বৃহস্পতিবার, ৩০ আগস্ট, ২০১২

উদ্ভট পেঁচার ব্যঙ্গ

আলোকিত মানুষ গড়ে তোলার আন্দোলনের জন্য দেশে-দেশে নন্দিত  এক নাম - আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। শিক্ষক হিসেবেও সকল মহলে একই রকম বন্দিত তিনি। তাঁর নামের আগে তাই ‘অধ্যাপক’ লেখা হয় যথেষ্ট সম্মান ও শ্রদ্ধার সঙ্গে । তবে আমার মতো অনেকের কাছে  তিনি বিশেষভাবে পরিচিত কবি, কথাসহিত্যিক, সম্পাদক হিসেবে। অনুবাদ, নাটক প্রভৃতিতেও এক সময় প্রবল উৎসাহ দেখেছি তাঁর। শিক্ষা ও সাহিত্যচর্চা ছাড়াও টিভি ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁর যে সর্বজনমান্য অবস্থান তা তো এখনই পেয়েছে কিংবদন্তির মর্যাদা। তাঁর পরিচয় আমি প্রথম পাই ষাটের দশকের প্রথম দিকে, ওই সময়ের আলোচিত কবিতাপত্র ‘স্বাক্ষর’-এ প্রকাশিত একটি কবিতার সূত্রে। কবিতাটি তিনি লিখেছিলেন এক জ্ঞানপাপী সম্পর্কে। সে শেঙপিয়ার, মিলটন, ইউরোপের সাহিত্য, দর্শন, রেনেসাঁ সম্পর্কে পড়েছে... কিন্তু সে সব পড়া একটুও আলোকিত করতে পারে নি তাকে, কাজে-কর্মে চিন্তাচেতনায় সে থেকে গেছে চরম কুক্রিয়াশীল। যদ্দূর মনে পড়ে কবিতাটির শুরু ‘লোকটি শেঙপিয়ার পড়েছিল...’ আর শেষ ‘এক উদ্ভট পেঁচা ব্যঙ্গ করে গেছে তাকে’। তখন ধারণা করেছিলাম, পরে শুনেছিও, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কবিতাটি লিখেছিলেন ওই সময়কার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনকে লক্ষ্য করে। তিনি পণ্ডিত ছিলেন, একই সঙ্গে ছিলেন প্রতিক্রিয়ার প্রতিমূর্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠার প্রতিভূ, জাতীয়তাবোধ ও বাংলা-বাঙালি চেতনার বৈরী। বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়ুবি-মোনেমি ভাবাদর্শ ও পরিকল্পনার ধারক, বাহক ও বাস্তবায়ক। আমার নামের বানান পরিবর্তনের অন্যতম কারণ তিনি। অথচ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন (১৯২০-১৯৯৫)-এর একাডেমিক কৃতিত্ব ছিল অনেক। ১৯৪২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইংরেজিতে এম এ পাশ করেন প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে। ১৯৫২ সালে ইংল্যান্ডের নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি পান ইংরেজ কবি-কথাসাহিত্যিক জোসেফ রাডিয়ার্ড কিপলিং (১৮৬৫-১৯৩৬)-এর সাহিত্য ও তাঁর রচনায় প্রকাশিত ভারতীয় উপমহাদেশের জীবনধারা সম্পর্কে গবেষণা করে। ইংল্যান্ডের কোনও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপমহাদেশের কোন মুসলমান গবেষকের সেই প্রথম পিএইচডি অর্জন।
    মনে পড়ে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অনেকেই ছিলেন আমাদের সমালোচনার প্রধান লক্ষ্য। ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন ছাড়াও ইতিহাস বিভাগের ড. মুহম্মদ মোহর আলী (১৯৩২-২০০৭), রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ড. হাসান জামান প্রমুখের কার্যকলাপের সমালোচনায় মুখর থাকতো আমাদের আড্ডাগুলো। মোহর আলীর পাণ্ডিত্য ছিল সুবিদিত। বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস বিষয়ে তিনি ছিলেন বিশারদ। ১৯৬৩ সালে পিএইচডি করেছেন ইউনিভারসিটি অভ লন্ডনের স্কুল অভ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ থেকে। পরের বছর আইন পড়েছেন লিঙ্কনস্‌ ইন-এ। মধুর ক্যানটিন, শরিফ মিঞার ক্যানটিন, টিএসসি’র লন বা ক্যানটিন, নিউ মার্কেটের মোনিকো, বাংলাবাজারের বিউটি বোর্ডিং, নবাবপুরের ঢাকা হোটেল, গুলিস্তানের রেঙ - যেখানেই আড্ডা ছিল আমাদের ঘুরেফিরে আসতো তাঁদের ক’জনের নাম। তখন স্বায়ত্তশাসনের দাবি পরিণত হচ্ছে স্বাধিকারের আন্দোলনে, তারপর তা রূপ নেয় স্বাধীনতার সংগ্রামে।
    মনে পড়ে সেই আড্ডার মুখগুলোকে। মুখে-মুখে তখন সুকান্ত, সুভাষ, নজরুল, জীবনানন্দ, রবীন্দ্রনাথ। উৎপল দত্ত, সলিল চৌধুরী, মুলকরাজ আনন্দ, রাহুল সাংকৃত্যায়ন। খাজা আহমদ আব্বাস, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, নাজিম হিকমেত। পুশকিন, গোগোল, তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, চেখভ, গোর্কি, শলোকভ। লু সুন, কুয়ো মোরো, লাও শে, মাও তুন, পা চিন। হাতে-হাতে অধ্যাপক নীহারকুমার সরকারের ‘ছোটদের অর্থনীতি’, ‘ছোটদের রাজনীতি’; ড. দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘যে গল্পের শেষ নেই’, ‘নিষিদ্ধ কথা আর নিষিদ্ধ দেশ’, ‘লোকায়ত দর্শন’; নরহরি কবিরাজের ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙ্গালী’; রেবতীমোহন বর্মণের ‘ভারতের কৃষকের সংগ্রাম ও আন্দোলন’, ‘সমাজ সভ্যতার ক্রমবিকাশ’; রণেশ দাশগুপ্তের ‘উপন্যাসের শিল্পরূপ’; শহীদুল্লা কায়সারের ‘রাজবন্দীর রোজনামচা’; শহীদ সাবেরের ‘এক টুকরো মেঘ’; সত্যেন সেনের ‘মহাবিদ্রোহের কাহিনী’; ‘সোভিয়েত লিটারেচার’; ‘চাইনিজ লিটারেচার’; লিউ শাওছি’র ‘ভাল কমিউনিস্ট হওয়ার উপায়’; হো চি মিন-এর ‘কারাগার কাব্য’; ফ্রানৎস ফানোন-এর ‘দ্য রেচেড অভ দ্য আর্থ’; ক্রিসটোফার কডওয়েল-এর ‘ইলিউশন অ্যান্ড রিয়ালিটি’, জন রিড- এর 'দুনিয়া কাঁপানো ১০ দিন ' ... আরও কত বই। আর কত তর্ক মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন, ট্রটস্কি, মাও, মানবেন্দ্রনাথ... কত জনকে নিয়ে।
    আড্ডার কেউ থেকে গেলাম সাহিত্যে। কেউ গেলেন রাজনীতিতে। হারিয়ে গেলেন অনেকে। আবার অনেকে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেছেন শীর্ষ বলয়ে। দিনের পর দিন যাঁদের সঙ্গে আড্ডা জমিয়েছি, তর্ক করেছি, হাসি-আনন্দে মেতেছি তাদের অনেককেই হতে দেখেছি ও দেখছি মন্ত্রী-এমপি, জবরদস্ত আমলা এবং জব্বর ধনী ব্যবসায়ী। দেখছি তাদের নেতা-নেত্রী এখন কারা,  আর তারা কাজকর্ম কি করছেন! উদ্ভট পেঁচা ব্যঙ্গ করে গেছে তাদেরও!

sazzadqadir@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন