রবিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৩

মানুষ নয়, বধযোগ্য

পৃথিবীর বহু দেশে যুদ্ধ ও সহিংসতায় নিত্য ঘটছে মানবিক বিপর্যয়ের নানা বেদনাদায়ক ঘটনা। আমাদের দেশে, এ অঞ্চলেও দেখা দিচ্ছে অনেক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি। গত বছর প্রতিবেশী মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গারা শিকার হয় জাতিগত নিপীড়নের। ওই দেশের গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত থাকায় বাইরের জগতে সামান্যই এসেছে হত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের খবর। তারপর যেটুকু তথ্য ও দৃশ্য দেশী-বিদেশী মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে তা রীতিমতো গা শিউরানো ভয়াবহতায় বীভৎস। ওই সময় শ’ শ’ রোহিঙ্গা নরনারী শিশু প্রাণভয়ে পালিয়েছে ভিটামাটি ছেড়ে। ট্রলারে, নৌকায় চেপে ভেসে পড়েছে অজানার উদ্দেশ্যে। তাদের অনেকেরই সলিল সমাধি ঘটেছে সাগরের বুকে, অনেকে আশ্রয় নিতে ছুটে গেছে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভারতে। অনেকে এসেছে আমাদের দেশে। কিন্তু আগে থেকেই রোহিঙ্গা শরণার্থীতে প্রপীড়িত আমরা, তাই নতুন করে শরণার্থী গ্রহণে অনিচ্ছা দেখিয়েছে সরকার। এ অবস্থায় এক ভয়াবহ মানবিক ট্র্যাজেডি আমরা দেখতে পাই দেশের উপকূল অঞ্চলে। অসহায় আশ্রয়প্রার্থীদের তাড়িয়ে দেয়ার সে দৃশ্য নাড়া দিয়েছে বিশ্ববিবেককে। তাই জাতিসংঘ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা অনুরোধ জানিয়েছে বিতাড়ন বন্ধ করে মানবিক সাহায্য দেয়ার। কিন্তু সরকার অনড়। আরও অনড় সরকার-সমর্থকরা। তারা ওই সময় শুরু করে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা-অভিযান। বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গারা কত বিপজ্জনক, কত সমস্যার কারণ তা শতমুখে প্রচার করতে থাকে তারা। তাদের কথায় রোহিঙ্গারা একটি অপরাধী সমপ্রদায়। তারা অস্ত্র, মাদক, নারী ব্যবসা সহ যাবতীয় দুষ্কর্মে জড়িত। দেশের মুসলমানকে তারা ধ্বংস করছে। বাংলাদেশী সেজে বিদেশে গিয়ে তারা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করছে। সেখানে তারা সব ধরনের জঘন্য কুকর্মে লিপ্ত। এছাড়া রোহিঙ্গাদের জামায়াত-শিবির সমর্থক হিসেবেও প্রচার চালানো হয়। ফলে যারা বলতে গিয়েছেন- ওরাও মানুষ, ওদেরও বাঁচার অধিকার আছে- তাদের জঘন্য কটু ভাষায় গালমন্দ করা হয়েছে। ‘রাজাকার’ চিহ্নিত করা হয়েছে। তখন নজরুলের মতো “অসহায় জাতি মারছে ডুবিয়া সন্তান মোর মা’র” বলার মতো দৃপ্ত মানুষ দেখেছি খুবই কম। এরপর একই রকম ভয়াবহ মানবিক ট্র্যাজেডি ঘটে আসামের কোকড়াঝাড়-এ। সেখানকার বোড়োদের হায়নার শিকার হয় বাংলাভাষী মুসলমানেরা। তাদের বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী অভিহিত করে চলে নিধনযজ্ঞ। সেই সঙ্গে লুট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ। এ সময় প্রায় সকলেই ছিলেন নীরব। গণমাধ্যমে সে রক্তপাতময় দাঙ্গা ও প্রাণহানির খবর যেমন ছিল না। ভারতের ‘আউটলুক’ পত্রিকা গুরুত্ব দিয়ে কিছু সচিত্র প্রতিবেদন ছেপেছিল- এছাড়া আর কোন পত্রিকায় সেভাবে স্থান পায়নি এই মানবিক বিপর্যয়ের খবর। তখনও দেখা গেছে মহল বিশেষকে কোকড়াঝাড়ের খবর চেপে রাখার জন্য বিশেষভাবে তৎপর। কিছুদিন আগে আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধ সমপ্রদায়ের মঠ-ঘরবাড়ি এবং সমপ্রতি হিন্দু সমপ্রদায়ের মন্দির-ঘরবাড়ি শিকার হয়েছে হামলার। অগ্নিসংযোগ করে ধ্বংস করা হয়েছে বহু নিরীহ নিরপরাধ পরিবারের আশ্রয়স্থল। এখনও দেখছি কিছু মানুষ ভাল চোখে দেখছে যা এসব ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ। তাদের ভেতরে ভেতরে যেন চাপা উল্লাস। ‘উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল’ কাকে না বিচলিত করে? দেখছি, সবাইকে করে না। রোহিঙ্গা, বাংলাভাষী অসমিয়া, বাঙালি বৌদ্ধ-হিন্দু তবে কি কারও-কারও চোখে আক্রমণযোগ্য? বধযোগ্য? সামপ্রতিক সরকারবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিবর্ষণে হতাহত হয়েছে বহু মানুষ। এভাবে হত্যা কি সমর্থনযোগ্য? কিন্তু এর প্রতিবাদ করা অনেকের কাছে অপরাধতুল্য। নাস্তিক মুরতাদ বা মৌলবাদী এখন বধযোগ্য হয়ে উঠছে কোন কোন পক্ষের কাছে। এ অবস্থায় মনে পড়ে, হিটলারও ইহুদিদের মানুষ মনে করতেন না। ভাবতেন, তাদের হত্যা করলে কিছু আসে যায় না। আমরা কি সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিশাপে আক্রান্ত হয়েছি? কিন্তু এসব প্রশ্ন তোলাই তো বিপজ্জনক। বললেই শুনতে হবে সেই অমোঘ গালি।
sazzadqadir@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন