মঙ্গলবার, ১ জানুয়ারী, ২০১৩

ও ছিল উচ্ছল প্রাণময়

ও ছিল উচ্ছল প্রাণময়। মাত্র বিকশিত হতে শুরু করেছিল ওর জীবন। জেগেছিল স্বপ্ন হয়ে ফুটে ওঠার কুঁড়ি। পড়া লেখা আর দেখা শোনা নিয়ে আবর্তিত ছিল দিন ও রাতের সময়। বয়স মাত্র তেইশ। ছিল একজন তরুণী ছাত্রী। তার ভুল ছিল রাতের বেলায় একটি ভুল বাসে উঠে পড়া। অন্তত কয়েকজন বলেছিল সে কথাটাই। আর বড় ভুল তো একটাই- ও একটি মেয়ে। ভুল নয় অপরাধ। রীতিমতো ঘোরতর অপরাধ। তাই একের পর এক ছ’জন পালাক্রমে ধর্ষণ করে তাকে। শিকারের ওপর শিয়াল-কুকুরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে খাবলে কামড়ে ছিন্নভিন্ন করে তার অসহায় শরীরটাকে। তাতেও মেটে নি সেই নরপিশাচদের ক্ষুধা। আক্রোশ। লালসা। তারা একটি লোহার রড ঢুকিয়ে দেয় তার যৌনাঙ্গে। ক্ষতবিক্ষত করে তার গোপন প্রত্যঙ্গ। তখন পেটের ভিতর থেকে ছিঁড়েখুঁড়ে বেরিয়ে আসে তার ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদান্ত্র। সেই পুরুষ নামের পিশাচদের তৃপ্তি আসেনি বোধ হয় তখনও, তাই ওকে তারা ছুড়ে ফেলে দেয় রাস্তায়। যাতে ধুঁকে-ধুঁকে কাতরাতে-কাতরাতে ও মরে যায় কুকুর-বিড়ালের  মতো।
তারপর রাস্তার পাশে ও পড়ে থাকে একা। নগ্ন। ক্ষতবিক্ষত। উদোম। বিধ্বস্ত। ওই পথ দিয়ে যায় অনেকে, কিন্তু  কেউ একটু ফিরেও তাকায় না ওর দিকে। কনকনে শীতে কুঁকড়ে যাওয়া ওর উলঙ্গ শরীরের দিকে এক ফালি কাপড়ও ছুড়ে দেয় না কেউ। হায় হতভাগা মেয়ে! সুস্থ স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন- না, তার জন্য আর ছিল না কোনভাবে। সেই অভিশপ্ত ১৬ই ডিসেম্বর রাতের পর পাঁচ-পাঁচবার জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পৌঁছে যায় ও। তখন কোন চেতনা ছিল না ওর। বোধশক্তি ছিল না। অন্ধকার গ্রাস করেছিল ওকে। আশঙ্কায় কম্পিত ছিল শেষ নিঃশ্বাসটুকু। কেবল কান্নাটি থামেনি কখনও। অবিরল কান্নায় সিক্ত হয়েছে ও।
কিন্তু তাতে আমাদের কি? ও তো আমার বোন নয়। আমার কন্যা নয়। কিন্তু হতে পারতো। আমার, তোমার, আরও অনেকের বোন, কন্যা। সে তো কেবল দিল্লি’র একটি মেয়ে নয়, সে সকল দেশের মেয়ে- সকলের মেয়ে।
এখন একটিই চিৎকার বাকি আছে আমাদের। সকলের সোচ্চার কণ্ঠে বলতে হবে- এই নৃশংসতা বন্ধ হোক। ওই পাষণ্ডদের দাও চরমতম শাস্তি। দৃষ্টান্তমূলক দণ্ড। জঘন্য কুকর্মের হোতা দুর্বৃত্তদের বিচার করো নিষ্করণ কঠোরতার সঙ্গে।
আর কোন কথা নেই আমাদের। কাতর স্বরে, রুদ্ধ কন্ঠে বলি- দিল্লির সেই তরুণী আর নেই। শনিবার ২৮শে ডিসেম্বর নীরবে ও চিরবিদায় নিয়েছে এই বর্বর-অধ্যুষিত সমাজ-সংস্কারের বিভীষিকা থেকে।
কামনা করবো- শান্তি পাক ওর আত্মা? না, প্রার্থনা করবো ওর খুনিদের হোক সম্ভাব্য চরমতম শাস্তি। সে শাস্তিকে করে তুলতে হবে সর্বকালীন, বিশ্বজনীন। এ বীভৎসতা শুধু দিল্লি নয়, দেশ-বিদেশের সকল শহরে গ্রামে ঘটে চলেছে প্রতিকারহীনভাবে। ওই নিষ্ঠুর অন্যায়ের প্রতিকার চাই। নারীর প্রতি সব ধরনের ক্রুর সহিংসতার প্রতিকার চাই। না হলে এ পৃথিবী কি বাসযোগ্য থাকবে আর?
কি নাম মেয়েটির? আমানত, দামিনী, উদয়া- যা-ই হোক। ও কি আর নেই আমাদের মাঝে? না, ও আছে। থাকবে। ওকে আমরা দেখছি। দেখবো।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন