বৃহস্পতিবার, ২৩ মে, ২০১৩

এক স্বৈরাচারের বিদায়

এই সেদিন, ১৭ই মে, মারা গেলেন হরহে রাফায়েল বিদেলা। ১৯৭৬-৮১ সালে ছিলেন আরহেনতিনা (আর্জেন্টিনা)-র সশস্ত্র বাহিনীর সিনিয়র কমান্ডার আর বিধিগত ভাবে না হলেও কার্যত দোর্দ- প্রতাপশালী প্রেসিডেন্ট। ক্ষমতায় এসেছিলেন কু দেতা’র মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ইসাবেল মারতিনেজ দে পেরন-কে উৎখাত করে। ১৯৮৩ সালে প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে ব্যাপক মনবাধিকার লঙ্ঘন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিচার শুরু হয় বিদেলা’র। তার পাঁচ বছরের শাসনকালে আরহেনতিনা পরিণত হয়েছিল এক দুঃস্বপ্নের দেশে। বিরোধী রাজনীতিক, আন্দোলন-কর্মীদের অপহরণ, জোর করে গুম, যথেচ্ছ নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যা তখন ছিল নিত্যঘটনা। বিদেলা’র রোষের শিকারদের অনেকে ছিলেন বিরোধী দলীয় রাজনীতিক ও প্রতিবাদী নর-নারী, তবে বেশির ভাগই ছিলেন সন্দেহভাজন ও অভিযুক্ত। কেবল ব্যক্তিরা নন তাদের গোটা পরিবারও হয়েছে একই রকম খুন ও নিপীড়নের লক্ষ্য। গোপন সব নির্যাতন শিবিরে প্রাণ গেছে বহু নর-নারীর। অবৈধ বন্দিশিবিরে আটক মায়েদের কাছ থেকে অসংখ্য শিশুকেও চুরি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তখন।
১৯৮৩ সাল থেকে ২০০৮ সালের ১০ই অকটোবর পর্যন্ত গৃহবন্দি ছিলেন বিদেলা, পরে তাকে পাঠানো হয় সামরিক কারাগারে। কু দেতা’র পর ৩১ জন বন্দিকে হত্যার দায়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয় ২০১০ সালের ২২শে ডিসেম্বর। এ দ- অবশ্য ভোগ করতে হয় বেসামরিক কারাগারে। এরপর ২০১২ সালের ৫ই জুলাই তাকে ৫০ বছরের কারাদ- দেয়া হয় নিয়মমাফিক শ’-শ’ শিশু অপহরণের দায়ে। রাজধানী বুয়েনস এয়ারেস থেকে ৪৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মারকোস পাজ বেসামরিক কারাগারে বিদেলা মারা গেলেন দু’ বছর দ- ভোগ করে। তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। মারকোস পাজ-এর খ্যাতিমান বাসিন্দাদের মধ্যে রয়েছেন ১৯৬৬-৭০ সালে ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট হুয়ান কারলোস ওঙ্গানিয়া কারবালো (১৯১৪-৯৫)।
প্রথমে জানা গিয়েছিল ঘুমের মধ্যে স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করেছেন বিদেলা। পরে জানা গেল দিন পাঁচেক আগে কারাগারে শাওয়ারে পিছলে পড়ে মারাত্মক আহত হয়েছিলেন তিনি। তখন হাড়গোড় ভেঙেছিল কয়েকটি, রক্তক্ষরণও হয়েছিল ভেতরে।
ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সম্পূর্ণ অনুতাপহীন ছিলেন বিদেলা। বিরোধী রাজনীতিক ও আন্দোলন-কর্মীদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘ওরা সন্ত্রাসী... নাশকতাবাদী।’ বিরোধীদের গুম ও শিশু অপহরণের কোনও দায়ও স্বীকার করেন নি তিনি। তার সঙ্গে অভিযুক্ত সেনা-কর্মকর্তারাও নিখোঁজদের ব্যাপারে মুখ খোলে নি আদালতে।
আরহেনতিনা’র রাজনৈতিক অঙ্গনের অনেকেই মত-মন্তব্য প্রকাশ করেছেন বিদেলা’র মৃত্যুতে। র‌্যাডিক্যাল সিভিক ইউনিয়নের ডেপুটি রিকারদো গিল লাভেদরা বলেছেন, মানুষ তাকে স্বৈরশাসক হিসেবেই মনে রাখবে। সানতা ফে প্রদেশের সাবেক গভর্নর হারমিস বিনার শোক প্রকাশ করেছেন বিদেলা’র শাসনকালে নিহত সকলের উদ্দেশ্যে। বুয়েনস এয়ারেস সিটি’র সংস্কৃতি মন্ত্রী হারনান লোমবারদি এক বিবৃতিতে বিদেলা’র বিচার ও তাকে দ- দেয়ার জন্য প্রশংসা করেছেন আরহেনতিনা’র গণতন্ত্রকে। সাবেক প্রেসিডেন্ট রাউল আলফনসিন-এর পুত্র, র‌্যাডিক্যাল সিভিক ইউনিয়নের নেতা রিকারদো আলফনসিন বলেছেন, কারাগারে মৃত্যু - এটাই ঠিক হয়েছে বিদেলা’র জন্য। মন্ত্রীপরিষদের প্রধান হুয়ান মানুয়েল আবাল মেদিনা সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, আরহেনতিনা’র জনগণ কর্তৃক ধিকৃত বিদেলা’র মৃত্যু হয়েছে ন্যায়বিচারে সাজা পেয়ে একটি সাধারণ কারাকক্ষে। এটাই হয়েছে উচিত কাজ। ১৯৮০ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী  আদলফো পেরেজ এসকুইভেল বলেছেন, বিদেলা’র মৃত্যুতে হাসি-আনন্দ করা উচিত নয় কারও। আরও ন্যায়পরায়ণ, আরও মানবিকতাপূর্ণ এক উন্নততর সমাজ গড়ে তোলার কাজ করে যেতে হবে আমাদের - যাতে ক্ষমতাসীন হয়ে অমন বিভীষিকা সৃষ্টি করতে না পারে আর কোনও স্বৈরাচার।
এসকুইভেল ঠিকই বলেছেন। আমাদের অভিজ্ঞতাও তা-ই বলে। স্বৈরাচারী গোখরো ফোঁস-ফোঁস করে ছোবল দেয় - দংশে অনেক, তারপর একদিন জনগণ যখন সাপুড়ে হয়ে বাজিয়ে দেয় বাঁশি, তখন ঢোঁড়া হয়েই মরতে হয় তাকে। নির্জন কারাপ্রকোষ্ঠে একজন সাধারণ কয়েদির মতো মরে গিয়ে এ সত্যটাই আরও অনেক স্বৈরাচারের মতো প্রমাণ করে গেলেন এককালের প্রবল পরাক্রান্ত একনায়ক বিদেলা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন