পত্রী, ঢাকায় কাইয়ুম চৌধুরী, কালাম মাহমুদ, আশীষ চৌধুরী খ্যাতি পান এ ধারার প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে। এঁরা পাঠকরুচির সঙ্গে-সঙ্গে পালটে দেন দর্শকরুচিকেও।
    প্রচ্ছদ নিয়ে শিল্পী, লেখক ও প্রকাশকদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিল বরাবরই। বই ও লেখক সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য তাঁরা নানাভাবে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন বইয়ের মলাটে। ষাট-সত্তর দশকে শেষ প্রচ্ছদে বেশ সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে পরিচয় উল্লেখের বিষয়টি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল খুব। ওই লেখাগুলো লেখকেরাই লিখে থাকেন সাধারণত। এর ব্যতিক্রমও আছে। প্রকাশকও নিজে অথবা কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নেন ওই পরিচিতি। যেমন, জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রনে'র ১৯৭৬ সালের সংস্করণের শেষ প্রচ্ছদের লেখা:
রবীন্দ্রোত্তর যুগের
অসামান্য কবি
জীবনানন্দ দাশ
যদি কোনও একটি মাত্র গ্রন্থে
তাঁর সার্থকতম পরিচয়
রেখে গিয়ে থাকেন
সে গ্রন্থ ‘বনলতা সেন’।
তাঁর কাব্যের প্রধান গুণ
রবীন্দ্রনাথের ভাষায়
‘চিত্ররূপময়’।
‘প্রসন্ন বেদনায় কোমল উজ্জ্বল
বড়ই নতুন এবং নিজস্ব
তাঁর লেখা: বাংলা কাব্যের
কোথাও তার তুলনা পাই না।’
এই বলে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন
অমিয় চক্রবর্তী।
একক ভাবে শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ
‘বনলতা সেন’-এর
এটি দ্বাদশ সংস্করণ।
    একটি ভুল আছে এই পরিচিতিতে। সংস্করণটি দ্বাদশ নয়, ত্রয়োদশ।
    একই ধারার পরিচিতির আরেকটি নমুনা দিচ্ছি এখানে। এটি ছিল কবি নরেশ গুহ-এর কাব্যগ্রন্থ ‘দুরন্ত দুপুর’-এর ১৯৬৯ সালে দ্বিতীয় মুদ্রণের শেষ প্রচ্ছদে:
তরুণতরদের মধ্যে
সবচেয়ে
সুরেলা কবি
নরেশ গুহ,
বলেছে কবিতা পত্রিকা।
ছন্দের
বিচিত্র ব্যবহারে,
সুরের
একান্ত নিজস্বতায়
তিনি বিশিষ্ট।
বাংলা কবিতার
সামপ্রতিক অবক্ষয়
যাঁদের
ক্রমশই হতাশ করছে,
এই সুকুমার
কবিস্বভাবের
পরিচয় পেয়ে
তাঁরা
আনন্দিত হবেন।
    এর পর, নব্বই দশক থেকে, বই ও লেখক পরিচিতির স্থান বদলে যায় প্রচ্ছদে। শেষ প্রচ্ছদ থেকে পরিচিতি দু’ ভাগ হয়ে যায় মলাটের দুই ভাঁজে। এর নাম হয়ে যায় ফ্ল্যাপ। প্রথম প্রচ্ছদের ভাঁজ বা ফ্ল্যাপে বই পরিচিতি, শেষ প্রচ্ছদের ভাঁজে লেখক পরিচিতি। দু’টি পরিচিতিই ছবি সহ।
    ওই ফ্ল্যাপ লেখার কাজ সাধারণত করে থাকেন লেখকেরাই। অনেক লেখক লিখিয়ে নেন অন্য লেখকদের দিয়ে। ওই লেখকদের কেউ-কেউ আবার রীতিমতো সমাদর পেয়ে থাকেন ফ্ল্যাপ রচনার কুশলতার জন্য। তেমন সমাদৃত ফ্ল্যাপ-লেখকদের একজন এই আমি স্বয়ং। বেশ অসঙ্কোচেই বলছি কথাটা। কারণ গত ৪০ বছরে ৪০০’র বেশি বইয়ের শেষ প্রচ্ছদের  পরিচিতি অথবা ফ্ল্যাপ লিখেছি। এখনও গড়ে সাত-আটটি বইয়ের ফ্ল্যাপ লিখে চলেছি প্রতি বছর। এ বছর আমার লেখা একটি ফ্ল্যাপ উদ্ধৃত করছি এখানে:
“প্রায়ই আমার দিনের শুরু হয় কঙ্কা জামিলের সঙ্গে। তাঁর কণ্ঠের সৌরভ ছড়িয়ে থাকে আমার গ্রিন রোডের এই ছোট্ট নীড়ের স্নিগ্ধ সকাল জুড়ে। তাঁর কথার লাবণ্য-দীপ্তি ক্রমে-ক্রমে  মিশে যায় আকাশভরা ভোরের স্ফুটনোন্মুখ আলোয়। আমি অবগাহন করি, মগ্ন নিমজ্জিত হই এক অনির্বচনীয় স্বতঃসুবাসিত সুরধারায়। এভাবে কঙ্কার গানে সাড়া পাই তাঁর প্রাণের, স্পর্শ পাই তাঁর আত্মার। তাঁর শিল্পীহৃদয়-সত্তা আমাকে, আমার মতো আরও অনেককে, প্রায়ই প্রাণিত করে নতুন-নতুন সৃষ্টিশীলতা উপহার দিয়ে। তিনি লেখেন, সেই লেখায় সুর দেন, তারপর গান করেন, উপহার দেন সকল সহজনকে। কঙ্কা কবি, সুরকার, শিল্পী এবং সমাজমর্মী। তাঁর উপস্থাপনা অনাড়ম্বর, কিন্তু প্রাণের ঐশ্বর্যে তাঁর গান রাজসিক মহিমায় সমৃদ্ধ। কবিতাতেও কঙ্কা সহজ করে সরল ভাষায় প্রকাশ করেন নিজেকে। তিনি লেখেন ব্যক্তির বিভ্রম ও সমাজের অসংগতির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। জীবনের যেখানে অন্ধকার সেখানে তিনি চান আলো জ্বালতে; দাঁড়াতে চান বিপন্ন, রোগাক্রান্ত, নির্যাতিত নর নারী শিশুর পাশে। তাঁর কবিতা হাত বাড়ায় বঞ্চিত লাঞ্ছিত নিষ্পিষ্ট মানবতার দিকে। তাদের দুঃখ-ব্যথা দূর করতে চায়, সুখী সমৃদ্ধ জীবনের স্বপ্ন দেখতে চায়। সমাজবিরোধী অশুভ অসুন্দরের স্বরূপ উদ্ঘাটন করেন কঙ্কা। তবে প্রতিবাদ করেন না দুর্বলের মতো। তিনি আঘাত করেন সরাসরি। কারণ তিনি সবল, শক্তিমত্তায় প্রবল। দৃঢ়। এভাবেই তাঁর সহজ ভাষার সরল কবিতা বিপুল মহিমায় হয়ে ওঠে সবেগে সমুদ্যত। গানে যেমন মরমী কঙ্কা, কবিতায়ও তেমন দরদি। মরমিয়া অনুভব তাঁকে মহিমা দিয়েছে, আর জনদরদ তাঁকে করেছে মহীয়ান। কঙ্কা কল্যাণী নারী, মরমী শিল্পী, দরদি কবি - তাঁকে অভিবাদন।”
এ লেখায় ফেসবুক-এর মাধ্যমে কঙ্কা জামিলের সঙ্গে আমার পরিচয় ও যোগাযোগ এবং ফেসবুক-ভিত্তিক তাঁর বিভিন্ন কর্মপ্রয়াস সূত্রে সৃষ্ট অনুভবের বিষয়টিই প্রাধান্য পেয়েছে, আসলে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে মাত্র দু’বার। তা-ও অল্প ক্ষণের জন্য। আমি চেয়েছিলাম তাঁকে নিয়ে একটি তথ্যপূর্ণ ফ্ল্যাপ লিখতে - যেমনটি লেখা হয় না সাধারণত। একটি বহুভাবনা-মণ্ডিত বইয়ের মূল বিষয়গুলো ১৫০-১৭৫ শব্দের ফ্ল্যাপে তুলে ধরা সহজ মনে হয় নি আমার কাছে। আমি তাই পারি নি মনোমতো ফ্ল্যাপ লিখতে, যদিও চেষ্টা করেছি মনেপ্রাণে।
জিজ্ঞেস করতে পারেন, আমার পছন্দের ফ্ল্যাপ হবে কেমন? ইংরেজি বই থেকে অনেক উদাহরণ দিতে পারবো, বাংলা বই থেকে খুব বেশি দিতে পারবো বলে মনে হয় না। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তো “কত বড় আমি - কহে নকল হীরাটি / তাই তো সন্দেহ করি, নহ তুমি খাঁটি।” তবে একটি আদর্শ ফ্ল্যাপের উদাহরণ দিতে পারি এখানে - মিনার মনসুরের “হাসান হাফিজুর রহমান: বিমুখ প্রান-রে অনির্বাণ বাতিঘর” (বাংলা একাডেমী, ১৯৯৯)-এর প্রথম প্রচ্ছদের ফ্ল্যাপ উদ্ধৃত করে:
“বাস-বিকই এক বিমুখ প্রান-রের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। প্রাবন্ধিক-গল্পকার-সম্পাদক-সংগঠক-অধ্যাপক-সাংবাদিক-কূটনীতিক ও কর্মমুখর জীবন ব্যয়িত হলেও, তিনি ছিলেন মূলত কবি। তাঁর ব্যক্তিত্বের সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশও ঘটেছে কবিতায়। কবিতাকে যে শেষ পর্যন- কবিতাই হয়ে উঠতে হবে - এ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সংশয় ছিল না তাঁর। কিন্তু তাঁর কাছে আর সবই ছিল তুচ্ছ, গৌণ; মুখ্য ছিল তাঁর দেশ। সে জন্য সমকালের অন্য কবিদের মতো স্বদেশের আনন্দ-বেদনায় সাড়া দেয়ার মধ্যেই সীমিত নয় তাঁর কবিতার ভূমিকা; তাঁর কবিতা তাঁর যাপিত কালের প্রতারক শূন্যতার বিপরীতে সমগ্র মানবজাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে ভবিষ্যতের দুর্লভ সেতুবন্ধন নির্মাণ করে; হতাশায় নিমজ্জিত মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে সংগ্রামে; অন্ধকারের সমুদ্রে দিগ্‌ভ্রান্ত মানুষকে দেয় আলোকিত ভবিষ্যতের পথ-নির্দেশনা। বিমুখ প্রান্তরে অনির্বাণ এক বাতিঘরের মতো আমৃত্যু তিনি পালন করে গেছেন কবি ও কর্মীর এই অনন্য ভূমিকা। কি কবিতায়, কি রাজনীতিতে - আমাদের সমাজে অত্যন্ত বিরল এই ভূমিকাটিরই উপর আলো ফেলা হয়েছে বর্তমান গ্রন্থে। পঞ্চাশের পরবর্তী দশকগুলিতে সমাজ পরিবর্তনের যে-বৈপ্লবিক দর্শন পৃথিবীকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল, তা বর্তমানে দৃশ্যপট থেকে অন্তর্হিত হলেও - সেই সময়, সেই সময়ের প্রকৃত প্রতিনিধিত্বকারী একজন বাঙালি কবির বিশেষ মনোভঙ্গির ব্যাপক ও বিশ্বস্ত ভাষ্য ‘হাসান হাফিজুর রহমান: বিমুখ প্রান্তরে অনির্বাণ বাতিঘর’।”
কবি হাসান হাফিজুর রহমান এবং তাঁর জীবন ও কর্ম ভিত্তিক একটি বই সম্পর্কে অল্প কথায় এই যে এত অধিক বলা, তা খুব সহজ কি?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন