শনিবার, ৯ মার্চ, ২০১৩

মনের মাধুরী মিশিয়ে

‘তিনি চেনালে লেখক। তিনি চাইলে প্রচার। তিনি দিলেই প্রাইজ’। অর্থাৎ আপনার কাজকর্মের স্বীকৃতি, প্রসার, সম্মাননা - সব নির্ভর করে তার ওপর। তিনি ইচ্ছা করলে আপনি উঠবেন উপরে, নিত্য ঝলমল করবেন খবরে, ঘটনায়, যাবতীয় অনুষ্ঠানে আয়োজনে, পাবেন পদ পদক পুরস্কার পারিতোষিক- দেশ-বিদেশে পাবেন সম্মান সংবর্ধনা। না হলে থাকতে হবে যে আঁধারে সে আঁধারেই। আপনি যত জ্ঞানী গুণী বিজ্ঞ বিশারদ যা-ই হোন কেন- তিনি না চাইলে আপনার সমাদর হবে না, মূল্যায়ন প্রতিষ্ঠা কিছুই হবে না। উদ্ধৃত কবিতাংশ কবি মতি মুখোপাধ্যায়ের। কবিতাটির নাম ‘মিডিয়া’। আশা করি বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে পাঠকদের কাছে, আর খোলাসা করে কিছু বলতে হবে না আপনাদের। এই গোষ্ঠী প্রীতি, দলবাজি, গ্রুপিং নতুন কিছু নয় এ দেশে। আগে সরকারি মিডিয়াতেই ছিল এ ব্যাপারগুলো। সেখানে অলিখিত অঘোষিত কালো তালিকা থাকে। বরাবরই থাকে, এখনও আছে। কিন্তু এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে বেসরকারি মিডিয়াতেও। আর সে ছড়িয়ে পড়া যেন সরকারি মিডিয়ার চেয়েও বেশি। কারণ প্রচার প্রসার প্রভাব এখন তাদেরই বেশি। এ ক্ষমতা তার উত্তরোত্তর বেড়েছে ৯০-পরবর্তী ‘গণতান্ত্রিক’ যুগ শুরু হওয়ার পর থেকে।
তবে পর্বতের চূড়ায় আরোহণের পর সেখানে বেশি ক্ষণ থাকা যায় না, আবার নেমে আসতে হয়। কারণ জায়গাটি ছোট। আমাদের মিডিয়াও ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণের পর এবার বুঝি নিচে নামার পর্ব শুরু হয়েছে। তার সামপ্রতিক ভূমিকায় এমন আশঙ্কাই দেখা দিয়েছে। দেশ এখন চরম সন্ধিক্ষণে। অস্থির উত্তেজনা ক্রমে ক্রমে গ্রাস করেছে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত। দ্বন্দ্ব সংঘাত সহিংসতা সর্বত্র। রাজনৈতিক বিবাদ বিরোধ ক্রমে ছড়িয়ে পড়েছে পাড়ায় পাড়ায় ঘরে ঘরে। মৃত্যু উপত্যকা হয়ে উঠেছে দেশ। ক্ষমতার লড়াইয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিযোগী পক্ষগুলো। এক পক্ষের মানুষের রক্ত ঝরছে, অন্য পক্ষে চলছে আনন্দ উল্লাস। যেন যে আমার পক্ষে নয় তাকে বধ করা চলে। সে যেন মানুষ নয়, তাই তাকে মেরে ফেললে কিছু হয় না। সেই কবে থেকে চলে আসা ‘মুর্দাবাদ’, ‘নিপাত যাক’, ‘খতম করো’ ইত্যাদি স্লোগান যেন মূর্তিমান রূপ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে জীবনের ওপর। এ মৃত্যুর জন্য দুঃখও করা যাবে না, মানবতার পক্ষেও কথা বলা যাবে না- তাহলেও আপনাকে চিহ্নিত করা হবে কোন পক্ষের লোক হিসেবে। তারপর আপনাকে চিহ্নিত করা হবে বিশেষ নামে, আপনার ওপর লাগিয়ে দেয়া হবে বিশেষ তকমা। এ এক অভাবনীয় পরিস্থিতি। যেন পালটে গেছে মানবতার সংজ্ঞা, দেশপ্রেমের অর্থ। মানুষ যেন মানুষ নয়, পক্ষ মাত্র। বিশেষ পরিচয় মাত্র। এমন এক জটিল মানবিক ও জাতীয় বিপর্যয়কালীন পরিস্থিতিতে কি ভূমিকা হবে মিডিয়ার? যুদ্ধবাজ দুই পক্ষের একটি বেছে নেয়া না সাধারণ মানুষের পক্ষ হয়ে পরিস্থিতির ভেতর বাইর সামগ্রিক দিক নিরপেক্ষ নৈর্ব্যক্তিক ভাবে তুলে ধরা? দুঃখের বিষয়, গভীর হতাশার বিষয়, আমাদের প্রতাপশালী প্রভাবশালী মিডিয়া ঝুঁকে পড়েছে পক্ষপাতের পাঁকে। নিরপেক্ষ নৈর্ব্যক্তিক খবরের আদর্শ ভুলে নিজেও হয়ে উঠেছে যুযুধান। পত্রিকায় মতামত প্রকাশের জন্য সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, কলাম, মন্তব্য প্রতিবেদন অনেক বিভাগ রয়েছে, টিভি চ্যানেলগুলোতে রয়েছে টক শো, সাক্ষাৎকার প্রভৃতি। কিন্তু এখন কি হচ্ছে? একজন প্রবীণ সাংবাদিক লিখেছেন, ‘আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো এবং সংবাদপত্রে রিপোর্টার মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করছেন।’ মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতার গিন্নির কথা- যা কিছু হারায়, গিন্নি বলেন, ‘কেষ্টা বেটাই চোর।’ আমাদের চারপাশে এখন সেই মুখরা গিন্নি।
sazzadqadir@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন